You are currently viewing রাতের মনি- কল্পনার আধারে লিখা || জয়শ্রী তালুকদার

রাতের মনি- কল্পনার আধারে লিখা || জয়শ্রী তালুকদার

রাতের মনি- কল্পনার আধারে লিখা 

জয়শ্রী তালুকদার

দিনটি ছিল ঈদের দিন।  সবে  মাত্র  আকাশে  চাঁদ  দেখা গেছে।  বাড়িতে বাবা মা ও আমি টিভির সামনে বসে  গান শুনছি।রমজানের ওই রোজার শেষে এল খুশীর ঈদ। কি আনন্দ টানা ৭ দিন ভালো  ভালো  টিভি পোগ্রাম  দেখব। তবে  সালটি ঠিক মনে নেই।  বাবা তখন গাইবান্ধার  জেলা শিক্ষা অফিসার ।  গাড়ি আছে বাবার।  অনেক আনন্দ আমার। গাড়ি নিয়ে  বাবার সাথে  অফিসের পর বেড়াতে যাই প্রায় প্রতিদিন।  তবে যাবার স্থান আমার, বাবার ও ডাইভার  সোহেল ভাইয়ের জানা। সেই  স্থান যেটা আজও মনে পড়ে বার  বার।
গাইবান্ধা  ডেভিট কোম্পানি পাড়ার গোপালদার বাসা। আমার পিসির মেয়ের দেবরের বাসা। গোপালদার বাসায় যাবার সময়  পড়ে একটা খোলা মাঠ। প্রতিদিন বিকালে সেই  খোলা মাঠে জমে ওঠে  ডেভিট কোম্পানী পাড়ার তরুনদের ফুটবল খেলা। গোপালদার বাসার পাশেই ছিল  একজন হোমিওপ্যাথি ডাক্তারের চেম্বার। বেশ নামডাক ছিল তাঁর সেই সময় গাইবান্ধা শহরে। আমার আনন্দ  বাবার অফিসের গাড়িতে করে বেড়ানো। আমার দাদামনি  বাবার গাড়িতে কোন সময়  উঠতো না।  বলতো যখন নিজের গাড়ী  হবে তখন সে উঠবে। অফিসের গাড়ি  শুধুই  বাবার জন্য  বরাদ্দ। 
  
