You are currently viewing হেলিকপ্টার ও সোনার তলোয়ার, কিস্তি-২ > খালেদ হামিদী

হেলিকপ্টার ও সোনার তলোয়ার, কিস্তি-২ > খালেদ হামিদী

হেলিকপ্টার ও সোনার তলোয়ার

খালেদ হামিদী

(কিস্তি-২)

এদিকে পঁয়ত্রিশ বছর বয়সে দেশে তিন মাসের ছুটিতে গিয়ে খোকন বিয়ের পিঁড়িতে বসলেও বিবাহের আট মাস পরেই তার স্ত্রী নাজিমের সাথে পালিয়ে যায়। এতে দ্বিতীয় বিয়ের চিন্তাও মাথায় না এনে বাকি জীবন একাকী কাটানোর সিদ্ধান্ত নেয়। তা সত্ত্বেও, নারী-পুরুষের সম্পর্ক বিষয়েই, আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়ে সে। কল্পনাশক্তিকেও হার মানিয়ে তার ছোট চাচার ছোট ছেলে এভাবে ওকে খন্ডিত করবে কোনোদিন ভাবেইনি খোকন। এখন কেবল স্বগত প্রশ্নের ফণারই মুখোমুখি হয় সে: নারীর কাম কি এতোই অপরিণামদর্শী! সদ্য যুবার রিরংসাও কি হন্তারকতুল্য! বিয়ের নয় মাসের মাথায়, স্ত্রীর গুরুতর অসুস্থতার অজুহাত দেখিয়ে, পুনরায় ছুটিতে গিয়ে তালাকের আনুষ্ঠানিকতা সারে সে। সেই তরুণী স্ত্রীও তার বাবার বাড়িতে থেকে খোকনের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা রুজুর ভয় দেখায়। শেষে সালিশ করে দেনমোহর বাবদ পাঁচ লক্ষ টাকা গচ্চা দিতে হয় খোকনকে। এদিকে পলাতক বউয়ের বদনামে সবার মুখর থাকার সুযোগে অনায়াসে বাড়ি ফেরে নাজিম।

নিজের ওসব অভিজ্ঞতা ঘনিষ্ঠ ফিলিপিনো কলিগ মোফারের সাথেই শেয়ার করে খোকন, এই আরবে আর কারও সঙ্গে নয়। এই শেয়ারিংও ঘটে খুব সংক্ষেপে। মোফার নিজেরও প্রায়-অভিন্ন স্মৃতি কেবল এক বাক্যে উচ্চারণ না করলে খোকন হয়তো আপন বিষয়ে নীরবই থেকে যেতো। কাজের ফাঁকে ফাঁকে উদাস হয়ে-যাওয়া তার শূন্য দৃষ্টির, মোফারের ভাষায় স্টেয়ারিং-এর, হেতু জানাতে গিয়ে, মোফারেরই কৌতূহলের জবাবে, একদিন মুখ খোলে খোকন। কিন্তু নিজের চেয়ে বেশি দেশে তার দেখা অন্য ভাঙনের গল্পই পাড়ে।

মোফার শুধু জানায়, দৃষ্টিভঙ্গি ও অভ্যাসের অমিলের কারণে তার স্ত্রীই ত্যাগ করে তাকে। পরে এই রিয়াদে এসে ধর্ম বদলের মাধ্যমে, বেঞ্জামিন থেকে মোফার, নিজ নামের এই পরিবর্তন ঘটায় খোকনের সহকর্মী। মেইনটেন্যান্স কোম্পানি আল কুসির এই সাউদি এরাবিয়ান মনিটারি এজেন্সি বা সামা প্রকল্পে নামাজ পড়ার এ-দেশীয় আইনি বাধ্যবাধকতা না থাকায়ও হয়তো মোফারকে মুসলিম জীবনাচারে অভ্যস্ত দেখে না খোকন। মোফারের খাদ্যাভ্যাসও ফিলিপিনোই। তবে আরেক কোম্পানিতে কর্মরত ব্যাচেলর জেসিকার সাথে তার ফোনালাপে ভেতরে ভেতরে ঈর্ষান্বিত না হয়ে পারে না খোকন। কিন্তু মোফারের মুখে প্রতিদিনই তাগালোগ ভাষায় জেসিকার জন্যে উচ্চারিত মাআল কিতা, ইংরেজিতে আই লাভ ইউ, বাক্যটি বিরক্তিকর ঠেকে না। কখনো কখনো মোফারের হয়ে একটু ভয় পায় সে, প্রশাসন যদি এই ফোনালাপ রেকর্ড করে! এ দেশে অবিবাহিত নারীর সঙ্গে আলাপ ও সাক্ষাৎ উভয়ই দন্ডনীয় অপরাধ বলেই মোফারের বিপরীতে খোকন দেয়ালেরও কান থাকার বিষয়টি মনেপ্রাণে বুঝি বা টের পায়।

