You are currently viewing যে তিয়াসে সূর্য পোড়ে || শিল্পী নাজনীন

যে তিয়াসে সূর্য পোড়ে || শিল্পী নাজনীন

যে তিয়াসে সূর্য পোড়ে
শিল্পী নাজনীন

অঘ্রাণের মাঝা-মাঝির দিকে এ তল্লাটে শীত পড়ে জাঁকিয়ে। গফুর কাকার মজা পুকুরটার পানি বরফের মত ঠান্ডা থাকে এ সময়ে। পুকুরটা একে তো বাঁশঝাড়ের ছায়ায় ঢাকা থাকে বারোমাস, রোদের মুখ প্রায় দেখেই না সেটা কোনোকালে, তার ওপর আবার কচুরিপানায় পুরো ছেয়ে থাকে তার জল থৈ থৈ বুক। ফলে এ পুকুরের পানি গ্রীষ্মে যেমন থাকে গা জুড়ান ঠান্ডা, তেমনি শীতে থাকে বরফের মত হীম। সচরাচর এই পুকুরে তাই লোক নামে না তেমন, শুধু মাঘ-ফাল্গুনের দিকে পুকুরের পানি নেমে গেলে মাছ ধরার মচ্ছব লাগে গাঁয়ে। পাড়াসুদ্ধ মানুষ হুমড়ি খেয়ে পড়ে মাছ ধরার সেই মচ্ছবে । কচুরিপানার প্রতি ঝোপের শেকড়ের সঙ্গে তখন উঠে আসে বয়সের ভারে হলদেটে হয়ে আসা পেল্লায় সাইজের একেকটা কৈ। পানি সেঁচলে ওঠে ইয়া বড় বড় শিং, মাগুর, শৌল আর টাকি। এবার বুঝি মাছধরার সুযোগ আর মিলবে না মজনুর। আহা! মাছধরার নেশাটা তার অতি প্রিয়। গ্রামে মাছ ধরার মচ্ছব লাগবে, অথচ মজনু থাকবে না, ব্যাপারটা ভাবতেই কান্না পেল তার।
কচুরিপানার ঝোপের মধ্যে সামান্য একটু জায়গা ফাঁকা করে কোনোমতে নাকটা বের করে অনেকক্ষণ হল সে ডুবে আছে পুকুরের এই বরফ ঠান্ডা পানিতে। শীতে তার শরীর জমে আসছে প্রায়। অতি কষ্টে বুক চিরে বের হতে চাওয়া দীর্ঘশ্বাসটা আবার গিলে ফেলল মজনু। ততদিন পর্যন্ত বাঁচবে কি না তারই কোনো ঠিক-ঠিকানা যেখানে নাই এবার, সেখানে সে অযথাই ভেবে মরছে মাছধরার মৌসুম নিয়ে! সাধে কি আর বুড়ো বাপটা তাকে দামড়া বলে চেঁচায়! শীতে দাঁতে দাঁত বাড়ি খাওয়ার শব্দটা হজম করতে করতে নিজেই ভাবল সে। ভোর রাতের দিকে গ্রামে ঢুকেছিল মজনু। উদ্দেশ্য ছিল বাপের সঙ্গে দেখা করা, মা বেচারা তার চিন্তায় কাঁদতে কাঁদতে অন্ধপ্রায়, তাকেও চোখের দেখাটা একবার দেখে যাওয়ার ইচ্ছে ছিল। আজকাল মজনুর দিন কাটে লুকিয়ে চুরিয়ে, গা ঢাকা দিয়ে। মুক্তিবাহিনীতে যোগ দেওয়ার পর থেকেই আর সহজে গ্রামে আসে না মজনু। গত রাতে কাছাকাছি এক জায়গায় অভিযান চালিয়েছিল তারা, একটা মিলিটারি ক্যাম্প ব্রাশ ফায়ারে উড়িয়ে দিয়েছে গত রাতে। মিলিটারিদের অস্ত্রগুলোও লুট করা গেছে কাল। অস্ত্রগুলো দলনেতার জিম্মায় রেখে তারা গা ঢাকা দিয়েছিল রাতেই। আপাতত দুয়েকদিন আর ওদিকে ভিড়বে না তারা, নতুন অপারেশনের তারিখ না জানা পর্যন্ত যার যার মতো গা ঢাকা দেওয়ার নির্দেশ আসায় মজনু ভেবেছিল এই সুযোগে বাড়ি থেকে একবার ঘুরে যাবে। ইচ্ছে ছিল রাতের অন্ধকারে গাঁয়ে ঢুকে দিনটা লুকিয়ে কাটিয়ে দেবে বাপ-মা’র সঙ্গে, তারপর রাত নামলে আবার সে বেরিয়ে পড়বে পথে। কিন্তু এর মধ্যে যে এমন বিপত্তি বাঁধবে, পাকিস্তানি মিলিটারি যে সাতসকালেই হানা দেবে তাদের গ্রামে, সে আর কে জানত!
