You are currently viewing স্ট্রবেরী মুন এবং একটি ঝুলবারান্দার গল্প || শেলী জামান খান

স্ট্রবেরী মুন এবং একটি ঝুলবারান্দার গল্প || শেলী জামান খান

স্ট্রবেরী মুন এবং একটি ঝুলবারান্দার গল্প

শেলী জামান খান

()

বিশালাকার কুসুমের মত সূর্যটা ধীরে ধীরে ডুবে যাচ্ছিল। সেই ডুবন্ত-সূর্যের রক্তিমাভা ছড়িয়ে পড়ছিল পশ্চিমাকাশে। মূহুর্তটা ভীষণরকম মায়াবী। চারিদিক শুনশান। সেই মূহুর্তে বারান্দার উপর দিয়ে উড়ে গেল একঝাঁক পাখি। সারিবদ্ধ পাখির দলটি ক্রমান্বয়ে দূরে-বহুদূরে গিয়ে একসময় দিগন্তে মিলিয়ে গেল। সন্ধ্যার আলো-আঁধারিতে অপসৃয়মান পাখিদের দিকে তাকিয়ে দেবযানীর মনটা বিষন্ন হয়ে উঠল।কিছু সৌন্দর্য এমনই।অকারনেই বুক ভারী করে তোলে।

কএই ঝুলবারান্দাটি দেবযানীর শোবার ঘর সংলগ্ন। দীপঙ্করের আসার নির্ধারিত সময় পাড় হয়েছে অনেকক্ষণ। দীপঙ্করের সময় জ্ঞান টনটনে হলেও আজ কোন কারনে তার দেরী হচ্ছে। দেবযানীর মনে একটা উৎকণ্ঠা ঘণিয়ে উঠল। অপেক্ষার সময়গুলো দীর্ঘ বলেই এই উৎকণ্ঠা।

হঠাৎ দেবযানীর বুকের ভেতরে হুঁহুঁ করতে লাগলো। এমন যদি হয়? একটা সময় দীপঙ্কর আর আসবে না। দীপঙ্করবিহীন জীবন সে ভাবতেও পারে না। এই মানুষটা কীভাবে যেন তার সম্পূর্ণ জীবনটাকেই দখল করে নিয়েছে। দীপঙ্কর তার জীবনের অক্সিজেন। অক্সিজেন ছাড়া সে বাঁচবে কী করে? 

দেবযানী কিচেনে ফিরে এসে খাবারের ডিশগুলো ওভেনের ওয়ার্মারে রেখে দিল। দীপঙ্কর ঘরে এলে সে কিছুতেই অন্যদিকে মনোযোগ দিতে পারবে না। তার স্বভাব দেবযানীর মুখস্ত। এসেই তাকে আদোর করতে শুরু করবে। ব্যাস্ত হয়ে পড়বে শরীরী খেলায়। দেবযানী নিজেও উন্মুখ হয়ে থাকে দীপঙ্করের স্পর্শের জন্য। 

সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে দেবযানী আবার ঝুলবারান্দায় ফিরে এলো। রেলিং ধরে দাঁড়াতেই তার চোখ পড়ল রাস্তার ধারের উইপিং-উইলো গাছ দুটোর দিকে। যেন পরস্পরকে আলিঙ্গন করে দাঁড়িয়ে আছে ওরা। তাদের বাকলের ভাঁজে ভাঁজে বয়সের সুস্পস্ট ছাপ। এমন উতলা সন্ধ্যায় দিগন্তে মিলিয়ে যাওয়া ঐ পাখির দল, ডুবন্ত-সূর্য, ক্রন্দনরত এই উইলো দম্পতি সবাই মিলেমিশে দেবযানীর মনের হাহাকারকে আরও বাড়িয়ে দিল।এমনতো কখনও হয় না। দীপঙ্করের সাথে দেখা হওয়ার আগ-মূহুর্তগুলো তাকে সদ্যকৈশোর পেড়ুনো তরুনীর মত চন্চল করে তোলে।তার শরীর শিরশির করে। উডুসন্ধি সিক্ত হয়ে ওঠে। কামনার আগুনে শরীর পুড়তে থাকে। তার বয়সি নারীর জন্য যা খুবই বেমানান!

সে আসবেতো? অজানা আশঙ্কায় দেবযানীর বুক ঢিপঢিপ করতে শুরু করে। বুকের ভেতরে চাপধরা একটা ব্যাথা তীব্রতর হয়। যদি না আসে? যদি এমন হয় দীপঙ্কর আর এলো না। আর কখনও আসবে না। 

এতবড় একটা ধাক্কা সে সামলাতে পারবেতো? 

