You are currently viewing সাম্প্রদায়িকতা প্রতিরোধ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা/  হোসাইন কবির

সাম্প্রদায়িকতা প্রতিরোধ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা/ হোসাইন কবির

সাম্প্রদায়িকতা প্রতিরোধ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা
 হোসাইন কবির
সম্প্রতি উপমহাদেশের রাজনীতিতে, রাষ্ট্র ও সমাজে ধর্ম অনুষঙ্গের ব্যবহার ও প্রভাব দেখে, কেন যেন মনে হয়, টাইম মেশিনে চড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি, মধ্যযুগের গির্জা (ক্যাথিড্রাল) নিয়ন্ত্রিত ইউরোপের সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থায়; আর শুনছি– ইনক্যুজিশনে খুন হওয়া মানুষের আর্তনাদ; দেখছি দাহ্য কাঠের পাটাতনে কালো পোষাকে মুড়ানো মহামতি  ব্রুনোর পুড়ে খুন হওয়ার দৃশ্য, দেখছি মধ্যযুগে ইউরোপীয়দের ধর্মীয় উন্মাদনায় পরস্পরের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে লিপ্ত হতে, দেখছি ক্যাথলিক আর প্রোটেস্টানদের রক্তাক্ত ধর্মযুদ্ধ, একে অপরকে নির্মমভাবে পুড়িয়ে মারার দৃশ্যসহ আরো কত কী! আর সাথে খুনি আর খুনের সমর্থনে ধর্মে উন্মত্ত উন্মাদ জনতার ভয়াবহ ভয়ঙ্কর উল্লাসও! আর কত শত নারীকে ধর্মীয় কারণে ধর্মীয় উন্মাদনায় ডাইনী আখ্যায়িত করে পুড়িয়ে মারার ভয়াবহ দৃশ্য;  আর কারাবন্দী শৃঙ্খলিত গ্যালিলিওর বিচার করছে চার্চ; কারণ গ্যালিলিওর সৌরকেন্দ্রিক পৃথিবীর ঘূর্ণনের যে ধারণা, তা ছিল বাইবেলের বিরুদ্ধাচরণ; আর শুনছি মহামতি গ্যালিলিও আপ্তবাক্যে  উচ্চারণ করছেন– ‘আমি যাই বলি না কেন! রাজা যাই ভাবুন কেন! চার্চ যাই বিচার করুক না কেন! তাতে কী আসে যায়? সূর্য নয়, বরং পৃথিবীই ঘুরছে সূর্যের চারপাশে, ঘুরবে অনন্তকাল।
তবে আজ পাশ্চাত্য সমাজে সেসব অতীত, রাজার ধর্ম প্রজা পালনে বাধ্য নন, আর রাজার বিরুদ্ধাচরণে খুন (ইনক্যুজিশন) হবার ভয়ও নেই আগের মত। গির্জার রাহুর গ্রাস থেকে রাষ্ট্র মুক্ত হয়েছে, মানুষ মুক্ত হয়েছে এবং তাঁরা স্বাধীনভাবে বিশ্বাস চর্চার অধিকার পেয়েছে; যদিওবা  ধর্ম-বিশ্বাসের স্বাধীনতার স্থলে আবারো পাশ্চাত্যে কোন কোন রাষ্ট্র ও সমাজে কৌশলে ফিরিয়ে আনা হয়েছে কিছু ধর্মীয় অনুষঙ্গ ও রেয়াজ যেমন ‘We trust on god’ কিংবা বিশেষ ধর্ম-পুস্তকে হাত রেখে শপথ নেয়ার ধর্মীয় রীতি। তবে ভূরাজনীতির গভীর কূটচালের অংশ হিসেবে তারা খেলছে প্রাচ্যের মিথ পুরাণের ধর্মাশ্রিত রাষ্ট্র ও সমাজ ব্যবস্থা নিয়ে, দুর্বলতার সুযোগকে কাজে লাগিয়ে। আর এসব দেশসমূহকে খেলার মাঠও বানাচ্ছে নানান কূটচালে উন্মত্ত উন্মাদ দ্বিপদ ধর্মান্ধ ষাঁড়গুলোকে ধর্ম-আফিমের সুরা পানে লেলিয়ে দিয়ে। এ উন্মত্ততা এমনই যে, উন্মাদ উন্মত্ত দ্বিপদ ষাঁড়গুলো স্বজাতের স্বজনকে খুন করতে আত্মঘাতী হয়ে ওঠে হরহামেশাই। আর যারা মানুষ হবার পরিবর্তে শুধু ধর্মের ধর্মীয় লেবাসে ধর্মীয় পরিচয়ে পরিচিত হতে চায়! তাঁরাতো তাঁদের বাদ দিয়ে অপরাপর বিশ্বাস ও ধর্মের  মানুষকে বিদ্বেষের চোখে, বিধর্মী হিসেবে দেখে, ইহুদি নাছাড়া কাফের হিসেবে দেখে, এমনকি নিজ ধর্মের ভিন্নভাবে ধর্মাচারের, বিশ্বাসের লোকজনকেও তাই ভাবে। অতএব আলোর সমাজ, আলোকিত সমাজ, মানুষের সমাজ– তাদের ভাবনায় কখন যে চাষাবাদ হবে! তা ভবিতব্যই জানে! আসলে তাদের বোধ-ভাবনা-চিন্তার জগত মধ্যযুগের ইউরোপের ইনক্যুজিশনের সময়-কাল থেকেও অনেক পেছনে অবস্থান করছে বলে মনে করি। যা কোনোভাবে একুশ শতকের জ্ঞান-বিজ্ঞানের এ আলোকময় সময়ের সারথি হতে পারে না।
