You are currently viewing সমাধিপ্রস্তর/ কবীর রানা

সমাধিপ্রস্তর/ কবীর রানা

সমাধিপ্রস্তর

কবীর রানা

           একটা সূর্যোদয় যাচ্ছে সূর্যাস্তের সন্ধানে, একটা সূর্যাস্ত যাচ্ছে সূর্যোদয়ের সন্ধানে। তারা পরস্পরকে খুঁজে পাবার আগে যেটুকু সময়, সে সময়টুকুর মাঝে আবিষ্কার হয়ে যায় অর্থনীতি, রাজনীতি, ধর্মনীতি, সংসারনীতি, কোলাহলনীতি। এই কথা বলে একটা ব্যাঙ চলে যায় সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের বাইরে।

তার মৃত্যুর পর তার মৃত্যুর ভোজ উৎসবে যাই আমরা। সে আমাদের কে হয়। সে আমাদের একজনের বোন,যখন জীবিত। যখন মৃত সে, আমাদের একজনের, সব জনের উড়ে যাওয়া সম্পর্ক। তার উড়ে যাওয়ার ক্ষমতায় কারো বিশ্বাস ছিলো না। কারণ সে কখনো ওড়া শেখেনি। এই কথা কেউ একজন বলে, ওড়া জন্মগত ক্ষমতা। যে গ্রামে তার জন্ম, সে গ্রামে আমাদেরও জন্ম।  বই পড়তে পড়তে, বইয়ে নাম লিখতে লিখতে, তাকে পিছনে রেখে, গ্রামকে পিছনে রেখে, তার দূরত্বে, গ্রামের দূরত্বে চলে আসি। অনেক বছর পর, অনেক কথা ভুলে যাবার পর, তার মৃত্যুর ভোজ খেতে সে গ্রামে যাবার সময় হয়।

এই কথা এখানে স্মরণ করি, ব্যাখ্যা করি, মৃত্যুর ভোজ খাবার কথা। বিয়ের ভোজের দাওয়াতে এ গ্রামের সবাই আমন্ত্রিত না হলেও মৃত্যুর ভোজের দাওয়াতে এ গ্রামের সবাই আমন্ত্রিত হয়। কেউ মারা গেলে এ গ্রামের সবাই খরচ দিয়ে ভোজ উৎসব করে।

আমি, আমরা একবার স্মরণ করি গ্রামের নামটা। ধূলিরচর। একবার এ নাম উচ্চারিত হলে দেখি বিস্মৃতির সমাধি থেকে উঠে আসছে মা, মা আমার; বোন, বোন আমার ; বাবা, বাবা আমার। সমাধির প্রতিও মানুষের ভালোবাসা থাকে। সমাধিও টানে মেঘকে, বৃষ্টিকে। সমাধি দেখার জন্য, সমাধি আবিষ্কারের জন্য একবার ভ্রমণকারী হয় সে, একবার প্রত্নতাত্ত্বিক হয় সে, সে আমি। ধূলি থেকে ধূলি- প্রাচীন পুস্তকে লিখিত আমার, আমাদের জীবনী। ধূলির জীবনী দেখো শেষ হয় না। উড়তে থাকে অতীতে, বর্তমানে, ভবিষ্যতে।

সমাধির জন্য বিখ্যাত এ গ্রাম। এ গ্রামের মানুষদের গর্বের বিষয় সমাধি। প্রতিদিন সূর্যোদয়ের সময় এ গ্রামের মানুষ ঘর থেকে বের হবার আগে অপেক্ষা করে মাইকের ঘোষণা শোনার জন্য। গ্রামের কেউ বা কোনো জীবন মারা গেলে ঘোষিত হয় তার নাম মাইক দিয়ে। গ্রামের মাঝখানে একটা ঘর। তার চারপাশে মাইকের চারটা হর্ন। মৃত্যুর ঘোষণা দেবার জন্য চার ব্যক্তি সেখানে বসেন। তাদের কাছে খাতায় লিপিবদ্ধ থাকে মারা যাওয়া জীবনের নাম। এ জীবন শুধু মানুষের জীবন নয়। একটা কুকুর, একটা বিড়াল, একটা ষাঁড়, একটা ছাগল,একটা ঈগল- যারা ধূলির চরকে ভালোবেসেছিল, তাদেরও উল্লেখ থাকে সে খাতায়। সে খাতাকে এ সময় যদি কেউ বলে গ্রামের ইতিহাস, তবে তা ভুল বলবে না কেউ। ইতিহাস যদি সবচেয়ে বড় সমাধিক্ষেত্র তবে এ গ্রাম ঐতিহাসিক।

