You are currently viewing সমালোচনা সাহিত্য নিয়ে কিছু কথা || রুখসানা কাজল

সমালোচনা সাহিত্য নিয়ে কিছু কথা || রুখসানা কাজল

সমালোচনা সাহিত্য নিয়ে কিছু কথা

রুখসানা কাজল

এ বিষয়ে লিখতে গিয়ে প্রথম যে কথাটি মাথায় এলো তাহলো, সাহিত্য সমালোচনা হবে, নাকি সমালোচকদের নিরলস গবেষণা, আলোচনা, ব্যাখ্যার মাধ্যমে কোন রচনাকর্মের মূল্যায়ণ নির্ণয় করে সাহিত্যের অলঙ্কার হয়ে উঠবে সমালোচনা ? কিম্বা সাহিত্যকে ঘিরে দুটি বক্তব্যই পৃথক মঞ্চে আসীন হয়ে তাদের পৃথক কর্মকুশলতার স্বতন্ত্র স্বকীয়তা প্রমাণ করবে।
প্রশ্ন হচ্ছে, আমরা আসলে কি চাই ?
অর্থগত দিক দিয়ে বিশ্লেষণ করলে দুটি বক্তব্যই আদতে পৃথক। তবে একে অন্যকে জড়িয়ে গুছিয়ে তবেই এরা পৃথক। এক্ষেত্রে সমালোচনা নানা বিষয়ে হতে পারে। অর্থাৎ সমালোচনার আওতা বিশাল এবং ব্যাপক। ক্ষমতা অর্জন, দ্বন্দ্ব, শত্রুতায় সহিংস বা নমনীয় নীতি, রাজনৈতিক উক্তি, মতবাদ, বাস্তব কার্যক্রম কিম্বা রাজনীতিতে ধর্ম এবং ধর্মের দোহন ছাড়া আর্থ সামাজিক মতবাদ থেকে নৈতিকতা, মূল্যবোধ ইত্যাদি নিয়ে প্রতিনিয়ত সমালোচনা এবং পাল্টা সমালোচনা চলছে। স্বদেশ এবং বিদেশের এসব বিষয়, ঘটনা, সংঘটন ইত্যাদি সম্পর্কে আলোচনা সমালোচনার মাধ্যমে আমরা জানতে পারি। কিন্তু যে সমস্ত সমালোচকরা শিল্প সাহিত্যের রূপ রস নিয়ে অনুসন্ধান, পর্যালোচনা, ব্যাখ্যার মাধ্যমে গবেষণা করে যে গঠনমূলক মূ্ল্য নির্ধারণ করে সেগুলো কি আমরা দেখতে পাই ? বিদেশি সাহিত্যে নিয়ে কিছু আলোচনা সমালোচনা অনুবাদের মাধ্যমে পড়তে পেলেও আমাদের নিজ সাহিত্য অঙ্গনে সাহিত্য সমালোচনা বা সমালোচনা সাহিত্য ধারার কতখানি চর্চিত হয় ? আদৌ কি হয় ? কিম্বা চর্চা হোক, এটা কি আমরা চাই ? চাইলেও কিভাবে চাই ?
