You are currently viewing হেলিকপ্টার ও সোনার তলোয়ার: খালেদ হামিদী

হেলিকপ্টার ও সোনার তলোয়ার: খালেদ হামিদী

হেলিকপ্টার ও সোনার তলোয়ার

খালেদ হামিদী

কিস্তি: সাত

 

১৩

এখনো নিঃসন্তান থাকায় নওরীন চিঠিতে ওর মাকে অভয় দেয়, আগামী বছর নাতিপুতির মুখ দেখাবে বলে। সদ্য কনসিভ করায় ফরহাদকে কর্মদিবসে অকারণেও ফোন কল দেয় নওরীন। ফরহাদও সাপ্তাহিক ছুটির দিনটি অ্যাপার্টমেন্টেই কাটায়। অন্য একদিন ডাইনিং রুমের কার্টেন ঈষৎ সরিয়ে নওরীনকে কাছে ডাকে ফরহাদ। ওপাশের দশ তলা দালানের ছাদে স্থানীয় তরুণ-তরুণীর এক যুগলকে পরস্পর চুম্বনরত দেখা যায়। পশ্চিমা সমাজের মতো এখানে প্রকাশ্যে চুম্বনের অনুমোদন না থাকায় সেই দৃশ্যে নওরীন চমকে উঠলেও, সেদিনের পর থেকে, সে দিনে অন্তত একবার ওই জুটিকে খোঁজে। কিন্তু এক বিকেলে ওই ছাদেই, মেয়েটির বুকে ছেলেটিকে হাত রাখতে দেখেই পিছু হটে সে। সামনে চলে আসে অজ্ঞাতনামা সেই প্রথম খদ্দের, প্রচন্ড রেগে যে ওকে বলে: ‘ধরতে না দিলে কাইট্যালামু। মাগনা আহি নাই। সর্দারনিরে টেকা দিয়া আইছি।’

নওরীন মাস সাতেক যাবৎ নিজেকে মৃত বলে টের পায় সেই পাড়ায়। সেদিন মেকআপ নেয়ার পর রিফাত তাকে মৃত্যুপুরীর তোরণে, ঠোঁট থেকে পানের পিক গলে-পড়া সর্দারনির সামনে এনে দাঁড় করায়। প্রতিদিন দুপুর দু’টা থেকে রাত দশটা পর্যন্ত সেখানে থাকতে হয় নওরীনকে। তাকে এই পল্লীতে আনা-নেয়ার দায়িত্বে থাকে স্বয়ং রিফাতই। তবে প্রতিবারই পল্লীর অদূরের এক বাস স্টপেজ থেকে খানিকটা হাঁটতে হয় নওরীনকে। গমনাগমনের ওই পথের ধারে নিয়োজিত থাকে এক পর্যবেক্ষকও।

নওরীন এখনো অবাক হয় কিভাবে ওর মা-বাবাকে ওরই খবর জানায় ওই পল্লীরই এক নিয়মিত কাস্টোমার মোরশেদ। এর আগে পাড়াতুত এই ভাইকে সেখানে দেখে নওরীন বিস্ময় মানলেও কোনো কথা বলারই সুযোগ মেলে না। মোরশেদও কাছ ঘেঁষে না। পরে রিফাতকে ধরিয়ে দিয়ে স্বয়ং পিতা পুলিশ নিয়ে কন্যাকে উদ্ধারে ওই পল্লীতে হাজির হলে নবজন্ম লাভ করে নওরীন। তারপরের দু’বছরে যথাক্রমে গোপনে জন্মস্থান ছেড়ে সপরিবার ওর ঢাকায় মাইগ্রেশন, ফরহাদের সঙ্গে বিয়ে এবং এই আরব জাহানে আসা।

আরেক শুক্রবারে সেই ছাদের দৃশ্য দেখতে ফরহাদ হঠাৎ ডাক দিলে নওরীন নির্ভয়ে এগিয়ে যায়। তাকে বাহুডোরে বেঁধে নিজের বয়স অনেক কমিয়ে আনে ফরহাদ আর বলে: দে আর মেকিং লাভ স্ট্যান্ডিং আপ অন দ্য রুফ টপ। লুক, লুক! বোথ অফ দেম আর নট ফলিং ডাউন! দে আর স্টিল ইন দ্য আপরাইট পজিশন এট দীস এক্সট্রিম মোমেন্টস্!! হাও ওয়ান্ডারফুল, ডার্লিং!! লাইফ ইজ রিয়েলি বিউটিফুল!!!

