You are currently viewing সুপ্রিয়া সু চক্রবর্তী’র দুটি মুক্তগদ্য।

সুপ্রিয়া সু চক্রবর্তী’র দুটি মুক্তগদ্য।

সুপ্রিয়া সু চক্রবর্তী’র দুটি মুক্তগদ্য

ভোরের আলাপ

এই ভোরে কাকে ডেকে নিলে থেমে যাওয়া শরীরের নদী বাঁক ফিরে পাবে, ঘুমিয়ে থাকা বিছানা ছেড়ে শিশিরের মধ্যে গিয়ে দাঁড়িয়ে হাতড়াই ভোরের আলোর বুক ফুঁড়ে উঠে আসা প্রাচীন যুবকের বুক।

আকাশ দেখা বলতে শহরে, খোলাছাদটাই অসীম প্রানবন্ত আর প্রেমিকের মতো অপেক্ষায় থাকে।এদিকে ঘড়ির কাঁটার শব্দকে উপেক্ষা করলে জেগে ওঠা পায়রার পায়চারি। পাশের ফ্লাটের বারান্দায় গতরাতে মেলা দেওয়া ভিজে মলিন শাড়ি, কতগুলি ক্যাকটাস পাশাপাশি আড়চোখে পড়ে আছে — শাড়িটির পাশেই একটি ঘুঘু পাখি আমাকে দেখে চোখ সরিয়ে কত কী বলে যাচ্ছে। কে না জানে বাড়ির চৌহদ্দিতে এ পাখিটির কালো ছায়া গৃহস্থের অকল্যান ডেকে আনে। ভিটে ছাড়া করে গনগনে আগুন রঙ এর যুবতী বাস্তুর কালো সাপকে।

এখানে হুলোবেড়াল গম্ভীর স্বরে তার প্রেয়সীকে আদিম ডাকে ভুলিয়ে নেওয়ার ছল কষে যাচ্ছে এই ভোরে। ঘুম ভেঙে প্রেমিক পায়রা কাঁচা পিরীতির আগুনে ভেজাবে বলে মেয়েটির ওড়নার রঙে নিজের চোখ বুক ঠোঁট ঝলসে নিচ্ছে।

প্রেমিক পুরুষটিও না জানি রাতের কোলাহল ভুলে প্রিয়তমার আঁচল খসিয়ে বৃষ্টি ছেঁচে ; একটি দুটি তিনটি অথবা অজস্র সঙ্গমে নদীর চর ভেঙে ভেঙে খাল কেটে এনেছে ভিতরঘরে। অনন্ত নীল আকাশের নীচে রাতজাগা রতিক্লান্ত পাখিরা তোমার বুক ঝাপটে পড়ে আছে ভেজা গামছার মতো। ঝর্ণার গান, বেডরুম, ড্রয়িংরুমের সাজসজ্জা, প্রিয় রুমালের রং, ঘেমে ওঠা অন্তর্বাসের বিরহী ছোপ ছাপ, আঙুলের চঞ্চলতার ছবি পৌঁছে যাচ্ছে  আকুল প্রেমিক ইশারায়। নাগরিক গাছেদের স্তন থেকে খসে পড়ছে যাবতীয় শাদা যন্ত্রণা।

কিছুদূরে একটি আদিবাসী যুবা নির্ণীয়মান এক ফ্লাটের সামনে সারিসারি ইট সাজিয়ে রাখতে দেখছি। সুদূরের এক অখ্যাত গ্রামীণ জীর্ণ ডাকঘরের পাশে তার বউ গতরাতে গভীর সমুদ্রে সাঁতরে জলদাগ মুছে ভোরের আলো মেখে অন্ধদিন শুরু করবে বলে কাঠের উনুন জ্বালিয়েছে নিশ্চয়ই।

