You are currently viewing সমকাম/  রুখসানা কাজল

সমকাম/ রুখসানা কাজল

সমকাম

রুখসানা কাজল

শীত বিকেলটি চেপে বসছে বুকের ভেতর।

সন্ধ্যামণি ফুলের ঝোপে বিনবিন সুরে পাক খাচ্ছে মশাদল। একটি লম্বা পাটখড়ি হাতে অনির্দেশ্য চোখে তাই দেখছে রুমকি। বেগুনি হলুদ ম্যাজেন্টা লাল ফুলগুলো তারার চোখে চেয়ে আছে। ওর বুকের ভেতর হাজারটি মায়া পাখি ডানা ঝাপ্টে ঢুকে পড়ে। কি সুন্দর দৃশ্য। বড় চেনা। আপন আপন  লাগছে মনের ভেতর। কত কত বছর পর সে ফিরে এসেছে !

রমজান ডাক দেয়, ও ফুফু এহেনে কহন আসিছেন ?

ছেলেটির বয়েস  মাত্র পনের কিম্বা ষোল । ওর ছেলের অনেক ছোট। সেভেন পর্যন্ত পড়েছে। ইশকুল ড্রপ আউট । এই বাড়ির গরু ছাগল দেখাশোনার সাথে এটা সেটা খুচরো কাজ করে দেয় । এগিয়ে আসে রুমকি, তুই নৌকা বাইতে পারিস ?

তালশাঁসের মত সাদা দাঁত বের করে হাসে রমজান,কোহানে যাবেন ফুফু ? আসেন নিয়ে যাই।

এক কোষা নৌকা ধীরে ধীরে বেয়ে যায় রমজান।  রুমকি দেখে খালের পাড় ঘেঁষে দাঁড়ানো সেই তিনটি তালগাছ । বুড়ো হয়ে গেছে। তার পাশ দিয়ে এক চিলতে মাটির রাস্তা উঠে গেছে সাদা উঠোনের একটি উঁচু ভিটেতে। বাড়িটার কোণাকুণি উঠোন দেখা যাচ্ছে।

— কার ভিটে জানিস ?

–বালাম পালের ভিটে ছেলো। এহন নাই।

— নাই মানে? ইন্ডিয়া চলে গেছে?

– না হেরা ত ঢাহা থাহে। চৈতন কাহা থাহে এহানে। তয় হাঁড়িকুঁড়ি আর  বানায় না। ছিটকাপুড়ের দোহান দেছে বাজারে।

রুমকির মনে পড়ে পালবাড়ির একটি  ছেলেকে সে চিনত। রামুদাদা। পর পর দুবার অংকে টপার হয়ে চমকে  দিয়েছিল সবাইকে।  মডেল ইশকুলের শিক্ষকরা তাকে ফ্রি কোচিং দিয়ে এসএসসি তে ভাল রেজাল্ট  করানোর জন্যে খুব খেটেছিল। সেই রামুদা নিচু ক্লাশের ছেলেমেয়েদের অংক দেখিয়ে দিত। কালো ঝিকঝিকে রঙ । সরু সরু হাত পা। রুমকি খুব ভোগাত। অংক নিয়ে চরম বিরক্ত ছিল সে । সাড়ে, পাঁচ সিকা,  দশমিক, ভগ্নাংশ, হাতে রাখা অংকের প্যাচ ও কোনো দিন বুঝত না।

রামুদাদা খুব চেষ্টা করত। বলত, মনে কর তোর বাবা একটা ওষুধ দুই টাকা দশ পয়সায় বিক্রি করে। ওষুধটার আসল দাম দুই টাকা।  তাহলে এক ডজনে কত লাভ করবে তোর বাবা ?

রুমকি  কিছুক্ষণ ভেবে দশ পয়সার ঘাপলা মেটাতে না পেরে বলে দিত,সে আমি কি জানি ! তুই কম্পাউন্ডার কাকুকে জিগ্যেস করে জেনে নিস রামুদাদা। হাসির ধুম পড়ে যেত ক্লাশে। রামুদাদা করুণ মুখ করে বলত, পড়াশুনা করতি হলি প্রার্থনা করতি হয় তা বুঝিস! তুই  অংকে খুব ফাঁকিবাজ হয়েছিস রুমকি।

একদিন কোচিংএ গিয়ে শোনে রামুদাদা চলে গেছে যাত্রার দলে। পড়াশুনা করবে না। রামুদার এক মামা যাত্রাদলে হারমোনিয়াম বাজিয়ে গান গায়।  ভাল বেতন।  খাওয়া থাকা ফ্রী। সেই নিয়ে গেছে। খবরটি জানতেই ছুটে গেছিল অংকের দুই  স্যার। রামুর মা মাটির চুলোয় ধিকি ধিকি জ্বলা আগুনের দিকে তাকিয়ে স্যারদের বলেছিল, প্যাডে ভাত নাই । বচ্ছরের আধেক সুমায় খাতি পাই না জানেন তো মাস্টারমশাই । লেহাপড়া করি  কবে কি হবিনি তার জন্যি তো এতগুলান প্যাড বসি থাকপে নানে।