আমরা মরে গেলে আমি হই, আর আমি জীবিত হলে আমরা হই। মৃত আমি চলি একা একা, আমি হয়ে ; জীবিত আমি চলি সবার সাথে, আমরা হয়ে। যখন কথা হয় সব সময় জীবন ও মৃত্যু নিয়ে, তবে এ সময়, এ কথা, এ গ্রামের কথা, আমি বলি কখনো, আমরা বলি কখনো। গ্রামের পাশে যে নদী, কথার নদী, সে নদীতে আমি ভেসে যাই, আমরা ভেসে যাই। নদী শুকিয়ে গেলে আমি শুকিয়ে যাই, আমরা শুকিয়ে যাই। তবে ভেসে যাবার গল্প, শুকিয়ে যাবার গল্প, ভেসে যায় না শুকিয়ে যায় না। তা থাকে গ্রামের ধূলিতে ধূলিতে। প্রাচীন বেথেলহেমের পুস্তকে তো লিখিত আছে এ কথা-ধূলিরচর গ্রামের সকল কথা।

গ্রামে সব সময় হেঁটে ঢুকতে হলে, হেঁটে হেঁটে ঢুকে পড়েছি গ্রামে। পুনরায় ঢুকে পড়েছি গ্রামের গল্পে। গ্রামের গল্প থেকে বের হয়ে গিয়েছিলাম। একটা গল্প থেকে বের হয়ে পুনরায় প্রবেশ করা বেশ কঠিন মনে হয়। এবং ঠিক বুঝি না আদৌ তার ভেতরে প্রবেশ করতে পারবো কী-না।

যার মৃত্যুর ভোজ খেতে এসেছি তার সমাধিটা দেখা উচিৎ ভেবে যাই তার সমাধি দর্শনে। এতোদিন পর গ্রামে এসে মনে হয় গ্রামকে দেখার সাধ্য নাই আমার। কিভাবে গ্রাম দেখতে হয় ভুলে গেছি আমি। গ্রাম দেখার জন্য যেতে হয় কার পিছু পিছু। একটা মেঘের পিছু পিছু। মেঘ তো দূরে যায়, গ্রাম হারিয়ে যাবে। একটা ঝড়ের পিছু পিছু। ঝড় তো বাড়ি ভেঙ্গে দেয়, গ্রাম হারিয়ে যাবে। একজন গাইড হলে সত্যি ভালো হয় ভাবি। সে সময় চোখে পড়ে একজন বালককে। তার কাছে যাই। তাকে জিজ্ঞেস করি সে এ গ্রামের কী-না। সে ধূলার কথা বললে বুঝি সে এ গ্রামের। রাজি হয় সে গ্রাম দেখাতে। আমি তাকে বলি এ গ্রামের গল্পের সংগে আমি যুক্ত হতে চাই। সে রাজি হয় এ গ্রাম দেখাতে। তার সংগে একটা কুকুর। সে বলে সে একা এ গ্রাম চেনে না পুরোপুরি। তার কুকুর তার সংগে থাকলেই কেবল সে পুরোপুরি চেনে এ গ্রামকে। সে আরো বলে তার কুকুর এ গ্রামকে তার চেয়ে বেশি জানে, বেশি চেনে। আমার এ সময় মনে হয় একজন বালক ও তার কুকুর সবচেয়ে ভালো জানে কিভাবে একটা গ্রাম আবিষ্কার করতে হয়।

