You are currently viewing শহীদ দিবসের অঙ্গীকার ভাষা চেতনা ও প্রজন্মযোগ/ আজিজ কাজল

শহীদ দিবসের অঙ্গীকার ভাষা চেতনা ও প্রজন্মযোগ/ আজিজ কাজল

শহীদ দিবসের অঙ্গীকার ভাষা চেতনা ও প্রজন্মযোগ

আজিজ কাজল

লটিয়া মাছ সাগরের তলদেশে থাকে। মাটির সাথে একেবারে গা ঘেঁষে লেপ্টে থাকেএবং সরাসরি স্বাস্থ্যকর আয়োডিন ও প্রোটিন সংগ্রহ করে। মাতৃভাষাও ঠিক তেমন—মানুষকে তার নিজ শেকড়-গুল্মের ভেতরে, নিজের জল হাওয়ায় থেকে ভাষার স্বাস্থ্যকর আয়োডিন আর প্রোটিনের রস সংগ্রহ করতে হয়। সেই সিঞ্চিত  রসের ভাবাবেগ আর সৌন্দর্য থেকেই বের করে আনতে হয়, নিজভাষার বর্ণ-গন্ধ—ধ্বনি-শব্দ-বাক্য-উপমা-উৎপ্রেক্ষাসহ শত যুক্তি আর আবেগ-আকাঙ্ক্ষার মায়াবি ঝালর।

পৃথিবীর অন্যতম আদি ভাষা হিব্রু ভাষা। জাতীয় পুনর্জাগরণের মাধ্যমে যেটি পরে আবার জেগে ওঠেছিলো। লাতিন ভাষার অবমুক্তি থেকে যে  লৌকিক ভাষাগুলো জেগে ওঠেছিলো ইংরেজি, স্পেনিশ, ইতালি, ফরাসি ইত্যাদি ভাষা। এরপর দীর্ঘ  সংগ্রাম, ত্যাগ, হত্যাসহ এই লাতিন আমেরিকাতেই যে আদিভাষা জেগে ওঠেছিলো, তার মধ্যে প্যারাগুয়ের হিস্পানিক ভাষা ও গুয়ারাণি ভাষা অন্যতম (প্যারাগুয়ের হিস্পানিক ভাষা ও সে দেশের আদিবাসীদের কথ্য ভাষা গুয়ারাণি)।

দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ শেষ হওয়ার সাথে সাথে রাজনৈতিক বাস্তবতা যখন পাল্টাতে থাকে, তখন আশি ও নব্বইয়ের দিকে হিস্পানিক ও গুয়ারাণি এই দুই ভাষাকে, প্যারাগুয়ে রাষ্ট্র বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে রাষ্ট্রীয় ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। নিজ দেশের মাতৃভাষার অধিকারসহ ছোট ছোট মৃতপ্রায় বহুদেশের এই ভাষাগুলোকে, এক ধ্রুপদি স্বীকৃতি এনে  দিয়েছিলো মহান একুশে ফেব্রুয়ারি। বিশেষ করে ১৯৯৯ সালে, জাতিসংঘের ইউনেস্কোর আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি প্রদানের মাধ্যমে।