তাই মনে প্রশ্ন জাগে! এ কেমন ধর্মানুভূতি! উন্মাদ উন্মত্ত হয়ে আজও নিরপরাধ নাগরিকের, মানুষের ঘরদোর বসতভিটা জ্বালিয়ে দেয়া! হায়েনার অবয়বে রক্তের হোলিখেলায়– খুন আর ধর্ষণে মদমত্ত হওয়া! এমন মানবতা বিরোধী অমানবিক পাশবিক কর্মকাণ্ডে আমাদের চোখেমুখে, সর্বোপরি রাষ্ট্রের তাবৎ অঙ্গে  চুনকালির কলঙ্ক-চিহ্ন এঁকে দেয়া। একজন নাগরিক হিসেবে এহেন জঘন্য অপকর্মের জন্য লজ্জিত ব্যথিত হওয়াটই স্বাভাবিক। আর এসব ঘটনা তো সামষ্টিকভাবে আমাদেরকেও অপরাধের দায়ভাগে যুক্ত করে, কেননা এসবের বিরুদ্ধে আজকাল আমরা তেমন একটা সামাজিক প্রতিরোধে এগিয়ে যাই না, অধিকাংশ ক্ষেত্রে  নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করি– এই ভেবে যে, ওতে সংখ্যাগুরু সম্প্রদায় হিসেবে আমার তো কিছু হয়নি। আদতে ক্ষতিটা সামষ্টিকভাবে আমাদের সকলেরই হয় এবং হয়েছে। এ হিংসা বিদ্বেষের তীর-ধনুকের নিশানা থেকে আমরাও মুক্ত নই। ধর্মবিদ্বেষের এ মহা দাহ্য অনুষঙ্গ কারো জন্যই মঙ্গল বয়ে আনে নি, আনবেও না।  আমরা যে ধর্মে, বিশ্বাসে, সংস্কৃতিতে বিশ্বাসী হই না কেন?  আমার প্রথমত মানুষ,  জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত রক্তমাংসে একজন মানুষই। সর্বমানবের কল্যাণে আমাদের সোচ্চার কণ্ঠে তাই মনেপ্রাণে বারবার উচ্চারণ করতেই হবে ‘শুনহ মানুষ ভাই, সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই’। আর সামগ্রিক বিবেচনায় উপলব্ধি করতে হবে রাষ্ট্র ও সমাজে মানুষের, নাগরিকের ‘মানুষ’ পরিচয়ই সম্মানের; ধর্ম-তবকের পরিচয় নয়। আজকাল কেন যেন ধর্ম-তবকের পরিচয়ে– কেবল হিন্দু, কেবল মুসলিম, কেবল খৃস্টান, কেবল বৌদ্ধ, কেবল ইহুদি– ইত্যকার পরিচয়  অনেক ক্ষেত্রে মুখ্য হয়ে ওঠে; যা একুশ শতকের জ্ঞান-বিজ্ঞানের উৎকর্ষতার এ আলোকময় সময়ে আধুনিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় ‘মানুষের’ পরিচয়ের জন্য কাম্য হতে পারে বলে মনে করি না।
নাগরিকগণ রাষ্ট্রের পবিত্র আমানত, সে আমানতের সুরক্ষা দেয়া, নাগরিকবৃন্দের প্রাপ্য সেবা বুঝিয়ে দেয়া রাষ্ট্রের দায়িত্ব এবং কর্তব্য। কিন্তু রাষ্ট্রের পবিত্র সংবিধানে যখন বিশেষ কোন ধর্মের তিলক চিহ্ন জুড়ে দেয়া হয়, তখন রাষ্ট্রের দর্পনে অপরাপর ধর্মে, সংস্কৃতিতে বিশ্বাসী নাগরিকগণ নিজেদের কতটা নিরপেক্ষ অবয়বে দেখতে পান? রাষ্ট্র ও সমাজ জীবনের বিবিধ প্রাপ্তি ও কার্যকলাপে কতটা বৈষম্যহীন অবস্থানে দেখতে পান? তা ভাববার অবকাশ থেকে যায়। আমাদের মনে রাখতে হবে বহুত্ববাদী আধুনিক সমাজে ‘রাষ্ট্র’ সব নাগরিক আর সর্ব-সম্প্রদায়ের একটি প্রতিষ্ঠান, বাস্তবে এটি কোন প্রার্থনালয়ে কিংবা উপাসনালয়ে প্রার্থনার জন্য যায় না, যেতেও পারে না। তাই রাষ্ট্র নামক এ প্রতিষ্ঠানের কোন ধর্ম থাকটাও যেকোনো বিবেচনায় যৌক্তিক নয় বলে মনে করি। বরং তা সমাজে, রাষ্ট্রে নানা বিশ্বাসে পথচলা মানুষের মাধ্যে বিভেদ-বিভাজন সৃষ্টিতে অনুঘটক কিনা? তাও ভেবে দেখা দরকার বলে মনে করি। