You are currently viewing শশীসম্ভব কাব্য- নির্ঝর নৈঃশব্দ্য

শশীসম্ভব কাব্য- নির্ঝর নৈঃশব্দ্য

সংসার হলো আসলে মুক্তিরূপী বন্ধন। রবিনাথের গানে আছে না, ‘তুমি আমার মুক্তি হয়ে এলে বাঁধনরূপে’ সেই রকম আর কি।
দুইজন মানুষ যখন একই সঙ্গে বসবাস করতে শুরু করে ক্রমশ পরস্পরের জেলখানা হয়ে যায়। বসবাস করার আগে তারা থাকে পরস্পরের বাগান, পার্ক, বনজঙ্গল, নদী, সমুদ্র, জানলা, সৈকত ইত্যাদি। প্রত্যেক মানুষ প্রকৃত-অর্থে নির্ভার একটা সম্পর্কই চায়। কিন্তু পায় না। সম্পর্কের ভারে মানুষ কুঁজো হয়ে যায়। মানুষ তো আর অ্যাটলাসের মতো মহাশক্তিধর দেবতা নয় যে পুরো পৃথিবীর ভার কাঁধে নিবে? আর সম্পর্কের ভার তো পৃথিবীর ভারের ত্রিগুণ।


ইদানীং কেন জানি শশীর কথা মনে পড়ে। তাকে মনে পড়লে আমার ভিতরে মাইলের পর মাইল শূন্য হয়ে যায়। কেন কে জানে!

কোনোদিন আমার ছোটোবেলায় লুকিয়ে আমি শশীর পিছে পিছে তার বাড়ি পর্যন্ত চলে গিয়েছিলাম। তারপর তার সঙ্গে দেখা না করেই তাদের ছাত থেকে ঘুরে চলে এসেছি আমার ঘরের ঠান্ডা অন্ধকারে।

মধ্যে মধ্যে শশীকে দেখতে ইচ্ছে করে। কিন্তু জানি, আমি তার বাসায় যেতে চাই না। সে ফেসবুক চালায় না। এইখানে আমার কাছে তার কোনো ছবি নেই। তার হাসব্যান্ডের ফেসবুক আইডিতেও তার কোনো ছবি নেই। আমি হয়তো তার এখনকার ছবি দেখতে চাই না। আমার কাছে তার একটাই ছবি আছে। সেটা চট্টগ্রামের বাড়িতে। এসএসসি পরীক্ষার মাস খানেক আগে তোলা ছবি। এবার গেলে ভাবছি সেটা নিয়ে আসবো। তারপর ক্যাকটাসের টবের পাশে রেখে দিব।
শশীর কথা মাথায় এলেই আমার মনে হয় যেনো বা রক্তের ভিতর ঢুকে গেছে নদী, তার কিছুটা রাত্রির করতরে পা রেখে দাঁড়িয়েছে একা। তখন আমি আর ঘুম যেতে পারি না, রাত জেগে দেয়ালের দিকে তাকিয়ে থাকি। আমার শ্বাসকষ্ট হয়। আমার নিশ্বাসের শব্দে ভেঙে পড়ে রাতের নৈঃশব্দ্য।


