You are currently viewing যুদ্ধ দিনের বয়ান || ইসরাত জাহান

যুদ্ধ দিনের বয়ান || ইসরাত জাহান

যুদ্ধ দিনের বয়ান
ইসরাত জাহান

মানুষ মরে গেলে কোথায় যায়!
মেশে মাটিতে,ভাবে আকাশে।

জুলাই মাস। ১৯৭১।

বছরের কিছু ঋতু আছে খারাপ। সেই সব ঋতুতে আবহাওয়ার গড়মিল হয়। কোনো কারণ ছাড়াই দাঙ্গা-ফ্যাসাদ, রোগ-বালাই হয়। এই সময় ঝুরিনামা বটগাছটাও নীরব থাকে। কালের সাক্ষী তাই প্রকৃতির সাথে রাজনীতি ও সমাজনীতির সকল পাঠ ও পুনর্পাঠ যে তার অনেক আগেই সম্পন্ন হয়েছে। শুধু নীল আকাশে সাদা কিছু মেঘের ছোটাছুটি করে। মেঘগুলো হঠাৎ হঠাৎ সুর্মা রঙ গায়ে মেখে গগনবিদারী চিৎকার করে ওঠে। হয়তো বিধাতাকে জানাতে চায় শকুনের কালচে ধুসর পালকের নীচে ক্ষয়ে যাওয়া অগনিত লাশের গুমরে কাঁদা কষ্টগুলো। এরই মাঝে হাওয়ায় হাওয়ায় দুই চারটা আনন্দের খবর পায়। সেগুলো মনটা ফুড়ুৎ হওয়ার জন্য উপযুক্ত। ইদানীং আছিয়ার মনটা ক্ষণে ক্ষণে বদলায়। চেনাজনের প্রতি অজানা অনুরুক্তির নীরব হাওয়ার তিরতিরে কম্পন টের পায়। সেই কম্পন লোমের মাঝে শিহরন জাগায়। আবার চারপাশের বৈরী পরিবেশ, ভয় গুলো শীতল স্রোত হয়ে বয়ে যায়। কয়দিন হলো ওর বাবা নতুন এক কমিটির মেম্বার হয়েছেন। সেই থেকে উঠানে লোকসমাগম, ভীতু চাহনি, নীরবতা, গভীর রাতে ফিসফিসানি এখন ওদের ঘরের নিত্যদিনের ফর্দ। মাঝেমাঝে ফিসফিসে কথাগুলো শুনে চোখে অমানিশি দেখে। ভয়ংকর কিছু আশংকায় জগদ্দল পাথরটা বুকের মাঝে চেপে বসে। অস্থির সময়ের আভাস পায়। শহর থেকে মুখে মুখে বয়ে আসা কথাগুলোর জেড়ে বুকটা আরো ভয়ে ভারী হয় । ২৫শে মার্চের দীর্ঘশ্বাস দিগন্ত ছোঁয়, ঘুমের মধ্যে মানুষগুলো লাশ হয়ে গেল। আছিয়ার মনে ভেতরে সেই মানুষটাকে নিয়ে নানা ভাবনা হুরহুরে করে, নিঃশব্দে হাওয়ায় মিলিয়ে যায় । তিনমাসের বেশী সময় ধরে সেই মানুষটার দেখা নাই। ওর মেম্বার বাবা লোকজনকে বলেছেন, লজিং মাস্টার নিজের গ্রামে ফিরে গেছেন, কিন্তু আছিয়া জানে মাস্টার বর্ডারের ওইপারে গেছে প্রশিক্ষণ নিতে। যাবার আগের দিন আছিয়া ডেকে বলেছিল ‘ বেঁচে ফিরলে আবার তোমাদের বাড়িতে আসব’। আছিয়া জানে ‘ মাস্টার আসবে।

আছিয়াদের স্কুলটা এখন পাকিস্তানি সেনাদের আস্তানা। সকাল দুপুর ওদের বাড়ি থেকে এক ডেক ভাত ও হেলেদুলে ছুটে বেড়ানো মোরগগুলো চলে যায় পাকিদের উদরপূর্তির জন্য। দুপুর ভাত গেলেও রাতে যায় রুটি। আছিয়া প্রতিবেলায় রান্নার পরে সেই খাবারে থুতু ছিটিয়ে আসে। ঘরে ইঁদুর মারার বিষ আছে। পুরো শিশিটা গুলিয়ে দিতে ইচ্ছে করে খাবারে, পারে না ওর বাবার কারণে। হায়নাগুলোর খাবার আগে যে ওর বাবাকে খেতে হয়, তারপরে জানোয়ারগুলো খায়। ওদিকে সারাক্ষন বলে ‘বশির মিয়া সাচ্চা পাকিস্তানি হে’।

