সমালোচনা সাহিত্য ভাবনা
মনিজা রহমান
শার্লি জ্যাকসনের লেখা ‘দি লটারি’ গল্পটি কত শতভাবে, কত দৃষ্টিকোণ থেকে আলোচনা হয়েছে, তার কোন ইয়ত্তা নেই। আমেরিকান সাহিত্যিকের লেখা এই গল্পটিকে পৃথিবীর সবচেয়ে ‘টুইস্টেড’ গল্প বলা হয়। বেশীরভাগ পাঠক গল্পের পরিণতি মেনে নিতে পারেনি। শত শত সমালোচক নানা দৃষ্টিকোণ থেকে গল্পের ব্যাখ্যা করেছেন। এভাবে শার্লির একটি সৃষ্টি পেয়েছে ভিন্ন ভিন্ন মাত্রা। একইভাবে বলা যায় ফ্রান্ৎস কাফকা রচিত ‘দি মেটামরফসিস’ এর কথা। যে বইটি নিয়ে গত একশত বছরের বেশী সময় ধরে আলোচনা চলছে, কিন্তু এখনও কোন মীমাংসায় পৌঁছানো যায়নি।
একজন সৃষ্টিশীল লেখক লিখে যান তাঁর অসামান্য প্রতিভাবলে। তাঁর সেই সৃষ্টিকে ব্যাখ্যা করেন, তাকে তুলে ধরেন, তাঁর সময়কে নির্ণয় করেন একজন সমালোচক। শিল্প, সাহিত্য, চিত্রকলা, সঙ্গীত, চলচ্চিত্র যে বিভাগেই লিখবেন, একজন সমালোচককে হতে হয় পুরো বিষয় সম্পর্কে সম্যক অবগত।
হয়তো কেউ বলতে পারেন, সমালোচকরা শুধু নেচিবাচক কথা বলেন! আবার কেউ মনে করেন, তারা শুধু তোষামোদি করেন। একজন প্রকৃত সমালোচককে এই অভিযোগের উর্ধ্বে থাকতে হবে। গঠনমূলক সমালোচনা অবশ্যই কাঙ্খিত। শুধু প্রশংসাসূচক সমালোচনা যারা পছন্দ করেন, তাদের সৃষ্টি এক জায়গায় থেমে যায়। গঠনমূলক সমালোচনা এগিয়ে দেয় একজন সৃষ্টিশীল মানুষকে। তাই কবির ভাষায় বলতে হয়-
‘নিন্দুকেরে বাসি আমি সবার চেয়ে ভাল,
যুগ জনমের বন্ধু আমার
আঁধার ঘরের আলো।’
একজন সমালোচক না থাকলে আজ কি এই উচ্চতায় পৌঁছাতে পারতেন ভ্যান গগ! কিংবা জীবননানন্দ দাশ হতে পারতেন বাংলা সাহিত্যের অন্যতম সেরা কবি! কখনোই না!