সবে তখন সূর্যটা তার লালচে লাজুক মুখ বের করে উঁকি দিয়েছে হারুন কাকাদের তালগাছের মাথার ওপর দিয়ে, তার তেরছা রোদের মিষ্টি ফলা সবে এসে ঝিকিয়ে পড়েছে মজনুদের শনের ঘরের চালে আর শিশিরে ভিজে অনেকটা পিছল হওয়া উঠোনটার দীঘল পিঠে। মজনুর মা’র ভাতেও বলক এসে গেছে ততক্ষণে, পাতিলের মধ্যে তুমুল আনন্দে টগবগ ফুটতে শুরু করেছে চালের মিছিল, পাশে ডালের পাতিল থেকে ধোঁয়া উঠছে দারুণ। সঙ্গে পেঁয়াজ-রসুনের তেলেভাজা গন্ধটা মজনুর নাকে যেন অমৃতের মতো লাগছে এসে। এমনিতেই বরাবরের পেটুক সে, তারপর কতদিন পেট পুরে খাওয়া হয় না তার, মুক্তিবাহিনীতে যোগ দেওয়ার পর থেকে তার দিন কাটে পথে-প্রান্তরে। নাওয়া, খাওয়া, ঘুম, কোনোকিছুরই কোনো মা-বাপ নাই। বহুদিন পর তাই মা’র হাতের রান্নার সুবাসটা সে বিছানায় শুয়ে শুয়েই টেনে নিচ্ছিল নাকে। বহুদিনের পরিশ্রান্ত শরীর লেপের ওম ছেড়ে উঠতে চাইছিল না এই শীতের ভোরে। কিন্তু পেটের মধ্যে খিদেটাও গুতোচ্ছিল খুব। মাত্রই উঠব উঠব করছিল মজনু। হঠাৎই শোরগোল ভেসে এল। মিলিটারিরা ঘিরে ফেলেছে সারা গ্রাম। বের হওয়ার পথ নাই কোনো। মজনু মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিয়েছে, সেটা কীভাবে যেন চাউর হয়ে গেছে গ্রামে। তার বুড়ো বাপ সারা গ্রামে যদিও বলে বেড়িয়েছে যে মজনুর মামার ভারি অসুখ, মজনু তার মামার বাড়ি গেছে, দু’চারমাস থাকবে সেখানেই। কিন্তু সে কথা কেউ মনে হয় বিশ্বাস করেনি বড় একটা। আজকাল গ্রাম থেকে মজনুর মতো জোয়ান ছেলেদের হঠাৎ উধাও হয়ে যাওয়া সহজভাবে নেয় না কেউ। হয় সে মিলিটারির হাতে ধরা পড়ে গুলি খেয়ে মরেছে, নয়তো মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিয়ে যুদ্ধে গেছে, সবাই এমনটাই ভেবে নেয়। এবং এই ভাবনায় ভুল থাকে খুব কম। ফলে মজনুর অনুপস্থিতিতে তার বাপ যতই মজনুর মামার অসুখের গপ্প ফাঁদুক, ভেতরে ভেতরে সবাই জানে মজনু আশলে কোথায় গেছে। আর গাঁয়েরই গাদ্দার কেউ ঠিক তার মিলিটারি বাপদের কাছে গিয়ে দিয়ে এসেছে মজনুর খবর। অগত্যা ধড়মড়িয়ে উঠল মজনু। উঠতে হল। নইলে মিলিটারির হাতে ধরা পড়তে হবে। প্রাণ তো যাবেই সঙ্গে অত্যাচারের মাত্রা বাড়লে অনেক তথ্যও বের হয়ে যাবে পেট থেকে। তাতে দেশের স্বাধীনতা আসবে না সহজে, জয়ের স্বপ্নকুঁড়িটা ফুল হয়ে ফুটতে দেরি হবে ঢের। তারা যুদ্ধে নেমেছে দেশের মানুষের মুক্তির জন্য। সেটাও পিছিয়ে যাবে অনেক। কিন্তু মজনু পালাবে কোথায় এখন? সারা গ্রাম তো ঘিরে ফেলেছে পাকিস্তানের হারামখোর মিলিটারি জোয়ানেরা! অগত্যা বুড়ো বাপ আর মাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে পড়িমড়ি ছুটল মজনু। পেছনে পড়ে থাকল তার মায়ের হাঁড়িতে টগবগ ফুটতে থাকা ভাতের মিছিল আর দারুণ ধোঁয়া ওঠা ডালের পাতিল। ঘরের পেছন দিয়ে দিকভ্রান্তের মত ছুটল মজনু। খানিকদূর যেতে না যেতেই খাকি পোশাক পরা মিলিটারির দল চোখে পড়ল। রাইফেল বাগিয়ে তারা এদিকেই আসছে, মজনুকে তখনো তারা ঠাওর করতে পারেনি। মজনু আবার উল্টোদিকে দৌড় লাগাল অগত্যা। দিশেহারা লাগল। কী করবে ঠিক করতে পারল না প্রথমটায়। সামনে পেছনে, ডানে বামে যেদিকেই যাবে সেদিকেই শত্রু এখন, নিশ্চিত মৃত্যু। হাতে সময়ও নাই একদম। অতঃপর সাত-পাঁচ না ভেবে সরসরিয়ে বাড়ির পেছন দিকে গফুর কাকাদের এই মজা পুকুরেই নেমে পড়ল মজনু। কতক্ষণ হল? ঠিক জানে না সে। তার কাছে মনে হল অনন্তকাল। শুয়োরের বাচ্চা মিলিটারিরা গ্রামে ঢুকেছে তো ঢুকেছেই! বের হওয়ার নাম-গন্ধও নাই আর। পুকুরের মধ্যে নাক ডুবিয়ে কাঁহাতক আর