এসব ভেবেছি ভোরের আলাপে জন্ম যন্ত্রণার রাতের পোশাক ছেড়ে। এই ভোরে কাকে ডেকে নিলে জন্মক্ষণ ভুল নয় ভেবে অবশেষে ডেকে তুলেছি বৃদ্ধ বাবাকে। বলেছি এইবার দুঃখ-শোক-সন্তাপ-অভিমান ভালোবাসা সব ছেড়ে চলে যাব তোমার কাছে। গভীর জঙ্গলে নতুন করে বাসা বাঁধব প্রেমে। তুমি বেতস ফল, শশাফুল, ঝিঙেফুল চিনিয়ে দিতে দিতে নদীর পারে খেজুরের রস জ্বাল দেবে। ফেনিয়ে ওঠা নাগর রস পাক দিতে দিতে রসিক হয়ে উথলে উঠলে চিনিয়ে দেবে গুড়ের মহিমা। পালং এর ক্ষেত থেকে ফড়িং আর পঙ্গপালের আনন্দের নাচটুকু ফুরিয়ে এলে তাদের সর্বনাশের ফন্দিফিকিরের ফারাক বোঝাবে।

নতুন করে জেনে নেবো জন্ম থেকে কীভাবে শ্বাস কুড়িয়ে কুড়িয়ে দুই মলাটের মধ্যে পড়ে থাকে অক্ষর গানে ঝুঁকে আসা আমাদের আদিম উপন্যাস।

ভোরের আলাপ

ভোরের অনেক আগেই অক্ষরের নিপাট ভাঁজ খুলে দরজার এই চৌকাঠে এসে বসে আছি আজ। কে ডাক দিয়ে গেল এ রাত শেষে — কে জানে! জানারও বিশেষ প্রয়োজন তো নেই, বেশি কিছু জেনে নিলে জীবনকে বড় বীভৎস দেখায় চৌকো ফ্রেমে। দূরে ঐ কে চলেছে….

হোসেন মিঞা যে। বড় সাধ নৌকা বাইবে সে — তার নৌকার ভাঙা মাস্তুলে বিরহের নীল রঙ জ্বালিয়ে রেখে রাত্রির গভীর প্রক্ষোভ ভেঙে পাড়ি দেবে অজানা কোন ময়না দ্বীপে তার রাইকিশোরীর সাথে। অন্তহীন এ অপেক্ষা তার। ঝিল্লির গান নদীর একপারে জেগে এ রাত পাহারায়। ধবধবে পুলকিত আলোর জ্যোৎস্নায় জলমেয়েটার নূপুরের আওয়াজ শুনবে নৌকাদাঁড়ের ছলাৎ শব্দে। রাইকিশোরীর আঁচল উড়বে নদীর গভীরে।

জীবনের এমনই সব শেষ পঙক্তির কিনারায় এসে আমাদের হারিয়ে ফেলা শৈশব, যৌবনের সমস্ত তরঙ্গের দিকে সকরুণ চোখ মেলে তাকিয়ে থাকে বেঁচে থাকা অসাড় আঙুলে। কপালের ভাঁজে হুতাশ শব্দ জানায় আমাদের যা আছে তার সমস্ত নিয়েও প্রায় খালিহাতে শেষমেশ ফিরে যাওয়ার প্রতিলিপি নিয়ে অসহায় এ প্রহরগোনা।

আমাদের ভাঁড়ারে মূল্যহীন এক আয়না পড়ে থাকে। তাৎক্ষণিক ও চলতি মরসুমের ছবি পড়ে তার উপর। ফেলে আসা কোনো গানের কলির সাথে ছন্দ মেলানোর দায় তার নেই। হোসেন মিঞার সাধ ভারি নৌকা বেয়ে পাহাড়ের দেশে নিয়ে যাবে আমাকে এক পরমাশ্চর্য জ্যোৎস্নারাতে।

হোসেন মিঞা তুমি কি জানো পাহাড়ের গায়ে যে ঝর্ণা বাধা পেয়ে সরোবর হয়ে গেছে তার গান কোন সুরে বাজে। জানো কি তুমি পাহাড়ের গা বেয়ে যে বন, যে নদীরেখ স্মিত চাঁদের আলোয় স্নিগ্ধ অনাবিল স্থির এক স্বপ্নদেশের হাতছানি দেয়। যেখানে পথে পথে হলুদ নীল সবুজ ফুল। উঁচু নীচু এলোমেলো পথ জ্যোৎস্নার ইশারায় আসলে প্রাচীন এক সন্ন্যাসীর দেশে নিয়ে চলে যেখানে প্রকৃত চাঁদ কথা হারিয়েছে অথচ সে অমৃতলোকে অন্ধকারের ক্লিন্ন চলাফেরাটুকু নেই!

