You are currently viewing রেফাত আলারিয়া – অগ্নিজাত কথক: গল্প যাঁর কাছে প্রতিবাদের হাতিয়ার || পার্থ দেবনাথ

রেফাত আলারিয়া – অগ্নিজাত কথক: গল্প যাঁর কাছে প্রতিবাদের হাতিয়ার || পার্থ দেবনাথ

রেফাত আলারিয়া – অগ্নিজাত কথক: গল্প যাঁর কাছে প্রতিবাদের হাতিয়ার

পার্থ দেবনাথ

“আমরা সংখ্যা নই” (We are not numbers) এই নামের একটি অভিনব ও সংবেদময় সংস্থা গঠনের অন্যতম রূপকার ও যুগ্ম প্রতিষ্ঠাতা – রেফাত আলারিয়া (Refaat Alareer)। উদ্দেশ্য – জন্মভূমি গাজা’র তরুণ প্রজন্মের লেখকদের সঙ্গে বহির্বিশ্বের লেখকদের পরিচয় করানো, পরামর্শ দেওয়া এবং গল্প বলার ভেতর দিয়ে, অনুবাদের সাহায্যে, পৃথিবীর মানুষদের কাছে প্যালেস্টাইন জাতিসত্তার কথা তুলে ধরা। প্যালেস্টাইনের সংস্কৃতি, ইতিহাস, ঐতিহ্য ও শিকড়ের গল্প বলা, সুখ-দুঃখের ছোট ছোট কাহিনী বলা, নিজভূমে পরবাসী হয়ে থাকার কথা, অন্যায় দখলদারির অনবরত সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের বিপরীতে মুক্তির আকুতির কথা বলা, ও এইভাবে কথকতার পরম্পরায় প্রতিবাদী ভাষা সৃষ্টি করার কাজে অসংখ্য ছাত্র-ছাত্রীকে অনুপ্রাণিত করেছিলেন রেফাত। রেফাত ছিলেন প্যালেস্তানী লেখক, কবি, অধ্যাপক, সাংবাদিক ও সর্বোপরি এক গল্পকার, সমাজ চিত্রকল্পের এক অগ্নিজাত কথক। ২০১৫ সালে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মানবাধিকার ও অহিংস ভাবনার শরিক, স্বাধীন লেখিকা, সাংবাদিক ও সমাজ-বিচারের সক্রিয় কর্মী প্যাম বেইলির সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে গঠন করেন “আমরা সংখ্যা নই”। এই সংগঠনে আমরণ যুক্ত ছিলেন রেফাত আলারিয়া। প্রতিষ্ঠানপন্থী সংবাদ মাধ্যমগুলি একচেটিয়া পক্ষপাতদুষ্ট হয়ে মধ্যপ্রাচ্যের সংকটের খবর প্রচারের অজুহাতে যেখানে সাজানো আখ্যান তৈরী করে চলেছে অনবরত, সেখানে শুধুমাত্র হতাহতের সংখ্যা দিয়ে সংকটের সঠিক চিত্র তুলে ধরা সম্ভব নয়। সেখানে দরকার ব্যতিক্রমী ও তথ্যভিত্তিক খবর প্রচার করা, অবহেলিত ও অধিকৃত সমাজের আখ্যান লেখা। তাই প্যাম হ্যালি ও তার সহকর্মীদের সঙ্গে যোগ দিয়ে রেফাত গড়ে তুলেছিলেন “আমরা সংখ্যা নই” নামের এই অভিনব সংস্থা। অধিকৃত গাজা ভূখণ্ডের এই প্রতিভাবান সন্তান, তাঁর জীবন উৎসর্গ করেছেন লেখা, কথকতা, অধ্যাপনা ও জনসংযোগকে জাতিসত্তা ও মুক্তিসংগ্রামের অন্যতম হাতিয়ার হিসেবে গড়ে তুলতে।

BBC, Democracy Now!, ABC News, Al Jazeera, New York Times বিভিন্ন সংবাদ সংস্থায় রেফাত আলারিয়ার প্রতিবেদনে কিছু কিছু চিত্র বারে বারে ফিরে আসে – অসহায় জাতির অন্ধকার রাত্রি যাপনের চিত্র, মুক্তির লক্ষ্যে অন্তহীন প্রতিরোধের লড়াই – নিজভূমে উদ্বাস্তু মানুষের দুঃখ দুর্দশা, আশা ভরসা, প্রতিবাদ প্রতিরোধের চিত্র, ও সর্বোপরি জীবন ও লড়াইয়ের গল্প লেখার চিত্র।

