You are currently viewing হঠাৎ পার্ল জ্যাম/ জয় শাহরিয়ার

হঠাৎ পার্ল জ্যাম/ জয় শাহরিয়ার

হঠাৎ পার্ল জ্যাম

জয় শাহরিয়ার

২০১৪ সালের ৮ অক্টোবর। ইউ এস স্টেট ডিপার্টমেন্টের ফেলোশিপ নিয়ে আমি তখন ওকলাহোমা ইউনিভার্সিটিতে। আমি পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট বাংলাদেশ দলের একজন। বাকি চারজন হলো নাফিস, মিজান ভাই, বিপ্লব ভাই ও মহিউদ্দিন ভাই। আমাদের সাথে এই ফেলোশিপের অংশ ছিল নেপালের ছয় সদস্যের দল। ইশিতা, জুনাদি, রাজিভ দাই, মানিশ দাই, মাহেশ দাই আর বিশাল দাই ছিলেন সেই দলের সদস্য। আমরা মোট ১১ জনের দল। একেক দিন একেক ধরণের অনুষ্ঠান থাকে আমাদের। কোনদিন কনফারেন্স, কোনদিন ট্রেনিং তো কোনদিন প্রেজেন্টেশন। আমাদের জন্য বরাদ্দ একটা সাদা ভ্যান। ১৪ জনের সিট ক্যাপাসিটি ড্রাইভারের সিট সহ। আমাদের প্রোগ্রাম কো অর্ডিনেটর ছিলেন এলানি স্টেইন, যিনি গে লর্ড কলেজ অভ জার্নালিজম ও ম্যাস কম্যুনিকেশনের একজন প্রফেসর। এছাড়াও আমাদের সাথে বিভিন্ন সময়ে দায়িত্ব পালন করেছেন অন্ট্রাপ্রেনারশিপ ইন্সটিটিউটের প্রফেসর জেফ।

যাই হোক মূল গল্পে আসি। সেদিন আমরা একটা সারাদিনের প্রোগ্রামে ওকলাহোমার পাশের শহর টালসাতে যাই। সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত ৪-৫ টি জায়গায় নানান সেশন শেষে সন্ধ্যায় ওকলাহোমা ফেরার জন্য সবাই রাস্তায় অপেক্ষা করছি আমাদের সেই সাদা ভ্যানের জন্য। এমন সময় খেয়াল করলাম দলে দলে মানুষ যাচ্ছে সামনে কোথাও। একটা উৎসব উৎসব ভাব। আমি আমাদের দলের সাথে থাকা ওকলাহোমা ইউনিভার্সিটির প্রতিনিধি রেনেকে জিজ্ঞেস করলাম সবাই কোথায় যায়? সে বললো সামনে বিওকে সেন্টার সেখানে যাচ্ছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম বাস্কেটবল খেলা নাকি? সে বললো নাহ, একটা কনসার্ট আছে। আমি তখন দারুণ উৎসাহ নিয়ে জানতে চাইলাম কার কনসার্ট? রেনে উত্তর দিলো ছোট্ট করে, পার্ল জ্যাম।

আমার তো মাথা খারাপ হবার দশা। বলে কী? পার্ল জ্যামের কনসার্টের পাশ থেকে ঘুরে যাচ্ছি? আমাদের দলের আরেক মিউজিশিয়ান নাফিসকে জানালাম খবর। স্বাভাবিকভাবেই সেও দারুণ উত্তেজিত। ওইদিন আমাদের টিম লিডার ছিল জেফ।