জানো কি সেখানে ধূ ধূ প্রান্তরে কাশবন, শিউলিছায়া বনঝাউ এর কত বিরামহীন খেলা উদাসীন হয়ে পড়ে আছে। অথচ তার মায়ারূপ নদীর জলের সাথে রোজ রাতে জলকেলি করতে আসা রূপসীর সাজে অসহনীয় সুখ দেয়। তুমি নিয়ে যাবে সেইখানে?

আচ্ছা হোসেন মিঞা তুমি ওই কিছু গল্পগাছা পড়েছ কখনও?যেখানে রাত জেগে এক বন্দী কিশোর এমনই এক মৃত্যু ভোরের ছোঁয়া পেয়ে ওঠার আগে তার জীবনের যত প্রাপ্তি লিখেছিল। লিখেছিল তার আলতাপায়ের শ্যামলাগায়ের প্রেমিকার কথা! কত কথা লিখেছিল সে সেই রাতে। তাকে ঠকিয়ে কতবার জীবন মুখোশে ঢেকেছিল। এসব তোমার পড়বার কথা কিনা জানিনা। তোমাকে দেখিনি তো। মনেও পড়ে না জন্মের আগে কখনও তোমার সাথে আলাপ ছিল কিনা।

তবুও তোমাকেই ডেকেছি বন্ধুতায়, প্রিয়তায় অসহায় অন্ধত্বে, আর তোমাকে শুধু ডাক দিতে শুনেছি — সুখ, আছো তুমি?

হোসেন মিঞা তুমি না বাইতে পারো এই বৈতরণী তবুও যাব একদিন এক পাহাড়ের গায়ে ওখানে পরম প্রিয়র বাস। যাব কখনও এক নদীর পারে সেখানে আমার জন্মদাতার ঘর। মা ভাইয়ের অপার স্নেহ। হোসেন মিঞা সমুদ্রের ধারেও যাব একদিন শেষমেশ, যেখানে আমার প্রেমিক থাকে। ফুলের বাড়ি যাব বারবার যেখানে আমার আত্মজার ছেলেবেলা।

তুমি বৈঠা নামাও। আর কত বাঁচবে সুখের ভেতর এ ঘুমভোরে। আমার এসব অলীক কথা, এসবের কোনো সাহিত্যগুন নেই।  নাই বা থাকল। জীবনের কাছেই নিথর পড়ে আছে যেখানে এ সমস্ত সুতো ছেঁড়া ইচ্ছেঘুড়ি, সেখানে আর চিত্রকলা নেহাতই অর্বাচীনের সময় অসুখ।

জানো শেষবার যেদিন ভোর ডেকেছিলাম রাজার নৌকায় শেষ সম্বলটুকু ছেড়ে মুঠো মুঠো ধান ভরে দিয়েছি তার আলোজুড়ে। যাবার কালে আমার এ নিঃস্ব করতল আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। সহজ ছিল না মোটেই। ইছামতী বয়ে গেছে তালুর পিঠে — মশালে মশালে রক্ত ছিটিয়ে আগুন উসকে দিতেই তবেই তো সে চিতা……. যাক সেসব।

তুমি ভবপারেই থেকো হোসেন মিঞা। সুখ প্রাণে বাঁচলে পরবাসী তোমার ঘরেই আলতা-পিদিমে ভোরের আলাপে তুলসীমন্ত্র গাইবে সে….!