You are currently viewing স্বপ্নের ছায়াচ্ছন্ন পটভূমি: অ্যালেক্স হ্যালি

স্বপ্নের ছায়াচ্ছন্ন পটভূমি: অ্যালেক্স হ্যালি

স্বপ্নের ছায়াচ্ছন্ন পটভূমি
মূল: অ্যালেক্স হ্যালি
অনুবাদ: মুজিব রাহমান

তরুণদের অনেকেই আমাকে বলে তারা লেখক হতে চায়। এমন তরুণদের আমি প্রায়শই উৎসাহিত করি কিন্তু ব্যাখ্যা করে এ কথাও বলি যে ‘লেখক হওয়া’ এবং ‘লেখালেখি করা’ দুটোর মাঝে বিরাট তফাত। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এই তরুণেরা ব্যক্তিগতভাবে সম্পদ এবং সুখ্যাতির স্বপ্ন দেখে কিন্তু কিবোর্ডের পেছনে একাকী দীর্ঘ দীর্ঘ সময় ঠায় বসে থাকার বিষয়টি আমলে নেয় না। আমি তাদের বলি, ‘তুমি অবশ্যই লিখতে চাইতে পারো, লেখক হবার ইচ্ছে পোষণ না করেও।’
বাস্তবতা হচ্ছে, লেখালেখি এক নিঃসঙ্গ, একান্ত এবং অর্থযোগহীন গরিবি ব্যাপার। সৌভাগ্য  যে-সংখ্যক লেখকের কপালে চুমু খেয়েছে তার বিপরীতে হাজার হাজার জন এমন আছেন যাদের আকাঙ্ক্ষা কখনোই পরিপুরিত হবার নয়। এমন কি যারা সফলতা অর্জন করেছে তাদেরকেও একটা সময় অবহেলা এবং দারিদ্র‍্য সয়ে দীর্ঘ দুরূহ পথ পাড়ি দিতে হয়েছে। আমি পাড়ি দিয়েছিলাম।
ফ্রিল্যান্স রাইটার বা মুক্ত লেখক হবার জন্যে অ্যামেরিকান উপকূল সুরক্ষা বাহিনিতে আমার কুড়ি বছরের ক্যারিয়ার যখন ছেড়ে আসি  আমার সামনে তখন কোন ভবিষ্যৎ  ছিল না। নিউ ইয়র্ক নগরে আমার বন্ধু জর্জ সিমস ছিল যার সঙ্গে টেনেসির হেনিংয়ে আমি বেড়ে উঠেছিলাম। জর্জ আমার থাকার জন্যে একটা জায়গা খুঁজে পেয়েছিল নিউ ইয়র্কের একটা অ্যাপার্টমেন্টের সাফ-সুতরো করা গুদামঘরে যে অ্যাপার্টমেন্ট ব্লকটির সে-ই ছিল তত্ত্বাবধায়ক। অত্যন্ত ঠাণ্ডা এই গুদামঘরে  বাথরুম না থাকাটাও যেন কোনো পীড়াদায়ক ব্যাপার ছিল না। সাত তাড়াতাড়ি আমি একটি ম্যানুয়েল টাইপরাইটার কিনে নিলাম এবং আমার মনে হচ্ছিল আমি একজন সত্যিকার লেখক বনে গেছি।
যা-ই হোক, এক বছর বা তারও বেশি সময় গড়িয়ে গেল, আর্থিক লাভের কোনো সম্ভাবনা দেখা গেলো না, নিজেকে সন্দেহ করতে শুরু করেছিলাম। গল্প-গাছা বিক্রি-বাট্টা করে কায়ক্লেশে বেঁচে থাকার রসদ যোগাড় করাও খুবই কঠিন ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছিল। কিন্তু আমি জেনেশুনেই লেখালেখি করতে চেয়েছিলাম। লেখালেখির বিষয়টিই আমার বহু বছরের স্বপ্ন ছিলো। যদি হতে না পারি তাহলে কী হবে এ কথা ভেবে যারা মরে  আমি তাদের একজন ছিলাম না! আমি আমার স্বপ্নকে পরীক্ষার হাতে তুলে দিতে থাকলাম যদিও এর মানে ছিল যুগপৎ অনিশ্চয়তা ও ব্যর্থতার ভয়ের ভেতর বসবাস। এ হচ্ছে আশার ছায়াচ্ছন্নভূমি, এবং স্বপ্নবান যে কাউকে এখানে বসবাস করা শিখতে হবে।
তারপর একদিন আমি একটি ডাক পেলাম যা আমার জীবন বদলে দিয়েছিল। এটি কোনো এজেন্ট বা সম্পাদকের সঙ্গে বড় চুক্তির প্রস্তাব ছিলো না। পুরোপুরি উল্টোটাই ছিল – কুহকিনির মায়াডাক ছিলো আমার স্বপ্ন পরিহারের জন্যে। ফোনে ছিলো কোস্ট গার্ড বা উপকূল প্রহরীদের মধ্য হতে আমার পুরনো পরিচিত একজন যে এখন ক্যালিফোর্নিয়ায় কর্মরত। একসময় সে আমাকে কিছু টাকা-কড়ি ধার দিয়েছিল এবং সে এ প্রসঙ্গ উত্থাপন করে উত্ত্যক্ত করলো। “ওই ১৫ ডলার কখন পেতে যাচ্ছি, অ্যালেক্স?”
“পরের বারের লেখাটা বিক্রি হলেই।”
সে বললো, “আমার একটা ভালো প্রস্তাব আছে।”
” আমাদের এখানে এখন একজন জনতথ্য সহকারী দরকার। আর আমরা তাকে বছরে ৬০০০ ডলার দিচ্ছি। তুমি যদি চাও, তুমি এটি পেতে পারো।”