 

১৪

গামলার পানিতে ন্যাকড়া ডুবিয়ে মেঝে মোছার সময় হঠাৎ থমকে যায় নাসিমা। সামনে চলে আসে মিশরের এক টিভি সিরিয়ালের দৃশ্য। বার্জ খলিফা থেকে আধা কিলোমিটার দূরে জুমাইরায়, আবে জাবেলির বাড়ির ফ্লোরে, একদিন দাঁড়িয়ে মপ চালনার মুহূর্তে ওই নাটকে ব্যাপারটা ঘটে। বাড়ির কর্ত্রী রেগে-মেগে কাজের মেয়েটির মপ কেড়ে নেয় এবং লাথি মেরে ফেলে দেয় বালতির নোংরা পানি। কিন্তু আজকাল নিজের দেশেই মাঝে মাঝে আঁৎকে ওঠে নাসিমা। বহর্দার হাটের এক কিলোমিটার এলাকার এই বাসায় প্রায় সাত মাস ধরে কাজ করলেও বিধবা কর্ত্রীর সন্তোষ লাভের চেষ্টা তার এখনো কমেনি। ভদ্র মহিলার কলেজ-পড়–য়া কন্যা লুনাও নাসিমার উপস্থিতিতে স্বস্তি বোধ করে না। কিন্তু চাকুরে পুত্র ইফাতকে অনেকটা নির্বিকার দেখায়। নাসিমার বিরুদ্ধে অভিযোগ অপরিচ্ছন্নতার। ওর ধোয়া-মোছা প্রায়ই অসম্পূর্ণ ঠেকে। কর্ত্রীকে খালামণি ডেকেও নিস্তার পায় না নাসিমা। ইফাতের মা জয়নাব বেগমকে খুবই খুঁঁতখুঁতেই মনে হয় ওর। খোকনের কলেজ পর্বে তিনি ছিলেন প্রাণী বিদ্যা বিভাগের প্রধান। নিজের বাড়িতে একবার রেগে গেলে তিনি বকাঝকাও করেন অনর্গল। কখনো মারমুখোও হয়ে ওঠেন প্রায়। নাসিমা তখন চুপি চুপি দোয়া কুনুত পড়ে। একবার সে কৈফিয়ৎ দিতে গিয়ে জাবেলির বাড়িতে ব্যবহৃত ডিশ ওয়াশার, ওয়াশিং মেশিন, মপ, ভেকুয়াম ক্লিনার ইত্যাদির কথা তোলে। হাতে-কলমে কাজ করার অভিজ্ঞতা না থাকার দোহাই দেয়। এতে ক্ষুব্ধ জয়নাব বলেন:

নিজেরে দুবাইওয়ালি মনে কর? তাইলে বুয়ার কাম করতে আইছ ক্যান?

নাসিমা কিছু না লুকিয়ে উত্তর দেয় আর মিনতি করে:

কি করুম, দুনিয়াতে কেউ নাই আমার। কোথায় যামু! হাতের সব কাজ আস্তে আস্তে শিখ্যা লমু। আমারে তাড়াইয়া দিয়েন না।

জয়নাব প্রশ্ন হাঁকেন:

ক্যান, দুবাইয়ের ওই বাড়িঅলা কি তোমারে খেদাইয়া দিছিল?

না, না, খালা। আমি নিজেই পলাইয়া আইছি।

নাসিমা এতোটুকু বলতেই খালা ওকে কাজের তাড়া দিয়ে, দুপুর বারোটার দিকেই, নিজের বেড রুমে এলিয়ে পড়েন। ঘণ্টা খানেক পরেই চমকে ওঠেন তিনি আর ঘুমের ঘোরে অনেকটা দৌড়ে গিয়ে নাসিমাকে জিগ্যেস করে বসেন:

তুমি আমার সুরভিরে দেখছো? সে বিদেশে খুব কষ্টে আছে! কাইন্দা আমারে ডাকলো এখন!

