You are currently viewing স্বাধীনতার তিরিশ বছর > মেহনাজ মুস্তারিন 

স্বাধীনতার তিরিশ বছর > মেহনাজ মুস্তারিন 

স্বাধীনতার তিরিশ বছর

মেহনাজ মুস্তারিন 

অনেক যাত্রী পেটের মধ্যে নিয়ে বাসটা থমকে আছে অনেকক্ষণ ধরে। আগেপিছে অসংখ্য বাস। দেখে মনে হবে যেন পিপিলিকার দল পিলপিল করে হাঁটছে। ছোট্টবেলায় বাবার কাছে শোনা গল্পগুলোর মধ্যে পিঁপড়ার গল্প ভীষণ আকৃষ্ট করতো আমাকে। সারিবদ্ধভাবে ওদের চলাফেরা সংগ্রাম আর একতাবদ্ধতার কথা বাবা এত চমৎকারভাবে বলতেন যে বারবার শুনতে শুনতে সেই ছেলেবেলাতে আমার কেন জানি খুব পিঁপড়ে হতে ইচ্ছে করতো। কত গল্প শুনে যে ছেলেবেলা কেটেছে ভাবতে বসলে খুউব ভালো লাগে!  অনেক কথা মনে দাগ কেটে গেছে আবার  ভুলেও গেছি কতকিছু। ছোট আর কচি মস্তিষ্কে যতটুকু নেয়া যায় আর কী!  দিন যত গেছে গল্পের ধরণ বদলেছে, বদলে গেছে জীবন। বাবার সাথে আমার গল্পের  শেষ ছিল না।  বড় হবার পথে বাবা বন্ধু বেশে ধরা দিয়েছিলেন। আমরাও বাবার খুব কাছে চলে এসেছিলাম। চুপিচুপি বলে রাখি, আমি ছিলাম তাঁর সবচে কাছের মানুষ; মা বলেন ‘বাবা নেওটা মেয়ে!’ সত্যি তাই। কোনকিছু জানতে চাইলে বাবা বিরক্ত হয়েছেন বা বলেছেন ব্যস্ত আছি পরে এসো, এমনটা কোনদিনই হয়নি। বরং হাতের কাজ ফেলে রেখে হলেও আমার প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন সবসময়। যেকোন বিষয় নিয়ে যেকোন সময় তাঁর কাছে গেলে ভীষণ খুশি হতেন। আর সেই বোঝানোটা ছিল আদ্যপান্ত। আমি মুখ হা করে গালে হাত দিয়ে মুগ্ধ হয়ে শুনতাম। কতটুকু-বা বুঝতাম; কিন্তু ভাব দেখাতাম যেন সবকিছু যেভাবে বাবা চাইতেন সেভাবেই বুঝতে পেরেছি ষোলআনা।

 

বাবা আমাকে পেয়ে বা আমার সাথে কথা বলে যতটা আনন্দ পেতেন,  ততটাই বিরক্ত হতেন মা। কেনই-বা হবে না আমাকে বলেন তো? মা হয়তো বাবার সাথে কোন সাংসারিক বিষয় নিয়ে বসেছে, ঠিক সে সময় আমি হাজির। আর বাবাও তক্ষুনি বসে যেতেন বোঝাতে। ছোটবেলায় না বুঝলেও একটু বড় হতেই বুঝতে শুরু করি বাবা সংসারের প্রতি একটু উদাসীন।  কোথায় কী লাগবে, কীভাবে সেটা ম্যানেজ হবে সবকিছুই দেখতেন মা। তাই মার রাগ করাটা আমরা সকলেই মেনে নিতাম। সংসারে সুখ ছিল; কিন্তু, অভাব অনটনও লেগেই থাকতো। মা অসাধারণ দক্ষতায় সব পরিস্থিতি সুন্দরভাবে সামলে নিতেন। জানি না কোন জাদুতে কীভাবে সামলাতেন এখনও মাথায় আসে না আমার।

 