আদতে এই শিল্প সাহিত্যকে ঘিরে সমালোচকদের যে ব্যাখ্যান এবং মূল্যায়ন তাই হচ্ছে সমালোচনা সাহিত্য। এক্ষেত্রে অনেকেই সামালোচনা সাহিত্য প্রসঙ্গে আলোচনা করতে গিয়ে নানারকমের তত্ত্ব প্রয়োগ করে থাকেন। কেউ তাত্ত্বিক, কেউবা বিচার বিশ্লেষণাত্বক, কেউবা আবার এক্ষেত্রে প্লেটোনীয় আবার অনেকেই অ্যারিষ্টোটলীয় দর্শনের প্রয়োগ করেছেন। যে তত্ত্বই প্রয়োগ হোক না কেন, সেক্ষেত্রে যে সমালোচনা বেরিয়ে আসে তাই সমালোচনা সাহিত্য। ভ্রমর যেমন মধু আহরণে ছুটে আসে, তেমনি পাঠককূলও বিদগ্ধ সমালোচকদের মূল্যায়ণে মুগ্ধ হয়ে সমালোচিত শিল্প সাহিত্য কর্মটি সম্পর্কে জানতে আগ্রহী হয়ে ওঠে। সমালোচনা সাহিত্যের এমনই গুণ, টান এবং আকর্ষণ রয়েছে। যার ফলে শিল্পসাহিত্যের অঙ্গনে এই শাখাটির একটি অনস্বীকার্য প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।
তবে কিনা সমালোচনা শব্দটি শুনলেই কেমন যেন নেগেটিভ কিছু ভাবনার দ্যোতক মগজ থেকে মনে চলে আসে।
সেই সাথে প্রথমেই suggestive বা ইঙ্গিতপূর্ণ ভাবনারা খলবলিয়ে ওঠে। অনেকটা ব্যঙ্গবিদ্রুপ বা sarcasm মতো। যেমন, অমুক কবিতার বই করেছে, তমুক গল্প উপন্যাস লিখেছে এবং অনুবাদ করেছে ? ধ্যুত, না জানি কেমন হয়েছে ! হয়ত খাজা কিছু লিখেছে। তাছাড়া কি আর লিখবে, ওর পড়াশুনার দৌঁড় ত জানি ! তেমন উল্লেখযোগ্য কিছু নয়। ইত্যাদি ইত্যাদি নেগেটিভ কথা মনের ভেতর ঝেঁপে নেমে আসে। তখন অই কবিতার বইটি, গল্প বা উপন্যাসটি পাঠকের অনিচ্ছায় অনালোচিত ছায়াবৃত্তে ঢাকা পড়ে যায়।
কিন্তু যদি কেউ এই একই কবিতা, গল্প এবং উপন্যাস নিয়ে তার সমালোচনামূলক লেখাটিতে inspiring বা উদ্দীপক সৃষ্টি করতে পারে তাহলে কিন্তু অই গল্প, কবিতা অথবা উপন্যাসটি আলোর বৃত্তে চলে আসে। ভালো বা মন্দ সেটি পরের কথা। কিন্তু সাহিত্য নিয়ে প্রকৃত সমালোচনা হওয়া খুব প্রয়োজন। যে কোন সাহিত্যরচনা নানা দিক দিয়েই সমালোচিত হতে পারে। সমালোচকদের সে স্বাধীনতা রয়েছে। তাঁরা সাহিত্যের রূপ রস, দেহপট, নিম্নাঙ্গ, তলদেশ সবকিছু নিয়েই ব্যাখ্যা করে মূল্যায়ণ নির্ধারণ করতে পারে। এরফলে সাহিত্যের মূল্য, মান এবং গুরুত্ব বেড়ে যায়, তেমনি পাঠকের পাঠ ক্ষুধারও উন্মেষ ঘটে। কেউ কেউ তাত্ত্বিক অর্থে কোন লেখা বা রচনাকে ব্যাখ্যা করে তার মূল্যায়নকে তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে, নানা বিভাগ-বিন্যাসে বিভক্ত করে, তার কলা-কৌশল, মানসিক রুচি পছন্দ ইত্যাদি সম্পর্কে রায় দেয় তবে তো পাঠক উদ্দীপ্ত হবে। তারা আগ্রহী হয়ে উঠবে সেই লেখা বা রচনাটি পড়ার জন্য। এভাবেই কোন কবিতা, গদ্য, গল্প উপন্যাস ছড়িয়ে পড়ে পাঠক সমাজে। আর সমালোচনাটি হয়ে ওঠে সাহিত্য বা সাহিত্যের দিক নির্দেশক।
তাহলে কেমন হবেন সমালোচক ? প্রথমত, যিনি সমালোচনা করবেন তার নিরলস পাঠাভ্যাস থাকতে হবে। সমালোচক হিসেবে নিজেকে তৈরি করে নিতে হয় এই পাঠ অভ্যাস অর্জনের মাধ্যমে। এ ছাড়া সমালোচনার ক্ষেত্রে তাঁকে অর্থাৎ সমালোচককে হতে হবে নির্মোহ। সম্পূর্ণভাবে নিশ্ছিদ্র নিরপেক্ষতা অবলম্ব করতে হবে তাঁকে। সমালোচক হতে হবে নির্ভীক। পক্ষপাতশূন্য মাপক মন এবং মস্তিষ্ক নিয়ে তাকে ব্যাখ্যা করতে হয়, সমালোচনার জন্য নির্দিষ্ট লেখাটি বা রচনা কর্মটির গুণগত এবং বস্তুগত বিভিন্ন দিক সম্পর্কে।
