You are currently viewing সুন্দর আর কিছুই নয়, ভয়ংকরের সূচনা || ঋতো আহমেদ

সুন্দর আর কিছুই নয়, ভয়ংকরের সূচনা || ঋতো আহমেদ

সুন্দর আর কিছুই নয়, ভয়ংকরের সূচনা

ঋতো আহমেদ

কবিতার কাছে কেন ফিরতে হয় আমাদের? কবিতা আসলে কী? জীবনকে সম্মুখীন হওয়ার যন্ত্রণাময় এক সংগ্রামই তো কবিতা। নয়তো ইয়েট্‌স কেনইবা তাঁর বান্ধবী ডরোথি ওয়েলেসলিকে চিঠিতে লিখবেন, ‘I need a new stimulas now that my life is a daily struggle with fatigue. I thought my problem was to face death gaiety, now I have learnt that it is to face life.’ হ্যাঁ, জগত্‌সৃষ্টির মুহূর্ত যতটা রহস্যাবৃত, কবিতাসৃষ্টির জন্মমুহূর্ত পাঠক তো দূরের কথা স্বয়ং কবির কাছেও ততটাই দুর্জ্ঞেয়, দুরবগাহ। আর তাই হয়তো ভালেরি তাঁর আপন কবিতার জন্মমুহূর্তগুলিকে ক্রমাগত খনন করে গেছেন। জানতে চেয়েছেন চির অমীমাংসিত প্রশ্নের উত্তর। [he was perpetually engaged in solving an insoluable puzzgle.] নিজেকে খনন করে নিজেরই যন্ত্রণার উৎস সন্ধানে কবি যেন উন্মত্ত হয়েছেন। কিন্তু আমরা দেখেছি সব কবির ভেতরেই শোকের ঘন ছায়া লুক্কায়িত থাকে। আর তাই কবিতার জন্মমুহূর্ত হয় বেদনাদিগ্ধ। কী রূপে তার প্রকাশ হবে তা হয়তো কবি নিজেও আগে থেকে অনুমান করতে পারেন না। এই বেদনা জ্ঞানচক্ষু উন্মেষের বেদনা। এই বেদনায় আত্মস্থ থাকে দুঃখ যা সৃষ্টির আনন্দে জগৎসংসার প্লাবিত করে। রাইনার মারিয়া রিলকাও আমাদের আরও গভীরভাবে এই বেদনাদিগ্ধ আনন্দকে অনুভব করান তাঁর কবিতায়, গদ্যে ও চিঠিতে। মনে আছে, আমাদের ছাত্রাবস্থায় তখন আমার বিছানায় বালিশের পাশেই পড়ে থাকতো কালো মলাটের ৭২ পৃষ্ঠার ছোট্ট একটা বই। শক্তি চট্টোপাধ্যায় আর মুকুল গুহের অনুবাদে রিলকার ‘দুইনো এলিজি।’ সেই সময়ে অদ্ভুতভাবে আবিষ্ট হয়ে পড়েছিলাম তাঁর সেইসব উচ্চারণে। ‘কে, আমি চেঁচিয়ে উঠি, দেবদূত-অনুশাসনের মধ্যে আমার কথা শুনবেন?/ এবং যদি ওদের মধ্যে কেউ আমাকে তার বুকে জড়িয়ে ধরেন,/ আমি তার জোরালো অস্তিত্বের চাপে মিলিয়ে যেতে পারি।/ কেননা, সুন্দর আর কিছুই নয়, ভয়ংকরের সূচনা,…’।

হ্যাঁ, প্রতীকী হিসেবে বিংশ শতাব্দীর এই ইউরোপীয় কবিকে শেষ অন্তর্মুখী মানুষ বলে চিহ্নিত করা যায়। কারণ, তাঁর কবিতার, তাঁর চিঠিপত্রের, তাঁর ভাবনার অভিমুখ আশ্চর্যরকম অন্তর্মুখী আলোয় উদ্ভাসিত। আমাদের মধ্যে কেউ কেউ, হয়তো জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে, সবসময়ই অতীন্দ্রিয় আর অধিবিধ্যার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে থাকব। অন্যদিকে, অন্তর্মুখীতার যুগে, পাশ্চাত্যের সংস্কৃতির ফুল ফোটানোর সেই ব্যক্তিস্বাতন্ত্রবাদ আর চিন্তাশীলতা, এখন আর নেই। সেই তখনই রিলকা নিজেও মনোভাবের একটা বড় পরিবর্তন অনুভব করেছিলেন। কারণ, তাঁর জীবদ্দশাতেই, ধর্মীও উপাসনার আরও সংগঠিত রূপ আর বিশ্বাস নিজেই ক্রমান্বয়ে হ্রাস পেয়েছিল। তিনি কখনই সেভাবে প্রচলিত ঈশ্বর-বিশ্বাসী ছিলেন না। তবে, ঈশ্বর ধারণা কিংবা ঈশ্বর অনুভূতি তাঁর কাছে অনেক বড় অর্থ বহন করত। হ্যাঁ, এই একটি ব্যাপার তাঁকে কেবলমাত্র একজন মহৎ কবিই নয়, ঐতিহাসিকভাবে একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব হিসেবে প্রতীয়মান করে তোলে। জীবদ্দশাতেই যথেষ্ট উচ্চতায় ছিল তাঁর খ্যাতি। ২০ শতকের গোড়ার দিকে, যখন ইউরোপীয় সাংস্কৃতিক গতি হঠাৎ করেই তীব্রভাবে ধর্মনিরপেক্ষ আর রাজনৈতিক হয়ে ওঠে, তখনও তাঁর উচ্চতার কোনও পতন হয়নি। বরং, উত্তরোত্তর বৃদ্ধিই পেয়েছে। রাজনৈতিকভাবে জড়িত ভবিষ্যৎ তখন শিল্পের রূপ কী হওয়া উচিৎ তার চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছিল। ফলশ্রুতিতে রিলকার ‘এঞ্জেলস’ আর ‘রোজেস’ হঠাৎ যেন অপ্রাসঙ্গিক মনে হচ্ছিল। এতো কিছুর পরও আমার কাছে মনে হয়, রিলকার কৃতিত্ব আর তাঁর অবস্থান, প্রায় শত বর্ষ পেরিয়ে আরও বেশি মর্মস্পর্শী হয়ে উঠেছে।