জন্ম ১৯৭৯ সালে, ইসরায়েল অধিকৃত প্যালেস্টাইনের গাজা ভূখণ্ডে – গাজা শহরের পূর্বপ্রান্তে এক ঐতিহাসিক পাহাড়ি অঞ্চল, নাম – Shuja’iyya (শুজাইয়্যা)। জন্ম মুহূর্ত থেকেই তিনি দেখেন “ক্ষুব্ধ স্বদেশভূমি”। জ্ঞান হওয়ার পর থেকেই উপলব্ধি করেন তাঁর দেশ এক “মৃত্যু উপত্যকা”, যার ঘাত প্রতিঘাত সারা জীবন তিনি বহন করেছেন।

যুক্তরাজ্যের University College London থেকে MA ডিগ্রী করেন ও মালয়েশিয়ার Putra Malaysia University থেকে PhD ডিগ্ৰী করেন ইংরেজি সাহিত্যে। ষোড়শ ও সপ্তদশ শতকের বিখ্যাত ইংলিশ কবি জন ডান (John Donne)-এর ওপর তাঁর গবেষণা ছিল। পরে গাজার ইসলামিক ইউনিভার্সিটি (Islamic University)-তে বিশ্বসাহিত্য, সৃজনশীল লেখা ও শেক্সপীয়ারের সাহিত্য বিষয়ে তিনি অধ্যাপনা করতে শুরু করেন ২০০৭ সাল থেকে।

Light In Gaza – Writings Born of Fire, একটি বইয়ের নাম – মর্মবিদারী গল্প কাহিনীর সংকলন। দখল, আগ্রাসন আর উদ্বাস্তু জীবনের সীমাহীন অনিশ্চয়তা আর দুর্দশার অবসানে এক ভবিষ্যৎ জীবন তৈরির গল্প কাহিনী – যা প্যালেস্টাইনের গাজা ভূখণ্ডে বসবাসকারী লেখক, শিল্পীদের অভিজ্ঞতার আলোয়, কঠিন ও মর্মান্তিক বাস্তবতার আগুনে রচিত। এই বইয়ের অন্যতম সম্পাদিকা, লেখিকা, সাংবাদিক ও বক্তা Jennifer Bing (American Friends Service Committee (AFSC) সংস্থার Palestine-Israel program -এর Director) একটি লেখায় রেফাত আলারিয়া সম্পর্কে বলেছেন –

রেফাতের কথা ভাবলে আমার বাবার কথা মনে পড়ে। আমার বাবাও ইংরেজি সাহিত্যে Shakespeare-এর বিষয়ে শিক্ষকতা করতেন। রেফাতের মতন আমার বাবাও তাঁর ছাত্র-ছাত্রীদের অনুপ্রাণিত করতেন, সুবিচার আর শান্তির জন্য লিখতে বলতেন, ওদের লেখা প্রকাশ করতে উৎসাহিত করতেন। বিগত আট বছরেরও ওপর রেফাতের সংস্পর্শে এসে, গল্প বলার ও কথকতার ব্যাপারে যেসব শিক্ষা আমি পেয়েছি, অসম্পূর্ণ হলেও তার একটা তালিকা লিপি আমি তৈরী করেছি। রেফাতের সঙ্গে যারা পরিচয় করার সুযোগ পান নি, আমার আশা, এই তালিকা পড়লে তারা বুঝতে পারবেন, ওকে আমরা কেন এতো miss করি।

১। “ব্যক্তিগত গল্প বলা হয়তো কঠিন মনে হতে পারে, তবুও বলো”
Light In Gaza বইএর প্রথম লেখাই ছিল রেফাতের – “Gaza Asks: When Will this Pass?” এই লেখায় রেফাত তাঁর ও পরিবারের মর্মান্তিক জীবনের গল্প বলে গেছেন। গাজা শহরের প্রান্তে তাঁর শৈশব কেটেছে শুজাইয়্যা প্রতিবেশী অঞ্চলে, ইসরায়েলি মিলিটারির ক্রমাগত আগ্রাসন আর তারকাঁটার ভেতরে বন্দি জীবনের ভেতর দিয়ে তাঁর বেড়ে ওঠা। কঠিন হলেও সেই গল্পই রেফাত লিখে গেছেন বইটির প্রথম অনুচ্ছেদের প্রতি ছত্রে।