আবার এমনও দেখা গেছে, কোন কোন সমালোচক তাঁর নিজস্ব অভিরুচি অনুযায়ী কোন লেখকের কোন বিশেষ লেখা বা রচনাকে ব্যক্তিগত পর্যালোচনার আলোকে সমালোচনা করে থাকে। এক্ষেত্রে সমালোচকের ব্যক্তিগত অনুভূতি, ব্যক্তিগতভাবে তার ভালো লাগা, মন্দ লাগা, উচ্ছ্রাস, বিলাপ, আফসোস, কল্পনা ইত্যাদির ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া বেরিয়ে আসতে পারে। হয়ত এগুলোকে প্রতীতিমূলক (impressionistic / creative criticism) সমালোচনা বলা হয়। যা আমরা হরহামেশা বন্ধুবান্ধব, আত্মীয় প্রিয়জনদের লেখা গল্প কবিতা উপন্যাস বা অন্য কোন রচনাকর্মের ক্ষেত্রে এ ধরণের সমালোচনা করে থাকি। এই একান্ত ব্যক্তিগত সমালোচনাগুলো আসলে ‘the adventure of soul among masterpiece’। আবার কোন কোন সমালোচক বিশ্লেষণাত্বক, ঐতিহাসিক, তূলনামূলক, সংরূপগত, মনোবৈজ্ঞানিক, সমাজতান্ত্রিক বা মার্ক্সীয় এবং আরও নানা তাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে সাহিত্যকর্মকে সমালোচনা করে থাকে।
কিন্তু সমালোচনা করে কি কোন লাভ হয় ? বা আদৌ কি কবি সাহিত্যিক উপন্যাসিকদের সাহিত্যকর্ম কীর্তি নিয়ে সমালোচকদের সমালোচনা ব্যক্তি, সমাজ বা রাষ্ট্রের কোন দরকারে আসে ?
আসলে গল্প, কবিতা উপন্যাস তো বাস্তব জীবনের প্রতিচ্ছায়া। সাহিত্যকে যদি আয়না বলে কল্পনা করে নিই তাহলে এই আয়নার দৈর্ঘ্য প্রস্থকে সুনিপুনভাবে গেঁথে রাখে যে দারুবৃক্ষ বা অন্য কোন কিছুর ফ্রেম বা বাঁধুনি সেটাই হচ্ছে সমালোচনা। কেবল সাহিত্যের মূল্য নির্ধারণে সমালোচনার গুরুত্ব রয়েছে সেটি একমাত্র সত্য নয়। সাহিত্যের শ্রী, সৌন্দর্য, তার পরিমিতি বোধের জ্ঞান এবং দক্ষতার জন্যেও সমালোচনার প্রয়োজন রয়েছে। এ কারণেই সমালোচনাকে একটি সৃষ্টিশীল শিল্পকর্ম বলা হয়। কাঁচা, বাঁধুনিহীন, নীরস, অবাস্তব কিম্বা উত্তাল আবেগের আতিশয্যে রচিত সাহিত্যকে একচ্ছত্র চর্চ্চায় রাখলে যে কোন দেশের সাহিত্য অঙ্গন ফাঁপা হয়ে পড়বে। চিরায়ত সাহিত্যকর্ম হিসেবে সে দেশে কোন সুস্থ, স্বাভাবিক শিল্প অনুরাগী সাংস্কৃতিক পরিবেশ গড়ে উঠবে না। পাঠক হয়ে পড়বে উদ্দীপনাহীন নির্জীব। সাহিত্য জগত হবে বন্ধ্যা, হাহুতাশনে পূর্ণ ধূ ধূ। যে যা লিখবে সেই মতো স্বেচ্ছাচারী শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতির মৌতাত গড়ে উঠবে। কবি, লেখক, গল্পকার, উপন্যাসিকদের কলমে নতুন পৃথিবীর নতুন ধারার প্রতিধ্বনি ধ্বনিত হবে না। সংস্কৃতির গতি হবে রুদ্ধ। তাই সমালোচনা সাহিত্যের গুরুত্ব রয়েছে বইকি ! মোট কথা, যে কোন পদ্ধতি অথবা তত্ত্বে হোক না কেন, সমালোচনা শিল্প সাহিত্যের মান উন্নয়ন, যুগ উপযোগী করার ক্ষেত্রে অত্যন্ত দরকারী ভূমিকা পালন করে।
কিন্তু সাহিত্য সমালোচনা কেমন হবে কিম্বা কেমন হলে সমালোচনাটি গুরুত্ববাহী হয়ে উঠবে ?