বালক ও তার কুকুরের পিছে পিছে হাঁটতে থাকি আমি। আমি এ গ্রামে কী দেখতে চাই, কী জানতে চাই, গ্রামের গল্পের কোথায় প্রবেশ করতে চাই, থাকতে চাই, কী ভূমিকায়। জানি না। আমি তো এসেছি বোনের মৃত্যুর ভোজ খেতে। এখন চাচ্ছি ভোজ খাবার পূর্বে তার সমাধিটা দেখতে।

একটা গাছের কাছে দাঁড়াই। তার ছায়া ছোট। গ্রামের কী-ই-বা ধারণ করতে পারে সে। গ্রামের কতোটুকু জীবন, কতোটুকু মৃত্যু, কতোটুকু পাখি, কতোটুকু উড়াল, কতোটুকু সমাধি সে ধারণ করতে পারে। গাছটার ডালে একটা পাখির বাসা। বালকটি আমাকে পাখির বাসার কথা বলে। আমি জানিনা পাখি ও পাখির বাসা দেখার সম্পূর্ণ কৌশল। আমি গাছটাকে ধাক্কা দিই। পাখি নাই। শুধুই বাসা। বাসাটার খড়গুলো এলোমেলো। বাসাটায় কী আছে তা ভালোভাবে দেখার জন্য গাছটাকে আবারো ধাক্কা দিই। সেখানে একটা ডিম ছিলো। ডিমটা বাসা থেকে পড়ে যায় মাটিতে। ভাঙা ডিম মাটির উপর। বালকটি বলে গ্রাম দেখা কিংবা কোনো কিছু দেখা শুরু করতে হয় ডিম দেখা দিয়ে। সে আরো বলে ডিম দেখার কৌশল না জানলে গ্রাম দেখা যায় না ভালো করে। আমার এ সময় এ আগ্রহ জন্মে, পাখিটা এখন কোথায়, যে ডিমটাকে একলা রেখে গিয়েছিলো তার এলোমেলো বাসায়।

বালকটির পিছে পিছে হাঁটতে হাঁটতে তাকে বলি আমি বোনের সমাধি দেখতে চাই, যার মৃত্যু ভোজ আজ। সে আমাকে জিজ্ঞেস করে বোনের নাম, মৃত্যুর তারিখ। আমি তো বোনের নাম জানি না। মৃত্যুর তারিখ জানিনা। সে আমার বোন কী-না তাও জানিনা। শুধু জানি এ গ্রামে আমার জন্ম হয়েছিলো। এ গ্রাম থেকে হাঁটতে হাঁটতে, বইয়ের ভেতর দিয়ে শহরে গিয়েছিলাম। সেখানে থেকে জানতাম গ্রামের মৃত্যুর ইতিহাস, সমাধির ইতিহাস। কে কে মারা যাচ্ছে, কী কী মারা যাচ্ছে। তারপর বোনের মৃত্যুর খবর জানা হয়। বোনের মৃত্যুর ভোজ উৎসবের দাওয়াত পাই।

