You are currently viewing সাপলুডু / রওশান ঋমু

সাপলুডু / রওশান ঋমু

সাপলুডু

রওশান ঋমু

এক

তুলতুল মারা গেলো রাতে, সে কতো রাত তা আন্দাজ করা একটু কঠিন, একটাও হতে পারে আবার রাত তিনটাও হতে পারে। তাদের ঘরের দেওয়ালে কোনো দেওয়াল ঘড়ি নেই।শহরতলীর চালের গোডাউনের  তিন নম্বর গেটের পাহারাদার আব্দুল মালেক তুলতুলের পিতা, তার একটা হাতঘড়ি আছে,  সিকো – 5  বিয়ের সময় শ্বশুরবাড়ি হতে পাওয়া একমাত্র উপহার। অফিস হতে ফিরে কাপড় দিয়ে ঘাম মুছে কাগজে মুড়িয়ে পায়া ভাঙ্গা টেবিলের ড্রয়ারে রেখে দেয় আবার পরদিন সকালে অফিসে যাওয়ার সময় ডানহাতের কব্জিতে পরে ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ, বোধকরি ভাবে ওটা এখনো সচল আছে কি না। আমাদের এই গল্পে অবশ্য তুলতুলের মৃত্যুর সময়টা জরুরী না, জরুরী সংবাদ হলো তুলতুল মারা গেছে নিউমোনিয়ায় এবং তার বয়স তখন নয় মাস এগারো দিন।তাদের ছোট ছোট দুইটা ঘর,  পাঁচ ফিট বাই সাত ফিটের খাটে মা, তুলতুল, আব্দুল মালেক, নীলু এবং বাবু আড়াআড়ি ঘুমায়, তাদের খাট একটা আর অন্য ঘরটা ভাড়া দেওয়া একজন বৃদ্ধের কাছে, যার ছেলেমেয়ে কেউ নেই।

ভোরের আযান দিয়েছে কি দেয় নি জানি না,  গুনগুন কান্নার স্বরে নীলুর ঘুম ভেঙ্গেছে, ধরফরিয়ে  শোয়া হতে উঠে বসে নীলু, ওর বয়স ছয়।  মা কাঁদছে তুলতুলকে কোলে নিয়ে, বাবা চুপচাপ বসে, তার চোখ বেয়ে পানি পড়ছে মুখ শব্দহীন। চার বছরের বাবু অঘোরে ঘুম, এইসব শব্দ তার অসুবিধা করছে না ঘুমের। হঠাৎ ঘুম ভাঙাতে লাইটের আলো পড়ে ওর চোখ জ্বালা করে উঠলে দুইহাত দিয়ে একবার চোখ কচলে নিলো,   এখনো বোঝে নি তার বোন মারা গেছে, ভেবেছে বোনের অসুখ বেড়েছে , তাই তো মা অমন করে কাঁদছে। অনেক দিন ধরেই বোনের অসুখ, মা বাবাকে কতোদিন বলেছে ডাক্তারের কথা কিন্তু বাবার টাকা নেই, ডাক্তার ডাকা হয় না। এ নিয়ে প্রতিরাতেই বাবার সঙ্গে মায়ের ঝগড়া। বাবার রাগ বেশি হলে মায়ের বেনি বাঁধা চুল হাতের মুঠোয় ধরে পিঠে কিল ঘুষি মেরে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যায় , মা তুলতুলকে কোলে নিয়ে ঘরের এক কোণে বসে মিহি সুরে কাঁদে। নীলুর কষ্ট হয় মায়ের জন্য, সে বিকেলে খেলতে গিয়ে ঘরে ফেরে না,  খালের পাড় ঘেঁষে কেয়ার ঝোপ,  সেখানে বসে থাকে, সন্ধ্যা হয়, ঝিঁঝিঁ ডাকে, ভয় আচমকা কালো ভূত হয়ে দাঁড়ায় তার সামনে তবু মাথা গুঁজে হাঁটুতে সে বসে থাকে। । ক্ষিধে পায়, চোখ জ্বালা করে, মশা কামড়ায়,  ঘরে ফিরে যেতে ইচ্ছে করে না, বাবা মায়ের ঝগড়া বুকে পাথর চাপিয়ে দেয় যেন। কখনো বাবলুর বড় ভাই কখনো বাবা তাকে খুঁজে ঘরে নিয়ে যায়। বাবলু নীলুর বন্ধু, ওর  বড় ভাই হাইস্কুলে পড়ে।