সেই ১৯২৬ সালে, যখন তিনি মাত্র ৫১ বছর বয়সে মারা যান, তখন সবাই রিলকা পড়ছিলেন। সবাই বলতে আমরা বলতে পারি ইংরেজ ঔপন্যাসিক ভার্জিনিয়া উল্ফকে, নিতে পারি ভবিষ্যতের অ্যামেরিকার শিল্প সমালোচক মেয়ার শ্যাপিরোর নাম, যিনি ইউরোপে প্রথম ভ্রমণে যখন গিয়েছিলেন, তাঁর পকেটে ছিল রিলকার বই। অস্ট্রিয়ার আধুনিকতাবাদী ঔপন্যাসিক রবার্ট মুসিল ছিলেন তাঁর ভক্ত। ছিলেন ফ্রান্সের ধর্মীয় অন্তর্নিহিততা আর নিত্‌সে-পন্থি সুক্ষ্ম ঔপন্যাসিক আঁদ্রে জিদ। ছিলেন তুলনামূলক জতিলতার আধুনিকতাবাদী কবি পল ভালেরি। আর তারা দুজনেই রিলকার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন আর তাঁকে আসীন করেছিলেন অতি উচ্চ শৈল্পিক মর্যাদায়। মুসিল ১৯২৭ সালে এক দীর্ঘ স্মারক বক্তৃতায় রিলকার ভাষার ভূয়সী প্রশংসা করেন। কিন্তু এরপর, এর মাত্র ১০ বছর পর জার্মান-ভাষী জানাশোনা বৃত্তে এবং আরও কিছু বছর পর ব্রিটেনে, বিশ্বযুদ্ধের প্রাদুর্ভাবের সময়ে, রিলকা আর প্রাসঙ্গিক ছিলেন না। জার্মান প্রগতি-পুরোধা সমালোচকগণ তখন কাফকার কল্পনার জগতে ডুবে ছিলেন। কাফকা তখন উপহার দিয়েছিলেন এক নতুন ধরনের গদ্য। আর ব্রেখ্‌ট, এমন একজন কবি, যিনি নাটকীয় মঞ্চে বিপ্লব ঘটিয়ে বিশ্বের পরিবর্তন আনতে চেয়েছিলেন।

কিন্তু কেন হঠাৎ এমন হল? কারণটা সহজ। রিলকা ছিলেন খুবই পরিমার্জিত। তাঁর আবেদন ছিল শিক্ষিত সংখ্যালঘুদের কাছে। কিন্তু ব্রেখ্‌ট, তাঁর গীতিকবিতা আর থিয়েটারের ধারণা তুলে ধরেছিলেন গণমানুষকে উদ্দেশ্য করে। তাদের স্বাগত জানিয়েছিলেন সাহিত্যের জগতে। তাদের অভিজ্ঞতা, ভাষা ছিল রুক্ষ আর ক্ষুধার্ত। এবং আরও স্বতঃস্ফূর্ত। যা তিনি সচেতনভাবে নিয়ে আসতে চেয়েছিলেন সাংস্কৃতিক মূলধারায়। আর কাফকার প্যারাবল ছিল কর্তৃত্বের রহস্যময় পথ, যা তখনকার নতুন ধরনের রাজনৈতিক অভিজ্ঞতায় আঘাত করেছিল। এভাবেই বিভ্রান্ত সাধারণ মানুষ নিজেকে আবিষ্কার করেছিল উঁচুতলার মানুষের কর্তৃত্বের মুখোমুখি। যদিও কর্তৃত্বের এমন চাপ সবসময়ই ছিল। কাফকার রচনার এই রাজনৈতিক প্রভাব সর্বগ্রাসী হয়ে সমগ্র ২০ শতক জুড়েই ছিল। কিন্তু অপরদিকে, রিলকার রচনা মোটেও রাজনীতি সম্পর্কিত ছিল না। হ্যাঁ, পুরো ব্যাপারটা সামনে রেখে দেখলে এমনই দেখতে পাব আমরা। বলা যেতে পারে জার্মানি-অস্ট্রিয়া, ফ্রান্স, ব্রিটেন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গত শতাব্দীতে তাদের নির্দিষ্ট রিলকা টাইমলাইন ছিল। সেই তুলনায় আমেরিকার পাঠকরা রিলকাকে নিরবচ্ছিন্নভাবে ভালোবাসতেন বলে মনে হয়, কারণ তিনি তাদের শিল্প জীবনের গতি এবং শৈলীর একটি চলমান সমালোচনা উপহার দিয়েছিলেন। রিলকা আমাদের সকলকে বস্তুবাদী-প্রযুক্তিগত আক্রমণ প্রতিরোধে সাহায্য করার জন্য কবিতার একটি ফাংশন দিয়েছেন এবং এখনও দিচ্ছেন। তিনি আধ্যাত্মিক, কিন্তু ধর্মীয় নন। যা আজকাল একেবারেই বিরল।