বছরে ৬০০০ ডলার! ১৯৬০ সালে দাঁড়িয়ে এ পরিমাণটাকে বেশ ভালই বলতে হয়। চমৎকার একটা অ্যাপার্টমেন্ট হয়ে যাবে, ব্যবহৃত হয়েছে এমন একটা গাড়ি পেয়ে যাবো, ঋণ শোধ করা যাবে এবং সম্ভবত অল্পস্বল্প জমানোও যাবে। আর কি চাই, পাশাপাশি লেখালেখি করতে পারবো।

আমার মাথায় যখন ডলারগুলো নাচানাচি করছিলো, একটা কিছু আমার বোধকে পরিষ্কার করে দিলো। আমার বোধের গভীর থেকে একটা গোঁয়ার সিদ্ধান্ত ফুঁসে উঠলো। লেখক হবার স্বপ্ন ছিলো- পূর্ণকালিন লেখক হবার। এবং আমি সেটিই হতে চাই। “ধন্যবাদ, কিন্তু না,” আমি নিজেকে বলতে শুনলাম। “কষ্ট সত্ত্বেও  আমি লেখালেখি শেষ পর্যন্ত চালিয়ে যেতে চাই এবং লিখতে চাই।”
তারপর, আমার ছোট্ট ঘরে পায়চারি করছিলাম আর নিজেকে বোকা ভাবতে শুরু করছিলাম আমি। খাবারের আলমারিটার কাছে পৌঁছে – কমলার যে ঝুড়িটা দেওয়ালে পেরেকাবদ্ধ ছিল তাতে ছিল দুই বাক্স সার্ডিন মাছ। পকেটে হাত ঢুকিয়ে আমি ১৮ সেন্টস পেলাম। দুটো ক্যান এবং কয়েনগুলো আমি জোর করে একটি কুঁচকে যাওয়া একটি কাগজের ব্যাগে ঠেসে ভরে নিলাম। এই যে, অ্যালেক্স, আমি নিজেকে বললাম। এ যাবৎ তোমার যেমনটা দরকার তেমন করেই নিজেকে গড়ে নিয়েছো অ্যালেক্স। আর কখনো আমি এতোটা মনমরা হয়ে পড়েছিলাম কিনা আমি নিশ্চিত নই।
আমার ইচ্ছে করছে এক্ষুনি বলে উঠতে যে সব কিছু ভালোভাবে চলতে শুরু করেছে। কিন্তু চলছিল না। ভাগ্যিস জর্জ ছিল এই বাজে পরিস্থিতি উৎরে যাবার বেলায় আমার সাহায্যকারী হিসেবে।
তার মাধ্যমেই জো ডেলানের মতো লড়াকু শিল্পী, একজন ঝানু চিত্রকরের  সঙ্গে আমার সাক্ষাত ঘটেছিল। প্রায়শই  খাবারের পয়সা জুটতো না জো-এর। কাজেই সে পার্শ্ববর্তী কসাইয়ের দোকানে যেতো যে তাকে গায়ে লাগা সামান্য মাংসশুদ্ধ বড় বড় হাড্ডিগুলো দিতো। এবং সে সবজির দোকানে গেলে সবজিওয়ালাও তাকে সজীবতা হারানো বিবর্ণ কিছু সবজি দিতো। এগুলোই জো’র  সূপ বানাতে দরকার হতো।

