শহিদ মুক্তিযোদ্ধার তালিকা
অমিতা মজুমদার
পাঁচমাসের ছেলে সপ্তর্ষিকে ঘুম পাড়িয়ে একলা ঘরে রেখে জয়িতা গিয়েছিল পুকুরঘাটে জল আনতে। একলা ঠিক নয়, পক্ষাঘাতে শয্যাশায়ী অশীতিপর বৃদ্ধ শ্বশুর নবনীবাবু ছিল । যিনি এক সময়ের ডাকসাইটে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের নেতা ছিলেন। অবিভক্ত ভারতবর্ষে জন্মসূত্রে তিনি পূর্ববঙ্গের লোক। দেশভাগের তিক্ততা তাকে অনেকটা জীবনবিমুখ করে ফেলে। তবুও আর দশজনের মতো জন্মভূমি ছেড়ে তিনি যেতে পারেননি। জন্মভূমিকে মা মানতেন,তাই সেই মাকে একলা ফেলে উদ্বাস্তু জীবনের পথে পা বাড়াননি। যদিও তাকে উপযুক্ত সম্মান দিয়েই ভারত সরকার নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তিনি সে ডাকে সাড়া দিতে পারেননি।
এলো ১৯৭১সাল,
সপ্তর্ষির দাদু নবনীবাবু জানুয়ারি মাসে মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণের কারণে পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে পড়ায় মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলেও আর দশটা পরিবারের মতো দেশ ছেড়ে নিরাপদ কোনো আশ্রয়ের সন্ধানে যেতে পারেনি জয়িতারা।
জয়িতার স্বামী হিরন্ময় স্কুল শিক্ষক গোপনে মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করে। বাবা ও শিশুপুত্রকে নিয়ে একা জয়িতা কীভাবে সামলাবে সেকথা ভেবেই সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে যেতে পারেনি। কিন্তু দেশপ্রেম তো তার ধমনীতে। তাই সুযোগ পেলেই মুক্তিযোদ্ধাদের কাজে লাগার চেষ্টা করত। প্রত্যন্ত এই গ্রামাঞ্চলে যুদ্ধের আঁচ তখনও তেমন করে লাগেনি। তাই মানুষ তখনও ভাবছে গ্রামে কিছু হবে না। কিন্তু নীরিহ সরল গ্রামবাসীর ভাবনাকে ভুল প্রমাণ করতে পাকিস্তানের দোসর এদেশীয় দালাল রাজাকার আলবদর বাহিনী পথ দেখিয়ে ঠিক নিয়ে এলো হায়েনাদের। তাদের আক্রমণের প্রথম লক্ষ্য নবনীবাবুদের মতো গুটিকয়েক সংখ্যালঘু পরিবার । তাই তাদের উপর আক্রমনের খাড়া নেমে আসতে সময় লাগেনি।
সেদিন ছিল জুন কিংবা জুলাইয়ের দুপুর, জয়িতা কিছু বুঝে ওঠার আগেই পুকুরঘাট থেকে দেখে তাদের ঘর জ্বলছে দাউদাউ করে। ঘরে দুটি অবোধ মানুষ আর একটা পোষা বিড়াল এটুকু মনে আসতেই সব কেমন ফাঁকা হয়ে যায় চোখের সামনে। তারপরে আর কিছু মনে নেই। মিলিটারি যাওয়ার পরে অজ্ঞান জয়িতার জান্তব আক্রমণে ক্ষত-বিক্ষত নগ্ন শরীরটা উদ্ধার করে গ্রামবাসী। স্বামী হিরন্ময় খবর পেয়ে যখন বাড়ি আসে তখন জয়িতা পুরোপুরি মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছে।
দেশ স্বাধীন হবার পরে জয়িতার অনেক চিকিৎসা করেও কোনো ফল হয়নি। একদিন গ্রামের লোকেরা হিরন্ময়ের পুড়ে যাওয়া বাস্তুভিটায় যে ছাপড়াঘর তুলেছিল সেই ঘরে দুটো ঘুমন্ত মৃতদেহ আবিষ্কার করে।
একটি শিশু, একজন বৃদ্ধ, একটি বিড়াল, দুটি তরতাজা তরুণ প্রাণ হারিয়ে গেল বিস্মৃতির অতল তলে। প্রশ্ন জাগে মনে এই অনাকাংক্ষিত মৃত্যু কী স্বাধীনতার জন্য উৎসর্গীকৃত নয় ?
শহিদের তালিকায় কি ওদের নাম উঠেছিল?