 

()

প্রথম পরিচয়েই দীপঙ্কর শর্মা নামের মানুষটি দেবযানীর জীবনে দখল নিয়েছিল। অণুঘটক হিসেবে কাজ করেছিল বন্ধু তনুজা। এক শনিবারের দুপুরে তাতিয়ানা রেস্টুরেন্টে তনুজা তাকে লান্চে ডেকেছিল। তনুজার মাসতুতো ভাই দীপঙ্কর ব্রাইটনেই থাকে। সেই লান্চের হোস্ট। দীপঙ্করের সাথে দেবযানীকে পরিচয় করিয়ে দিতেই এই আয়োজন। নেভিব্লু জিন্স, সাদা টিশার্ট এবং ডীপ নেভি কালারের নাইকির স্পোর্টস সু’তে দারুন এক চনমনে পুরুষ দীপঙ্কর। তাকে দেখে মুগ্ধ না হয়ে উপায় নেই। মেদহীন, পেটানো শরীরের দীপঙ্করকে প্রথম নজরে বয়স আন্দাজ করা কঠিন। 

সেই সাক্ষাতটাই দেবযানীর জীবনকে আমূল বদলে দিয়েছিল। দেবযানীর নিঃসঙ্গ জীবনে দীপঙ্কর যেন ঝড়ো হাওয়া। সবেগে এসে তার জীবনে জমে থাকা সব হতাশা ধুয়ে-মুছে দিয়েছে। এই মানুষটাই শিখিয়েছিল, কীভাবে নতুন করে জীবন শুরু করা যায়, নিজেকে ভালোবাসা এবং উপভোগ করা যায়।

দীপঙ্কর প্রায়ই বলে, ‘হানি, ফোকাস অন ইউরসেল্ফ। জাস্ট এনজয় ইট। রিমেম্বার, দেয়ার ইজ নো টুমোরো!’

স্বামীর মৃত্যুর পর ছেলে-মেয়ের পড়াশোনা, ওদের ভবিষৎ গড়তেই কীভাবে সময় চলে গেলো… 

পন্চাশের কোঠার দেবযানী রায় সত্যিই এবার নিজের দিকে মনোযোগী হয়েছে। তার কাঠখোট্টা জীবনেও বসন্ত এসেছে। অজিত চলে যাবার পর একান্ত-পুরুষসঙ্গ হয়নি কখনও। সেতো ভেবেই নিয়েছিল; তার জীবন শুকিয়ে গিয়েছে। একটি পুরুষের গাড়-কণ্ঠস্বর, উষ্ণ-ছোঁয়া আজও শরীরে শিহরণ তুলতে পারে। চল্লিশ পেরিয়েও ‘পুরুষসঙ্গ’ শরীরে জোয়ার আনতে পারে। কে জানতো?

নীচের রাস্তায় চোখ পড়তেই তার ভাবনায় ছেদ পড়ল। ঐতো দীপঙ্কর! দেবযানীর শরীরে যেন তড়িৎ প্রবাহ বয়ে গেল। উত্তেজনায় শরীরের প্রতিটি লোমকূপে কাঁটা দিয়ে উঠল। 

লম্বা-চওড়া মানুষটি দ্রুত গতিতে হাঁটছে। মূহুর্তেই সার্ফ-এভিনিউ পেরিয়ে সে দেবযানীর অ্যাপার্টমেন্টের সামনে চলে এলো।মানুষটিকে দেখলেই দেবযানীর মনে একধরনের রষায়ণ তৈরি হয়। তা হল আস্থা, নির্ভরতা এবং সমঝোতা। তাদের মধ্যকার গিভ-এন্ড-টেক অসাধারণ। তারা কেউই কারও উপর পুরোপুরি নির্ভরশীল নয়; আবার দুজনই দু’জনের পরিপূরক। 

 

()

দীপঙ্করের জীবনে রাশিয়ান নারীদের প্রবল প্রভাব রয়েছে। মস্কো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ত পড়তে ওডেসা সুন্দরী অলিভিয়ার সাথে তার ভাব এবং পরিনয় হয়েছিল। তাদের একটি পুত্র সন্তান আছে। 

সত্তর দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে ব্রুকলীনের সাগরতীর ঘেঁষা ব্রাইটন এলাকাটি রাশিয়ান-ইউক্রেনীয় আশকেনাজি ইহুদিদের জনপ্রিয় স্থান হয়ে উঠেছিল। এলাকাটি কৃষ্ণসাগর বিধৌত ইউক্রেনীয় শহর ওডেসা’র নামে “লিটল ওডেসা” হিসেবে পরিচিতি পায়। উত্তরে শীপশেড বে, পশ্চিমে কনি আইল্যান্ড, পূর্বে ম্যানহাটন সৈকতে আবদ্ধ ব্রাইটনে দীর্ঘদিন ধরে  ইউরোপীয়-ইহুদিরাই প্রধান-বাসিন্দা। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর রাশিয়া এবং ইউক্রেন থেকে অভিবাসীদের একটি নতুন জোয়ার আসে এই এলাকায়। এইকারনে এলাকার অধিকাংশ অধিবাসীদের মধ্যে ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা প্রচলিত।

ঐসময়টাতে অলিভিয়ার পরিবারও কৃষ্ণসাগরের কোল ছেড়ে আটলান্টিকের তীরে এসে আশ্রয় নেন। দীপঙ্করও স্ত্রীপুত্রের সঙ্গী হয়। অনেক চড়াই-উৎরাইয়ের পর ব্রাইটন-বীচ সংলগ্ন নবনির্মিত লাক্সারি কনডোমিনিয়াম ‘ওশেনা’য় পাশাপাশি দুটো অ্যাপার্টমেন্টে দীপঙ্কর-অলিভিয়া এবং অলিভিয়ার পরিবার সুখের সংসার শুরু করে। ধনী রাশিয়ানরা ‘ওশেনা’তে ইউনিট কিনতে শুরু করলে রাতারাতি এটি একটি পশ-এলাকায় পরিনত হয়। 

