You are currently viewing সাতটি কবিতা : মানুষই আহার্য, ধর্মাবতার!> আলী সিদ্দিকী

সাতটি কবিতা : মানুষই আহার্য, ধর্মাবতার!> আলী সিদ্দিকী

অপরিণামদর্শী কালের ঢেউয়ে ভেসে আসে অন্ধকারের কালস্রোতে। সময়ের গ্রন্থিতে জমাট বাধে স্বকালভুক অন্ধকার। স্বপ্রণোদিত প্রাণময় জীবনের পরতে পরতে দীর্ঘশ্বাসের ঘূণপোকা অষ্টপ্রহর রচনা করে চলে হননের জয়গান। নিঃস্বতার বিস্তৃতি ঘটে চলে প্রেমাংশুর অস্থিমজ্জায়, বোধের বাগানে। প্রেমহীনতার রজ্জু গলায় বেঁধে অনন্ত হলাহলে মেতে ওঠে অতৃপ্ত পিপাসা। সঙ্গমে জঙ্গমে মন্ত্রমুগ্ধতায় সাঁতার কাটে নতুন পোনারা অশুদ্ধ সরোবরে। যথানিয়মে বিলুপ্ত হয়ে যায় বিরাজমান দানব দঙ্গলে। বড়শিবিদ্ধ নানারঙের মাছ দুঃস্বপ্নের ভেতর সাঁতরে চলে রুদ্ধশ্বাস। বুদবুদ হয়ে বেঁচে থাকার লড়াইগুলো, প্রেম ও দ্রোহের কাহিনীগুলো অনিবার্য কবিতা হয়ে ওঠে।

কাঠামোবন্দী মানুষ মূলত দৃশ্য ও অদৃশ্য নানা শেকলে বন্দী এবং কোনোভাবেই মুক্তি মেলে না তার। কাঠামোর কাছে বারবার হেরে যাওয়া মানুষ পরাজয় ও অসহায়ত্বের দুঃখগুলো ভোলে না কখনো। সে বোঝে, কাঠামোর খোরাক সে। তাই অমূল্য সম্পদের মতো সে এসব দুঃখগুলোকে নিজের ভেতর সংরক্ষণ করে। নিজস্ব ক্ষতগুলোকে, ঘা দেয়া দুঃখগুলোকে পরম যত্নে, গভীর মমতায় মনমন্দিরের পূজোর আসনে বসিয়ে রাখে। এইসব মানবিক বোধগুলো হীরকদ্যুতির মতো তার জীবনে জ্বলজ্বল করে কাব্যময়তায়।

প্রবাসের জটিল সমীকরণের নিগড়বন্দীত্বের কারনে প্রকাশিত বইটি পাঠকের হাতে পৌঁছানোর ক্ষেত্রে বরাবরই অসন্তুষ্টির কষাঘাতে জর্জরিত হই। তাই বহুপ্রচেষ্টার অংশ হিসেবে মনমানচিত্র-এর পাঠকদের কাছে বইয়ের কিছু কবিতা শেয়ার করার লক্ষ্যে সাতটি পাঠক সমাদৃত কবিতা এখানে সন্নিবেশ করলাম। সামাজিক মাধ্যমে হয়তো কিছু কবিতা কিছু পাঠক পড়ার সুযোগ পেয়েছেন কিন্তু আরো বেশি পাঠকের কাছে নিয়ে যাবার লক্ষ্যে নিচের কবিতাগুলো বাছাই করে দেয়া হলো। পড়ার আমন্ত্রণ।

 

সাতটি কবিতা : মানুষই আহার্য, ধর্মাবতার!

আলী সিদ্দিকী

 

মৃত্যুঞ্জয়

 

তুমি মৃত্যুর কথা বললে- আমি মাতৃজঠরে
ফিরে যাওয়া বুঝি- নাকে এসে লাগে
হৃৎকমলের সেই ঘ্রাণ- মৃদু ঢেউয়ে দোলা
জলতরঙ্গে ভেসে যাওয়া-স্পন্দনের
অবিরাম গীতের অপরূপ এক গীতাঞ্জলি
মৃত্যু আমার হারানো ভুবনের স্বপ্নশেকড়।

মৃত্যুর গানের কথা বললে- মায়ের গুনগুন
করে গাওয়া চেনা সুর বুঝি- বৃষ্টির ছন্দময়
আমেজ ছড়ানো প্রমোদ- বাতাসে তরঙ্গিত
মায়ের সুখময় হাসি- ঝলকে ওঠা চন্দ্রিমা
পুস্পিত হয়ে ওঠা মায়ের জোড়া শস্যগোলা
উষ্ণীষ হয়ে ওঠা মায়ের অবাধ ক্রীড়াভূমি।