ইউরোপীয় সময়রেখায় আমরা দেখতে পাই, মহাদেশটি যুদ্ধ আর রাজনৈতিক সংকটে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। সেখানে আধ্যাত্মিক প্রভাব খুব দ্রুতই পুরনো হয়ে ওঠে। আর কবিতা নিজেকে আমূল আধুনিকীকরণ করে ফ্যালে। ৩০এর দশকের পর, বিশেষত ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে পরাজয়ের পর, চরম মুদ্রাস্ফীতি, জাতীয়তাবাদ, আর সংঘটিত শ্রমশক্তির উত্থানের পর জার্মানিতে কবিতা আরও বেশি সামাজিক হয়ে ওঠে। ইংল্যান্ডেও এটা অনুসারিত হয়েছে, তবে তা থেকে থেকে, একেবারে ধুম করে নয়, আস্তে আস্তে এক দশকের মধ্যে মিলিয়ে গিয়েছিল সেই আধ্যাত্মিক আবেদন। তবুও এইসব, আর সেই পরিবর্তনের গতিকে একটা বিপ্লবই বলা যায়। সংবেদনশীলতার বিপ্লব। সময়ের প্রয়োজনে সবকিছুকে যেভাবে অনুধাবন আর মূল্যায়ন করা হয়েছিল তা একপ্রকার বিপ্লবই। সাহিত্যে “আধুনিক” এবং “আধুনিকতা” বলতে যা বোঝায় তার সঙ্গে এই নতুন বিপ্লবের সবকিছুই জড়িত ছিল। সেইসব সাংস্কৃতিক ঘটনা—যে কারণে তারা সচেতনভাবে সংগঠিত হওয়ার চেয়ে বেশি অভূতপূর্ব ছিল—তাদের যথাক্রমে অন্যান্য কারণও ছিল।

ঐ সময়টার দুই বা তিন দশক আগে, সর্বোপরি, একটি নান্দনিক বিপ্লব হয়েছিল, যার মধ্যে অস্কার ওয়াইল্ড এবং হেনরি জেমস বাইরের প্রান্তটি ধরেছিলেন এবং রিলকাও এটি স্পর্শ করেছিলেন। প্রকৃতপক্ষে তিনি পরিবর্তনের চাকার নিয়ন্ত্রণের কাছাকাছি ছিলেন। এমনকি বলা যায় তিনিই পরিবর্তন ঘটাচ্ছিলেন। যেভাবে লিখেছিলেন সেখানেই ছিল পরিবর্তনের চাবি। তিনি ছিলেন বিষয়ভিত্তিক। তিনি তার অভ্যন্তরীণ অনুভূতি সম্পর্কে বিশ্বকে জানাতে চেয়েছিলেন এবং নিজেকে পৃথিবীতে স্থাপন করতে তিনি কতটা কষ্ট পেয়েছেন তা প্রকাশ করে গেছেন। সেসব চরাই-উৎরাই তাঁকে পেরুতে হয়েছিল ২০ শতকের প্রথম দিককার বছর গুলোয়। তাঁর অন্তর্নিহিত সত্ত্বাকে লিপিবদ্ধ করতে তিনি কতোটা উদ্বিগ্ন ছিলেন তা প্রকাশের জন্য একটা নতুন পথের সন্ধানে ছিলেন। এবং তারপরও তিনি ১৯ শতকের ধৈর্যশীলতা আর জার্মান আঞ্চলিকতাকে সম্পূর্ণরূপে ছাড়েন নি।

