You are currently viewing সম্পর্ক এক নির্ণীত গ্রন্থি: একটি নিকট বিশ্লেষণ/  পারমিতা ভৌমিক

সম্পর্ক এক নির্ণীত গ্রন্থি: একটি নিকট বিশ্লেষণ/ পারমিতা ভৌমিক

সম্পর্ক এক নির্ণীত গ্রন্থি: একটি নিকট বিশ্লেষণ

পারমিতা ভৌমিক

সরাসরি নরনারীর সম্পর্কের কথায় আসি। সংসারে, সমাজে,জীবনে, এ নিয়ে যত গণ্ডগোল। নরনারীর সম্পর্ককে ঘিরে চিরদিন একটা ধোঁয়াশা আছে ।

নরনারীকে, পুরুষ ও প্রকৃতির সঙ্গে তুলনা করে ভাগ করা হয়েছে । তাহলে পুরুষ এখানে, প্রাকৃত নর-নারীর থেকে স্বতন্ত্র কোনো অস্তিত্ব নিশ্চয় ।  দ্বি-লিঙ্গ মানুষ জাতির ক্ষেত্রে দেখি নর-নারীকে পুরুষ ও প্রকৃতির গুণাগুণের ভিত্তিতে ভাগ করা হয়েছে। বস্তুত এই ভাগ হয়েছে উপাদানের তারতম্য অনুযায়ী। এই উপাদানগত তফাতের জন্য স্বাভাবিক ভাবেই দেখা গেছে কতক কাজ পুরুষ পারে না, নারী পারে…. আবার কিছু কাজ নারী পারে না, পুরুষ পারে । এই গুণগত পার্থক্যের জন্যেই মনে হয়, প্রাকৃতস্তরে স্ত্রী পুরুষের মধ্যে একটা চিরকালীন ভুল বোঝাবুঝি থেকে গেছে ।

এখন এই প্রবন্ধে আমাদের মূল সন্ধানের বিষয় হল, খুঁজে বার করা কোথায় এবং কেন এই বৈপরীত্য ও বৈষম্য নারী-পুরুষকে আলাদা করে রেখেছে। প্রসঙ্গতঃ বলে রাখা দরকার, নারী ও পুরুষের ক্ষেত্রে যারা অসুর স্বভাব সম্পন্ন তাদের কথা আমরা বাদ দেবো । মনে রাখতে হবে পুরুষ মূলতঃ পুরুষ এবং নারী মূলতঃ নারী। তাদের ক্ষেত্রে মানসিক বোঝাপড়ার একটা ফাঁক থেকে যাচ্ছে।

কিন্তু কেন ?

যে পুরুষ অসুর স্বভাব সে নারীর ওপর অত্যাচার করে আর যে নারী অসুর স্বভাবসম্পন্ন সে সংসারে পুরুষকে টিকতে দেয় না।

এই নিম্নস্তরের স্ত্রী পুরুষ সম্পর্কের মধ্যে আমরা যাব না।….

নারীকে, প্রকৃতিস্বয়ং নিজের মত করে গড়েছে। পুরুষকে পারেনি ।

পুরুষ  নিম্নতর জড়প্রকৃতি নয়, মহাপ্রকৃতির সন্তান । যদিও জন্ম নিতে হয়েছে প্রাকৃত ভূমিতে।

প্রকৃতির যে সমস্ত মহৎগুণ, তা নারীর মধ্যে আছে। নারীর মধ্যে থাকে প্রাণধারণ প্রাণপালন ও প্রাণ তোষণের ক্ষমতা। এই জায়গাটিতে নারী তার স্বভাবে স্থিত।

