You are currently viewing রক্তের দাগ/ কল্যাণী রমা

রক্তের দাগ/ কল্যাণী রমা

রক্তের দাগ

কল্যাণী রমা

‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি

আমি কি ভুলিতে পারি

ছেলেহারা শত মায়ের অশ্রু গড়ায়ে ফেব্রুয়ারি

আমি কি ভুলিতে পারি’

সুরকার শহীদ আলতাফ মাহমুদ। গীতিকার আব্দুল গাফফার চৌধুরী।

প্রতিবছর ২১শে ফেব্রুয়ারিতে ভাষা শহীদদের শ্রদ্ধা জানাতে এই গান গেয়ে আমরা শহীদ মিনারে ফুল দিতে যেতাম। চাচীদের পরনে সাদা শাড়ি কালো পাড়। গায়ে কালো চাদর। চাচাদের পরনে সাদা পাজামা, পাঞ্জাবী। ছোট এক টুকরো কালো কাপড় দিয়ে বানানো ব্যাজ বুকের কাছে পিন দিয়ে আঁটা। হাতে ফুল। খালি পা। প্রভাতফেরি। রাত বারোটা এক মিনিটে ফুল দিতে আসতেন ভাইস-চ্যান্সেলর, নানা রাজনৈতিক দল, ইউনিভার্সিটির শিক্ষক, শিক্ষিকাবৃন্দ। সাদা আর লাল রঙে আলপনা আঁকা শহীদ মিনারের বাঁধানো চত্বর।

রীদের পর রীদে ঢেকে যেত শহীদ মিনারের সামনেটা।

আমি কয়েকবার মাত্র রাত বারোটা এক মিনিটে ফুল দিয়েছি। আমরা বাচ্চারা সাধারণতঃ ভোর ছয়টার দিকের প্রভাতফেরিতেই অংশ নিতাম। রাত বারোটা এক মিনিট থেকে শুরু ক’রে সারাদিন নানা অনুষ্ঠান হ’ত শহীদ মিনারে, জুবেরি ভবনে, নজরুল ইসলাম মিলনায়তনে।

প্রভাত ফেরির সামনের দিকে থাকত ছোট্ট পাপ্পু। তখন বছর দুই বয়স ওর। পাপ্পু কোনদিন ওর বাবাকে দেখেনি। ওর জন্ম ১৯৭২ সালের ২৯শে ফেব্রুয়ারি। আমাদের বাড়ির নাম্বার ছিল ডাব্লিউ-৬৭-সি। আর মাস্তুরামাসী অপুভাই, কেয়া, পিয়া, পাপ্পুকে নিয়ে থাকতেন আমাদের পাশের বাসায় – ডাব্লিউ-৬৭-ডি তে।

১৯৭১ সালের ২৫শে নভেম্বর রাজশাহী শহরের বাসা থেকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক; অপুভাই, কেয়া, পিয়া, পাপ্পুর বাবা; মাস্তুরা চাচীর স্বামী মীর আব্দুল কাইয়ুম চাচাকে তুলে নিয়ে যায় পাকিস্তানী সেনাবাহিনী। রাত নয়টার দিকে একটা লোক কাইয়ুম চাচাদের বাসায় গিয়ে জানায় যে তাকে বাইরে একজন আর্মি অফিসার ডাকছে। চাচা আর্মি অফিসারের সাথে দেখা করতে যান। এরপর কাইয়ুম চাচা আর কখনো বাসায় ফিরে আসেননি। তখন অপুভাই-এর বয়স ছিল সাড়ে ছয় বছর। বাংলাদেশ স্বাধীন হবার দু’দিন পরে ১৮ই ডিসেম্বর রাজশাহী শহরের কাছে পদ্মার চরে এক গণকবরে কাইয়ুম চাচার মৃতদেহ পাওয়া যায়। শার্ট আর হাতের আংটি দেখে মৃতদেহ শনাক্ত করা হ’য়।

আমাদের ফ্ল্যাটগুলোর খুব লম্বা বারান্দা ছিল। কেয়াদের বাসা আর আমাদের বাসার সদর দরজা বেশিরভাগ সময় ই খোলা থাকত। ফলে বারান্দা হয়ে যেত আরো লম্বা। অন্যান্য বন্ধুরাও যখন খুশি এসে যোগ দিত। এ মাথা থেকে ও মাথা আমরা দৌড়ে বেড়াতাম। কিত কিত খেলতাম। দাদুভাই-এর দোতালা বেয়ে ওঠা মাধবীলতা বাতাসে দুলে উঠত। ছেলেবেলা থেকে পাশাপাশি বাসায় থেকেও কোনদিন বাবা নিয়ে কথা বলতাম না আমরা। দম মনে হয় বন্ধ হয়ে আসত।