কিন্তু সেই সুখময় দিনগুলোতে হঠাৎই যবনিকা নেমে আসে। ভয়াবহ এক রোড অ্যক্সিডেন্টে অলিভিয়ার মৃত্যু হয়। অলিভিয়ার ছেলে নিকোলাই ইভান পুরোপুরিভাবেই ইউক্রেনীয় আবহে নানা-নানি’র কাছে বড় হয়েছে। মায়ের রূপ নিয়ে জন্ম নেয়া ইভানের মধ্যে বাঙ্গালিয়ানার ছাপ খুবই কম। দীপঙ্করও বহুদিন দেশের বাইরে, আত্মীয়-স্বজন বিহীন জীবনে অভ্যস্ত। রাশিয়ান পরিবারের সাথে সম্পৃক্ততার কারনে সেও বাঙালিয়ানা থেকে বিচ্যুত। স্ত্রী-বিয়োগের পরও ছেলের কারনে শ্বশুরবাড়ির সাথে দীপঙ্করের সম্পর্ক এখনও অটুট। অলিভিয়ার মা দীপঙ্কর কিংবা ইভানকে কখনওই মায়ের অভাব বুঝতে দেননি। অলিভিয়া চলে যাওয়ার পর দীপঙ্কর অনেকদিন উদভ্রান্ত সময় কাটালেও একমাত্র সন্তানের জন্য সে আবার জীবনমূখী হয়েছে।

দীপঙ্করের সাথে পরিচয়ের পর থেকে পূর্ব ইউরোপীয় খাবার, সংস্কৃতি, ভাষা ছিল দেবযানীর জন্য ব্যাতিক্রমী অভিজ্ঞতা। দীপঙ্করের শাশুড়িও তাকে সহজেই আপন করে নিয়েছেন।ব্রাইটনের দোকানপাট, রেস্তোরার সিরিলিক ভাষার নামগুলোর সাথে পরিচয়ের পাশাপাশি ইয়েস, নো, ভেরিগুড জাতীয় গোটাকয়েক রাশিয়ান শব্দও সে শিখে ফেলেছে। এখন সে প্রয়োজনে ‘দা’, ‘নিয়ত’ ‘স্পাসিবা’র মত কিছু শব্দ বলতেও পারে। 

প্রায়শঃই ছুটির দিনে তারা ব্রেকফাস্টের জন্য ব্রাইটনের গুল্লুওগ্লু বাকলাভা ক্যাফেতে যায়। সেখানকার তুর্কি স্পেশাল ব্রেকফাস্ট তাদের খুব পছন্দের। তারা তুর্কি চা, সসেজ দিয়ে তৈরি ওমলেট, বাকলাভা দিয়ে প্রাতরাশ সারে।দীপঙ্কর রঙ্গ করে বলে, ‘রোমে থাকবো কিন্তু রোমান খাবার খাবো না তাতো হয় না।’

ব্রাইটনের অবস্থান হল কনি আইল্যান্ডের পূর্বদিকে। ব্রাইটনের পরিষ্কার সৈকত, সুসজ্জিত নরনারী এবং দীপঙ্করের কারনে পূর্বদিকটাই দেবযানীকে বেশী টানে। সকাল-সন্ধ্যা বোর্ডওয়াকে হাঁটাহাঁটি, সময়-অসময়ে সাগরে দাপাদাপি করে ক্ষুধার্ত হলে, তারা খেতে যায় ব্রাইটন-ফোর্থ স্ট্রিটের তাতিয়ানা গ্রিল কিংবা ক্যাফে ভলনাতে। সেখানকার অসাধারণ খাবারের পাশাপাশি সাগরের ঠেঁউ এবং গাঙ্গচিলের ওড়াউড়ি উপভোগ করা যায়। এদের সেসমি-টুনা-সালাদ দুজনেরই প্রিয় মেন্যু। ব্রাইটন-ফোর্থের ‘ক্যাফে অ্যাট ইউর মাদার ইন ল্য’ও দীপঙ্করের পছন্দের জায়গা। তার মতে, এদের কোরিয়ান-উজবেক খাবার হল ঘরে বসে ঠাকুমার রান্না খাওয়ার মতই।রেস্টুরেন্টের সার্ভার এবং অন্য রাশিয়ানদের সাথে দীপঙ্করের রাশিয়ান ভাষায় বাক্যালাপ দেবযানীকে মুগ্ধ করে।

 

()

তিন দশকের নিউ ইয়র্ক জীবনে মাথা গোঁজার নিজস্ব কোন ঠাঁই হয়নি দেবযানীর। স্থায়ী সম্পত্তির প্রতি অজিতের আগ্রহ কম ছিল।অজিতের হঠাৎ মৃত্যুতে দুটো ছেলে-মেয়ে নিয়ে প্রচন্ড দিশাহারা হতে হয়েছিল দেবযানীকে। নিজের ভাল একটি জব থাকায় সে সামলে নিয়েছিল। 

অর্নব, অরিনরা নিজস্ব জীবনে সেটল হতেই দেবযানীর প্রশ্নটা সামনে এসেছিল। ছেলে-মেয়েদের সংসারে আশ্রিত হওয়ার ইচ্ছে দেবযানীর ছিল না। একা হয়ে যেতেই সানি সাইডের তিনরুমের বাড়ির ‘অ্যামটি নেস্টার সিনড্রম’ তাকে প্রায় জাঁকিয়ে ধরেছিল।