বিয়ে করেও পুনরায় কৌমার্য বরণের সঙ্কল্প গ্রহণের পর থেকে ভীরুতা প্রায় সহজাত হয়ে পড়ে খোকনের। অফিসে লা  ব্রেকের সময় আরেকদিন আরেক পাকিস্তানির প্রসঙ্গ টানে সে, মোফারের সাথে আলাপকালে। এমবিএ মোফার কোম্পানির অন্য টেকনিশিয়ান ফিলিপিনোদের মতো ভাঙা ভাঙা বাক্যে ইংরেজি বলে না। তাই বাণিজ্য বিষয়ে কেবলি স্নাতক খোকনকে অনেকটা কষ্টে-সৃষ্টে গুছিয়ে ইংরেজি বলার চেষ্টা করতে হয়। সে এভাবে ঘটনার বিবরণ দেয় :

আমাদের শহরের রহমত নগর এলাকায়, তৎকালে বিখ্যাত একটি দুই ইউনিটের চার তলা দালান ডাঃ নূর নিকেতনের দোতলায়, প্রায় বিশ বছর ভাড়ায় ছিলেন আমার মামারা। আমিও ক্লাস এইট থেকে ইন্টারমিডিয়েট পর্যন্ত সেই বাসায় ছিলাম। একই ফ্লোরের অপর ফ্ল্যাটে থাকতেন পেশোয়ারের বেনজির সাহেব। আমাদের স্বাধীনতার অষ্টম বছরে তিনি বাংলাদেশ ত্যাগ করেন। এর দুই বছর আগে তাঁর স্ত্রী ও সদ্য বিবাহিত পুত্র পাকিস্তান চলে যান। কিন্তু তখনো তাঁরা পরিচিত বোম্বাইওয়ালা হিসেবে। ওদিকে আমার সেই জেঠি মা জেবাকেও বিহারের মহিলা মনে করতেন সবাই। স্থানীয় ভাষায় আমার মুরুব্বিরা তাঁঁকে আড়ালে বিয়ারনি বলে ডাকতেন। নিজ পরিবারের পেশোয়ারে প্রত্যাবর্তনের পর ষাটোর্ধ্ব বেনজির সাহেব তাঁর অর্ধেকেরও কম বয়সী হালকা গড়নের যে বিহারি মোহাজের নারীকে বিয়ে করেন, সেই স্ত্রী, দেখি, সাত-আট দিন ধরে প্রতি সন্ধ্যায় নানার সঙ্গে উর্দুতে কি কি সব আলাপ করছেন। মাঝে মাঝে বিক্ষুব্ধও হয়ে উঠছেন। তখন আমি উর্দু না বুঝলেও শেষ সন্ধ্যার সালিশের বিষয়টি বুঝতে আমার অসুবিধা হয়নি। এই স্ত্রীর গর্ভজাত বছর খানেক বয়সের কন্যা সন্তানটির দায়িত্ব নেবেন না পিতা বেনজির। তিনি এখানকার ব্যবসা গুটিয়ে অচিরেই এ-দেশ ত্যাগ করছেন বিধায় ওনার পক্ষে তা সম্ভব হচ্ছে না। আর, সন্তান কোলে শীর্ণকায় নারীটি স্বামীর ঘোষিত তালাক মানছেন না। কখনও উচ্চ কণ্ঠে ফেটে পড়ছেন। তাঁর পক্ষের কেউই উপস্থিত নেই। একা ও একক বিচারক হিসেবে আমার সত্তরোর্ধ্ব নানা ভাই সন্ধ্যা থেকে মধ্যরাত অব্দি অনর্গল পাকিস্তানি ভাষায় মা-মেয়েকে রক্ষার প্রয়াস চালিয়েও ব্যর্থ হন। সোফায় বসা মায়ের চোখের পানি গড়িয়ে পড়ে কোলে শোয়া শিশু সন্তানের বুকে। শেষ পর্যন্ত দেনমোহরের মাত্র এগারো শ টাকা বেনজির সাহেব পরিশোধ করেন আমার সামনেই। সারাক্ষণ কাবলি ও টুপি পরা, চাপ দাড়িঅলা ভদ্রলোক নিজের অপ্রাতিষ্ঠানিক বিয়ে সোয়া এক বছরের মাথায় হঠাৎ অতো হাল্কাভাবে ভেঙে দেবেন তা কোনোদিন ভুলেও ভাবেননি সেই বিহারি নারী। কোথাও আশ্রিত থেকেও কোনও কোনও মানুষ হঠাৎ কিভাবে একেবারে নিঃস্ব হয়ে যায়!