ডাচ শিল্পী ভিনসেন্ট ভ্যান গগ মাত্র ৩৭ বছরের জীবনে ৮০০ পেইন্টিং করেছেন। ড্রইং করেছেন ১১০০টি। জীবদ্দশায় কোন স্বীকৃতি পাননি তিনি। বিভিন্ন প্রদর্শনী হলেও দর্শক এবং শিল্প সমালোচকরা ঘুরে ঘুরে দেখে চলে গেছেন। তাদের কাছে এইসব চিত্রকর্মকে মনে হয়েছিল অর্থহীন। পুরো জীবনে মাত্র একটি ছবি বিক্রি হয়েছিল তাঁর। রাগে-ক্ষোভে আর হতাশায় আত্মহত্যা করেন অবশেষে ভ্যান গগ।
মৃত্যুর পরে তাঁর চিত্রকর্মকে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করা হয়। তাঁর ছবিতে উজ্জ্বল রঙের তাৎপর্য্য ও পোস্ট ইম্প্রেশনিস্টিক চরিত্র বিশ্লেষণ করে শিল্প সমালোচকরা ভুল বুঝতে পারেন। ভ্যান গগ যে উনবিংশ শতকের সেরা শিল্পীদের একজন হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছেন তার পিছনে রয়েছে শিল্প সমালোচকদের নিরপেক্ষ ও সুচিন্তিত বিশ্লেষণ।
জীবনানন্দ দাশ যখন কবিতা লিখছেন, তখন বাংলা কবিতা ফলবান বৃক্ষের মতো সৃষ্টিশীল। রবীন্দ্রনাথ-নজরুল-সুধীন দত্ত-অমিয় চক্রবর্তী-বিষ্ণু দে ও বুদ্ধদেব বসু তখন উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর। এরকম একটি সময়ে বাংলা কবিতায় নতুন ভাষা, নতুন উপমা-উৎপ্রেক্ষা ও নতুন বোধ নিয়ে উপস্থিত হলেন জীবনানন্দ। কিন্তু প্রথমে কেউ তাঁকে চিনতে পারেনি। যে তালিকায় আছেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথও।
সাধারণ পাঠকের কাছে জীবনানন্দ তখন সাপ-ব্যাঙ-পেঁচার কবি। তথাকথিত সমালোচকদের ভাষায় তাঁর কবিতা ‘উদ্ভট’ ও ‘দুর্বোধ্য’! কবি কিন্তু নির্বিকার। নিজের মতো করে লিখে চলেছেন। কে কি বলছে এই নিয়ে কোন মাথা ব্যথা নেই। ইংরেজী সাহিত্যের ছাত্র হবার কারণে ইউরোপিয় সাহিত্য তাঁর মননজুড়ে।
এই সময়ে বুদ্ধদেব বসু একটি বই সমালোচনা লিখলেন জীবনানন্দের। কবির দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘ধূসর পান্ডুলিপি’ নিয়ে লিখেছিলেন বুদ্ধদেব বসু তাঁর ‘কবিতা’ পত্রিকায়। তিনি লেখেন, ‘অতি পুরনো কল্পনা এখানে যেন একটি অপূর্ব রূপ পেয়েছে। তার কারণ ছন্দের নবত্ব, ধ্বনির বৈশিষ্ট্য। কয়েকটি লাইনে সম্পূর্ণ একটি ছবি পেলুম; এ ছবির রচনায় যে কলাকৌশল ব্যবহৃত হয়েছে, তা এই কবিরই নিজস্ব সৃষ্টি। বস্তুত, এখানে জীবনানন্দের মৌলিক সৃষ্টি প্রেরণার পরিচয় পাওয়া যায়; পড়তে পড়তে মনে হয় একজন নতুন কবির বুঝি দেখা পেলুম।………. ভালো কবিতার কেমন একটি আদিম অপটুতা আছে; মনে হয় এ যেন সদ্যোজাত অথচ চিরন্তন; এই মুহূর্তে এর জন্ম হ’লো, এবং চিরকালের মধ্যে এর মতো আর কিছু হবে না। …. প্রতিটি রচনার ভিতর দিয়ে এমন একটা স্বর বুকে এসে লাগলো. যেরকম আর কখনো শুনিনি। একেবারে নতুন সেই স্বর, আর এমন অদ্ভূত যে চমকে উঠতে হয়।’