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, রাষ্ট্রের নাগরিকগণ স্ব স্ব ধর্ম ও বিশ্বাসচর্চার তাগিদে প্রার্থনা কিংবা উপাসনার জন্য মন্দির, মসজিদ, গির্জা, সিনেগগ, প্যাগোডায় গিয়ে থাকেন। সে ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের দায়িত্ব নাগরিকবৃন্দের ধর্মচর্চায়, বিশ্বাসচর্চায় সুরক্ষা দেয়া, নিরাপত্তার বিধান করা। প্রসঙ্গত বলি, রাজনৈতিক ফায়দা লুটবার জন্য যদি কোনো রাজনৈতিক গোষ্ঠী সাম্প্রতিক এবং অতীতে ঘটে যাওয়া জঘন্য সাম্প্রদায়িক কর্মকাণ্ড ঘটিয়ে থাকে, তার জন্য জানাই তাদের শতকোটিবার ধিক্কার; ধিক তাদের মানব জীবন, ধিক তাদের অপরাজনীতির অপকৌশল। তবে এসব ঘটনা ঘটবার পেছনে যে প্রতিহিংসার মনস্তাত্বিক কারণটি ক্রিয়াশীল এবং যে প্রতিহিংসা ও দ্বেষ-বিদ্বেষের অনল এ ঘটনা ঘটনানোর অনুঘটক হিসেবে ক্রিয়াশীল, তা সমাজদেহ থেকে দূর করবার জন্য কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। তাই সবিনয়ে বলি, সমাজ দেহের বিরাজমান বিদ্বেষের অনল মাটিচাপা দিয়ে, কেবল জেল জরিমানা করে, গ্রেফতার আর আইন আদলতের মাধ্যমে বিষয়টির সুরাহা হবে বলেও মনে করি না। কেননা সমাজস্থ মানুষের মনজগতে কী মাত্রায় হিংসার অনল পুষে রাখলে! মিথ্যা আর গুজবে ভর করে– কোনো প্রকার পূর্বাপর চিন্তা না করে অপর ধর্মে, বিশ্বাসে বিশ্বাসী মানুষের উপর হায়েনার অবয়বে হামলে পড়তে পারে; জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে দিতে পারে তাঁদের ঘরদোর বসতভিটা পূজার অর্ঘ্য, প্রতিমা। তাই এর প্রতিকারে আমাদের সমস্যার উৎসে নজর দিতে হবে। ক্ষতস্থান– মলমের প্রলেপে আড়াল করলে, সে ক্ষতস্থান চামড়ার অবরণে ঢাকা পড়লেও পড়তে পারে; কিন্তু শরীরের ভেতর যে মেদ-মাংসের ক্ষত, তা সেপ্টিক আলসার হয়ে মরণব্যাধি ক্যান্সারে রূপ নিতে পারে। সে কারণে সমস্যাকে পাখির চোখে উপর থেকে দেখা নয়, বরং সমস্যার মূল থেকে, শেকড় থেকে, ভেতর থেকে দেখাটাই জরুরি বলে মনে করি।
আমাদের সমাজে ধর্মানুভূতি, ধর্ম অবমাননার বিষয়, কেন যেন এক তরফা মনে হয় । কখনো কখনো আইনের প্রয়োগও কিছুটা পক্ষপাতদুষ্ট বলেও মনে হয়। নানা সময়ে গুজব রটিয়ে, অপপ্রচারকে হাতিয়ার বানিয়ে, মিথ্যাচার আর প্রবঞ্চনার আশ্রয় নিয়ে, একটি ধর্মসম্প্রদায়ের উপর আঘাত আক্রমণ, ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করার যে উপলক্ষ আর তথা কথিত ধর্ম-অবমাননার তবক দিয়ে যে রটনা, তা আসলে যেকোনো বিবেচনায় ধর্ম অবমাননা কিংবা ধর্মগ্রন্থের অবমাননা বলা কোনোভাবে যৌক্তিক নয়, বরং এটি উদ্দেশ্য প্রণোদিত সুপরিকল্পিত ষড়যন্ত্র হিসেবে চিহ্নিত এবং কথিত হওয়া উচিত বলে মনে করি। বাস্তবে যারা মিথ্যা গুজব রটিয়ে, দলবদ্ধ হয়ে একটি ধর্ম-সম্প্রদায়ের উপর