তনুজা এলএলসি কর্পোরেশনের অ্যাফোর্ডেবল হাউজিং লটারির জন্য অ্যাপ্লাই করেছে শুনে সেও বন্ধুর সাথে বসে অ্যপ্লিকেশন-ফর্ম পূরণ করেছিল। সেই লটারি জিতেই আটলান্টিক সাগরের কোল ঘেঁষে, ছোট্ট, নিরিবিলি একটি বাসস্থানের স্বপ্ন পূর্ন হয়েছে দুই বন্ধুর।

যখন তার জীবনে দীপঙ্করের আবির্ভাব ঘটেনি, তখন এই বিশাল আকাশ, সাগরের উত্তাল ঠেঁউ এবং ক্রমাগত জলভাঙ্গার অবিরাম শব্দে দেবযানী তার নিঃসঙ্গতা কাটাতে চেষ্টা করতো। বোর্ডওয়াকে কতশত নতুন মুখের সাথে দৃষ্টিবিনিময় হয় প্রতিদিন। সাগরের জলস্রোতের মতই এই জনস্রোত।ভাটার সময় যে জল ফিরে যায়; পরবর্তী জোয়ারে তা আর ফিরে আসে না। বোর্ডওয়াকের পথচারীরাও তেমনি। প্রতিদিনই নতুন জল; নতুন মুখ। তারা কেউ কাউকে মনে রাখে না।

কিন্তু এখন দেবযানীর প্রতিটি সকাল আসে নতুন সম্ভাবনা নিয়ে। ঝুলবারান্দাটা এই বাড়ির প্রাণভোমরা। এখানকার সোনালি সকাল, ঝিমধরা দুপুর, নিঝুম সন্ধ্যাগুলোতে প্রেম যেন প্রজাপতির মত পাখনা মেলে।নিষিদ্ধ আনন্দে থৈথৈ করে ঘরের বাতাস। গহনঘণ ঘোরে নিমজ্জিত হয় পৃথিবীর প্রথম মানব-মানবী। 

দীপঙ্কর এখানে ফুলটাইম বাস করে না। তবুও সর্বত্র তার অস্তিত্ব বিরাজমান। বেডরুমের ক্লোজেটে তার স্লিপিংড্রেস, টিশার্ট, জিন্স। শু’কেইসে জুতা, স্নিকার, স্লিপার। বাথরুমে তোয়ালে, সেভিংকিট, দাঁতের ব্রাশ, চিরুনী, ওডিকোলন। লিভিংরুমে নতুন সংযোজিত ‘ফ্যামিলি বার’। কাউন্টারে দু’টো টুল। বার-ক্যাবিনেটে বিভিন্ন ব্রান্ডের ওয়াইন, হুইস্কি, ভদকা, রাম। ব্লাডিমেরি মিক্স, মিক্সার, আইসবক্স, স্ট্র, বার-স্পুন আরও কত কী। 

দেবযানীর পছন্দ রেডওয়াইন। ককটেলের মধ্যে ব্লাডিমেরি, মোহিতো, মার্টিনি। দীপঙ্করের প্রথম পছন্দ ভদকা। ভদকা দিয়েই তার হাতেখরি হয়েছিল। প্রিয় ককটেল ‘লং-আইল্যান্ড-আইস-টি’। দীপঙ্কর শর্মা এই ঘরোয়া বারের বারটেন্ডার। তাই সে এলেই বার ওপেন হয়। না এলে বার বন্ধ থাকে! এমনকি গৃহকর্তীর পোশাকে, সাজসজ্জায়ও পড়েছে বারটেন্ডারের পছন্দের ছোঁয়া। 

 

()

দরজায় চাবি ঘোরানোর শব্দে দেবযানী দ্রুতপায়ে এগিয়ে গেলো। ঘরে পা ফেলতে না ফেলতেই দীপঙ্কর দেবযানীকে কাছে টেনে নিলো। তারপর দৃঢ় আলিঙ্গনে বেঁধে দেবযানীর উর্ধ্বমূখী ঠোঁটে সশব্দে চুমু খেলো। এতক্ষণের জমে ওঠা সব দূর্ভাবনা, দীপঙ্করকে হারানোর অহেতুক ভয় সব গলে জল হয়ে গেল এই উষ্ণ আলিঙ্গনে। দীপঙ্কর তাকে পাঁজাকোলা করে বিছানায় নিয়ে এলো। আরও খানিকক্ষণ খুনশুটির পর তারা শান্ত হল। ফুরসত হল একে-অপরের কুশল বিনিময়ের।

‘এত দেরী করলে?’

‘আমাকে খুব মিস করছিলে বুঝি?’ দেবযানীর অভিমানী ঠোঁটে আবারও চুমু খেলো দীপঙ্কর। 

‘খুউব।’

‘তাহলে এক্কেবারে চলে আসি; কি বল? তোমার বাচ্চারা আমায় মেনে নেবেতো?’

