You are currently viewing যে জীবন কিছু কণ্ঠহীন পাখির|| সত্যজিৎ সিংহ

যে জীবন কিছু কণ্ঠহীন পাখির|| সত্যজিৎ সিংহ

যে জীবন কিছু কণ্ঠহীন পাখির

সত্যজিৎ সিংহ

মাঙলেনের চাকরি চলে যাওয়ার কারণ শুনলে বাঙালিরা হাসবে, আমিও শুনার পর থেকে হাসতে আছি, যে ছেলে আমেরিকা থেকে শূন্যে মিসাইল ছুড়লে চিনের বড় একটা শহর ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়ে যাবে সেই খবর রাখে, সেই মিসাইলের নামও জানে, স্বয়ং চিনের আর্মি জেনারেল সেই মিসাইলের নাম জানে কিনা সন্দেহ আছে- সেই মাঙলেনের চাকরি চলে গেছে বাড়ি থেকে নির্ধারিত দিনে ছুটি শেষ করে চাকরিস্থানে জয়েন না করার অপরাধে, তাও তাকে ৪৮ ঘন্টা সময় দেয়া হয়েছিল, তারপরও সে জয়েন করতে ব্যর্থ  হয়েছে, কারণ হিসাবে সে যদি বলতো মায়ের অসুখ, তার বস তাকে নিরধিদ্বায় আরো একদিনের ছুটি মঞ্জুর  করে দিতেন, মায়ের অসুখের কথা শুনলে কোন সে পাষাণ আছে যার বুক কাঁপে  না ! যদি বলতো- জায়গাজমির হেকারত থাকায় সে একা উপস্থিত বুদ্ধি দিয়ে কোন দিক সামাল দিতে পারে নি, এইটাও তার বস মেনে নিতেন, যদি বলতো ঘর পুড়ে গেছে আগুনে কিংবা গরু চুরি হয়ে গেছে –গ্রামদেশে যে ঘটনাগুলি প্রায়ই হয়ে থাকে – বস তবু তাকে রাখতেন, চাকরি নট করে দিতেন না এইটা নিশ্চিত , কিন্তু সে যখন কারণ দেখালো- আষাঢ়  মাসে আম্বাকুচির প্রথম তিনদিন মেইতেইরা কেউ বাড়ির বাহিরে গিয়ে থাকে না, যেতে যদি হয় তবে তিনদিন পরে যেতে হবে – মোবাইল ফোনে এইটা শুনার পর তার একসময়কার বাসদ করা বস কী উত্তর দিয়েছিলেন, তা আমরা শুনি নি ঠিক, কিন্তু  মুখটাকে ভেংচি দিয়ে   কপালটাকে কুঁচকে তিনি যে পরবর্তী কদিন বন্ধুমহলে নতুন একটা “কুতুব” নিয়ে হাজির হয়েছেন বলে নিজেকে একটু চামে ভাব নিয়ে ভাবেসাবে থাকবেন- সেইটা চোখ বন্ধ করে   আমরা কল্পনা করে ফেলেছি।

তার যে চাকরি নট হয়ে গেছে সে কিন্তু মুখে আজো  বলে নি। প্রায় ছয়মাস কেটে গেছে। তাকে জিগালে সে বলছে, তার কোম্পানির উপর মামলা হয়েছে, মামলার হাজিরা চলছে কোর্টে । তার কোম্পানির মালিক নরওয়ের উত্তরে আর্কটিক মহাসাগরে জাহাজে করে কয়েক মাসের জন্য  ছুটি কাটাতে গেছেন। ফিরতে ফিরতে বছর খানেক লেগে যাবে । উত্তর মেরুতে নেট নাই। মালিক এখনো কোম্পানির উপর মামলা টামলা নিয়ে কিছুই জানেন না। তিনি দেশে থাকলে কিংবা লন্ডনে থাকলেও,  যেহেতু তিনি সারা বছরই সেখানে থাকেন –সরকার তার কিছুই করতে পারতো  না । কারণ স্বয়ং প্রাইম মিনিস্টারের ছেলের সাথে তিনি শেয়ারে বিজনেস করেন। 

প্রাইম মিনিস্টারের ছেলের বিজনেস পার্টনার যিনি ,তিনি যদি এক বছর অজ্ঞাতবাসে থাকেন যোগাযোগহীন, তারপরেওতো সরকার তাকে মামলা দিতে চারবার ভাববে। প্রাইম মিনিস্টারের ছেলের বিজনেস পার্টনার বলে কথা   !  পার্টনার মানে বন্ধু। বন্ধুত্বের উপর বেঈমানি করবে কেউ ! এইসব কথা মাঙলেনকে কথা প্রসংগে বলতে পারতো কেউ। কিন্তু বলে নি। কারণ আসল সত্যতো আমরা সেইদিনই জেনে গেছি। যেদিন মাঙলেনকে  তার কোম্পানির বস মোবাইল ফোনে তার চাকরি নট করে দিলেন সেইদিন দিবাগত রাত প্রায় আড়াইটার সময় আমাদের গ্রামের কুলাউড়া ডিগ্রি কলেজে পলিটিক্যাল সায়েন্স  নিয়ে পড়া সেকেন্ড ইয়ারের  অচিরা আমাকে মেসেঞ্জারে বার্তা পাঠালো এইভাবে “ কা, মাংগুর খবর জানো নি ? আজকালকার কলেজে পড়ুয়া ছেলেমেয়েরা মেইতেই ভাষার চাইতে লোকাল বাংলাতেই স্বাচ্ছ্যন্দ্য বোধ করে বেশী। ভাষা একটা হইলেই হইল। ভাইয়ের জায়গায় যদি ব্রো হয়, পিসি মাসির জায়গায় আন্টি, ম্যাডামের জায়গায় ম্যাম- তাহলে মেইতেই ভাষার জায়গায় বাংলা হলে আপত্তি কোথায় ! আমার অতসব এলারজি নাই ভাষা নিয়া। ভাষা একটা  মাধ্যম মাত্র।   যোগাযোগের জন্যই ভাষার প্রয়োজন।  যাই হোক, আমি অচিরার মেসেজ   দেখামাত্রই রিপ্লাই দিতে দেরি করি নি। হঠাত অজানা আশংকায় মনটা দুরুদুরু করছিল। কিন্তু এই একটু আগেইতো মাঙলেনকে মান্ডপে দেখে এলাম। একসাথে রথের জয়দেব চংবি ( রথের নাচ) করলাম। এক সারিতে বসে খিচুড়ি খেলাম। অচিরাওতো মান্ডপে আমাদের সাথে ছিল। কই তখনতো কিছু বলে নি । আর বড় কোন দুর্ঘটনা হয়ে থাকলে এতক্ষণে নিশ্চই  খবর পেয়ে যেতাম। মাত্র বাইশ ঘরের ছোটোমোটো একটা গ্রাম। কারো ঘরে বাচ্চা কাঁদলে কয়েক মিনিটেই সে খবর আশপাশ থেকে ঘরে ঘরে পৌঁছে যায়। তারপর পরের দিন সেই বাচ্চার  মাকে নসিহত দেয়া শুরু হয়। বাচ্চা জন্ম দিলেই মা হওয়া যায় না। এইভাবে কেউ দুধ  খাওয়ায় ! এত গরমের মধ্যে কাঁথা  সুপ্পি ( জড়ানো) করে কেউ !বাচ্চা কান্দে ক্যান কান্দে ক্যান ! কাশুবি !  ( ছিনাল)   ঠিকমতো হাত দিয়ে ধরতেই জানে না সে আবার মা হবে !