অপরপক্ষে, পুরুষের বিচরণ ক্ষেত্র মনের জগৎ। যেহেতু মাটির পৃথিবীতে তাকে জন্মাতে হয়েছে, তাই প্রকৃতিকে বা নারীকে সে সহজে অস্বীকার করতে পারে না। পৃথিবীর তীব্র আকর্ষণে পুরুষ নেমে আসে শুধুমাত্র নারীতে সম্প্রযুক্ত হতে।  আবার জড়িয়ে পড়ার ভয়ে সেই পুরুষই ছটপট করে মুক্তির জন্য এবং স্বাভাবিক ভাবেই মনোজগতে ফিরে যেতে চায়। ঠিক এই জায়গাটিতে একটা চিরন্তন ভুল বোঝাবুঝি তৈরী হয় । পুরুষ বোঝে না নারী কেন তার সহযোগী পুরুষটিকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে রাখতে চায় আর নারী বোঝে না আকাশের পাখীকে খাঁচায় ধরে রাখলে সে ছটপট করে বিরাট আকাশের জন্য। এই যে দুটো জগৎ সীমার পার্থক্য বুঝে নিতে হবে।

জন্মকালে আমাদের এই পদার্থগঠিত জড় দেহ তৈরী হয় এবং ঠিক সেই সময়ের পরিবেশে একটা নির্দিষ্ট বৈষম্যের জন্যই পুরুষ ও নারীর স্বতন্ত্র দেহগঠন  সম্ভব হয়।

মূল কথাতে ফিরে আসি । এই সব কারণেই নারী ও পুরুষের স্বভাবগত বৈষম্য সৃষ্টি হয়েছে। একে অপরকে বুঝতে পারে না বলেই, নানারকম দোষারোপ করে । নারী বলে পুরুষ বহুগামী কিন্তু আমরা জানি সময় ও সুযোগ থাকলে পুরুষের বহুগামিতার (Polygemy) মত নারীরও বহুগামিতা (Poliandry) রয়েছে। তাহলে এই দোষারোপটা সর্বৈব সতা নয় ।

প্রায়শই একটা কথা শোনা যায়, বউ মারা গেলেই নাকি তিন মাসের মধ্যে পুরুষ টোপর পরে আবার বিয়ে করে । আমরা বলি, এছাড়া পুরুষের গত্যন্তর নেই । পৃথিবীতে বাঁচতে গেলে প্রকৃতিকে গ্রহণ করা তার কাছে অনিবার্য প্রয়োজন ।

বিপরীত দিকে দেখি, নারী অতি অল্প বয়সে বিধবা হলেও চরম দুঃখ কষ্টে সন্তানকে মানুষ করে । আমরা জানি, এই প্রকৃতি রাজ্যটি নারীর নিজস্ব স্বভাবভূমি । তাই এটা সে সহজেই পারে । যত সহজে নারী বৈধব্য পালন করে ঠিক ততটাই কঠিন হয় কোন বিপত্নীকের পক্ষে সংসার নির্বাহ করা আর তার একমাত্র কারণ হল, পুরুষের স্বভূমি হল মনোজগৎ । পার্থিব জগৎ তার স্বভূমি নয় বলেই তা তার কাছে অবহেলিত।

পুরুষ মনোজগতের বাসিন্দা বলেই সে মনের সঙ্গী খুঁজে বেড়ায় অথচ বিপরীত লিঙ্গের প্রতি তার পার্থিব আকর্ষণ থাকায় সে নারী সঙ্গীনিকেই খোঁজে। ঠিক এই সময় তারা কামকে মানস প্রেমে তুলে নিয়ে যায়। কোনো কারণে সেখানে দেহ মিলনের প্রশ্ন এসেও যদি পড়ে সেটিকে রিরংসা বলে চিহ্নিত করার কোন কারণ নেই।

নারী যেমন চায় জড় পৃথিবীতে নর্ম-সহচর, পুরুষও তেমনি চায় মনোভূমিতে মর্ম-সহচরী ।

ট্র্যাজেডি এই ,নারীর টানে পুরুষ গৃহবাসী হয়ে বীর্য নিষেকের কাজটি সম্পন্ন করে কিন্তু নারীর ইচ্ছামত গার্হস্থ্য ও সন্ততি পালনের ক্ষেত্রে সে বাঁধা পড়তে চায় না।
তাই তাকে বিনিময়ে শক্তি এবং অর্থ সংসারকে দিতে হয় এবং সংসার সংসার খেলতে হয়।