‘এক সময় জানো, বেইলি রোডে প্রাক্তন থাকতো। ঠিক কোথায় তা জানতাম না। তবে ছুটির দিনে উত্তরা থেকে বেইলি রোডে যেতাম।
‘তোমার প্রাক্তনের জায়গায় আমি হলে, আমিই তোমার কাছে আসতাম…’
‘তো সেখানে একটা আকাশগামী শপিংমল ছিলো। ওটার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতাম। অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে যখন মলটাকে পাহাড় মনে হতো তখন সে আসতো।’
‘প্রাক্তন মানে হলো ছেড়ে আসা বা ছেড়ে যাওয়া ঘর এবং জানলার গলিত ও বিগলিত স্মৃতি, যা মানুষÑ বিশেষ করে মেয়েরা কখনোই ভুলতে পারে না। মানে মেয়েরা তাদের প্রথম প্রেমের সুখ অথবা দুঃখের কোনো স্মৃতিই ভুলতে পারে না। আর খুব কম ক্ষেত্রেই ছেলেদের কাছে প্রেমের স্মৃতি গুরুত্বপূর্ণ।’
‘মধ্যে মধ্যে আমরা রমনাপার্কে গিয়ে বসে থাকতাম। বসে গাছপালা আর পাখির ডাক শুনতাম। কিন্তু সে মুখ গোমড়া করে বসে থাকতো। কারণ তার সামনে অ›ধকারÑ কই থাকবে, কী করবে, কই যাবে, কী খাবে কোনো কিছুর ঠিক নাই। আমি বলতাম, ‘এতো চিন্তা করার কিছু নাই, একটা ছোটো বাসা নিয়ে ফেলবো।’ সে বলতো, ‘তোমাকে দেখে মনে হয় তোমার কোনো চিন্তা-ভাবনা নাই।’ সে আমার উপর খুব বিরক্ত হতো। কারণ আমি হাসিখুশি থাকতাম। সে বিরক্ত হলেও আমি হেসে ফেলতাম, তখন সে আরো রেগে যেতো। আর বলতো, ‘তোমার হারানোর কোনো ভয় নাই, জীবনে কোনো সংগ্রাম নাই, দুঃখ-কষ্ট নাই, তাই এতো নিশ্চিন্তে থাকো। তোমার সঙ্গে আমার যায় না।’ এখন ভাবলে মনে হয় সে ঠিকই বলেছিলো। আমার সঙ্গে তার কোনোদিনই যায়নি আসলে। আমার বোধহয় তার সঙ্গে থাকার যোগ্যতা ছিলো না। সে তখন চাকুরি খুঁজছে সমানে। আমি নিষেধ করতাম। বলতাম, ‘আমি তো করছি। তোমার করতে হবে না। তুমি তোমার নিজের কাজ করো। একজনের বেতনে কষ্ট করে চলে যাবে।’ যখন বাসা খোঁজার সময় এলো তখন একটি মেয়ের সঙ্গে তার পরিচয় হলো। মেয়েটির বিপন্ন ছিলো। মেয়েটিকে বিয়ে করে সে উদ্ধার করলো এক প্রকার। মেয়েটি আমার মতো শ্যামলা নয়, ফর্সা-সুন্দর, দীর্ঘ চুল…’
‘তুমিও জানো যে বিয়ে না করেও তাকে সাহায্য করা যেতো। তার পাশে দাঁড়ানো যেতো।’
‘পরে বলেছিলো যে তার সঙ্গে ওর আরো আগেই পরিচয় হওয়া দরকার ছিলো। বড় দেরিতে আলাপ হয়েছে। আমার সঙ্গে তার কোনো কমিটমেন্টে যাওয়া উচিত হয়নি। আমাকে নিয়ে থাকা চলে না, স্বপ্ন দেখা চলে না। আমার সঙ্গে দূরত্ব রেখে বন্ধুত্ব চলে।’
‘দূরত্ব রেখে সব চলে, কিন্তু বন্ধুত্ব চলে না। যে ইন্দ্রিয়পরায়ণ সেইই কেবল শরীরকেই নিকটত্ব মনে করে। শরীর খুবই তুচ্ছ আর নশ্বর বিষয়। যে প্রকৃত-অর্থে ভালোবাসতে জানে সেইই জানে শুধু শরীর-নিরপেক্ষ থেকেও চিরদিন কাছাকাছি থাকা যায়। আর মানুষ যখন শরীরকেই একমাত্র আধার ভাবে তখন সে আর শান্তিপ্রাপ্ত হয় না, তার স্থিরতা সদাই ব্যাহত হয়, বারংবার সে ধৈর্যরহিত হয়ে পড়ে। রাগে-যন্ত্রণায় সবসময় অন্ধ থাকে।’
‘যাইহোক, দুঃখ আমি পার হয়ে এসেছি।’
‘তুমি আসলে কিছুই হারাওনি। কেবল যা অনিবার্য ছিলো তাইই ঘটে গেছে। তুমি কি মনে করো না যা কিছু অনিবার্য তা ঘটে যাওয়াতেই মুক্তি? আর তুমি যদি নিজেকে মানুষ ভাবো, তাহলে দেখবে প্রাণ ছাড়া তোমার আসলে হারানোর কিছুই থাকে না।’
‘মজার ব্যাপার হলো, ঢাকা শহরে অনেক বছর হয়ে গেলো। অথচ কোনো মঞ্চ নাটক দেখা হয়নি। আসলে আজ হঠাৎ মঞ্চ নাটক দেখতে ইচ্ছে করছিলো তো তাই বেইলি রোডের কথা মনে পড়ে গেলো।’