২। “মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ কর, একটা সম্পর্ক তৈরী হলে তোমার গল্পও অন্যদের মনে স্থায়িত্ব পাবে”
২০১৪ সালে রেফাতের সম্পাদিত বই প্রকাশ হয় – Gaza Writes Back. প্রকাশকের সঙ্গে যুগ্মভাবে বক্তৃতা সফরে আসেন রেফাত, যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো ও অন্যান্য শহরে। সেই সফরে বহু মানুষের সঙ্গে ওঁর পরিচয় হয়। গাজায় ফিরে গিয়েও তাঁর নতুন বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রেখেছিলেন রেফাত। পরবর্তী সময়ে গাজায় আমন্ত্রণ করে গাজার শৈলতটে বন্ধুদের সঙ্গে নানা বিষয়ে আলোচনাও করেছেন তিনি।

৩। “তোমার নিজের জন্যে আর অন্যদের জন্যেও উঁচু মান তৈরী কর”
অধ্যাপক আর লেখক হিসেবে রেফাত বরাবরই ছিলেন উঁচুমান বজায় রাখার পক্ষে। ওঁর ছাত্ররা জানতো ওঁর কাছে ভালো নম্বর পাওয়া কত কষ্টকর ছিল। উৎসাহিত করলেও মান উঁচু রাখার কাজে রেফাত বরাবরই সচেষ্ট ছিলেন।

৪। “তোমার যদি রসবোধ, কৌতুকবোধ থাকে তাহলে অন্যদের সঙ্গে সেগুলো ভাগাভাগি করতে পিছপা হয়ো না”
রেফাতের লেখার বিষয়ে দুঃখজনক ঘটনার কথা থাকলেও তিনি কৌতুকের ছলে গল্প পরিবেশন করতেন। তাঁর অনেক গল্পেই প্যালেস্টাইনের ছোট ছোট ছেলে মেয়েরা কিভাবে ইসরায়েলের অধিগ্রহণকারী সৈনিকদের বুদ্ধির দৌড়ে পর্যুদস্ত করছে, কিভাবে ছোটরা বড়োদের সঙ্গে দুষ্টুমি করছে এইসব কৌতুকী রসদ দিয়ে ভরা থাকতো। একদিকে Hamlet থেকে উদ্ধৃতি, অন্যদিকে Seinfeld show থেকে মজার বিবরণ দিয়ে শ্রোতাদের আনন্দ দিতে রেফাত দক্ষ ছিলেন।

৫। “কখনো যদি মন খারাপ হয় অথবা মনে কোনো আবেগ আসে তাহলে সেটা প্রকাশ কোরো, লুকিয়ে রেখো না”
লেখায় কিংবা বক্তৃতায় রেফাত তাঁর অনুভব, অনুভূতি ও আবেগের কথা গোপন রাখতেন না – রাগ, দুঃখ বা অন্য যে কোনো ধরণের আবেগের ক্ষেত্রেই এই কথা সত্যি ছিল। তাঁর ছাত্রদের তিনি প্রায়ই বলতেন মনের আবেগগুলোকে লেখার ভেতর দিয়ে সঞ্চালন করতে। এই ভাবে তিনি চাইতেন নানান অনুভূতি ও আবেগের অভিজ্ঞতা থেকে প্যালেস্টাইনের আত্মসম্মান আর মুক্তির আকুতির গভীর পরশ যেন পাঠকেরা পান। শুধু মাত্র মস্তিষ্ক দিয়ে নয়, হৃদয় দিয়েও মানুষের মনকে ছোঁওয়ার কাজে গল্পকে ব্যবহার করার গভীর মানবিকতার অধিকারী ছিলেন রেফাত।

রেফাত আলারিয়া বেঁচে ছিলেন গল্প বলার জন্যে। যে গল্প চিত্রকল্প হয়ে, তার কবিতার ভেতর, প্রতিবেদনের ভেতর, সাক্ষাৎকারের ভেতর ও নানাবিধ কথোপকথনের ভেতর দিয়ে সজীব হয়ে ওঠে, মানুষের মনের ভেতরের তন্ত্রীতে অনুরণন তোলে। প্রাত্যহিক জীবনের ছোট ছোট ঘটনা, অধিবাসীদের কান্না হাসি, ঘরে ঘরে জমা হওয়া কাহিনী, প্যালেস্টাইনের সমাজ জীবনের ও সেখানকার মানুষ জনের আশা আকাঙ্খার এই সব গল্প গাজা উপত্যকার গণ্ডি ছাড়িয়ে বিশ্বময়তা অর্জন করে।

গাজার অন্তহীন দুর্দশার খবর ইংরেজিতে অনুবাদ করে বাইরের দুনিয়ায় প্রকাশ করার দুরূহ ও বিপদসংকুল গুরুদায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন রেফাত। একই সঙ্গে বহু তরুণ লেখকদের উৎসাহিত করেছেন লেখার ভেতর দিয়ে বাস্তবতাকে তুলে ধরতে, গল্প লেখা ও গল্প বলার মাধ্যমে জীবন যুদ্ধে সম্পৃক্ত থাকতে। প্রাণোচ্ছল জীবন, সহনশীলতার ঋজু প্রত্যয়, আর স্বাধীনতার নিদ্রাহীন অনুসন্ধানের অপর নাম রেফাত আলারিয়া।