জো-এর আরেক প্রতিবেশি ছিল গানের শিল্পী, সুদর্শন এক যুবক সেও কষ্টেসৃষ্টে একটা রেস্টুরেন্ট চালাতো। জনশ্রুতি আছে যে, কোন খদ্দের খাবারের ফরমায়েশ দিলে,  এমনকি একটি স্টেকের অর্ডার দিলেও সে দৌড়ে রাস্তা পার হয়ে সুপারমার্কেট থেকে তা কিনে আনতো। তার নাম ছিল হ্যারি বেলাফন্টে।
ডেলানে এবং বেলাফন্টের মতো মানুষেরা আমার জন্যে অনুকরণযোগ্য আদর্শ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। আমি শিখেছিলাম যে, তোমাকে ত্যাগস্বীকার করতে হবে, এবং সৃষ্টিশীলভাবে বাঁচতে হবে তোমার স্বপ্নপূরণের কর্মময় পথরেখায়। ছায়াচ্ছন্ন পটভূমিতে বসবাস বলতে এ-সবকেই বুঝায়।
এই অভিজ্ঞতাকে যেহেতু আমি অঙ্গীভূত করে নিয়েছিলাম, ধীরে ধীরে আমি আমার প্রবন্ধ-নিবন্ধ বিক্রয় করতে শুরু করলাম। অনেক মানুষ যে-সকল
বিষয় নিয়ে তখন কথা বলতো আমি ওই সব বিষয় নিয়ে লিখতে শুরু করি: নাগরিক অধিকার, আফ্রিকা ও আমেরিকার কালো মানুষ। শীঘ্রই, পাখিদের দক্ষিণে উড়ার মতো আমার ভাবনারাজি শৈশবের দিকে ফিরতে শুরু করলো। আমার ঘরের নীরবতায় আমি আমার দাদি, চাচাতো বোন জর্জিয়া, চাচী প্লাস, খালা লিজ, ফুফু টিল, সবার স্বর শুনতে পাচ্ছিলাম। আমাদের পরিবার এবং ক্রীতদাসপ্রথা নিয়ে গল্প করতো তারা।
এ-সব গল্প ছিলো কালো মার্কিনিদের। যে-সব তারা আগে সযত্ন পরিহার করতো এবং এ কারণে আমি প্রায় সব গল্পই আমার কাছে রেখে দিতাম। কিন্তু একদিন রিডারস ডাইজেস্টের সম্পাদকদের সঙ্গে দুপুরের খাবারের সময় আমার দাদি-চাচী-খালা আর চাচাতো-খালাতো-ফুফাতো ভাই-বোনদের নিয়ে গল্পগুলো বলেছিলাম। বলেছিলাম আমার পরিবারের ইতিহাস এবং শেকলে বাঁধা প্রথম আফ্রিকিয়কে ঠিক কীভাবে মার্কিন উপকূলে আনা হয়েছিল তার সুলুক সন্ধানে আমার স্বপ্নের কথা। ঐ মধ্যাহ্নভোজে একটি চুক্তি সম্পাদিত হয়েছিল যা আমার গবেষণাকর্ম এবং নয় বছরের লেখালেখিকে সমর্থন ও সাহায্য যোগাবে।