‘তারপর কোনোদিন তুমি তোমার কুসুমকুমারের সঙ্গে বেইলি রোডে মহিলা সমিতির মঞ্চে নাটক দেখেছিলে। সেই স্মৃতি নিশ্চয়ই তোমার মনে আছে? কুসুমকুমার তার ডায়েরির ২৬ আগস্টের পাতায় লিখে রেখেছিলো, ‘আজ আমরা ছাতিমফুলের গন্ধ পেয়েছিলাম…।’ সেইদিন স›ধ্যায় একটা ছাতিম গাছের পাশ ঘেঁষে যেতে যেতে তিনটা ছাতিম ফুল তোমাদের দেখে ফেলেছিলো। তোমরা ছাতিম ফুলের ঘ্রাণ নিশ্বাসের ভিতর নিয়ে পেছনের সারিতে বসেছিলে। আর খানিকপর তুমি টের পেলে তোমাদের পাশে ঘুমিয়ে ছিলো বিস্তারিত হিমালয়। আর হিমালয়ের ঘুম ভাঙছে একটু একটু করে। ঠান্ডায় তোমার বিশেষ অ্যালার্জিÑ আইসক্রিম খেলেই গলাব্যথা হয়। ফলত তুমি ঠান্ডায় জমে যাচ্ছিলে, তুমি ঠান্ডায় জমে যাচ্ছিলে। আর কাঁপছিলে। কুসুমকুমারের নাটক ভালো লাগছিলো না। কিন্তু তোমার পাশে বসে থাকতে ভালো লাগছিলো। আর ইচ্ছে করছিলো তোমাকে বুকের ভিতর নিয়ে হিমালয়কে এক লহমায় নিভিয়ে দিতে। মনে আছে তোমার সেই দিনের কথা?’
‘না, আমার কিছুই মনে নেই।’


‘আমার যে আত্মজা—তাকে নিয়ে মধ্যে মধ্যে খুব ইচ্ছে করে একটা কবিতা লিখি। কিন্তু যেমনটা লিখতে চাই, তেমনটা হয়তো কোনোদিন বিনয় লিখে ফেলেছেন এই ভেবে আর লিখি না কিছুই। আমার আত্মজার নাম তরঙ্গিণী, আর তার মায়ের নাম কুসুম। তাহাদের কাহারো জন্ম অদ্যাবধি পৃথিবীতে হয় নাই বলিয়াই হয়তো পৃথিবীতে এতো অন্ধকার।’
‘আমি অনেক দিন আগে এক শ্রাবণের রাতে তোমাকে ভেবে একটা পদ্য লিখেছিলাম, ‘ঝর ঝর ঝর ঝরনা হয়ে আকাশটা ঝরে। তোমায় দেখে মাকে আমার কেনো যে মনে পড়ে? আমার বাড়ি তোমার বাড়ি নয়তো পাশাপাশি, তবু আমি শ্রাবণধারায় ভিজতে ভালোবাসি। একদিন শ্রাবণের বৃষ্টির ভিতর তোমার নাম দিয়েছিলাম আমি ‘কুঁজো শ্রাবণ’। তুমি বললে যে তোমার নিজেকে ভিক্তর য়ুগোর ‘হান্সব্যাক অব নথার-দাম’-এর সেই কুঁজো লোকটার মতো মনে হচ্ছে, যার নাম ছিলো কসিমদো। মনে হচ্ছে তুমি কেবল আমার জন্যেই বসে থাকো গির্জার চূড়ায়।’