সংসারে তখন পাঁচজনের বসবাস। বাবা ছোট্ট একটা সরকারি চাকুরি করতেন। ভূমি রেজিস্ট্রি অফিসে কেরানির চাকুরি, কী এমন বেতন! ভাগ্যক্রমে জুটেছিল সেই-বা কম কী! বাবার মতো অন্তর্মূখী একজন মানুষ যে চাকুরি করতে রাজি হয়েছেন, তার সবটুকু কৃতিত্ব বেলাল কাকুর। নিশ্চয়ই বুঝে গেছেন যে, তিনি বাবার খুব কাছের বন্ধু। জীবনের দুঃসহ সময়গুলো দু’জন এক সাথেই কাটিয়ে ছিলেন। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন থেকে ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান, তারপর মুক্তির লড়াই,  স্বাধীনতা অর্জন এবং সবটাতেই তাঁরা পাশাপাশি ছিলেন— একসাথে, একই মতে, এবং একই পথে। স্বাধীন দেশে নানা অরাজকতা আর বিচ্ছিন্নতা সত্ত্বেও বেলাল কাকু ঠিকই একটা ভালো চাকুরি জুটিয়ে নিয়েছিলেন; কিন্তু, বাবা রয়ে গেলেন একই নিষ্ঠা আর আদর্শ লালন করে। আমার মনে আছে, তখন থেকেই বাবার সাথে একটা দূরত্ব তৈরি হয় কাকুর। এটা অবশ্য বুঝেছি একটু  বড় হওয়ার পরে। বাবা তখনও বেকার। পড়াশুনা সেই ইন্টারমিডিয়েট পর্যন্ত, এরপর দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবন। যুদ্ধ শেষে  ফিরে এলেন। সংসারে চালচুলো কিছুই ছিল না; শুধু শুষ্ক ভিটেমাটিতে অসহায়ের মত দাঁড়িয়ে ছিল জীর্ন একটা বাড়ি। গাছ নাই, কোন প্রাণ নাই, শূণ্য হাতে যাত্রা।  সংসারে ছিল  একমাত্র সন্তান, নাম বিপ্লব। মুক্তির ডামাডোলে অনেক বাচ্চার ঘাড়ে এই নাম চেপে বসেছিল তখন। ওর বয়স তখন সবে এগার মাস। ছোট শিশু সন্তানকে নিয়ে যেন এক নতুন যুদ্ধ। সে সময়ের কথা বলতে গেলে বাবা কেমন যেন নির্জনতার মধ্যে লুকিয়ে পড়তেন। এলাকাবাসী তাঁর দুর্দশা দেখে একরকম জোর করেই মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেট হাতে ধরিয়ে দিয়েছিল। সেটা দিয়ে চেষ্টা কম করা হয়নি; কিন্তু, কে দেবে চাকুরি? যুদ্ধের পরে দেশের যে অবস্থা!  যে যা পারছে তাই করছে। আখের গুছিয়ে নিতে সে সময় অনেকেই মুক্তিযোদ্ধা বনে গেছে, যে যত নিজেকে  তুলে ধরতে পেরেছে, সেই কিছু না কিছু বাগিয়ে নিয়েছে। বাবা সেগুলো আমলে নেননি কখনো। অভাবের সংসারে তাই বরাবর টিকে থাকার সংগ্রাম করে যেতে হয়েছে। মা সেই পরিস্থিতি মানতে রাজি ছিলেন না। বাবার পাশাপাশি তাকেও কম সংগ্রাম করতে হয়নি। যুদ্ধের শুরুতে বিপ্লব ছিল মাত্র দুই মাসের। ছোটো সন্তানকে নিয়ে মা কোথায় ছিলেন কী অবস্থায় ছিলেন কীভাবে কাটিয়েছেন, বাবার পক্ষে সেগুলোর খোঁজ নেওয়া সম্ভব হয়নি। দেশ স্বাধীন করার যে ব্রত তাঁদের ছিল, ইচ্ছে থাকলেও সুনির্দিষ্ট করে নিজ পরিবারের খোঁজ নেওয়া সম্ভব ছিল না। মা বিষয়টা দেখেছেন একেবারে ভিন্ন দৃষ্টিতে। তাঁর কথা, ‘যুদ্ধ করে দেশ উদ্ধার করছ ঠিক আছে; কিন্ত, এত এত পরিবার, তাদেরও বাঁচার অধিকার আছে’! ক্ষতের মতো সেই পুরোনো স্মৃতি আজও তিনি বয়ে বেড়ান। যে মানুষটা জীবন বাজি রেখে দেশের জন্য এত করলেন, একটা পা পর্যন্ত খোয়াতে হলো, তার পরিবার এত সংগ্রাম কেন করবে? সহজ এই প্রশ্নের জবাব মা’র কাছে ছিল না। বাবা প্রাইভেট পড়াতেন, সেটা দিয়ে কতটুকেই বা হয়? বাকিটা মা চালাতো, সেলাই ফোড়াই এটা-সেটা করে। এমন জীবনযুদ্ধে হঠাৎ একদিন সূর্য যেন স্বস্তি নিয়ে জেগে উঠলো।

সেই বিকেলের কথা বলি। আমি কী করছিলাম, দাঁড়ান মনে করি…; আরে ধ্যাত কী করছিলাম সেটা দিয়ে কী হবে, কী ঘটেছে সেটাই বলি। হঠাৎ দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ। এমন সময় কেউ তো আসে না। দরজা খুলতেই দেখি মধ্যবয়সী একজন মানুষ। আমার বুঝতে বাকি রইলো না যে, ইনি বেলাল কাকু। না হয়েই পারেন না। বাবার কাছে ওনার এত গল্প শুনেছি যে প্রথম দেখাতেই মনে হলো যেন কতদিনের চেনা। আমি যে জ্বলজ্যান্ত একটা মানুষ দরজার সামনে, সেদিকে খেয়াল নাই, তাঁর দুচোখ শুধু বন্ধুকে খুঁজে বেড়াচ্ছে। জিজ্ঞাসা,“এটা রাশেদের বাড়ি না?”

আমার হতভম্ব অবস্থা কাটাতে কাটাতে বললাম, “জ্বী।”

“তুমি নিশ্চয়ই রাশেদের মেয়ে?” তিনি জানতে চাইলেন । পরিচয়টা তিনি তখনও দেননি, এটা আমার অনুমান যে, আগুন্তুক বেলাল কাকুই হবে। তো আমার মুখের চারপাশে চোখ ঘুরিয়ে খানিকটা অবাক হয়ে বললেন, “তোমার বাবার পুরো মুখটা তুমি পেয়েছ। আমি তোমার বেলাল কাকু।” তারপর দেখলাম, বেশ গভীরভাবে তিনি আমার কপালের দিকে তাকিয়ে আছেন, সেখানে একটা লাল টিপ জ্বলজ্বল করছিল, সেটার দিকে ইংগিত করে তিনি বললেন, “হুম! লাল টিপে খুব মানিয়েছে তোমাকে!”

এবার বুঝলেন তো যে, যা ভেবেছিলাম তাই, ইনি বেলাল কাকুই। অনুমানের সত্যতা প্রতিষ্ঠা পাওয়ায় আমার হতভম্ব অবস্থাটা বেশিক্ষণ স্থায়ী হল না। তা সত্ত্বেও, আমি তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলাম, যেন কত আপন! কতবার দেখেছি! চকচকে চেহারা দেখে মনেই হচ্ছে না উনি বাবার বন্ধু! অথচ একই বয়সি উনারা! যাহোক, কাকুকে নিয়ে ভেতরে গেলাম। বাবা তখন পুরনো একটা বই-এ মুখ গুজে বসে আছেন। কাকু বেশ গলা উচিয়ে বললেন, “কী রে রাশেদ এখনো বই নিয়ে!”