একুশে ফেব্রুয়ারির প্রভাত ফেরিতে থাকতেন ঊর্মিআপা। অঙ্কের অসম্ভব মেধাবী অধ্যাপক শহীদ বুদ্ধিজীবি হবিবুর রহমান চাচার সবচেয়ে ছোট মেয়ে। মিন্টু ভাই, রুনু আপা, সীমা আপা, ঊষা আপা, নান্টু ভাই আমাদের থেকে বড় হলেও ঊর্মি আপা পড়তেন আমাদের দুই ক্লাশ উপরে, অপুভাইদের সাথে। সবাই বলত হবিবুর রহমান চাচার অঙ্কের মাথা পেয়েছে ঊর্মি আপা। খুব ভালো পড়াশোনায় উনি।

একাত্তরের যুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিবাদী কন্ঠস্বর ছিলেন হবিবুর রহমান চাচা। নিয়মিতভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে যোগাযোগ রাখতেন। ২৫ মার্চের পরে প্রতিরক্ষা শক্তি হিসাবে ইপিআর বাহিনীর একটা অংশ ক্যাম্পাসে অবস্থান করছিল ।হাবিবুর রহমান চাচার বাসা থেকে তাদের জন্য খাবার ও অন্যান্য জিনিস পাঠানো হত। শুনেছি ওয়াহিদা রহমান চাচী তাদের জন্য নিজ হাতে রুটি বানাতেন।

কিছু রাজাকার যুদ্ধে হবিবুর রহমান চাচার ভূমিকা পাকিস্তানী আর্মিকে জানায়। বহু মানুষ ওঁনাকে ক্যাম্পাস ছেড়ে চলে যেতে বলেছিল। কিন্তু চাচা বলেছিলেন,’Like the captain of a ship I shall be the last to leave’। বিপদ সামনে জেনেও পরিবারের সবাইকে নিয়ে ‘প-১৯/বি’ নম্বর বাসায় ক্যাম্পাসেই থেকে যান হবিবুর রহমান চাচা। ১৫ই এপ্রিল ব্রিগেডিয়ার আসলাম আর কর্নেল তাজের নেতৃত্বে পাকিস্তানী আর্মি হবিবুর রহমান চাচার বাসায় এসে তাঁকে তুলে নিয়ে যায়। আর কোনদিন উনি ফিরে আসেন নি।

১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, চিকিৎসক এবং সাংবাদিকসহ বিভিন্ন পেশার প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তিদের এভাবেই নির্মমভাবে হত্যা করেছিল পাকিস্তানী বাহিনী।

দেশ যখন প্রায় স্বাধীন হতে যাচ্ছে ঠিক তার প্রাক্কালে বুদ্ধিজীবিদের হত্যা করবার নীল নকশাও তৈরী হয়েছিল। উদ্দেশ্য একটাই। যদি দেশ স্বাধীনও হয়, তবুও মেরুদন্ডটা ভাঙ্গা থাকবে। কোনভাবেই এগিয়ে যেতে পারবে না নতুন দেশ বাংলাদেশ।

পাকিস্তানী বাহিনীকে সহযোগিতা করেছিল আল-বদর, রাজাকার, আল-শামস। কিন্তু রাজাকারের দল ১৯৭১-এর যুদ্ধের সাথেই নিঃশচিহ্ন হয়ে যায়নি। আজও এইসব মীর জাফর প্রকাশ্যেই বাংলাদেশের বিরুদ্ধে স্বাধীনতার বিরুদ্ধ শক্তি হ’য়ে নির্ভয়েই সমাজে নিজেদের স্থান করে নিচ্ছে।

কিছু কিছু নৃশংসতাকে ঘৃণা করলেও কম ক’রা হয়।

রক্তের দাগ কি কথা বলে?

প্যারিস রোড দিয়ে প্রভাত ফেরি ক’রে আমরা এসে থামি জোহা চাচার কবরে। রাজশাহী প্রশাসনিক ভবনের সামনে ঘন হ’য়ে পাতায় পাতায় লেগে দাঁড়িয়ে থাকা ইউক্যালিপটাস গাছ দিয়ে ঘেরা জোহা চাচার মাজার। সুন্দর বাগান। যদিও এখন শুনি জোহা চাচার কবরের চেহারা নাকি বদলে গেছে। কবরের চারপাশ ঘিরে সেই গাছ আর নেই। পুরাতনের জন্য বুকের ভিতরটা মুচড়ে ওঠে।