(জীবনানন্দ দাশ: ধূসর পান্ডুলিপি। কালের পুতুল, বুদ্ধদেব বসু।)
এই দুটি শিল্প ও কাব্য সমালোচনা এখানে প্রণিধানযোগ্য। বাংলা সমালোচনা সাহিত্যের গোড়াপত্তন মূলত উনবিংশ শতকে হলেও শুরুর দিকে তেমন জোরালো ছিল না। বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে রবীন্দ্রনাথসহ প্রমথ চৌধুরী, মোহিতলাল মজুমদার, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, বিষ্ণু দে, ধূর্জটি প্রসাদ মুখোপাধ্যায় (সঙ্গীত বিষয়ক), এবং বুদ্ধদেব বসু বাংলা সমালোচনা সাহিত্যের ধারাটিকে প্রাতিষ্ঠানিকতা দেন। জীবননান্দ দাশের লেখা সম্পর্কে বুদ্ধদেব বসুর মূল্যায়ন আজ থেকে প্রায় ৮০ বছর আগে হলেও আজো সেটা অপরিবর্তনীয়। সমালোচনা সাহিত্যের শিল্পমূল্য এখানেই নিহিত।
কিন্তু সাহিত্য সমালোচনা কেন? সাহিত্যের জন্য সমালোচনা কতটা অপরিহার্য্য? সমালোচনা কি সাহিত্যের মান উন্নয়নে ভূমিকা রাখে? প্রশ্নগুলোর উত্তর পাওয়া জরুরী।
সাহিত্য বা সাহিত্যের গূঢ় অর্থ অনুধাবন করা সাধারণ মানুষের কাজ নয়। সাধারণ পাঠক কেবল ভাসা ভাসা ভাবে এর রসাস্বাদন করতে পারেন। অগ্রসর পাঠক লেখা পাঠ করার পরে এই বিষয়ে চিন্তা করেন। তবে প্রকৃত বোধসম্পন্ন পাঠক লেখার গভীরে চলে যেতে পারেন। লেখার তাৎপর্য্য বা দার্শনিক বিষয় অনুসন্ধান করতে পারেন। এই অনুসন্ধানের বিভিন্ন স্তর আছে। অনুসন্ধানের আগে সাহিত্য রচনার কলাকৌশলগুলি আয়ত্ব করতে হয়।
সাহিত্য সমালোচনার বয়স প্রায় আড়াই বছরের পুরনো। প্লেটোকে প্রথম সাহিত্য সমালোচক ধরা হয়। তিনি হোমারের কবিতা বিষয়ে তাঁর মতামত দিতে গিয়ে স্পষ্ট ভাষাতে বলেছিলেন, তার প্রজাতন্ত্রে বা রিপাবলিকে কবিদের কোন স্থান থাকবে না। তার অভিযোগ ছিল কবিতায় জীবনের অনুকরণ নিয়ে। প্লেটো এই অনুকরণ পছন্দ করেননি। কিন্তু তার শিষ্য এরিস্টটল অবস্থান নিয়েছিলেন গুরুর বিপরীতে। মনে রাখতে হবে যে, হোমারের বিখ্যাত রচনা ইলিয়াড ও ওডিসি রচিত হয়েছে তারও তিনশত বছর আগে। এই দুই মহাকাব্য নিয়ে দুই গ্রীক দার্শনিকের ভিন্ন মতামত মূলত সাহিত্য সমালোচনারই দৃষ্টান্ত।
অন্ধকবি হোমারের সৃষ্ট মহাকাব্যটি পৃথিবীর প্রথম পূর্ণাঙ্গ কাব্য। এর কাহিনী বা আখ্যান, কাহিনীর গাঁথুনি, গল্পবলার ধরন, ছন্দ এতোটাই পরিণত যে আজ কল্পনা করা বেশ দু:সাধ্য। যেমন প্রাচ্যে অর্থাৎ ভারতবর্ষে সংস্কৃত ভাষায় লেখা মহাকাব্য ব্যাসের মহাভারত ও বাল্মিকীর রামায়ণের রচনাকালও হোমারের কাছাকাছি সময়ে। মহাকাব্য মানেই এর ব্যাপ্তি বিশাল। জীবন ও জগতের নানা দর্শন, অভিজ্ঞান ও আধ্যাত্মিকতা এরইমধ্যে নিহিত। কিন্তু এই অন্তর্নিহিত অভিজ্ঞানকে অর্ঘ্য হিসেবে তুলে এনে তা সাধারণ মানুষের কাছে তুলে ধরেছেন বিশ্লেষকরা। অনেকে মহাভারত-রামায়ণকে ধর্মগ্রন্থ হিসেবে বিবেচনা করলেও সাহিত্য সমালোচকরা এর সাহিত্য মূল্যের কথা ভোলেননি।