তিনি প্যালেস্টাইনের ছোট গল্প সিরিজের দুটি সংকলন – Gaza Writes Back (2014) ও Gaza Unsilenced (2015) সম্পাদনা করেন, যা বিশ্বের বহু ভাষায় অনূদিত হয়েছে। একটি সাক্ষাৎকারে রেফাত বলেন “Gaza Writes Back” আগামী প্রজন্মের জন্যে একটি সাক্ষ্য সংকলনের প্রচেষ্টা। ২০০৮-২০০৯ সালে প্যালেস্টাইনের ওপর ইসরায়েলের ধ্বংস-আগ্রাসন থেকে শুরু করে তার পরবর্তী সময়ের অবিরত আক্রমণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের উপায় হিসেবে রেফাত তাঁর ছাত্রদের লিখতে বলেছেন প্যালেস্টাইনের গল্প – যে গল্পে লেখা থাকবে নিজভূমে পরবাসী হয়ে থাকা প্যালেস্টাইন পরিবারগুলির কথা। Gaza Unsilenced সম্পর্কে তিনি বলেন – ২০১৪ সালে ইসরায়েল আগ্রাসনের পুনরাবৃত্তির ঘটনায় প্যালেস্টাইনের দুর্দশার চিত্র তিনি প্যালেস্টাইনের লেখকদের দিয়ে বলানোর চেষ্টা করেছেন। পশ্চিমী দুনিয়ার প্রতিষ্ঠানপন্থী সংবাদ মাধ্যমগুলির খণ্ডিত ও বিকৃত তথ্য এবং উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রচারের জবাবে সঠিক ও যথার্থ প্রতিবেদন সারা বিশ্বে তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। অস্থির অনিশ্চিত সময়ে, সংঘর্ষময় পরিবেশের কেন্দ্রবিন্দুতে থেকে ঘটনাবলীর তথ্যনির্ভর প্রচারের ভেতর দিয়ে এবং কথকতার আঙ্গিকে সমাজ জীবনের গল্প বলার মাধ্যমে একটি সম্মিলিত প্রতিবাদী কণ্ঠ তৈরী করার কাজে ব্রতী ছিলেন তিনি।

২০১৫ সালের নভেম্বর মাসে TEDx-এর মঞ্চে রেফাতের দেওয়া একটি প্রতিবেদনের মূল সুর অনেকটা এইরকম ছিল –

আমরা যদি গল্পকে লালন করা বন্ধ করে দিই, আমাদের গল্প যদি আমরা আর না বলি, আমাদের অতীত, আমাদের পূর্বপুরুষের বলা কথা ও গল্প যদি না শুনি, তাহলে আমরা এক বিরাট শূন্যতা তৈরী করে ফেলবো। আমাদের অজান্তেই আমাদের তৈরী করা শূন্যতা ভরে ফেলবে দখলদারীরা । আমাদের অতীত, আমাদের অন্তরের অদৃশ্য জমিটুকুও ওরা দখল করে নেবে। ইতিহাস তো আসলে আমার আপনার মতন সাধারণ মানুষদের জীবনের কাহিনী। আমাদের জীবনের যেসব গল্প মুখে মুখে ফেরে, ইতিহাস তৈরী হয় সেইসব গল্পের অনুসারী হয়ে, সমষ্টিগতভাবে।

গত ৬ই ডিসেম্বর উত্তর গাজায় নিজদেশে পরবাসী উদ্বাস্তুর মতো, বোনের বাড়িতে আশ্রয় নেওয়া এই প্রতিবাদীকণ্ঠ, পরিবারসহ চিরতরে কালের কোলে ঢলে পড়লো – ইসরায়েলি মিসাইল বোমার শিকার হয়ে – এক অহিংসপ্রাণ, সচেতন, ক্রান্তিকারী প্রতিভা মাত্র ৪৪ বছর বয়সে হারিয়ে গেল তার অসমাপ্ত কাজের ডালি পেছনে ফেলে।