আমরা শিল্প নিয়ে কথা বলি ঠিকই কিন্তু আজকের দিনে শিল্পকলা একপ্রকার বাণিজ্যিক ধারণা বা পণ্যে পরিণত হয়েছে। হ্যাঁ, শিল্প বাণিজ্যের পথে চলে, কারণ শিল্পীদের বাঁচতেও হয়। যারা একে এফোর্‌ড করতে পারেন কিংবা যারা পারেন না, তারাও জীবনে শিল্প চান, তাই একে কেনার, ধার করার বা চুরি করার উপায় খুঁজে বেড়ান। কিন্তু এখানে তারা যা চায়, আমি বলতে চাচ্ছি সেটা শিল্প, শিল্পকলা নয়। এ আমাদের মহত্তর প্রয়োজন। একইভাবে, ইংরেজিতে একরকম বিভ্রান্তিকর শব্দটি শুধুমাত্র পেইন্টিং বোঝায় না। আমি ‘শিল্প’ শব্দটি ব্যবহার করার সঙ্গে সঙ্গে বোঝাতে চাইছি এর অর্থ জার্মান শব্দ ডাই কুনস্ট [die Kunst] দ্বারা বোঝায় এমন সবকিছুই। সংগীত, স্থাপত্যকলা, কবিতা, নাটক এই সবকিছুই। (চলচ্চিত্রও আসবে এখানে তবে রিলকার জীবদ্দশায় অতটা নয়, অন্তত তাঁর অভিজ্ঞতায় চলচ্চিত্রের আসন নেই বললেই চলে।) শিল্পের ধারণা, এই সমস্ত সৃজনশীল ক্রিয়াকলাপকে একটি পরিমার্জিত ও গভীরভাবে করা কাজের প্রতিক্রিয়ার সঙ্গে সম্পর্কিত করে, যাকে বলা যায় মানুষ। প্রকৃতি, হতে পারে অনিবার্যভাবে সুন্দর, নাটকীয়, দৃষ্টান্তমূলক এবং মহৎ। আমরা প্রকৃতির অনেক বার্তাই পড়তে পারি। কিন্তু এটি নিজে থেকে, শিল্প এবং শিল্পীরা আমাদের যা দেয় তা কখনই তৈরি করতে পারে না, যেমন, আমাদের চারপাশের জীবন কীভাবে আমাদের কল্পনার সঙ্গে ধাক্কা খায় এবং উদ্দীপিত করে, শিল্পই কেবল তার একটি দারুণ শৈল্পিক উপস্থাপন ঘটাতে পারে আমাদের সামনে, প্রকৃতি পারে না।

সঙ্গীতের কথাই ধরা যাক। সেই ২০ শতকের শুরুর দিকে, শাস্ত্রীয় সঙ্গীত শিল্পে রিলকার অস্ট্রিয়া আর জার্মানিতে যা ঘটেছিল তা হতে পারে এক উৎকৃষ্ট উদাহরণ। যদিও শ্রোতারা প্রতিবাদ করেছিলেন, তারপরও শোয়েনবার্গের অ্যাটোনাল মিউজিক আধুনিক প্রযুক্তি-চালিত অবস্থাকেই প্রকাশ করেছিল। ব্যাপারটা দারুণ উত্তেজনাপূর্ণ, বিস্ময়কর হলেও পুনরাবৃত্তিমূলক আর আপাতদৃষ্টিতে চিরতরে অসমাপ্ত ছিল। সংবেদনশীল মানব হৃদয় হঠাৎ কোথায় আশ্রয় নিতে পারে তা জানত না বোধয়— এবং কোথাও সম্ভবত অন্তর্নিহিত উত্তরও ছিল না। ব্যাপারটা ছিল আধুনিকতার মুখোমুখি হওয়া, অর্থাৎ, অনেকটাই মেশিন-যুগের দ্বারা উন্মোচিত একটি নির্দিষ্ট নতুন ধরনের অস্পষ্টতা এবং অপক্কতার দিকে এগিয়ে যাওয়া। শোয়েনবার্গের পূর্ববর্তী নব্য-রোমান্টিক কমপোজিশানটি বেশ ভিন্ন ছিল। শোয়েনবার্গ নিজেই ফ্যাশনের শেষ প্রান্তটি ধরেছিলেন, যে কারণে অনেক রোমান্টিক শ্রোতা তাঁর [প্রচুর টেক্সচারযুক্ত, টোনাল] প্রাথম দিকের কাজ বেশ পছন্দ করেন। ব্যক্তিগতভাবে আমি যেন সেখানে আশ্রয় খুঁজে পাই। রিলকার মতোই আধ্যাত্মিক আশ্রয়। শোয়েনবার্গের প্রথম দিকের কাজ ছিল মধ্যবর্তী পর্যায়ের। আধ্যাত্মিক আর আধুনিকের মাঝামাঝি। অনেকটা রিলকার মতো। রিলকা— তীব্রভাবে স্বতন্ত্র গানের কথা এবং তাঁর তথাকথিত ‘বিষয়-কবিতা’কে অনুভব করতে পারছিলেন তখন। তাঁর উপাখ্যান আর তাঁর সনেটগুলি ছিল নতুন ধরনের। এই কারণেই রিলকাকে মনে হয় শোয়েনবার্গের মতোই এখনও যথেষ্ট আধুনিক নন। কিন্তু রিলকাকে রক্ষণশীল এবং একচেটিয়াভাবে নান্দনিক-মনোভাবাপন্নও বলতে পারি না। তাঁর রচনা তাকে যে নতুনত্ব দিয়েছে, তা তখন মেলে না। তিনি যে বিশ্বকে সম্বোধন করেছিলেন সে তার আধ্যাত্মিকতা হারাচ্ছিল, এবং শোয়েনবার্গ যেমন সঙ্গীতের একটি নতুন ভাষার প্রয়োজন অনুভব করেছিলেন, তেমনি রিলকা পুরানো ভাষা চলতে পারে কিনা তা নিয়ে নিরীক্ষা করেছিলেন। পরীক্ষা করেছিলেন বিশ্বাসযোগ্যতা হারানো ঈশ্বর এবং আত্মা বলতে কী বোঝায় এবং এর অর্থইবা কী।