এহেন জঘন্য ঘটনা ঘটিয়ে থাকে; উল্টো তাদের বিরুদ্ধে অর্থাৎ সে দলবদ্ধ আক্রমণকারীদের বিরূদ্ধে ধর্ম-অবমাননার অভিযোগটি উত্থাপিত হওয়া যৌক্তিক বলে মনে করি। আমাদের মনে রাখা উচিত কথায় কথায় বিধর্মী কাফের ইত্যাদি শব্দবন্ধনে  প্রতিনিয়ত যে ঘৃণা প্রকাশ, তাও কিন্তু অপর ধর্মের মানুষের প্রতি অশ্রদ্ধা অবমাননা প্রদর্শন এবং গুরুতর হেট ক্রাইম; আর পূজার প্রতিমা ভাঙা, তাও তো অপরের ধর্মানুভূতিতে আঘাত দেয়া এবং ধর্ম-অবমাননারই অপরাধ। আমাদের নিজের বিশ্বাস আর ধর্ম যেমন অন্তরের বিষয়, প্রাণের বিষয়; অপরাপর বিশ্বাস আর ধর্মাচারের মানুষের কাছেও তাঁদের বিশ্বাস আর ধর্মও প্রাণের বিষয় অন্তরেরই বিষয়– এটি উপলব্ধি করবার বোধশক্তি আমাদের থাকা চাই। আমাদের মনে রাখতে হবে, মানুষ আদতে বিশ্বাসী, বিশ্বাস করতে পারেন প্রচলিত ধর্মে, বিশ্বাস করতে পারেন যুক্তি-বিজ্ঞান-দর্শনে, কিংবা বিশ্বাস করতে পারেন প্রাকৃতিক কোনো বিষয়ে; অথবা ব্যক্তি মানুষ সমাজের অপরাপর মত ও পথকে সম্মান দেখিয়ে নিজের আপন বিশ্বাসেও পথ চলতে পারেন। তাই আমাদের অপরের বিশ্বাসকে সম্মান দেখানো উচিত। কামনা করি সমাজে রাষ্ট্রে বিশ্বাস চর্চার অধিকার বিশ্বাস চর্চার স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠা পাবে। প্রসঙ্গত সবিনয়ে বলি, আমরা যখন অপরাপর বিশ্বাসের মানুষজনকে কাফের, বিধর্মী, ইহুদী, নাসারা, মুরতাদ বলে হরহামেশা গালাগাল করি, তখন কি ভাবি এতে তো অপরাপর বিশ্বাসের মানুষজনের অনুভূতিতে আঘাত লাগে! তাঁদেরও এ ঘৃণার উচ্চারণ শোনামাত্র হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হয়, যেমন রক্তক্ষরণ হয় আমাদেরকে আমাদের বিশ্বাস আর ধর্ম নিয়ে বললে। তাই আমাদেরও  কথাবার্তায় শব্দচয়নে ঘৃণা উৎপাদন, ঘৃণা প্রকাশ থেকে বিরত থাকা উচিত বলে মনে করি; আর এক্ষেত্রে আইন প্রয়োগে রাষ্ট্রের নিরপেক্ষ ভূমিকাও  অপরিহার্য  বলে মনে করি। কেননা অনেক ধর্মীয় নেতাগণ সময় এবং যুগের পরিপ্রেক্ষিতকে বিবেচনায় না নিয়ে কথাবার্তায়, বক্তৃতায়  প্রতিনিয়ত বিদ্বেষপূর্ণ ও উস্কানিমূলক বক্তব্য  নানা প্রচার মাধ্যমে দিয়ে থাকেন, এমনকি এসব প্রচারে প্রসারে ধর্ম প্রতিষ্ঠানকেও ব্যবহার করে থাকেন, যা মূলত যেকোনো বিবেচনায় গুরুতর ‘হেট ক্রাইম’। তাদের এ ঘৃণা ও বিদ্বেষমূলক বক্তব্যের প্রচার প্রসার সমাজে ভয়াবহ বিপর্যয় ডেকে আনছে বলে মনে করি এবং সংগঠিত হামলা সম্প্রদায়িক ঘটনাবলীর পেছনে তাদের এ দ্বেষ-বিদ্বেষমূলক ঘৃণা ছড়ানোর বক্তব্য প্রভাব বিস্তারি অনুঘটকের কাজ করছে বলেও মনে করি। ধর্মের নামে ধর্মের লেবাস ধারণ করে যারা এসব অপতৎপরতায় লিপ্ত; তাদের বিরুদ্ধে এবং এসব অপতৎপরতা রোধে রাষ্ট্রকে যথাযথ  কার্যকর আইনী পদক্ষেপ নিতে হবে, নাহয় এ হিংসা প্রতিহিংসার অনল পুরো সমাজ তথা মুক্তিযুদ্ধে অর্জিত আকাঙ্ক্ষার অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশকে পুড়ে ছারখার করে দেবে; যা কোনোভাবে কাম্য হতে পারে না।
