You are currently viewing শাহিদ আনোয়ারের কবিতা আমাদের বর্ণপরিচয় / সাজিদুল হক

শাহিদ আনোয়ারের কবিতা আমাদের বর্ণপরিচয় / সাজিদুল হক

শাহিদ আনোয়ারের কবিতা

আমাদের বর্ণপরিচয়

সাজিদুল হক

রুগ্ন সময়ের ভগ্নস্বাস্থ্যের কবি শাহিদ আনোয়ারের কবিতা ছিলো বলিষ্ঠ, স্পন্দমান, নান্দনিক ও ললিত ভাবনায় নির্মিত স্রোতস্বিনী। বৃহৎ নীলিমার ঠিকানা। আজ আমাদের মাঝে তার শারীরিক অবস্থিতি না থাকলেও ইকারুসের আকাশের প্রতিটি তারায় বেঁচে আছে শাহিদের কবিতার শব্দকোষ।

আশির দশকে আমাদের এখানে তারুণ্য নানা সামাজিক এবং রাজনৈতিক অসঙ্গতিতে জ্বলে উঠেছিলো শিল্প-সাহিত্য ও সংস্কৃতির বিভিন্ন শাখায়। বিশেষ করে তার তীব্রতা দেখা যায় কবিতায়। এখানে কবিদের মেধার স্ফুরণ ঘটেছে দ্রোহ এবং প্রেমে। সামরিক শাসন বিরোধিতা, গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষার পাশাপাশি কেউ কেউ সমাজতন্ত্রের প্রতি দায়বদ্ধ হয়ে পড়ে। কবি শাহিদ আনোয়ার সেই উত্তাল শিবিরের একজন নিভৃতচারী সময়ের নির্মাতা।

শাহিদের কবিতা অনেকগুলো বৈশিষ্ট্য নিয়ে বিকশিত হয়েছে তেমন নয়। তিনি ব্যক্তি প্রেমের জন্য বিচলিত ছিলেন, কিন্তু সমাজ ও রাজনীতির উপস্থিতিতে কবি এখানে নিজেকে দৃশ্যমান করেছেন। ধর্মকে আধ্যাত্মিকতায় উত্তীর্ণ করেছেন কবিতার নানামাত্রিকতায়। তাই এই প্রশ্ন অবান্তর, কবি আস্তিক না নাস্তিক ছিলেন। শেষপর্যন্ত ব্যক্তিমানুষ একজন সামাজিক মানুষ হয়ে কবিতার জন্য তৈরি করে গেছেন পূর্বসূরিদের ধারায় আধুনিক মানবিক দর্শনের ভুগোল। তিনি তার স্বভাবের অন্তর্গঠনে সমসময়ের সম্ভাবনা এবং ঘাত-প্রতিঘাতকে কবিতার মেজাজ নির্মাণ করেন। শাহিদ এক্ষেত্রে আশির দশকে অন্যান্য অনেকের থেকে আলাদাভাবে চিহ্নিত।
কবিতা নিয়ে যখন কিছুটা ভাবতে শিখছি, তখনই আমাদের মনন জুড়ে স্থান করে নেয় রবীন্দ্রনাথ, নজরুল,জীবনানন্দ, বুদ্ধদেব, শামসুর রাহমান, শহীদ কাদরী এবং আল মাহমুদ এর কবিতা। তারপর বাঙালির মুক্তির মিছিলে যুক্ত হয়েছেন আরও অনেক উল্লেখযোগ্য কবি। তাদের কবিতার ব্যবচ্ছেদে আমরা আজ তরুণতম থেকে এগিয়ে প্রবীণ বয়সের কাছাকাছি। অথচ এখনো আমাদের মনোজগতে পূর্বসুরীদের সেই কাব্যচিন্তা প্রবলতর বিদ্যমান। আমরা বা আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম পরম্পরায় সেই চিন্তার ঘুরপথে পরিভ্রমণ করছে। দশকের পর দশকব্যাপী আমরা রবীন্দ্রনাথ থেকে আবুল হাসানে অভ্যস্ত হয়ে আছি। তাদের অভ্যাসের সাথে আমরাও নিজেদের চিন্তাভাবনাকে পরিবর্তন করেছি তাদেরই মতো। গ্রাম পতনের মধ্য দিয়ে নগরের চেহারাগুলো স্পষ্ট হতে দেখেছি। তীব্র বেদনা এবং রক্তঃক্ষরণের মূর্ত সময়ের অনুবাদ ছিলো বরপুত্রদের সৃষ্ট সেসব কবিতায়। তবে কী তাদের সময়টা অনতিক্রম্য? আমরা বা আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম নিজের সময়কাল সম্পর্কে অন্ধ ছিলো? নিজেদের সাম্প্রতিক বোধ নিয়ে অসচেতন ছিলো? স্বাধীনতা পরবর্তী অস্থিরতা, জটিলতা, সম্ভাবনা এবং তারুণ্যের স্বপ্নকে বাংলা ভাষার আর কোনো তরুণ কবি নিজেদের কবিতায় ধারণ করেনি?

তাহলে আমরা কিংবা আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম বুদ্ধি প্রতিবন্ধী? মেধাশূন্য এবং অনভিজ্ঞ আমরা  নিজেদের সমাজ ও সময় সম্পর্কে মোটাদাগে এভাবে বললে অপরাধ হবে? পঁচাত্তর এর হত্যাকাণ্ডের পর অনেকের গর্জন শুনতে পেয়েছি তাদের কবিতায়। রচনা করেছিলেন সহস্র কবিতা। আজও তা অব্যাহত আছে। সেক্ষেত্রে এই প্রশ্নেরও তো মুখোমুখি হই, মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী অর্থাৎ আশির দশক বা পরবর্তীতে কী শামসুর রাহমানদের উত্তরসূরী বাংলা কবিতার মেঠোপথে কেউ আসেনি? আশি,নব্বুই কিংবা এর পরের কবিকূল কী সময় থেকে মুখ ফিরিয়ে ছিলো? দীর্ঘ ঘুম ভেঙে দেখতে পেলো এরা সকলেই স্বর্গলাভ করেছে, যেখানে মানুষের মধ্যে হিংসা, ঘৃণা, লোভ এসব কোনো রিপুই নেই। মানুষের রক্তে নেই খুনের নেশা। আবার এ-ও দেখা যায় যে, সমকালে ব্যতিক্রমী চিন্তার অথবা ভিন্নতা নিয়ে কেউ কেউ নির্দিষ্ট সময়কে অতিক্রম করেছে এমন কাউকে অস্বীকারের প্রবণতা। অদ্ভুত অবরুদ্ধ চিন্তা থেকে বেরিয়ে আসার লক্ষ্যে এবং একটি গুরুত্বপূর্ণ পর্যবেক্ষণ থেকেই বিদ্যমান মনোজগতের বিপ্রতীপে দাঁড়িয়ে চলমান সময়ে কবিতার ভিন্ন এক কন্ঠস্বরকে চিহ্নিত করছি এই আখ্যানে। তার কবিতাপাঠ আমাদের পূর্ব, বর্তমানের ক্রান্তিলগ্ন এবং আগামীর সম্ভাবনা ও সংকট অনুধাবনে সাহায্য করে । কবিতার বরপ্রাপ্ত শাহিদ আনোয়ার মৃত্যুছায়ায় খুঁজে নিয়েছেন সৃজনশীলতার উন্মোচনে জন্মের মুহুর্তটি অনির্বচনীয় জলকণার সৌন্দর্যে। জন্মের সমান্তরাল পথে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করে চলে গেলেন আটান্ন সালে জন্ম নেয়া এই কবি মাত্র তেষট্টি বছরে। এই মৃত্যুতে শোকাহত হলেও আমরা যারা জানতাম তিনি দীর্ঘদিন ধরে অসুস্থ, তাদের জন্য তার মৃত্যুটাকে মেনে নিয়েই বলছি, তিনি বেঁচে থাকবেন তার অজর কবিতায়। আমরা কলেজ লাইফ থেকে কবিতার মোহগ্রস্ততায় জীবনানন্দ, শামসুর রাহমান, সুনীল সহ আধুনিক কবিদের কবিতায় ডুবে ছিলাম। তখন পাশাপাশি আবুল হাসান, নির্মলেন্দু গুণের ভক্ত পরিচয় দিয়ে এক ধরনের অহংকার অনুভব করেছি। সেই অভ্যস্ত পাঠকের মননে জায়গা করে নেয় আমাদেরই সমসাময়িক কবি শাহিদ আনোয়ার। আমরা শাহিদের কবিতায় আবিষ্কার করলাম, জন্ম-মৃত্যু রহস্যের অন্য এক রূপান্তরের দার্শনিক ভাবনা। এখানেই তিনি আশির দশকে একজন ব্যতিক্রমী চিন্তার গুরুত্বপূর্ণ পর্যবেক্ষক।

ওনার উল্লেখযোগ্য কাব্য হলো,
” কুঁকড়ে আছি মনোটনাস গর্ভে” ;
” শুঁড়িখানা নুঁড়ির মধ্যে”
” দাঁড়াও আমার ক্ষতি”।

সংখ্যায় অল্পকটি কাব্য হলেও আমরা এইসব কবিতার মেজাজ অভিনিবেশে মহাজাগতিক ভাবনায় অস্থির হই এবং আমাদের জন্মরহস্যের দার্শনিক ব্যখ্যা পেয়ে যাই।  কবির আশাবাদ পাঠকের জন্য কখনও সখনও আশ্রয়স্থল হলেও পাঠক সেখানে থেমে থাকে না এবং নিজেকে বদলে অন্তহীন গতিপথ তৈরি করে নান্দনিক অভিজ্ঞতায়। কবিকে নিয়ে সেই সময় এবং  আজকের অনেকেই আলোচনায় যুক্ত হয়েছেন শাহিদের কবিতা এবং যাপিত জীবনের সহজাত সুর এবং রুক্ষভাষণ নিয়ে। তার কবিতার ভেতর থেকে সময়চিহ্নিত মানুষের মুখ অতীতের আলোয় যেমনটা দেখে শাহিদ আনোয়ারের পরবর্তী প্রজন্ম, একইসাথে সমসাময়িক পাঠকের মনন খোঁজে তার কবিতার মনোভূমির উৎস কী? কোন যাদুবলে তিনি কবিতায় নেতিবাচকতার ব্যাপারটা ইতিবাচক শব্দের অর্থবহ পরিচয় হয়ে ওঠে। ইউরোপীয় আধুনিকতা খুব সহজে শাহিদের কবিতায় পাঠক খুঁজে পেলেও সেই সাহিত্যের সাংস্কৃতিক আধিপত্য নেই বললেই চলে। বাঙালির লৌকিক বাস্তবতার দলিল হিসেবে বিবেচিত হয় তার কিছু কিছু কবিতা। সেখানে আত্মজিজ্ঞেস থেকে উপস্থাপিত হয় কবির ব্যক্তিগত পরিচয়। কালান্তরে এই পরিচয়কে আলোচক-পাঠক যদি মনে করে প্রতিটি পঙক্তিমালা তাদের নিজেদের বর্ণপরিচয়, তাহলে কী মহাসিন্ধু পরিমাণ ভ্রম হবে?

১৫.১১.২০২১