You are currently viewing সংহতি: বাংলার মেহনতী মানুষের প্রথম পত্রিকা > এম এ আজিজ মিয়া

সংহতি: বাংলার মেহনতী মানুষের প্রথম পত্রিকা > এম এ আজিজ মিয়া

সংহতি: বাংলার মেহনতী মানুষের প্রথম পত্রিকা

এম এ আজিজ মিয়া

১৯২৩ সাল।
বাংলা সাময়িকপত্রের ইতিহাসে একটি স্মরণীয় বছর। এ বছরে ছয়টি পত্রিকা প্রকাশিত হয়েছিল। তারমধ্যে সাপ্তাহিক জনসেবক, সম্পাদক- শোলেশ নাথ বিশি; সাপ্তাহিক সোনার বাংলা, সম্পাদক- শ্যামসুন্দর চক্রবর্তী, বিপিনচন্দ্র পাল ও গোপালচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়; মাসিক কল্লোল, সম্পাদক- দীনেশরঞ্জন দাশ; মাসিক সংহতি, সম্পাদক- জ্ঞানাঞ্জন পাল ও মুরালীধর বসু; মাসিক তরুণ, সম্পাদক- সুকুমার দত্ত ও হীরালাল দাশগুপ্ত এবং দ্বিমাসিক সোনার ভারত, সম্পাদক- মোহাম্মদ জোবেদ আলী। অবশ্য বঙ্গীয় কৃষক ও শ্রমিক দলের মুখপত্র ‘লাঙল’ প্রকাশিত হয়েছিলো ১৯২৫ সালে এবং তার সম্পাদক ছিলেন বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম। এদের মধ্যে দুটি পত্রিকা বিষয় বৈচিত্র্য, প্রকারপ্রকরণ ও বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। কল্লোল ও সংহতি সম্পর্কে বিশিষ্ট সাহিত্যিক ও কল্লোলের কথাকার অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত লিখেছেন:
“একদিকে ‘কল্লোল’, আরেক দিকে ‘সংহতি’।
ভাবতে আশ্চর্য লাগে, দুটি মাসিক পত্রই একই বছরে একই মাসে এক সঙ্গে জন্ম নেয়। ১৩৩০, বৈশাখ। ‘কল্লোল’ চলে প্রায় সাত বছর আর সংহতি উঠে যায় দু’বছর না পুরতেই।
‘কল্লোল’ বলতেই বুঝতে পারি সেটা কি। উদ্ধৃত যৌবনের ফেনিল উদ্দামতা সমস্ত বাধা-বন্ধনের বিরুদ্ধে নির্ধারিত বিদ্রোহ, স্থবির সমাজের পচা ভিত্তিকে উৎখাত করার আলোড়ন। কিন্তু ‘সংহতি’ কি? সংহতি তো শিলীভ‚ত শক্তি। সংঘ, সমূহ, গণগোষ্ঠী। যে গুণের জন্যে সহধর্মী পরমাণুসমূহ জমাট বাঁধে। তাই তো সংহতি, আশ্চর্য নাম। আশ্চর্য সেই নামের তাৎপর্য!
একদিকে বেগ, আরেক দিকে বল। একদিকে ভাঙ্গন, আরেক দিকে সংগঠন, একত্রীকরণ।
আজকের দিনে অনেকেই হয়তো জানেন না, সেই ‘সংহতি’ই বাংলাদেশে শ্রমজীবীদের প্রথমতম মুখপত্র, প্রথমতম মাসিক পত্রিকা। সেই ক্ষীণকায়, স্বল্পায়ু কাগজটিই গণজয়যাত্রার প্রথম মশালদার। ‘লাঙল’, ‘গণবাণী’ ও ‘গণশক্তি’-তো এসেছিল অনেক পরে। ‘সংহতি’ই অগ্রনায়ক।”২
সেকালে এমন একটি উদ্যোগ নিয়েছিলেন কোলকাতার প্রেস-শ্রমিক ইউনিয়নের একজন উদ্যেক্তা অমৃতবাজার পত্রিকার প্রেস-কর্মচারী শ্রীজিতেন্দ্রনাথ গুপ্ত। তাঁর উদ্যোগ-আয়োজন সম্পর্কেও অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত সুন্দর সুললিত ভাষায় লিখেছেন:
“এ কাগজের পিছনে প্রথম একজনের পরিকল্পনা ছিল তাঁর নাম বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে উজ্জ্বল অক্ষরে লিখে রাখা উচিত। তিনি জিতেন্দ্রনাথ গুপ্ত। আসলে তিনি এ কাগজের প্রতিষ্ঠাতা। অমৃতবাজার পত্রিকার ছাপাখানায় কাজ করেন। ঢোকেন ছেলে বয়সে, বেরিয়ে আসেন পঞ্চাশ না পেরোতেই, জরাজর্জর দেহ নিয়ে। দীর্ঘকাল বিষাক্ত টাইপ আর কদর্য কালি ঘেঁটে ঘেঁটে কঠিন ব্যাধির কবলে পড়েন। কিন্তু তাতেও মন্দা পড়েনি তাঁর উদ্যাম-উৎসাহে, মুছে যায়নি তাঁর ভাবীকালের স্বপ্নদৃষ্টি।”৩