আছিয়া ওর বাবাকে ঘৃনা করে, আবার মায়াও লাগে। আগের সেই সাদাসিধা মানুষটা চেয়ারম্যানের ছত্রছায়ায় থেকে কেমন যেন হিংস্র হয়ে উঠেছে। শান্তিকমিটিতে প্রতিদিন নতুন নতুন সদস্য যুক্ত হয়, তাদের নাম লেখেন বশির মেম্বার, আবার কে আসতে গড়িমসি করে, এড়িয়ে চলে তার সবকিছু তালিকা করে রাখেন। তথ্যের গড়মিল যাচাই করেন, কারো চোখের কোনে প্রজ্বলিত আগুন দেখলে ভয় পায়, মাথার সাদা টুপিতে ফুঁ দিতে দিতে সেই বয়ান ব্যক্ত করেন চেয়ারম্যানের কাছে। এই পর্যন্ত বাজারে চারটি সোনার দোকান লুট করেছেন। এই লুটের মাল এখন ওর মায়ের সিন্দুকে গচ্ছিত। আছিয়ার মা সোনা গয়না দেখে খুশীতে লুটাপুটি খায়। ওর এই অনাচারের মাঝে থাকতে ইচ্ছে করে না। মাঝেমধ্যে ঘর থেকে পালিয়ে যেতে ইচ্ছে করে মাস্টারের মতো, রাইফেল চালনো শিখতে ইচ্ছে করে, কিন্তু পালানো পথ যে বন্ধ। মায়ের চোখে এখন কুমিরের ঘুমের মতো এক চোখ খোলা থাকে সারাক্ষন। তারউপর মুয়াজ্জিন সালেহ উদ্দিনের কড়া নির্দেশ, ঘরে বসে শরীর ঢেকে থাকতে হবে। মেয়েছেলেরা কোরানশরিফ পাঠ করবে নিয়মিত। তাহলে নাকি সব আবার আগের মতো হয়ে যাবে আল্লাহর রহমতে। সেই কথা শোনার পর থেকে আছিয়া সারাক্ষণ কোরানশরিফে মুখ ডুবিয়ে রাখে। ও চায় সব আবার আগের মতো হয়ে যাক, মাস্টার আবার ফিরে আসুক । ওর যে অনেক কথা আছে সেই মানুষটার সঙ্গে ।

এইদিকে আছিয়াদের বাড়ির গোমস্তা খলিল। গতকাল পাকি হারামীগুলোর খাবার দিয়ে আসার সময় দেখে বিশ বাইশ জনের সারি দেখেছে বটগাছ তলায়। ভরদুপুরে দূর থেকে সরলরেখার মতো দেখাচ্ছিল সারিটা। দূরে দাঁড়িয়ে খলিল দেখল সারিটা থেকে দুই একজন করে মাটিতে পড়ে যাচ্ছিল বা দুই একজন সরে যাচ্ছিল। শেষমেশ সেটা তিনজনের সারিতে শেষ হয়। দুর থেকে ভেসে আসছিল, ‘উতারো শব্দটা। যারা শোনার পরপর উতরাতে পেরেছিল তারা পুর্নজীবন প্রাপ্তির আনন্দে খাঁটি পাকিস্তানি মুসলমান হওয়ার পণ করে ফিরেছিল। দুই একজন ভয়ে, লাজলজ্জায় কাপড় তুলতে দেরী করে, তারা কাদাজলে লাল রক্ত বিলিয়ে লাশ হয়ে পড়ে থাকে। আবার ভয়ে প্রস্রাব করে কেউ কেউ। বটতলায় মাটি প্রস্রাব ও রক্ত সিক্ত হয়েছে আজ। সারির তিনজনকে ক্যাম্পে নিয়ে যায় ওরা। খলিল ভেবে পায়না এইভাবে সাচ্চা মুসলমান খোঁজার কি দরকার! আবার এও মনে হয় একটু কাপড় তুলে সাচ্চা মুসলমান পরখ করতে দিলে কি এমন ক্ষতি। তালু গরম লোকগুলোকে ঠান্ডা রাখা দরকার এই সময়। খলিল চায় ওরা তাড়াতাড়ি নিজের দেশে ফিরে যাক। প্রতিদিন বিশাল খাবারের বহর নিয়ে আসা কি কম কষ্টের! আর এইসব খলিল করছে গ্রামবাসীকে শান্তিতে রাখার জন্য। কচি মুরগীর রান খেয়ে যেন হারামজাদাগুলোর মাথা ঠান্ডা থাকে। খলিল মনটা খারাপ, নিবারন স্যার সেই সারির তিনজনের একজন। বাকি দুজনকে চেনে না খলিল।