আজাহার স্যার আর  দিলীপ স্যার ছিলেন শহরের  শ্রেষ্ঠ অংক শিক্ষক। যে কোন  ছাত্রকে তারা পড়াতেন না। অনেক অনুরোধ করলে তবে তারা অঙ্কে  মিনিমাম ষাট পাওয়া ছাত্রকে টিউশন দিতেন। চুলোর ধার ঘেঁষে কতগুলো ক্ষুধার্ত অসহায় মুখ দেখে মাথা নিচু করে স্যাররা সেদিন ফিরে এসেছিলেন।  কেউ কারো দিকে না তাকিয়ে বুঝেছিলেন বইয়ের অঙ্ক ছাড়াও অঙ্ক আছে। তার নাম জীবন অঙ্ক।সেই অঙ্ক মেলানোর সহজ সূত্র আজ পর্যন্ত কেউ বের করতে পারেনি।

রমজানকে পালবাড়ির ঘাটে থামতে বলে রুমকি, চল তো ঘুরে আসি। কত বছর এরকম ঘরবাড়ি দেখি না।

তাল গাছে নৌকা বেঁধে রমজান আগে আগে হেঁটে  উঠোনে পা দিয়েই হাঁক পাড়ে, ও কাকী কোহানে আছ বারুয়ে আসো দেহি। তুমাগের বাড়িতে কিডা আইছে দেহসেন।

কিছুক্ষণের ভেতর বাড়ির উঠোনে ছোটখাট ভিড় জমে যায়। প্লাস্টিকের একটি পরিষ্কার চেয়ার নিয়ে আসে কেউ। তারপর অবাক হয়ে জানতে চায়, কিডা গো? হেলতের নতুন আপা নিহি ?

রমজান পরিচয় করিয়ে দেয়, আরে না কাকি! অই যে বুড়ো ডাক্তারদাদুর মাইয়ে । আমিরিকায় থাহে  হেই জন।

একজন নীল পাড় সাদা  শাড়ি পরা রুগ্ন মহিলা এসে রুমকির হাত ধরে , চিনতে পাতিছিস ? কিলাশ এইট, রোল  বাহান্ন। শুচিস্মিতা পাল !

চমকে উঠে রুমকি। তার স্মৃতি খুব জাগ্রত । এই বুড়ি মত মহিলা তার ক্লাশমেট ছিল ? শুচিস্মিতা পাল। ওহো সূচি !অঙ্কে টপার ছিল। কেউ ওকে হারাতে পারেনি কোনোদিন ।  খুব ভাল লাগে রুমকির।শুচিস্মিতার শুকনো খালি হাত ধরে বোকার মত বলে বসে, কেমন আছ সূচি ?  রামুদাদার কি খবর ?  কোথায় সে ?

রুমকির হাত বুলিয়ে আদর করতে করতে শুচিস্মিতা জানায়, সে অনেক গল্প রে।  কত বছর পরে আসলি নিজের গ্রামে কতি পারিস? এই দ্যাখ আমার ছেলের বউ, কোলের এইটা আমার নাতি।

ঢিপ করে প্রণাম করতে যায় বউমা।  কোলের বাচ্চাটিকে টেনে নেয় রুমকি। বাচ্চাটি একটু অবাক হলেও কাঁদে না। বউমা ছুটেছে রান্নাঘরে। আদরঘন এই পরিবেশে  খুব সুখী  সুখী লাগে  রুমকির।  এই সাততাল্লিশে  শুচিস্মিতা দাদি আর  সে কেবল একটি তেইশ বছরের ছেলের মা। তার যখন নাতি হবে সে কি তাকে দেখতে পাবে? কোলে নিয়ে এমন বেড়াল আদরে ভরে নিতে পারবে বুকের জমিন? বাস্তবে কি  কখনো তার কোনো নাতি হবে? তার ছেলেটি কি ফিরে আসবে নর্মাল পুরুষ জীবনে ?

মরিচ জবা গাছের পাশ ধরে হাঁটতে হাঁটতে শুচিস্মিতা গল্প করে রামুদাদার। যাত্রার দলে ভালই ছিল । গান শিখেছিল। হারমোনিয়মে যে কোন হিন্দি গান তুলে  নিতে পারত। গ্রাম গঞ্জের মানুষ হিন্দি গান খুব ভালবাসে। দাদার দাম বাড়ছিল দলে। বছরে একবার আসত গ্রামে। সূচি তখন ছেলে কোলেবিধবা হয়ে বাবার বাড়ি ফিরে এসেছে।  রামু শুচিস্মিতাকে বলেছিল,  কিছু কাজ শিখি নে।  সারা জীবন হাতির উপর হাত রাখি চালাবি কেমনি ক ত ?  শুচিস্মিতা ধাত্রীর কাজ শিখে  নিয়েছিল ।  নামও হয়েছে একটু আধটু। এমন সময় এক বিকেলে রামুদাদা একজন সুন্দরী মহিলাকে নিয়ে হাসপাতেলে আসে। যাত্রা দলের মালিকের  রক্ষিতা সোহিনী । সূচিকে ডেকে বলেছিল, যে করে হোক খালাস করে দে বুন্ডি। ও আমাদের নায়িকা। এই মরসুমে কিছুতেই ওর ছেলে বিয়ানো চলবে না।

