You are currently viewing সদরঘাট থেকে হুলারহাট, নদীপথে নৈশযাত্রা ||  মনিজা রহমান

সদরঘাট থেকে হুলারহাট, নদীপথে নৈশযাত্রা || মনিজা রহমান

সদরঘাট থেকে হুলারহাট, নদীপথে নৈশযাত্রা

মনিজা রহমান

আমরা ছিলাম সদরঘাটের বাঙাল। থাকতাম পুরান ঢাকায়, দাদার বাড়ি ছিল বরিশাল। সদরঘাট ছিল আমাদের দুই ঠিকানার সঞ্চিস্থল। সন্ধ্যায় ব্যাগ ব্যাগেজ আর টিফিন ক্যারিয়ারে ভাত-তরকারী নিয়ে আমরা সদরঘাট থেকে রওনা দিতাম লঞ্চে। পরদিন দুপুরে হুলারহাটে গিয়ে পৌঁছাতো লঞ্চ। তারপর রিক্সায় বলেশ্বর নদীর তীরে পিরোজপুর শহর। যেন এক স্বপ্নযাত্রা। নদীপথে নৈশযাত্রার সেই আনন্দের তুলনা খুঁজে পাইনি আর কোথাও।

‘যেন সেই ছেঁড়াখোড়া স্বপ্ন আমি,

যে বহু আগে ডুবে গেছে বুড়িগঙ্গা

কিংবা বলেশ্বরের অতলে

জীবন উল্টে গেলেও ফিরতে চাই না

মাঝনদীতে

তবু মাঝরাতে ঘুমের ভিতর তাকেই দেখি।’

পুরনো ঢাকার নিম্নবিত্ত জীবনে আসলে তেমন কোন চাকচিক্য ছিল না যার টানে ফিরতে চাইবো শৈশবে। ক্রীড়া সংগঠক বাবা সব সময় গলা শুকাতেন। সবচেয়ে পছন্দের গান ছিল তাঁর, ‘বড় বড় খাসি/ খাইতে ভালোবাসি/ পয়সা নাইতো করব কি?’ টাকা পয়সা হবে কিভাবে? সেটা অর্জনের কোন চেষ্টা ওনার ছিল না। খেলতে নামার আগে নিজের নামের আগে ‘পরাজিত’ তকমা লাগিয়ে রাখতে ভালোবাসতেন।

রোজার ঈদে কিংবা কোরবানী ঈদে আব্বা আমাদের ভাইবোনদের জন্য কেনাকাটা করতেন সদরঘাট মার্কটে। বাসায় যে গৃহকর্মী থাকতো সেই মেয়েটিসহ আমাদের জন্য একই ধরনের জামা কেনা হতো। আমাদের মন পড়ে থাকতো নিউমার্কেটে। আমরা চাইতাম সেখান থেকে মিডি বা স্কার্ট কিনতে। আর এলিফ্যান্ট রোড থেকে জুতা। নব্বই দশকের সেই সময়ে ওই দুই মার্কেট সবচেয়ে নামকরা ছিল। আমাদের ইচ্ছা পূর্ণ হত না। সদরঘাট মার্কেট থেকে জামা আর গুলিস্তান থেকে জুতা কিনতো আব্বা!

কৈশোরে সেই অপূর্ণ ইচ্ছাগুলি পূর্ণ করি মধ্যবয়সে নিউইয়র্কে এসে। মিডি বা স্কার্ট না কিনতে পারার আক্ষেপ মেটাই চল্লিশোর্ধ বয়সে এসে। সদরঘাট টার্মিনালটা খুব পছন্দের হলেও মার্কেটটি যে কারণে আজীবন আমার চক্ষুশুল ছিল। সদরঘাট নাম শুনলে সুখস্মৃতির পাশাপাশি আক্ষেপ মিশ্রিত কষ্টের স্মৃতিও মনে পড়ে যায়।গেন্ডারিয়ায় আমাদের প্রতিবেশীদের অনেকের অবশ্য দোকান ছিল ওখানে। যে কারণে আলগা খাতির পাওয়া যেত। যেটা আব্বার খুব পছন্দ ছিল। নিউমার্কেটে গেলে সেটা মিলতো না।

শৈশবে সদরঘাট থেকে আমরা যে লঞ্চে দাদারবাড়ি যেতাম, কেবিনে যাওয়া হতো না কখনও। কেবিন ভাড়া করার মতো সামর্থ্য আব্বার ছিল না। তবে যখন কৈশোরে পদার্পণ করলাম, একটা সিঙ্গল কেবিন নেয়া হতো! হয়তো আমরা বড় হয়ে গেছি বা বড় হয়ে যাচ্ছি, এই কথা ভেবে এমনটা করা হতো। আব্বা অবশ্য ডেকে শুয়ে যেতেন। সারাজীবন কৃচ্ছ্রতাসাধন করা বাবা আমার!

