You are currently viewing হেলিকপ্টার ও সোনার তলোয়ার > খালেদ হামিদী

হেলিকপ্টার ও সোনার তলোয়ার > খালেদ হামিদী

হেলিকপ্টার ও সোনার তলোয়ার

খালেদ হামিদী

কিস্তি: চৌদ্দ (শেষ)

২৮

ফ্লাইওভারে ধাবমান গাড়ি থেকে যানসমেত অথবা একাই, আকাশে উড়াল দেবার সেই ঘটনাটা, মনে পড়ে খোকনের। তখন, দ্বাদশী চাঁদের রাতে, সে কোম্পানির ভিলার ফ্রন্ট ইয়ার্ডে এসে দাঁড়ায়। দেড় মাস ধরে বাড়িথেকে কোনও ফোন কল এবং এমনকি বার্তাও না আসায় সে অসহায় বোধ করছে। নিজেও কী এক অভিমানে কারও খোঁজ নেয়নি এ-ক’দিন। পাশাপাশি দেশে কী ধরনের চাকরি মিলতে পারে কিংবা আদৌ মিলবে কি না জানতে চেয়েও আত্মীয় ও বন্ধু-বান্ধবদের কাছ থেকে গ্রিন সিগনাল মিলছে না। এই অবস্থায় ওর মনে হয় সে শুয়ে আছে। কিন্তু নিজেকেই বলে ওঠে:

আমি তো আসলে মরুর বালুতে পড়ে আছি মুখ থুবড়ে! নিছক টিকে আছি গরাদবিহীন কারাগারে! পৃথিবীতে অর্ধ শতাব্দিরও বেশি পার করেও উদ্বৃত্তহীন! শেষ অব্দি আমার আর স্বদেশী শ্রমিক ভাইদের মধ্যে কোনও অমিল নেই। সেই ওষুধ পামেলা সেবনেরও আর সুযোগ নেই। গোপনে বিক্রি হওয়া মদ্য সাদিকিও আগের মতো আর কে এনে দেবে!

ওর মর্মোৎসারিত হাহাকারের এক পর্যায়ে খোকন বসে পড়ে লনের চেয়ারে। পরের দিন কেউ সকাল সাতটায়, কেউ বা আটটায় কাজে যোগ দেবে। তাই তিন তলা দালানটির ভেতরে প্রায় সবাই তখন ঘুমিয়ে। জ্যোৎস্নায় পুড়ে যাচ্ছে কাছের ও দূরের সব খেজুরপাতা। চারিদিকে যেন কাফন মাখানো নীরবতা। তখন প্রায় মধ্যরাত। ইমো, ম্যাসেঞ্জার, ফেসবুক, হোয়াটস্অ্যাপ, টুইটার কিছুই ঘোচাতে পারে না খোকনের মৌলিক একাকিত্ব। ওর তন্দ্রা নাকি নিদ্রা পায় নিজেই বুঝতে পারে না। চেয়ারে বসতেই তার চোখ মুদে আসে। ওর বাবা, যিনি কলকাতায় স্কুলে পড়ার সময় দারুণ সব ছবি আঁকলেও পরে আর শিল্পী হয়ে উঠতে পারেননি, এই জেলখানায় আসেন আরেক ডিডেলাস হয়ে। খোকনের পিঠে সেঁটে দেন বিশাল দুই মোমের ডানা। বাবা এগুলোতে গুঁজে আনেন দেশের দোয়েল, শ্যামা, কবুতর, কাক ও ধনেশের পালক। সেইসঙ্গে সে গ্রথিত করে চড়–ইয়ের সাথে মরুর দেশে বিস্ময়কররূপে সুলভ ঘুঘুর পালকও। মোম গলে পড়ার আশঙ্কায় সূর্যের কাছে যেতে পিতার বারণ। সে বলে:

চাঁদের নিকটে গেলে ডানা হারাবো না।

অমনি সে উড়াল দেয়। মাধ্যাকর্ষণের আওতা পেরুনোর আগেই সে আনন্দে ফেটে পড়ে আর সর্বোচ্চ কণ্ঠে আরও বলে:

আমি ইকারুস নই। তবু গ্র্যাভিটির লেয়ার ছাড়িয়ে আরও উপরে যাবো। সেখান থেকে ফিরবো না। ওখানে আহার নাই, কামও নাই। তোমরা কি জানো না, মাধ্যাকর্ষণের শক্তিহীন অবস্থায়, নভোযানের ভেতরে, পুরুষ নভোচারীরটা দাঁড়ায় না! কী মজা! কারও পক্ষে আমাকে ছেড়ে যাওয়ার প্রশ্নই আসবে না! উল্লাস! উল্লাস!