এই জীতেন্দ্রনাথ গুপ্ত একদিন তাঁর স্বপ্ন পূরণের আশা নিয়ে পরামর্শ করার জন্য সেকালের বিখ্যাত জাতীয়তাবাদী নেতা শ্রী বিপিনচন্দ্র পালের (১৫৮৫-১৯৩২) বাড়িতে গিয়েছিলেন। তাঁর ছোট ছেলে জ্ঞানাঞ্জন পাল (১৮৯৬-১৯৭৯) ছিলেন জীতেন বাবুর পূর্বপরিচিত। কিছুকাল আগে থেকেই লেখালেখি ও বক্তৃতা-বিবৃতিতে বিপিন পাল মহাশয় ধনী-গরীব সমস্যা নিয়ে আলোচনা করে চলেছিলেন। তাছাড়া প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হলে যুদ্ধবিরোধী একটি আন্তর্জাতিক গোষ্ঠী ‘ক্লার্তে’-এর পক্ষ থেকে ১৫-দফা সম্বলিত একটি আন্তর্জাতিক ইশতেহার প্রকাশ করেছিলেন অ্যাঁরি বারবুস। তাতে বিশ্ববরেণ্য কবি, সাহিত্যিক ও শিল্পীদের সঙ্গে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথেরও স্বাক্ষর ছিল। ১৯১৯ সালের ১২ ডিসেম্বর কোলকাতার কলেজ স্কয়ারে অনুষ্ঠিত এক সভায় ভাষণদানকালে ইশতেহারটি দফাওয়ারি উল্লেখ করেন শ্রী পাল মহাশয়। জীতেনবাবু বললেন তাঁর স্বপ্নের কথা। প্রেস-শ্রমিক কর্মচারীরা তাঁকে কথা দিয়েছেন পত্রিকার গ্রাহক করে দিবেন এবং বিজ্ঞাপনের ব্যবস্থা করে দিবেন। খুশি হয়ে শ্রদ্ধেয় পাল মহাশয় বলেছিলেন আর দেরি নয়। তিনি পত্রিকার ব্যাপারে সর্বোতভাবে সহযোগিতা ও সাহায্য করবেন বলে আশ্বস্ত করলেন। তিনিই পত্রিকাটির নামকরণ প্রস্তাব করলেন ‘সংহতি’ এবং সম্পাদক হিসেবে নিজের ছেলে জ্ঞানাঞ্জন পাল ও মুরলীধর বসুর কথা বললেন। কার্যালয়ের ব্যাপারে জিতেন গুপ্ত তাঁর নিজের বাসা ১ নম্বর শ্রীকৃষ্ণ লেন, বাগবাজার-এর কথা বললেন। ত্যাগ স্বীকার করা আর কাকে বলে! অচিন্ত্যকুমার সেন লিখেছেন:
“সেটা আমারই বাসা। একতলায় দেড়খানা ঘরের একখানি।
সেই একতলায় দেড়খানা ঘরের এককানিতে ‘সংহতি’র অফিস বসল। দক্ষিণে চাপা গলি রাস্তার দিকে উত্তরমুখো লম্বাটে ঘর। আলো-বাতাসের সংস্পর্শে নেই। এক পাশে একটি ভাঙ্গা আলমারি, আরেক পাশে একখানি ন্যাড়া তক্তপোশ। টেবিল চেয়ার তো দূরের কথা, তক্তপোশের উপর একখানা মাদুর পর্যন্ত নেই। শুধু কি দরিদ্রতা? সেই সঙ্গে আছে কালাঙ্কক ব্যাধি। তার উপর সদ্য স্ত্রী হারিয়েছেন। তবু পিছু হটবার লোক নন জিতেনবাবু। ঐ তক্তপোশের উপর রাতে ছেলেকে নিয়ে শোন, আর দিনের বেলা কাশি ও হাঁপানির ফাঁকে ‘সংহতি’র স্বপ্ন দেখেন।
সম্পাদকের সঙ্গে রোজ তাঁর দেখাও হয় না। তাঁরা লেখার জোটপাট করেন ভবানীপুরে বসে, প্রুফ দেখেন ছাপাখানায় গিয়ে। কিন্তু ছুটির দিন আপিসে এসে হাজিরা দেন। সেদিন জিতেনবাবু অনুভব করেন তাঁর রথের রশিতে টান আছে। মুঠো থেকে খসে পড়েনি আলগা হয়ে। অস্বাস্থ্যকে অস্বীকার করেই আনন্দে ও আতিথেয়তায় উজ্জ্বল হয়ে ওঠেন। আসে চা, আসে পরোটা, আসে জলখাবার। আপত্তি শোনবার লোক নন জিতেনবাবু।৫