সাহিত্যের গুণ বিচারে এর কারিগরি দিকটি জানা গুরুত্বপূর্ণ। একজন সমালোচককে অবশ্যই নন্দনতত্ত্ব ও সৌন্দর্য্যতত্ত্ব জানতে হবে। কবিতায় নন্দনতত্ত্ব জানার জন্য যেমন কবিতার বাহ্যিক দিকটি জানতে হয়, তেমনিভাবে এর ভিতরের স্তরকেও। এই সব জানার জন্য দরকার অলংকারশাস্ত্রে বূৎপত্তি। থাকা চাই কাব্যদর্শনবোধ। কবিতার অপরিহার্য্য অংশ ছন্দ। মুক্তছন্দেও এক ধরনের ছন্দ নিহিত থাকে। যে কোন পাঠক কারিগরি দিক না বুঝেও কাব্যপাঠে ও ছন্দের দোলাচলে এবং সুচারু প্রয়োগে আনন্দ পেতে পারেন। কিন্তু বেশীরভাগ পাঠকই হয়ত জানেন না কবিতাটি কোন ছন্দে রচিত। একজন সমালোচককে সেটা অবশ্যই জানতে হয়।
জীবনানন্দ দাশের বনলতা সেন কবিতাটি অনেকেই পড়েছেন। কিন্তু সাধারণ পাঠকের পক্ষে বোঝা সম্ভব নয় যে এটি অক্ষরবৃত্তে লেখা। উল্লেখ্য জীবননানন্দ দাশের বেশীরভাগ কবিতাই অক্ষরবৃত্ত ছন্দে লেখা হয়েছে। এসব না জেনেই জীবননান্দ দাশের কবিতা উপভোগ করেন অনেকে।
কবিতা পাঠে মধুর স্বাদ এনে দেয় পক্তিতে অনুপ্রাসের ব্যবহার। অনুপ্রাস কি এবং কিভাবে এর ধ্বনিময় শব্দালংকার পাঠকের হৃদয়কে মঞ্জুরিত করে সে কথা না জানলেও কবিতার আস্বাদ পাওয়ায় কোন বিঘ্ন তৈরী হয় না।
তবে কবি যখন কবিতায় চিত্রকল্প, উপমা, উৎপ্রেক্ষা ব্যবহার করেন, তখন সাধারণ পাঠকের জন্য এর ব্যাখ্যার প্রয়োজন হয়। মেটাফোর, প্রতীক বা রূপক ব্যবহার করলেও অনেক সময় পাঠক সেটা ধরতে পারেন না। রামায়ণে সীতাকে রামের বৃত্তবন্দী করে রাখা, মহাভারতে কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের নানা অনুষঙ্গ সবার পক্ষে বোঝা সম্ভব হয় না। বুদ্ধদেব বসু কিংবা রাজশেখর বসুর মহাভারত নিয়ে বিশ্লেষণাত্নক লেখা পড়লে অনেক কিছু সাধারণ পাঠকের জন্য স্পষ্ট হয়। ম্যাকবেথ, হ্যামলেট, ওথেলো নাটকে মানবজীবনের যে স্বাভাবিক প্রবণতা বা রিপূ তুলে ধরেছেন শেকসপিয়ার এর তাৎপর্য্য অনুধাবনের জন্য ব্যাখ্যা প্রয়োজন।
বাংলা সাহিত্যের দিকে তাকালে দেখতে পাই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্ত্রীর পত্র, গোরা, ডাকঘর, রক্তকরবী, ঘরে-বাইরে; মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পদ্মা নদীর মাঝি বা পুতুল নাচের ইতিকথা; মহাশ্বেতা দেবীর দ্রৌপদী, হাসান আজিজুল হকের শকুন, আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের উৎসব, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ভুতে খেয়ে যায় ভাত- ইত্যাদি গল্প বা উপন্যাসের অন্তর্নিহিত তাৎপর্য্য অনুধাবন করা সহজ নয়।