এটি ছিল ছায়াচ্ছন্নতা থেকে বেরিয়ে আসার এক দীর্ঘ, ধীর হামাগুড়ি। এ-সব সত্ত্বেও ১৯৭৬ সালে, কোস্ট গার্ড ছেড়ে আসার ১৭ বছর পরে “রুটস” প্রকাশিত হয়েছিল। প্রকাশিত হবার সঙ্গে সঙ্গে যে সুখ্যাতি এবং সাফল্য আমি পেয়েছিলাম তা খুব সংখ্যক লেখকেরই জীবনাভিজ্ঞতার অংশ হতে পারে। এভাবেই ছায়াচ্ছন্নতা চোখ ধাঁধানো ঔজ্জ্বল্যে খ্যাতির আলোকে রূপান্তরিত হয়েছিল।

প্রথম বারের মতো আমার হাতে টাকা এলো এবং সব জায়গাতেই সাদরে বরিত হতে শুরু করলাম। নূতন নূতন বন্ধু এবং নূতন নূতন  চুক্তির ব্যাপারে সারাক্ষণই ফোন বাজতে থাকলো। গাট্টি-বোঁচকা বেঁধে আমি লসএঞ্জেলেস স্থানান্তরিত হলাম যেখানে রুটস-এর টিভি মিনি-সিরিজ নির্মাণে আমি সাহায্য করতে পারবো বলে আশা করছিলাম। এটি ছিল এক এলোমেলো, আনন্দময় সময়, এবং এক অর্থে আমার সাফল্যের আলোয় আমি অন্ধ হয়ে গিয়েছিলাম।

তারপর একদিন, যখন গাঁট্টি-বোঁচকা খুলছিলাম বহু বছর আগে নিউ ইয়র্কে অর্জিত বাক্স ভর্তি জিনিসগুলো পেয়ে গেলাম। তার ভেতর ছিল একটি মোটা বাদামী রঙের কাগুজে  ব্যাগ।

আমি এটি খুললাম, পাওয়া গেলো দুটো ক্ষয়ে যাওয়া সার্ডিন ক্যান, আর আঠারোটি সেন্টস। হঠাৎ যেন বাঁধভাঙ্গা জলধারার মত সবকূল উপচানো অতীত এসে হাজির হলো। আমি মনশ্চক্ষে নিজেকে আবার সেই এক কক্ষ-অ্যাপার্টমেন্টের সংকীর্ণতায় ঠাণ্ডায়, শূন্যতায় টাইপরাইটারের উপর গাদাগাদি করে পড়ে আছি দেখতে পেলাম। এবং নিজেকে বললাম, এই ব্যাগের জিনিসগুলোও আমার শেকড়, আমার মূল। আমি কখনোই ওটা ভুলতে পারি না।
আমি সে-সব জিনিস লুসাইট ব্র‍্যান্ডের স্বচ্ছ প্লাস্টিক আবরণে ফ্রেমে বাঁধানোর জন্যে বাইরে পাঠালাম।স্বচ্ছ প্লাসটিকের এই বাক্সটিকে এমন জায়গায় রাখলাম যাতে আমি এটিকে প্রতিদিন দেখতে পারি।
এখন আমি এটিকে আমার অফিস-ডেস্কের উপরে পুলিৎজার পুরস্কারের সঙ্গে দেখতে পাই; রুটসের জন্য প্রাপ্ত নয়টি এমি অ্যাওয়ার্ড খচিত প্রতিকৃতি; এবং স্প্রিংগার্ন মেডাল – অশ্বেতকায় জনগণের অগ্রগমনের জন্য জাতীয় সমিতির সর্বোচ্চ সম্মাননা।
না বললেই নয় যে, এটিকেই আমি সর্বস্ব জ্ঞান করতাম। কিন্তু একজনই আমাকে স্মরণ করিয়ে দেয় যে, ছায়াচ্ছন্ন পটভূমিতে টিকে থাকার জন্যে দরকার সাহস এবং অধ্যবসায়।
স্বপ্নবান যে কাউকে এই শিক্ষাটাই আত্মস্থ করা উচিত।