১৩৩০ সালের বৈশাখ মাসে ‘সংহতি’র প্রথম বর্ষ প্রথম সংখ্যা বেরোল। প্রথম লেখাটিই ছিল কবি কামিনী রায়ের কবিতা ‘নিদ্রিত দেবতা জাগো’। তাছাড়া বিপিনচন্দ্র পাল ও পাঁচ কড়ি বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রবন্ধ ছিল। জ্ঞানাঞ্জন পাল লিখেছিলেন সংহতি’র আদর্শ নিয়ে। তার কপি পাঠানো হয় আচার্য ব্রজেন্দ্রনাথ শীল (১৮৬৪-১৯৩৮) ও বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে (১৮৬১-১৯৪১)। আচার্য শীল মহাশয় আশীর্বাণী পাঠালে তা সংহতি’তে ছাপা হয়। আর রবীন্দ্রনাথতো পাঠিয়ে দিয়েছিলেন একটি প্রবন্ধ। তা জ্যৈষ্ঠ সংখ্যায় ছাপা হয়। নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্যের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি ‘দিন মজুর’ নামে গল্প পাঠিয়ে দিলেন। কিন্তু আরোতো লেখা চাই। প্রমেন্দ্র মিত্র, শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়, বীরেন্দ্র গঙ্গোপাধ্যায়সহ আরো অনেকের সঙ্গে। শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায় ‘বাঙ্গালী ভাইয়া’ নামে উপন্যাসের অংশ পাঠালেন তা সংহতিতে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হতে শুরু করে। তা পরে ‘মাটির ঘর’ নামে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। লেখকদের সঙ্গে যোগাযোগের ব্যাপারে একটি সুন্দর বর্ণনা দিয়েছেন অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত। তিনি লিখেছেন:
“এদিকে মুরলীধর প্রেমেনকে হাতড়ে বেড়াচ্ছেন আর প্রেমেন তাঁর বাড়ির দরজা থেকে নিরাশ মুখে ফিরে যাচ্ছে। কিন্তু ফিরবে কোথায়?… কিন্তু আমাদের তিনজনের পথ যেন সেদিন শেষ হতে চায় না। একবার শৈলজার মেস শাখারীপাড়া রোড, পরে প্রেমেনের মেস গোবিন্দ ঘোষল লেন, শেষে আমার বাসা বেলতলা রোড… বারে বারে ঘোরাফিরা করতে লাগলাম। যেন এক দেশ থেকে পথিক একই তীর্থে এসে মিলেছি। বিকেলে আবার দেখা। বিকেলে আর আমরা ‘আপনি’ নেই, ‘তুমি’ হয়ে গিয়েছি। শৈলজা তাঁর গল্প বলা শুরু করল।১
তাছাড়া দুই বন্ধু জ্ঞানাঞ্জন পাল আর মুরলীধর বসু গিয়েছিলেন শিবপুরে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের (১৮৭৬-১৯৩৮) বাড়িতে। কিন্তু সে বাড়ির কুকুর ভেলির তাড়া৮ খেয়ে ভিতরে ঢুকতেই পারেনি। এমনি নানা অভিজ্ঞতা ও টানাপোড়নের মধ্যদিয়ে দু’বছর না কাটতেই ‘সংহতি’র প্রকাশনা থেমে যায়।