সে ঈগল কিংবা স্যাটেলাইট না হওয়া সত্তে¡ও যতোই উপরে ওঠে ততোই স্পষ্ট দেখতে পায় ধর্ষণের ফলে সুরভি জীবন্মৃত অথবা নিহত। অজ্ঞাত ঠিকানায় ওর দুই পাশে, লাশের ধরনে ঘুমিয়ে আছে নাসিমা ও শেফালি। মা-বাবা থেকেও অনাথ স্মার্ট তরুণী চন্দ্রিকা, একান্তে কাঁদছে। এই কান্না কেউই জানতে-দেখতে পারছে না।

সেইসঙ্গে খোকনের আরও চোখে পড়ে- ফিলিপিনস্-এ সেই দীর্ঘকালীন মার্কিন ঘাঁটি, অনেক ফিলিপিনোর সাথে ফিলিপিনাদেরও প্যাসিভ হয়ে ওঠা, আরবের রাস্তায় ফিলিপিনোর নরকামিতা, মধ্যপ্রাচ্যমুখি ভারতীয় তরুণদেও কর্মদক্ষতা, তাদের কারও কারও মিনিটে ৮০টা ইংরেজি শব্দ টাইপিংয়ের বিস্ময়কর ক্ষমতা, গরিবের প্রেমের প্রতি পরিহাসরূপে দাঁড়িয়ে থাকা তাজমহল, গেইট অফ ইন্ডিয়া, সাভারের স্মৃতিসৌধ, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর ইত্যাদি।

এভাবে এক পর্যায়ে, জুম না করেও, খোকনের চোখে বিশালরূপে ভাস্বর হয়ে ওঠে সমগ্র বাংলাদেশ। সেই রেসকোর্সের ময়দানে বজ্রকণ্ঠে কালজয়ী ভাষণ দিচ্ছেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সারা দেশের মানুষ দাঁড়িয়ে, বসে একযোগে তাঁকে সাড়া দিচ্ছেন। কবর থেকে উঠে দাঁড়িয়েছেন চার নেতা। জোছনার জলে মুখ ধুতেছেন রবীন্দ্রনাথ আর সব হত্যাকান্ডের বিরুদ্ধেই লিখছেন:

মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারানো পাপ।

সেই সঙ্গে তাঁর গানের কথায় ও সুরে প্লাবিত হয়ে চলেছে বাঙালির দশ দিগন্ত। ঠিক তখন, মাও জে দঙ সাঁতরে পার হচ্ছেন ইয়াংসি নদী।

 

২৯

সেই রাতে পাশের উঁচু ট্র্যাশ ক্যান থেকে দুটি বিড়াল, যাদের ইকামা লাগে না, সশব্দে নিচে লাফিয়ে পড়ায় খোকনের ঘুম ভাঙে। পরের দিন সকালে অফিস যাওয়ার সময় সে ভাবে: বিড়াল দুটি কি দম্পতি?

সকালেও সে স্বপ্নের ঘোর থেকে মুক্ত হতে পারে না। নিজেকেই বলে কিছু শিশুতোষ অসংলগ্ন কথা: চাঁদের অতো কাছাকাছি গিয়েও কীভাবে ফিরে আসি এই মরুর শহরে? ভর থাকে না বলে শূন্য থেকে পালক ও কয়েন একই সাথে নিচে পতিত হয়। কিন্তু রাজা-বাদশাদের, বড় লোকদের ধন নিচে পড়ে না কেন! আমাদের আয় কেন এতো অল্প বাড়ে, তাও দেরিতে? অনেকের বেতন কেন একেবারেই বাড়ে না এবং কারও কারও কমে যায়? না, না, ধনকুবেরদের সম্পদ বেড়ে উপরের দিকে উঠলেও তা তো মাধ্যাকর্ষণ ছাড়িয়ে যায় না!

আরেক দিন বিকেলে, পথ চলার সময়, অন্য অনেকবারের মতো, চারিদিক অন্ধকার হয়ে আসে। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টিসহ ধূলিঝড় শুরু হয়। খোকন হাঁটার গতি বাড়িয়ে দেয়। হঠাৎ আকাশে বেজে ওঠে দেশের আষাঢ়-শ্রাবণ। কিন্তু তৎক্ষণাৎ মনে হয়, তার ওপর এসে পড়ছে বিদেশী মিসাইল, হুতিদের অথবা আল কায়েদার। নাকি ধেয়ে আসছে সেই হেলিকপ্টার? এবার সে নিজেকে আড়াল করতে চায় এক হাত মাথার পেছন অব্দি তুলে। তার গায়ে টি শার্ট। সে ভেবে পায় না তবু এই পরিস্থিতিতেও কেন মনে পড়ে, ‘আর্মপিট হেয়ার ইজ দ্য সেক্সিয়েস্ট পার্ট অফ আ ম্যান’স্ বডি!’ সাথে সাথে, শীত আসার আগে শিলাবৃষ্টির সময় যেমন হয়, বিজলি চমকায়। কাছেই বাসা বিধায় সে দৌড়াতে শুরু করে মনে মনে এই বলতে বলতে:

বজ্রপাতের সাথে বাঁকা হয়ে কেন নামছে সোনার তলোয়ার! মোহাইমেন কি প্রেয়সীর সাথে মিলিত হয়? জানা যায় না। হায়, ইহুদি তরুণীটিকে শুধু সে বিয়ে করতে চায়!

নিজের রুমে ফিরে কিছুক্ষণ হাঁপাতে থাকে খোকন। এ-সময় তার মাথায় আরও কিছু কথা খেলে যায়। যেমন, তরু ও তন্ময় শুনে বলবে:

ওই রাজপুত্রের জন্যে এতো দুঃখ কেন! অদেখা, নিরস্ত্র আক্রমণেও কতো লোক যে আস্তে আস্তে মরে যাচ্ছে!

এখনও পৃথিবীর নয় শতাংশ মানুষ রাতে না খেয়ে ঘুমোতে যায়!

( সমাপ্ত )

*==**==**==*==**==**

**==**=**==*==**==**=*