১৯৮৫ সালের ২১ মার্চ। দেশজুড়ে সাধারন ধর্মঘট। এইদিন আবার নির্বাচন। আব্দুল মালেক চিন্তিত। না, নির্বাচন নিয়ে তার মাথা ব্যথা নেই। মাসের শেষ, তার হাত খালি। এমন অসময়ে মেয়েটা মারা গেলো! মৃত মানুষের দাফনের জন্য কিছু টাকার দরকার হয়। সেই টাকার জোগাড় তাকে করতে হবে। ড্রয়ার খুলে হাত ঘড়িটা বের করে পরে নিলো, সকাল দশটা। খাটের নীচে বেতের ঝুড়ি, টেনে সামনে এনে শাদা একটা পান্জাবী আর আধা পুরনো প্যান্ট বের করে পরে স্ত্রীর দিকে বিরক্ত চোখে তাকিয়ে বললো,

”  আল্লার দোহাই লাগে অখন  খান্দন থামাও।মাস  হুরাই গেছে টেকা নাই। টেকার জোগাড় করা যায় কিলা। টেকা ছাড়া  খয়বর দেওয়া যাইতো নায়। ভাইর কান্দাত যাইতাম?

কোল থেকে মৃত মেয়ে বিছানায় শুইয়ে চোখ মুছলো মিনু, তুলতুলের মা, মদ্যপ স্বামী আব্দুল মালেকের স্ত্রী।

”যাও  ভাইসাব অখন বাড়ীত  আছইন। জলদি আও গিয়া। নীলুরে লগে লইয়া যাও। ”

লাল রঙের ফ্রক পড়ে বাবার সঙ্গে বের হলো নীলু। যদিও বাবার সঙ্গে কোথাও যেতে তার ভালো লাগে না কিন্তু এখন কেন যেতে হবে সে জানে। সে থাকলে বাবা চাচার দেওয়া টাকা নিয়ে ঘরে ফিরে যাবে। তার বয়স অনেক কম হলেও সে বুঝতে পারে বাবার হাতে টাকা আসলে শুক্রবার বাবা একটা খারাপ জায়গায় যায়, ঘরে আসে এলেমেলো পা ফেলে, এ নিয়ে মায়ের সঙ্গে ঝগড়া হলে  বাবা মাকে খারাপ খারাপ লাগি দেয়, খুব মারে। মাও নীচু গলায় বাবা কোথায় যায় তা নিয়ে আহাজারি করে কাঁদে। ধর্মঘটের জন্য গাড়ি চলাচল বন্ধ, মামার বাসায় যাওয়ার অবশ্য একটা হাঁটা পথ আছে। তাদের বাসা হতে বাম দিকে অনেকটা পথ হেঁটে বালুর মাঠ পার হয়ে লোহার পোল পার হতে হয় তারপর হাওয়ের মাঠ পার হয়ে মামার বাসার গেট। অনেকটা পথ হাঁটতে হয়, আব্দুল মালেক দ্রুত পা চালিয়ে হাঁটে, নীলু ওর সঙ্গে পেরে ওঠেনা। আব্দল মালেক হাঁটে, নীলু দৌড়ায় তবু সে পিছনে পড়ে যায়। লোহার পোলে এসে নীলু ইচ্ছে করে আস্তে হাঁটে। এই জায়গাটা তার খুব প্রিয়। চারদিকে ঘন বন, দিন দুপুরে ঝিঁঝিঁ ডাকে, কলাগাছের পাতা বাতাসে সরসর করে কাঁপে, তেলকুচ তলা বাঁশের সঙ্গে জড়িয়ে জড়িয়ে ছেয়ে ফেলে পুরো বন। আর আছে লন্ঠন ফুলের ঝোপ, কতো কতো ফুল ফোটে তাতে, কতো তাদের রঙ! ঘাগরা কাঁটা আছে অসংখ্য, কত নেবে, নাও না। নীলু ঘাগরা কাঁটা ছিঁড়ে রুক্ষ চুলে গেঁথে দেয় তিনটা চারটা। বেগুনী কলমী ফুল খালের ধার ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকে, আকন্দ ফুলে ফড়িং ওড়ে। সময় থাকলে সে একটা ফড়িং ধরতো, ডানায় সুতো বেধে দাও না উড়িয়ে, কোথায় আর যাবে, আবার সুতোর টানে ফিরে আসে নীলুর কাছে। পোলের নীচে কালো কুচকুচে পানি, একটা মরা গরু ভেসে যাচ্ছে। এই খালের পানি সবসময় কালো কেন কে জানে! একটু দূরে বাঁশের ভেলায় একটা মানুষ হাতে বৈঠা, কোথায় যায়! নীলুও একদিন ওইরকম চলে যাবে, মনে মনে ভাবে।