সোহিনী  শবনম এইট পর্যন্ত পড়েছিল। অংকে মাথা ছিল দারুণ। রামু আর শবনম অবসরে অংক করত । যাত্রাপালার মালিক থেকে সকলের প্রথমে সন্দেহ হলেও পরে অবাক মেনেছিল সবাই । কেবলই অংকের সম্পর্ক। আর কিছু না ! সেই সময় খুব সুখে ছিল রামু। কাঁধ পর্যন্ত বাবরি চুল। নিয়মিত খেয়ে পরে সুন্দর নরম চেহারা হয়েছিল। ভারী ভাল লাগত দেখতে। কিন্তু এর দু বছর পরেই রামুর লাশ পাওয়া যায় মিউজিশিয়ানদের তাবুতে। পুলিশ আর যাত্রাপালার কেউ কেউ বলে আত্মহত্যা। আবার অনেকেই বলে খুন।

যাত্রাদলের মালিক এসেছিল সাহায্য নিয়ে। সূচিকে গোপনে ডেকে বলেছিল, শোন আমারে সন্দেহ করি কোন লাভ হবি নানে। খুন করলি অনেক আগিই করতি পারতাম। আমার লুম্বাও তোরা  ধরতি পারতি না। তোগের মা কালির কিরে শবনমের সাথি রামুর অতিরিক্ত ভাব দেখি খুনের ইচ্ছাও হইছিল। পরে জানলাম রামু নারীসঙ্গ পছন্দ করত না। শালা পুরুষ ভালবাসত। পুরুষের সাথি শুতি আরাম পাতো। ওরে খুন করি  কি সুখ আমার ক দেহি !

শুচিস্মিতা পরম যত্নে চায়ের কাপ তুলে দিয়ে নিচু গলায় জানায়, রামুদাদা মরি যাবার দু মাস পরি যাত্রাদলের বাঁশিওয়ালা হুমদো শামসু আত্মহত্যা করে। বুঝলি এবার!

রুমকি বুঝে গেছিল। ছেলে রাতুল যখন তার লেবানিজ বন্ধু  রাকিবকে বিয়ে করে  চলে যায় ওর মাথায়  বাজ  ভেঙ্গে পড়েছিল। কি করে সে বলবে তার ছেলে সমকামী ? পরিবার সমাজ সংসারের কোনকিছুরই ধার ধারেনি ওরা। ভেঙ্গে পড়েছিল রুমকি। তখন মনে হয়েছিল, মরে যাক রাতুল। আবার কখনো কখনো নিজেও সুইসাইড করার কথা ভেবেছে। আমেরিকায় থাকলেও সেখানেও তো বাঙালি আছে, সমাজ আছে। তারা ফিসফাস থেকে ক্রমশ সরাসরি কথা শুনাতে শুরু করেছিল ঠারে ঠারে। রাকিবের বাবা মা এসেছিল। তারাই অনেকটা সাহায্য করেছে রুমকিকে। দুঃখ দু’ পরিবারেই সমানভাবে বেজেছে। কিন্তু মেনে নেওয়া ছাড়া উপায় কি !

মনকে সান্ত্বনা দিতেই বহুবছর পরে দেশে এসেছে সে। মনের ভেতর দ্বন্দ্ব ছিল হয়ত একা মা হিসেবে সে রাতুলকে ভাল শিক্ষা দিতে পারেনি। ওখানকার অনেকেও তাই বলেছিল। রাতুলের বাবা থাকলে নাকি এরকম হতে পারত না ছেলে। আবার ভাবছিল, এই দেশে থাকলে হয়ত রাতুল এরকম হত না!  ভাবছিল দেশে থাকলে আত্মীয় স্বজনের সাথে থাকলে রাতুল গে হতে পারত না। কিন্তু এখন রামুদাদার জীবন রুমকির সব ভাবনাকে চুরমার করে দিয়েছে। মনে হচ্ছে মৃত্যুর চেয়ে  ভয়ংকর আর কি আছে এই জীবনে ?

রামুদাদা এই সমাজে নিজের মত বাঁচতে পারেনি তাই নিজেকে মেরে নিঃশেষ করে দিয়েছে। কিন্তু তার ছেলে পেরেছে। হোক সে সমকামি। রুমকির এবার যথেষ্ট হালকা লাগে। নাতির মুখ নাইবা দেখলো সে। তার ছেলেটি তবু বেঁচে থাকুক।