দীপঙ্করের হাত দেবযানীর শরীরময় আবর্তিত হতে হতে নিম্নগামী হয়। একসময় তা উরুসন্ধিতে গিয়ে স্থির হয়। ঠিক এই মূহুর্তটি এলেই দেবযানীর সারা পৃথিবী অকসাৎ স্তব্ধ হয়ে যায়। তার দুচোখ আপনাআপনি বন্ধ হয়ে আসে। শরীরের প্রতিটি কোষে-কোষে খবর ছড়িয়ে পড়ে। পরবর্তীতে কী ঘটবে সেই প্রতিক্ষায় তারা সব উৎকন্ঠিত হয়ে ওঠে। একসময় সেই চরম মূহুর্তটিও আসে। দু’জনের উচ্চকিত শিৎকারে সমস্ত পৃথিবী তোলপাড় করে যেন বৃষ্টি নামে।তারপর ক্লান্ত, বিধ্বস্ত, সিক্ত দুই মানব-মানবী বিছানার দুইধারে নিথর পড়ে থাকে।

একসময় তন্দ্রা ভেঙ্গে দীপঙ্কর জেগে উঠল।দেবযানীর কপালে আলতো করে ঠোঁট ছুঁইয়ে জানতে চাইলো, ‘হানি, ইউ ওকে? আর ইউ হ্যাপি? ডু ইউ হ্যাভ অ্যা অর্গাজম?

‘ইয়েস আই ডু হ্যাভ ওয়ান। ইট ওয়াজ রিয়েলি গুড।’

 

()

দীপঙ্করের সাথে প্রথম রাতের কথা মনে হলে দেবযানী এখনও আরক্ত হয়ে ওঠে। দেবযানীর শরীর দীপঙ্করের হাতে প্রাণ পেয়েছিল। পদ্মফুলের পাপড়ির মত দীপঙ্কর তার শরীরের এক একটা ভাঁজ উন্মোচন করেছিল সেই রাতে। 

দুজনে পুরো এক বোতল মার্লো শেষ করেছিল। তারপর মারিওনার দুটো স্টিকে অগ্নিসংযোক করে দীপঙ্কর একটি ওর হাতে ধরিয়ে দিয়েছিল। অনভ্যস্ত ধুমপান এবং  তরলের গুণে দেবযানী তার জীবনের গভীরতর গোপন কুঠরি খুলে দিয়েছিল। 

চল্লিশের কোঠা পাড় করা দেবযানীর শরীরের গঠন নিখুঁত ছিল না আগের মত। দীপঙ্করের সামনে নগ্ন হতে তার বড় বাঁধো-বাঁধো লেগেছিল। কিন্তু দীপঙ্কর সেই কুণ্ঠা থেকে তাকে মুক্তি দিয়েছিল। দেবযানীর শরীরের শীতলতাকে গলিয়ে উষ্ণ করে তুলেছিল। ওর মুগ্ধ চোখ, গভীর সহমর্মিতা, একান্ত সহযোগীতা তাকে সাহস যুগিয়েছে। দীপঙ্করের মুখে তার অন্তর্নিহিত সৌন্দর্যের প্রশংসা তাকে আত্মবিশ্বাস জুগিয়েছে। 

 

()

দীপঙ্কর ঝুকে তার আরও কাছে আসতেই দেবযানীর মনে হল, এই মুহূর্তে একটা চুমু খেতে না পারলে সে মরে যাবে। সে দীপঙ্করকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে তার তপ্ত ঠোঁটে চুমু খেলো! 

দীপঙ্কর মুচকি হেসে বললো, ‘দেবীজী, বড্ড ক্ষিদে পেয়েছে। বড্ড পরিশ্রম করিয়েছো আজ। পেট যে দাউ-দাউ করে জ্বলছে।’ 

দেবযানী বাথরুমে ঢুকতেই কিচেন থেকে দীপঙ্করের উচ্চকন্ঠ শোনা গেল, ‘হানি, এযে দেখছি আমার পছন্দের সব খাবার। ওহ্, মাই মাই। উমম্… ফুলকপির রোস্ট হয়েছে দেখতে পাচ্ছি। মনে হচ্ছে স্যামনও উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে! ওয়াও!’

ওভেনের ডালা খোলায় খাবারের মুখরোচক গন্ধটা ততক্ষণে ঘর জুড়ে ঝড়িয়ে পড়েছে। দেবযানীর নিজেরও ক্ষিদে পেয়েছে খুব। কিন্তু এখনও ‘স্ট্রবেরী দেবী’র চাঁদমুখখানা মেঘের পর্দা সরিয়ে উঁকি দেয়নি। দেবযানীর খুব ইচ্ছে আজ তারা চাঁদের আলোয় ডিনার করবে। তাই সে দীপঙ্করকে বললো, 

‘ডার্লিং, এসো, না হয় মারিওনার আরেক রাউন্ড হয়ে যাক।’

দুজন গিয়ে আয়েস করে বারন্দায় বসল। দীপঙ্কর সিগারেট কেইস থেকে দুটো স্টিক নিয়ে অগ্নিসংযোগ করল। দুজনে ছোট-ছোট টানে শুন্যে ধোঁয়া ছাড়তে লাগলো। 

 

()

‘দীপ, তাকাও, ঠিক দক্ষিণ-পূর্ব দিকে তাকাও। ঐ-ঐযে ওখানে, চন্দ্রকন্যা তার নেকাব খুলছেন, দেখেছো?  একটুপরেই একেবারে রক্তাভ-গোলাপী রঙের দেখতে হবে। জান, এই চাঁদের একটি গালভরা নামও আছে, ‘স্ট্রবেরী মুন’। এই স্ট্রবেরি চাঁদটা আমি আজ তোমায় উপহার দেবো। এই নেপচুনিয়ান রাতটা তোমাকে ছাড়া একদমই অসম্পূর্ণ থাকতো। আই’ম সো লাকি। আই’হ্যাভ ‘ইউ’।’