আব্দুল মালেক খেয়াল করে সঙ্গে মেয়ে নেই, পিছন ফিরে তাকায়। দেখতে পায় এখনো পোলের উপর নীলু, জঙ্গলী ফুল ছিঁড়ে জামার কোচর ভরছে। ধমক দিতে গিয়েও সামলে নিয়েছে নিজেকে। এই মেয়ের উপর তার একটু দূর্বলতা আছে। মেয়েটা সারাদিন একা একা ঘুরে বেড়ায়, ফুল, প্রজাপতি, ফড়িং এগুলো ওর খেলার সাথী। তাকে অবশ্য ভয়ও পায়, ঘৃণা কতোটুকু করে! করতে পারে। মাতাল হলে তার মাথা ঠিক থাকে না। পৃথিবীর সমস্ত কিছুকে পায়ে পিষে মারতে ইচ্ছে করে। চারদিকের এতো শত অভাব তাকে পাগল করে তোলে। তিন তিনটা সন্তানের জনক সে। তার বোকা স্ত্রী কিছুতেই জন্ম নিরোধক ব্যবহার করবে না, তাতে নাকি তার শ্বাসকষ্ট হয়। বাপের জন্মেও সে শোনে নাই এ কথা। অগত্যা তিন সন্তান। যদিও আজ একজন নেই হয়ে গেছে। সে কি একটু মুক্তি পেলো, একটা মুখ তো কমলো, সে কি পাষাণ!

বড় ভাইয়ের বাসায় সামনে দাঁড়িয়ে আছে আব্দুল মালেক। ঘরে   ঢুকবে না  তার সময়ের অভাব, মিনু ঘরে একা।  জানালায় টোকা দিয়ে ঘরের দিকে চেয়ে আছে। বড় ভাবী জানালায় উঁকি দেয়, ‘কেগুরে ভাই, জানলাত কেনে? ঘরের ভিত্রে আও। ‘

“না ভাবী সময় নাই

আইজকু রাইত তুলতুল মরি গেছে । ভাই কিতা বাসাত  আছইন নি? একটু ডাকিয়া দেউক্কা ”

খবর শুনে ঘর থেকে আব্দুল মালেকের বড় ভাই বেরিয়ে এলো। ভাবী নিকট আত্নীয়ের মৃত্যর খবর শুনলে কাঁদতে হয় বলে একটু কাঁদার ভান করে ঘরের ভেতর ঢুকে গেলো। আব্দুল মালেকের বড় ভাই জলিল বুঝতে পেরেছে ছোট ভাই কেন তার কাছে এসেছে কিন্তু সে তাকে টাকা হাতে দেবে না, এক পয়সার বিশ্বাস সে ছোট ভাইকে করে না। কে বলতে পারে দাফনের টাকা নিয়ে মদ খেতে চলে যায় কি না। নীলুদের বাসার দিকে হাঁটতে লাগলো তারা। লোকজন ডেকে বাড়ির পাশের গোরস্থানে গোর দেওয়া হলো তুলতুলকে। সেদিন নীলুও তুলতুলের কবরে গেছে, জামার খুঁটে বারবার চোখ মুছে সেও একদলা মাটি কবরের উপর দিয়েছে। বাবলুর বড় ভাই খেজুর গাছের ডাল কেটে গোরের উপর শুইয়ে দিয়েছে তারপর খাল থেকে কলসী ভরে পানি তুলে ভিজিয়ে দিয়েছে গোরস্থান।