জ্ঞানাঞ্জন পাল
সম্পাদক, মাসিক সংহতি

বিশিষ্ট সাংবাদিক ও লেখক জ্ঞানাঞ্জন পাল (১৮৯৬-১৯৭৯) ১৮৯০ সালে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা বিশিষ্ট জাতীয়তাবাদী নেতা ও বাগ্মী শ্রী বিপিনচন্দ্র পাল। জ্ঞানাঞ্জন পাল কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাস বিষয়ে এম.এ পাশ করেন। প্রথম জীবনে পিতার সাহিত্য ও সাংবাদিকতার কাজে প্রধান সহযোগী হিসেবে কাজ করেন। তিনি ‘বেঙ্গলী’ ও ‘অমৃত বাজার’-এর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তাছাড়া ‘পল্লীস্বরাজ’, ‘ন্যাশনাল রিকসস্ট্রাকশন’ ও ‘মাসিক সংহতি’ পত্রিকা সম্পাদনা করেছেন। ‘সংহতি’র আদর্শ নিয়ে প্রথম বর্ষের প্রথম সংখ্যার লেখাটি তিনিই লিখেছিলেন। শেষ জীবনে তিনি পিতার গ্রন্থাবলী প্রকাশ ও প্রচারের কাজে আত্মনিয়োগ করেছিলেন। ১৯১৯ সালের ১২ ডিসেম্বর তাঁর পিতা কোলকাতার কলেজ স্কয়ারে এক সমাবেশে ‘ক্লার্তে’ গ্রুপের ১৫-দফা দাবীর ইশতেহারটি দফাওয়ারি আলোচনা করেছিলেন সেটি জ্ঞানাঞ্জন পালের মাধ্যমেই পেয়েছিলেন ‘প্রতিরোধ প্রতিদিন’ সংকলন গ্রন্থের প্রকাশক এবং তা ১৯৭৫ সালে প্রকাশ করেছিলেন।
শ্রী জ্ঞানাঞ্জন পাল বিভিন্ন সামাজিক কর্মকান্ডের সঙ্গেও জড়িত ছিলেন। ভারত-সভা হল ও ফেডারেশন হল-এর সঙ্গে তাঁর সম্পৃক্ততা ছিল। ‘দি ইংলিশম্যান’ পত্রিকার সম্পাদকমন্ডলীতেও তিনি কিছুদিন ছিলেন। তাঁর বেশ কিছু গ্রন্থও প্রকাশিত হয়েছে। তারমধ্যে ‘স্টাডিজ ইন বেঙ্গলি রেঁনেসান্স’ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
জ্ঞানাঞ্জন ছিলেন বন্ধু বাৎসল্য। শত কাজের মধ্যেও কোনো কোনো আড্ডায় তিনি উপস্থিত থেকেছেন। যেমন বন্ধু মুরলীধর বসুর বাড়িতে। আচন্ত্যকুমার সেনগুপ্তের লেখা চিঠিতে কল্লোল সম্পাদক দীনেশরঞ্জন দাস লিখেছেন-
‘কাল রবিবার গেল মুরলীদার বাড়িতে সন্ধ্যাবেলা জোর আড্ডা বসেছিল। চা, পান, গান, অভিমান সবই খুব হল। বীরেন বাবু ও জ্ঞানাঞ্জন পাল মহাশয়েরাও ছিলেন।’৯
১৯৭৯ সালের ১১ মে তিনি কলকাতায় মারা১০ যান। তখন তাঁর বয়স হয়েছিল ৮৫ বছর।