বালকটিকে বলি সে আমাকে গ্রামের সমাধিগুলোর কাছে নিয়ে যাক। সে সকল সমাধিতে মৃত ব্যক্তিদের নাম নিশ্চয় লিপিবদ্ধ আছে। বালকটি বলে প্রতিটা সমাধির কাছে একটা করে পাথর আছে। যে পাথরে মৃত ব্যক্তির নাম, জন্ম, মৃত্যুর উল্লেখ আছে। উৎকীর্ণ আছে দুই লাইনের কবিতা। বালকটি আরো বলে সমাধিগুলো দেখার আগে গ্রামের পাশে যে বিল, তার দিকে তাকান। আমি কতোটুকু তাকাতে পারি। চশমা যতোটুকু নিয়ে যায় চোখকে, ততোটুকু। কিংবা পাঠ্যপুস্তক যতটুকু নিয়ে যায় চোখকে, ততটুকু। বিলের কাছে আসি। বিলের ভেতর সামান্য জল। জল ঘিরে কয়েকটা বক। তাদের ওড়াউড়ি। বকগুলো যেনো বিলের পাহারাদার। বালকটি বলে বিলটা আমি ঠিকমতো দেখতে পেয়েছি কী-না। আমি হ্যাঁ বললে, সে জিজ্ঞেস করে কী দেখতে পেয়েছি আমি। আমি তাকে বলি, সামান্য জল, আর কয়েকটা বক, বকের ওড়াউড়ি। সে বলে আমি যেনো আরেকটু থামি, আরেকটু দেখি। থামি। আরেকটু দেখি। একটু থামার পর দেখি আমার দেখা বদলে গেছে। সামান্য জলটুকু অসামান্য হয়। আমার দেখা সকল জল জমা আছে এ বিলে। আমি তো কখনো আমার জল পাহারা দিই নাই। এই বকগুলো আমার জল পাহারা দিচ্ছে। এই বকগুলোকে এ সময় আমার বোন মনে হয়। আমার বোন যদি বক তবে বকেদের নিকট যাবার জন্য আমার উড়াল হতে ইচ্ছা করে।

বালকটি বলে এই বিলটুকুর জল বেঁচে আছে এই বকগুলোর জন্য। বেঁচে থাকার কাছে যাবার জন্য আমি জলটুকুর কাছে যেতে চাই। জলটুকুর কাছে যাই। আমি জলে নামি, বালকটি জলে নামে, বালকটির কুকুরটি জলে নামে। জলে নেমে জলটুকুকেও বোন মনে হয়। যাকে আমি ভুলতে পেরেছি নানাভাবে। ঐটুকু জলে বালকটি গোসল করে, কুকুরটি গোসল করে। পোশাক ভিজে যাবার ভয়ে আমি গোসল করি না। যদিও আমার আছে অসংখ্য পোশাক। জল থেকে উঠে এসে আবার বিলের পাড়ে দাঁড়াই। সেখানে একটা পাথর। আমি পাথরটাকে ভালো করে দেখার চেষ্টা করি। তার উপরে কিছু লেখা আছে কী-না তা দেখার চেষ্টা করি। পাথর পড়া শিখেছিলাম কী কখনো, মনে পড়ে না। আমি বোঝার চেষ্টা করি এ পাথরে এ বিলের নাম, এ বিলের জন্ম তারিখ, এ বিলের মৃত্যু তারিখ লেখা আছে কী না। কিছুই বুঝতে না পারলে আমার মনে এই প্রশ্ন জাগে, আমি কী আমার গ্রামের বর্ণমালা ভুলে গেছি। সে সময় স্মরণে আনি আমার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের স্মৃতি। স্লেটের কথা মনে আসে, যে পাথরের স্লেটে লিখতাম তার কথা। সে স্লেট কী এখন বড় হয়ে নানা রকম সমাধিপ্রস্তর হয়েছে। যদি এ প্রস্তরে কিছুই লেখা না থাকে তবে আমি পেনসিল চাই এ প্রস্তরে কিছু লেখার জন্য। কিন্তু কী লিখবো আমি।

বালকটিকে জিজ্ঞেস করি বিলের পাড়ে এ পাথর কেনো। সে জানায় এ পাথরে লেখা আছে এ বিলের জীবনী। আমি তাকে বলি আমি তো পড়তে পারছিনা এ প্রস্তরলিপি। সে হাসে। সে উত্তর দেয় না। সে এগিয়ে যায়। তার পিছে পিছে তার কুকুর ও আমি এগিয়ে যাই।