তোমরা মৃত্যুর কথা বললে- আমি কোমল
মাতৃকোষের স্বাধীন এক লীলাকানন বুঝি
তুমি মৃত্যুর কথা বললে- মায়ের ভেতর নয়া
বসতি গড়ে তোলার উল্লাসে মেতে উঠি।

 

ঝড় হয়ে নাচি

 

ঝড়ের ভেতর মুখ ডুবিয়ে বসে আছি।
ঝড় যেন এক তুমুল আলিঙ্গন- বেদনা-
সুখের, মৃত্যুময়।

হৃদয় নিংড়ানো তার হাহাকার ধ্বনি – অনতিক্রমণীয়
এক প্রতাপশালী ঢেউ- এক রুদ্ধশ্বাস প্রলয়ের
বুকফাটা আর্তচিৎকার- যেন অনন্য এক
হন্তারকের উন্মত্ত নৃত্য-
আকাশ মথিত করে ছুটে আসা এক
অবিনাশী বজ্রনির্ঘোষ।

পাঁজরের হাঁড়গুলো গুড়ো হয়ে ঝরে পড়ে- তোমাকে
ছুঁয়ে প্রাণ পাওয়া আঙুলগুলো ভাঙে
শুকনো কাঠির শব্দে-প্রখর নখরে
খুবলে নেয় তোমার চুমুমগ্ন ঠোঁট জোড়া-
তোমার আঙুলের স্পর্শে নিবিড় ঘন হয়ে ওঠা
চুলগুলো তুলে নেয় ছোঁ মেরে- তোমাকে
আলিঙ্গনের প্রিয় বামহাত মুচড়ে দেয়-অবশেষে
তোমাকে ধারণকৃত হৃদয় ছিন্ন করে নেয়।

ঝড়ে মুখ ডুবিয়ে আছি-ঝড় হয়ে নাচি।

 

তোমার কাছে রয়ে গেছি

 

তুমি বলেছিলে হারিয়ে যেতে, পালিয়ে যেতে।
বলেছিলে পৃথিবীতে এতো এতো পাহাড়,
গিরিখাদ, তুমুল ভীষণ গহীন জঙ্গল, সাগর
আর মহাসাগর–কোথাও নাকোথাও তুমি
পালিয়ে যাও, হারিয়ে যাও।

বলেছিলে, পৃথিবী জুড়ে কতো কতো ধূ ধূ
মরুভূমি আর মালভূমি আছে, আরো
আছে কতো কতো ভুতুড়ে আর পিশাচ সংকুল
পরিত্যক্ত জনপদ–তাদের যেকোনো একটায়
পালিয়ে যাও, হারিয়ে যাও।

পই পই করে বলেছিলে, দুনিয়ায় এতো এতো
বড়ো বড়ো শহর, লক্ষ কোটি মানুষের অরণ্য
ইটপাথর আর লোহার বিশাল সব অট্টালিকা
কতো কতো গলি কানাগলি- যেকোনো শহরে
হারিয়ে যাও, লুকিয়ে যাও।

হারিয়ে যেতে কতো কতো বন-জঙ্গলে গেলাম,
তপ্ত বালুকণা মাড়িয়ে ছুটে গেলাম মরুভূমিতে,
গেছি কতো যে মৃত্যুপুরী আর শহরের অরণ্যে,
ছুটেছি অবিরাম বিশ্বময়-নিজেকে হারিয়ে দেখি
বরাবর তোমার কাছেই রয়ে গেছি।

 

সজারু সময়

 

দিনের কার্ণিশে গাওয়া অচেনা পাখির গান
খেয়ে যায়
সজারু রোদ
মহানন্দে শকুনেরাও মানুষের করোটি খুলে
খুঁটে খায়
মনন ও বোধ।

মাটির চিতায় পোড়ে বুকের ভেতরের গোর
প্রেমাংশুর হাঁড় মজ্জাতে হয়েছে ভূমি উর্বর।

করতলে নৃত্যরত নন্দন গোলকের কপালে
জ্বলে বৈধব্য
রাক্ষুসে ঘৃণা
ছুঁয়েছে মানুষ অসুন্দর সব বীভৎস ভয়াল
ক্ষয়-অবক্ষয়
শীর্ষ বেদনা।

সময় চাতালে তুমি আমি নিছক কল্পতরু
মায়া আর মোহের আদলে বিভ্রম সজারু।

 

মানুষই আহার্য, ধর্মাবতার!