মুরলীধর বসু
সম্পাদক, মাসিক সংহতি

বিশিষ্ট পত্রিকা সম্পাদক, লেখক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব মুরলীধর বসু। ১৯২১ সালে১১ কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাস বিষয়ে এম.এ পাস করেন। শিক্ষকতা করেন ভবানীপুর মিত্র ইনস্টিটিশনে। নানা প্রতিক‚লতার মধ্যেও তিনি সাহিত্যচর্চা করেছেন। ১৩২৩ সালে মাসিক ‘সংহতি’ প্রকাশিত হলে তিনি তার অন্যতম সম্পাদক নির্বাচিত হন। এ-পত্রিকার অপর সম্পাদক ছিলেন তাঁরই বন্ধু জ্ঞানাঞ্জন পাল। ১৯২৫ সালে মাসিক ‘কালি-কলম’ প্রকাশিত হলে এ পত্রিকারও তিনি অন্যতম সম্পাদক নির্বাচিত হন। অশ্লীলতার অভিযোগে কালি-কলমের নামে মামলা হয়েছে, কোর্টে হাজিরা দিতে হয়েছে। অবশ্য মামলা থেকে বেকসুর খালাস পেয়েছেন।সাহিত্যচর্চার পাশাপাশি বন্ধু শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে সিনেমা তৈরি করায় মনোনিবেশ করেছিলেন। এ-কারণে স্কুলে শিক্ষকতার চাকরি ছেড়ে দিয়েছিলেন। আদর্শবাদী মুরলীধর বসু ও তাঁর সাহিত্যমান সম্পর্কে অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত লিখেছেন-
“আদর্শবাদী মুরালীধর। স্কুল মাস্টার ছিলেন, কিন্তু সেই সংকীর্ণ বন্দীদশা থেকে মুক্ত ছিলেন জীবনে। নিজে কখনো গল্প-উপন্যাসে লেখেননি, প্রবন্ধ ও সম্পাদকীয় প্রসঙ্গে লিখেছেন- তাই ভয় ছিল এ সীমিত ক্ষেত্রে না মাষ্টারি করে বসেন। কিন্তু না, চিরন্তন মানুষের উদার মহাবিদ্যালয়ে তিনি পিপাশু সাহিত্যিকদের মতন চিরনবীন ছাত্র। সাহিত্যের একটি প্রশস্ত আদর্শের প্রতি আহিতলক্ষ্য ছিলেন। ভ্রষ্ট হননি কোনদিন। স্বমত-বিঘাতক মীমাংশা করেননি কোনো অবস্থায়। শুধু নিষ্ঠা নয় নিষ্ঠার সাঙ্গেঁ প্রীতি মিশিয়েছেন। আর যেখানেই প্রীতি সেই খানেই অমৃতের আস্বাদ।
তাঁর স্ত্রী নীলিমা বসুও কল্লোল যুগের লেখিকা এবং অকালপ্রয়াতা। নিম্ন মধ্যবিত্তের সংসার নিয়ে গল্প লিখতেন। বিষয়ের আনুক‚ল্যে লিখনভঙ্গিতে একটি স্বচ্ছ সারল্য ছিল। এই সারল্য অনেক নীরব অর্চনার ফল।”১২
‘কালি-কলম’ পত্রিকায়ও নিলীমা বসুর ‘গোপনধারা’ নামক গল্পটি প্রকাশিত হয়েছিল। দেশভাগের সালে তাঁদের বিশাল পারিবারিক লাইব্রেরিটি ফেলে রেখে পালিয়ে১৩ আসতে হয়েছিল। ফলে অনেক মূল্যবান বই-পুস্তক ও পত্র-পত্রিকা কালের গর্ভে হারিয়ে গেছে। কল্লোল পত্রিকায় মুরালীধর বসু লিখেননি, কিন্তু কল্লোলের সঙ্গেঁ তাঁর ছিল নিকট সম্পর্ক। তাই কাজী নজরুল ইসলাম (১৮৯৯-১৯৭৬)-এর বড় ছেলের আকিকায় কল্লোলের সকলের নেমন্তন প্রসঙ্গে অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত লিখেছেন-
“এমন সময় মুরালীদার আবির্ভাব।
প্রথম আলাপ-পরিচয়ের উত্তাল ঢেউটা কেটে যাবার পর মুরলীদা বললেন- ‘আসছে রবিবার পঁচিশে জ্যৈষ্ঠ কাজীর ওখানে আমাদের সবায়ের নেমন্তন্নো’। ‘আমাদের সবাইকার’। আমি আর প্রেমেন একটু ভ্যাবাচাকা খেয়ে গেলাম। তার সঙ্গে আলাপ নেই, তার ওখানে নেমন্তন্নো কি করে হতে পারে।
‘হ্যাঁ’ সবাইকার।’ বললেন মুরলীদা। সমস্ত ‘কল্লোলে’র নেমন্তন্নো।
তা হলে তো আমাদেরও নেমন্তন্নো। নিঃসংশয়ভাবে নিশ্চিত হলাম। ‘কল্লোলে’ তখনও লেখা এক আধটা ছাপা না হোক, তবু আমরা মনে-প্রাণে “কল্লোলের”।
বললাম, কোথায় যেতে হবে?
‘হুগলিতে। হুগলিতে কাজী নজরুলের বাসা।’