কবিতার ভিতরের সৌন্দর্য্য ও বহিরঙ্গের অলংকার বোঝা আর গল্পের কাঠামো ও চরিত্র সৃষ্টি, আখ্যানের দ্বন্দ্ব অনুধাবন এক নয়। কথাসাহিত্য ও কবিতা সাহিত্যের দুটি জনপ্রিয় ধারা। কবি ও কথাশিল্পীর উপস্থাপনার ভঙ্গী পৃথক। যদিও এখন কবিতাকে কখনো কখনো গল্পের মতো করে লেখার প্রচেষ্ঠা লক্ষ্যণীয়। আবার গল্পও কবিতায় ভাষায় বলা যায়। আধুনিক কবিতার বক্তব্য সুপ্ত। সবচেয়ে কমপ্যাক্ট আবহে সবচেয়ে গুঢ় বাণী কবিতাই ধারণ করে।
১৪ পংক্তির সনেটের বয়সও এক হাজার বছর। সনেট কবিদের জন্য এক ধরনের শৃঙ্খল। ১৪ পংক্তি ছাড়াও বিশেষ অন্ত্যমিল,বিভাজন, বিশেষ মাত্রা প্রতিটি পংক্তিতে এবং ৮ ও ৬ লাইনে দুই প্যারাগ্রাফের নিয়ম কবিরা প্রাণখুলে গ্রহণ করেননি। শেষ পর্যন্ত শেকসপিয়ারই সবচেয়ে সফল সনেট রচনা করেছেন। এরপর জন ডান, জন কিটস, বায়রন, ওয়ার্ডসওয়ার্থ নিজের মতো করে সনেট লিখলেও তারা কবিতার এই জোনরাকে কবিতা লেখার স্বাধীনতা হরণ হিসেবেই বিবেচনা করেছেন।
উনবিংশ শতকে কবিতা ধীরে ধীরে ছন্দ ও অন্ত্যমিলের বাধ্যবাধকতা থেকে বের হয়ে আসতে শুরু করে। ফলে ছন্দের দোলা থেকে বেরিয়ে এসে টানা গদ্যে কবিতা লেখার ধারা শুরু হয়। তারপরেও কবিতাকে শেষ পর্যন্ত কবিতাই হতে হবে। ছন্দের সরাসরি ব্যবহার না হলেও কবিকে ছন্দ জানতেই হবে। আরো জানতে হবে ভাষার তাৎপর্য, শব্দের ওজন, সেই সাথে শব্দ ব্যবহারের ব্যকরণ।
গল্পের বিষয়টি ভিন্ন। গল্প বা ফিকশন, ব্যাক্তিগত বা বৃহত্তর মানবজীবনের ঘটনা, জীবনের সংগ্রাম, জীবন যুদ্ধ, দ্বন্দ্ব এবং শেষ পর্যন্ত মানুষের এগিয়ে যাওয়ার অনুষঙ্গগুলিকে তুলে ধরে একটি আখ্যানের মধ্য দিয়ে। যদিও আখ্যান গল্পের জন্য অনিবার্য্য নয়।
মানুষের জীবনের কোনো বিধিবদ্ধ ব্যকরণ নেই। প্রত্যেক মানুষের চিন্তা ও জীবনযাপন পদ্ধতি তার নিজের মতো। কিন্তু জীবনকে সঠিক পথে চালিত করার জন্যে মানুষই রচনা করেছে বিবিধ যৌক্তিক নিয়মকানুন। তবে এই সব নিয়মকানুন আবার দেশকাল ভেদে এক নয়। কালের যাত্রায় তা পরিবর্তনশীল। তাছাড়া অর্থনৈতিক বিকাশ, শিক্ষার অগ্রগতি, গণতান্ত্রিক প্রাতিষ্ঠানিকতা ও ধর্মীয় কারণে এক এক গোলার্ধে সামাজিক ও রাষ্ট্রিক নিয়মকানুন, জীবনাচরণ, সামাজিক ট্যাবু, এবং মানুষের সহনীয় ক্ষমতা ভিন্ন।
মানুষের জীবনদর্শন, মূল্যবোধ, পরিচিতির নিয়ম রাষ্ট্র তৈরী করেছে। যাকে আমরা বলি আইন। গল্প বা উপন্যাস কখনও সমাজের এই মানবিক ও সামাজিক মুল্যবোধকে তুলে ধরে, কখনো সেই মূল্যবোধের ভিতরে সমাজ বিবর্তনের প্রতিবন্ধকতা লক্ষ্য করে লেখক সেই সমাজ ভাঙ্গার ইঙ্গিত তুলে ধরেন। ফলে কবি ও কথাসাহিত্যিকের সামাজিক দায়িত্ব বিশাল ও ব্যাপক। তাছাড়া নিজ নিজ কিংবা সর্বজনীন সুকুমার বৃত্তির বিকাশেও লেখক-শিল্পী সরাসরি সংশ্লিষ্ট।