বাবা ঘোলাটে চোখে চশমাটা উঁচিয়ে তাকালেন। অবাক হওয়ার কোন চিহ্ন তার চেহারায় খুঁজে পাওয়া গেল না। নির্লিপ্ত চাহনি ধরে রেখে তিনি বললেন, “এটাই তো পরম বন্ধু যে কখনো ছেড়ে যাবে না।” তারপর পাশেই বসার জায়গা করে দিয়ে বললেন, “এখানেই বস, তোর বোধহয় একটু কষ্ট হবে।” কাকু সহজভাবে বাবার বিছানায় বসতে বসতে বললেন, “কী যে বলিস!” এরপর  ডান পা ভাঁজ করে পাছাটাকে তার উপর চাপিয়ে সহজ স্বাভাবিকভাবে বসে পড়লেন।

বাবা ইশারা করলেন– ‘দেখ কাকুকে কিছু জল খাবার দিতে পার কি না’। কেন জানি সে মুহূর্তে তাদের এতটুকু কাছ ছাড়া হতে ইচ্ছে করছিল না; দুই বন্ধুর অভিমান, জমানো গল্প শোনার জন্য ব্যাকুল হয়ে ছিলাম। অনিচ্ছা নিয়ে ভেতরে গেলাম। মা ততক্ষনে খবর পেয়ে গেছেন, ছোটু, অর্থাৎ, আমার ছোট ভাই স্বাধীন মা’র কাছে খবরটা পৌঁছে দিয়েছে। তাঁর মনোযোগ নাস্তা বানানোর দিকে। এই সুযোগে মা’র কথা একটু বলি। আমি না মাঝে মাঝে খুব অবাক হয়ে ভাবি অভাবের সংসারে কীভাবে এমন চমৎকার বুদ্ধিমত্তা দেখাতে পারেন একজন মানুষ।  আশ্চর্য লাগে! মা ঠিকই কাকুর জন্য লতাপাতা দিয়ে একটু বড়া, আলুর চপ, চিড়া ভাজা,আর ডিমের ঝুরি বানিয়েছিলেন। আমার নিজেরই জিভেয় জল আসার মতো অবস্থা। কাকু বেশ তৃপ্তি নিয়ে খেতে খেতে বললেন, “ভাবি আপনার রান্নাও খালাম্মার মত হয়েছে। ইস! খালা বেঁচে থাকতে কত জ্বালাতন করেছি, খালার কাছে কত আবদার ছিল বন্ধুদের। মনে আছে রাশেদ?”

বাবা একগাল হেসে অনেকটা সময় পেছনে ফিরে গেলেন, স্মৃতি তখন তাঁকে হয়তো সেই সময়ে ফিরিয়ে নিয়ে যায়,  স্মরণের গভীর থেকে উঠে আসে বাবার চোখের জল । বাবার চোখ দুটো চিকচিক করছে দেখে নিজেকে সংবরণ করতে পারিনি সেদিন, অবলিলায় গড়িয়ে পড়েছিল পানি।

পুরোনো জল কীভাবে নতুন জলের জন্ম দেয়, এটা কিছুতেই আমার মাথায় ঢোকে না। বাবাকে জিজ্ঞেস করব, সেই সুযোগটাও পাই না। আমার মনেই থাকে না। শুনেছি সাগরের বুক থেকে জলরাশি বাষ্প হয়ে উড়তে উড়তে হাজার মাইল পথ পাড়ি দিয়ে পর্বতের চুড়ায় জমাট বরফরূপে আশ্রয় নেয়, আর যখন মন চায় তখন নিজেকে গলায়। ঢুকঢুক করে চলতে থাকা বাসের মধ্যে আমার চোখের জলে সেই বরফ গলা চক্রের কথা মনে পড়ে গেল হঠাৎ করে। দেখি আশেপাশের দু’একজন আমার দিকে তাকিয়ে আছে। তাদের দৃষ্টিতে বিস্ময়! এ যে চোখের জল দেখে নয়, সেটা বুঝতে বেশিক্ষণ লাগলো না। ওরা আমার চোখের দিকে না, বরং কপালের টিপটার দিকে তাকিয়ে আছে! গাড়ি ভর্তি মানুষ, যে কয়জন মেয়ে চোখে পড়লো কারো কপালে টিপ নাই। টিপ আমি বরাবর পরি, নতুন তো না। তবে কি টিপ আমার কপালে বেমানান লাগছে? মনের ভেতর এত খচখচ করছে কেন? বাবাকে মিস করতে থাকলাম। টিপ পরাটা তাঁর খুব পছন্দের ছিল। মাকে টিপ পরানোর জন্য মাঝেমধ্যেই জেদ করতেন, বলতেন, ছোট একটা বিন্দুর কী অসীম দম্ভ, সে সূর্যের সাথে করে লড়াই! বাবার কথার আগামাথা কিছুই বুঝত না আমার মা। তবুও, মাঝেমধ্যে, বিশেষ করে কারো বাড়িতে বেড়াতে যাবার সময় কপালে কাজলের একটা টিপ এঁকে নিতেন। তাতেই বাবার চোখের ভাষা বদলে যেতো। পরে যখন আমি টিপ পরা শুরু করি, বাবার সেকি আনন্দ। আনন্দের ঠেলায় আমাকে জড়িয়ে ধরতেন, বিশেষ করে যেদিন লাল টিপ পরতাম। লাল টিপের মধ্যে কী দেখতেন আল্লাই জানে। বাসভর্তি মানুষের দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ আগে যে বিস্ময় দেখেছিলাম, এবার সেখানে দেখি হিংস্রতা। তারা যেন বিদ্রুপ করছে। মনে মনে বাবাকে ডাকলাম, তিনি কি বরাবরের মতো এবারও বুকের সাথে জড়িয়ে নেবেন! কপালের টিপটায় হাত ছোয়াবেন? নাকি বাবা বাবা বলে চিৎকার দিলেও সাড়া দেবে না; দেখবে না তার মেয়ে কতদূর থেকে ছূটে এসেছে তার কাছে। বাসটা কেন এত আস্তে চলছে বুঝতে পারছি  না। বাবার নিথর দেহটার মত গাড়িটাও যেন স্তব্ধ। কোন কথা নাই, কোন গল্প নাই। সব গল্প যেন পেছনে লুকোচুরি খেলছে।