ভররাতের নিস্তব্ধতা চারিদিকে। চ্যাপচ্যাপা গরম ফেলেছে। আষাঢ় ঢুকে শেষের পথে প্রায়। তবু এবার বৃষ্টি ছাড়া ছাড়া। এরকম করলে ক্ষেত বাড়ি সব চাংগে উঠবে। জুইতমতো ঝমঝমিয়ে একটানা ৩/৪ ঘন্টা নামিয়ে দিলে  ঝাক্কাস হয়ে যেতো। কৃষকের চোখে জল /রাজার আসন টলমল ।

অচিরাকে ফিরতি মেসেজ পাঠালাম,  “ কিতা অইছে” । বড় কোন কিছু যে ঘটে নি তা একরকম নিশ্চিন্ত হলাম। হলে এতক্ষণে এই ভর রাতে দুপুরবেলার ময়মনসিঙ্গা বস্তির শোরগোল পড়ে যেতো। অচিরা ফিরতি মেসেজ পাঠালো ,” কা , তোমার মাংগু মামার তো লারি লাপ্পা অই গেছে। যাক, এই লারি লাপ্পা শব্দটি দিয়ে অচিরা আমাকে প্রায় আশ্বস্ত করে দিল। ধন্যবাদ দিতে হয় এই জেনারেশনের ছেলেমেয়েদের। এই  দুঃখ কষ্টের দেশে প্রতিদিন নানা ঘটনার ভীড়ে কিছু  কিছু এমন শব্দ এসে মিশেছে যে ঐ একটি দুটি শব্দ দিয়ে গোটা ৩০ পাতার ব্যাপারটাকে তুচ্ছ করে দেয়া যায়। যেমন কদিন আগে স্কুলের ছাত্রদের সাথে  পুলিশের এক গ্যাঞ্জাম লেগেছিল। ছাত্ররা ব্যানার বানিয়েছিল এরকম, “ পুলিশের গোয়া মারি “ । আরেকটা অনলাইন পত্রিকা সরকারি দলের এক উঠতি নেত্রীর আস্ফালন দেখে শিরোনাম করেছিল এরকম “ চায়ের চাইতে পেয়ালা গরম “। নিউজের নীচে কমেন্টস বক্সে এক জন লিখেছিল “ উনারতো টাংকি ছ্যাদা “। আরেকজন লিখেছিল “ সুদানি ড্রিল মেশিন দিয়ে তৈরি আপেল জুসের তাজা গন্ধ ছড়ানো ছোট্ট কিওব, যার গভীরতা অনন্তকালের । মানুষগুলা পারেও বটে ! কার কপালে কি বিশেষণ  জুটবে সেইটা একমাত্র তার ভাগ্য ছাড়া আর কারো জানার উপায় নাই।  