‘কথা ছিলো প্রতিবছর শ্রাবণ এলে অন্তত একটি সন্ধ্যা আমরা দুজন শ্রাবণের গভীর বৃষ্টির ভিতর ভিজবো। হুডখোলা রিকশায় ঘুরে বেড়াবো হলুদ আলোর ভিতর। কিন্তু আমরা এতোদিনে জেনে গেছি, পৃথিবীতে একবারই শ্রাবণ আসে।’
আমার কণ্ঠ নীল, একটি চিৎকার ছুঁয়ে তীব্র কালশিটে দাগ বেরিয়ে আসে চিত্রাভ শরীর থেকে। আমি গভীর রক্তক্ষরণের ভিতর থেকে বের হয়ে আসি, শাদা একটা বিছানায় শুয়ে থাকি তিরিশ ঘন্টা। তারপর বের হই। আমার হাত-পা কাঁপতে থাকে, স্থির দাঁড়িয়ে থাকতে পারি না। দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়াই। ভাবি, সে হয়তো তরঙ্গিনীই ছিলো, মাথাভর্তি উল্লুমেঘের মতো চুল হতো তার। আমার নাম ধরে ডাকতো আর ঘরময় ঘুরে বেড়াতো, উড়ে বেড়াতো। আমার ভাবনাজাল ছিন্ন করে প্রাক্তন আসে, যেনো বা মাটি ফুঁড়ে উঠে আসে। তার পাশে দাঁড়ানো শাদা বিছানার মতো একটা মেয়ে, দীর্ঘ চুল। সে বলে, ‘আমি তোমাকে ওর কথাই বলেছিলাম। আমরা আজকে বিয়ে করবো ঠিক করেছি।’
এইসব কথা আমার মাথায় ঢুকে না। আমি অস্ফ‚টে বলি, ‘তো করো বিয়ে।’
সে আমতা আমতা করে বলে, ‘টাকা নেই পকেটে।’
তার কথা শুনে আমার কোনো বিকার নেই। আমি চুপিচাপ শরীরের সকল শক্তি জড়ো করে হাঁটি। হেঁটে ইস্টার্নপ্লাজার কোনার একটা এটিএম বুথে ঢুকে পড়ি। চারহাজার পাঁচশো টাকা বের করে আনি। সেই টাকা তার হাতে তুলে দিই। সে হাক পেতে টাকাটা নিয়ে বুকপকেটে রাখে। সে চলে যায় তার মেয়েটি-সহ। সহসা আমার বুক থেকে তার স্মৃতিগুলি বের হয়ে রাস্তায় গড়িয়ে পড়তে চায়। আমি দুহাত বুকে ভাঁজ করে ফুটপাথে বসে পড়ি। আমার ঘুম পেতে থাকে।


‘স্বপ্ন সবসময়ই স্বপ্ন তার কাছে। স্বপ্ন সত্যি হয়নি কখনো। সে চিরদিন স্বপ্ন দেখবে। সত্যি হবে না। আইবুড়ো মহিষ কাদায় স্নান সেরে অভিসারে যাবে। সে চিরদিন স্বপ্ন দেখবে, সত্যি হবে না জেনে। বাঁশের পাতা পরস্পর সহবাসে রত। হাওয়ার কাছে পরস্পর নিবিড় হয়ে যায়। এইখানে উষ্ণ রতি আরতি তিথি। স্বপ্ন এইখানে ফুরিয়ে যায় না। এইখানে তার আর আমার শ্রেণিহীন সমাজের স্বপ্ন অমর হয়ে যায়। কোথাও গভীর বনে বনে রক্ত জ্বলে ওঠে। আর আমার হঠাৎ হঠাৎ একটা কথা মনে পড়ে যায়, জানো!’
‘কী কথা?’
‘আমি রাতের বাসে করে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম যাচ্ছি। পরদিন মানে আমার পরীক্ষা। পাঁচশো-এক নম্বর পেপারÑ শেক্সপিয়র। কপাল ভালো যে পরীক্ষা শনিবার পড়েছিলো, আমাকে ছুটি নিতে হয়নি। বাসে উঠেছি। বাস ছেড়েছে। ঠিক তখন প্রাক্তন ফোন করলো। বললো, ‘তোমাকে দিয়ে কিছু হবে না।’ বললো, ‘একজনের সঙ্গে পরিচয় হয়েছে। সে অনেক প্র্যাকটিকাল, বুদ্ধিমতী। তুমি তা না। তোমার সঙ্গে থাকা চলে না। তুমি ভীষণ ক্লান্তিকর।’ ফোন রেখে ভাবলাম পরীক্ষাটা মনে হয় ভালো হবে না। হয়তো কলম দিয়ে কোনো লেখাই বের হবে না। ম্যাকবেথ, হ্যামলেট, কিং লিয়র কিছুই না। আমার মনে হলো শুধু হ্যামলেটে নয়, পৃথিবীর কোথাও ওফেলিয়া টাইপ চরিত্রগুলি কোনো অর্থ বহন করে না। যাইহোক, হলে ঢুকলাম, চার ঘণ্টা পরীক্ষা দিলাম। বেরিয়ে এলাম। কেমন দিয়েছিলাম মনে নেই। কিন্তু রেজাল্ট বের হলে দেখলাম পাঁচশো-এক নম্বর পেপারে বি-প্লাস পেয়েছি। আর কোনো পেপারে এতো পাইনি, জানো!’