আমরা পুরুষের মনে যদি উঁকি দিয়ে দেখি তাহলে দেখবো স্বততঃই প্রিয়তমা নারীকে সে মনোজগতের দিকে টানছে। সে মনের সঙ্গীনিকে চাইছে। একমাত্র বিদূষীনারীই পারে তেমনটি হতে। কিন্তু অতি সাধারণ ক্ষেত্রে তা হয় না। কাজেই নারী ও পুরুষের মধ্যে অদ্ভূত একটা আকর্ষণ বিকর্ষণের টান তৈরি হয়। মহাজাগতিক ক্ষেত্রে যেমন কেন্দ্রানুগ ও কেন্দ্রাতিগ দুটি টানের লীলা চলে, নর-নারীর মধ্যেও ঠিক সেরকম একটা টানের লীলা চলে।
খুব জড় স্তরে এটা নিয়েই নারী পুরুষের পারস্পরিক দোষারোপ চলে। কেউ কাউকে বোঝার চেষ্টা করে না।

এই যন্ত্রণার স্বরূপ যারা বুঝেছে তারা সাধনার কথা ভেবেছে।

পুরুষ ভেবেছে প্রকৃতি মুক্তির কথা যাতে সে স্বচ্ছন্দে মনোজগতে ফিরে গিয়ে আরও উচ্চজগতে উজান বাইতে পারে এবং বিন্দুলীন হওয়াই তার চরম লক্ষ্য আর নারীর সাধনায় কিন্তু এমন প্রকৃতি মুক্তির তাগিদ নেই। কেননা নারী স্বয়ংপ্রকৃতি বলে সে স্বভাবেই নিত‍্যমুক্ত।

নারী যেখানটায় পুরুষকে বোঝে না, সেটা হল পুরুষের জ্ঞানের জগৎ এবং মনের জগৎ। কাজেই মনন ও প্রজ্ঞার জগতটিকে লাভ করাই নারীর সাধনা হওয়া উচিত।

প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ করি, এই পারস্পরিক আকর্ষণের ও ভালোবাসার ইচ্ছায় নারী যখন পুরুষের সমভূমিতে উঠে যায় তখন শুরু হয় একের (Singularity) দিকে উজান বাওয়া। অধ্যাত্মত্মবাদীরা মনে করেন, এভাবেই কাম যখন প্রেমে পরিণত হয় তখন অযোনিজ (asexual) বোধ তৈরী হয়। বৈষ্ণব কবিরা সেই অবস্থাটিকে বলেছেন “ না সো রমণ না হম্ রমণী”

আসলে তখন আমরা উজান বাইছি বিসর্গ থেকে বিন্দুর দিকে। অর্থাৎ দুই থেকে একে ।

আমরা ঊর্ধচেতনা স্তরে (Vertical) যাত্রা থেকে আবার এখন নেমে আসব আনুভূমিক স্তরের আলোচনায়—- (Horizontal Plane) ।

আমরা এখন আবার সংসারে ফিরে এলাম । নারীর কিছু নিজস্ব গুণ আছে। নারী ক্ষমাশীল, নারী প্রাণ বিধাত্রি, নারীরই একমাত্র ক্রমপরিণাম আছে। কেননা কেবল প্রকৃতিরই পরিণাম সম্ভব। নারী নিজেকে বিভিন্ন “ভাবে” রূপান্তরিত করে। নারীর পক্ষে সেই ছড়িয়ে যাওয়াটা অত্যন্ত সহজ ও স্বচ্ছন্দ । সুতরাং পার্থিব জীবনেও গার্হস্থ্যে, নারীর দায়িত্ব সব থেকে বেশি। পুরুষের মনের সঙ্গীনি নারী , ইচ্ছে করলেই শ্বশুর-শাশুড়ীর কাছে সুশীল সুন্দর পুত্রবধূ হতে পারে। দেওর ননদের কাছে বন্ধুর মত বৌদিদি হতে পারে। সন্তানের কাছে মা হয়ে উঠতে পারে।  সংসারে এই সম্পৃক্তি যেমন নারীর নিজস্ব গঠন, সংসারের চরম বিভক্তিও তেমনি পুরুষের নিজস্ব গঠন । কাজেই ভীষণ প্রয়োজন নারী ও পুরুষের দুজনে দুজনকে বুঝে নেওয়া । পুরুষের স্বভাবটি নিত‍্যমুক্ত । বিদ্বান ও প্রাজ্ঞ পুরুষ কখনো সংসারে আষ্টেপৃষ্ঠে বাধা পড়েন না। যাজ্ঞবল্ক‍্যকেও আমরা দেখেছি একাধিক স্ত্রী থাকা সত্ত্বেও তিনি মহানঋষিসুলভ বৈরাগ্যের অধিকারী হতে পেরেছেন।