এখন তারা দুই ভাই বোন, নীলু আর বাবু। মা সারাদিন কাঁদে। তুলতুলের বালিশ, কাঁথা বিছানা থেকে ছুঁড়ে মেঝেতে ফেলে দেয় মা। নীলু তুলে আবার বিছানায় রাখতে গেলে মা জোড়ে ধমক দিয়ে আবার সেসব মেঝেতে ফেলে দেয়। মায়ের মেজাজ দিনদিন খারাপ হয়, দিনদিন ওরাও উপোস দেয়। কখনো পাশের ঘরের দাদু একবাটি মুড়ি দেয় ওদের, ওরা মুরগীর বাচ্চার মতো প্রতিটি মুড়ি খুঁটে খুঁটে খায়। বাবুর হাত ধরে দুপুরে খাওয়ার সময় কয়েকদিন বাবলুদের বাসায় গেছে নীলু, উদ্দেশ্যে গুরুতর কিছু না, যদি খালাম্মা বলে বসে, আজকে আমাদের সঙ্গে খা তোরা ‘ কিন্তু খালাম্মা কখনোই এ কথা বলে নি, উল্টো বলেছে,

“দুফুরে ইনো কিতা? নিজের বাসাত যাউক্কা। ঐ, হুনলাম তোর মা নাকিতা ফাগল হইগেছইন। ইস রে ‘

ইস রে  বলার সময় খালাম্মার চোখ মুখ খুশিতে ভরে গেছে। এ কথা নীলুকে কেউ বলে দেয় নি, আপনিতে বুঝতে পায়।

আইলের  পাড়ে  খেজুর  গাছ ভর্তি। গাছে কাঁচা পাকা খেজুর ।পাড়ার ডানপিটে  ছেলেরা  গাছে উঠে খেজুরের থোকা কেটে নামায়। নীলু ছোট বলে গাছে উঠতে পারে না, ছোট ভাইয়ের পাশে উবু হয়ে চুপচাপ বসে ছেলেদের খেজুর পাড়া দেখে। আজকে একটা ছেলে তাদের কাছে আসে, ‘কিতা রে তোমরারে ডেইলি ওনো বওয়াত  দেখি। খেজুর খাইতে নি?’

নীলুর মুখে হাসি ফোটে, কথা না বলে সম্মতি সূচক মাথা নাড়ে। ছেলেটা এক কাঁদি হলুদ হয়ে পাওয়া খেজুর  ওদের হাতে দেয়।

বাবা এখন বাসায় ফেরে না বলতে গেলে। একদিন চাচী এলো ওদের বাসায় নারকেলের পিঠা নিয়ে। মা চাচীর সাথে হেসে হেসে কতো গল্প করলো, চা করে খাওয়ালো চাচীকে, চায়ের ভাগ ওরাও পেলো, চা দিয়ে নারকেল পিঠা চুবিয়ে খেলো । তারপর একসময় চাচী চলে গেলে মা খাটে হেলান দিয়ে কাঁদতে বসলো।

কতোদিন পর, হিসেব নেই নীলুর,  বাবা ফিরলো বড়সড় এক জোড়া ইলিশ মাছ নিয়ে সঙ্গে কাঁচাকলা দুই হালি। মা তড়িঘড়ি করে উঠে মাথায় বড় ঘোমটা টেনে বলে, “আফনে কে, না কইয়া ঘরের ভিত্রে  ঢুকি  গেছইন?  বাইরে যাউক্কা। তাইন বাড়িত নায় অখন। তাইন আইলে আইবা। ”

দুই

নীলুরা এখন মামাদের বাড়ি থাকে, গ্রামের নাম ‘চাতল ‘। বাবা তাদের মামার বাড়ি রেখে আবার বিয়ে করেছে। মাকে শেকল দিয়ে বেঁধে রাখতে হয় ঘরের ভেতর অথচ মা খুব শান্ত, কোনো রকম চিৎকার করে না। কয়েকদিন আগে গায়ের সব কাপড় খুলে রাস্তায় বের হয়ে গেলে মামীরা মিলে জোড় করে ধরে এনে কাপড় পড়িয়ে দড়ি দিয়ে ঘরের খুঁটির সঙ্গে বেঁধে রেখেছে। বড় মামা শক্ত দেখে লোহার শেলক কিনে এনেছে।