গতকাল কুমারখালি স্কুলের সমাজবিজ্ঞানের মাস্টার নিবারন স্যারকে মেরে ফেলেছে পাকিস্তানি বাহিনী। খলিল ছুটতে ছুটতে এসে সেই খবর জানিয়েছিল সবাইকে। স্যার কাপড় না খোলায় বেয়নেটের সরু অংশটি প্রথমে তার দুই পায়ের মাঝে অকপটে ঢুকে যায়। তারপরে লাথি, ছিটকে যায় বহুদূরে। তারপরে ক্যাম্পে নিয়ে যায়। সকালে কাপড় বিহীন উম্মুক্ত শরীর খালের জলে ভাসছিল। বেয়নেটের খোঁচায় তলপেট থেকে বের হয়ে আসা নাড়িভুঁড়ি দলাপাকিয়ে দুই উরুর মাঝে আটকে ছিল। খালের জল লাল ছিল অল্প কিছু সময়। সেই দৃশ্য সকালে দেখার পরে খলিলের মুখ এখন রুচিবিকার। আছিয়াকে বলার সময় বমি করেছিল। তখন নামাজের পাটিতে বসে থাকা আছিয়া সাথে সাথে মোনাজাত তোলে।

‘হে আল্লাহ মানুষটারে তুমি ভালা রাইখো, শীত সইতে পারে না মানুষটা, একটা কাঁথা জোগাড় কইড়া দিও…’

বীনাপানি শাঁখা- সিঁদুরের চিহ্ন হারিয়েছে পাঁচ দিন আগে। নিবারক মাস্টারের মুখাগ্নি না করার গ্লানিবোধটুকু ওকে মাটির সাথে নুয়ে ফেলেছিল। সেদিন রাতে স্বামীর মৃত্যু খবরটা ভেসে ভেসে এলে, বীনা একাই রওনা দেয়, স্বামীর দেহে আনত। মাঝ পথে বশির মেম্বার ওর পথরোধ করে। বুঝিয়ে, ভয় দেখিয়ে বাড়ি পাঠায়। শেষমেশ বীণাপানি ভেবেচিন্তে নিজের ভিটেমাটি সবকিছু বশির মেম্বারের কাছে নাম মাত্রা দামে বিক্রি করে আজ বর্ডারের পথে পা বাড়ায় দুটো সন্তান নিয়ে। পাকিস্তানের দোসর বশির মেম্বার সবার প্রতি অবিচার করলেও বীণাপানি সাথে কেন যেন অবিচার করতে পারে না। ওর বাঁধে, হয়তো মনে কোনে লুকিয়ে রাখা ভালাবাসাটুকু ওকে আটকায়। বীনাপানিকে একটা সময় বশিরের খুব ভালো লাগত। অনেকবার চেয়েছিল, সব ছেড়ে বীনাপানিকে সঙ্গী করে চিরতরে হারিয়ে যাবে নিরুদ্দেশের পথে। কিন্তু ধর্মের কারণে বশির বীনাপানিকে মনের কথা বলতে পারনি। আজ এতোদিন পরে বশির মেম্বার সবরকম সুযোগ পেয়েও বীনাপানির অসহায়ত্বের ফায়দা লুটে না, বরং পালিয়ে যেতে সাহায্য করে। মনে মনে চায় বীনা যেন ভালো থাকে ওপাড়ে। বীনাপানির প্রতি সদয় হলেও সেইরাতে নিবারন মাস্টারের শরীরটার উপরে সবরকম হিংসা রাগ ঝারে বশির। বিশেষ করে সেই অঙ্গের প্রতি। অন্ধকারে বটগাছে সাথে নিবারন মাস্টারের শরীরটা ঝুলিয়ে প্রথমে কেটে ফেলে তার লিঙ্গটি। পাকিস্তানিরা নাড়িভুড়ি নামিয়েছিল প্রথম দফায়। মৃত মানুষটাকে পরে খালে ফেলে দেয়া হয়। বশির মেম্বার সেই রাতে বেশ আরাম করে ঘুমায়।

অক্টোবর মাস। ১৯৭১।

‘জাফু জাফু ওঠ ওঠ, পুবধারে পক্ষী বোলে…’