বিলের কাছেই মাঠ। আমরা মাঠের ভেতর চলে আসি। মাঠের মাঝে এতো কিছু যে, বুঝিনা কী দেখবো এ মাঠের। মাঠে শস্যের আলো। শস্যের আলো তোমাকে দেখি। তুমি আমাকে দেখো। তারপর শস্যের আলোর সাথে কতো রকম শস্য আমার শরীরের কাছে এসে বলে, আমি তাদের, আমার মাংশ তাদের। তারা আমাকে দাঁড় করিয়ে রেখে কোথাও যায়। আমার সে সময় মনে হয় তারা পাথর আনতে গেছে। আমার পাশে সমাধিপ্রস্তর বসিয়ে লিখে দিবে আমার জীবনী। আমার পাশে সমাধিপ্রস্তর বসিয়ে দিলে আমি কীভাবে ফিরে যাবো আমার বিদ্যালয়ে, আমার বিশ^বিদ্যালয়ে।

আমি বালকটিকে বলি মাঠ দেখা হয়ে গেছে। বালকটি হাসে। হাসতে হাসতে বলে এ মাঠ অনিঃশেষ। এ মাঠ দেখে শেষ করা যায় না। এ গ্রামের যারা সমাধিতে আছে তারা এখনো দেখছে এ মাঠ। আর যারা সমাধির বাইরে আছে এখনো তারা তো দেখছেই এ মাঠ। আমি তাকে জিজ্ঞেস করি কীভাবে দেখতে হয় এ মাঠ। সে বলে যেভাবে সূর্যোদয় হয়, চন্দ্রোদয় হয়, সেভাবে, ধ্যান করতে করতে, প্রার্থনা করতে করতে।

আমি কিছুই বলি না। বালকটি আর তার কুকুরটিকে আমি অনুসরণ করি। তারা আমাকে নিয়ে যায় এ গ্রামের প্রার্থনা গৃহের নিকটে। বালকটি একটা গৃহ দেখিয়ে জানায় সেটি এ গ্রামের সবচেয়ে বড় ও প্রাচীন প্রার্থনাগৃহ। বালকটি আমাকে জানায় প্রার্থনাগৃহে আছে এ গ্রামের সবচেয়ে বড় পাথর। আমি পাথরটিকে ভালোভাবে দেখার জন্য, বোঝার জন্য সেটির নিকটে যাই। পাথর পাঠ আমার ভালো জানা নাই, প্রার্থনা পাঠ আমার ভালো জানা নাই, ধ্যান পাঠ আমার ভালো জানা নাই। এ পাথরের সামনে দাঁড়িয়ে তবে কী দেখি আমি। এ পাথরখন্ড এ সময় আয়না হয়ে যায়। পাথরটির সামনে দাঁড়িয়ে পেয়ে যায় আয়না-পথ। আমি বালকটিকে, কুকুরটিকে দাঁড় করিয়ে রেখে পাথর-পথ, আয়না-পথের মাঝ দিয়ে যাত্রা শুরু করি। যেতে যেতে পাহাড়- পাথরের পাহাড়। যেতে যেতে পাহাড়- আয়নার পাহাড়। পাহাড় থেকে নামি। যেতে যেতে বন। বনে প্রবেশ করি। বন থেকে বেরিয়ে আসি। যেতে যেতে কী আমার বোন ? বোনের ছায়া ? বোনের সমাধি ? আমি সে ছায়ার ভেতর, সে সমাধির ভেতর প্রবেশ করতে পারি না। ফিরে আসি। ফিরে এসে দেখি বালকটি ও কুকুরটি আমার জন্য অপেক্ষা করছে।

বালকটিকে বলি কী লেখা আছে এ পাথরে। সে বলে এ গ্রামের প্রথম প্রার্থনা। আমি বলি এ গ্রামের প্রথম প্রার্থনা কী? সে বলে আকাশের দিকে তাকাও। আকাশের দিকে তাকাই। মেঘও ছিলো তবে আমাদের মাথার উপরে। আকাশ থেকে মেঘটুকু আমাদের আরো নিকটবর্তী হতে চাইলে ছোটো ছোটো বৃষ্টি ফোঁটা। বৃষ্টি আমার শরীরে আসে। আমার শরীর কী পাথর। আমি ভিজতে চাই অথচ ভিজতে পারছি না। ভিজতে না পারলে আকাশ থেকে চোখ নামাই। বৃষ্টি থেমে যায়।