মুরলীদা, শৈলদা, প্র্রেমেন্দ্র আর আমি চারজন ভবানীপুর থেকে একদলে, আর অন্য দলে ডি-য়ার, গোকুল, নৃপেন, ভূপতি, পবিত্র, সুকুমার- সকলে সদলবলে হুগলিতে এসে উপস্থিত হলাম। প্ল্যাটফর্মে স্বয়ং নজরুল। “দে গরুর গা ধুইয়ে” অভিনন্দনের ধ্বনি উঠল। পূর্ব-পরিচয়ের নজির এনে ব্যবধানটা কমাবার চেষ্টা করা যায় কিনা সে-কথা ভেবে নেবার আগেই নজরুল সবল আলিঙ্গনে বুকে টেনে নিলেন- শুধু আমাকে নয়, জনে-জনে প্রত্যেককে। তোমরা হেঁটে হেঁটে একটু-একটু করে কাছে আসি আর আমি লাফিয়ে-ঝাঁপিয়ে পড়ে জাপটে ধরি- সাঁতার জানা থাকতে সাঁকোর কি দরকার!
সেটা বোধহয় নজরুলের বড় ছেলের ‘আকিকা’ উৎসবের নিমন্ত্রণ। দিনের বেলায় গানবাজনা, হৈ-হল্লা, রাতে ভুরিভোজ। ফিরতি ট্রেন কখন তারপর? “দে গরুর গা ধুইয়ে”। ফিরতি ট্রেনের কথা ফিরতি ট্রেনকে জিগগেস করো।”১৪
অশ্লীলতার অভিযোগে ‘কালি-কলম’-এর নামে যে মামলা হয়, তার কারণ সুরেশ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘চিত্রগহা’ উপন্যাস ও মহেন্দ্র রায়ের গল্প ‘শ্রাবণ-ঘন-গহন-মোহে’ প্রকাশ। কতজন এগিয়ে এসে সাহায্য করতে চেয়েছেন। কিন্তু মুরলীধর বসু ছিলেন ধীরস্থির মানুষ। কোনো ভয়-ভীতিতে টলেননি। সে সম্পর্কে অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত লিখেছেন-
“মুরলীধর হাসলেন। বললেন, না, তেমন কিচ্ছুর দরকার নেই।
‘তা হলে কি করবেন? এসব বড় নোংরা ব্যাপার। মাঠের বিচার আদালতের বিচার এক নাও হতে পারে। আর যদি কনভিকশান হয়ে যায় তা হলে শাস্তি তো হবেই উপরন্তু তোমার ইস্কুলের কাজটি যাবে।’
‘তা জানি। তবু থাক। মুরলীধর অবিচলিত রইলেন। বললেন, সাহিত্যকে ভালোবাসি, পূজা করি সেবা করি সাহিত্যের। জীবন নিয়েই সাহিত্য-সমগ্র, অখন্ড জীবন। তাকে বাদ দিয়েই জীবনবাদী হই কি করে? সু আর কু দুই-ই বাস করে পাশাপাশি। কে যে কি এই নিয়ে তর্ক। সত্য কতদূর পর্যন্ত সুন্দর, তার সুন্দর কতক্ষণ পর্যন্ত সত্য এই নিয়ে ঝগড়া। প্রুভারি আর পর্নোগ্রাফি দুটোকেই ঘৃণা করি। সত্যের থেকে নেই সাহস আর সুন্দরের থেকে নেই সীমাবোধ-আমরা স্রষ্টা, আমরা সমাধিসিদ্ধ।”২
সে মামলায় তাঁরা সন্দেহের সুফল লাভ করেছিলেন। মামলা থেকে অব্যাহতি লাভ করেছিলেন কালি-কলম প্রকাশক ও সম্পাদকদ্বয়।
সমকালের কবি-সাহিত্যিকদের সঙ্গে মুরলীধর বসুর শ্রদ্ধা, প্রীতি ও ভালোবাসার সম্পর্ক। বিশেষ করে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে। সংহতি’র সম্পাদনাকালেও একবার তিনি বন্ধু জ্ঞানাঞ্জন পালকে নিয়ে শরৎচন্দ্রের বাড়িতে গিয়ে তাঁর কুকুরের তাৎপর্যময় পড়িতে ঢুকতে পারেননি। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ও একবার তাঁকে কালি-কলমে খুঁজতে গিয়েছিলেন। সেদিনই মুরলীধর বসু শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়কে শরৎচন্দ্রের পানিত্রাসের বাড়িতে গিয়েছিলেন। না পেয়ে অপেক্ষার প্রহর আর শেষ হয় না। সে সম্পর্কে অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত লিখেছেন-