রিলকা সীমিত পরিসরে শারীরিক অভিজ্ঞতা নিয়ে কাজ করেছেন। জাগতিক জীবনে তাঁর লক্ষ্য ছিল সীমিত। কিন্তু তাঁর কবিতাগুলো মহৎ জীবনজিজ্ঞাসায় পরিণত। ১৮৭৫ সালে প্রাগে জন্মগ্রহণ করেছিলেন তিনি। থাকতেন মিউনিখে। ১৯ শতক সমাপ্ত হওয়ার আগে আগে তিনি ইটালি ভ্রমণে বের হন। সেখানে রোম এবং ফ্লোরেন্সে তিনি মহান মানবতাবাদী ঐতিহ্যে তার ধর্মনিরপেক্ষ বিশ্বাস পরীক্ষা করতে শুরু করেন। সেখান থেকে তিনি রাশিয়া গিয়েছিলেন, উত্তর-জার্মান গ্রামাঞ্চলে এক বছর কাটিয়েছিলেন এবং ১৯০২ সালে প্যারিসে চলে যান। মহান যুদ্ধের সময় তিনি মিউনিখে সীমাবদ্ধ ছিলেন। তারপরে তিনি বিনয়ীভাবে ভ্রাম্যমাণ ছিলেন এবং কৃতজ্ঞতার সঙ্গে জীবনের শেষ পাঁচ বছর তাঁর নামে কেনা একটি সুইস বোলথোল [এমন এক বাড়ি/স্থান যেখানে মানুষ নিজেকে আড়াল করতে পারেন, লুকাতে পারেন] গ্রহণ করেছিলেন। টানা দুই বছর ধরে ভয়ানক যন্ত্রণা সহ্য করে ১৯২৬ সালে তিনি যখন লিউকেমিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মারা যান, তখন তাঁর কবিতা তাঁর ক্রমবর্ধমান পাঠককুলের কাছে একেবারে চকচকে নতুন ছিল। এমনকি এখনও এই শত বর্ষ পরেও তিনি নতুন। আমরা যদি আরও এগিয়ে যাই, আগ পিছ করে ঢুকে যাই এই আধুনিক যুগেও—কী সেই ব্যাপার যা রিলকাকে এত মহৎ করে তুলেছে? সীমিত পরিবেশে নিজেকে সাড়া দেবার তাঁর আশ্চর্য ভঙ্গিই কি সেই কারণ? যেখানেই গিয়েছেন তিনি সর্বত্র প্রকৃতি এবং শিল্পের আলোড়নগুলিকে উপভোগ করতেন এবং অন্ধকার আর হালকা আকাশের নীচে পশু, পাখি এবং গাছের মধ্যে বাস করতে পছন্দ করতেন। তাঁর জীবনে বাতাস, নক্ষত্র এবং মাটির শক্তিশালী উপস্থিতি ছিল, কিন্তু মানুষ তুলনামূলকভাবে ছিল দুষ্প্রাপ্য। তবে তাঁর চিঠিপত্রের মাধ্যমে আমরা জানতে পারি প্রত্যেকটি মানুষের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ ছিল গভীর আত্মিক।