  মাঙলেনের সাথে  “লারি লাপ্পা”  শব্দটা বলার কারণ আছে।   সে যখন মেট্টিক পরীক্ষার্থী  ছিল তখন ফ্রম ফিল আপ করার টাকা তার বাপ তাকে দেয় নি। সেও এজন্য বাপকে কোন অভিযোগ করে নি। টাকা দিতে না পারলে যে তার ফাইনাল পরীক্ষা দেয়া হবে না ,এজন্য কোন দুশ্চিন্তার ছাপও তার মধ্যে দেখে নি কেউ। সে  বাদে বাকী   সবারই দেয়া হয়ে গেছে। কয়েকবার তারিখ দেয়ার পরও তার  সেই একই উত্তর – বাপ বলেছে পরে দেবে।  যেদিন শেষ ডেইট সেদিন   আর থাকতে না পেরে স্কুলের হেডমাস্টার টেনের  ক্লাসে চলে আসেন। তখন সেকেন্ড পিরিয়ডে মকদ্দস স্যারের ইংলিশ গ্রামার চলছিল। মকদ্দস স্যার তখন বরাবরের মতোন টেন ক্লাসের সবচেয়ে সুন্দরী মেয়ে বিথিকা দত্তকে টেবিলের পাশে ডেকে এনে পুরো শরীর চেয়ারে ফেলে ঘাড়টাকে তেরছা  করে পুবদিকের দেয়ালের মাথার উপর যেখানে কে জানি সবুজ কচুপাতা ছ্যাচা দিয়ে লিখেছিল “ জাসদে ধরলে খবর আছে “, সেই দিকে তাকাবেন না তাকাবেন না  বলে যতবারই চেষ্টা করেন   কিন্তু গুলাম  চোখ  ততবারই যেন তাকে সেইদিকে জোর করে বিঁধে,  তো সেই উপর থেকে চোখ নামাতে নামাতে তিনি বিথিকা দত্তের ফর্সা, পান পাতার গড়নের মতোন মুখের উপর এসে শান্ত হওয়ার চেষ্টা করেন, যেন তৃষ্ণায়  ক্লান্তিতে হাঁপাতে থাকা এক পথিকের সামনে থির কালো জলের দিঘি।  লেখাটা কে লিখেছিল জানে না কেউ। হতে পারে কোন দুষ্টু ছাত্রের কাজ। কিন্তু তাই বলে এটা মকদ্দস স্যারের ইশকুলে কেন! তাও আবার তিনি যে ক্লাসে সর্বাধিক সময় অতিবাহিত করেন সেই ক্লাসে ! একেবারে চোখের সামনে ! ডাইনে ঘুরালে চোখে লাগে বামে ঘুরালে চোখে লাগে । যেদিন প্রথম তিনি দেখেন সেদিন ইশকুলের পিছনের হলুদ পচা পানির ডোবার পাশ থেকে গোটা কচুবন উজাড় করে ,ছাত্ররাও নতুন একটা দায়িত্ব পেয়ে হেইয়ো হেইয়ো করে গোটা দেয়ালজুড়ে তাজা কচু ছ্যাচতে ছ্যাচতে বিশাল সবুজের ক্যানভাস লেপে দেয়। কিন্তু লাভ হয় না তাতে । যতবারই মুছা হয় ততবারই যেন সীসার মতোন এইটা জ্বল জ্বল করে ।    যেন সাদা চুনকাপ দেয়ালের পিঠে  তাজা সবুজ বুলেটের একটা একটা করে গুলি গেঁথে  দিয়েছে কেউ। শেষে পাশের ক্লাসে ক্লাস নেয়া  আলীগড় পাস করা মৌলভী স্যার মকদ্দস স্যারের ছাত্রদের হই হল্লা দেখে মকদ্দস স্যারের ক্লাসে  এসে মকদ্দস স্যারের অতি উত্তেজনায় ঘাম জবজবা অবস্থা দেখে বেশ অবাক হয়ে যান, তিনি কিছু না বলে দাঁড়িয়ে থাকেন। জ্বল জ্বল করা লেখাগুলোর দিকে  কিছুক্ষণ  তাকিয়ে  তিনি মকদ্দস স্যারকে হেসে হেসে বলেন, আপনে তো ভুল করছইন মিয়া ! ইনো অত যুদ্ধ করা লাগে না। যদি আপনে শুরু তাকি লিখতা “  “জাসদে” ইকটা ঠিক রাখিয়া “ধরলে” তাকি “ধর”  রাখিয়া , “ লে” রে দান্তন্য বানাইয়া আর এর আগে এ কার রে “ই” , এ কারের জেগাত ম্যালা জেগা ফাঁক  আছিলো , তহন অইল অনে “ জাসদে ধরইন” তারপরে একটানে “খবর” শব্দটা মুছিয়া এর ঠিক উপরে লিখতা “ ঘুমাইয়া” , “আছে” সাবেক থাকুক। তহন গোটা লাইন অইল অনে “ জাসদে ধরইন ঘুমাইয়া আছে “ । মৌলভী স্যারের এমন সাক্ষাত সমাধান দেখে মকদ্দস স্যার বোধ হয় ভ্যাবাচেকা খেয়ে যান। হাতের কাছে এত সহজ একটা সমাধান রেখে তিনি কিনা সাইবেরিয়ার বরফে হাঁসফাঁস  করছিলেন এতক্ষণ।

 মৌলভী স্যারের দিকে তার ফ্যাল ফ্যাল করে তাকানো দেখে ,সেদিনের ক্লাসের যে বিবরণ দিচ্ছিল দিলিপ আমাকে , সে বলতে চাইল এরকম,  মকদ্দস স্যার যেন মৌলভী স্যারের সামনে পড়ে  “ অক্সিলিয়ারি ভারবের পরে যে মেইন ভারব বসে সেই সহজ ভাত খাওয়া পানি খাওয়ার মতো নিয়মটা ভুল করে যেন চুদুম বনে গেছেন “ । কিন্তু সেইটা লোকদেখানো অভিনয় কিনা সে নিয়েও দু চারজনের সন্দেহ হয়েছিল। কারণ এর কদিন পর মকদ্দস স্যার আবারও সেই আগের মতোন উদাসী, বিষাদে থ্যাতলানো মুখ, যেন তার সারা মুখেই কেউ লিখে দিয়েছে , “ জাসদে ধরলে খবর আছে” আর সেই লেখা মুছবার জন্য তিনি কচুর দলা হাতে নিয়ে সর্বশক্তি দিয়ে নিজের গাল নাক কপাল থুতা থ্যাতলে দিচ্ছেন। পক্সের ফেলে যাওয়া সমস্ত রস শুষে ফেলা এক একটা গর্ত , চাপার উপর বিশ্রীভাবে ঢেউ দেয়া দুইটা হাড়, যেন বার্লিন  ওয়াল ভাঙার পর বেআবরু  হয়ে বের হয়ে থাকা দুইটা মরিচা ধরা রড। চোখ দুটো কোটরাগত, গভীর কুয়ার তলে টলমল করা মাঘমাসী আশাহীন দুপুর যেন। এক সময় বাম রাজনীতি করা, এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে রাজপথে তুমুল স্লোগান দেয়া এই নিঃসঙ্গ , এখনো বিয়ে না করা বাপের বয়সী যুবক কিংবা স্যারের জন্য হয়তো সুন্দরী বিথিকা দত্তের মায়া হয়। তার স্নিগ্ধ ,শান্ত চোখের দিকে তাকিয়ে লোকটা যে পৃথিবীর  যাবতীয় অস্থিরতাকে নাক দিয়ে বেয়ে পড়া সর্দির ঝুলকে ছুড়ে ফেলার মতোন  ছুড়ে ফেলে দিয়ে গাড় রৌদ্রের ছায়াপড়া অপরাহ্নের থির দিঘির জলকে খুঁজে , বিথিকা দত্ত তা বুঝে। সেও তখন তার লম্বা জিরাফের মতোন গলাটাকে একদিকে কাত করে নিঃসঙ্গ লোকটাকে দেখবার সুযোগ দেয়। এমনকি মাঝেমধ্যে কোমরটা একটু বাঁকিয়ে  যৌবনের প্রদশরন করবার সুযোগটাও সে হাতছাড়া করে না। সে সবসময়ই চায় দেয়ালের ঐ লেখাটাকে যেন তার শরীর দিয়ে  ঢেকেঢুকে রাখতে পারে, যেন   মধ্যবয়সী  যুবক কিংবা স্যারের বুকের ব্যাথাগুলো সে খানিক সময়ের জন্য হলেও লাগব করে দিতে পারে। কিন্তু দেয়ালের দিকে সে চলে গেলে তার পশ্চাতদেশ থাকবে ছেলেগুলার পিছনে ,এইটা আরো অস্বস্তিকর । পরে এরা নানান পদ্য জুড়ে দিয়ে তার জীবনের বারোটা বাজিয়ে দেবে না তার কি গ্যারান্টি আছে ! কাজীবাড়ির তাদের দু ক্লাস সিনিয়র রাবেয়া আপু লেখাপড়াই বাদ দিয়ে দিল। প্রেমে সাড়া দেয় নি বলে তার ক্লাসের এক ছেলে পদ্য বানালো “ ঢুকাও বেগুন / জ্বালাও আগুন/ ভর্তা ঝাল ঝাল / চুপ্পুত চাপ্পুত লালাখাল “। বেচারি রাবেয়া ইশকুল ছুটির পর তার খালার বাড়ি থেকে কয়টা বারোমাসী বেগুন হাতে করে বাড়ি যাচ্ছিল, সেই দিন থেকে তার জীবনে বেগুন নেমে আসল অভিশাপ হয়ে।