এবার আসি শহিদ দিবসের অঙ্গীকার হিসেবে ভাষা বিষয়ে অন্যতম এক নিরেট সত্য ভাবনায়—ইংরেজিকে বাংলার প্রতিপক্ষ হিসেবে দেখলে চলবে না। দেখতে হবে অনিবার্য সহযোগী। নিজ ভাষার লৌকিক শক্তির কালজয়ী অনুভূতি, মাহাত্ম্য ও যৌক্তিক আবেগের মধ্যদিয়েই আমাদের  বর্তমান প্রজন্মের মাঝে ভাষাবিকাশ ঘটাতে হবে। এছাড়া আমাদের দেশে ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত যারা, তাদের আরো বেশি স্বদেশপ্রাণতা, স্বজাত্যবোধ নিয়ে জেগে ওঠা দরকার। কেননা এই মাধ্যমের শিক্ষার্থীদের নিজের ভাষা-চেতনার মধ্য দিয়ে নিজ আদব-লেহাজ  মূল্যবোধগুলো নিজের অনিবার্য শেকড়ের মধ্য দিয়ে করাটা অনিবার্য  হয়ে ওঠেছে। এ বিষয়ে আব্দুল কাইয়ুম এর “মাতৃভাষায় পঠন-দক্ষতা  প্রবৃদ্ধি বাড়ায়” প্রবন্ধ সংক্ষেপ”… মাতৃভাষায় পঠন দক্ষতার গুরুত্ব এত বেশি কেন? কারণ যে শিশু মাতৃভাষায় দক্ষতা অর্জন করতে পারে,  সে সহজেই ইংরেজি বা অন্য এক বা দু’টি বিদেশি ভাষা শিখে নিতে পারে। তখন তার সামনে জ্ঞান বিজ্ঞানের শীর্ষে চলে যাওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেড়ে যায়”… এছাড়াও ইউ এস এ আইডির শিক্ষা বিষয়ক  দলনেতা কেট মেলনি বলেন, “শিশুদের পাঠদক্ষতা ১০ শতাংশ  বাড়লে অথনৈতিক প্রবৃদ্ধি শূন্য দশমিক ৩ শতাংশ বেড়ে যায়”…উল্লেখিত চুম্বক বিষয়ের ভেতরে আমরা ( নানা প্রবণতায়) নিজ  মাতৃভাষার তুল্যমূল্য একটা আলোচনা হাজির করতে পারি।

আমাদের প্রজন্ম; বাংলা মাধ্যম, ইংরেজি মাধ্যমসহ একাডেমিক নন একাডেমিক প্রতিষ্ঠান, কোর্ট কাচারি, বড় বড় কর্পোরেট প্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ছে—তাদেরসহ-সবার সার্বিক কর্মযজ্ঞে-দরকার রাষ্ট্রভাষা তথা বাংলার অনিবার্য উপস্থিতি। এদের সিংহভাগ (ধীরে ধীরে) নিজ দেশে থেকেও শয়ানে-স্বপনে-ধ্যানে হয়ে পড়ছেন দূর-পরবাসী বা দূর আকাশের তারার মতো; যারা সাময়িকভাবে ও শারীরিকভাবে থাকেন দেশে। কিন্তু চেতনে-অবচেতনে ও মানসিকভাবে থাকেন ভিন দেশে—চোরাগুপ্তা বা আত্মবিধ্বংসী স্বপ্ন দেখার উল্লম্ফনে। যদিও এর পেছনে অনুঘটক হিসেবে কাজ করছে সার্বিক নিরাপত্তা, অসম অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনা, চাহিদা যোগানের অসাম্যসহ ইত্যাদি বড় একটি ফ্যাক্টর হিসেবে প্রতিভাত হচ্ছে।

যাদের নিজস্ব কোন আইডেনটিটি থাকে না তাদের নিজস্ব কোন মাটি থাকে না, যাদের নিজস্ব কোন মাটি থাকে না তাদের নিজস্ব কোন আকাশ থাকে না; সুতরাং তারা কীভাবে নিজেকে বুঝবে? নিজের  মাতৃভূমিকে বুঝবে? জন্মদাতা বাবা-মা, আত্মার স্বজনকে বুঝবে?  নিজের ভাষা তথা নিজেরদেশকে বুঝবে? অন্যের মাটিতে দাঁড়িয়ে,  অন্যের আকাশে চোখ রেখে মাটিবিমুখ নিজের স্বপ্ন দেখা  মহাব্যাধি বা রোগ। যা নিরাময়যোগ্য নয়। সর্বোপরি এর বলি হতে হয়,  বাবা-মা-শিক্ষক, নিজের পরিবার, নিজের সমাজকে। রক্তসম্পর্কীয় অকৃত্রিম বন্ধন থেকে শুরু করে, একেবারে রাষ্ট্রে গিয়ে  লাগে এর ভয়াবহ বিষের বাতাস। কথায় বলে নিজেকে ছোট রেখে  কখনো নিজেকে বড় করা যায় না। তেমনি নিজের দেশ, নিজের শেকড়কে উপেক্ষা করে কখনো নিজের সঠিক পরিচয় পাওয়া যায় না।  ভগ্ন বিকলাঙ্গ অসুস্থ মন, আর অসুস্থ শরীর দিয়ে যেমন সুস্থ কিছু কাম্য  হতে পারে না, তেমনি একটি দেশে জাতীয় চিন্তার ঐক্য,  ভাষাবীক্ষা,  মূল্যবোধ, দেশপ্রেম, স্বজাত্যবোধের চর্চা ছাড়া নিজের সঠিক বিকাশ সাধন কখনো সম্ভব হয় না।