দুই মাস  আগের কথা। চাকুরি পাবার পর সেটাই প্রথম বাড়িতে আসা। তো আসবার সময় বাবার জন্য তাঁতের পাঞ্জাবি, মার জন্য একজোড়া শাড়ি, দুই ভাই এর জন্য পোশাক। বাবা মিষ্টি হেসে বললেন ‘কেন এত খরচ করেছিস?” কিন্তু সেদিনই গোসল সেরে পাঞ্জাবি পরে বললেন, “দেখতো কেমন লাগে!” চুপিচুপি দেখেছি তাঁর মুখে পরিতৃপ্তির হাসি! স্মৃতিগুলো আজ এলোমেলো ভাবে একটার সাথে আরেকটা কেমন যেন মিশে যাচ্ছে। তো সেদিন যখন বাবার বন্ধু বারবার বলছিলেন, “রাশেদ কেন তুই ওভাবে নিজেকে গুটিয়ে রাখিস বলতো?  নিজে কষ্ট পেলি পরিবারকেও খুব ভোগালি। এত নীতি নৈতিকতা দিয়ে কী হবে বল’? বাবা সেদিন কোন তর্কে যাননি। নিরবে সবকিছু শুনে গেছেন। বেলাল কাকুর সেদিকে ভ্রক্ষেপ নাই। তিনি বকেই চলেছেন, “শোন, তোর জন্য ছোটখাটো একটা কাজ জোগাড় করেছি। অনেক কষ্টে, এবার কিন্তু না করিস না। এর আগে বেশ কয়েকবার ফিরিয়ে দিয়েছিস । বিশ্বাস কর তোর আদর্শের কেউ কী বেঁচে আছে এ দেশে? নাই। নিশ্চিত বলতে পারি আমি। বেতন যা পাবি ছেলে মেয়ে নিয়ে খেয়ে পরে চলে যাবে দিনক্ষণ। বাড়তি টাকা এখানেও আছে  কিন্তু তোকে তো চিনি সে পথ তুই মাড়বি না আমিও বলবো না।  দেখ মেয়েটা বড় হচ্ছে ছেলে দুটোকে মানুষ করতে হবে। সামনে কত কাজ তোর।ভাবীকে আর কষ্ট দিস না।” বাবা আমার চোখে চোখ রেখে বললেন, “যাও মাকে ডাকো।” মা হয়তো আড়ি পেতেই ছিলেন ডাকা মাত্র ছুটে এলেন আর বাবার দিকে না তাকিয়ে কাকুকে সিদ্ধান্ত দিয়ে দিলেন বিন্দুমাত্র তোয়াক্কা না করে। বাবা নির্জীব বসে ছিলেন চুপটি করে ।

এরপর কয়েকটা বছর কেটে গেছে। আমাদের জীবন যাপনের পরিবর্তন বলতে বাড়িটা মাটির গাথুনি দিয়ে ইটের দেয়াল উপরে টিন। যাহোক  সংসার কেটে যাচ্ছিল কোন রকমে। সংসারে আয় না বাড়লেও খরচ কিন্তু ততদিনে বেড়ে গিয়েছিল। বাবার ইচ্ছে ছিল আমরা শত কষ্টেও যেন পড়াশোনা  না ছাড়ি। এরই মধ্যে  সমাজের চিত্র বেশ পাল্টেছে। পড়ার খরচ হু হু করে বেড়ে গেছে। অবস্থাশালীরা প্রাইভেট কোচিং করতে পারছে, ভালো রেজাল্ট নিয়ে তারা ভালো জায়গাগুলো দখল করছে। সেই সাথে প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানগুলো গজিয়ে উঠেছে ধনীর ছেলেমেয়েদের জন্য। পিছিয়ে পড়ছে সাধারণ খেটে খাওয়া ঘরের সন্তানরা।কারণ শিক্ষা এখন অনেকটা পুঁজি নির্ভর হয়ে গেছে।  ধাক্কা খেতে খেতে বড় ভাই বিপ্লব কোন রকমে ইন্টার শেষ করে ঘরে বসে আছে অনেকদিন। আমি যখন ইন্টার ফাস্ট ইয়ার, তখন যথেষ্ট বুঝতে শিখেছি জীবনযুদ্ধ কাকে বলে! তবুও বাবার সততা রন্ধে রন্ধে লালন করার চেষ্টা করেছি। বাবাকে অনেক যন্ত্রণা বুঝতে দিতে চাইতাম না আমি। বড় ভাই বিপ্লব ছেলে মানুষ বাইরে বাইরে ঘুরত, কাজেই বাবাকে বিভিন্ন পরিস্থিতিতে এটা সেটা বলে দিতে দ্বিধা করত না। আমি আবার সেগুলো ঠিক সামলে নিতাম। আর স্বাধীন বেশ খানিকটা ছোট বলে এসবের কিছুই বুঝতো না। তারপরও বলা যায় বাবার ব্যক্তিত্ব চোখে আলো জ্বালিয়ে দিয়েছিল আমাদের। যদিও কষ্ট পেতাম; কিন্তু, ভালো মন্দের তফাত আমরা সকলে বেশ অনুভব করতাম।