থাকা যায় এই শীতে! শরীর পুরো জমে যাচ্ছে তার। তার ওপরে আছে মাছেদের অত্যাচার। কৈ, শিং, মাগুর, টাকি আরো কী কী সব মাছ কে জানে, সমানে ঠোকড়াচ্ছে তাকে সেই তখন থেকে। মাছগুলো নির্ঘাত মরা ভেবেছে মজনুকে। তারা খাদ্য ভেবে তাকে খাওয়ার আয়োজনে ব্যস্ত। মজনু যে প্রতিবাদ করবে, সামান্য নড়াচড়া করে নিজের বেঁচে থাকার প্রমাণ দেবে, সে উপায় নাই। এরমধ্যেই সে তাদের বাড়ির দিক থেকে ধোঁওয়া উঠতে দেখেছে, গুলির শব্দ শুনেছে। তাদের বাড়িটা সম্ভবত পুড়িয়ে দিয়েছে, নইলে ধোঁওয়া অত ওপরে ওঠার কথা নয়। তা পোড়াক। বাড়ি পুড়িয়ে দিলে সময় গেলে আবার ঘর উঠবে ভিটেয়। কিন্তু গুলির শব্দ? তার বুড়ো বাপটাকে কি মেরে ফেলেছে তাহলে? আর তার মা? মাকেও কি?…
আর ভাবতে পারে না মজনু। শরীরের মতন তার বুকের ভেতরটাও হীম হয়ে আসতে চায় শঙ্কায়।
অনেকদিন পর একমাত্র ছেলেকে পেয়ে আনন্দে আত্মহারা হয়ে উঠেছিলেন মজনুর মা আকলিমা। ছেলের অভুক্ত, শুকনো মুখ আর কোটরাগত চোখ দেখে কেঁদে বুক ভাসিয়েছিলেন তিনি রাতে। বহুদিনের সাধনায় প্রায় শেষ বয়সে জন্ম নেওয়া তার একমাত্র সন্তান মজনু। যক্ষের ধন তার। সেই সন্তানের এমন দশা তিনি সহ্য করতে পারেননি দেখে। সূর্য ওঠার আগেই তাই বিছানা ছেড়ে চুলো ধরিয়েছিলেন মজনুর মা। আজকাল চোখে ভালো দেখতে পান না তিনি। মজনুর জন্য কেঁদে কেঁদে আরো খারাপ অবস্থা হয়েছে চোখের। তবু নিজের কাজটুকু নিজেকেই করতে হয় তার। চলে-ফিরে বেড়াতে হয়। নইলে তেমন তো কেউ নেই, যে দেখেশুনে রাখবে তাদের । ইচ্ছে ছিল একমাত্র ছেলেটাকে বিয়ে-থা দেবেন, বউ এসে হাল ধরবে সংসারের। সে আর হল কই! কী যে যুদ্ধ বাঁধল দেশে! তার সহজ-সরল, বোকাসোকা ছেলেটা ক্ষেতের কাজ ফেলে, হাল আর লাঙল ফেলে অস্ত্র তুলে নিল হাতে, নাম লেখাল গিয়ে মুক্তিবাহিনীতে। এখন ছেলের চিন্তায় বুক কাঁপে তার, অজানা আশঙ্কায় সারাক্ষণ সিঁটিয়ে থাকেন নিজের ভেতর। অনেকদিন পর ছেলেকে দেখে, তার অভুক্ত মুখের দিকে তাকিয়ে নিজেকে আর সামলাতে পারেননি তিনি। অঝোরে কেঁদে চলেছেন সেই ভোররাত থেকে। শব্দ করেননি, পাছে মজনুর আগমনের সংবাদ জেনে যায় কেউ। কাউকে বিশ্বাস নাই এখন। কে যে কোথায় ওঁৎ পেতে আছে, মিলিটারিদের কাছে গিয়ে খবর দিয়ে আসবে কখন, তার কিচ্ছু ঠিক নেই। ছেলেকে দুটো খাইয়ে কোনোমতে দিনটা পার করতে পারলেই হয়, অন্ধকার নামলেই মজনু আবার চলে যাবে। আবার কবে ফিরবে, কিংবা আদৌ ফিরবে কি না সেটা নিয়তিই জানে শুধু। ফজরের নামায পড়েই তাই রান্নায় বসেছিলেন আকলিমা। ডাল হয়ে গেছিল, চালের মধ্যে দুটো নতুন আলো আর বেগুন সেদ্ধ দিয়ে ভাতও বসিয়ে দিয়েছিলেন চুলায়, ঠিক তখনই কোত্থেকে ছুটে এল মিলিটারির ঝাঁক। তার ছেলেটাও কোনোদিকে না তাকিয়ে বিছানা ছেড়ে পড়িমরি ছুটল ঊর্ধ্বশ্বাসে। মজনুর বাপ তমিজদ্দি তখনও বারান্দায় শুয়ে রোদ তাপাচ্ছিলেন। অঘ্রাণের শীতে ভোরের মিষ্টি রোদটা তার বুড়ো হাড়ে আরাম দিচ্ছিল দারুণ। আচমকা শোরগোল শুনে তমজিদ্দি উঠে বসলেন ধচমচিয়ে। চোখের কোনা দিয়ে দেখলেন মজনুর ঊর্ধ্বশ্বাস ছুটে যাওয়া। চোখ কচলে আকলিমার দিকে তাকাতেই দেখলেন আকলিমাও তার মতই হতবিহ্বল তাকিয়ে আছেন ছেলের অপসৃয়মান ছায়ার দিকে। তারা কিছু বুঝে ওঠার আগেই গুলির শব্দ শুনলেন কয়েক দফা, চিৎকার চেঁচামেচি, ধুপধাপ পায়ের আওয়াজ ভেসে এল কানে, আর তার খানিক বাদেই কোত্থেকে বাড়িতে দুদ্দাড় ঢুকে পড়ল মিলিটারির ঝাঁক। বুড়ো তমিজদ্দির দাড়ির গোছা চেপে ধরল এক তাগড়া মিলিটারি। বাজখাঁই গলায় জিগ্যেস করল, আয়ে বুড়হা, তেরা বেটা কাঁহা হ্যায়?