আনেকেই আবার মনে করেন, পুরুষের জীবনে নিজের স্ত্রী ছাড়াও কমপক্ষে আরও দুজন নারীর সঙ্গে সু সম্পর্ক থাকা প্রয়োজন , না হলে পুরুষ সুস্থ ভাবে বাঁচতে পারে না। আমাদের মিথলজি বলে, নারায়ণের পত্নী লক্ষ্মী আর উপপত্নী সরস্বতী । লক্ষ্মী হচ্ছেন সংসারের স্ত্রী , মঙ্গল ও সমৃদ্ধির দেবী। সংসার জীবনে তিনিই যথার্থ মঙ্গলা। কিন্তু উপপত্নী সরস্বতী বিদ্যার দেবী ও সুরের দেবী । তার জন্য সংসার নয়। সেই বিদূষী নারীর কাছে নারায়ণ কিন্তু অন্য কারণে বাঁধা।
একটু মজা করেই বলতে পারি, আমাদের পরিচিত নারী সমাজে লক্ষ্মী-নারায়ণকে যেমন শ্রদ্ধার সঙ্গে পূজা করা হয় তেমনি সরস্বতীকেও পূজা করা হয়, তাই নয় কি??  এই সহ-অবস্থানকে যদি তাঁরা ধর্মীয় কারণে মেনে নিতে পারেন, তবে নিজেদের জীবনে তুমুল গণ্ডগোল করার কোন হেতু দেখি না। তাহলে, আসলে আমাদের বুঝতে হবে, নারী পুরুষের মনোজগতের মূল বিরোধটা কোথায় ?
পুরুষ বাস করে  উচ্চতর মনোভূমিতে আর নারী প্রায়শই বাস করে নিম্নতর জড়ভূমিতে।

ভগবান শঙ্কর(আচার্য শঙ্কর) নারীকেও জড় বলে অভিহিত করেছেন । জ্ঞানীগণ বলেন জড় জগতের প্রতি তীব্র আকর্ষণ মানুষের উজান যাত্রাকে ব্যাহত করে। অথচ, মানব জীবনের বিবর্তন (Evolution) এ ওই ফেরা যাত্রাই শেষ কথা। ঠিক যেমন ভাবে সৃষ্টি লগ্ন থেকে পর্যায়ক্রমে আমরা মানুষে পরিণত হয়েছি, তেমনিভাবে রূপান্তরের মাধ্যমেই আমরা আবার সেই সৃষ্টি বিন্দুতে পৌঁছে যাব । বিজ্ঞান ওই বিন্দুটিকেই চিহ্নিত করছে মহাবিস্ফোরণের (bang) ও মহাসংকোচনের (cruch) মিলন বিন্দু (Singularity) হিসেবে ।

আমরা সূক্ষ্ম থেকে জড়ে রূপান্তরটি দেখে নিতে পারি——

অতিমানসস্তর (Supermind) ব্ৰহ্ম — (energy absolute)

অধিমানস (Overmind) বোধিমানস (Intutivemind)এবং

জ্যোতির্মানস (illumined Mind)

ঊর্ধ্বমানস (Higher Mind)

মন    ( Mind)