শোনা মাত্র মেঘাচ্ছন্ন চিত্তে মোফার তার ভাষায় বলে:

পাতাইও! পাতাইও তাই জান!!

এ কী! এ কী করে সম্ভব!!

নিজের দীর্ঘশ্বাস শেষ না হতেই খোকন যোগ করে:

ভিখিরি তাঁর দরজায় কড়া নাড়লে অল্প বাংলা জানা বেনজির সাহেব রেগেমেগে উচ্চ স্বরে বলতেন:

নিচে যান! নিচে যান!!

তাঁঁর এই সম্মানসূচক ‘যান’ আদেশটি প্রতিবেশিদের হাসাতো। তিনি এক পয়সাও কোনাদিন ভিক্ষা দেননি।

 

অনেক বছর যাবৎ খোকন তরুণ-তরুণীর মুক্ত সম্পর্ক বিষয়ে আগ্রহী থাকলেও আজকাল দেহরঞ্জনের প্রশ্নেও নিস্পৃহ বোধ করে। এই দেশে তো বন্ধুত্বপূর্ণ স্বাধীন সম্পর্কের প্রশ্নই আসে না। কিন্তু আইনি ক্ষমাহীনতাকেও ফাঁকি দিয়ে কোনও কোনও বাড়িতে চালু থাকে দেহের দোকান। এ-দেশেরই এমন পর্যায়ের অসম্ভব রূপসী এক তন্বীর, আল খোবারে যার বসবাস, খবর আল কুসিরই আরেক কর্মী, টাঙ্গাইলের মফিজ, খোকনকে জানালে সে তৎক্ষণাৎ অসম্মতি জ্ঞাপনে দ্বিধা করে না। তবে আরব তরুণ সমাজের অনেকেই এখন, অনেকটা বিনা খরচে, বন্ধুত্বের অভিনয়যোগে, সেল ফোন, ইমেইল ও ফেসবুকের সুবাদে, পুলিশকে ফাঁকি দিয়ে রমণাভিজ্ঞতায় এগিয়ে থাকছে। মেয়েদের বোরকা এখন আইন ঠেকানোর সর্বোত্তম উপায়ে পরিণত। তাই বলে আবার আরব নর কিংবা নারী-সমপ্রেমে ভাটা পড়েনি। প্রযুক্তির সুবাদে সব সংযোগই এখন সহজতর। গত দশ বছরে আগের আইন একটুও শিথিল না হলেও রিয়াদ বদলে গেছে ঢের। তবুও খোকন ঝুঁকি নিতে অনিচ্ছুক। নারী এবং পুলিশ এখন তার দুই ভীতির কারণ।

তবে অতি স¤প্রতি দেশে ফোন করে মায়ের মুখে জেঠি জেবার সংবাদ শুনে খোকন নিথর হয়ে পড়ে। তার ভয় ও সা¤প্রতিক ধারণাসমূহ কিি ৎ বদলাতে শুরু করে আর কান্না পায় বুক ভেঙে। দূরের ছবি ও শব্দ কাছে চলে আসে। সেই তার প্রপিতামহের আমলের উত্তর থেকে দক্ষিণ অব্দি পঞ্চাশ ফুট দীর্ঘ মাটির ঘরের, পাঁচ পরিবারের জন্যে পাঁচ ভাগে বিভক্ত বৈঠক খানার দক্ষিণেরটিতে, বাবুলের ডাকা সভায় উপস্থিত সকলে তাকেই দায়ী করতে শুরু করে। বেড়ার পার্টিশনের এপারে, চতুর্থ অংশে, মা ও তিন চাচীর সঙ্গে দাঁড়িয়ে, সন্ধেবেলায়, খোকনও শোনে, কে যেন মিটিঙে এসে বলে:

শাকিবের মা তো নাই! ঘরে শাকিব ছাড়া আর কাউকেই দেখা যাচ্ছে না! ওর মায়ের বালিশের ওপর সে এই চিঠিটা পায়।

সভার একজন দু’তিন উর্দু লাইনখচিত চিরক‚টটা পড়ে:

তোমার অত্যাচার সইতে না পেরে আমি আমার জানে জিগার, দিল কি ধাড়কান আলমের সাথে চলে যাচ্ছি। বড় ছেলে শাকিব ছাড়া আমার চার মেয়ে, দুই ছেলের পাঁচজনই আমার সাথে যাচ্ছে।