পরিচিত কেউ একজন বলেছিলেন, তিনি যখন কোন সাহিত্যকর্মকে সমালোচনা করতে বসেন, তখন হাতে ব্লেড তুলে নেন। সেই অদৃশ্য ব্লেডের ধারে তিনি পাতার পর পাতা, লাইনের পর লাইন, বাক্য, শব্দ, শব্দের ব্যবহার, প্রয়োগ ইত্যাদি কেটে কেটে দেখেন সাহিত্যকর্মটি আদতে শুদ্ধ হয়েছে কিনা। আবার কেউ কেউ জানান, সমালোচনা করলে বন্ধুত্বে ফাটল ধরে, সমালোচিত লেখক ক্ষুব্ধ হয়ে দূরে সরে যায় ইত্যাদি। অর্থাৎ অধিকাংশ লেখক, কবি, গদ্যকার বা উপন্যাসিক রচয়িতারা সমলোচনা নিতে পারেনা।
কথা হচ্ছে, সমালোচনা কি কোন খরশান অস্ত্র যার মাধ্যমে কোন সাহিত্যকর্মকে শুদ্ধতার দোহাই পেড়ে নিষ্ঠুর উল্লাসে জবাই করতে হবে ? নাকি সমালোচনা কোন বিষাক্ত উচ্চারণ যা দিয়ে গল্প উপন্যাস কবিতা লেখক বন্ধু্টিকে লজ্জা দিতে হবে ? কিম্বা তাকে দুর্বল বিব্রত করে নির্বাসন বেছে নিতে বাধ্য করা হবে ? অথবা লেখক স্বয়ং এবং তার অনুরাগীরা ক্ষিপ্ত হয়ে সেই সমালোচকের বিপক্ষে ঘোঁট পাকিয়ে কাদা ছুঁড়তে উদ্যত হবে ?