রিলকা তাঁর জীবনে যেমন পরিচিত ও কাছের বন্ধুদের চিঠিপত্র লিখেছেন ঠিক তেমনি অনেক অপরিচিত পাঠককেও চিঠি লিখেছেন যাদেরকে ব‍্যক্তিগতভাবে একবারেই চিনতেন না। ১৯২৬ সালে ৫১ বছর বয়সে তাঁর মৃত্যুর সময় চিঠিপত্রের মোট সংখ্যা হয়েছিল ১৪০০০। গদ‍্য এবং কবিতার মতো এগুলোকেও তিনি প্রকাশিত হ‌ওয়ার সমান গুরুত্বপূর্ণ ও মূল্যবান মনে করতেন। এই বিশাল পত্র বিনিময় সম্ভারে ২৩ টি চিঠি আছে যেগুলোকে শোকগাঁথা বলা যায়। প্রায় ১০০ বছর হয়ে গেল, এগুলো আমাদের উদ্দীপিত করছে এবং সাধারণ দৃষ্টির আড়ালে এগুলোর যেন এক শক্তিশালী অন্তর্দৃষ্টি আছে। বিশৃঙ্খলভাবে আর কিছু কিছু পুনরুদ্ধারে সম্ভব নয় এমনভাবে প্রকাশিত হয়েছে। আর সমাহিত হয়ে আছে দুই মহাদেশের দুই সংগ্রহশালায়। এখানে পাওয়া যাবে রিলকার সেই চিঠিগুলো যাতে ক্ষয়, বিষাদ আর মরণশীলতা বিষয়ে তাঁর গভীর চিন্তা ভাবনা প্রতিফলিত হয়েছে। মৃত্যু যে একটি রূপান্তর প্রক্রিয়া তা এই চিঠিগুলোয় সৎ ও স্থির স্বীকারোক্তির মাধ্যমে প্রকাশিত। যেমনটি রিলকার জনপ্রিয় লেখা “লেটারস টু এ ইয়ং পোয়েট” এ আছে। ঐকান্তিক আত্ম-রূপান্তরের জন্য স্থির স্ব-হিসেব আর একাকীত্বের স্বীকৃতির গল্প এটি। আলাদাভাবে পড়লে দেখা যায়, রিলকা একেকটি চিঠি একেক জনকে লিখেছেন কিন্তু বিষয় সেই একই, জীবনের ক্ষয়িষ্ণুতা, এক‌-মনে এক‌ই উদ্দেশ্য নিয়ে লিখেছেন, কাউকে যেন সহযোগিতা করছেন, যেন ব‍্যক্তিগত ক্ষতিতে শোকগ্রস্ত কাউকে সান্ত্বনা দিচ্ছেন। ক্ষতিগ্রস্ত হলে কেমন লাগে আমাদের? সমস্ত কথাবার্তাকে নিরর্থক মনে হয়, মনে হয় আমাদের বিষন্নতা আর কষ্টকে প্রশমিত করতে অপারগ এরা। প্রিয়জনের বিয়োগে ব‍্যথিত কাউকে আমরা কীভাবে সান্ত্বনা দিতে পারি? যে ব‍্যাপারে রিলকা বারবার জোর দিয়েছেন। শুধু কিছু জিনিস সাজিয়ে রাখা ছাড়া আর কিছু পারি না আসলে। ক্ষতি আর বিষাদগ্রস্ত সময়ে এই চিঠিগুলো আমাদের অন্তর্গত কন্ঠকে কাটিয়ে উঠতে দিকনির্দেশনা দেয়। এমনকি চরম বিধ্বংসী অভিজ্ঞতাকেও আমাদেরকে নৈঃশব্দ্যে বা আসাড়তায় আচ্ছন্ন করে ফেলতে দেয় না। সেরকম একটা চিঠির উল্লেখ করছি এখানে—

রবিবার, ৮ই ডিসেম্বর, ১৯০৭; রিলকা একটি চিঠি লিখেছিলেন মিমি রোমানেল্লীকে। ইনি আর্ট ডিলার পিয়েত্রো রোমানেল্লীর সর্বকনিষ্ঠ বোন। রূপ-সৌন্দর্য আর সংগীত প্রতিভার জন্য বিখ্যাত ছিলেন। ১৯০৭ সালে ভেনিসে রিলকা এঁর পারিবারিক হোটেলে কিছুদিন ছিলেন। সেখানে তাদের মধ্যে বিশদ রোমান্টিক সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল এবং পরবর্তীতে তাদের অনেক চিঠিপত্রের আদান-প্রদান হয়।