২০২১ সালের ১৩ অক্টোবর  কুমিল্লার নানুয়াদিঘির পাড়ের একটি পূজামণ্ডপে কোরানশরিফ রাখা এবং পরবর্তীতে তা নিয়ে উস্কানিমূলক বক্তব্যে ধর্মবিদ্বেষের গুজব ছড়িয়ে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে পূজামণ্ডপে আক্রমণ, প্রতিমা ভাঙচুর, উন্মাদ উন্মত্ত হয়ে নিরপরাধ মানুষের ঘরদোর বসতভিটা জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে! হায়েনার অবয়বে রক্তের হোলিখেলায় খুন আর ধর্ষণে মদমত্ত হয়ে যে তাণ্ডবলীলা চালিয়েছে, তা মানুষের সমাজে একটি মানবিক সমাজে কোনভাবে কাম্য হতে পারে না। উল্লেখ্য যে, এরূপ ঘটনার পুনরাবৃত্তি বারবারই ঘটছে, ঘটে চলছে, কিন্তু কেন? ২০১৭ সালের ১০ নভেম্বর রংপুরের গঙ্গাচড়ায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কথিত একটি পোস্টের মাধ্যমে ইসলাম ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের অভিযোগে সনাতন সম্প্রদায়ের ঘরবাড়ি আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে দেয়া হয়। সে সময়ের পত্রপত্রিকার সূত্রে জানা যায়, নারায়ণগঞ্জে বসবাসকারী গঙ্গাচড়ার টিটু রায় নামক এক যুবক ফেসবুকে ইসলামের নবীকে অবমাননা করে  পোস্ট দিয়েছে। একে অভিযোগ বিবেচনায় ৬ নভেম্বর মুদি দোকানি রাজু মিয়া টিটু রায়ের বিরুদ্ধে গঙ্গাচড়া থানায় তথ্য প্রযুক্তি আইনে মামলা দায়ের করেন। পরবর্তীতে এ স্পর্শকাতর বিষয়কে পুঁজি করে জামায়াতে ইসলামীর উগ্রপন্থীরা কথিত টিটু রায়ের পোস্টের স্ক্রিনশট নিয়ে তা কালার প্রিন্ট করে কয়েক দিন ধরে রংপুরের গঙ্গাচড়া, তারাগঞ্জ এবং নীলফামারী জেলার বিভিন্ন মসজিদে বিলি বণ্টন করে মানুষজনকে উত্তেজিত করে তোলে। পরে ধর্মীয় উন্মদনায় উত্তেজিত লোকজন গঙ্গাচড়া উপজেলায় ঠাকুরপাড়া ও ব্রাহ্মণপাড়া গ্রামে কথিত ইসলাম ধর্ম অবমাননার অজুহাত তুলে জামায়াতে ইসলামীর উগ্র কর্মীরা হিন্দু-সম্প্রদায়ের উপর হামলা চালায় এবং নিরিহ নিরপরাধ লোকজনের ঘরবাড়ি মন্দির জ্বালিয়ে দেয়। পরে জানা যায় টিটু রায় অশিক্ষিত। তিনি নারায়ণগঞ্জ জেলার ফতুল্লাতে থাকেন। তিনি ফেসবুক তেমন একটা চালাতেও জানেন না। তিনি ফেসবুকে কোনো স্ট্যাটাসও দেননি। তার ফেসবুক একাউন্ট হ্যাক করে নবীকে কটাক্ষ করে এ স্ট্যাটাস দেয়া হয়েছে (সূত্র: উইিকিপিডিয়া)। ‘বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের উপর হামালার বিচার হয় না কেন’? এ শিরোনামে গত ১৩ নভেম্বর ২০১৭ এর বিবিসি-এর এক অনলাইন ভার্সন প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়– বাংলাদেশে এরূপ একই ধরনের ঘটনা আরও ঘটেছে, যেমন কথিত ধর্ম অবমাননার অভিযোগ এনে ২০১২ সালে কক্সবাজারে রামুতে বৌদ্ধপল্লী আর মন্দিরে অগ্নি সংযেগ; ২০১৩ সালে পাবনার সাঁথিয়া উপজেলার বনগ্রাম বাজারে ধর্মীয় অবমাননার অভিযোগ এনে হিন্দু সম্প্রদায়ের ঘরবাড়ি ও মন্দিরে হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ; ২০১৬ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে হিন্দুপল্লীতে হামালা। বিবিসির প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, যেসব তথাকথিত ধর্মীয় অবমাননার ফেসবুক পোস্টের অভিযোগ এনে এসব হামলা অগ্নিসংযোগ করা হয়েছিল, পরে তদন্তে