সে কারণেই হয়তো কোনদিন সেভাবে নিজেদের প্রকাশ করিনি আমরা। খুব সাধারণ সাদাসিধা জীবনের সাথে মানিয়ে বড় হবার চেষ্টা করেছি। কিন্তু সত্যি বলতে কী যখন চাহিদা মত অনেক কিছুই পেতাম না, খুব মন খারাপ হতো। অসহায় লাগতো, মনে হতো, বাবা সবার চেয়ে আলাদা কেন? একই অফিসে চাকুরি করতেন মতিন কাকু; তাঁর মেয়ে মিলা আমার সাথেই পড়তো। ওকে দেখতাম নতুন নতুন পোশাক খাওয়া দাওয়া সাজসজ্জা সবকিছুই স্বচ্ছলতার প্রকাশ। ভাবতাম কত ভালো আছে ওরা। ধীরে ধীরে যতই বড় হলাম, চিন্তার যাত্রাও আমার সাথে এগিয়ে গেল! বুঝলাম কোথায় থেকে আসে মতিন কাকুর বাড়ির এতকিছু। বাকী যারা বাবার সহকর্মী ছিলেন সকলের জীবনযাপন দেখলে মনে হতো অনেক বড় পদে আছেন তাঁরা। বিশ্বাস হতো না বাবা আর ওনাদের পদ একই! বাবার কলিগদের পরিবার বা ছেলেমেয়েদের সাথে আমাদের সেভাবে সখ্যতা গড়ে উঠেনি। এটা নিয়ে মা’র আফসোসের শেষ ছিল না। মা বলতেন, ”কেন এমন হলো? আমরা তো চেয়েছিলাম একটা চমৎকার সমবন্টনের দেশ হবে! অধিকার আদায়ের জন্য এত বড় যে আত্নত্যাগ, সেটা কোথায় গেল!” বাবা নির্লিপ্ত! তুমি কী কোন প্রশ্নের জবাব খুঁজছ বাবা, আমাকে বলবে? আর বলেছ! উদাস চাহনি দেখে বুঝতে পারতাম তাঁর কাছে কোন উত্তর নাই। তবু্ হাল ছেড়ে দেয়ার পাত্র তো নন তিনি।  মাঝে মাঝেই আমাদেরকে একত্র করে তাঁর গম্ভীর গলা শুনাতেন, আর আমরা আমাদের কানকে শুনতে দিতাম একই কথা বারবার,  “সততার শক্তি এমনই বুঝেছ বুক ফুলিয়ে চলা যায়! কোথা থেকে যেন একটা শক্তি আসে, অদ্ভুতভাবে সামলে নেয়া যায় সবকিছু।” কথার ফাঁকে মা হয়তো চলে আসতেন, ইশারায় বুঝাতেন নিজের মাথা তো খেয়েছ, এবার বাছাধন বাচ্চাদের মাথাটাকে একটু ছাড় দাও। তো বক্তার আসন থেকে বাবা তখন এক চুল নড়তে রাজি না। বলেই যেতেন, ”সৃষ্টিকর্তা সৎ মানুষের পাশে থাকেন সারাক্ষণ।” মা কিন্তু বাবার কথাগুলো শুনেও শুনতেন না। বাবাকে থামাতে তিনি যুক্তি দিয়ে বলতেন, ”তাহলে দেশের জন্য এত আত্নত্যাগ মানেই কি চেয়ে থাকা আর নানা অরাজকতার মুখোমুখি হওয়া! কোথায় গেল আদর্শ। কোথায় সাধারণ মানুষের জন্য ভাবনা! সৎ, সাধারণ মানুষজন কি এভাবেই ক্রমশই এক ঘরে হয়ে যাবে? কষ্টই  সয়ে যাবে? সবকিছু বিসর্জন দিয়ে শেষে এই ফল!” বাবা কিছু শুনতেন কিনা বোঝা যেত না।

গাড়ির কাঁচ কেমন যেন ঘোলা লাগছে হয়তো ব্যথাগুলো ওখানে জমাট বেঁধে আছে । সেই আবছায়া জানালা দিয়ে তাকিয়ে আছি সুদূরে। দেশটা আমাদের বড়ই সুন্দর! সবুজ মাঠ কত ধরনের ফসল। ডোবা নালায় ফুটে আছে অসংখ্য শাপলা, কত ধরনের  পাখি উড়ে যেতে দেখছি। দু’একটা একচালা বাড়ির মাচায় কুমড়ো ঝুলে আছে! আউড়ের পালায় পিচ্চিদের দাপাদাপি। মাঠে কৃষকের পরিশ্রমের চিত্র। আজ এগুলো  মুগ্ধতা নিয়ে দেখার কথা কিন্তু আমার ঘোটালে দৃষ্টি আর শুধুই খুঁজে চলেছে প্রকৃতির ভেতরে মমত্ব। দেখছি সবুজ মাঠ আর আকাশের নীলের আজন্মের বন্ধুত্ব। ছুটে যাওয়া গাড়ির কাচ দিয়ে প্রকৃতি দেখতে দেখতে আমার চিন্তাও ছুটে চলেছে দিগন্তে। নীল আকাশে ভেসে বেড়ানো মেঘের ভাজে বাবার মুখটা যেন জ্বলজ্বল করছে। কিন্তু আমি কেন পরিস্কার  দেখতে পাচ্ছি না সেই একান্ত মুখটা? তাহলে কি  চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে বারবার? বুঝতে পারছি, স্মৃতিগুলো বুকটাকে মোচড়িয়ে দিচ্ছে। পাশে এক মধ্যবয়সি মহিলা অনেকক্ষণ ধরে তাকিয়ে আছে, বোঝার চেষ্টা করছে কিছু একটা। অবশেষে বলেই বসলো, ”কোথায় যাবে?”

আমি তার মুখের দিকে না তাকিয়ে বললাম, ”কুষ্টিয়া।”

: কী হয়েছে বাছা?  কাঁদছ ক্যান?

: আমার বাবা আজ আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন।

উনি আমার কপালের জ্বলজ্বলে লাল টিপের দিকে তাকিয়ে থাকলেন। হয়তো ভাবছেন নিশ্চয় হিন্দুঘরের বউ, নইলে বাবা মরার পরেও টিপ কেন কপালে!  এত শখ!  আমি সজাগ হয়ে আবারও স্পর্শ করলাম আমার কপাল। টপ টপ করে ঝরে পড়লো পানি। কেন জানি কিছুই বলতে ইচ্ছে করছিল না আমার। শুধু কিছু চাহনি আমাকে সংকুচিত করে ফেলছিল। আমি মিশে যাচ্ছিলাম অন্তরের গহীনে! আকাশের দিকে তাকিয়ে  চোখ বন্ধ করলাম।