পূর্নিমার চাঁদ নিয়ে দেবযানীর প্রবল আগ্রহ। পূর্নিমার আলো তাকে ঘোরগ্রস্ত করে তোলে। সে গুগোল ঘেঁটে জেনেছিল, ১৪ জুনের পূর্নিমা হল বসন্তের শেষ পূর্ণিমা। জুন হল প্রেমের-দেবী ‘জুনো’র নাম-মাস! ‘দ্য ওল্ড ফার্মারস আলমানাক’ অনুসারে, স্ট্রবেরি চাঁদের আধ্যাত্মিক দিক হল প্রেম। তাই স্ট্রবেরি পূর্নিমাকে মধুচন্দ্রিমার রাতও বলা হয়।  স্ট্রবেরি চাঁদ অতীত, বর্তমান বা ভবিষ্যত রোমান্টিক সম্পর্কের প্রতিফলন ঘটায়।  

‘জান দীপ, জ্যোতিষীদের মতে  “এই রাত আকাঙ্ক্ষা পূরণের  সবচেয়ে উপযুক্ত সময়। এই মাহেন্দ্রক্ষণে  মহাবিশ্বের কাছে, শ্রষ্ট্রার কাছে যা চাওয়া হয়; তাই পাওয়া যায়। তাইতো আজ রাতে, মনপ্রাণ দিয়ে, আজীবনের জন্য, শুধু তোমাকেই চাই!’

 

()

রহস্যময় এই পূর্নিমারাত দীপঙ্করকে বহুবছর আগের আরেকটি পূর্নিমা রাতকে স্মরণ করিয়ে দিল। সে রাতটিও ছিল ভয়ঙ্কর এক রহস্যময়তায় ভরা। সে তখন বাইশ-তেইশ বছরের যুবক। দেশ থেকে সদ্য বিদেশে এসেছে। বিদেশের অতি আধুনিকতার সাথে তার তখনও পরিচয় ঘটেনি। দীপঙ্করের মস্কো যাওয়ার সুযোগ এসেছিল স্টুডেন্ট ভিসায়। তাকে বহনকারী উড়োজাহাজটি মস্কোর মাটি স্পর্শ করার আগেই দীপঙ্কর নিশ্চিত জানতো অভিজিতদা এবং প্রমীলাবৌদি সেখানে তার জন্য অপেক্ষা করবেন। অভিজিতদের সাথে কিছুদিন থেকে সে ডর্মে চলে যাবে। কোন জটিলতার কারনে সীট পেতে দেরী হওয়ায় তার আরও কিছুদিন অভিজতদের সাথে থাকতে হচ্ছিল।

দীপঙ্কর দেবযানীর চুলে আঙ্গুল দিয়ে বিলি কাটছিল। অস্ফুটে বললো, ‘দেবী, তোমাকে আমার অতীতের একটি গল্প বলবো। যা কখনও তোমাকে বলা হয়নি।’

হঠাৎ তার আঙ্গুলে জড়তা এলো। কণ্ঠে দ্বিধা। অন্য হাতের মারিওনার জ্বলন্ত জয়েন্টে কয়েকটি টান দিয়ে নিঃশেষিত স্টিকটা অ্যাশট্রেতে গুঁজে রাখলো সে। দেবযানী বিস্মিত হয়ে দীপঙ্করের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। তার চোখ লাল হয়ে উঠেছে। গলার স্বর অস্বাভাবিক গাঢ়।

‘অভিজিত-প্রমিলার কথা তুমি বহুবার আমার কাছে শুনেছো।আমি যখন মস্কো যাই বৌদির ছোটবোন উর্মিলাও তখন সেখানে। সেও ডর্মে থেকে মস্কো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়বে। আমরা প্রতিদিন রাতে বসার ঘরে আড্ডা দেই। খুব সুন্দর সাজানো ঘর। ফায়ার প্লেসের সামনের মেঝেতে একটা মখমলের কার্পেট বিছানো। সবুজ রঙা সেই নরম কার্পেটের উপর ফুটিফুটি সাদা ঘাষফুলগুলো দেখতে ছিল আশ্চর্যরকমভাবে সতেজ। মনে হত ঘাঁসের উপর বসে আছি। বাড়িভর্তি ছিল বড় বড় ইনডোর প্লান্ট। যা বনের একটা আবহ তৈরি করেছিল।খুব মানুষের বাড়ি। দাদা-বৌদিকে দেখলেই বোঝা যায়, কী চমৎকার, রুচিশীল, হাসিখুশি সুখী দম্পতি।

আমরা প্রায়ই তাস খেলতাম। অভিজিতদা বাসায় থাকলে চারজন মিলে ব্রিজ, সে কাজে থাকলে, তিনজন মিলে খেলতাম ‘ফাইভ হান্ড্রেড’। আমি প্রায়ই উর্মিলার পাশে বসতাম। দেয়ালে হেলান দিয়ে, কুশন কোলে নিয়ে। বৌদি বুকের নিচে কুশন গুঁজে উপুর হয়ে শুয়ে খেলতেন। একেক সময় উর্মিলার সাথে আমার হাতের ছোঁয়াছুঁয়ি হয়ে যেত। আমি শিহরিত হতাম। বৌদি উজ্জল ফর্সা হলেও উর্মিলার রং ছিল চাপা। চাপা রঙেও একধরনের লাবন্য উপচে পড়ত।

‘আসলে, তুমি উর্মিলার প্রেমে পড়েছিলে।’

‘আমার মনে হতো, উর্মিলা আমায় পছন্দ করে।আমি আড়-চোখে তাকে লক্ষ্য করতাম। খেয়াল করলাম, সেও আমায় লক্ষ্য করে। সম্ভবত উভয় দিকেই অনুরাগ বা পূর্বরাগের পর্ব তৈরি হয়েছিল। তবে তা প্রকাশ করার সুযোগ হয়নি।তার আগেই আমায় ঐ বাড়ি ছাড়তে হয়েছিল।’

‘কেন?ডর্মে সীট পেয়ে গেলে বলে?’