আমি আর নাফিস তাকে গিয়ে বললাম যে পাশেই কনসার্ট হচ্ছে, আমরা একটু পরিবেশটা দেখতে চাই। জেফ মানা করলেন না। কারণ দলের সবাই জানে আমি আর নাফিস গানের মানুষ। আমরা ফেলোশিপে গিয়েছি একজন মিউজিক প্রডিউসার হিসেবে আরেকজন ইভেন্ট অর্গানাইজার হিসেবে। ফলে আমাদের আগ্রহ এই বিষয়ে থাকবেই, আর সামনাসামনি এমন একটা ইভেন্টের পরিবেশ ও পারিপার্শ্বিকতা দেখতে ও জানতে পারলে আমাদের উপকারই হবে। অতএব দলের সবাই মিলে এগিয়ে গেলাম বিওকে সেন্টারের দিকে। যেতে যেতে আমি আর নাফিস আলাপ করছিলাম যে, ইশ আগে জানলে কনসার্টটা দেখতে পারতাম। এখন নিশ্চয়ই আর টিকেট পাওয়া যাবে না। কনসার্ট ভেন্যুতে গিয়ে চারপাশ দেখছি। স্যুভেনির শপটা ঘুরতে গিয়ে কী মনে করে জিজ্ঞেস করলাম কনসার্টের টিকেট তো সোল্ড আউট তাই না? যে উত্তর পেলাম তারপর আমি নাফিসের দিকে তাকাই আর নাফিস আমার দিকে। আমরা জানতে পারলাম যে শেষ মূহুর্তের কিছু টিকেট ছাড়া হয়েছে একটু আগে। তখন বাজে ছয়টার মতো। কনসার্ট সাড়ে আটটায়। আমি আর নাফিস সবার কাছে গিয়ে জানালাম যে কনসার্টের টিকেট আছে কিছু এবং আমি আর নাফিস সেটা দেখতে চাই। আমাদের প্রফেসর জেফ বললেন, সবাই থাকতে চাইলে থাকা যাবে। আর যদি তা না হয়, যারা থাকতে চায় তাদের থাকতে দিতে পারবো তখনই যখন তাদের ফেরার সুব্যবস্থা আমি করতে পারবো। কারণ টালসা থেকে রাতে ওকলাহোমা ফেরার জন্য কোন বাস সার্ভিস নাই। নাই কোন রেগুলার ট্যাক্সি সার্ভিসও। সারাদিন নানা জায়গায় ঘোরাঘুরি করে সবাই খুবই ক্লান্ত। আর কনসার্ট দেখার শখ তো আর সবার সেভাবে নাই। আমার আর নাফিসের আগ্রহ দেখে জেফ বললেন, আমি একটু খবর নিয়ে দেখি যা রাতে তোমাদের ফেরার জন্য আমি কোন প্রাইভেট ট্যাক্সি সার্ভিস পাই কীনা। জেফ কিছুক্ষণ পর ফোনে কথা বলে জানালেন যে তিনি ফেরার ব্যবস্থা করতে পারবেন। ট্যাক্সি ভাড়া আসবে ৫০০ ডলার আর সাথে ৫০ ডিলার টিপস সহ মোট ৫৫০ ডলার খরচ হবে। আমরা চাইলে জেফ ব্যবস্থা করে দেবেন, আমরা পরে দিলেও হবে সেই টাকা। কনসার্টের টিকেটের দাম জেনে আসলাম ৭০ ডলারের মতো। আমি আর নাফিস তখন ভেবে দেখলাম দুজনের ৭০০ ডলার খরচটা বেশি হয়ে যায়। যদি ৫ জন কনসার্টটা দেখি তাহলে সম্ভব। কারণ কনসার্ট টিকেটের দাম বেশ কম এই ধরনের কনসার্ট বিবেচনায়। ৫ জন মিলে ৫৫০ ডলার ট্যাক্সি ফেয়ার নাহয় দিলাম। ১৮০ ডলারে চাইলেই কী আর জীবনে পার্ল জ্যাম দেখতে পারবো? আমাদের ভাবনার কথা জানালাম দলের সবাইকে। আর কেউ দেখতে চায় কীনা? ৫ জন হলে আমরা থাকবো। নইলে ফেরত যাবো সবার সাথে। কিছুক্ষণের মধ্যেই পেয়ে গেলাম আরো তিনজন। জুনাদি, ইশিতা আর মিজান ভাই দেখতে চাইলেন কনসার্ট আমাদের সাথে। ফলে আমাদের জন্য ফেরার ব্যবস্থা করে বাকি সবাই রওয়ানা হয়ে গেল ওকলাহোমার পথে। আমরা তাড়াতাড়ি কনসার্টের টিকিট কিনে ঢুকে পড়লাম বিওকে সেন্টারে।