‘আরে তোমরা?’ শরৎচন্দ্রের স্তম্বিত ভাবটা নিমিষে কেটে গেল। ‘আমি যে আজ দুপুরে তোমাদের কালি-কলমেই গিয়েছিলাম। কী আশ্চর্য- তোমরা এখানে। এলে কখন?’
দুঃসংবাদটা চেপে গেলাম- ভাগ্যের কারসাজিতে কী সম্পদ থেকে বিরত হয়েছে কালি-কলম। উদ্বেলিত হয়ে উঠলেন আতিথিয়েতার ঔদার্যে; তা বেশ হয়েছে- তোমরা এসেছ। খাওয়া-দাওয়া হয়েছে তো? অসুবিধে হয়নি তো কোনো? কি আশ্চর্য- তোমরা আমার বাড়িতে আর আমি তোমাদের খুঁজে বেড়াচ্ছি। তা এই রকমই হয় সংসারে। এক রকম ভাবি হয়ে ওঠে অন্যরকম। আচ্ছা, তোমরা বোসো, আমি জামা-কাপড় ছেড়ে খেয়ে আসি। কেমন?’
বলেই ভিতরে চলে গেলেন এবং বললে বিশ্বাস হবে না, মিনিট পনেরোর মধ্যেই বেরিয়ে এলেন চটপট। তারপর শুরু হল গল্প- সে আর থামতে চায় না। মমতা করবার মত মনের মানুষ পেয়েছেন, পেয়েছেন অন্তরঙ্গ বিষয়-জীব ও জীবন- তাঁকে আর কে বাধা দেয়। রাত প্রায় সাবার হতে চলল, তরল হয়ে এল অন্ধকার, তবু তাঁর গল্প শেষ হয় না।
তাঁকে বারণ করবার লোক আছে ভিতরে। প্রায় ভোরের দিকে ডাক এলো, ‘ওগো তুমি কি আজ একটুও শোবে না?’
তক্ষুনি মুরলীধর তাঁকে উপরে পাঠিয়ে দিলেন। যেতে যেতে কিছু দেরি করে ফেললেন। তাঁর লাইব্রেরি ঘরে মুরলীদের শোবার বিস্তৃত ব্যবস্থা করলেন। তাতেও যেন তাঁর তৃপ্তি নেই। বিছানার চারপাশে ঘুরে-ঘুরে নিজ হাতে মশারী গুঁজে দিলেন।”১৬
মুরলীধর বসু গল্প-উপন্যাস বা কবিতা লেখেন নি। তবে পত্রিকার সম্পাদকীয় ছাড়াও প্রবন্ধ পরত (রস-রচনা), বেতালের বৈঠক (রঙ্গঁ-ব্যঙ্গঁ), হাসি-কান্না (চিত্র) ইত্যাদি লিখেছেন। তাছাড়া সাহিত্যের আটচালা কলামে সাহিত্য বিষয়ক লেখা লিখেছেন। অনুবাদ করেছেন টলস্টয় ও গোর্কির স্মৃতিকথা থেকে বেশ কিছু লেখা। নিম্নে তাঁর কয়েকটি লেখা উদ্ধৃত করা হলো। তা থেকে তাঁর সাহিত্যবোধ ও রসবোধের১৭ আভাস পাওয়া যাবে-
[১] অতি আধুনিক সাহিত্যিকেরা সুলেখক কি না সে বিষয়ে এখনও সন্দেহ আছে, কিন্তু তাঁরা যে শক্তিমান লেখক সে বিষয়ে সন্দেহ করবার আর বিশেষ অবসর নেই। তাঁদের লেখা যে শুধু তরুণলেককদেরই মাথা খারাপ করেছে তা নয়, অনেক প্রবীণ বয়স্কদেরও বিকৃৃত-মস্তিষ্ক করে তুলেছে। এই রকম একজন ক্ষিপ্তপ্রায় প্রবীণ ব্যক্তি বৈশাখের মাসিক বসুমতি’তে বর্তমান সাহিত্য সম্বন্ধে বিলাপ আলোচনা করেছেন। তাঁর প্রধান অভিযোগ যে, রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দের আদর্শে আধুনিক সাহিত্য রচিত হচ্ছে না। আমাদের মনে হয়, সমস্ত সাহিত্যিকদের বাধ্যতামূলক আইন করে রামকৃষ্ণ মিশন বা হিন্দুসভার সভ্য করে দিলেই সম্ভবত এই শোচনীয় অবস্থার প্রতিকার হতে পারে।