বাংলা সাহিত্যের ঘুঘুপ্রাণ জীবনানন্দ দাশ এর কথা মনে আছে ? জীবিত কালে কবির কবিতাগুলোকে কতভাবেই না তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে শ্বাসরোধ করে দেওয়া হয়েছিল তার কবিপ্রাণকে ! তিনি কেবলই আড়াল বেছে নিয়েছিলেন। নিভৃতিতে সরে গেছিলেন। আর আজ ? কবি জীবনানন্দ যেন আবছায়া আড়াল থেকে মনে করিয়ে দিচ্ছেন, সমালোচক কোন কসাই নন। তিনি নিন্দুকও হবেন না। তাঁকে মনে রাখতে হবে, বিশ্বসাহিত্যের অঙ্গনে সমালোচনা সাহিত্য একটি স্বীকৃত নন্দিত ধারা। তাই সমালোচক হবেন নিরপেক্ষ। তিনি তার স্বকৃত নিরপেক্ষ সমালোচনার মাধ্যমে যে কোন সাহিত্যকর্ম থেকে খুঁজে আনতে সচেষ্ট থাকবেন সাহিত্যের রূপ রস সুগন্ধকে। সেই কারণে সমালোচকের হৃদয়ে থাকবে উষ্ণতার উত্তাপ, কলমে জ্বলবে উৎসাহ দানের বরাভয়, হাসিতে ঝরবে স্নেহ পরিমল। ডুবুরীর অভিনিবেশে গভীরভাবে পর্যালোচনা করে সমালোচিত সাহিত্যকর্মটি থেকে আনন্দ খুঁজে পাঠককে জানানোর দায়দায়িত্ব একজন সৎ এবং আন্তরিক সমালোচকের উপরেই বর্তায়। তাছাড়া, গল্প কবিতা উপন্যাসে ভেসে ওঠা অতিরঞ্জিত আবেগ যেন বিষয়কে অতিক্রম করে না যায়, বাহুল্য বর্ণনা যেন পাঠককে বিরক্ত করে না তোলে, অতিভাষণ এবং অশোভনতা যেন সাহিত্যের স্বতঃস্ফূর্ত শালীনতাকে ব্যাহত না করে এসব নিয়ে আলোচনা করে বিদগ্ধ সমালোচকরা দেশের সাহিত্য অঙ্গনকে ফুল্লকুসুমিত করে তোলেন। এরফলে সাহিত্যের গ্রহণযোগ্যতা এবং সৌন্দর্য বেড়ে যায়। রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন তিনি, ‘সাহিত্যের সমালোচনাকে সাহিত্য করে তোলার পক্ষপাতী।’ (প্রবন্ধসমূহঃ বুদ্ধদেব বসু )
যেমন বুদ্ধদেব বসুসহ অনেক কবি এবং কবিতা প্রেমিকরা মনে করতেন, গদ্য হচ্ছে মেদচর্বি বিশিষ্ট স্থুল দেহধারী ধীরগতি সম্পন্ন সাহিত্য। অর্থাৎ কবিতার মতো গদ্যের ভ্রমণপাখা নেই। এক্ষেত্রে ব্যক্তিগতভাবে আমার মনে হয়েছে, গদ্য অত্যন্ত সবল, সর্পিল এবং সুমিত সাহিত্য। তবে এটাও ঠিক, অতিরঞ্জিত প্রভাবে দুষ্ট হলে গদ্য গুরুভার হয়ে ঝুলে পড়ে। পাঠক তখন বইতে পারে না। অতিভাষণে দীর্ঘ গদ্য অর্থাৎ গল্প, প্রবন্ধ, মুক্তগদ্য হলে পাঠক ক্লান্ত হয়ে বেশীক্ষণ নিতে পারে না। আবার গল্প, গদ্যে আমিত্ব বোধের প্রভাব যে কোন সাহিত্যকর্মকে স্বৈরাচারী করে ফেলে। পাঠকের চেতনালোকে ফুটে ওঠে বিরক্তির বুদ্‌বুদ। আবার সাহিত্যে মুখের ভাষা স্থান পেলেও তাতে থাকতে হবে শৃংখলা, ভারসাম্য, মাত্রা এবং ধ্বনিজ্ঞান। ভাষাকে কারুকার্যময় করে প্রয়োগ এবং ব্যবহার করলেই তাকে অসাধারণ করা যায় না।