তখন  সদরঘাট থেকে যারা লঞ্চের ডেকে যেতেন, সকালে গিয়ে জায়গা রেখে আসতেন। পুরনো শাড়ি কিংবা বিছানার চাদর দিয়ে ডেকে একটা নির্দিষ্ট জায়গা ঘেরাও করে রাখা হতো। যাত্রী দলে মহিলা ও শিশু সন্তানরা থাকলে এটা অবশ্যই করা হত।

সন্ধ্যায় যখন লঞ্চ ছাড়তো, চারদিকে গমগমে একটা ব্যাপার ঘটতো। একটার পর একটা লঞ্চ টার্মিনাল থেকে ছেড়ে যাবার শব্দ, লঞ্চের কর্মচারী আর ফেরীওয়ালাদের হাঁকডাক, হুইসেলের শব্দ, নদীর গন্ধ, তীরের বাতাস, ঘাটের দুলুনি- যেন এখনও চোখ বুজলে সেই সময়টার গন্ধ-শব্দ-স্বাদ সব অনুভব করতে পারি।

সদরঘাট দিয়ে দাদার বাড়ি যাবার সময়টুকু যেমন আনন্দের ছিল, ফেরার সময় ছিল তেমন বিষাদের। স্কুলের বার্ষিক পরীক্ষা শেষে আমরা দাদারবাড়ি যেতাম। পড়াশুনা নেই, নেই কোন নিয়মকানুনের বালাই, আনন্দ আর আনন্দ! পুরান ঢাকার অখ্যাত এই আমি দাদারবাড়ির শহরে গিয়ে হয়ে যেতাম যেন এক কেউকেটা। আমার দাদাজান ধনীব্যাক্তি হওয়ায় পুরো শহরে আমাদের বংশের মানুষদের দাপট ছিল তখন ভীষণ। এ নিয়ে খুব অহংকার ছিল সবার। বিষয়টা আমাকেও সংক্রমিত করতো। ‘সরদার বাড়ির মেয়ে’ বলে কথা! এমনটাই বোঝাতো চাচাতো ভাইবোনরা। এত বছর পরে এসে কেমন যেন হাস্যকর লাগে সেই দম্ভ প্রদর্শনকে।

আমি আসলে ছিলাম- ‘এম কাকার মেয়ে’। আব্বার নামের প্রথম অক্ষর এম হওয়াতে চাচাতো ভাইবোনরাসহ আশেপাশে অনেকে ওনাকে ডাকতো ‘এম কাকা’। আমি ছিলাম এম কাকার বড় মেয়ে। অনেক সময় আম্মা ও অন্য ভাইবোনদের ছাড়া আব্বার সঙ্গে দাদারবাড়ি যেতাম। চাচাতো বোন পুতুল ছিল আমার সার্বক্ষনিক সঙ্গী। তখন পথে যেতে অনেকে বরিশালের ভাষায় জানতে চাইতো, ‘এ পুতুল, তোর লগে এডা কেডারে?’ পুতুল উত্তর দিতো- ‘এম কাকার মেয়ে!’

স্মৃতির জানালা দিয়ে যতদূর দেখতে পাই, সদরঘাট থেকে লঞ্চে চড়ার সবচেয়ে পুরনো স্মৃতি, যেবার দাদাজান মারা গিয়েছিলেন। আমার দাদাজান হাজী আবদুর রহমান সর্দার ৯৭ বছর বয়সে যখন ইন্তেকাল করেন, তখন জ্যৈষ্ঠ  অর্থাৎ বা এপ্রিল-মে মাস ছিল। আগেই বলেছি, আমরা দাদার বাড়ি যেতাম ডিসেম্বর-জানুয়ারি মাসে যখন ঝড়বৃষ্টি তেমন হত না। কারণ আম্মা ছিলেন প্রচন্ড ভীতু। আম্মার জন্য আমরা সব সময় বড় স্টিমারে, যেমন গাজি রকেটে দাদার বাড়ি যেতাম।

সেবার আমরা গেলাম ঝড়ের মৌসুমে। আর কি আশ্চর্য্য ওই রাতে প্রচন্ড ঝড় উঠেছিল মাঝনদীতে। বহু লঞ্চ ডুবি হয়েছিল সেদিন রাতে। এখনও মনে আছে, স্টিমারের চারদিকে কান্নার রোল। আম্মার ভয়ে নীলবর্ণ চেহারা। জোরে জোরে অনেকে আজান দিচ্ছিলেন। গাজী রকেটের দড়িদড়া সব ছিড়ে যাচ্ছিল ঝড়ের বেগে। নাম ছিল গাজী, তাই হয়তেদা সেবার আমরা জীবন নিয়ে যেতে পেরেছিলাম!

সদরঘাট থেকে যারা লঞ্চে চড়ে তাদের জন্য ঝড়-কুয়াশা কোন ব্যাপারই না! যেমন আমার মামাদের দেখতাম, তারা তাড়াতাড়ি যাবার জন্য যে কোন ছোট লঞ্চে চড়ে বসতেন। লঞ্চ ডুবে গেলে সাঁতরে তীরে চলে যাওয়ার জন্য  মানসিক প্রস্তুতি তাদের থাকতো। আমার দাদারবাড়িতেও অনেকে এমন সাহসী ছিলেন। শুধু আমার আব্বা-আম্মা ছিলেন জম্মের ভীতু আর সহজ সরল।

জমমের একটা বরিশালের শব্দ, যার মানে খুব বা অনেক। আমার আব্বা-আম্মার প্রথম সন্তানও ছিল জমমের সরল। ‍তাইতো এই মধ্যবয়সে ভিনদেশে এসে অচেনা কফিশপে বসে ‘সদরঘাট’ এর কাহিনী লেখে। লেখে আর চোখের পানিতে ভাসে।

===================