নাটোর আর গাইবান্ধার  সংসার মা আর ঠাকুরমা সুন্দরভাবে পরিচালনা করত। নিজে সব কাজ করত। কিন্তু  হঠাৎ করে মায়ের পাকস্থলীতে ধরা পড়ল পাথর। ডাক্তার বলল যত তাড়াতাড়ি   সম্ভব  অপারেশন করতে হবে। বাড়ির কাজ করার জন্য  কাজের মানুষের দরকার। শুরু  হলো খোঁজ।  
অশোাক দা নামে একজন স্কুল  শিক্ষক  তখন বাবা মায়ের  সাথে  খুব ঘনিষ্ট ছিল। সময় পেলে তাঁরা একসাথে  হাঁটত গাইবান্ধা  শহরের রাস্তা দিয়ে।  অনেক সময়  তাঁরা হাঁটতে  হাঁটতে  চলে যেত পুরানো মন্দির গুলোতে। আমি অশোকদাকে  কখনো চোখে দেখেনি। তবে বাবা মায়ের কাছে  থেকে তাঁর অনেক গল্প শুনেছি।  দাদা মায়ের অসুস্থ তার কথা  শুনে একজন কাজের মেয়ে  যোগাড় করে দিল। মেয়েটির নাম ছিল রাতের মনি। মা বাবা তাঁকে মনি করে ডাকত। মা বাবা তাঁকে মেয়ের মতো ভালোবাসত।
গায়ের রঙ  কালো, চুল গুলো  বড় বড়, বয়স হবে পনেরো বছর।  মেয়েটিকে দেখতে এতো মায়াবী  লাগত যেটা না দেখলে কেউ  বুঝতে  পারবে না। মাকে ডাকত বৌদিভাই আর বাবাকে ডাকত স্যার ভাই।  তবে সবাইকে তুই ডাকত।
মেয়েটির বাড়ি ছিল রংপুরে। কি মিষ্টি মিষ্টি করে কথা বলত যেটা কল্পনায়  করা যেত না। তাঁর ব্যবহারে কেউ  মুগ্ধ  না হয়ে যেতেই  পারত না। অল্প কিছুদিনের মধ্যেই রাতের মনি সবার মন জয় করে নিল। মাকে কোন কাজ  করতে দিত না। ভোরবেলা  ঘুম থেকে  উঠত আর রাত এগারোটার  দিকে শুতে যেত। অবিরাম ছিল তাঁর কাজ। খুঁজে খুঁজে কাজ বের করত। মাকে কিছু  বলতেই হতো না। কিন্তু  সে কখনও ঠাকুর ঘরে প্রনাম করত না। বলত আমি দেবতা বিশ্বাস  নাহি জানি। বাবা অফিস থেকে  ফিরে আসলে বাবাকে বাতাবি লেবুর শরবত বানিয়ে  দিত। একদিন মা রান্না ঘরে গিয়ে  দেখে বাবার শরবত সে খায় আর লেবুর খোসা ব্লেন্ডারে দিয়ে  তাঁর সাথে চিনি মিশিয়ে  শরবত বানিয়ে  বাবাকে দেয়। আস্তে আস্তে  চুরি হতে থাকে মায়ের ছোট ছোট জিনিস গুলো যেমন লিপস্টিক,  কানের, শাড়ি।  কিন্তু  মা মুখে  কিছুই বলতে পারে না।  তিন মাস পেরুতেই  রাতের মনির আসল চেহারা প্রকাশ পেতে থাকে। বাবার কোয়াটারের পাশে ছিল একজন মুসলিম  ডাক্তার। সে একদিন রাতে বাবার কাছে  এসে বলে রাতের মনি সম্পর্কে  খোঁজ খবর নিতে। মেয়েটি নাকি খুব একটা ভালো হবে না বলে মন্তব্য  করে। বাবাকে বলে সে অন্য  কোন উদ্দেশ্য নিয়ে কাজ করতে এসেছে।  
সেই রাতে মা বাবা ঘুমাতে পারে না। পরদিন ছিল বৃহস্পতিবার।  প্রতি বৃহস্পতিবারে বাবা মা নাটোর আসত। রাতের মনিকে নিয়ে  আসত সাথে  করে নাটোর আমাদের কাজের সহায়তা  করার জন্য।  একবারই এসেছিল নাটোর। আমার ছোট কাকিমা দেখেছিল সে ফোনে কার সাথে  যেন কথা  বলছে। তখনও মোবাইল  ফোনের প্রচলন এখনকার মতো করে শুরু  হয়নি। সকাল মনি বলছে আর মাত্র  কটা দিন লাগবে কাজ গুলো সাজিয়ে  নিতে। কে ছিল সেই  ব্যক্তি?। বাবা মা সেই  একই নিয়মে আবার কর্মস্থল গাইবান্ধা  যায় রাতের মনিকে নিয়ে।  আমার এখনও রাতের মনির চোখের কথা  বারবার মনে পড়ে। মেয়েটির তাকানো দেখলে আমার খুব ভয় লাগতো। 
বাবা সকাল ৯ টায় অফিসে যেত।  মা আর মেয়েটি বাসায় একা থাকত। দুপুরে বাবা  বাসায়  খেতে আসত। একদিন দুপুরে বাবা বাসায়  এসে দেখে সদর দরজা খোলা।  মা অঘরে ঘুমাচ্ছে।  মেয়েটি বাসায়  নেই।  বাবার হাতে সময় কম দুপুরের খাবার খেয়ে আবার অফিসে ফিরতে হবে। সেদিন আবার অফিসে কাজের চাপ  একটু  বেশিও ছিল। মায়ের অসময়ে  গভীর ঘুম দেখে বাবা বেশ অবাক  হয়েছিল। মাকে  প্রশ্ন করলে  মা বলে আমি এক কাপ চা চেয়েছিলাম মনির কাছে ।  তারপর আমার তো কিছু  মনে নেই।  কখন ঘুমিয়ে  গিয়েছি চা খেতে খেতে  বলতে পারি না। বাবা কিছুটা অবাক হয় এবং  মনে  ভয় নিয়েই সেদিন বাবাকে অফিসের গাড়ি তে উঠতে হয়েছিল।  শুধু  মাকে বলছিল সদর দরজা ভিতর থেকে লাগানোর জন্য। 