 

নুইয়ে আছি অনন্তকাল, মিইয়ে আছি!
যেন মুথা শাক কিংবা পথের পাশের
দলিত ঘাসসংঘ আবার বলতে পারো
ঝড়সন্ত্রস্ত বলহীন মান্দার গাছ।
নুইয়ে আছি, নত হয়ে আছি।

এই বুঝি ঝাপটা আসে, দুমড়ে মুচড়ে যায়!
এই বুঝি জ্বলে ওঠে ক্রোধ লেলিহান,
লকলকে করে লালসা, চকচকে লোভ!
অতিশয় নাজুক তাই
নুইয়ে আছি, নত হয়ে আছি কয়েক জীবন।

নত হয়ে আছে দৃষ্টি, নুইয়ে আছে মাথা,
আপাদমস্তক সন্ত্রস্ত সুদীর্ঘকাল।
শতসহস্র বছর পুরনো মাটির ভিটে কাঁপে,
শান বাঁধানো পুকুর ঘাটে নিশ্চল জল
মাটির শরীর মিইয়ে যায়
ভেঙে চুরচুর হয় মাটির মন, প্রতিমা।

সিঁদুর মুছে সাদাথান ওঠে সহস্র জায়া
জননীর মাথায়, শাঁখাশূন্য হাতে
থির অন্ধকার, রাতারাতি শ্মশানে আসীন
চাঁদতারা, দেবালয়ে বখতিয়ারি তলোয়ার
নাচে উৎকট বেলেল্লায়, যুবতীর শ্লীলতা
হয়ে ওঠে পুর্ণিমার মায়ের
তন্ত্রীছেঁড়া আর্তনাদ।

এভাবে নুইয়ে আছি শতবছর- গুজরাট
থেকে সারা বাংলায়, পুরো উপমহাদেশে-
এপার না ওপার! কোথায় জাগে রক্তপিপাসা
জেগে ওঠে হায়েনারা মাংস ও রক্তের নেশায়!
শ্রেষ্ঠত্বের লেলিহান ক্রোধ লালসায়- মানুষই
আহার্য আজ মসজিদ মন্দির, গীর্জায়, ধর্মাবতার!

 

পালাবদলের পালা

 

খসে পড়ছে-
চুনসুরকি, পলেস্তারা, চতুর মেকআপ
আসল-আসলে, নকল-নকলে ভুয়া
ব্রেকআপ।

পড়ছে ঝরে-
বালির বাঁধ প্রেম, ঠুনকো সব আহাউহু
মেকি মেকি ঈশ্বরতা, পায়ে পড়া আঙুল
প্রভু প্রতিভূ।

ধুকপুক করছে-
ক্ষুধার্ত হৃদপিন্ড, লক্ষ কোটি জঠরানল
অপচিত যৌবন, উচ্ছন্নে যাওয়া নক্ষত্র
অসীম জগদ্দল।

হাত কচলাচ্ছে-
অধিকন্তু ‘তবু’ লালাজীবী খোজাদল
ওরা ধরে তক্তা মারে পেরেক নির্বিচারে
ওরা ধর্মদঙ্গল।

শানানো চলছে-
বন্ধকী মগজ, সুপ্ত সত্তা ও জংধরা মন
ছলাৎ ছল জেগে ওঠে ঘুমন্ত রক্তে ঢেউ
সাজে রণাঙ্গন।

 

কালের কলেবর

 

তোমার প্রথম দীর্ঘশ্বাস ধারণ করেছিলো
যে নিরালা দূপুর
উড়ে যাওয়া বেপথু বেগানা বাতাস,
আমি ছিলাম তার প্রাক্তন অভিলাষ
অভিষিক্ত বিলাপ।

তোমার সাক্ষাত হয়নি সূর্যালোকের উদ্ভাসে
হয়নি চোখাচোখি
সময়ের ভিন্নতর নিঃশ্বাসের ভাষা,
আমি ছিলাম অন্তর্গত অগ্নিবলয়ে
গভীর নৈঃশব্দ্যসখা।

সহস্র দ্রোহোৎস্যুক প্রাণ কাঁপে বিরান প্রান্তরে
শব্দ শিহরণে জাগে পরাভব
রক্তাপ্লুত ভয়ের সংস্কৃতির দংশনে,
মিথের চোরাস্রোত গিলে নেয় নুসরাত
তনুদের আকুতি।

তোমার পলাশ উদ্বেল বসন্তের অভিষেক হলো
যে নবীন স্বপ্নময় সমাহারে
সময়ের অবগুণ্ঠন খুলে ফেলে নিপাট,
আমি নিষাদ খচিত অন্তর্বাহী কালের
নিঃস্ব এক কলেবর।