‘ডর্মে যাবার সুযোগও এসেছিল সত্যি। কিন্তু যেতে হল অন্যকারনে!’

দীপঙ্কর হঠাৎ থেমে যেতেই, দেবযানী চমকে তাকাল।

‘অন্যকারনে?’

‘একরাতে হঠাৎ কারও স্পর্শে আমার ঘুম ভেঙ্গে গেল। মনে হল; নারী স্পর্শ। আমি চাপা কণ্ঠে জানতে চাইলাম, কে? আগন্তুক তার হাত আমার মুখের উপর রেখে বললো, 

“চুপ! শব্দ কোর না। সবাই জেনে যাবে।”

‘সে আমার উপর উপুর হয়ে শুয়ে আমায় জড়িয়ে ধরল। তার ঠোঁট নেমে এলো আমার ঠোঁটে। তারপর সর্বত্র। অন্ধকারে উর্মিলার মুখটা ভেবে চাপা স্বরে বারবার ‘উর্মি’ বলে ডাকলাম। তার কমনীয় ঠোঁট, পুরুষ্ঠ স্তনের স্পর্শে আমার সর্বাঙ্গ শিহরিত হয়ে উঠল। আমিও পাল্টা চুমু খেলাম।তার শরীর স্পর্শ করলাম।আমাদের শরীর উন্মোচিত হলেও ঘরের অন্ধকার আমাদের পরস্পরকে আড়াল করে রাখলো। আমি হিতাহিত জ্ঞান হারালাম। প্রবল উত্তেজনায় আমরা পৃথিবীর আদিমতম খেলায় লিপ্ত হলাম। যৌনক্রিয়ায় তার দক্ষতা আমাকে যুগপৎ বিস্মিত এবং পুলকিত করলো। 

কিন্তু দিনের বেলায় তার সাথে যখন দেখা হল, সে এমন ভাব করলো যেন গতরাতে কিছুই ঘটেনি। আমরা পরপর কয়েকদিন আগের মতই তাস খেললাম। একসাথে ব্রেকফাস্ট, লান্চ, ডিনার করলাম। সবকিছুই অতি স্বাভাবিক। আমি চোরাচোখে বারবার উর্মিলাকে দেখি। তার ভাবগতিক বোঝার চেষ্টা করি। কিন্তু সে নির্বিকার। 

ছুটির দিনগুলোতে অভিজিতদা আমাদের মস্কো শহরে বেড়াতে নিয়ে যেতেন। মস্কো ইউরোপের বড় শহরগুলোর মধ্যে অন্যতম। আমি এবং উর্মিলা সেখানকার স্মৃতিসৌধ, পুরানো ক্যাথেড্রালস, সেতু যাই দেখি তাতেই বিস্মিত, চমৎকৃত হই! মস্কো নদী, নোভোডিভিচি কনভেন্ট, শুভভস্কায়া টাওয়ার, আন্দ্রেভস্কি মঠ, লুঝনিকি স্টেডিয়াম, কলোনামস্কি পার্কের মনোহারিত্বে যত বিস্মিত হই; তারচেয়েও বেশী বিস্মিত হই উর্মিলার নির্লিপ্ততায়। তার রাতের আগ্রাসি রুপের সাথে দিনের নিরাসক্ত রূপের কোন মিল খুঁজে পাই না।যা আমাকে ভেতরে ভেতরে ক্ষিপ্ত এবং উদভ্রান্ত করে তুলছিল। 

আরেক রাতে সেই ফিসফিস কণ্ঠ, “দীপু, তুমি আমায় মিস করছিলে? তারপর সেই তীব্র-চুম্বন। সেই উন্মাদনা। সেই ভয়ঙ্কর জলোচ্ছাস। দক্ষ নাবিকের মত নোঙ্গর ফেলা। যা দিনের বেলার কমনীয়, রমনীয় উর্মিলার সাথে একেবারেই যায় না। 

রাতের অন্ধকারের উর্মিলার অবয়ব, শরীর আমার প্রায় চেনা হয়ে গেলেও, দিনের আলোয় সে আমার অচেনাই রয়ে গেল। কিছুতেই ধরা দিচ্ছিল না। একরাতে আমি জোড় করেই তাকে চেপে ধরলাম। কিছুতেই যেতে দিলাম না। মাফলার দিয়ে তার হাত খাটের বাজুর সাথে বেঁধে, জানালার পর্দা সরিয়ে দিলাম। যে মুখটি দেখলাম, তাকে দেখার জন্য আমি মোটেই প্রস্তুত ছিলাম না। পূর্নিমাচাঁদের মতই রহস্যময় সেই মুখ! আমি ভুত দেখার মত চমকে উঠলাম।’ 