লুনা এসে ওর মাকে থামিয়ে দিলে সুরভির বৃত্তান্ত আর জানা হয় না নাসিমার।

তবে জয়নাব বেগম ধীরে ধীরে নাসিমার প্রতি সদয় হতে শুরু করেন। হারানো সন্তানকে স্বপ্নের মধ্যে, দূর দেশে ক্রন্দনরত দেখার পর থেকে, তিনি মিতবাকও হয়ে ওঠেন অনেকটা। তাঁর ব্যক্তিত্বে যুক্ত হয় নতুন গাম্ভীর্য। ফলে নাসিমার সঙ্গে ওনার দূরত্ব বরং আরেকটু বাড়ে। তবে পঞ্চাশোর্ধ্ব বয়সের কর্ত্রী আর একুশ বছরের তরুণী গৃহপরিচারিকার মধ্যে সশব্দ অস্বস্তির স্থলে নেমে আসে অনেকটা নিরবতার শান্তি। যদিও, লুনার সাথেও সহজ হতে না পারার কষ্ট নাসিমার থেকেই যায়। খালার বিছানার পাশে মেঝেয় রাতে ঘুমিয়েও বাসার কারোরই আপন হয়ে উঠতে পারে না সে। আর এই কষ্ট জুড়ে কখনো ঝাঁপিয়ে পড়ে নাসিমার প্রবাসের স্মৃতি। দ্বিতীয় মাসের এগারো তারিখে প্রথম মাসের বেতন চাইলে তার মাথায় ঠাডার পড়ে। জাবেলির স্ত্রী উমাইয়া তাঁরই মাতৃভাষায় বলেন:

কিসের বেতন? তোমাকে তো আমরা কিনে এনেছি।

ভালো আরবি শিখে ওঠার সুযোগ তখন না মেলায় সে আর কিছু বলতে পারে না। দ্রুত তারই জন্যে বরাদ্দ রুমটায় ঢুকে নাসিমা সরু সিঙ্গেল খাটে বসে পড়ে, আকস্মিক প্রবল আঘাতে গুরুতর আহতের ধরনে। এরপর থেকে ওর পানাহার কমে আসে। প্রায় এক মাস নির্ঘুম অতিবাহিত হয়। রিয়াদের লোক জাবেলি জুমাইরার উমাইয়াকে বিয়ে করে স্বনির্মিত দেয়াল-ঘেরা, বাগান-বেষ্টিত এই বিশাল এক তলা দালানে থিতু হন। ব্যবসা-বাণিজ্যও তাঁর জুমাইরাতেই। কিন্তু রিয়াদে তাঁরই তিন বিবি থাকায় মাসে অন্তত একবার, এক সপ্তাহের জন্যে হলেও, দেশের বাড়ি যান জাবেলি। তাছাড়া লোকটা ইফাতের মতোই, নাসিমার দিকে ফিরেও তাকান না।

এক শুক্রবার সকালে, জাবেলির দুটি গাড়ির একটির ভারতীয় চালকের বন্ধুকে, যে কি না একটি কোম্পানির বাংলাদেশী হার্ড ড্রাইভার, জাবেলিরই বাড়িতে ডেকে আনা হয়। নাসিমার অস্পষ্ট বক্তব্য বুঝে নিতে সদয় গৃহকর্তারই এই উদ্যোগ। কিন্তু দেশীয় এজেন্টের হাতে নাসিমার প্রতারিত হবার বিষয়টি বিস্তারিত শুনেও জাবেলি বিগলিত হন না মোটেও। উপরন্তু ক্রুদ্ধ হয়ে ওঠেন দাসীর মুক্তি প্রার্থনায়। উপস্থিত দুই চালক পুরুষকেও বিস্মিত করে নিজ ভাষায় এই বলে গর্জে ওঠেন বাড়ির কর্তা:

আমি ক্রীতদাসীকে কিভাবে মুক্তি দেবো? তার দাম কি সে শোধ করতে পারবে? তাকে নিয়ে হাজার রাত শুলেও তো ওই টাকা উসুল হবে না!