নীলুর বারো বছর হলো, বাবুও আরো বড় হয়েছে। সারাদিন ঘরের কাজ করে নীলু। গ্রামের বাড়ি, উঠান ঝাড়ু দেওয়া থেকে  শুরু করে মাটির চুলা লেপা, আগান – বাগান থেকে শুকনো পাতা, ডাল কুড়িয়ে আনা, পুকুরে হাঁড়ি -পাতিল ধোয়া, বাড়ির সবার কাপড় কাচা আর রান্না তো আছেই। তার ভীষণ কষ্ট হয় এতোসব কাজ করতে কিন্তু ছোট ভাইয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে সে সব সহ্য করে নেয়। কাজ না করলে সেদিন বড় মামী তাদের খেতে দেয় না।

তার কথা না বলতে পারা ভাইটা খিদে পেলে নীলুর কাছে এসে ঘোৎ ঘোৎ শব্দ করে, খাবার চায়। সকালে গত রাতের বাসী তরকারি অথবা শুকনো মরিচ পোড়া দিয়ে দুই মুঠ ভাত খায় দুই ভাইবোন। কোনোদিন পান্তা না থাকলে একমুঠো মুড়ি রঙ চায়ে ভিজিয়ে খেয়ে নেয়। দুপুরে সবার খাওয়া হলে ওরা দুটিতে খেতে বসে তখন বিকেল হয়ে যায়। দুই চামচ ভাত একটু ঠান্ডা ডাল কখনো সবজি ভাজি পড়ে থাকে হাঁড়ির তলে, তাই চেটেপুটে খায়  ওরা। নীলুর খাওয়া নিয়ে কোনো অভিযোগ নেই, কাঁচা মরিচ কামড়ে একগাল ভাত মুখে দিয়ে ঢকঢক করে পেট ভরে পানি খেয়ে বাকি ভাতটুকু ডাল দিয়ে মেখে ভাইকে খেতে দেয়। মাছ কিংবা মাংস ওদের ভাগ্যে জোটা না কখনো। রান্নাঘরে মাছ ভাজার ঘ্রাণ বাতাসে ছড়িয়ে পড়লে বাবু বারবার রান্নাঘরের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। নীলু সভয়ে ভাইকে সরিয়ে দেয় ওখান থেকে। বড় মামী দেখলে কুকুর তাড়ানো তাড়ায় ভাইকে,  কখনো চ্যালাকাঠ ছুঁড়ে মারে রান্নাঘর থেকে সঙ্গে  পৃথিবীর সমস্ত অকথ্য ভাষায় গালাগাল ,    ” যত আপদ বালা  আইয়া জুটছে ঘাড়োর উফরে। আস্হাদিন খাই খাই। মা মাগী  ফাগল হইয়া বাঁচছে। বাপ বিয়া কইরা  সুখে আছইন। আমার কফালে সুখ নাই।লাত্থি উষ্টা মারি তোরার  কফালো।”

নীলর  দুটি জামা, মামাতো বোনদের বাতিল করা ছেঁড়া জামা সেলাই করে পরে। তার একটা ওড়না দরকার, বড়ো অস্বস্তি হয় বুক সোজা করে হাঁটতে। ইদানিং মামাতো ভাই, নীলুর চেয়ে অনেক বড় সে ওর বুকের দিকে তাকিয়ে কেমন করে হাসে, চোখ টিপ দেয়। নীলু ভয়ে, লজ্জায় সংকুচিত হয়ে পড়ে, কুঁজো  হয়ে হাঁটে। মামীকে ওড়নার কথা বলতে ভয় পায়, কেবল ওড়না কেন কোনো কিছুর কথাই ওকে বলা যায় না বললেই তেলে বেগুনে জ্বলে উঠে তার মন্দ কপাল এবং হাতির পাল পালতে হয় বলে চেঁচিয়ে পাড়া মাথায় তোলে। সারাদিন বৃষ্টি পড়ছে, থামার কোনো লক্ষন নেই। বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে ঘরে  – বাইরের কাজ সেরেছে নীলু। ওড়না না থাকার দরুণ জামা ভিজে শরীরের সঙ্গে লেপ্টে আছে।তবে সে জানে এই সময় পুরুষ কেউ বাড়ি থাকে না, দ্রুত হাতে কাজ করছে সে, পুরুষরা আসার আগে বাইরের কাজ শেষ করতে হবে।