মিলিটারি দেখে এমনিতেই তরাসে গলা শুকিয়ে গেছিল তমিজদ্দির, ধমকে সেটা মিইয়ে গেল আরো। মিইয়ে যাওয়া গলায়, প্রায় ফিসফিসিয়ে তমিজদ্দির গলা দিয়ে যে বাক্যটি বের হল, তার সহজ অর্থ হল, আমি জানি না।
মিলিটারি জওয়ানদের অত সময় নাই, ধৈর্যও নাই যে বুড়ো তমিজদ্দির পেছনে অধিক সময় ব্যয় করবে তারা। তারা দ্বিগুণ জোরে গর্জে উঠে বলল, বেত্তমিজ বুড়হা, জলদিছে বাতাও তেরা বেটা কাঁহা রাহা! এসকে ছাওয়া তমকো আভি স্যুট করকে তেরে ছের কা খুলি তাবাহ কর দেংগে!
বুড়ো তমিজদ্দি খানিক আগেই গুলির শব্দ শুনেছেন, তার দৃঢ় বিশ্বাস মজনু আর বেঁচে নেই। খানিক আগে মজনু যেদিকে দৌড়ে গেছে, গুলির শব্দটা ঠিক ওদিক থেকেই এসেছে। কাজেই মজনুর বেঁচে থাকার কোনো সম্ভাবনাই নাই আর। মজনু বেঁচে থাকলে তাকে বাঁচানর জন্য হয়ত মুখ খুলতেন তমিজদ্দি। কিন্তু ছেলেই যেখানে বেঁচে নেই, সেখানে তো হারানোর আর কিছু নাই তার। তিনি আগের মতোই নিচুস্বরে বললেন, মুঝে কুছ মালুম নেহি।
হ্যাঁচকা টানে তমিজদ্দির দাড়ির একগোছা উপড়ে ফেলল এক মিলিটারি সেনা। আরেকজন উপড়ে ফেলল তার তমিজদ্দির একটা চোখ। বাজখাঁই গলায় আবার চেঁচিয়ে উঠল, বাতাও তমকো বেটা কাঁহা!
যন্ত্রণায় কাটা ষাঁড়ের মত মাটিয়ে পড়ে গোঙাতে থাকলেন তমিজদ্দি। বাঁ চোখের কোটর থেকে গলগলিয়ে রক্ত নেমেছে তার।
আচমকা এতসব ঘটনায় হতবুদ্ধি হয়ে গেছিলেন আকলিমা। অদূরে চুলোর পাশে মূর্তিবৎ বসেছিলেন তিনি এতক্ষণ। পাথর হয়ে গেছিলেন পুরো। বোবা হয়ে দেখছিলেন সব। তার কেবলই মনে হচ্ছিল বাস্তবে নয়, স্বপ্নে ঘটছে এসব। স্বর ফুটছিল না তার মুখে। কিন্তু তমিজদ্দির গোঙানি আর কোটর থেকে বেরিয়ে আসা গলগলে রক্ত দেখে আচমকা ডুকরে উঠলেন তিনি, স্থান-কাল-পাত্র ভুলে দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরলেন বুড়ো তমিজদ্দির রক্তমাখা শরীর। মিলিটারিরা ততক্ষণে বুঝে গেছে এখানে বৃথাই সময় নষ্ট করছে তারা। পাখি উড়ে গেছে ঢের আগে। বুটের শক্ত লাথিতে তারা আকলিমা বেগম আর তমিজদ্দিকে দূরে সরিয়ে দিল ফুটবলের মত। তারপর ফিরে যাওয়ার জন্য পা বাড়াল। দু কদম গিয়েই কী ভেবে ফিরে এল আবার। তারপর দাঁতে দাঁত চেপে বলল, খিনজির কা বাচ্চুঁ ছব মুক্তিফৌজ বন গ্যায়া, ছব জায়ে বাংলাকা আদমি হ্যায়। খিনজির কা বাচ্চুঁকো আচ্ছি তরহা বান্ধো!