কনসার্টটা ছিল পার্ল জ্যামের ১০ম স্টুডিও অ্যালবাম ‘লাইটনিং বোল্ট’ এর ট্যুর কনসার্টের অংশ। এই কনসার্টের ৩ দিন পর ১১ অক্টোবর অ্যালবামটি সারাবিশ্বে প্রকাশ পায়। টালসাতে এটাই ছিল পার্ল জ্যামের প্রথম কনসার্ট।

বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষার পর শুরু হলো কনসার্ট। প্রায় তিন ঘন্টাব্যাপী কনসার্টে পার্ল জ্যাম পরিবেশন করে ২৯টি গান। আমার জীবনে দেখা অন্যতম সেরা রক কনসার্ট ছিল এটা। এত এনার্জেটিক পারফরম্যান্স আমি খুব কম দেখেছি। টানা ১৮টা গান পরিবেশনের পর তারা প্রথম ব্রেক নেয়। পার্ল জ্যাম কনসার্ট শুরু করে তাদের গান পেন্ডুলাম দিয়ে। তারপর একে টানা গেয়ে শোনায় হার্ড টু ইমাজিন, এল্ডার্লি ওম্যান, ব্রেকার ফল, লাস্ট একজিট, এনিমেল, মাইন্ড ইউর ম্যানার্স, ইন মাই ট্রি, লাইটনিং বোল্ট, ডিসিডেন্ট, মার্কার ইন দ্য স্যান্ড, ইভেন ফ্লো, সাইরেনস, গিভেন টু ফ্লাই, জেরেমি, লেট দ্য রেকর্ড প্লে, স্পিন দ্য ব্ল্যাক সার্কেল ও রিয়ার ভিউ মিরর। সবগুলো গান যে শোনা ছিল আগে তেমনটা নয়। বেশ কিছু চেনা আর বাকি অচেনা গানগুলো শুনতে দারুণ লাগছিল। বাড়তি পাওনা ছিল তিনদিন পরে রিলিজ হতে যাওয়া লাইটনিং বোল্ট অ্যালবামের আনরিলিজড কিছু গান শুনতে পাওয়া। পুরো কনসার্টে নতুন অ্যালবাম থেকে পাঁচটি গান করে পার্ল জ্যাম। টানা আঠারো গানের পর একটা ছোট্ট ব্রেক নিয়ে আবার স্টেজ মাতাতে ওঠে পার্ল জ্যাম। কোনো ক্লান্তি নেই তাদের পরিবেশনায়। নব্বই দশকের অন্যতম সেরা রক ভোকালিস্ট এডি ভেডার ছিলেন দারুণ সপ্রতিভ। ১৯৯০ সাল থেকে তিনি গাইছেন পার্ল জ্যামের সাথে। পঞ্চাশ বছর বয়সী রকস্টারের পারফরম্যান্স ছিল তারুণ্যদীপ্ত। প্রথম ব্রেকের পর পার্ল জ্যাম আবারো টানা গান করে ছয়টি। যেগুলো হলো জাস্ট ব্রেথ, ব্ল্যাক, ক্রেজি ম্যারি (ভিক্টোরিয়া উইলিয়ামসের কভার), আই বিলিভ ইন মিরাকলস (র‍্যামোনেস কভার), ব্লাড ও পর্চ। কনসার্ট শেষ করে সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে স্টেজ থেকে বিদায় নেয় তারা। ইনডোর স্টেডিয়ামজুড়ে তালি বন্ধ হচ্ছে না। আমার আগের কনসার্ট দেখার অভিজ্ঞতা বলে পার্ল জ্যাম আবার আসবে স্টেজে শ্রোতাদের এই ভালোবাসার উত্তর দিতে এবং গান গেয়ে শেষ করবে কনসার্ট। আমার বন্ধুরা যখন বের হয়ে যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছে, আমি বললাম অপেক্ষা করো, আবার আসবে স্টেইজে। ঠিক তাই হলো। পার্ল জ্যাম আবার আসলো স্টেইজে। এবার তারা কনসার্ট শেষ করার আগে টানা গাইলো আরো পাঁচটি গান। সেই গানগুলো হলো ডু দ্য ইভ্যলিউশন, বেটার ম্যান, অ্যালাইভ, বিশ্বখ্যাত ব্যান্ড দ্য হু এর গান বাবা ও’রাইলি এবং ইনডিফারেন্স। পার্ল জ্যাম স্টেইজে ছিল অবিশ্বাস্য সুন্দর। এত টাইট, প্যাকড পারফরম্যান্স একটা তিন ঘন্টার শো-তে আসলেও অভাবনীয়। স্টেইজে তাদের শো ম্যানশিপও ছিল দেখার মতো। গানের মাঝে ইলেক্ট্রিক গিটার আর অ্যাক্যুস্টিক গিটারের পরিবর্তন দেখে হা হয়ে গিয়েছিলাম। এক গিটার বাজাতে বাজাতে ব্যান্ডের সহযোগী স্টেইজে আরেক গিটার নিয়ে পেছনে দাঁড়াতেই নিমিষে বদলে নিলো গিটার। দেখার মতো বিষয় বটে। এডি ভেডারের পাশাপাশি আমি মুগ্ধ হলাম দুই গিটারিস্ট স্টোন গোসার্ড ও মাইক ম্যাকরিডির পারফরম্যান্সে। ড্রামসে ম্যাট ক্যামেরন ও বেজ গিটারে জেফ অ্যামেট ছিলেন অসাধারণ। আর এডির পারফরম্যান্স নিয়ে যাই বলবো কম হয়ে যাবে।