 যাই হোক , সেদিনও বিথিকা দত্ত মকদ্দস স্যারের সামনে দাঁড়িয়ে একটু বোধ হয় লাস্যময়ী ভাব আনার চেষ্টা করছিল, বরাবরই যেরকম করে থাকে। ঠিক সেসময় কাবাব মে হাড্ডি হয়ে ক্লাস্রুমে প্রবেশ করেন হেড স্যার তবারক উদ্দিন মিঞা । সাদা পাঞ্জাবি, দেশভাগে  ঐপাড় থেকে আসা , পান মুখে অবিরাম, ছোটমোটো শরীর। কিন্তু গলা যেন আহত খাটাশ , থমথমে , যেন এক্ষুণি ঝাঁপিয়ে পড়বে। কোন অনুমতি টনুমতির ধার না করে “ ইকটা কিতা ক্লাস টেন  নি “  বলে তিনি  যখন ভিতরে এসে পড়েন, তখন বিথিকা দত্ত চমকে যায়, হেড স্যারকে   আচমকা দেখে তার  লাজুক চোখজোড়া যেন টুপ করে  ভাদ্র মাসের ধীর নদীর জলে পড়ে যায়। মকদ্দস  স্যারের তেমন কোন  প্রতিক্রিয়া হয় না।  হেড স্যারকে ক্লাসে দেখার পর  তিনি স্বাভাবিক ভাবেই উঠে দাঁড়ান । তবারক উদ্দিন মিয়া অভিজ্ঞ লোক। মানুষ চিনতে তার ভুল হয় না। মকদ্দস সাহেবকে তিনি একলা নির্জন রুমে কোন মেয়েমানুষের সাথে দেখলেও যে মকদ্দস সাহেবের কাছ থেকে খারাপ কিছু হবে  না এই নিশ্চয়তা তার আছে। সমস্ত ক্লাসে থমথমে ভাব চলে আসে। হেড স্যারের হাতে ফ্রম ফিলাপের নীল শিট আর রেড লিফ কোম্পানির কলম। ছাত্রগুলা বুঝে যায়, কেন হঠাত তাদের ক্লাসে স্বয়ং হেড স্যারের আগমন।  অবধারিতভাবে তখন সকলের চোখ চলে যায় পিছন বেঞ্চে বসা বরাবরের মতো ময়লা হলুদ হাফ হাতা চেক শার্টের মাঙলেনের দিকে। ছাত্ররা জানে, এক্ষুণি খাটাশ ঝাঁপিয়ে পড়বে মাঙলেনের ঘাড়ে  । আহত, ক্ষুব্ধ ,ক্ষুধার্ত খাটাশ। আজ মাঙলেনের রেহাই নাই।  কিন্তু তবারক উদ্দিন   মিঞা  যতটুকু সম্ভব ভদ্র হওয়া যায়, ততটুকু পর্যন্ত  নিজের গলাকে খাদের তলায় নামিয়ে এনে , নিজের গলা শুনে তিনি নিজেও হয়তো বিস্মিত, বললেন ” বাবা মাঙ্গ লেন” তার নাম উচ্চারণ করা বাঙালির জন্য কঠিন বটে, দিলিপ আমাকে তাই বলল, ” তুমিতো আইজ টেকা না দিলে পরীক্ষা দিতে পারতায় নায়”। কিন্তু  মাঙলেন এইসব বিনয় টিনয়ের ধার ধারল না। বরাবরের মতোন তার সেই একই গলার সুর, ” বাবায় কইছে টেকা দিতো পারিতো না। আমি কই তাকি দিব স্যার, আমার হাতে টেকা আছে নি ? ” তার সরল সীকারোক্তি শুনে মকদ্দস স্যারের হয়তো মায়া এসে গিয়েছিল। তিনি তখন তার  হেড স্যারের চোখ দেখে বুঝতে পারছিলেন অশান্ত রাতের ক্ষুধার্ত  খাটাশ হতে উনার আর দেরী নাই। মাঙলেনের দায়িত্ব নিজ হাতে তুলে নিয়ে তিনি হেড স্যারকে আশ্বস্ত করেছিলেন। দিলিপ আমাকে বলছিল, তার নিজেরও খুব রাগ হচ্ছিল ।  ” টাকা নাই সেইটা কি ভদ্রভাবে বলা যায় না ! আসলে দা, উপজাতিরা আচার ব্যবহার জানে না !”।  পরে কোন কথা না বলে হেড স্যার চলে গেলে মকদ্দস স্যার মাঙলেনকে বলেছিলেন হেসে হেসে, ” তুইতো ব্যাটা হেড স্যারের লারি লাপ্পা করি দিছস ” । সেইদিন থেকে মাঙলেনের নামের সাথে জুড়ে গেল “লারি লাপ্পা” শব্দটা।  দিলিপ বলছিল পরে আমাকে , মাঙলেন নাকি মকদ্দস স্যারের কথা শুনে দাঁত  বের করে হাসছিল ।   “হালা অকৃতজ্ঞ একটা”। 