এই হুংকারে, ত্রাসে ও লজ্জায়, নত মাথায়, নিরবে প্রস্থান করে উভয় চালকই। বাংলাভাষী ড্রাইভারকে ভাই জ্ঞান করেও কোনো ফল মেলে না নাসিমার। কর্তাকে বোঝানোর আকুল অনুরোধ অরণ্যে রোদনে পর্যাবসান মানে। এর আগে, সে তার ছোট্ট শোবার ঘরের দরজা আনলকড্ রেখেই ঘুমায় মাস তিনেক। কর্তার অন্য রূপের ইঙ্গিত মেলার পর থেকে নিজেকে সর্বত্রই লক করে রাখে নাসিমা। তবে উমাইয়া অনেকটা নির্দয় হলেও স্বামীর সম্ভাব্য কবল থেকে নাসিমার সুরক্ষায় সতর্ক হয়ে ওঠেন প্রায়। এভাবে দিন বিশেক কেটে গেলে এসে পড়ে রমজান মাস। উমাইয়া এবং তার একমাত্র কিশোরী সন্তান লাইলীর সাথে স্বপ্নিল শপিং সেন্টার আল আকারিয়ায়, প্রথমবারের মতো পা রাখার সুযোগ ঘটে নাসিমার। সিলিং থেকে গ্রাউন্ড ফ্লোর পর্যন্ত খোলা প্যারাবোলা আকৃতির স্পেস এবং এর চারদিকে, দশ তলা দালানের প্রত্যেক ফ্লোর জুড়ে, হরেক রঙিন দোকান। দশম তলার সিলিং থেকে নিচ তলার মেঝে পর্যন্ত স্থাপিত এক বড় গুচ্ছের তার বেয়ে অবিরাম পানি ঝরছে দেখে নিজের মধ্যে প্রথম প্রাণ ফিরে পায় নাসিমা। আচমকা ওর মাথায় একটা বুদ্ধিও খেলে গেলে সে ওয়াশ রুমে যাবার নাম করে ইন্ডিয়ান ড্রাইভারটার সাথে কথা বলার সুযোগ করে নেয়। এভাবে তার মাধ্যমে স্বদেশীয় গাড়িচালক দিলদারের সঙ্গে পরে অনেকবার, দুবাই ফেস্টিভাল সিটিসহ অন্য আরও একাধিক শপিং মলে, দেখা করে নাসিমা। দিলদার একবার বলে:

এইডা জাবেলির নিজের দেশ হইলে পালানোর কোনো উপায় আছিল না। আমি সেই দেশে তিন বছর আছিলাম। মাটির তলায় তেল পাওয়ার বছরেও, ওখানকার বাথা বাংলাবাজারের পুবদিকে মালাজ এলাকায়, দাস-দাসী কেনা-বেচা হইত বইলা হুনছি। হেগো দেশের গরিব বেদুইনদেরকেও দূরের মরুভূমি থিকা ধইরা আইন্যা অত্র এলাকায় বেইচ্যা দিত। জায়গাটাতে পুব থিকা দক্ষিণ দিক পর্যন্ত লম্বা, বাঁকা একটা টিলা আছে। সেই টিলার নিচে, বড় নিরালা জায়গায়, সুদান, ইথিওপিয়া আর ইরিথ্রিয়ার দাস-দাসী কেনা-বেচা হইত। বাথারই এক বুইরা আরইব্যা আমারে কইছিল। অবশ্য সেই দেশে আর এখানেও যে অমন আর হয় না তা কেমতে কই! আগে মানুষ কিনতে ভিসা লাগতো না। এখন পেলেইনে কইরা উড়াইয়া লইয়া আনে। আমি সেখানকার এয়ারপোর্টে এক আরইব্যা বেটারে দেখছি পেলেইন থিকা নামার পরে ইন্দোনেশিয়ার একটা মাইয়ার লগে হেন্ড শিপ (হ্যান্ড শেক অর্থে) করতাছে।