গতবছর অফিস থেকে  ফেরার সময় বাবা হঠাৎ করে পড়ে যান। ডাক্তার বললেন, একপায়ে চলাফেরা করতেন বিধায় পায়ে বেশ প্রেসার নিতে হয়েছে। শরীরও দূর্বল, পুষ্টির ঘাটতি আছে, সবমিলিয়ে শরীরের লোড নিতে পারছেন না। উনার এখন রেস্ট নেওয়া দরকার। কাজেই বাবা আগে ভাগেই অবসর নিয়ে নেন। এদিকে মা’র অসুস্থতাও অনেকদিনের। নানারকম শারীরিক মানসিক ক্ষয়ে মানুষটা  জীর্ণ। বলতে গেলে পরিবারে তখন দুজন অক্ষম মানুষ। রুটি রোজকার একেবারে কম। বাবার এককালিন অল্পসল্প টাকা দিয়ে কোন রকমে মাথার উপর ছাদটা যেন  ঝড়-ঝঞ্জা থেকে রক্ষা করেছিল। এদিকে আমার ইন্টার পরীক্ষা, ফরম ফিলাপের জন্য বেশকিছু টাকা লাগবে; কিন্তু, কোথা থেকে আসবে? দু’জনের ঔষধ, বাজার খরচ এটাসেটার পর হাতে কিছুই থাকে না। মা ভাবলেন, যেকোন ভাবে আমার একটা বিয়ে দিতে পারলে চিন্তা লাঘব হবে। ওই বয়সে বিয়ে হোক বাবা সেটা কখনোই চাননি। সব সময় বলতেন ”মেয়ে তো কী হলো! দেখো একদিন কোথায় পৌঁছে যায়।” সত্যি বাবা এমন বিশ্বাসযোগ্য করে বলতেন যে, আমি নিজেকে  নিয়ে আশ্চর্য সব স্বপ্ন দেখতে বসতাম। মা সেসব আমলে নিতেন না। বলতেন “দেখ এখন সুন্দর হয়ে উঠেছে, এ সময় বিয়ে দিলে পাত্র পাওয়া যাবে, খরচ কম হবে।” ইত্যাদি ইত্যাদি। তো সত্যি-সত্যি বিয়ের হিড়িক পড়ে গেল। দেখতে এসে যেন তক্ষুনি বিয়ে হয়ে যাবে এমন ভাব!  কিন্তু, যখন লেনদেনের কথা উঠতো কোথায় যেন তাদের আগ্রহ হারিয়ে যেত! এমন ঘটনার মুখোমুখি হতে হয়েছে বেশ কয়েকবার। সেই ডামাডোলে ইন্টার পরীক্ষা দেয়া হলো না। মা’র মুখের দিকে তাকানো যেত না। আর বাবার চোখ থেকে পালিয়ে বাঁচতে চাইতাম। সবচেয়ে খারাপ লাগতো এটা ভেবে যে মানুষটার এত আত্নবিশ্বাস, দৃঢ়তা আর মনোবল, তিল তিল করে সব হারিয়ে যাচ্ছে। উপায়ন্তর না দেখে বড় ভাই কাজের সন্ধানে ছুটোছুটি করতে শুরু করলো। ইন্টার পাসের কী এমন চাকুরি? ভেবেছিল, বাবা মুক্তিযোদ্ধা কিছু একটা ঠিক জুটে যাবে। বেশ কিছুদিন পার্টির নেতাদের সাথে ঘোরাঘুরিও করলো । আমি জানতে চাইলে বলতো, “বাবাকে কিছু বলিস না, উপায় নেই বুঝলি। এদের হাতে পায়ে না ধরলে কাজ পাওয়া সহজ হবে না।” তো এভাবে বছর খানেক ঘোরার পরে ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে এলো। বাবার এক প্রাইভেটের ছাত্র তার গড়ে তোলা হাইস্কুলে বড় ভাইয়ের জন্য একটা চাকুরির ব্যবস্থা করে দিল। অফিস সহকারি। বেতন অল্প হলেও মানসন্মান বাঁচলো যেন। ভাই বললেন, “দেখ বসে না থেকে ইন্টার কষ্ট করে শেষ কর, কারণ স্বাধীন আছে ওকে তো পড়াতে হবে। আমার একার রোজগারে কি হবে?”

এভাবেই কেটে যাচ্ছিল। একসময় পরীক্ষা দেবার সিদ্ধান্ত নিলাম, যথারীতি উতরেও গেলাম।

সেসময় বাবা কোথাও তেমন বেরুতেন না। বলতে গেলে ঘর বন্দি। বই পড়ে সময় কাটিয়ে দিতেন। আগের মতো গল্প বা নানা বিষয়ে কথাও তেমন বলতেন না। সত্যি বলতে আমরা নিজেরাও বাবাকে তেমন সময় দিতে পারতাম না। জীবনের বাস্তবতায় ছুটে চলছিলাম সম্মুখে। বিপ্লবের বেতন যৎসামান্য। তাছাড়া কিছুদিন পরে যখন সে তার নিজের সংসার করবে, তখন এই পরিবারের দায়িত্ব সে কীভাবে মাথায় নেবে!  এসব চিন্তা থেকে নিজেও চাকরির চেষ্টা করতে শুরু করলাম।

বেলাল কাকুকে একদিন পরিবারের কথা, বাবার কথা, মার অসুস্থতার কথা জানালাম। তিনি যতটুকু পারেন চেষ্টা করেছেন আমাদের জন্য। তো কাকু বললেন, ”তোমার চাকরি পাবার ব্যাপারে চেষ্টা করতে পারি, কিন্তু সেটা তো ঢাকায়। বাবাকে ছেড়ে থাকতে পারবে?” তারপর বেশ খানিকটা সময় নীরব থাকার পর বললেন, ”আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করব, বাকীটা আল্লাহ ভরসা।”

সেদিন বুকে চাপা দেওয়া বড় একটা পাথর যেন নেমে গেল।

একদিন সুযোগ বুঝে বাবাকে বললাম, ”বাবা, ঢাকায় একটা চাকরির চেষ্টা করছি তুমি যেতে দেবে তো?”