বলতে বলতেই মজনুদের ঘরে আগুন দিল তারা। তমিজদ্দি আর আকলিমাকে হাত-পা বেঁধে ঘরের ভেতরে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়ে দরজা লাগিয়ে দিল তারা বাইরে থেকে। আগুনের শিখা মুহূর্তেই গিলে নিল তমিজদ্দি আর আকলিমাসহ মজনুদের পুরো বাড়ি। অদূরে দাঁড়িয়ে গল্পগুজব করতে করতে পুরোটা দেখল মিলিটারিরা। আগুনের শিখা ফুঁড়ে বেরিয়ে আসা তমিজদ্দি আর আকলিমার চিৎকার উপভোগ করল তারা দীর্ঘক্ষণ। গোয়াল থেকে ছুটে যাওয়া গরুদুটোকে ধাওয়া করল কেউ কেউ। দারুণ ফূর্তিতে হেসে গড়িয়ে পড়ল তারা, তারপর ফাঁকা গুলি ছুড়ে চলে গেল তাদের জিপে চড়ে, ধূলো উড়িয়ে।
মজনুর মনে হল অনন্তকাল সে ডুবে আছে গফুর কাকার মজা পুকুরের কচুরিপানার নিচে। জমে হীম হওয়া শরীর অবশ প্রায়। আর কিছুক্ষণ থাকলে নির্ঘাৎ মারা পড়বে সে, মিলিটারির গুলির ভয়ে পুকুরে নেমে শেষে পুকুরেই মরে পচে উঠবে তার লাশ, মাছেরা খুবলে খাবে, কেউ হদিস পাবে না তার আর। তাদের বাড়ির দিক থেকে ওঠা ধোঁয়াটা সে ধীরে ধীরে স্তিমিত হতে দেখল অবশেষে। গুলির শব্দও থেমেছে অনেকক্ষণ। কেমন সুনসান নীরবতা নেমেছে গ্রামে এই সকালেই। কী করবে ভাবল মজনু। আরো কিছুক্ষণ পুকুরে থাকলে সে এমনিতেও শীতে জমে যাবে। তারচে ওপরে উঠলে বরং বাঁচার কিছুটা আশা আছে, যেহেতু কাছে-পিঠে কোনো মানুষের সাড়াশব্দ নাই আপাতত। অতঃপর ধীরে ধীরে সাঁতরে ওপরে উঠল মজনু। পুকুরপারের ঝোপের মধ্যে ঢুকে লুকিয়ে পড়ল চুপচাপ। শরীরের কাপড়গুলো একে একে খুলে পানি ঝরিয়ে নিল চিপে। ঝোপের মধ্যে ঢুকে পড়া চিলতে রোদ্দুরে খানিকটা উষ্ণতা পেল শরীর। আপাতত এই ঝোপের মধ্যেই লুকিয়ে থাকতে হবে তাকে। ঠিক কী ঘটেছে গ্রামে, বুঝতে হবে সেটা। রাত না নামলে সে গ্রাম থেকে বেরোতে পারবে না আজ আর। কিন্তু গফুরকাকার এই মজা পুকুরটা বিশেষ একটা ব্যবহার করে না কেউ। ফলে এখানে কারো আসার সম্ভাবনা খুব কম। সেক্ষেত্রে কী করে গ্রামের হালচাল বুঝবে মজনু? তখনই কথাটা মাথায় এল তার। গফুর কাকাদের ঘরের পেছন দিকে ঘন বাঁশঝাড়। এই বাঁশঝাড়ের ভেতর দিয়ে গফুর কাকার ঘরের পেছনে গিয়ে কোহিনূরকে একবার খুঁজে পেলেই হবে। কোহি ঠিক তাকে সব খবর যোগাড় করে এনে দেবে। আর যোগাড় করতেই বা হবে কেন। গ্রামের কোথায় কখন কী হয় সে খবর হাওয়ায় ওড়ে, এতক্ষণে সবাই ঠিক জেনে গেছে কী হয়েছে আদতে। অবশ্য কোহিনূরকে যদি মিলিটারিরা ধরে নিয়ে যায়, কিংবা আরো খারাপ কিছু ঘটে তার সঙ্গে, সেক্ষেত্রে কাজটা কঠিন হয়ে যাবে মজনুর জন্য। কথাটা ভেবে অজান্তেই দীর্ঘশ্বাস পড়ল মজনুর। সময় মানুষকে দিয়ে কত কিছুই না করিয়ে নেয়! কোহিনূরকে নিয়ে এমন অশুভ ভাবনাও তাই এখন ভাবতে হয় মজনুকে! অথচ এই কদিন আগেও কোহিনূরকে নিয়ে কত স্বপ্ন ছিল তার, ছিল কত অতুল অনুভব!
বাঁশঝাড়ের মধ্যে সেঁধিয়ে ধড়ে যেন প্রাণ পেল মজনু। গায়ের কাপড়গুলোও অনেকটা শুকিয়ে এসেছে ততক্ষণে। শরীর উত্তাপ ফিরে পেয়েছে অনেকটাই। চুপচাপ দাঁড়িয়ে এখন কী করবে সেটাই ভাবছিল মজনু। এখনই গফুরকাকার ঘরের ওদিকে গিয়ে কোহিনূরকে ডাকবে, নাকি সন্ধ্যা পর্যন্ত অপেক্ষা করবে, সেটা ভাবতে ভাবতেই হঠাৎ কান খাড়া করল মজনু। বাঁশের শুকনো পাতার ওপর দিয়ে হেঁটে এদিকেই আসছে কেউ! মর্মর শব্দ আসছে কানে। ক্ষীণ শব্দটা ধীরে ধীরে স্পষ্ট হতে হতে এদিকেই এগিয়ে আসছে ক্রমশ। শব্দের উৎসমুখ বুঝে আড়াল নিল মজনু। খানিক পরে অবাক হয়ে ফিসফিসিয়ে বলল, কোহি!