পুঁজিবাদী আগ্রাসন, জীবন ব্যবস্থাপনার প্রবল চাপে-তাপে বর্তমান  মানুষ স্বার্থকেন্দ্রিক জীবন ব্যবস্থাপনার নিষ্ঠুর ঘেরাটোপে আটকে যাচ্ছে। পুরোনো মানুষ, দীর্ঘ চেনা জানার মানুষ, আত্মার-আত্মীয়  থেকে শুরু করে রক্তম্পর্কীয় অনেকের সাথেই তৈরি হচ্ছে দূরত্ব। মানবতা, মূল্যবোধ, বিবেক, অনুভূতি ও ইতিবাচক চিন্তাগুলো পারষ্পরিকবিচ্ছিরি অসুস্থ প্রতিযোগিতায় হারিয়ে যাচ্ছে। নীতি, সুনীতি, ভাল গুণসম্পন্ন চরিত্রের সুস্থ চর্চাগুলোর সাথে প্রতিনিয়ত মানসিক সংঘাত ও অসহিষ্ণুতা বাড়ছে।

দেশে অর্থলগ্নিকারী ও ঋণ খেলাপী প্রতিষ্ঠান বাড়ছে। সেই সাথে  জ্যামিতিক হারে বাড়ছে অসুস্থ পুঁজির প্রতিযোগিতা; দুর্নীতিবাজ,  ঘুষখোর, হুণ্ডি ব্যবসায়ী, পাচারকারী সম্পদের মালিক ও মালিকানা চলে গেছে তাদের হাতে। সুস্থ ও স্বাভাবিক বোধের চিন্তাসম্পন্ন মানুষগুলো অসুস্থ চিন্তার  বেপরোয়া মানুষের নিষ্ঠুর অচরিতার্থ-যাপনের  ঘেরা টোপে আটকে যাচ্ছে।এই দুর্বিনীত  মানুষের ধনবাদী বেপরোয়া  আলগা জীবন, সাধারণ জনজীবনের ব্যয় ও জীবনযাত্রার মান  অসুস্থভাবে বাড়িয়ে দিয়েছে। বাড়িয়ে দিয়েছে নিত্য প্রয়োজনীয় বাজার—চাল, ডাল, মসলা তেল—ভোগ্য ভোজ্য পণ্য থেকে শুরু  করে  কম দামের প্রযুক্তি পণ্যও চলে যাচ্ছে সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে।  সীমাহীন মুদ্রাস্ফীতিসহ লাগাম ছাড়া  অর্থনীতির পাগলাঘোড়া—দীন, আর্ত, খেটে খাওয়া দরিদ্র মানুষগুলোকে করছে আরো বেশি  উদ্বাস্তু, যাযাবর, ভাসমান; আরো নিঃস্ব আরো রিক্ত। তারা পাচ্ছে না প্রয়োজনীয় খাবার-দাবার ও পুষ্টি। অপুষ্ট ও ভুখানাঙ্গা মানুষগুলোর  অস্তিত্ব একেবারে বিপন্ন থেকে বিপন্নতর। সেই হাওয়া এখন লেগেছে,  কম দরিদ্র, নিম্ন বিত্ত, নিম্ন মধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্তের গায়েও। তাদের কাছে ক্ষুধা এখন অসুখের নাম। আর ভাত হচ্ছে ওষুধ।