Physical Plane (ব্যক্তিমন সত্তা) । এখান থেকেই আবার পরপর ঘটতে থাকে—

ক) চেতনার রূপান্তর

খ) চেতনার উজান বাওয়া

মর্ত্যস্থিতিতে থাকে নারী তাই তারই রূপান্তর সম্ভব । সেইই পৌঁছে যেতে পারে ঊর্ধ্বমানস, জ্যোতির্মানস, বোধিমানস, অধিমানস পেরিয়ে অতিমানস স্তরে। কারণ সে চলৎশক্তি। পুরুষ তো স্বভাবতই ঐ স্তরে বাস করে। নারী সেখানে উঠলে প্রজ্ঞা পারমিতা হয়ে যায়।

ভগবান কৃষ্ণই একমাত্র পুরুষ যিনি অধিমানস পর্যন্ত পৌঁছে ছিলেন।  এভাবেই যুগ্ম সাধনায় নারী পুরুষ যথাক্রমে, শিব ও শক্তিতে পরিণত হয়। অর্ধনারীশ্বর একেই বলি।

তাহলে নারী পুরুষে বিবাদ একেবারেই নিষ্প্রয়োজন। শুধু উচ্চতর ভূমিতে ওঠার সাধনায় পরস্পরকে বুঝে নিতে হবে । সেখানেই জীবনে সামঞ্জস্য আসবে । শিবই তো একমাত্র প্রেমিক পুরুষ যিনি স্ত্রীর বিয়োগ ব‍্যথায়  যন্ত্রণাদীর্ণ হয়ে তাণ্ডব করেছেন, তাঁর শক্তি হারিয়ে গিয়েছে বলে। আমাদের মিথলজি তো একথা কবেই বলে গেছে।

আসলে নারী পুরুষ, যুগনগ্ধ প্রেমস্বয়ং ।  এটি বুঝে নিলে আর কোন গোল থাকে না। আবার বলি, প্রাকৃতস্তরে নারী পুরুষের মধ্যে এক বিস্ময়কর সম্পর্ক কাজ   করে। এর একটু ব্যাখ্যা করে নিতে পারি । ধরা যাক একেবারে প্রাকৃতস্তরটি হল  ‘রিরংসা’। তারপর ‘কাম’। তারপর প্রেম। রিরংসাস্তরে পুরুষ ও নারীর প্রক্ষোভের ধারা কিন্তু একেবারে স্বতন্ত্র। পুরুষের প্রক্ষোভের (emotion) কারণ হচ্ছে বীর্যাধানের আকাঙ্ক্ষা। তাই সে এ ক্ষেত্রে একেবারে উদ্দাম । আর নারীর ক্ষেত্রে ঐ একই সময়ে কাজ করে বীজ গ্রহণের আকাঙ্ক্ষা।

পুরুষের ইতিহর্ষ (orgasm) আর বীর্যাধান বা বিসৃষ্টি একসঙ্গে গ্রথিত। নারীতে ইতিহর্ষ আসে অনেক পরে । অনেক সময় আসেও না। পুরুষ এ ব্যাপারে উগ্র এবং সচেতন আর নারী নিষ্ক্রিয় ও অচেতন। তাই খুব স্বাভাবিকভাবেই দেখতে পাই পুরুষের ক্ষণিক উদ্দামতা ও তার প্রশমন ইচ্ছার আকুলতা। আর নারীর ক্ষেত্রে আবার, সন্তান পালনে ত্যাগ ও তপস্যার এক আশ্চর্য ইতিহাস রচিত হয়। নারীর মাতৃত্ব সারারাত ব্যাপী জোৎস্নাপ্রবাহ আর পুরুষের পিতৃত্ব বিদ্যুৎ ঝলক। এ দুটির অসামঞ্জস্য থাকেই , থাকবেই।

পুরুষের চিরসাধনাই তাই বীজাধানের প্রবৃত্তিকে শোধন করা, এবং এভাবেই সে আত্মারাম হতে পারে। ভারতে বৈদিক সাম মন্ত্রের এই রহস্য। নারী হল শক্তি। দুর্গা, উম, পার্বতী। মহাদেব এই মহাবেগকে স্তম্ভিত করে আছেন। এই নিঃসঙ্গ রুদ্রের সঙ্গে নিত্যযুক্ত কুমারী উমা। তাঁরাই সৃষ্টির আদি মিথুন। এ তত্ত্ব নারী পুরুষের জানা প্রয়োজন ।