সাম্প্রতিক বাংলা সাহিত্য নিয়ে অনেকেই হতাশা ব্যক্ত করছেন। তাদের মতে, বিশ্বের অন্যান্য দেশের সাহিত্য জগতের সঙ্গে মিল রেখে এদেশের শিল্প সাহিত্যে বহুত্ববাদের সংযোগ হয়েছে এটা ঠিক আছে। কিন্তু এর পাশাপাশি দেখা যাচ্ছে, সৃষ্টিশীলতার দিক দিয়ে সাহিত্য অধোগতিতে নেমে গেছে। ফলন প্রচুর, কিন্তু চিটা বেশি। পশ্চিমবঙ্গের বাংলা সাহিত্য অঙ্গনে কি হচ্ছে সে বিষয়ে না গিয়ে নিজের দেশ, বাংলাদেশের সাহিত্য নিয়ে যদি দেখি, তাহলে বলা চলে এই বক্তব্য সর্বাংশে ঠিক নয়। সাহিত্যচর্চার এক স্বতন্ত্র দিগন্ত ফুটে উঠেছে বাংলাদেশে। এটা ঠিক সত্তরের অর্থাৎ একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের কিছু আগেই এই স্বতন্ত্রতা ঘটে গেছে। কবিতায় এসেছে যাদু বাস্তবতা। প্রায় অস্তিত্বহীন ধানসিঁড়ি নদী, হিজলের ফুল, বটের পাতার সংগে মেঠো ইঁদুরের চোখে ধবল জ্যোৎস্নারা উড়ে বেড়াতে বেড়াতে বুকের ভেতর বিষের বালি কিম্বা আমারই আঙ্গুল যেন শহীদের অজস্র মিনার হয়ে —- বাংলাদেশের কাব্য সাহিত্যে এ এক অসাধারণ অর্জন। এভাবে গল্প উপন্যাসেও ফুটে উঠেছে যাদু বাস্তবতার প্রতিচ্ছবি। প্রতিদিনকার জীবন সংগ্রাম, আরাম আয়েস, রাষ্ট্র, রাষ্ট্রের চরিত্র, ক্ষমতার অপব্যবহার, মুক্তিযুদ্ধ, ইত্যাদি নিয়ে লেখা হয়েছে গল্প উপন্যাস। বাংলাদেশে এই পৃথক এবং স্বতন্ত্র সাহিত্য চর্চার ধারা গড়ে ওঠার পেছনে অবশ্যই কতগুলো কারণ আছে। সাতচল্লিশের দেশভাগের পরে সাত কোটি বাঙালীর মাতৃভাষার উপর অন্যায় আঘাত আসে। শাসকের মুখ বদলে যায় শোষকের চেহারায়। রুখে দাঁড়ায় বাঙালী। মৃত্যু সুনিশ্চিত জেনেও একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত পশ্চিম পাকিস্তানী শাসক এবং এদেশীয় চামচাদের বিরুদ্ধে বাঙালী লড়ে গেছে। এই লড়াই করার শক্তি, সাহস, দৃঢ়তা, রক্ত, মৃত্যু, যুদ্ধ বাঙালীর মননকে গড়ে দিয়েছে পৃথক পরিচয়ে। তাই পদ্মা, মেঘনা, যমুনার জলে সিক্ত বাঙালীর সাহিত্যে এসেছে আলাদা সুবাস, কথা, ভাব, রূপ, মাধুর্য। আশির দশকে এসে বাংলাদেশের সাহিত্য প্রদীপ্ত হয়ে ওঠে। সেই সঙ্গে শিল্প সাহিত্যের জগতে আসে মতবাদের দ্বন্দ্ব সংঘাত। সৃষ্টি হতে থাকে বিশাল মূল্যমানের একেকটি রচনাকর্ম। সাহিত্যের এক সোনালি গৌরবে বাঙালী ঋদ্ধ হতে থাকে। শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ, আহসান হাবীব, হুমায়ুন কবির, শহীদ কাদরী, সুফিয়া কামাল, হেলাল হাফিজ, দাউদ হায়দার, রফিক আজাদ, আবুল হাসান, নির্মলেন্দু গুণ, রুদ্র মোহাম্মাদ শহীদুল্লাহসহ আরও অনেকে সৃষ্টি করেছেন কবিতার পৃথক আশ্রম। তেমনি সৈয়দ মুজতবা আলী, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, মাহমুদল হাসান, শওকত আলী, শহীদুল্লাহ কায়সার, জহির রায়হান, হাসান আজিজুল হক, সৈয়দ শামসুল হক, রাবেয়া খাতুন, রাজিয়া খান, হুমায়ুন আহমদসহ কথা সাহিত্যিকরাও প্রতিষ্ঠিত করে গেছেন কথাসাহিত্যের এক মজবুত