এর কয়েক বছর পরে মকদ্দস স্যার ধানের ক্ষেতে দেয়া যায় এনড্রিন খেয়ে নিজ বাড়িতে মারা গেলে পুলিশ তদন্ত করতে আসে, তার বাড়ি ছানা বিনা করে তেমন কিছুই পায় না শুধু একটা ডায়রি ছাড়া। সেখানে অজস্র তার জীবনের যাপনের টুকরো টাকরা লেখালেখি ছিল। কিন্তু একটা পাতায় শুধু কয়েকটা লাইন দেখে পুলিশের মনে কি আসল কে জানে – তারা মাঙলেন কে ? তার তালাশ করতে নেমে যায়। কোন সন তারিখ লেখা নাই, সাদা পাতার উপর টানা হাতের কয়টা লাইন মাত্র।  ” মাঙলেনের  নিরীহ হাসিটা ভুলবার নয়। ওর কিশোরী বোন কিংবা প্রেমিকাকে কি আমরা নিরাপত্তা দিতে পারছি ? ওদের সমাজে রেপ বলে যে একটা জিনিস আছে সেইটা নাকি তারা জানেই না ! আশ্চর্য   না ! ”  এই লেখাটার মধ্যে পুলিশ কি গভীর আলামত পেল কে জানে , তারা বলল, লোকটা নাকি গে। মানে দুই পুরুষে গোপনে যেইটা করে আর কি। আমরা এইসব শুনে স্তব্ধ হয়ে গেলাম। মকদ্দস স্যারের মতো মানুষ এমনটা করতে পারেন ! ধুরো ! বিশ্বাস হয় না। কিন্তু কারো বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠলে দশজন মতের মানুষের বিপক্ষে দুইজন অমতের মানুষও থাকে। এটাই নিয়ম দুনিয়ার। কেউ কেউ তখন বলল, কমিউনিস্টরা আল্লাহ ঈশ্বর মানে না। সমাজের রীতি নীতি মানে না। এদের দ্বারা সবই সম্ভব। নাহলে বিয়ে শাদী না করে একটা মানুষ টিকে থাকে কি করে !   মাঙলেন তার বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ শুনে চিৎকার দেয়া শুরু করল । থানায় দাঁড়িয়ে সে ওসি দারোগার মুখামুখি হয়ে বলল, ” আরে বেটা তুমরা কমিনিস্ট কিতা জানো নি ! গরুর দল ! তুমরার মনে আইল কেমনে,  স্যার অইয়া ছাত্রের লগে এইরকম কুকাম করব ! ছি ! “। মাঙলেনের সাহস দেখে আমরাও লারি লাপ্পা হয়ে যাই। হালার সাহস আছে বটে। পরে তার কথাবার্তা  শুনে তার সরলতা দেখে পুলিশও বোধ হয় তার বিরুদ্ধে কিছু করার সাহস পায় না। একদিন থানায় রেখে তাকে তারা ছেড়ে দেয়।  

 ৩

ভার্চুয়াল জগত আসার পরে মাঙলেনকে আমরা আরেক রুপে আবিষ্কার করি। আগে সে প্রয়োজন ছাড়া কথা বলতো না। আর যা বলতো মুখে মুখে বলে দিতো, সে তোমার ভাল মন্দ যাই লাগুক, কারো পরোয়া সে করতো না। কিন্তু মকদ্দস স্যারের সাথে তার নাম উঠে আসার পর সে নিজেকে খুব সাবধানী করে ফেলে। বন্ধুবান্ধব তার আগেও ছিল না । তবু সে আগে টুকটাক আড্ডা দিতো, ক্রিকেট খেলতো, মাঝেমধ্যে তাসের পার্টিতেও থাকতো। কিন্তু ভার্চুয়াল দুনিয়া আসার পরে সে সরাসরি মানুষের সাক্ষাত প্রায় পুরাপুরিই ছেড়ে দিল।  

 সারাদিন ক্ষেত গিরস্তি ঘর সংসার এইসব করতে করতে সে  একদিন বিয়ে করে ফেলে , বিয়ে হলে বাচ্চা হবে , তারও এক ছেলে আর এক মেয়ে হয়। কামকাজের বাহিরে আমরা সারাদিনই তাকে মোবাইল টিপতে দেখতাম। ফেসবুকে সে নানান কিছু শেয়ার দিতো- ভারতের কোন এক গ্রামে এক গোখরা সাপ কাচা দুধ পান করছে সেইটার ছবি দেখিয়ে বলা হতো , “এই ছবির নীচে যারা ‘জয় মা তারা ‘ বলে কমেন্টস করবে  তাদের মনের আশা জলদি পুরণ হবে। আর যারা এর বিপক্ষে লিখবে তারা দুনিয়া থেকে উঠে যাবে” ।  “আদর্শ মানুষ হতে চাইলে আমেরিকার অমুক দার্শনিকের দশটা বাণী ” , ” ভারতীয় কোন ঋষির সৎ থাকার পাঁচটা উপায় ” – তার এইসব ঘন ঘন শেয়ার দেখে আমরা অবশ্য তেমন গুরুত্ব দিতে চাই না। এরকমতো প্রায় মানুষই করে। যার যা অভিরুচি। কিন্তু এর কয়দিন পরে সে কেবল নীতিকথাতেই নিজেরে সীমাবদ্ধ রাখল না। মান্ডপে সামান্য সময় যে তাকে আমরা দেখি, দেখতাম , কালওতো দেখলাম- ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে নানান কথা বলছে। কোন বিমানের কি নাম, কার পক্ষ শক্তিশালী , কার গোয়েন্দা বেশী সক্রিয়, তাকে দেখে মনে হল বাড়ির পাশে মার্ডার হয়ে গেলেও তার এখন এইসবে আগ্রহ নাই। তামাম দুনিয়ার দায়িত্ব নিয়ে সে ভারী ব্যস্ত, বাড়ির আনাচে কানাচের খবর নেয়ার সময় আছে নাকি তার !  শুধু যুদ্ধ না, লাউ ক্ষেত, ইলেকট্রনিক্স ব্যবসা, গরুর খোড়া রোগ, ক্যান্সার, রোদের ভিটামিন , দেশের শিক্ষাখাত, মণিপুরে কুকি মেইতেই সংঘাত- হেন কোন বিষয় নেই যা সে জানে না। 