কিন্তু তার ফি বছর নবায়নযোগ্য পরিচয়পত্র ইকামার প্রথম বছর অতিক্রান্ত না হওয়া অব্দি নাসিমাকে অপেক্ষা করতে হয়। ইকামাসহ দেশ থেকে আরব আমিরাতের এই ঝলমলে নগরে আসার ভিসা এবং পাসপোর্ট জাবেলিই গচ্ছিত রাখে। কেবল বাড়ির বাইরে যাওয়ার সময়েই নাসিমা তার পরিচয়পত্রখানি নিজের সঙ্গে রাখার সুযোগ পায়। আইডি রিন্যুয়ালের কিছুদিন আগে লাইলী স্কুলে, উমাইয়া রোগশয্যায় আর জাবেলি রিয়াদে থাকার সময়, এক সকালে নাসিমা, ওই দুই চালকের সহায়তায়, সেই বাড়ি থেকে পালিয়ে যায়। পলায়নের পরবর্তী ঘটনাগুলো আর স্মরণ করতে চায়না সে। সেসব কথা মনে এলেই সে কাজকর্মে অপেক্ষাকৃত বেশি মনোযোগ ঢেলে দেয়।

কিছুটা স্মৃতি-খোয়ানো জয়নাব বেগমও হঠাৎ সহজ হতে শুরু করেন এই বলে:

তুমি কোন্ দেশে ছিলা? কেমতে পালাইলা?

প্রথম প্রশ্নের উত্তর শুরু করতেই প্রথমবারের মতো নাসিমা অঝোরে কেঁদে ফেলে। জয়নাবও তাকে কাঁদতে দেখে বিরক্ত হন না। অকল্পনীয়, ভয়াবহ প্রতারণার ঘটনা শুনে নাসিমার খালামণি বেদনা বোধ করেন শুধু নয়, সুরভিকে হারানোর অমোচনীয় দুঃখে নতুন মাত্রা যুক্ত হওয়ায় বেদনাহতও হন। কিন্তু নিজের সন্তান বিষয়ে মুখ না খুলে নাসিমার সেই আত্মোদ্ধারের কাহিনি শুনতেই বেশি তাড়া অনুভব করেন তিনি। তাই অনিচ্ছা সত্তে¡ও নাসিমা সংক্ষেপে শুধু এটুকু উল্লেখ করে:

দিলদার ভালা মানুষ। ওর এক ডাক্তার আত্মীয়ের বাসায় কিছুদিন আমার থাকার ব্যবস্থা করছিল। ডাক্তার সা’বের বউডাও খুব ভালা আছিল। আমার ইকামার মেয়াদ শেষ হওনের কয়েকদিন পর আমি দেইরা বাংলাবাজার এলাকার থানায় গিয়া একটা কাগজ জমা দেই। ডাক্তার সা’ব কাগজে সব কথা লেইখ্যা দিছিল। হেই দেশের একজনরে দিয়া নাকি আরবিতে লেখাইছিল। পুলিশেরা আমারে জেলখানায় নিয়া গেল। জেলখানায় তো আর এসি নাই। টিনের চালার পাকা ঘর। সেখানে মনে হয় দেড় মাস দোজখের আগুনে জ্বলছি। হ্যাষে একদিন চাইরটা পুলিশ আমারে হেগো গাড়ি কইরা এয়ারপোর্টে লইয়া যায়। আর কয় : ‘ইনতি রোহ দাক্কা। মালুম? দাক্কা!’ পেলেইনে উইঠা বুঝলাম আমি ঢাকা যাইতাছি। ওইভাবে থানায় যাওনের পরামর্শ আমারে দিলদার ভাইয়েই দিছিল।

শুনে জয়নাব দীর্ঘশ্বাস ফেলেন আর জাবেলির বিরুদ্ধে কোনো আইনি ব্যবস্থা নেয়া হয় কি না, পালানোর পরে লোকটাও ওকে খোঁজে কি না ইত্যাদি জানতে চান। নাসিমা বলে:

হেইডা জানি না। দিলদার নাকি সেখানে আমাগো দেশের আরেকটা মাইয়ার ঘটনা হুনছিল।

শ্রæত ঘটনার অনুসরণে দিলদার ওকে পরামর্শ দেয় বুঝতে পেরে জয়নাব প্রসঙ্গান্তর ঘটান। শুনতে চান তার দেশের বৃত্তান্ত। দুঃসহ স্মৃতি স্মরণঅযোগ্য ঠেকে বিধায় নাসিমার বয়ান আরো সংক্ষিপ্ত হয়ে আসে:

বস্তিতে জনম লইছি। হুনছি মায়ের বাড়ি আছিল ময়নামতি, বাপের দেশ বাহারছড়া। বাপে আরেকটা বিয়া করণের পরে মায়ে হেরে ত্যাগ দিয়া বাড়ি বাড়ি কামলা খাটে। আমি একটু ডাঙর হইলে হে আমারে গার্মেন্টস্-এ ঢুকায়া দেয়। কিন্তু হেই চাকরির বেতনে ঘর ভাড়া দিয়া, মায়েরে লইয়া চলতে পারছিলাম না। পরে ফ্যাকটারির এক বড় ভাই আমারে মমতাজ নামের এক অফিসে লইয়া যায়। মায়েরে যে বিয়া করতে চাইছিল মুদির দোকানের হেই সওদাগর আইসা একদিন আমার দুবাই যাওনের টেকা দিয়া যায়। দেশে আইসা হুনি, লোকটা আমার মায়েরে বিয়া কইরা ছয় মাসের মাথায় তালাক দেয়। মা-জননীরে আর খুঁইজা পাই নাই। বাপেরে তো ভুইলা গেছি বহুত আগে। ভাই-বোনও আছিল না আমার। হের বাদে বাসার কাম খুঁজতে খুঁজতেই তো আপনেগো চাকরিটা পাইয়া যাই।

জয়নাব শুধু বলেন:

হুম, তুমি তো প্রায় পোড়া কঙ্কালের লাহানই আছিলা।

নাসিমা যোগ করে:

হেই জেলখানার দোজখে থাইকা অমন হইয়া গেছিলাম!

কোনো কোনো রাতে জয়নাব বেগম ঘুমের অতলে হারিয়ে গেলেও তাঁরই শয্যার পাশে, মেঝেয়, নাসিমার চোখের পাতা এক হয় না। প্রবাসের, বিশেষত সেই কয়েদখানার অভিজ্ঞতার চাপে প্রায় সর্ববিষয়ে সে নির্বিকারত্ব অর্জন করলেও, মাকে আর ফিরে না পাওয়ার অভিঘাতটি ওকে টুকরো টুকরো করে দেয়। ভীষণ রক্তাক্ত বোধ করে সে। পারম্পর্যহীন অসংখ্য স্মৃতি হানা দিলে নাসিমা দেখতে পায়, একদিন সেই সদাগরের কৌত‚হলের জবাবে ওর মা বলছে: ‘আমার নাম নাসিমার মা।’

নানা-নানীর মুখও কখনো দেখেনি নাসিমা। মায়ের অবিশ্বাস্য নিরক্ষরতাই তাকে অজানায় লীন করে কি না ভাবতেই, রাত দ্বিপ্রহরে, সচরাচর উদাসীন বলে প্রতিভাত নাসিমার সমগ্র অস্তিত্ব নিংড়ে, চোখ ফেটে বেরিয়ে আসে অনন্ত অশ্রু।

মায়ের কাছে নাসিমার বৃত্তান্ত শুনে লুনাও খানিকটা বদলায়। পৃথিবীর সর্বোচ্চ টাওয়ার বার্জ খলিফার দিকে এর ক’তলা পর্যন্ত তাকানো যায় জানতে চায় সে নাসিমার কাছে। জবাবে দুবাই-ফেরত মেয়েটি লুনাকে অবাক করে দিয়ে বলে:

অত উপরে তাকানোর শক্তি তো আমাগোর নাই। হেইডা দেখতে গেলে তো আমি চিৎ হইয়া রাস্তায় পইড়া যাইতাম! পইড়া মইরা গেলে ভালোই হইত। ওই অসহ্য গরম জেলখানায় থাকতে হইত না!

 

~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~