মিথুনজাত আনন্দ অদ্বৈতের স্বাদ দেয় ।

প্রেম দ্বৈত-আশ্রিত আর সৌন্দর্য, বহুত্বকে আশ্রয় করে প্রকাশিত হয় ।

পরকীয়া প্রেমকে অধ্যাত্মভূমিতে সর্বসধ্যসার বলা হল। কেন ? স্বামী স্ত্রীর প্রেম কদাচিৎ ঐ স্তরে ওঠে বলে পরকীয়া রতিতে একটা অতর্কিত কামনা থাকে। এ ব্যাপারে পুরুষ অগ্রণী হলেও নারীর ভূমিকাও কম নয়। পরকীয়া রতিতে নারীর হঠাৎ কামনা যখন বিদেহ-ভাবনার ভূমিতে ওঠে, তখনই তার যথার্থ প্রীতির পরিমাপ হয় । এসব কথা বলছি কেন ? বলছি এই জন্য যে, নারী-পুরুষের আসল সম্পর্ক কেবল যৌনতায় নয়, সেসব অতিক্রান্ত এক সাম্যতে, ভালোবাসাতে… । চৈতন্য চরিতামৃতে এই প্রেমের উৎক্রান্তি দেখতে পাই, ভগবান শ্রী চৈতন্য ও রায় রামানন্দের সংলাপে। কৃষ্ণদাস কবিরাজের লেখা চৈতন্যচরিতামৃত গ্রন্থের মধ্যলীলার ৮ম পরিচ্ছেদে রায়রামানন্দ ও চৈতন্যের অনুভবের আদান প্রদানের ছবিতে এই ব্যাপারটি স্পষ্ট হয়েছে । এই বইটিতে আলোকিত যে “সাধ্যসাধন তত্ত্ব” আসলে তাই-ই হল প্রেম। রামানন্দ কোন্ প্রেম সর্বসাধ্যসার তা ব্যক্ত করেছেন চৈতন্যের প্রশ্নের উত্তরে। প্রতিবারই চৈতন্য বলেছেন ‘এহো বাহ্য’ । যখন রামানন্দ বললেন রাধাপ্রেম সর্ব সাধ্য সার, তখনও চৈতন্য বলেছেন ‘এহো বাহ্য, আগে কহ আর।’ এর পরের টুকু রামানন্দের চেতনায় নেমেছিল সম্পূর্ণ স্বয়ংক্রিয়ভাবে,— না সো রমণ না হম্ রমণী ।”

বিশ্বামিত্রের কথা বলি—-তিনি এক রহস্য পুরুষ । মেনকাকে নিয়ে তাঁর একটা কীর্তিকথা প্রায় অবিনশ্বর হয়ে গেছে । এই বিকৃতি (বিশেষ আকৃতি ) কিন্তু প্রাকৃত জীবনের গল্পকথার ফসল যেমন নারীপুরুষের সম্পর্ক নিয়ে চিরকাল আমাদের জীবনে একটা ভুল বোঝাবুঝি থেকে যাচ্ছে । বেদ কিন্তু বলছে এই বিশ্বামিত্রই বাহ্মীচেতনা দিয়ে রক্ষা করে আসছেন ‘ভারত’ জাতিকে। আজও কোটি কোটি ভারতবাসীর ইষ্টদেবী বিশ্বামিত্রের ‘সাবিত্রী’ । ঋকবেদ একেই বলেছে ‘ভারতী’। ইনিই একমাত্র নারী বা ‘মেনা’ বা ‘মেনকা” । সমস্ত বেদবানী পর্যাবসিত হয়েছে ওই একটি ঋকে।