মানুষের এগিয়ে যাওয়ার পথ পরিক্রমায় সাহিত্য ও শিল্প ততদিন পর্যন্ত সাধারণ মানুষের বোধে অভিঘাত সৃষ্টি করেনি (ইউরোপীয় রেনেসাসের আগে পর্যন্ত), যতদিন শিক্ষিত সাহিত্য ও শিল্পবোধ সম্পন্ন মানুষ এই সব সৃজনকর্মকে বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন, শিল্পী ও সাহিত্যিকরা তাদের সৃষ্টিকর্মের মধ্য দিয়ে প্রকৃতপক্ষে কি বলতে চেয়েছেন। অতএব, সাহিত্য ও শিল্পের স্রষ্টাদের জন্য একসময় অপরিহার্য্য হয়ে ওঠেন এর বিশ্লেষক, ব্যাখ্যাকার কিংবা সমালোচকবৃন্দ।
সাহিত্য ও শিল্প সমালোচনার ইতিবাচক দিকের পাশাপাশি নেতিবাচক দিকও রয়েছে। বাংলা সাহিত্যে এর নেতিবাচক দিকটি কখনও ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। ভয়াবহ হওয়ার কারণ হল, যারা সাহিত্য ও শিল্প সমালোচক তাদের সংশ্লিষ্ট বিষয়ে সম্যক ধারণা বা জ্ঞান না থাকা। যৎসামান্য থাকলেও তার অপপ্রয়োগ, পক্ষপাতিত্ব, স্বজনপ্রীতি, বৈষম্য (যেমন নারী লেখক বা শিল্পীদের সাহিত্য ও শিল্পকর্মের সমালোচনায় যথার্থ প্রাপ্য দিতে অনুদারতা), বুঝে কিংবা না বুঝে নিম্নমানের সাহিত্যকর্মকে উচ্চমানের এবং উচ্চ মানসম্পন্ন লেখাকে নিম্নমানের আখ্যা দেয়া। এটা এক ধরনের নীতিহীনতা। অন্যভাবে বললে অনৈতিকতা।
তবে এ কথাও সত্যি যে সাহিত্য বা শিল্পের ব্যাখ্যায় শেষ বলে কোন কথা নেই। গুণী লেখক তাঁর সৃষ্টিতে নানামাত্রিক বোধ তৈরী করেন। কল্পনাকে বিস্তৃত করার জন্য সেই বোধে অনেক বিচ্ছুরণ তৈরী করেন। অনেক স্তরও নির্মাণ করেন। যেমন টেক্সটের ও ন্যারেটিভের বিবিধ স্তর, জীবনদর্শন ও সমাজদর্শনের নানা মাত্রা। সমালোচককে পেঁয়াজের খোসার মতো একটি একটি করে ছাড়াতে হয় কনটেন্টের যাবতীয় পর্ব। এর জন্য সমালোচককে লেখকের মন মানসিকতা, তার কাল, তার সমকালীন সমাজবাস্তবতা সম্পর্কে জানতে হয়। তখনই বুদ্ধদেব বসুর মতো নতুন লেখককে আবিস্কার সম্ভব হয়। এই ধরনের বিদগ্ধজনেরা সাহিত্য সমালোচনাকে সমালোচনাসাহিত্যে পরিণত করেছেন। সমালোচনাসাহিত্য সাহিত্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে উঠেছে। এটাই সমালোচনাসাহিত্যের অন্তরমহলের ঝাড়বাতি।
বাংলাদেশের সাহিত্যে কি সমালোচনা এইভাবে সাহিত্য হয়ে উঠতে পেরেছে? আমি নিজে লেখালেখি করি বলে বিষয়গুলি আমাকে সব সময় ভাবায়।
==============================
মনিজা রহমানঃ কথা সাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক
==============================