এইভাবে ভার্চুয়াল দুনিয়ায় থাকতে থাকতে সে  যেদিন একটা চাকরি যোগাড় করে ফেলল  ঢাকায় লেদার কোম্পানিতে, আমাদের মা বাবারা তখন  আমাদের যাচ্ছেতাই বলে কথা শুনালো।  ! ” মাঙলেন বু ইয়েংগু। মাক নি নুপা মাচা হাইদো।” ( মাঙলেন কে দ্যাখো ! বাপের বেটা হল সে ! )। গোটা গ্রামে সকলেই বেকার, এর মধ্যে সে যদি ছুটিছাটায় বাড়ি এসে বউ বাচ্চা নিয়ে সিএঞ্জিতে করে সারাদিন রিজার্ভ নিয়ে শ্রীমংগলের চিড়িয়াখানা, মৌলভীবাজারের  চা বাগান  ,রাসের মেলা এইসবে ঘুরতে যায় আর ফেসবুকে বউ বাচ্চা নিয়ে নানান পোজ দিয়ে ছবি আপলোড করে -তখন কি আর আমাদের বুকের তলাটা জামগাছের নীচে ছায়াঘেরা ভাদ্রমাসের শান্তশিষ্ট কালোজলের পুকুর থাকে বলেন ! 

তাই অচিরার কাছ থেকে মেসেজটা পাওয়ার পর আমি বড় কোন একসিডেন্টের খবর শুনার জন্য একটু টেনশনে পড়ে গিয়েছিলাম ঠিক। আজকাল যা হচ্ছে। জুয়ান তাগড়া ছেলেপেলে টাস করে বসা থেকে পড়ে মরে যাচ্ছে। কিন্তু সে যেই বলল, মাঙলেনের চাকরি চলে গেছে। আমি উত্তেজনায় আবেগ সামলে রাখছিলাম কোনমতে, তারপরও মেয়েমানুষের কথার কি গ্যারান্টি আছে ! মেসেঞ্জারে লিখলাম,  “নির্ভরযোগ্য  সোর্স  কিতা ? তারেতো আইজকেও মান্ডপে খুব স্বাভাবিক দেখলাম ” । সে তখন রিপ্লাই দিল ” আরে কা ! হানড্রেড পারসেন্ট নিশ্চিন্ত থাকতে পারো । তার অফিসের এক কলিগ আমার ফেসবুক ফ্রেন্ড। সে আমারে জানাইছে। সিওর সিওর সিওর “।  একজনের  চাকরি চলে গেছে ! আর সেইটা নিয়া আমরা সেলিব্রেশন করতেছি। মাংগুরে মাপ করে দিস। সময় বড় নির্দয়  রে ভাই। 

 ৪

মাঙলেনের চাকরিচ্যুত হওয়াটা ঠিকঠাকমতো আমরা উপভোগ করতে পারছিলাম না আসলে ,তাকে দেখতো বুঝবার উপায় নাই। আবার ক্ষেত গিরস্থি করছে, বাচ্চাদের নিয়ে ইশকুলে যাচ্ছে, ফেসবুকে আগের মতো নানান কিছু শেয়ার দিচ্ছে। সে যে বলছে উত্তর মেরুতে নেট নাই, তার মালিক জানে না এইসব, মালিক ছুটি কাটিয়ে আসলে সব ঠিক হয়ে যাবে। এখন সত্য না মিথ্যা কে জানে ! 

আরেকদিন তার কর্মকাণ্ড দেখে আমরা হাসব না কাঁদব বুঝতে পারছিলাম না । হালায় এমন এমন কারবার করে ! তার কোম্পানির বস একটা তার নিজের হাস্যজ্জ্বলরত ছবি ফেসবুকে আপলোড করে। মাঙলেন সে ছবির নীচে কমেন্টস করে এইভাবে ” কি রে পেটমোটা দালাল ! তোরা বাসদের সবকটা দালাল। বাংলাদেশের বড় দুই দলকে তোরাই নষ্ট করেছিস ,এখন তোর কারণে “লিবার্টি লেদার কোম্পানিটাও নষ্ট হবে “। যেহেতু চাকরি নাই সেহেতু ইচ্ছামতো গালি দেয়া যায়। আমি তার কমেন্টসটা স্ক্রিণশট দিয়ে অচিরাকে মেসেঞ্জারে দেই, সে লাইনে ছিল, সে আমাকে রিপ্লাই দিল, সেও দেখেছে জিনিসটা। এইটা দেখার পর সে নাকি তার বাড়ির সবাইরে নিয়া হাসতেছে। আমি তখন তাকে লিখলাম,” আইজ নিশ্চিত হওয়া গেল যে তার চাকরিটা  নাই” সে লিখল, “হ্যা , সেটাই “।  

ঐদিন সন্ধ্যার দিকে অচিরা আমাকে মেসেজ করল ” কা নতুন খবর জানো নি ! ” নতুন আবার কি হবে ! মাঙলেনের দৌড় ঐ দুইটা গালাগালি আর এইটা সেইটা শেয়ার করা। সে যে মার্ডার /রেপ কিছুই করতে পারবে না ,সেতো জানা কথা। ভার্চুয়াল দুনিয়ায় খবরের শেষ নাই। মানুষ এখন ভাত তরকারির সাথে খবরও খায়। ভালো রান্না না হলে যেমন মুখে রুচে না, খবরও তাই। সাধারণ এক মাঙলেনকে নিয়ে পড়ে থাকবার কোন মানে হয় না ! তার এখন যেহেতু চাকরিই নাই ,সুতরাং দু কথা আর শুনার ঝামেলা নাই আমাদের। কিন্তু মাঙলেন বোধ হয় এত সহজে আমাদের ছাড়বে না। আমি অচিরাকে বললাম ” কিতা অইছে বে ?”