“জীবনে মৃত্যু রয়েছে। অথচ কী আশ্চর্য দ্যাখো, আমরা এই বিষয়টি অবহেলা করার ভান করি। মৃত্যু, যার নির্মম উপস্থিতি আমরা টের পাই আমাদের প্রতিটি টিকে যাওয়া পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে কেননা আমাদের অবশ্যই মরতে শিখতে হবে এবং তা ধীরে ধীরে। মরতে শিখতে হবে: জীবনের খাতিরে। ক্রমশ নিজেকে তৈরি করতে হবে একটি গৌরবময় ও মহৎ মৃত্যুর জন্য। এমন মৃত্যু যেখানে আচমকা-র কোনও ভূমিকা নেই, পূর্ব পরিকল্পিত, উৎসাহ উদ্দীপনা ও আনন্দময় মৃত্যু, যেমনটি সাধু সন্ন্যাসীরা জানেন কীভাবে পেতে হয়। একটি দীর্ঘ ও পাকাপোক্ত মৃত্যু যা এর ঘৃণিত নামকে নিশ্চিহ্ন করে দেবে। এটা একটা সংকেত ছাড়া কিছু না, যা কিনা অনামি এই বিশ্বে সেইসব নিয়মগুলো ফিরিয়ে দেয়, যেগুলোকে স্বীকৃতি দেয়া আর উদ্ধার করা হয়েছে তীব্র ও মার্জিত জীবনধারার মাধ্যমে। ছোটকাল থেকেই মৃত্যুর এই ধারণা আমার মধ্যে একটার পর একটা বেদনাদায়ক ঘটনার মধ্য দিয়ে গড়ে উঠেছে। আমাকে বাধ্য করেছে ছোট ছোট মৃত্যুকে বিনীতভাবে গ্রহণ করতে, যেন আমি সেই মৃত্যুর যোগ‍্য হয়ে উঠতে পারি যা আমাদের মহৎ করে তুলবে।… সবসময় মৃত্যু ব‍্যাপারটা আমার ভেতর চলমান থাকে। ভেতরে ভেতরে কাজ করে। আমার হৃদয়কে রূপান্তরিত করে। আমার রক্তের লাল-কে আরো রক্তিম করে তোলে। জীবনকে নামিয়ে আনে যা আমাদের নিজস্ব ছিল, যেন তা আমার রক্তের শিরায় শিরায় কোনো অম্লমধুর বিন্দু, সবকিছুকে তীক্ষ্ণ অন্তর্দৃষ্টি সম্পন্ন করে তুলছে। চিরতরে, যা আমার হ‌ওয়া উচিত।

আর, যখন দুঃখ-বেদনা পুরোপুরি আমাকে গ্রাস করে, হে সুন্দরী, তোমার অস্তিত্ব তখন ভালো লাগার অনুভূতি সৃষ্টি করে আমার ভেতর। ভয়ভীতিহীনভাবে তোমার সৌন্দর্যে নিজেকে নিহিত করতেই তখন আমার আনন্দ। যেভাবে পাখি নিজেকে ওড়ায় আকাশে। আমি খুশি, প্রিয়া, অবিচল বিশ্বাস নিয়ে সমস্ত অনিশ্চয়তার মধ্যে তোমার হৃদয়ের সেই দ্বীপে হেঁটে গেছি আমি, যেখানে ব‍্যথা প্রস্ফুটিত হয় ফুলের মতো। শেষ পর্যন্ত: আমি সুখি। –তোমার রাইনার।”

অন্য এক বন্ধুকে লেখা আরও একটা চিঠির অংশবিশেষ—

“প্রিয় অনুজ বন্ধু,
তোমার এই চিঠি যে আনন্দ এনে দিয়েছে আমাকে তার অনেকগুলো দিক আছে: সেগুলোর অন্তত কয়েকটি আমাকে বলতে দাও। প্রথমত, যে বিষয়টি আমরা সাদরে গ্রহণ করছি এখন, তা হচ্ছে, মানুষেরা এখান থেকেই একটি নতুন পথচলার সূচনা করেছে এবং গড়ে তুলছে শাশ্বত হৃদয়ের শক্তি ও বিশ্বাস থেকে সম্পূর্ণ নতুন এক জীবন। এছাড়াও কিছু মানুষ আছে, যদিও চেষ্টা করতে পারতো, কিন্তু, তা না-করে ওখানেই স্থবির হয়ে আছে, দেখছে আর বুঝতে চেষ্টা করছে, এবং এদের জন্য বিষাদ ও জড়তায় সব সম্পূর্ণরূপে অসম্ভব হয়ে উঠছে। আর এটা যদিও অনুভব ও তার বহিঃপ্রকাশের উপর নির্ভরশীল, কেবল একটি ব্যাপার খুব দ্রুত প্রয়োজন এখন: নিজেকে শর্তহীনভাবে কোথাও প্রকৃতির সঙ্গে সম্পর্কিত করা, যা কিনা শক্তিশালী, সংগ্রামী এবং উজ্জ্বল, আর যা এগিয়ে যাবে সামনের দিকে অকপট, এমনকি দৈনন্দিন জীবনের কম গুরুত্বের কিছুও যদি হয়। প্রতিবার আনন্দের সঙ্গে সবকিছু সামাল দিই আমরা, প্রতিবার আমরা চোখ খুলি অধরা কোনও দূরত্বে, তাকাই আর মুহূর্তকে রূপান্তর করি—শুধু এই মুহূর্তটি নয়, পরের মুহূর্তকেও, এবং আমরা আমাদের অতীতকে মনের ভেতর নতুন করে সাজাই। সত্যিকার সামঞ্জস্যতাকে না জেনেই হয়তো বাইরের যন্ত্রণাকে বিলীন করে দিই, অথবা খুঁজে দেখি না কতোটুকু(হয়তোবা) জীবন-যথার্থ প্রেরণা দেয় তা। মিশে যায়, আমাদের রক্তে।…”