পুরুষের একটি বড় গুণ হল সে স্বয়ং শিব হতে পারে। বস্তুপুষ্পাভরনী প্রকৃতিকে প্রত্যাখ্যান করে সে আগে মদনদহন করে তারপর শিবের সংসার পাতে । সারা পৃথিবীর নারীকে এই শিবের কাছে এই শিবময় পুরুষের কাছে নিবেদিতা হতেই    হয় । ত্যাগ ও মৃত্যুর সহজ দীক্ষা পুরুষ সহজেই আয়ত্ত করে । প্রকৃতির পা জড়কে আঁকড়ে থেকেছে বলেই ইউরোপীয় শক্তিরা শিবকল্প মানুষের সন্ধানে এসেছেন ভারতবর্ষের কাছে । ইতিহাস জানে সে সত্যকথা।

নারী রূপ ও সৌন্দর্যের আকর। প্রাকৃত পুরুষের আকর্ষণের জায়গা । রূপবতী কন্যা যখন জানতে পারে যে পুরুষটি তাকে ভালোবেসেছে সে এক বৈরাগী তখন তার জীবনে বিপ্লব ঘটে যায় । সমগ্র জীবনের অর্থ খুঁজে পায় সে ঐ বৈরাগীর চোখে । তাহলে এ কারণেই কি সর্বসিদ্ধির জন্য নারী জড়িয়ে রাখে বিরাগী বিবাগী পুরুষকে একান্ত নিজের করে ? পুরুষ মাত্রই স্বভাব বৈরাগী। এই সম্পর্কটিই হল আদি মিথুন।

সাংখ্য বলছে প্রকৃতি হল জড় আর পুরুষ হল চেতনা। পুরুষের দৃষ্টি শুধু ভাবমাত্র । আপনার বুকে প্রতি ফলনের কালে, আয়নার মতই সে নির্বিকার থেকে প্রকৃতিকে বুকে ধরে থাকে। এদিকে ঐ একই সময়ে প্রকৃতির মধ্যে চলে রূপান্তরের ক্রিয়া। চলে, ক্রমিক উৎকর্ষের কার্যক্রিয়া। একমাত্র নারীপ্রকৃতিই হয়ে উঠতে পারে পরমাপ্রকৃতি, যা আবার পুরুষেরও আত্মপ্রকৃতি।

এইসব জেনে, বুঝে, প্রাকৃত জীবনে দোষরোপের পালা একেবারেই মুছে যেতে পারে । অন্ততঃ যাওয়া সম্ভব।

পরিশেষে বলি,—– নারী পুরুষের সম্পর্ক মর্ত্যজীবনে কেবল পারস্পরিক ভালোবাসাতেই পূর্নতা পেতে পারে । এরই উপজাত ফসল হল পারস্পরিক বিশ্বাস ও সহঅবস্থান। একথা সত্য বলে মানতেই হয় যে আত্মস্থ না হলে ভালোবাসা যায় না, এবং কোনরকম চিন্তার অসাম্য মানুষকে আত্মজগতে স্থিতি দেয় না। অতত্রব চিন্তার শুদ্ধিকরণ চাই নারী পুরুষ উভয়েরই । এই শুদ্ধিকরণ আর কিছুই নয় সম্পর্ককে শিকড় থেকে জানা ।

নারী সঙ্গমিত হবার চাইতে লীলাবিলাসে তুষ্ট হয় বেশি। পুরুষ কিন্তু, সম্প্রয়োগের তীব্র আনন্দেই পূর্ণতা চায়। এখানেই একটা বোঝার ভুল সূত্রাকারে থেকে যায়। পুরুষকে তাই ভোগের রাস টানতে হয়, সেটাই সাধনা । আমাদের অধ্যাত্ম শিক্ষা এইরকম বলে যে, প্রিয়ার প্রতিমাকে হৃদয়ে আকর্ষণ করলে আপনা হতেই পুরুষের কাম ভাবনা উর্ধ্বমুখী হয় এবং তা প্রমে পর্যবসিত হয়।

নারীর যত আকর্ষণ দেহে, প্রায়শই মনের দিকে তারা দরিদ্র (সবাই নয়)। তাই মনোজগতের অধিকর্তা পুরুষের প্রতি তাদের একটা অজাগতিক টান থাকে। ভারতীয় নারী কিন্তু দেহ নিয়ে বিশেষ ভাবে না। সে কেবল পুরুষের কামকে পরিতৃপ্ত করে মাত্র। সেক্ষেত্রে, পুরুষের চাই সংযমের শিক্ষা। সেটাই ভারতের চিরন্তন সাধনা নারীকেও আবার উজ্জ্বল বৈরাগ্য ও ব্যাপ্তির শিক্ষা নিতে হবে পুরুষের কাছে।