বালকটি ও তার কুকুরটিকে অনুসরণ না করে পারছি না আমি। আমার স্মৃতির একটা পাতা উল্টে যায়, দু’টো পাতা উল্টে যায়। আমার মনে হয়, আমিও বালক ছিলাম। আমারও কুকুর ছিলো। আমার সাথে সাথে, আমার পিছে পিছে একটা কুকুর ঘুরে বেড়াতো। আমি বালকটির দিকে, কুকুরটির দিকে ভালো করে তাকাই। বালকটির সংগে আমার শরীরের, চেহারার সাদৃশ্য খুঁজে পাবার চেষ্টা করি। এই চেষ্টা ব্যর্থ হয়। অত:পর এই কুকুরটির সংগে আমার বাল্যকালের কুকুরটির সাদৃশ্য খোঁজার চেষ্টা করি। সেটিও ব্যর্থ হয়। আমি আসলে আয়নার সামনে না দাঁড়ালে জানবো না আমার চেহারা কেমন। আমি এখন আমার চেহারা স্মরণ করতে পারছি না। আমার বাল্যকালের কুকুরটির চেহারাও স্মরণ করতে পারছিনা। আমার একজন বোন ছিলো যে আমার চেহারা সবচেয়ে ভালো জানতো। সে ছিলো আমার সত্যিকারের আয়না। তার কাছে পৌঁছুতে পারলে এই বালকটির সংগে আমার, আর এই কুকুরটির সংগে আমার কুকুরটির মিল-অমিল জানা যেতো। কিন্তুু আমি তো তার মৃত্যুর ভোজ খেতে এসেছি।

একটা খেলার মাঠের কাছে আসি আমরা। মাঠে কেউ নাই। বালকটি বলে এখানে কিছুক্ষণ থাকা যায়। সে জিজ্ঞেস করে এ মাঠ দেখতে কেমন। আমি মাঠের ভেতর কী সন্ধান করবো। খেলা সন্ধান করা যায়। খেলার সন্ধানে কীভাবে যাওয়া যায়। আমি মাঠটির এক কোনায় যাই। বসি ঘাসের উপর। বালকটি এ সময় কুকুরটির সংগে দৌড়ালে একটা খেলা তৈরি হয়। কী নাম এ খেলার। বালক-কুকুর খেলা। এই খেলা ভালো লাগে আমার। একবার পিছনে তাকিয়ে দেখি একটা ফুটবল। ছেঁড়া ফুটবল। কারা ফেলে গেছে কতো আগে। আমি বিষন্ন হই ছেঁড়া ফুটবল দেখে। বিষন্নতা ভালো না লাগলে বালকটিকে ডাকি। সে আর কুকুরটি আসে। বালকটি জিজ্ঞেস করে মাঠটিকে আমি ঠিক মতো দেখেছি কী-না। আমি হ্যাঁ বলি। সে জিজ্ঞেস করে আমি এ মাঠের সমাধিচিহ্ন, সমাধিপ্রস্তর দেখেছি কি না। আমি বলি কোথায় সেটা। সে ছেঁড়া বলটিকে সরিয়ে দেয়। একটা পাথর পোঁতা সেখানে। আমাকে বালকটি জানায় এ পাথর খেলার ও খেলার মাঠের সমাধিচিহ্ন। পাথরটির আরেকটু নিকটবর্তী হই। কী লেখা আছে তাতে। পড়তে পারি না। বালকটি বলে হাততালি হোক। আমি হাততালি দিই, হাততালি হই। হাততালি কী খেলাকে জীবিত করে, খেলার মাঠকে জীবিত করে কিংবা মাঠ ও খেলার বন্ধু হাততালি। তারপরও আমি পড়তে পারিনা এ পাথর লিপি।