দারুণ একটা কনসার্ট দেখে বের হবার সময় ছোট্ট স্যুভেনির কিনলাম আমি পাঁচটি আমাদের সবার জন্য। কনসার্টের তারিখ সহ ছোট্ট ব্যাজ যার দাম ছিল মাত্র দুই ডলার করে। আমি সব সময় চেষ্টা করি এমন কোনো এক্সপেরিয়েন্সের একটা হলেও স্যুভেনির রাখতে।

কনসার্ট ভেন্যু থেকে বের হয়ে আমাদের প্রধান কাজ আমাদের ট্যাক্সি ড্রাইভারকে খুঁজে বের করা। ইশিতার মোবাইলে একটু চার্জ ছিল। ট্যাক্সি দেখে আমরা বুঝলাম ক্যানো পাঁচশো ডলার ভাড়া। একটা সেভেন সিটার বিএমডব্লিউ। ফেরার পথে দারুণ ক্ষুধার্ত আমরা থামলাম একটা সাবওয়ের ম্যাকডনাল্ডসে। ভরপেট বিগ ম্যাক আর কোলা খেয়ে আমাদের ভার্সিটির কটেজে ফিরতে বেজে গেল প্রায় রাত তিনটা। সবাই যার যার কটেজে চলে গেলাম পরেরদিন সকালে ওঠার তাড়া নিয়ে। তবে আমি ঘুমাতে অনেক সময় নিলাম, কারণ মাথায় ঘুরছিল পার্ল জ্যামের অসাধারণ পারফরম্যান্স। হঠাৎ এই দারুণ কনসার্ট এক্সপেরিয়েন্স আমার জন্য এক সারাজীবনের সঞ্চয়।

এই কনসার্টে পার্ল জ্যামের লাইন আপ ছিলো নিম্নরূপ –

জেফ অ্যামেন্ট – বেজ গিটার

ম্যাট ক্যামেরন – ড্রামস

স্টোন গোসার্ড – রিদম ও লিড গিটার

মাইক ম্যাকরিডি – লিড গিটার

এডি ভেডার – লিড ভোকাল ও গিটার