নারীর নিজস্ব একটা ভাবতরঙ্গ আছে, পুরুষকে সেটি সমুদ্রের মত বুক পেতে গ্রহন করতে হবে। সহজিয়াদের মত সম্প্রয়োগকে চিন্ময় করে তোলা যায়, পুরুষকে তা জানতে হবে। পরা ও অপরা প্রকৃতির যুগনদ্ধ সন্তান হল নরনারী । কাজেই যৌনতা থেকে ঈশ্বরলীনতার মধ্যেই তাকে যাতায়াত করতে হয় ।

আসলে বৈরাগীর যত সাধনা তা পুরুষেরই…. নারী তাকে সাহায্য করে মাত্র।
নারী স্রোতে ভাসতে পারে, তাতে তাদের ক্ষতি হয় না। তারা সমর্পণের ভেতর দিয়েই ভূমাকে পায় ভোগের মধ্যেও তাদের পক্ষে বৈরাগ্য লাভ করা অনায়াস সাধ্য। কিন্তু পুরুষকে রাশ টানতেই হয়, না হলে সে ভূমাকে পায় না। নারী তার প্রিয়তমকে কোষে কোষে জাড়িয়ে থাকে আর তাই প্রতিটি কোষে তার রমণ হচ্ছে। গতানুগতিক যৌন সংস্কার দূর না হলে দিব্য সম্প্ৰয়োগ বোঝা যাবে না । আর নরনারীর ক্ষেত্রে সেটি পূর্ণতা না পেলে, পুরুষ খুঁজে বেড়াবেই, সর্বত্র  তেমন নারীকেই  যার মধ্যে বৈরাগ্য জ্ঞান ও ভূমা বোধের প্রকাশ আছে।

পুরুষ তাই বলতে পারে—-হেথা নয় হেথা নয় অন্য কোথা অন্য কোনখানে।—- এমন ভাবনা সঠিক না বুঝতে পারলে, এক্ষেত্রে প্রায় কেউই প্রাকৃত স্থূল সম্প্রয়োগের কথা বিস্তৃত হয়ে আনন্দের স্রোতটিকে গ্রহন করতে পারে না। ফলে যত গণ্ডগোল তৈরী হয় নারী ও পুরুষের সম্পর্কের মধ্যে, অথচ এই নারীরই ‘প্রিয়ারূপ’ সুফী সাধকদের কাছে ‘ঈশ্বর ভাবনা’।

আজকে সমাজ জীবনের দিকে আসুন ফিরে দেখি: প্রাচীন ব্রহ্মচর্য আশ্রম, আমরা মানি বা না মানি , এটা ছিল একশত ভাগ বৈজ্ঞানিক চিন্তা।

আমরা ভাবের সাধনা করতে ভুলে গেছি। সে সাধনায় স্থূল দেহের প্রয়োজন নেই। স্থূলদেহকে ঘিরেই নারী পুরুষের যত সমস‍্যা ও বিসম্বাদ।

বৈষম্য ও স্থূলত্ব অতিক্রমণেই সমরস আসে নারীপুরুষের  সম্পর্কের মধ‍্যে । কোন বিবাদ আর থাকে না। এভাবে স্থির বিচারে ও দর্শনে নারী পুরুষের সম্পর্কটিকে দেখতে পারলে দ্বন্দ্বের অবসান ঘটে বা স্তিমিত হয়। নারীকে আলাদা করে নারীবাদী হতে হয় না। জীবনের অদ্ভূত রসায়ণে হাবুডুবু খেতে হয় না। বোঝা সম্ভব হয় যে নারী-পুরুষ পরস্পরের পরিপুরক।

তাই, পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও সমঝোতাই সুস্থ জীবন দিতে পারে । ঠিক নয় কি????