বাবা আমার মুখের দিকে তাকিয়ে শান্ত গলায় বললেন, ”কেন নয়? এত এত মেয়ে যদি দেশের জন্য আত্নত্যাগ করতে পারে তবে তুমি কেন নিজের জন্য পরিবারের জন্য পারবে ন!” বিছানায় শুয়ে শুয়ে বই পড়ছিলেন। উঠে এসে এ-বই ও-বইয়ের মধ্যে থেকে খুঁজে পেয়ে, আমাকে অবাক করে দিয়ে একটা লাল টিপ আমার কপালে পরিয়ে দিতে দিতে বললেন, ”আমার পূর্ণ সমর্থন থাকবে মা!”  আমি বাবার উদারতা জানতাম। এও জানতাম মেয়ে নয় মানুষ রূপে দেখতে চেয়েছেন উনি আমাকে। কিন্তু, আমাকে স্বাধীনতার প্রতীক হিসেবে আমার কপালে লাল টিপ পরিয়ে দেবেন এটা ছিল অবিশ্বাস্য ঘটনা। ঘটনাটা বাবার মুখ থেকেই শোনা। এক আহত মুক্তিযোদ্ধার শরীর থেকে রক্ত ঝরছিল, তিনি বললেন, রাশেদ একটা শাপলা পাতা এনে দিবি। সেটা এনে দিলে সেই ঝরে পড়া রক্ত থেকে একটা ফোটা নিয়ে শাপলা পাতায় দিয়ে বললেন, দেশের কপালে টিপ পরিয়ে দিলাম। মুক্তির টিপ। অনেকদিন পরে অন্ধকার ভেদকরে যেন আলো ফোটা সকাল দেখলাম। বাড়িটা একটু থমথমে। মা খাবার দেবার জন্য হাড্ডিসার শরীরটা টেনে তুলেছেন। ছোট্ট সোনা ভাই স্বাধীন ঘুরঘুর করছে চোখের সীমানায়। বাবার মুখে সেই স্বভাবসুলভ দৃঢ়তা। আজ অবশ্য একটু মলিন। বিপ্লবের যথারীতি একই আচরণ। সে বারবার তাগাদা দিচ্ছে খেয়ে নে, দেরি হয়ে যাবে!  বাবা মাথায় হাত দিয়ে বললেন “আমি যা পারিনি তুই সেটা করলি মা।”

বাবার হাতটা চেপে ধরেছিলাম কী এক আবেগে।

ধীরে ধীরে কপালে হাত ছুঁয়ে বলেছিলেন “বড্ড মায়া তোর কপালজুড়ে বড্ড মায়া এই টিপে।”

বাড়ি থেকে বের হবার সময় পেছন ফিরে একবারও তাকাইনি সেদিন। বাবার মুখটা আজ সারাবেলা মুখের সামনে ভাসছে। আজ একবারও বলেননি একবারও জানতে চাননি আমি কতদূরে এলাম!’ বাবা তুমি ব্যস্ত কোন কারনে!  নাকি অভিমান করে স্বাধীনতার এই ৩০ বছরে তোমাকে চলে যেতে হলো।’ খুব জোরে একটা চিৎকার দিতে মন চাইছে। কিন্তু, বিরত থাকলাম। গাড়ির মধ্যে একাকী এই লম্বা পথে অসীম ধৈর্য নিয়ে অপেক্ষা করছিলাম সেই মুহূর্তের জন্য যখন বাবাকে স্পর্শ করে বলবো, ‘এত অভিমান লুকিয়ে রেখেছিলে তুমি! যাবার আগে একবারও জানতে দিলে না বুঝতে দিলে না ঘুমন্ত তুমি চলে গেলে ওপারে!’

বাসের যাত্রীরা যে যার গন্তব্যে নেমে যাচ্ছে। এখন অনেকটা ফাঁকা। নিস্তব্ধতা আরও ঘন হয়ে আসছে। বিদায়ের কান্না যেন গাড়ির শব্দে ধাক্কা খেয়ে ফিরে আসছে আবারও আমার কাছে।   ভাবছি, অনেক অপেক্ষায় আপনজন তাকিয়ে আছে পথ চেয়ে। আর সেই অপেক্ষার সুখ নিয়ে ফিরছে প্রিয়জন। আমি ফিরছি প্রায় দুইমাস পরে। গার্মেন্টসে ছুটি পাওয়া খুব মুশকিল। সেখানেও প্রতিযোগিতা। কাজের সন্ধানে ছুটছে মানুষ। একজন অনুপস্থিত হলে কিছু এসে যায় না, সেখানে অন্য কেউ ঠিক বহাল হয়ে যাবে। চাকুরির এই দূর্মূল্যে বেলাল কাকু তাঁর এক বন্ধুর গার্মেন্টসে কাজটা পাইয়ে দিয়েছিলেন। সুপারভিশনের কাজ। অল্প সময়ের মধ্যে একটা জায়গা তৈরি করতে সমর্থ হয়েছি। মালিকের পরিচিত হওয়ার একটা বাড়তি সুবিধা আছে। এই যে বাবার মৃত্যুর খবর পেয়ে হুট করে ছুটি পাওয়া, এ কি সম্ভব ছিল? তাছাড়া, নিরাপত্তার ব্যাপারটাও গুরুত্বপূর্ণ, নইলে কাজ করা মুশকিল হত। বাবার কত স্বপ্ন ছিল আমাকে নিয়ে। মাস শেষে বেতন পেয়েই টাকা পাঠিয়ে কথা হত বাবার সাথে মার সাথে ওদের গলার স্বরে তখন একটু ভরসা খুঁজে পেতাম। একটু একটু করে স্বচ্ছলতা ফিরছিল। স্বাধীনের পড়াশোনার দিকে সবচেয়ে বেশি মনযোগী ছিলাম, যেভাবেই হোক ওকে মানুষ করতে হবে। বাবার ইচ্ছে পূরনের দিকটা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। আমরা জানতাম স্বাধীনকে সেজায়গায় দেখলে নিশ্চয়ই বাবার ভালো লাগবে, বড্ড ভালো লাগবে!