প্ল্যাটফরম। তবে এই মুহুর্তে একথা বলা যায়, বাংলাদেশের শিল্প সাহিত্যের সমালোচনার ক্ষেত্র সেভাবে নিবিড় এবং নিরপেক্ষ নয়। অন্তর্জাল উন্মুক্ত করে দিয়েছে লেখক এবং লেখক হতে প্রত্যাশী বহুজনের জন্য এক বিশাল বেহিসাবি খাতা। প্রকাশনা জগতে এসেছে সাহিত্য মূল্য রস রূপ বিবর্জিত একশ্রেণীর ব্যবসায়ী পুঁজিপতি। ছাপা হচ্ছে অসংখ্য গল্প কবিতা উপন্যাস। এগুলোর মান, গুণ নিয়ে ভাবিত নয় প্রকাশকরা। সাহিত্যিকদের নেই কোন পাঠক সম্মান। সাহিত্যিকরা কেউ অন্যের লেখা বই পড়ে না। প্রত্যেকেই স্বয়ম্ভু। আবার নিজ স্বার্থে দল চাটাবাজ হয়ে একে অন্যের পিঠ চুলকান। দু একটি ব্যতিক্রম ছাড়া পুরস্কারগুলোও নির্ধারিত হয়ে থাকে। এরা কেউ কোন বই নিয়ে নিরপেক্ষ সমালোচনা করে না। যা করে তা হয়, কেবলই স্তুতি অথবা নিন্দা।
প্রতি বছর একুশে বইমেলাকে সামনে রেখে প্রকাশিত হচ্ছে কয়েক হাজার গল্প উপন্যাস কবিতা বই। বাংলা সাহিত্যে জুড়ে যাচ্ছে মানহীনতা। এই মুহুর্তে এটি প্রতিরোধ করা একেবারেই অসম্ভব। কারণ প্রকাশনা ব্যবসা যেনতেন উপায়ে লাভ তুলে নিতে চাইছে। তারা শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতি নিয়ে ভাবিত নয়। এক্ষেত্রে সমালোচনা সাহিত্য বলে তেমন কিছুই গড়ে উঠেনি। অতিরিক্ত তোষামোদি, পিঠ চাপড়ানি, নইলে পুরীষ ভাষায় কোন লেখকের রচনাকর্মকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে পাঁকে ফেলে দেওয়ার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। আর যাই হোক, এগুলো সাহিত্য সমালোচনা নয়। এ কারণেই সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে সেভাবে সমালোচনা সাহিত্য গড়ে উঠেনি। উল্লেখ্য যে, বাংলা একাডেমিও সমালোচনা সাহিত্য নিয়ে বিশেষ কোন পদক্ষেপ নেয়নি। নেই কোন পুরস্কার এবং সম্মানীর ব্যবস্থা।
অর্থাৎ বাংলাদেশে সাহিত্য নিয়ে সেভাবে কোন সমালোচনা হয় না। ফলে সাহিত্য সমালোচনার শক্তিশালী ধারা, রীতি এবং প্রবাহ নেই বললেই চলে। যা চলছে তা হচ্ছে গুচ্ছের লাইক এবং লাভ সাইন। সেগুলোও আবার বিভিন্ন রকমের ইমোজির মাধ্যমে প্রকাশ পাচ্ছে। আর আছে কমেন্ট। যেমন, পছন্দের লেখকের বেলায় ভালো, খুব ভালো, অসাধারণ, ওয়াও, তুলনাহীন ইত্যাদি তেলবাজ শব্দের তেলেসমাতি। এমনকি লেখায় বানান ভুল, লেখকের নামের বানান ভুল হলেও দেখে না দেখার ভান করে এড়িয়ে যায়। অন্তর্জালে রাজত্ব করা অসংখ্য পত্রিকায় অসংখ্য লেখক প্রতি মুহুর্তে লিখে চলেছে। তাদের বইও প্রকাশিত হচ্ছে। অথচ, এদের মধ্য থেকে কোন লেখকের নিজস্ব স্বরভঙ্গি সৃষ্টি হয়েছে কিনা সেটি খুঁজে বের করার নেই কোন বিদগ্ধ সমালোচক।

********************************

রুখসানা কাজলঃ কথাসাহিত্যিক

********************************