দেখা যায় এসব পোস্টের কোনো কোনো ক্ষেত্রে হদিস কিংবা অস্তিত্বই খুঁজে পাওয়া যায় নি। তাই একে কী অর্থে ইসলাম  ধর্মের অবমাননার সীলমোহর দেয়া হয়, তা বোধগম্য নয়, বরং এ ক্ষেত্রে ষড়যন্ত্রমূলক গুজব ছড়িয়ে যারা একটি ধর্মীয় সম্প্রদায়ের উপর বর্বরোচিত অমানবিক হামলা, নির্যাতন এবং অগ্নিসংযোগের মত মানবতা বিরোধী অপরাধ সংগঠিত করছে; বরং ক্ষমার অযোগ্য এ অপরাধের জন্য তাদের দ্রুত বিচার আইনে বিচার হওয়া উচিত বলে মনে করি। আর এসব ঘটনা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করবার জন্যও যদি ব্যবহার করা হয়, তা সমাজের জন্য, রাষ্ট্রের জন্য কোনোভাবে কল্যাণ বয়ে আনতে পারে না। পক্ষান্তরে প্রকৃত অপরাধীরা ধরা ছোঁয়ার বাইরে থাকবে এবং সমাজ ও রাষ্ট্রে বিচারহীনতার সংস্কৃতিকে উৎসাহিত করবে বলে মনে করি। তাই এসব ঘটনায় অবশ্যই দ্রুত ন্যায় বিচারের উদাহরণ সৃষ্টি করতে হবে, নাহয় সমাজ ও রাষ্ট্রে অরাজকতার মাত্রা দিনকে দিন বেড়ে যাবে।
প্রসঙ্গত বলি, অন্তরে দ্বেষ-বিদ্বেষ আর ধর্ম-প্রতিহিংসার অনল লালন করে মুখে সাম্প্রদায়িক-সম্প্রীতির বাণী আওড়ালে, সমাজে রাষ্ট্রে যথার্থ অর্থে সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠা পাবে না; কারণ সম্প্রদায়িক সম্প্রীতি আকাশ থেকে নাজেল হবার বিষয় নয়, তার চাষবাস মানুষের অন্তরেই করতে হবে। তার জন্য অবয়বধারী মানব-সন্তানকে মানুষ হিসেবে গড়ে তোলবার জন্য যথাযথ সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে নিয়ে যেতে হবে; সমাজ দেহের ভেতরকার সাম্প্রদায়িকতার অনুষঙ্গ উপাদান ও অনুঘটকসমূহকে দূর করবার মানসে কার্যকর শিক্ষা-মনস্তাত্ত্বিক চিকিৎসা, শিক্ষাকারিকুলাম ও কর্মসূচির বাস্তবায়ন এবং তার অনুশীলনের উদ্যোগ রাষ্ট্রকে নিতে হবে। কোন একটি ঘটনা ঘটবার পর কেবল লোক দেখানো সভা-সমিতি, সেমিনার-সিম্পজিয়ামের আয়োজন উদ্যোগে এ ভয়াবহ সামাজিক ব্যাধি থেকে পরিত্রাণ ঘটবে বলে মনে করি না। অতএব এ রোগ প্রতিরোধ ও নিমূলে কেবল মুখের কথা নয় বরং চাই রাষ্ট্রের কার্যকর ও যৌক্তিক পদক্ষেপ।
আমরা যা চর্চা বা বিশ্বাস করি তার শ্রেষ্ঠত্ব জাহির করবার লক্ষ্যে অন্যের উপর জবরদস্তি করি কিংবা গায়ের জোর খাটাই। সংখ্যা গরিষ্ঠতার দাপটে এ কর্মটি যে মন্দ তাও অনেক সময় উপলব্ধি করি না। চাপিয়ে দেয়ার কিংবা জবরদস্তি করার এ মানসিকতার পরিবর্তে অপরের বিশ্বাসের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়াটা আধুনিক যুক্তি নির্ভর, জ্ঞান ভিত্তিক মানবিক সমাজ ও রাষ্ট্র বিনির্মাণে  জরুরি বিষয় বলে মনে করি। আমাদের মনে রাখতে হবে নিজের ধর্ম, বিশ্বাস এবং সংস্কৃতি যেমন মানব সভ্যতার অংশ এবং সম্পদ; সমাজের অপরাপর মানুষের ধর্ম, বিশ্বাস আর সংস্কৃতিও মানব সভ্যতার ঐতিহ্যেরই অংশ এবং সম্পদ। কিন্তু যারা সমাজ ও রাষ্ট্রের ক্ষমতা দখলের রাজনীতি করেন তারা ধর্মকে প্রয়োজন সাপেক্ষে কখনো রক্ষাবর্ম, কখনো জবরদস্তির হাতিয়ার বানিয়ে থাকেন। তাই সমস্যার মূলে দায়ী ক্রিয়াশীল সমাজ ও রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণের নিয়ামক