চমকে তাকাল কোহিনূর। ভূত দেখার মত চমকে উঠে বলল, তুমি!
তুই এই বাঁশঝাড়ে ক্যা? গলার স্বর যদ্দুর সম্ভব নিচু রেখে বলল মজনু।
গিরামে মিলিটারি আইছিল, জানো না?
হ জানি। মিলিটারি কি চইলে গেছে?
গেছে মনে কয়। গিরামে বলে মুক্তি ঢুকছে, তাই মিলিটারি আইছিল তাগের ধরতি। তুমি গিরামে আইছ কহন?
এইতো, আইছিলাম খানিক আগে। তুই এক কাম কর না কোহি, মিলিটারি গেছে কি না ইকটু খোঁজ নে তো যায়া, আর পারলি আমাগের বাড়িত য্যায়া আব্বা আর মা’র খবরডা আইনে দে।
সিডা নিয়ে চিন্তে কইর না, খবর আইনে দিচ্ছি। কিন্তু তুমি যে মুক্তিবাহিনীত যোগ দেছ, আমারে সিডা কও নাই, ক্যা? গাঁয় আইছ, একবার দেহাডা পর্যন্ত কর নাই! কোহিনূরের কণ্ঠে অভিমান ঝরে।
এসব কি এহুন কওয়ার সুময় কোহি? আগে যা, খোঁজ-খবর নিয়ে আমাক জানা, যে ক’রেই হোক আইজ রাইতের মদ্যি আমারে গিরামেত্তে বাইর হতি হবি!
যাচ্ছি!
অভিমানে গলা ধরে আসে কোহির। মজনুটা এমন ছিল না। কবে এমন বেদিশা হল সে! কোহিনূরের কান্নাকেও সে এভাবে পায়ে দলতে শিখল কবে! দ্রুতপায়ে মুখে আঁচল চেপে বাঁশঝাড় পেরিয়ে বাড়ির দিকে যায় কোহিনূর। গ্রামে মিলিটারি এসেছে বুঝে তার মা আর সে বাঁশঝাড়ের আড়ালে লুকিয়ে ছিল সকাল থেকে, সব সুনসান হলে তার মা বাড়িতে গেছেন খানিক আগে, তাকে বলেছেন আরো কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে তবে যেতে। প্রয়োজনে তার মা-ই ডেকে নেবেন তাকে ব’লে গেছেন। তার বাপ গফুর সাত-সকালে উঠেই ক্ষেতের কাজে গেছিলেন, সেই কারণে তার বাপের গায়ে এসবের আঁচ লাগেনি সম্ভবত। মজনুর জন্য প্রয়োজনে জীবন দিতে পারে কোহিনূর। আর এ তো সামান্য খবর যোগাড় করা। বাড়িতে গিয়ে মা-কে কোথাও দেখতে পেল না কোহিনূর। বাড়ির ভেতর থেকেই উঁকি দিয়ে বাইরেটা দেখার চেষ্টা করল সে। মজনুদের বাড়ির সামনে জটলা দেখল সে। মা আছেন সেখানে, গ্রামের আরো অনেকেই আছেন। মিলিটারি নেই। ভালো করে খেয়াল করল কোহিনূর। না মিলিটারি নেই। সম্ভবত তারা চলে গেছে গ্রাম থেকে। বেশ অনেকক্ষণ আগেই অবশ্য জিপের আওয়াজ পেয়েছিল তারা, তার পর পরই তার মা-ও বাঁশঝাড়ের আড়াল থেকে বেরিয়ে বাড়ির দিকে এগিয়েছিলেন। পায়ে পায়ে সাহস করে কোহিনূরও এগোল অগত্যা। বোঁটকা একটা গন্ধ লাগল নাকে। গন্ধটা কিসের? জটলাটার কাছে যেতেই তাদের কথাগুলো কানে এল কোহির। গ্রামের অনেককেই গুলি করে মেরে রেখে গেছে মিলিটারিরা। কাউকে কাউকে ধরে নিয়ে গেছে। কোহিনূরের বয়সি মেয়েদের যাদের ধরতে পেরেছে নিয়ে গেছে সঙ্গে করে। কিন্তু তমিজদ্দি কাকা আর আকলিমা কাকির সঙ্গে ঘটা বিভৎসতা গ্রামের মানুষের কল্পনার সীমা ছাড়িয়ে গেছে। এভাবে জ্যান্ত পুড়িয়ে মারাটা সহ্য করতে পারছে না কেউই। গন্ধে নাকে-মুখে আঁচল চাপা দিয়ে তারা আলোচনা করছে ব্যাপারটা নিয়ে। এত নৃশংসতা কেউ কখনো দেখেনি তারা। অনেকেই কাঁদছে, ভয়ে, শোকে, থমকে গেছে সবাই। মাকে নিয়ে তাড়াতাড়ি বাড়ির পথ ধরল কোহিনূর। কী করে এই খবরটা সে মজনুকে দেবে, ভেবে পেল না কিছুতেই। বাড়িতে ঢুকে উঠোনের কোনে ব’সে রইল সে অনেকক্ষণ। অনড়। চোখের জল শুকিয়ে গেছে তার। অধিক শোকে পাথর হয়ে যায় মানুষ, শুনেছে সে। কিন্তু মজনুকে এই খবরটা কীভাবে দেবে সে? কীভাবে গিয়ে সে দাঁড়াবে মজনুর সামনে! অবশেষে উঠল কোহিনূর। বাঁশঝোপের প্রায়ান্ধকারে সেই থেকে ব’সে আছে মজনু। মশার কামড় খাচ্ছে বেচারা। কতদিন তার পেটপুরে খাওয়া হয় না কে জানে! গায়ের জামাকাপড়ও ভেজা তার, দেখেছে কোহিনূর। চুপিচুপি ঘরে গিয়ে মায়ের নজর এড়িয়ে বাপ গফুরের একটা শুকনো পাঞ্জাবি নিল সে, হোক ছেঁড়া, তবু শুকনো তো! একটা চাদর নিল খুঁজে-পেতে। রান্নাঘরে ঢুকে একটা গামলায় সে ভাত নিল খানিকটা, রাতের বাসি কড়কড়া ভাত, সাথে বাসি তরকারি। জগে পানি নিতে গিয়ে থমকাল কোহিনূর। এতকিছু একবারে নেওয়া ঠিক হবে না তার। কারো চোখে পড়তে পারে। পাঞ্জাবি আর চাদরটা গায়ে ফেলল সে, কেউ দেখলে ভাববে ধুতে নিচ্ছে, গামলাটা নিল একহাতে, কেউ জিগ্যেস করলে যেন বলা যায় গোয়াল ঘরে যাচ্ছে সে, গরুকে খাওয়াবে। মজনুর গ্রামে থাকার বিষয়টা কোনোমতে চাউর হয়ে গেলে তাকে আর বাঁচান যাবে না হয়ত এ দফায়।
ভাতের গামলাটা কোহিনূরের হাত থেকে প্রায় ছিনিয়ে নিল মজনু। গোগ্রাসে গিলতে থাকল গপাগপ। সেই ফাঁকে দৌড়ে গিয়ে পানি এনে দিল কোহিনূর। মুহূর্তেই খাওয়া শেষ করল মজনু। দম ফেলে বলল, কী খবর, ক ইবার!
মিলিটারি চইলে গেছে। ব’লে মুখ নামিয়ে নিল কোহি। চোখ বেয়ে জল গড়াল টুপটাপ।
মিলিটারি গেছে, সিডা আমি জানি। আর সব খবর ক। আমাগের বাড়ির দিক গিছলি? আব্বা-মা’র কী খবর ক?
তুমাগের বাড়িত আগুন লাগায়া দেছে মিলিটারিরা। পুইড়ে গেছে সব। কিছু নাই আর।
আর আব্বা-মা? তারা কোনে? কতা কইসনে ক্যা? আব্বা-মা কোনে? মাইরে ফ্যালাইছে তাগের, ত্যায় না? আমি গুলির শব্দ শুনিছি ‍ওদিকতে!
উপর-নিচ মাথা নাড়ে কোহিনূর। মুখ দিয়ে কথা সরে না তার। কান্নার গমকে শরীর ফুলে ফুলে ওঠে। চোখ দিয়ে জল পড়ে টপটপ।
আব্বা-মা’র লাশ কোনে? পইড়ে আছে বাড়িত? তালি তো আমার আর লুকো থাকলি চলবিনে রে কোহি! দাফন-কাফনের ব্যবস্থাডা তো করতি হবি অন্তত!
ব’লেই পা বাড়াতে যায় মজনু। জাপটে ধরে তাকে থামায় কোহিনূর। বলে, তুমার ওসব নিয়ে ভাবা লাগবিনানে। গিরামের লোকজন করবিনি ওসব। তুমি সাঁঝলাগার আগে এ জাগাত্তে বাইর হবানা, আমার দোহাই লাগে, খবদ্দার বাইর হবা না তুমি!
কী কইস রে কোহি! আমার বাপ-মা মইরে পইড়ে আছে আমার ভিটেয়, আর আমি তাগের দাফন-কাফনের ব্যবস্থাডাও করব না!
কাকা-কাকির দাফন-কাফনের ব্যবস্তা গিরামের সবাই মিলে করবিনি সুময়মতো, তুমি এহুন এইজাগাত্তে বাইর হলি বাঁইচে ফিরতি পারবানানে আর। তুমাক এহুন বাঁচতি হবি, এই দ্যাশের জন্যি, আমার জন্যি! যারা চইলে গেছে তাগের জন্যি তুমি দুয়া কর আল্লার কাছে! হেনতে তুমি বাইর হবা না একদম, কথা দেও আমাক!