আমি বালকটিকে বলি, যে মৃত -বোনের ভোজ উৎসবে ভোজ খেতে এসেছি তার সমাধিটা দেখতে চাই। সে আমাকে নিয়ে যায় গ্রামের মাঝখানে অবস্থিত সেই ঘরটার নিকটে যেখানে লিপিবদ্ধ হয় সকল মৃতদের নাম।

মৃতদের নাম লেখকদের চারজনের একজন আমাকে জিজ্ঞেস করে মৃত বোনের নাম এবং তার মারা যাবার তারিখ। আমি তাকে একটা নাম বলি। একটা তারিখ বলি। ভুল নাম, ভুল তারিখ। কারণ সে সময় তার নাম ও মৃত্যুর তারিখ আমার স্মরণ ছিলোনা। নাম লেখক আমাকে গ্রামের সমাধি খননকারীদের নিকটে যেতে বলে। হয়তো তাদের নিকট থেকে মৃত বোনের সমাধির সন্ধান পাওয়া যাবে।

বালকটি আর তার কুকুরের পিছে পিছে হাঁটতে থাকি। সমাধি খননকারীদের একজনের বাড়ি আসি আমরা। তাকে জিজ্ঞেস করি আজ যে মৃত ব্যক্তির ভোজ উৎসব হচ্ছে তার সমাধিটা কোথায়। সে মৃত ব্যক্তির চেহারার বর্ণনা জানতে চায়। তাকে না উত্তর দিয়ে নিরাশ করি। সে হাসে। সমাধি খননের সময় যতোটুকু হাসি দেয়া যায় ততোটুকু হাসি। তার সাথে আমার কিছুক্ষণ গল্প করতে ইচ্ছা করে। তাকে জিজ্ঞেস করি মৃত্যু ও সমাধি খনন বিষয়ে তার ধারণার কথা। সে কথা বলে। তার কথার বেশিরভাগই বুঝিনা। এলোমেলো তার কথাসমূহ। কিংবা আমার শোনাটা এলোমেলো। সে বলে এ গ্রামের সকল কিছুর ভ্রমণ-যাত্রা আছে। এ ভ্রমণ-যাত্রা অসুখের দিকে। এ গ্রামটা ভেসে আছে নৌকার উপর। নৌকাটা সব কিছু নিয়ে ভেসে যাচ্ছে  অসুখের দিকে। অসুখ থেকে উদ্ধার পাবার জন্য কতো যে চেষ্টা। ফুল ফোটানোর চেষ্টা, ফুল ছেঁড়ার চেষ্টা। অন্ধকার হওয়ার চেষ্টা, আলো হওয়ার চেষ্টা, প্রজাপতি হওয়ার চেষ্টা, জোনাকি হওয়ার চেষ্টা। এ সময় তার স্ত্রী এসে জিজ্ঞেস করে আজ কী বার। এই প্রশ্নে নিভে যায় সে, নিভে যায় তার মুখের মোমবাতি।

বালকটি কতো কিছু যে জানে, কতো কিছু যে চেনে তার ইয়ত্তা নাই। সে জানায় এ গ্রামে কোনো সমাধিক্ষেত্র নাই। এ গ্রামের কেউ মারা গেলে তাকে সমাধিস্থ করা হয় তার বাড়ির প্রবেশ পথে। তাহলে কথা এরকম যে এ গ্রামের সকল সমাধি রাস্তার নীচে। তার এই তথ্য আমার কাছে অবিশ্বাস্য মনে হয়। এ কথা কেমন যে এ গ্রামের মানুষেরা মৃত্যুর পর নিজেদের সমাধি চায় নিজেদের হাঁটা পথের নীচে। তারা চায় যেনো তাদের বুকের উপর দিয়ে জীবিত ব্যক্তিরা হেঁটে যায়। জীবিত ব্যক্তিদের সংগে তাদের একটা যোগাযোগ থাক মারা যাবার পরেও।