শক্তি এবং ক্ষমতা দখলের রাজনীতি ও রাজনৈতিক মনোভাব। তাছাড়া আমাদের দেশে রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের জন্য সমাজ ও রাষ্ট্রের তৃণমূল হতে শীর্ষ পর্যায় পর্যন্ত ধর্মের যথেচ্ছাচার ব্যবহারও এর অন্যতম মূল কারণ বলে মনে করি। বিগত দিনে যারা ক্ষমতায় ছিল, তারা সকলেই এ পাপ কাজটি করেছে, আর এ পাপ এখন আমাদেরকে চতুর্দিক থেকে ভয়ানকভাবে ঘিরে ফেলছে, গ্রাস করছে। এ কথা আজ শতভাগ সত্য যে, সমাজে যাঁরা এসবের বিরুদ্ধে সোচ্চার কণ্ঠে কথা বলতেন, তাঁদের অনেকে আজ নিশ্চুপ, অধিক শোকে তাঁদের পাথর হবার দশা; কিন্তু কেন? সে উত্তর জানাও জরুরি বলে মনে করি।
প্রসঙ্গত বলি, যারা ভাবছেন রাজনীতির কূট-কৌশলে ধর্মীয় দাবার গুটির চাল দিয়ে, দেশের আপামর জনগণকে ঘুম পাড়িয়ে, প্রতারিত করে শেষ রক্ষা পাবেন; এমতর হিসেব-নিকেষ নাওতো মিলতে পারে। কারণ রাজনীতিতে ধর্মীয় অনুষঙ্গের যথেচ্ছাচার অপব্যবহারে বাংলাদেশের সমাজ ও রাষ্ট্রে এক ভয়াবহ উগ্র-ধর্মান্ধ, একরোখা, অনমনীয়, দানবীয় শক্তির উত্থানকে মদদ যোগাচ্ছে বলে মনে করি। বরং এ ধর্মীয় অনুষঙ্গ আশ্রিত দাবার গুটির  ভুল চালে সমাজের বিপণ্ন মানুষ যদি ভুল করে পরিত্রাণ পাবার প্রত্যাশায় উগ্র-ধর্মান্ধ দানবকে ত্রাতা ভেবে ভুলভাবে নেতা নির্বাচন করে বসে, তাহলে এর দায়ভার আজকের রাজনীতির কুশীলবরা কোনোভাবে এড়াতে পাড়বেন কি? রাজনীতিতে ধর্মীয় অনুষঙ্গ ব্যবহারকারীদের ধর্মীয় অনুষঙ্গের দাহ্যতাগুণ সম্পর্কে ওয়াকেবহাল থাকা উচিত বলে মনে করি। কেননা এ দাহ্য অনুষঙ্গ সহযোগে যে রাজনীতি আজ আমরা প্রত্যক্ষ করছি, তা যদি কোনো কারণে ধ্বংসের দাবানলে রূপ নেয়, তা থেকে আমরা কেউই রক্ষা পাবো না। আর সমাজের ভেতরে অসাম্য বঞ্ছনা, হতাশা, চরম দারিদ্রাবস্থা- এ দাহ্যতার মাত্রাকে বহুগুণ বাড়িয়ে দিতে পারে বলেও মনে করি।
আজকাল চিলে কান নিয়েছে বলে যে বা যারা প্রচার করে, আর যারা কান নিয়েছে বলে দৌঁড়ায়, কেন যেন মনে হয় তাদের উভয় পক্ষের স্বার্থ হাসিলের অভিপ্রায় এক ও অভিন্ন। তারা মনে হয় এসব পরিকল্পিতভাবে করছে; তাই সবাই যে, না জেনে দৌঁড়ায় তা কিন্তু নয়; কেউ কেউ জেনে বুঝেও দৌঁড়ায় । আর এসবে মহা দাহ্য অনুষঙ্গ, ধর্মচেতনার কথিত স্পর্শকাতর অনুভূতি রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলে বরাবরই ব্যবহার করা হয়। মনে রাখতে হবে ক্ষমতায় যেতে ধর্ম-অনুষঙ্গের ব্যবহার, আবার ক্ষমতায় থাকতেও ধর্ম-অনুষঙ্গের ব্যবহার একদিন ভয়াবহ বিপদ ডেকে আনতে পারে, সে লক্ষণ আমাদের সমাজ আর রাষ্ট্রে নানাভাবে পরিদৃশ্যমান; যেমন  ক্ষমতায় যেতে রাজনীতির সকল পক্ষই একে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে এবং করে থাকে। উপমহাদেশে রাজনীতিতে এ ধর্ম-তেঁতুলের সরাসরি ব্যবহার বড্ড ফলদায়ক; তবে পশ্চিমা দেশসমূহও এর ব্যবহার থেকে পিছিয়ে নেই; বিশ্ব ভূ-রাজনীতিতে তারাও এ মহা দাহ্য পদর্থ ব্যবহারে কূটচালে বরাবরই কৌশলী।