সেই ছোট্ট চিঠির হিন্দি-উর্দু শব্দগুলি এখনো খোকনের কানে বাজে।

বাবুলের সংসার ভাঙার সাথে সাথে সভাও পন্ড হয়ে যায়। অমন দাপুটে, জমজমাট ও রমরমা একটি পরিবার কেন ওভাবে ছত্রখান হয় খোকন যেন এখনো ঠিক বুঝে উঠতে পারে না।

আলম শাকিবের চার বোনকে বিয়ে দেয়, জেবার গর্ভজাত নিজের একমাত্র কন্যাটিকেও। জেবার সাথে তার একুশ বছরের সংসারে শেষে কি যে ঘটে কেরানি বাড়ির কেউই জানতে পারে না। অনেক বছর পরে আলমকে তার ফেলে-যাওয়া সেই প্রথম সংসারে ফিরে আসতে দেখে শুধু তারা কিছুটা হলেও বিস্ময় মানে। এদিকে পিতার যথোপযুক্ত পুত্র শাকিব বাবুলের সব সম্পত্তি নিজের নামে লিখিয়ে নেয়। আলমের বাড়ি ফেরার পরের বছর এক রাতে, বিবাহিত শাকিবের ঘরে অসুস্থ বাবুলের অবস্থা সঙ্কটাপন্ন শুনে, আলম ছুটে গিয়ে ক্ষমা চায়। কেঁদে পা-ও ছোঁয় বাবুলের। কিন্তু আলম আসার কয়েক মুহূর্ত আগেই বাবুল মারা যায়। এদিকে বাবুলের জীবনাবসানের বছর খানেক পরে জেবা ইন্তেকাল করে। এক রুমের এক ভাড়াকৃত বাসায়, জামাতাদের পয়সায়, কেবল গৃহপরিচারিকাকে নিয়েই জেবাকে কাটাতে হয় শেষ ক’টা বছর। ওর মৃত্যুর সপ্তাহ তিনেক আগে বাবুলের একমাত্র আপন ভাই মোজাম্মেল ওকে দেখতে যায়। জেবা তাকে বুকে চেপে, বুক বিদীর্ণ করে, উচ্চ স্বরে, অনেকক্ষণ ধরে অঝোরে কাঁদে।

সব শুনে মোফার জানতে চায়:

বাবুল আলমকে কি আনচ্যালেঞ্জড্ ছেড়ে দেয়? সে কি আর বিয়ে থা করেনি?

খোকন বলে:

বাবুল চাচা মামলা করলেও তাঁর সেই সন্তানেরা আদালতে তাদের পিতাকে বিলকুল অস্বীকার করে। আলম কাকা কখনো হঠাৎ বাড়িতে এলে বাবুল চাচা রাম দা, কিরিচ ইত্যাদি হাতে ধেয়ে যান। কেরানি বাড়ির লোকেরা তাকে প্রতিবারই নিবৃত্ত করে। না। তিনি আর বিয়ে করেননি। নামাজি ও রোজাদার হয়ে ওঠেন পরে এবং প্রায় আমূল বদলে যান। কিন্তু হারিয়ে ফেলেন আগের স্বাস্থ্য। ওজন হারাতে হারাতে শেষে অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাঁর মৃত মুখ আমি দেখিনি। তখন তো মোবাইল ফোন আবিষ্কৃতই হয়নি। মৃত্যুর দিন সকালে কলেজে গিয়ে, বিকেল থেকে নানা জায়গায় আড্ডা পিটিয়ে, প্রায় মধ্যরাতে যখন বাড়ি ফিরি তখন তিনি কবরে।

মোফারের আরো কৌতূহল:

আলম কি জেবাকে নিয়ে শুরুতে অন্য জেলায় বা দেশের বাইরে চলে যায়নি?

না। অদ্ভুতভাবে সেই রহমত নগরে আমিই শাকিবের ছোট বোন কিশোরী শাদাবকে প্রথম দেখতে পাই। ওদের বাড়ি ছাড়ার বছরেই। আমার নানার বাসার সামনের রাস্তায়। কিন্তু শাদাব আমাকে দেখেই দ্রুত একটি গলিতে ঢুকে পড়ে। সেই থেকে সবাই বুঝতে পারে, আলম চাচা ওদের সবাইকে নিয়ে নিজের আপন ধনী বোন মালতীর বাড়িতে আশ্রয় নেন।

এই উত্তরের পরে খোকন মোফারকে একটা পাদটীকা দেয়:

শাকিবের ভাই-বোনেরা যখন বাড়ি ছাড়ছে তখন ওর ইমিডিয়েট ছোট বোন শাহীন এবং ভাই শাহিদ প্রাপ্ত বয়স্ক। শাহিদ তার মামাদের সহায়তায় মায়ের মৃত্যুর বছর দুয়েক আগে পাকিস্তানে পাড়ি জমায়।