অফিস শেষে  বাজার করে বাবার সেদিন  ফিরতে ফিরতে রাত নয়টা বেজেছিল। বাবা বাসায় এসে দেখে রাতের মনি টিভি দেখে মা পাশে বসে আছে। বাবা প্রশ্ন করার আগেই  রাতের মনি বলে স্যার ভাই  আমি পাশের গলিতে দর্জির দোকানে গিয়েছিলাম আমার জামা সেলাই  করার জন্য।  মনে কিছু  করিস না তোরা বলে একটা মিষ্টি হাসি দেয়। 
দিন চলে আপন গতিতে।  রাতের মনি মা বাবার সাথে  বসবাস  করার সময়  ও বাড়তে থাকে।  দুইবছর দুইমাস। রাতের মনির বাবা আসে বাড়িতে তাঁকে নেবার জন্য। মায়ের অপারেশন  তখন সবে মাত্র হয়েছে আমি মায়ের কাছে  গিয়েছি গাইবান্ধায়। অনেক দুর্বল আমার মা। ঠিক মতো বিছানা থেকে উঠতে পারে না। রান্না মেয়েটি করে কিন্তু একটা রান্না ও মুখে দেবা যায় না। মা একদম খেতে পারে না। আমি যদি বলি তেল কম দিয়ে  রান্না করার জন্য সেই  দিন সে বেশি তেল দিয়ে  রান্না  করে। সব কিছু  সে নিজের মতো করে করতে চায়।  কারো বারন সে শোনে না। ফ্রিজের তরকারি ইচ্ছে  মতো ফেলে দেয়।  বলে নষ্ট হয়ে  গেছে।  আমি যদি বলি কেন ফেলে দিলে না জিজ্ঞেস  করে। পাল্টা উত্তর  দেয় মনে হয়েছে  তাই। আর কথায়  কথায় মিথ্যা  বলে। বোনের বিয়ে  ঠিক হয়েছে জন্য  বাবার কাছে টাকা চায়  পনেরো হাজার।  বলে বেতন থেকে মাসে মাসে কেটে রাখার জন্য। বাবা মা রাজি  হয়। টাকা দিয়ে  দেয়া হয় তাঁর বাবার হাতে।রাতের মনি সারা দিন অন্যমনষ্ক থাকে। কাজে একদম মন নেই। সারাদিন চোখে ঘুম ঘুম  ভাব লেগে থাকে। মা তখন ঠিকমতো হাঁটতে পারে না। সারাদিন বিছানায় শুয়ে থাকে। আমি ৭দিন থাকার পর চলে আসি বিশাবিদ্যালয়ে ক্লাস করার জন্য।  কিন্তু  মন পড়ে থাকে মায়ের কাছে।
দিনটি ঠিক মনে নেই।  তবে মাসটি ছিল মে মাস। সকাল ১১ টার দিকে হঠাৎ  বাবার ফোন। দাদামনি ফোন টি ধরল। বাবা  বলল বেটা রাতের মনিকে পাওয়া  যাচ্ছে  না। বাবা দাদামনিকে  আদর করে বেটা ডাকত। আলমারি খুলে  তোমার মায়ের সাত ভরি স্বর্ন আর আমার বেতনের পুরো টাকা টা নিয়ে  গেছে।  আমরা ঘুমিয়ে  ছিলাম কিছুই বলতে পারিনা। অথচ আলমারি টি তোমার মায়ের মাথার কাছেই ছিল। একটু শব্দ হলেই  আমি আর তোমার মা জাগা পাই কিন্তু গতরাতে আমাদের ঘুমই ভাঙল না কি আশ্চর্য ব্যাপার! 
দেখ বেটা। পরিচিত সব জায়গায়  বাবা খোঁজ নিয়েছে  কিন্তু  কোথাও রাতের মনি নেই।  এমনকি অশোক দা তাঁর ঠিকানায়  যোগাযোগ  করে দেখে ঐ ঠিকানায়  কেউ নেই। 
পুরোটা বিষয় রাতের মনিদের সাজানো  একটি দল ছিল। এরকম ভাবেই  তাঁরা আগে থেকে সবকিছু জানত  এক এক পরিবার সম্পর্কে তারপর সুযোগ  বুঝে  ঢুকে পড়ত পরিবারের মাঝে।  উদ্দেশ্য  সফল হলেই তারপর বিদায়  নিত। বাবা সেদিন কথা  বলতে পারছিল না ঠিকমতো। কি যেন একটা অজানা ভয় কাজ করছিল বাবার মাঝে।  মায়ের ঘুম ভাঙ্গতে সেদিন অনেক বেলা হয়েছিল।  বাবার শরীর  টাও ছিল সেদিন অনেক দুর্বল।
 চলে যাবার সময় রাতের মনি মার কাছে  একটি চিঠি  লিখে গিয়েছিল। সেই  চিঠিতে লিখা ছিল বৌদি ভাই  আমার উপর তোরা রাগ করিস না। আমি ও আমার মা একটা অন্ধ গলিতে আছি। অন্ধকারে  আমার জন্ম। কে আমার বাবা আমি জানি না। মালিকের কথামত মা ও আমাকে চলতে হয়। কোনভাবেই আমাদের মুক্তি  নেই।  যদি কোনদিন মাকে নিয়ে  মুক্ত  আকাশে নিচে যেতে পারি,স্বাধীন  জীবনে যেতে পারি তবে তোর কাছে  যাব। ক্ষমা করিস আমাকে। পুলিশে যাস না।
ইতি
রাতের মনি। 
মা চিঠিটি পড়ে কেঁদে ফেলেছি়ল। বাবা হয়েছিল  বাকরূদ্ধ।  
সোনা, টাকা চুরি হবার  পরও  বাবা  থানায়  যায়  নাই। নিজেদের মধ্যে লুকিয়ে  রেখেছিল রাতের মনির স্মৃতি। যাক রাতের মনিকে আমার মা ভালোবাসার বাঁধনে বেঁধেছিল। আজও মা তাঁকে স্বপ্নে দেখে।  পথ চেয়ে  থাকে রাতের মনি ফিরবে।
চিৎকার দ়িয়ে বলবে বৌদিভাই আমি আর একবছরের মধ্যে  বাড়ি যাব না। এবার একটু হাঁসনা  তোরা। নয়তো আমি চলে যাইব।  বাবা মারা যাবার পর মা বলেছিল সে যদি ফিরে তবে আমি তাকেই রাখব। এর নামই  মনে হয় ভালোবাসা। যাকে কোনদিন ভুলা যায় না। হৃদয়ের মনিকোঠায় রাখা হয় অতি যত্নে, পরম স্নেহে।
*****************************