১৯৬৯ সালের ১৮ই ফেব্রুয়ারি হানাদার বাহিনীর গুলিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের মেইন গেটের সামনে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছিলেন রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক ও প্রক্টর ড. শামসুজ্জোহা। তিনিই প্রথম শহীদ বুদ্ধিজীবী। দেশের গণআন্দোলন তাঁর আত্মদানেই গণঅভুত্থ্যানের রূপ নিয়েছিল। ড. জোহা হত্যার খবর ছড়িয়ে পড়লে আইয়ুব সরকারের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে তখনকার পূর্ব পাকিস্তানের সব স্তরের মানুষ ফুঁসে উঠেছিলো। উনি বলেছিলেন একটা ছাত্রের বুকে গুলি চালানোর আগে আমার উপর গুলি চালাও।

জোহা চাচার মাজারে ফুল দিয়ে আমরা যাই সমাদ্দার কাকুর সমাধিতে ফুল দিতে। লাইব্রেরীর সামনে ডানপাশ ঘেঁষে সংস্কৃতের অধ্যাপক সুখরঞ্জন সমাদ্দার কাকুর সমাধি। খোকন, খুকুমণি, শিউলির প্রিয় বাবা, চম্পামাসীর স্বামী এখানে শুয়ে আছেন। অধ্যাপক সুখরঞ্জন সমাদ্দার মুক্ত চিন্তা আর ধর্ম নিরপেক্ষতাতে বিশ্বাস করতেন। একজন অত্যন্ত জ্ঞানী মানুষ ছিলেন তিনি।

কাকু মারা যাবার পর চম্পামাসী অনেক কষ্ট করেছেন ছেলে মেয়েদের মানুষ করতে। একেবারেই অর্থনৈতিক স্বাচ্ছন্দ্য ছিল না। মাসী তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী। কিন্তু আপ্যায়নে কোনদিন কমতি ছিল না। এখনো মনে আছে লক্ষীপূজা হলেই আমরা খুকুমণিদের বাসায় হাজির হতাম। খিচুড়ি, বেগুনভাজা, বাঁধাকপি, ফুলকপির তরকারি খেয়ে বাড়ি ফিরতাম। সাথে থাকত নারকেলের নাড়ু, পায়েস। গান হ’ত। সবাই মিলে আবার জীবনটা চালানোর চেষ্টা হ’ত।

এপ্রিল মাসের ১৪ তারিখে পাকিস্তানী সৈন্যরা এসে ইউনিভার্সিটির স্টাফ কোয়ার্টার থেকে সমাদ্দার কাকুকে ধরে নিয়ে যায়, তারপর নির্মমভাবে হত্যা ক’রে। সমাদ্দার কাকুকে হত্যা করবার পর ইউনিভার্সিটির রাজাকার শিক্ষক ওঁনার চশমা এনে বাড়ির দরজার কড়া নেড়ে চম্পা মাসীর হাতে দিয়ে গিয়েছিল। মানুষের ধৃষ্টতা তার হিংস্রতাকেও অতিক্রম করে যায়।

ঢাকায় সায়েন্স লেবরেটরি থেকে আমরাও আমার বাবার মৃতদেহ পাই। ছোটবোন শ্যামার বয়স ছিল দেড়, আমার সাড়ে চার। মার সাতাশ। যেসব মানুষকে যুদ্ধ ছুঁয়ে গেছে তাদের মনে হয় ফুসফুসের মধ্যে একটা ছিদ্র হয়ে যায়। তারা আর কোনদিন অন্য মানুষদের মত করে নিঃশ্বাস নিতে পারে না।

(‘দম বন্ধ’ বই থেকে)

 

লেখক পরিচিতিঃ

কল্যাণী রমা-র জন্ম ঢাকায়। ছেলেবেলা কেটেছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে। ভারতের খড়গপুর আই আই টি থেকে ইলেকট্রনিক্স এ্যান্ড ইলেকট্রিক্যাল কমুনিকেশন ইঞ্জিনীয়ারিং-এ বি টেক করেছেন । এখন আমেরিকার উইস্কনসিনে থাকেন। অ্যাপ্লিকেশন ডেভেলপমেন্ট সিনিয়র ইঞ্জিনীয়ার হিসাবে কাজ করছেন ম্যাডিসনে।

প্রকাশিত বইঃ

আমার ঘরোয়া গল্প;

হাতের পাতায় গল্পগুলো – ইয়াসুনারি কাওয়াবাতা;

রাত বৃষ্টি বুনোহাঁস – অ্যান সেক্সটন, সিলভিয়া প্লাথ, মেরি অলিভারের কবিতা;

মরণ হ’তে জাগি – হেনরিক ইবসেনের নাটক;

রেশমগুটি;

জলরঙ;

দমবন্ধ।