                ” তোমার মাংগু আবার লারি লাপ্পা করি দিছে”

                ” ধুর ! হে আর কিতাও করব ! সামান্য মাংগু “

                ” সামান্য নায় বা। সে যে তার বসরে গালি দিছিল নানি , তার বসে তার উপর ডিজিটাল মামলার  হুমকি দিছে ” 

                ” অলরেডি কুলাউড়া থানা তাকি তোমার মাঙ্গুরে ফোন দেয়া অইছে। সে কমেন্টসটা কাটি দিছে ।আর থানাত গিয়া মুচলেকাও দিয়া আইছে ।হা হা হা । ” 

মাঙলেন অলরেডি থানায় গিয়ে মুচলেকা দিয়ে আসছে। হা হা  হা। আমার নিজেরও হাসি পাচ্ছে। এই শালা যে কত কিছু দেখাবে ! 

  তবে মাঙলেনের আসল খেলা যে এইভাবে আমাদের দেখতে হবে তা আমরা কেউ কল্পনাই করি নাই।  ভাই রে ভাই , এমন বিপদ যেন ঘোর শত্রুরও না হয়। তাকে সবসময় ঐ হাসি ঠাট্টার লেভেলের মানুষ হিসেবে ধরে নিলেও  ঐদিনের জন্য তার প্রতি মায়া এসে গিয়েছিল আমাদের। হয়েছে  কি , এই সপ্তাদিন আগের ঘটনা । দিনটা ছিল ভোটের দিন। হই হল্লা গ্রামসুদ্ধা ভোটকেন্দ্রে যাওয়া, আসার পথে বাচ্চাদের বাঁশি , বেলুন ,টিনের বন্দুক কিনে আনা ,তারপরে বিকালের দিকে ব্যাটামানুষের ভোটকেন্দ্রের দিকে বিড়ি খেতে খেতে  ভোটের ফলাফল কি হতে পারে তার টেনশন নিয়ে ধীরপায়ে যাওয়া  -এইসবইতো হওয়ার কথা। কিন্তু এই ভোটে এইসব কিছুই ছিল না। পৌষ মাসের শীত শীত আমেজ নিয়ে গ্রামের মানুষ  সারাদিনই এ সময় অবসরে থাকে। দিনের আবহাওয়া ছিল রোদ ঝলমলে। কিন্তু গ্রামের কেউই ভোট দিতে গেল না। ভোটকেন্দ্র পুরাই ফাঁকা ছিল। পোলিং অফিসাররা বারান্দায় পায়চারি করছিল । আনসার বাহিনীর দুই মুরুব্বি খৈনি ডলে ডলে আমগাছের ছায়ায় গল্প ঝাড়ছিল। কেউ না গেলেও মাঙলেন কিন্তু গেল। যাবার সময় সে পাড়ার দোকানে বসা দু চারজনকে শুনিয়েও গেল ” ভোট দেওয়া আমার অধিকার। ইকটা আমার নাগরিক হিসাবে কর্তব্য ”  । 

এর ঠিক ঘন্টাখানেক পরে মাঙলেনের ফেসবুক পোস্ট থেকে একটা শেয়ার দেখলাম আমরা, দেখলাম, বর্তমান এমপি সানগ্লাস পরে হাস্যরত অবস্থায় মাঙলেনের সাথে ছবি পোস্ট করেছেন। ছবির উপরে লিখেছেন,  ” ভরসা রাখুন। জাতি উপজাতি আদিবাসীরা মিলে কেন্দ্র আজ কানায় কানায় পূর্ণ  ছিল। ইনশাল্লাহ ! এমপির পাশে মাঙলেনের বেশ কাচুমাচু অবস্থা। যেন কোরবানির বাজারে বিরাট বপুর কারবারির সামনে রোগাসুগা একটা ছাগল। পোস্টটা মাঙলেন দেয় নি, স্বয়ং এমপি সাহেব তাকে শেয়ার করে  দিয়েছেন, সে লাইক দিয়েছে সত্য, তবে তার চোখের ভাষা দেখে বুঝা যায়, ব্যাপারটা সে ভালোভাবে নেয় নি। আমাদেরও ব্যাপারটা ভালো লাগে নি। কারণ ভোটের দিন এইসব ছবি শেয়ার কিংবা  ট্যাগানো  আইনতো অপরাধ। কিন্তু আমরা আমপাবলিক। গজব পড়লে আমাদের উপরেই পড়বে, নেতাদের কি ! 

এর ঠিক পনেরো বিশ মিনিট পরে মাঙলেনকে বেশ উত্তেজিত অবস্থায় পাড়ার দোকানে দেখলাম, সে ভোট দিয়ে ফিরে আসছে। তাকে বেশ অস্থির লাগছিল। এই শীতের দুপুরবেলাতেও সে ঘামছিল। তাকে ঘিরে যারা ছিল এই প্রথম দেখলাম তারাও বেশ চিন্তায় পড়ে গেছেন। ঘটনা হলো, মাঙলেনের ফেসবুক একাউন্ট হ্যাক হয়ে গেছে। এইটা আমাদের মতোন মাত্র বাইশটা ঘরের ক্ষুদ্র এক গ্রামের জন্য দুশ্চিন্তার বিষয়ই বটে। আমাদের অনেক জুনিয়র এক ছেলে বলছিল, ” ভাই এইটা বিপক্ষ পার্টির  কাজ। যুদি এখন তারা ভোটে পাস করি লায় তাইলে আমাদের গ্রামে বিপদ আছে। মাঙলেনদার লগে ছবি দিয়া এমপি সাবে আমরারে কালার করি লাইছে “। কথাটা অমূলক কিছু নয়। গত কয় বছরে ভোটের ফলাফলের পর গ্রামকে গ্রাম জ্বালানো হরহামেশাই হচ্ছে।  আর যদি সেইটা হয়, সংখ্যালঘুর গ্রাম, তাহলেতো আরো চান্স বেশী। দেখতে দেখতে পাড়ার দোকানটায় গ্রামের সব মানুষ এসে ভীড় করল। বাচ্চা,  বুড়া , নতুন বউ – সবার চোখেমুখে আতংকের ছাপ। আমাকে দেখামাত্র মাঙলেন ছুটে এসে আমার হাত ধরল। কাঁদো কাঁদো ভাব। ” সত্য ভাই ! আমরারে উদ্ধার করো ! ” । আমি কি করব ! বিপদটা এখন মাঙলেনের একার নয়, গোটা গ্রামের । কী করব কিছুই মাথায় আসছিল না। তখন অচিরা বলল, ” চলো আগে আমরা পুলিশে যাই ” । পুলিশ থাকার পরেও গতবার আমাদের এলাকার পাঁচটা  মন্দির ভাঙা হয়েছে। পুলিশের উপর আমার একদমই ভরসা নাই। সামান্য একটা লাইকের জন্য যদি গোটা গ্রাম যদি জ্বালিয়ে দিতে পারে সেখানে সরাসরি রাজনৈতিন নেতার  সাথে ছবি পোস্টাইলে কী হবে আন্দাজ করা যায় ! সমবেত হওয়া মানুষগুলার চোখে মুখে আতংক দেখে আমাদের কারো কারো  মনে পড়ে  যায়, কয়েকশো বছর আগে এইভাবে কারো না কারো ভুলের খেসারতে দেশ পাহাড় গ্রাম নদী ছাড়িয়ে পূর্বপুরুষরা সম্পূর্ণ অচেনা এক জায়গায় এসে আশ্রয় নিয়েছিল। সময় এখন আমাদের কোথায় নিয়ে ফেলে দেয় কে জানে ! 