মাটিতে লুটিয়ে পড়ে মজনু। পাগলের মত কাঁদে। কিন্তু শব্দ পাছে বাইরে চলে যায়, কেউ টের পেয়ে যায় তার উপস্থিতি, কোহিনূর তাই আঁচল দিয়ে চেপে ধ’রে মজনুর মুখ। এখানে বেশিক্ষণ থাকা নিরাপদ নয় তার বা মজনু কারো জন্যই। মা তার খোঁজ করবে যে কোনো সময়, তাকে খুঁজে না পেলে এদিকটাতে যদি চলে আসে, তাহলে সর্বনাশ হয়ে যাবে। এককান দুকান হয়ে ঠিক গ্রামে ছড়িয়ে যাবে মজনুর এখনো গ্রামে থাকার খবর। মজনুকে বুঝিয়ে-শুনিয়ে অগত্যা চলে যায় কোহিনূর। মজনুর বাপ-মাকে পুড়িয়ে মারার খবরটা ইচ্ছে করেই গোপন করে সে মজনুর কাছে। অতটা সহ্য করতে পারত না মজনু, ভেবে সে শুধু মৃত্যুর খবরটাই দেয় মজনুকে। বাপ-মা মারা গেছেন এটুকুই শুধু জানুক মজনু, কীভাবে সেটুকু না হয় তার কাছে গোপনই থাকুক আপাতত!
সন্ধ্যা নামতেই গ্রামটা নীরব হয়ে যায় আরো। নিঝুম হয়ে আসে চারদিক। সকালে ঘটে যাওয়া নৃশংসতার শোকে গ্রামটা যেন ঝিমিয়ে গেছে একদম, ঘন অন্ধকারে ডুবে গেছে পুরোপুরি। সাবধানে বাঁশঝাড়ের আড়াল থেকে বের হয় মজনু। হাতে খানিক আগে কোহিনূরের দিয়ে যাওয়া খাবারের পোঁটলা। এ বেলায় আর গলা দিয়ে খাবার নামেনি তার। কিন্তু বাস্তবতা বড় কঠিন। খাবারটা তাই নষ্ট না করে সঙ্গে নিয়েছে মজনু। তাকে বাঁচতে হবে। আর বাঁচতে হলে খেতেও হবে তাকে। হাঁটতে থাকল সে সাবধানী, শ্লথ পায়ে। কিন্তু গ্রাম ছেড়ে যাবার আগে একবার নিজের ভিটেটা দেখার লোভ সে ছাড়তে পারল না কিছুতেই। অন্ধকারে শাপগ্রস্তের মত সে এগিয়ে গেল ‍নিজেদের বাড়ির দিকে। শূন্য ভিটে। কালো কালো ছাইয়ের স্তুপ, বোঁটকা গন্ধ ছড়িয়ে আছে বাতাসে। কিছু নেই, কেউ নেই! অথচ কালও সব ছিল, সবাই ছিল। মা ছিল, বাবা ছিল, সাজান একটা সংসার ছিল এখানটায়। অথচ আজ! অসীম শূন্যতা গিলে খেতে চায় মজনুকে। অন্ধকারে সে এগিয়ে যায় তাদের রান্না করার খোলা জায়গাটার দিকে। এদিকটাতে পোড়েনি তেমন। মিলিটারিরা আগুন দিয়েছে তাদের থাকার চারচালা শনের ঘরটাতে। এদিকটা প্রায় অক্ষতই আছে। হাতড়ে সকালে তার মা আকলিমার রান্না করা ভাতের পাতিলটা খুঁজে পায় মজনু। ডালের পাতিলটা উল্টে আছে পাশেই। ভাতের পাতিলটা খোলা চোখে তাকিয়ে আছে অপলক। তার ভেতরে থাকা সাদা সাদা ভাতগুলো অন্ধকারে স্পষ্ট তাকিয়ে থাকে মজনুর চোখে। চোখ ফেটে জল আসে মজনুর। বুকভেঙে আসা কান্নায়। হাঁটুমুড়ে ব’সে পড়ে মজনু। মুঠো করে একমুঠো ভাত তোলে সে পাতিল থেকে। নাকের কাছে নিয়ে গন্ধ নেয়। মা’র রান্না করা ভাত। মা নেই। পাতিলভর্তি ভাত এখনো পড়ে আছে তেমনই। কেউ খায়নি। সে নয়, বাবা নয়, মা নয়। ভাতগুলো আনমনে উঠোনে ছড়িয়ে দেয় মজনু।
দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে হাঁটতে থাকে অন্ধকারে। রাতের মধ্যেই অনেক দূরে চলে যেতে হবে তাকে। একবারও পেছনে না ফিরে হাঁটে মজনু। পেছনে পড়ে থাকে তার পোড়া ভিটের শূন্য শরীর, গফুর কাকাদের মজা পুকুর, বাড়ি আর বুকভরা ভালোবাসা নিয়ে অপেক্ষমান কোহিনূরের ঝাপসা অবয়ব। সহসা দৃঢ় হয় মজনুর পথচলা। আবার ফিরবে সে, এই গাঁয়ে, এই ভিটেয়, এই কোহিনূরের কাছে। সেদিন তার হাতে থাকবে একটি লাল-সবুজ পতাকা, থাকবে স্বাধীনতা নামক একটি টকটকে সূর্য। তাতে লেগে থাকবে তার গেঁয়ো বাপ-মা আর তার মত অসংখ্য মজনুদের বুকের তাজা রক্ত। শপথে দৃঢ় হয় মজনুর চোয়াল। একটি সূর্যের প্রত্যাশায় দৃঢ় হয় তার পথচলা।

=================