চোখ দিয়ে অঝোরে ঝরে যাচ্ছে পানি। দু’হাত দিয়ে চোখের অসহ্য যন্ত্রণা ঢেকে রাখবার অনর্থক চেষ্টা করছিলাম।  মনে হচ্ছিল চিৎকার দিয়ে কাঁদি, ‘বাবা তুমি কেন চলে গেলে!’

সন্ধ্যার আবছায়া তখন চারপাশে। পাশের সিটটা কিছুক্ষণ থেকে খালি। বাস ফাঁকা হয়ে গেছে অনেকটা।  এমন সময় একজন ছেলে এসে বসলো পাশের সিটে। না ভদ্রতা করে জানতেও চাইলো না বসবে কি না। কেমন যেন এক অস্বস্তি আর বিরক্তি কাজ করছে। কিছু যে বলব তারও ‍উপায় নাই। মনের সাথে এতটাই যুদ্ধে লিপ্ত ছিলাম যে, কিছুই বলতে ইচ্ছে করলো না । নিজেকে সংযত করে বসে রইলাম চুপটি করে। দেখলাম, ছেলেটা বারবার তাকিয়ে কী যেন দেখছে। বুঝে উঠবার আগেই  অস্বস্তি যেন ঘিরে ধরেছে আমাকে। এক সময় ছেলেটা বলেই বসলো, “টিপটা জ্বলজ্বল করছে, মনে হচ্ছে আমাকে টানছে!”

অবাক হয়ে তাকিয়ে বললাম, ”আপনি কী বলছেন জানেন?”

“হ্যাঁ, জানি তো। অনেকক্ষন ধরেই জানি। তাইতো চোখের পাতা পড়ছে না আমাদের। এই যে গাড়িতে যে কয়জন আছি সবাই আমরা একমত। তুমি যদি চুপচাপ মুখ বন্ধ রাখো তো ভালো, নইলে জোর করতে হবে।”

বললাম, ”আমি এক্ষুনি নেমে যাবো।” মনে মনে ভাবলাম কিছু একটা ব্যবস্থা ঠিক হয়ে যাবে। আর মাত্র আধাঘন্টার পথ। আল্লাকে ডাকলাম, প্লিজ হেল্প কর খোদা।

ততক্ষণে সামনে দাঁড়য়ে থাকা ছেলেগুলোর বিচ্ছিরি অঙ্গভঙ্গিতে ভীত হয়ে পড়লাম। দেখি ৫/৬ জন নিজেদের মধ্যে কথা বলছে। জানি না কী বলছে, শুধু ইশারা করতে দেখলাম। গলার আওয়াজ বাড়িয়ে দিয়ে বললাম, “আমায় ছেড়ে দিন, আমার বাবা মারা গেছেন, আমাকে তাঁর কাছে যেতে হবে। দোহাই আপনাদের, প্লিজ রক্ষা করুন। আমি একজন মুক্তিযোদ্ধার মেয়ে। সন্মান করুন, দেখুন ভুল করছেন, ছেড়ে দিন ছেড়ে দিন।”

আমার চিৎকার তাদের কান অতিক্রম করে হৃদয়ে আঘাত হানতে সমর্থ হলো না। অথবা, অনেক আগেই তাদের হৃদয় মরে গেছে। দেখলাম, মুহূর্তেই ঝাপিয়ে পড়লো কয়েকজন এক সাথে। কোনকিছু বুঝে ওঠার আগেই আমাকে গাড়ি থেকে টেনে নামালো। বুঝলাম গাড়িতে শুধু পশুরাই ছিল। শ্বাস যেন আটকিয়ে আসছে। ওড়না দিয়ে মুখ বাঁধা। বাবা বলে চিৎকার করছি, কিন্তু মুখে ওড়না পেঁচিয়ে থাকায় কথাগুলো মুখের ভেতরেই মরে যাচ্ছে, আকাশে বাতাসে ভেসে আল্লার দরবারে পৌঁছানোর সুযোগটাও পাচ্ছে না। আমার মনোযোগ তখনও কপালের টিপটার দিকে, ওটা যেন পড়ে না যায় মনে মনে সেটাই বলে চলেছি। বাবা সব সময় বলতেন, “কপালের লাল টিপ আমাদের স্বাধীন পাতাকার বৃত্ত তোর  কপালে বড্ড মানায় সোনা।”

প্রচন্ড শব্দে ভারি হয়ে আসছে চারপাশ, পিঁপড়ে গুলো হেঁটে বেড়াচ্ছে শরীর জুড়ে, পিঠের নিচে শক্ত কিছু অনুভব করছি, ইটের ছোট ছোট টুকরো এখানে ওখানে। আকাশটা ফর্সা হয়ে আসছে, ভোরের সূর্য উঁকি দিচ্ছে কোথাও। একটা দুটো তারা দূর থেকে এখনও তাকিয়ে আছে। মনে হচ্ছে কোন জঙ্গলে পড়ে আছি আমি। স্বাধীনতা তার তিরিশ বছরে পা দিতে যাচ্ছে। সেনানিবাস গুলোতে তোপধ্বনীর শব্দ , নানা আয়োজনে মুখরিত থাকবে আজকের সারাটা দিন, পুরো দেশজুড়ে কত আয়োজন এখানে সেখানে। গরিবরা দু’মুঠো খেতে পাবে ডাল ভাত, এতিমরা মর্যাদা পাবে সবখানে। দেশের প্রতি ভালোবাসা আর দরদে ভরে যাবে পার্টি অফিসগুলো। অফিস আদালত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নানা আয়োজন, সরকারের নির্দেশনা যথাযথভাবে পালিত হবে। শুধু স্বাধীনতার ত্রিশ বছরেও মেয়েরা স্বাধীনতা পাইনি কোনখানে ঘরে কী বাইরে কোথাও না!  হুস ফিরে পেতে কপালের টিপটা স্পর্শ করলাম। নাই! আমি খুঁজতে শুরু করলাম। খুঁজছি, খুঁজছি, হঠাৎ মনে হলো বাবা সামনে দাঁড়িয়ে, হাতে জ্বলজ্বল করছে লাল টিপ। সূর্যের আলো তার কাছে ম্লান হয়ে গেছে।