তুমুল বৃষ্টির জন্য মামাতো ভাইয়ের আড্ডা আজ বন্ধ, গৃহবন্দী থাকতে হচ্ছে বলে বেশ দুঃখ হচ্ছিলো তার কিন্তু একি, এ কি দেখছে সে!জানালার দিকে আরো এগিয়ে এলে সে, নীলুর বুকের দিকটা স্পষ্ট দেখতে পেলো, কমলা রঙের সুপারী ডেবে বসেছে বুকের দুই পাশে। তার শরীর কেমন করে উঠলো, পায়ের তালু জ্বলে যাচ্ছে হঠাৎ। ডান হাত লুঙ্গির উপর রাখলো,  বাদলার অন্ধকারে  কালো হয়ে আছে ঘরের ভেতর, বাইরে থেকে বোঝার উপায় নেই ঘরে কেউ আছে কি না । নীলু জানে না তার জল থৈ থৈ স্নিগ্ধতা শ্বাপদ পুরুষ অগ্নিসম আঙ্গুলের চাপে খন্ডযুদ্ধে ভেঙ্গে দিলো জলের শরীর।

রাত আসে, বৃষ্টি পড়ে টিনের চালে। ঝমঝম শব্দ একটানা শুনতে শুনতে মাথার ভেতর ভোঁতা যন্ত্রণা হয় নীলুর। সারাদিন বৃষ্টিতে ভেজার ফল, গা ম্যাজম্যাজ করছে। কাঁথা গায়ে মাটিলেপা  মেঝেতে পাটি  পেতে শুয়ে আছে, বাবু পাশে ঘুম। মা বিছানার উপর চিৎ হয়ে ঘুমাচ্ছে, পায়ে শেকল।   ছেলেবেলার স্মৃতি চোখের উপর ভেসে ভেসে যায় ছায়াছবির মতো। এমনি বৃষ্টি হলে মা খিচুড়ি আর বেগুন ভাজি করতো সঙ্গে আমের আচার। বাবা মাঝেমধ্যে ইলিশ মাছ আনতো, মা মাছ ভাজি করতো, মাছের ঘ্রান ঘরের ভেতর ঘুরপাক খেয়ে ওদের নাকের ভেতর সুড়সুড়ি দিয়ে যেতো। মাছের গরম তেল মেখে ভাত খেতে কী মজাই হতো, মা কাঁটা বেছে প্লেটের পাশে রাখতো, সে একটু একটু করে সব ভাত শেষ করে তবে ঘুমাতে যেতো। অজান্তে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো বুকচিরে। পাশ ফিরে ভাইকে জড়িয়ে ধরে ঘুমানোর চেষ্টা করে। এক সময় ঘুমিয়েও পড়ে। গভীর ঘুমে মনে হয় জামার ভেতর কারো আঙ্গুল তার স্তন  মুঠোয় নিয়ে চাপ দিচ্ছে । ব্যথা এবং ভয় তাকে দিশেহারা করে তোলে মুহূর্তে, সে চিৎকার করে উঠে কিন্তু তার আগেই একটা হাত তার মুখ চেপে ধরে, ”  একবারে চুপ,কোনতা মাতবিনা তর ভাইয়ের গলা টিকনি মারি মারিয়া তইয়া যাইমু, ইতা কথা যেনো কেউ না হুনে

সময়ের ধারনা নীলু করতে পারে না, পুরো শরীরে মাকড়সা জাল বোনে, ধারালো জাঁতি সুপারি কাটে  ক্ষিপ্ত গতিতে, উরুমূলে রক্তজবা ফোটে বুলেট গতিতে, ধারালো নখে জ্যামিতিক রেখা আঁকে পিঠে ও পেটের সবুজ জমিনে, মাংস কাটার ধারালো ছুরির নীচে কুচিকুচি হয় হৃৎপিণ্ড। মহাপ্লাবন এক সময় শান্ত হয়ে নেতিয়ে পড়ে তার বুকের ‘পরে  । থকথকে আঠালো ফেনা গড়িয়ে পড়ে অতল গহ্বর হতে। নীলু বিষের ছোবলে  অচেতন শুয়ে থাকে বোবা, কালা ভাইয়ের পাশে। এক হাত দূরে মায়ের ঘন নিঃশ্বাস, ঘুমিয়ে কোন স্বপ্ন দেখছে কে জানে!