কিন্তু যাবার আগে সে লিখে গিয়েছিল একটি কবিতা – If I Must Die, মন্ত্রগুপ্তির এই গভীর ধ্যান দিয়ে গিয়েছিল তার সহযোগী-সহমর্মী লেখকদের কাছে, যা এখন প্রতিধ্বনিত হচ্ছে চারিদিকে, তর্জমা হচ্ছে বিভিন্ন ভাষায় – তাঁর আরব্ধ কাজকে বয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রচেষ্টায় ।
প্রতিনিয়ত ধ্বংস ও আগ্রাসনের আগুনের মধ্যে থেকে রেফাতের মনে হয়েছিল এই মৃত্যু উপত্যকায় তার নিজের জীবনও সংকটময়। একদিন হয়তো এই আগ্রাসন ও গণহত্যার শিকার হবেন তিনিও। তাঁকে হয়তো মরতে হবে ইসরায়েল-এর বোমা অথবা বন্দুকের গুলিতে। এই আশঙ্কা এতটাই বাস্তব ছিল আলারিয়ার কাছে যে ২০১১ সালেই তিনি একটি কবিতা লিখে যান, যার মূল বিষয় ছিল – “যদি আমায় মরতেই হয়, তোমায় বাঁচতে হবে আমার গল্প বলার জন্যে”।

 

If I Must Die – যদি আমায় মরতেই হয়

যদি আমায় মরতেই হয়,
তোমাকে বেঁচে থাকতে হবে।
তোমায় বাঁচতে হবে
আমার গল্প বলার জন্যে।
তোমায় বাঁচতে হবে
আমার জিনিষপত্র বিক্রি করে
একটুকরো কাপড় কেনার জন্যে
আর একরাশি সুতো,
একটা সাদা কাপড়ে লম্বা লেজ লাগিয়ে নিও।
ওই যে দেবশিশু,
গাজা শহরের কোনো এক কোণে
যখন শূন্য চোখে চেয়ে আছে ওই দূরের স্বর্গে,
অপেক্ষায় আছে তার বাবার জন্যে,
যে বাবা এক ঝলক লেলিহান শিখায় মিলিয়ে গিয়েছিল,
এক লহমায় চলে গিয়েছিল, কাউকে বিদায় না জানিয়ে, নিজেকেও না,
পড়ে থাকা নিজের নিষ্পন্দ দেহকেও “আলবিদা” জানিয়ে যায় নি,
সেই বাবার জন্যে অপেক্ষা করতে করতে দেবশিশু দেখতে পাবে সেই ঘুড়ি,
আমার জন্যে যে ঘুড়িটা তুমি বানিয়েছিলে,
লম্বা লেজ লাগানো ওই ঘুড়িটা
দূরে ওই উঁচুতে উড়ছে
আর শিশুটি এক লহমায় ভাবছে
ওখানে নিশ্চয়ই এক দেবদূত আছে যে ভালোবাসাকে ফিরিয়ে নিয়ে আসবে।
আমায় যদি মরতেই হয়,
সেই মৃত্যু নিয়ে আসুক আশা,
হয়ে উঠুক এক গল্প।

(অনুবাদঃ পার্থ দেবনাথ)

রেফাত আলারিয়ার হত্যাকারীরা তাঁর নশ্বর শরীরকে ধ্বংস করতে পেরেছে, কিন্তু পারে নি তাঁর মৃত্যুহীন প্রাণকে সংহার করতে। রেফাতের ধ্বনি এখন প্রতিধ্বনিত হচ্ছে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের মুক্তিকামী ও মুক্তচিন্তার মানুষদের মধ্যে। সহমর্মিতার এককবিন্দুতে একাত্ম হয়ে যাই আমরা সবাই। আমাদেরও বাবা-মা, মাসি-পিসি, দাদু-দিদার মুখে মুখে পরম্পরার গল্প ঘুরে ফিরে আসে, প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে প্রবাহিত হয়। শূন্যতা রোধে আমাদেরও সেই গল্পগুলি ক্রমাগত বলে যেতে হবে। নতুন রূপে, নতুন আকারে, আরো সক্রিয় ও সচেতন ভাবে। এই ভাবেই তৈরী হয় প্রতিবাদ, তৈরী হয় প্রতিরোধ। রেফাতের কথকতা যেন প্রতিধ্বনিত হচ্ছে – ওরা আমাদের মুখ বন্ধ করতে পারবে না, আমাদের নীরব করে দিতে পারবে না, আমাদের দাবিয়ে রাখতে পারবে না। বর্তমান আর ঐতিহ্যের মেলবন্ধনে সেই নতুন-পুরোনো গল্প, কথকতার মতোই মুক্তিকামী মানুষদের বলে যেতে হবে পরবর্তী প্রজন্মের জন্যে।

============================

পার্থ দেবনাথঃ প্রাবন্ধিক ও তথ্যপ্রযুক্তিবিদ

==========================