ক্ষমতায়নের এই আগ্রাসন সম্পর্কে বিশ্বের বড় বড় চিন্তকেরা দারুণ কিছু যৌক্তিক উদাহরণ  টেনেছেন। বিশিষ্ট দার্শনিক ও উত্তর আধুনিক চিন্তাধারার অন্যতম পুরোধা মিশেল ফুঁকোর কিছু প্রশ্ন ও ভাবনায়; এবং আরেক চিন্তক উত্তর-উপনিবেশিক কাউন্টার ডিসকোর্সের প্রবক্তা এডওয়ার্ড সাইদ—একটা ভাবনার মধ্যে এই দু চিন্তকের আছে, দারুণ  সমন্বয়। তারা বুঝতে পেরেছেনউপনিবেশ কিভাবে জ্ঞান ও ক্ষমতাকে তাদের  শক্তির সামর্থ্য দিয়ে বিচার করে এবং এভাবে ক্ষমতার সম্প্রসারণ ঘটায়। এছাড়াও নয়া সাম্রাজ্যবাদ ও মার্কিনসাম্রাজ্যবাদ নিয়ে সবসময় প্রতিবাদী ও উচ্চকণ্ঠ থাকেন বর্তমান বিশ্বের অন্যতম প্রবীণ বুদ্ধিজীবী,  ভাষাবিজ্ঞানী নোয়ামচমস্কি। যিনিকাল মার্কসের পরে সাম্প্রতিক একটি গ্রন্থে ভারত উপমহাদেশ সম্পর্কে দারুণ পর্যবেক্ষণ হাজির করেছেন। সৈয়দ আবুল মকসুদ’র প্রবন্ধ “মা ও মাতৃভূমি গৌরবের” থেকে তার  সামান্য সার সংক্ষেপ—“সাম্রাজ্যবাদী শাসন যে একটি বিপর্যয় তাতে সন্দেহের লেশমাত্র নেই। দেখুন ভারতবর্ষ। যখন ব্রিটিশরা বাংলায় প্রথম প্রবেশ করে তখন তা  ছিলো পৃথিবীর সবচেয়ে বিত্তশালী জায়গাগুলোর একটি।প্রথমব্রিটিশ  বেনিয়া যোদ্ধারা বাংলাকে (প্যারাডাইস) বেহেস্ত বলে বর্ণনা করেছে। সেই এলাকাটি এখন বাংলাদেশ ও কলকাতা, যা অত্যন্ত হতাশা ও আশাহীনতার প্রতীক”…সাম্রাজ্যবাদী কর্পোরেট (দানবীয়) পুঁজিবাদী অর্থনীতির বিকাশমানতার ভেতরে, নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে হবে আমাদের। তাছাড়া আমরা হচ্ছি একটি ভাষাদেশের মানুষ তথা বাংলাদেশের নাগরিক।  বিশ্বর আমরাই একমাত্র জাতি যারা একটি ভাষাদেশকে প্রতিষ্ঠা করেছি; ভাষার জন্য লড়াই করে, সেই ভাষা ও দেশকে অনন্য মর্যাদায় প্রতিষ্ঠা  করেছি। এই ভাষাতেই আছে হাজার বছরের বাংলার ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির শাশ্বত অমূল্য রতন। আমাদের শিল্প-সাহিত্য-কৃষ্টি-সংস্কৃতি-অথনীতি-রাজনীতি—এর প্রত্যক্ষতার ভেতরেইচালু রাখতে হবে, বাঙালি-বাংলাদেশ তথা বাংলা ভাষাভিত্তিক নয়া জাতীয়তাবাদী চিন্তন প্রক্রিয়া তাছাড়া আমরা বিভিন্ন মাধ্যমের শিক্ষা ব্যবস্থাপনার বাধ্যগত একটা  প্রক্রিয়ার ভেতর আটকে গেছি। এই মাধ্যমগুলোকেও(সময়োপযোগী)  ভাষাভিত্তিকসহ মোটাদাগে (আমাদের নিজস্ব) আরো কিছু মৌলিক  অনিবার্য বিষয়ের সাথে সম্পৃক্ত রেখে, এই ভাষারই উপযোগী করতে হবে। সুতরাং এইরূপ বোঝাপড়ার চর্চা যদি বেড়ে যায়, সব ভ্রান্তি পেছনে ফেলে অদূর ভবিষ্যতে ঠিকই একই জায়গায় এসে দাঁড়াবে অসাম্প্রদায়িক বাংলা ও বাঙালি। শুধু ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেওয়ার ভুল মাথায় না নিয়ে, আমাদের হাজার বছরের আচরিত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও প্রত্নতত্ত্ব থেকেও খুঁজে নিতে হবে বাংলা ও বাঙালি পরিচয়ের নতুন বীজমন্ত্র শহীদ দিবসের এই হোক অঙ্গীকার।