দেবযানী নিঃশ্বাস বন্ধ করে দীপঙ্করের গল্প শুনছিল। তার প্রশ্নবোধক দৃষ্টির জবাবে দীপঙ্কর সন্মতিসূচক মাথা নাড়ল। ব্যাথিত কণ্ঠে বললো, 

‘হ্যা! চাঁদের আলোয় আমি প্রমিলা বৌদিকেই দেখেছিলাম। তার চোখ বেয়ে তখন অশ্রু গড়িয়ে পড়ছিল। সেই রাতের পর ঐ বাড়িতে আমার আর থাকা সম্ভব ছিল না। আমি চিরজীবনের জন্য অভিজিতদার কাছে অপরাধী হয়ে রইলাম। আর কখনও তার সামনে গিয়ে দাঁড়াতে পারিনি।’  

 

(১০)

টেবিলে ডিনার সাজাতে সাজাতে দেবযানী ভাবছিল, ‘পূর্ণিমা রাত আসলেই খুব রহস্যময়। এটা এমন একটাসময় যখন সব গোপনীয়তা প্রকাশিত হয়।’

‘মিঃ দীপঙ্কর শর্মা। আজকের রাতের বারটেন্ডার হবো আমি, দেবযানী রায়।’

‘তথাস্তু মিস রায়।’ দিপঙ্কর মাথা নত করে, নতুন বারটেন্ডারকে অভিবাদন জানালো।

দেবযানী অতি যত্নে লম্বা ককটেল গ্লাসের ধারগুলো মরিচগুড়ো আর লবন দিয়ে গার্নিশ করলো। গোটাকয়েক বেবীঅলিভ স্টিকে গেঁথে গ্লাসে বসিয়ে দিল। সেলেরির সবুজ ডাঁটা, সাথে একফালি লেবু দিতেও ভুললো না। সাজানো ব্লাডিমেরির ককটেল গ্লাস দুটো ডিনার প্লেটের পাশে এনে রাখলো।

তারা যখন ডিনারে বসেছে চাঁদের আয়তন তখন পূর্ণগোলাকার। ধবধবে চাঁদের আলোয় ব্লাডিমেরির গ্লাস দুটো উঁচু করে তারা পরস্পরকে চিয়ার্স করলো। দীপঙ্করের দিকে তাকিয়ে দেবযানী তার মোহনীয় হাসিটি হাসলো। চাঁদের আলো তীর্যকভাবে দীপঙ্করের মুখে এসে পড়েছে। কিছুক্ষণ আগের পুরনো অপরাধবোধের গ্লানিটুকু এখন দীপঙ্করের মুখ থেকে সরে গেছে। দুজনেই খাওয়ায় মনোযোগী হল। 

দেবযানী ভাবলো, হয়তো একেই বলে মাহেন্দ্রক্ষণ! এই সময়টুকু শুধু তাদের দুজনার। কেউ এসে, কোনদিনও দীপঙ্করকে কেড়ে নিতে পারবে না। সে খুব শান্ত কণ্ঠে বললো,

‘জান দীপ, উত্তর আমেরিকার টাইমজোনে আজকের রাতের পরে চাঁদটি আর কোথাও দেখা যাবে না। তখন এটি দিগন্তের ওপারে  চলে যাবে। ঠিক আমাদের মত করেই।’

দীপঙ্কর তন্দ্রালু চোখে দেবযানীকে দেখলো। তার চোখে গভীর মমতা। খাওয়া শেষ হতেই পরিতক্ত থালাবাসনের দিকে তাকিয়ে দীপঙ্কর বললো,

‘দেবী, আমার বড্ড ঘুম পাচ্ছে। চোখ খুলে রাখতে কষ্ট হচ্ছে। গলা শুকিয়ে আসছে। এতটা স্মোক করা উচিত হয়নি। ডিশগুলো এভাবেই থাক। সকালে ক্লিন করে দেবো।’

গভীরতর ঘুমে দীপঙ্করের চোখ জড়িয়ে আসে। সে উঠতে গিয়ে মাতালের মত টলতে শুরু করলো। দেবযানী দীপঙ্করের বাহু জড়িয়ে ধরে নিজের পাশে বসায়। তার নিজের শরীরও প্রবলভাবে টলছে। সে গভীর দৃষ্টিতে দীপঙ্করকে পর্যবেক্ষণ করল। ভাবলো, ‘মানুষটা আসলেই আমাকে বড় ভালোবাসে। ঘুমে তার চোখ জড়িয়ে আসছে। তবুও সে আমার সুখের কথাই ভাবছে।’

‘ডু ইউ লাভ মি দীপ?’

জড়ানো কণ্ঠে দীপঙ্কর বিরবির করে, ‘ইউ রিয়েলি থিঙ্ক আই এভার স্টপড? ইউ’হ্যাভ স্পয়েল্ড মি।আই জাস্ট অনলি সি ইউ।ইউ’হ্যাভ গট অল মাই এটেনশন।এভরি লাস্ট বিট অফ ইট।’

‘ভেবোনা দীপ। স্ট্রবেরি মুন ডুবে গেলেও আমরা এই ঝুলবারান্দাতেই থাকবো। ঠিক এমনি করে, ঐ উইপিং উইলো দম্পতির মত, অনন্তকাল একে-অপরকে জড়িয়ে ধরে রাখবো। তোমাকে হারানোর ভয় আর আমাকে ব্যতিব্যস্ত করবে না; উৎকণ্ঠিত করবে না!’

=======================