তাহলে কোন বিষয়টা তাঁকে দুর্দান্ত করে তুলেছে? প্রাসঙ্গিকতা নিশ্চয়ই নয়। তবে কি তিনি যে নতুন সংবেদনশীলতা সৃষ্টি করেছেন ২০ শতকের জন্য, সেটাই এর জন্য দায়ী? করেছেন এমন সময়ে যখন দর্শনের কোনও শৈলী এখনও “জীবনের অর্থ কী?” এই প্রশ্নকে অবান্তর ঘোষণা করেনি। তাঁর কবিতাগুলো আমাদের জেন্ডার এবং যৌনতা, জীবন নিয়ে আমাদের কী করা উচিত সে সম্পর্কে আমাদের বোধ, ঈশ্বরের অস্তিত্বের সম্ভাবনা, প্রাণীদের সঙ্গে মোহনীয় আত্মীয়তা ইত্যাদির সুখ এনে দেয়। আমরা যে বস্তুগুলি তৈরি করি এবং ক্রয় করি এবং বাস করতে পছন্দ করি, যে ল্যান্ডস্কেপগুলিতে আমরা প্রতিক্রিয়া জানাই, আমরা যে বইগুলি পড়ি এবং আমরা যাদের সঙ্গে থাকি সেই চিত্রকর্মগুলির মধ্যে তাঁর রচনা একপ্রকার আত্মিক সংযোগ তৈরি করে দেয়। রিলকার দৃষ্টিতে এমন কোনও বস্তু নেই যা বিস্ময়কর মহাবিশ্বের বৈশিষ্ট্যে রূপান্তরকে প্রতিরোধ করে, আমাদেরকে এমন এক জগতে আচ্ছন্ন করে রাখে যা আমাদের অস্থির ও ভীত করে তুলতে পারে। রিলকার কবিতা হচ্ছে শিল্প, প্রাণময় শিল্প। অন্য কোনও উপায়েই একে অধিবিদ্যার ধারাবাহিকতা বলা যায় না। তাঁর কবিতা আমাদের বলে দেয় কীভাবে পৃথিবীতে আমাদের অস্তিত্ব রয়েছে: কীভাবে আমরা অস্থায়ী অর্থ বুনতে শিল্পকর্মকে ব্যবহার করি। কেবল শব্দেরাই যথেষ্ট নয়। উপভোগ আর জ্ঞানার্জনের মাধ্যমে আর পরস্পরের সঙ্গে যোগাযোগের মাধ্যমে শব্দের সঙ্গে পুনরায় সংযোগ স্থাপন করতে হবে। মনে রাখতে হবে সঠিকতাই মানুষের যোগাযোগের সঙ্গে সংযুক্ত একমাত্র মান নয়। রিলকা লোহা এবং পাথরের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক উন্মোচন করেন এবং উদাহরণ স্বরূপ বলেন আমরা এভাবেই আছি, আমারা বস্তুজগতে দৃঢ়ভাবে নিহিত রয়েছি। কখনও কখনও রিলকা সেই অস্তিত্বগত অবস্থার সত্যতা খুঁজে পান স্ক্রেক্লিচ [schrecklich], ‘ভয়ঙ্কর’, কিন্তু প্রায়শই এটি বিস্ময়করও হয়।

ওহে জীবন বৃক্ষেরা, কখন আসবে শীত তোমাদের?
আমরাও কোনদিন একমনস্ক নই, যাযাবর পাখিদের মতন কিংকর্তব্যবিমুঢ়
আমরা,
আমাদের দেরি হয়, পিছনের আকর্ষণ ছিঁড়ে সহসা বাতাসে মেলি ডানা,
তারও চেয়ে দ্রুত পড়ে যাই কঠিন পুকুরে,
উন্মোচিত হই আর একই সঙ্গে কুঁকড়ে যাই, এবং কোথাও ওখানে
সিংহরা ঘোরাফেরা করে, চমৎকার হতে গিয়ে
দুর্বলতা আসে, কেউই বোঝে না—

আমরা অনুভব করতে পারি জয় এবং মূল্য অপরের, তখন যখন
আমরা একমনস্ক হয়ে থাকি,
বিরূপতাই আমাদের প্রথম প্রতিক্রিয়া, প্রেমিক প্রেমিকারা কি অনন্তকাল ধরে
ক্রমাগত নিজেদের মধ্যে পরস্পর পৌঁছাতে চেয়েছে,
প্রেমিক প্রেমিকারা কিছু সময় চেয়েছিল, গৃহ, চেয়েছিল শিক্ষার অন্বেষণ,
তাহলে, একটি মুহূর্তের যে ছবি সহসা বৈপরীত্যের পটভূমি বহু কষ্টে
সৃজন করেছে
আমাদের দেখার জন্য, স্পষ্ট আমাদের কাছে আমরা যারা তাদের
অনুভূতির অবয়ব চিনি না,
হৃদয়ের পর্দার ভেতরে কে নয় বলো বসে আছে আস্থির ব্যাকুল, …
[দুইনো এলিজি/ভাষান্তর: শক্তি চট্টোপাধ্যায় ও মুকুল গুহ]

১১ই জুন, ২০২৩; উত্তরা, ঢাকা।

******************************************

                ঋতো আহমেদ

  কবি, অনুবাদক ও প্রাবন্ধিক

*******************************************