বালকটির কথা শোনার পর আমি রাস্তাগুলোকে পর্যবেক্ষণ করি আরো ভালোভোবে। এখন রাস্তাগুলোকে রাস্তা না মনে হয়ে সমাধিক্ষেত্র বলে মনে হয়। রাস্তাগুলোর কিছুদূর পরপর পাথর বসানো। মৃত ব্যক্তির সমাধিপ্রস্তর এ সব। আরেকবার মনে হয় সবগুলো রাস্তা মৃত ব্যক্তিদের সমাধিচিহ্ন সমাধিপ্রস্তর দ্বারা তৈরি। পৃথিবীর সকল রাস্তার নিচে আছে তবে সমাধি।

বালকটি বলে এ গ্রাম সমাধির জন্য বিখ্যাত। আমার এ সময় বিখ্যাত নানা সমাধির কথা মনে পড়ে। জন্মদিন উদযাপনের সময় ফুলের সমাধি, পাখি উড়ে গেলে ছায়ার সমাধি, দিন নিভে গেলে আলোর সমাধি, শিশু বড় হয়ে গেলে কান্নার সমাধি।

সমাধিচিহ্ন দেখতে দেখতে পৌঁছে যাই মৃত বোনের ভোজ রান্না হচ্ছে যেখানে, সেখানে। বারোজন রাঁধুনি ব্যস্ত রান্না করতে। তাদেরকে দেখে সে সময় লিওনার্দো দ্যা ভিি র দ্যা লাস্ট সাপার ছবিটার কথা মনে হয়। বারোজন রাঁধুনী ব্যস্ত আমার মৃত বোনের ভোজের রান্নায়। তারা জানায় তারা বারোজন এ গ্রামের মৃত ব্যক্তিদের ভোজ উৎসবে রান্না করে সব সময়। এ রান্নার কৌশল আলাদা, স্বাদও আলাদা। বাড়ির রান্নার সংগে এ রান্না মেলে না। তারা এ রান্না শিখেছে তাদের পূর্বপুরুষদের নিকট থেকে। তারা এ রান্না  শিখিয়ে যাবে পরবর্তী প্রজন্মকে। সারাদিন এ রান্না হয় আর সূর্যাস্তের পর পরিবেশন করা হয় তা খাওয়ার জন্য। খাবার সময় সবার হাতে থাকে প্রদীপ। খাবার পর প্রদীপ নিভিয়ে দিয়ে প্রার্থনা করা হয়।

তাদের কথা যখন শেষ হয় তখন সন্ধ্যা। আমি খেয়াল করি বালকটি ও তার কুকুরটি তখন সেখানে নাই, আমি তাদেরকে কীভাবে খোঁজ করি। কোন পথে আছে তারা জানিনা।

খাবার দেয়া শুরু হয়েছে। সবাই হাতে প্রদীপ নিয়ে খেতে এসেছে। এক হাতে খাবারের থালা আরেক হাতে প্রদীপ নিয়ে তারা খেতে বসেছে। আমি কীভাবে খেতে বসি যখন আমার হাতে প্রদীপ নাই। হঠাৎ এ সময় চোখে পড়ে সেই বালকটি ও তার কুকুরটি। বালকটির হাতে প্রদীপ। আমাকে সে প্রদীপটি দেয় যেন আমি খাবার নিয়ে খেতে পারি। আমি খাবার পরিবেশনকারীদের নিকট থেকে প্রদীপ দেখিয়ে খাবারের থালা গ্রহণ করি।

খাবার শেষ হলে সবগুলো প্রদীপ নিভে যায় কিংবা নিভিয়ে দেয়া হয়। আমি কোথায়। বালকটি ও কুকুরটি তখন আমার পাশে। বালকটি কথা বলে ফিসফিস করে, প্রদীপ নিভে যাবার শব্দের মতো, আপনার বোনের সমাধি পাওয়া গেছে।

প্রদীপ নিভে যাবার পর যতোটুকু আলো জীবিত থাকে আমি সে আলোটুকু ধরে ধরে অনুসরণ করতে থাকি বালকটিকে ও তার কুকুরটিকে, যারা আমাকে নিয়ে যাবে বোনের সমাধির কাছে, তার সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের কাছে।