‘বাসনা আর স্বপ্ন মানুষকে বাঁচিয়ে রাখে, গতিশীল রাখে। সুখ, পরিতৃপ্তি মানুষকে জড়ে পরিণত করে।’
‘হুঁ। আচ্ছা, ছুঁলেই সব নষ্ট হয়ে যায়, তাই না?’
‘ঠিক তা নয়। একবার স্পর্শ সুন্দর। কিন্তু বারংবার স্পর্শে সুন্দর মøান হয়। তবে একবার ছুঁলে সুন্দর ফুল হয়ে ফোটে। সে আরো সুতীব্র সুন্দর। তাই সুন্দরের কাছে একবারই যেতে হয়।’
‘এই কারণে মানুষ অমর হতে পারে না। নাহয় মানুষ অমর হয়ে যেতো। পরস্পরের স্পর্শে মানুষ অমর হয়ে যেতো যদি স্পর্শে সুন্দর মøান না হতো।’
‘ঠিকই বলেছো।’
‘হয়। আচ্ছা, পরের জন্মে তুমি কী হতে চাও?’
‘পরের জন্ম যদি থাকে তবে আমি মেয়ে হয়ে জন্মাবো অস্ট্রিয়ার ভিয়েনায়, মিউজিশিয়ান হবো। আর তুমি?’
‘আমিও মেয়ে হয়েই জন্মাতে চাই। তবে লাতিন আমেরিকার কোনো দেশে। আর আমি চাই ওখানে শশীর সঙ্গে আমার দেখা হোক। আমরা দুজন ফ্রক পরে ‘আয় তবে সহচরি বলে হাত ধরে ফুল তুলতে যাবো। তার চুলের বেনিতে ঝুলে থাকবে এক একটা প্রকাÐ দুপুর।’
‘লাতিন আমেরিকা কেনো?’
‘কারণ লাতিন আমেরিকার সব দিক থেকে ভারতবর্ষেও মতোই বৈচিত্রময়।’
‘লাতিন আমেরিকার ঠিক কোথায়?’
‘আর্হেন্তিনায়। ফিল্ম-মেকার হয়ে জন্মাতে চাই। সেখানে শশীর সঙ্গে আমার পরিচয় হবে। সে ওখানকার কোনো কলেজে পড়াবে। সে অনেক সাহসী হবে। আর আমাকে ছেড়ে যাবে না।’
‘আমি ভুল বলেছি। আমি আসলে আর জন্মাতেই চাই না। মানুষ হয়ে জন্মানোর যন্ত্রণা দুর্বিষহ।’
‘আমি চাই।’
‘ভালো তো। আমার তো আসলে তেমন কেউ নেই। তাই একা একা জন্ম নিতে ভয়।’
‘কেনো তোমার তো আছে।’
‘না নেই।’
‘কেনো? তোমার কৈশোরের সেই ছেলেটা!’
‘কে?’
‘যাকে ‘সুপ্রিয়’ নামে রোজ চিঠি লিখতে। যার জন্যে গোলাপ কিনে ফেরার পথে কোতোয়ালির মোড়ে গাড়ি চাপা পড়তে গিয়েছিলে…’
‘না, কাউকেই আমি চাইনি। আমি জানি।’
‘কাকে চাইছিলে?’
‘আমি আসলে কাউকেই চাইনি।’
‘মনে হয় কাহলিলকে চাইছিলে?’
‘কাহলিল কে?’
‘কাহলিল জিবরান। তাকে চেয়েই জন্মালে না হয়। কিংবা লোরকাকে। হয়তো সেই জন্মে তুমি লোরকার সঙ্গে ফ্রাংকোর সৈন্যদের হাতে শহিদ হলে…’
‘নাহ্।’
‘তুমি কাহলিল বা লোরকার জন্যে জন্মাও। তখন তুমিও ওদের মতো কবি হবে। আর তোমার লেখা আমরা পড়বো। শশীকে তোমার লেখা পড়ে শোনাবো। যদিও সে সাহিত্যরসিক হয়ে জন্মাবে কিনা জানি না।’
‘না, এই অভিশাপ দিও না। আমি যদি জন্মাই তোমার শশী হয়ে জন্মাতে চাই। আর কেবল আমি সে হয়ে জন্মালেই তোমার পুনর্জন্মের অর্থ তৈরি হবে। কারণ সেই জন্মের শশী তোমার রক্তলগ্ন হয়ে থাকবে। তোমাকে ছেড়ে কক্খনো যাবে না। তোমার চোখের ভিতর কান্নার মতো কাঁপবে, কখনো চোখ থেকে গড়িয়ে পড়বে না।’