জুনিয়র সেই ছেলেটি বলল, এখন আমরার  কাজ হল, যারা আমরা ফেসবুক চালাই আমরা নিজ নিজ পোস্ট থেকে কইমু , ” মাঙলেনের একাউন্ট হ্যাক হয়েছে। যে বা যারা মাঙলেনের নামে ফেসবুক ব্যবহার করছে এখন সে আসল মাঙলেন নয়। তার কোন পোস্ট /শেয়ার/ট্যাগের সাথে আসল মাঙলেনের কোন সম্পর্ক নাই ” ।  হ্যা, আপাততো এই কাজটা আমরা করতে পারি। মুহূর্তেই ঝড়ের গতিতে আমরা মোবাইল বের করে একে অপরে লেখাটা শেয়ার করি। যেন সামান্য দেরি হয়ে গেলে এক মহাসাগর আগুন , যেইটা আমাদের গ্রামের সীমানায় থমকে আছে , সে এসে গ্রাস করে ফেলবে। 

কিন্তু এটাও পর্যাপ্ত নয়। আমাদের তারপরেও থানায় যাওয়া উচিত। ভোটের দিন। গাড়ি চলবে তো রাস্তায় ! কিন্তু যেতে আমাদের হবেই। কয়টা হুন্ডা বের করে মাঙলেনকে নিয়ে আমরা কজন থানার উদ্দেশ্যে বের হয়ে যাই। যাবার পথে আমাদের মা নেনেরা  ( মাসী/পিসি) যেভাবে আমাদের বিদায় দিচ্ছিল মনে হচ্ছিল আমরা দু চারজন মানুষ যেন দেশের বড় সেনাপতির হাতেপায়ে ধরতে যাচ্ছি, যেন যুদ্ধটা না লাগে ! এভাবেই কি একদিন পূর্বপুরুষদের দু চারজন মিলে সেই ছেড়ে আসা দেশটার রাজার হাতেপায়ে ধরে অনুরোধ করতে গিয়েছিলেন !  

রাস্তা পুরাই ফাঁকা । যে কটা ভোটকেন্দ্র দেখলাম রাস্তার পাশে ,কয়জন আনসার বাহিনী আর দু চারটা মানুষ লাইন দেয়া ঘেরের এদিক ওদিক ঘুরাঘুরি করছে। 

 থানায় এসে দেখি, এখানেও ফাঁকা  । কেবল মাত্র একজন ডিওটি অফিসার বাদে সবাই ভোটকেন্দ্রে চলে গেছে। ডিওটি অফিসার লোকটা বেশ রসিক। আমাদের সাদরে সামনের চেয়ারে নিয়ে বসাল। কিন্তু পুলিশের হাসি দেখলেই আমার ভিলেন আহমদ শরীফের শয়তানি হাসিটা মনে পড়ে যায়। আমাদের অভিযোগ শুনে সে একপ্রস্থ হাসল। ” আরে বেটা বিপক্ষ আবার কে ? ঐ লোকটার নামইতো জানে না কেউ। তোমরা জানো কেউ ? ” আমাদের মুখ কোন ভাষা বাহির হয় না। ” আরে বেটা ,এই এমপি এমনেই পাস ! তোরা বাড়িতে গিয়ে ঘুম দে যা । উপজাতি মানুষ, খালি ডরায় । উ ……বিপক্ষ এসে পাড়ায় হামলা করব ! বোকাচুদার দল ! বিপক্ষই নাই কেউ ,তায় আবার হামলা করব ! “। মনে হয় আমরা খানিকটা আশ্বস্ত হলাম। অনেক সময় পর যেন একটু একটু করে শ্বাস নিতে পারলাম। তখন মাঙলেন তার স্বভাবমতো এখানেও একটা বুলেট ছুড়ল ” স্যার, এই এমপির লোকরাওতো হামলা করতে পারে ! নাম দিব বিপক্ষর। করতে পারে না ? “। 

 এবার আহমেদ শরীফ হাসতে হাসতে হঠাত যেভাবে  গম্ভীর হয়ে গেল এবং চোখটা ঘুরিয়ে মাঙলেনের উপর আনল , ভাবলাম এই বুঝি হালা মাঙলেনের উপর ঝাঁপিয়ে  পড়বে।  কিন্তু কয়েক মুহূর্ত কেটে যেতেই আহমদ শরীফ আবার সেই ঠা ঠা করে হাসি হাসল। মাঙলেনের দিকে আঙুল তুলে বলল  ” হালা !  এ বহুত বড় ঘাগু মাল “। মাঙলেনও তখন দীর্ঘ সময়ের ঘোর অনিশ্চয়তা আর উদ্বিগ্নতা কাটিয়ে একটা অমায়িক হাসি দিল। যে হাসি দেখে একদিন মকদ্দস স্যার বলেছিলেন,  “বড় নিষ্পাপ হাসি “। 

**************************