[২] শনিমন্ডল বিনামূল্যে উপাধি বিতরণ শুরু করেছেন। মেটারলিঙ্ক সম্বন্ধে প্রবন্ধ লিখে শ্রীযুক্ত মহেন্দ্রচন্দ্র রায় মেটালকীয় মহেন্দ্রচন্দ্র হয়েছেন। হরিদাগী বৈষ্ঞবী- নরেশচন্দ্র হয়েছেন। উপন্যাসের নামিকার মুখের একটা কথার জন্য শরৎচন্দ্রকেও “আজন্ম ব্রহ্মচারী সন্ন্যাসী” শরৎচন্দ্র বলা হয়েছে। …হালুমবুড়ো প্যারিমোহন এবং কচি ও কাঁচা সজনীকান্ত দলের উপযুক্ত যুক্তিই বটে।
কিন্তু মোড়লদের একটি ভুল হয়ে গেছে। উপাধি বিতরণ উপলক্ষে কবিগুরুকে তাঁরা ভুললেন কেন? এবং ক্ষতিপূরণ স্বরূপ রবীন্দ্রনাথকে তাঁরা যেন ভবিষ্যতে নষ্টনীড়- রবীন্দ্রনাথ নামে অভিহিত করেন।
[৩] সাহিত্যের অভিনব সৃষ্টি! দেখতে চান? তা’হলে আশ্বিনের ‘প্রবাসী’তে কবি শ্রীযুক্ত সুধীন্দ্রনাথ দত্তের ‘কুক্কুট’ কবিতা পড়ুন। আজ পর্যন্ত কুক্কুট প্রকাশ্যে এবং গোপনে অনেককেই যোগান দিয়েছে কিন্তু সকলেই সেই রস বেমালুম গান করে গেছেন। এতদিনে শ্রীযুক্ত সুধীন্দ্রনাথ দত্ত ‘কুক্কুট’ সম্বন্ধে রসোদ্ধার করে সেই সুচিরসি ত ঋণের পরিশোধকল্পে যে অমানুষিক চেষ্টা করেছেন সেজন্য তিনি সকলের বিশেষ ধন্যবাদার্হ।
কল্লোল যুগের লেখক হলেও মুরলীধর বসু ছিলেন বস্তুবাদী সাহিত্য ধারার লেখক। তাঁর লেখায় রসবোধের শ্লোষাত্মক উক্তি থাকলেও অহেতুক ফেনিল উদ্দামতা ছিল না। সবার মধ্যে থেকেও তিনি ছিলেন আলাদা। সেক্ষেত্রে তাঁর অন্যাযতা অবশ্য স্বীকার্য।
শতবর্ষ পরে প্রায় তাঁর সম্পর্কে অনেক তথ্যই আজ আমাদের অজানা। বিচ্ছিন্নভাবে হয়তো তা ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। তা সংগ্রহ করা আজ সহজসাধ্য নয়। তবুও তিনি যে সাহিত্যাদর্শ অনুসরণ করেছিলেন একালেও তা স্মরণ যোগ্য। তিনি ছিলেন এবং তিনি আছেন, থাকবেন চিরকাল। তাঁর সৃষ্টির প্রতি শেষ শ্রদ্ধাঞ্জলি শতবার।

ঢাকা
৪ ফেব্রুয়ারি ২০২১

১. ঝড় সাহিত্যপত্র, সেপ্টেম্বর ২০০৬, মুর্শিদাবাদ, পৃ. ২৩২
২. কল্লোল যুগ- অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত, কোলকাতা (শ্রাবণ ১৪১৬), পৃ. ১৭-১৮
৩. প্রাগুক্ত – ১৮

৪. প্রতিরোধ প্রতিদিন, প্রকাশক মসীত্রা গ্রন্থালয়, কোলকাতা (১ ডিসেম্বর ১৯৭৫), পৃ. ৩৭৪
৫. কল্লোল যুগ- পৃ. ১৮-১৯
৬. প্রাগুক্ত – প্রাগুক্ত পৃ. ২১
৭. কল্লোল যুগ- প্রাগুক্ত, পৃ.২৩
৮. প্রাগুক্ত- প্রাগুক্ত, পৃ. ১৯
৯. কল্লোল যুগ- প্রাগুক্ত, পৃ. ৪৪
১০. সংসদ বাঙ্গালি চরিতাভিধান (প্রথম খন্ড)- সাহিত্য সংসদ, কোলকাতা (১৯৮৮), পৃ. ১৮২।
১১. সংসদ বাঙালি চরিতাভিধান (দ্বিতীয় খন্ড), সাহিত্য সংসদ, কোলকাতা (২০০৪), পৃ. ২৭২।
১২. কল্লোলের কাল- জীতেন্দ্রসিংহ রায়, কোলকাতা (২০০৮), পৃ. ২৫৬-৫৭।
১৩. সংসদ বাঙালি চরিতাভিধান (দ্বিতীয় খন্ড), প্রাগুক্ত, পৃ. ২৭২।
১৪. কল্লোল যুগ- প্রাগুক্ত, পৃ. ২৩,৩৪
১৫. কল্লোলের কাল- প্রাগুক্ত, পৃ. ২৫৪
১৭. কল্লোল যুগ- প্রাগুক্ত, পৃ. ১৭২
১৮. কল্লোলের কাল- প্রাগুক্ত, পৃ. ১৬৭-৬৮।

==================