আমাদের মনে রাখা উচিত, বাংলাদেশ বহু ধর্মসম্প্রদায়ের দেশ বহু বিশ্বাস ভাবনার দেশ। সাংবিধানিকভাবেও এটি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ; এটি মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতানায় ত্রিশ লক্ষ শহীদের পবিত্র রক্তে স্নাত বাঙালির জাতি রাষ্ট্র বাংলাদেশ। না এটি কোনোভাবে একটি বিশেষ সম্প্রদায় কিংবা ধর্মসম্প্রদায়ের দেশ নয়; ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্রও নয়। এটি এদেশের সকল সম্প্রদায়ের দেশ। যারা সাম্প্রদায়িক চেতনার আলখাল্লা পড়ে একে কেবল একটি বিশেষ সম্প্রদায়ের দেশ বলে হুংকার দেন বক্তৃতা বিবৃতি দেন, তা সাংবিধানিক অর্থে সাংঘর্ষিক; তাদের এ অপপ্রয়াস অপতৎপরতা রোধে রাষ্ট্রকে উদ্যোগী হতে হবে। রাষ্ট্রের ত্রিশ লক্ষ শহীদের রক্তঋণের পবিত্র সংবিধানে স্বৈরশাসক জিয়া-এরশাদের কুমতলবে যুক্ত হওয়া যেসব ধর্ম তিলক জাতিকে দ্বেষ-বিদ্বেষের নিরিখে বিভাজনে প্রয়াসী তা মুছে দেবার জন্য  রাষ্ট্রকে সরকারকে উদ্যগী হতে হবে; কেননা তা কোনোভাবে মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের ধর্মনিরপেক্ষ বাঙালির জাতি রাষ্ট্র বাংলাদেশের সাথেও সঙ্গতিপূর্ণ নয়। আর বাংলাদেশ তো কোনোভাবে পেছনে হাঁটতে পারে না; পাকিস্তানমুখী ভাবাদর্শে পথ চলতে পারে না। যারা সে পথে বাংলাদেশকে নিয়ে যেতে চান, তারা কারা? তাদের এবং তাদের সাঙ্গপাঙ্গ দোসরদের একাত্তরে ভূমিকা কী ছিল? তারা কোন পক্ষে ছিল? তা তো আমাদের কমবেশ জানা, তবুও তা আগামী প্রজন্মের কাছে, জাতির কাছে পরিষ্কার হওয়া উচিত বলে মনে করি। একাত্তরে যুদ্ধাপরাধীর সমর্থক পরাজিত গোষ্ঠী ধর্মকে বর্ম বানিয়ে আজও যে অপতৎপরতায় লিপ্ত, তা দিবালোকের মত সত্য, এ সত্য আমাদের অনুধাবন করতে হবে। যেকোনো বিবেচনায়– আমাদের চলমান রাজনীতি ও রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে ক্ষমতা দখলের হাতিয়ার হিসেবে একটি বিশেষ ধর্মের ধর্ম-অনুষঙ্গের যথেচ্ছাচার ব্যবহার বন্ধের কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। কেননা এ ধর্ম-অনুষঙ্গের যথেচ্ছাচার ব্যবহার উর্দি পরে স্বৈরশাসক জিয়া-এরশাদ যেমন করেছে; তার যথেচ্ছাচার ব্যবহার এখনও অব্যহত রয়েছে, যার কার্যফল বাঙালির এ জাতি রাষ্ট্রের জন্য সুদূরপ্রসারী অশুভ লক্ষণ মনে করি। বিগত দিনের অভিজ্ঞতা থেকে বলা যায়  ক্ষমতার ভেতরের আর বাইরের উভয় পক্ষই নানা কূটচালে ধর্মীয় অনুষঙ্গের এ যথেচ্ছাচার ব্যবহার বাড়িয়েছে; যা আদৌ মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশে কোনভাবেই কাম্য হতে পারে না। কেননা  এরূপ ভাবনা, কার্যকলাপ মহান মুক্তিযুদ্ধে শহীদের পবিত্র রক্তের বিনিময়ে অর্জিত মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশের অস্তিত্ব আর চেতনারই পরিপন্থী বলে মনে করি। তাই চলমান সময়ে সকল অপতৎপরতা হটাতে, নির্মূলে সত্যিকারভাবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পথেই আমাদের হাঁটতে হবে, ধর্ম-অনুষঙ্গের রাজনৈতিক অপব্যবহারের পথে কোনোভাবেই নয়।
————————–
লেখক: কবি ও প্রাবন্ধিক, প্রফেসর লোকপ্রশাসন বিভাগ ও সাবেক ডিন সমাজবিজ্ঞান অনুষদ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়