কুয়াশার পাতলা নেতিয়ে পড়া পর্দাটা সূর্যের স্পর্শে টুপটাপ ঝরে পড়ে ভাঙা ঘরের টিনের চালে । সেই শব্দে তন্দ্রা ভাঙে জাফরের, চোখ মেলে তাকাতে দাদীর মৃদুস্বরের আহ্লাদী বুলিগুলো ঘুম কাতুরে অনুভবের সাথে মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। চোখ কচলে চোখ রাখে বাঁশ দিয়ে ঠেকানো দরজাটায়, যার গায়ে জং ধরে ক্ষয়ে যাওয়া অসংখ্য ছিদ্রের চিত্রকর্ম। ছিদ্রগুলো হিমেল বাতাসকে বাধাহীনচিত্তে স্বাগতম জানায় অনেকটা রাজাকার বশির মেম্বারের মতো। যিনি পাকিস্তানের সৈন্যদের বিভিন্ন উসিলায় খুশী করার চেষ্টা করছেন চেয়ারম্যানের নির্দেশে। ঝোড়ো হাওয়ায় ওদের হাঁড়ে কাঁপন লাগে নির্দয়ভাবে। ওদের মানে জাফর, শামসু, বেলাল, বজলু ও এনায়েতের।

নো ম্যানস ল্যান্ডের কাছাকাছি বসতিশূন্য বাড়িতে আত্নগোপন করছে ওরা। বাড়িটায় ছিল তিনটি ঘর একটি উঠান, এখন সেগুলোর ছেঁড়া ছিন্ন চিহ্নগুলো ছড়িয়ে আছে এদিক সেদিক। দুটো ঘরে শনের চালা ছিল, পাকিস্তান সৈন্যদের তান্ডব সহ্য করতে পারেনি বেশী সময়। আগুনে পুড়ে হাওয়ায় মিলে গেছে। পাটকাঠিতে ছাওয়া দেয়ালগুলো অল্প কিছু অবশিষ্ট আছে, টিনের ঘরটির কয়টা টিনও ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে । ঘরটির নিজের অস্তিত্বকে ধরে রেখেছে অনেকটা কষ্টে, একটি ঘরের চালা আছে তাও কিঞ্চিৎ। সেই অবশিষ্টাংশ বাড়ির ভেতরে দুইদিন যাবত কিছু অস্ত্রসহ লুকিয়ে আছে ওরা। এই গ্রামের আরো কয়টা বাড়ির এমনই দশা। মানুষজন এলাকা ছেড়েছে বহুদিন, ছন্নছাড়া বাড়িঘরে পরে আছে কিছু খড়ের পালা, ভাঙা চুলা, কাঁধে নেয়ার মতো অযোগ্য কিছু জড় বস্তু। ওদের খাবার প্রায় শেষ, সঙ্গে বয়ে আনা শুকনা খাবারে আর হয়ত দুইদিন হবে । এখানে খাবারে সংকট, বর্ডার পার হয়ে কিছু খাবার এসেছিল, টিনে ভরা সামুদ্রিক মাছ, টিনগুলো ফেটে যাওয়া মাছগুলোতে এখন সাদা লতা পোকের ঘরবাড়ি। জাফর খেতে পারেনি সেগুলো। দুইদিন চিড়া চিবিয়ে চলছে। টিনের ছোট বর্গাকার জানালাটা একটু খুলে উঠানে চোখ রাখে জাফর , চারপাশটা প্রাণহীন, খড়ের পালায় ওদের অস্ত্রগুলো লুকানো। সেগুলো পাকিস্তানীদের চোখ এড়িয়ে নিয়ে যেত হবে ক্যাম্পে। সেই জন্যই এই অপেক্ষা। দিনের গায়ে ভর দিয়ে রাত আসে, রাতের গায়ে দিন, ওরা বের হতে পারে না । কিভাবে পারবে! পাকিস্তানি সৈন্যদের অবস্থান ওদের থেকে প্রায় ৪০০ গজ দূরে। ওরা এসেছিল অন্য প্লাটুনের অগ্রগতি জানার জন্য। কিন্তু রাত প্রায় ৩টার দিকে হঠাৎ করে পাকিস্তানি সৈন্যদের অবস্থান থেকে প্রথমে ডান দিকে এবং ক্রমান্বয়ে সমগ্র অবস্থান থেকে ফায়ারিং শুরু হয়। ওয়্যারলেসে নায়েব সুবেদার এনায়েত কমান্ডার জামিলকে জানালে, ওদের খোলা ধান খেতে লাইং পজিশনে অবস্থান নিতে বলেছিল। কিন্তু ওদের অবস্থান খবর জেনে ফেলেছিল পাকিস্তানি বাহিনী। আর গুলিবর্ষণ শুরু করে। এসময় কামান্ডার জামিল আহসানের নির্দেশনায় প্লাটুনের কয়জন সদস্য নিরাপদ অবস্থানে চলে গেলও আটকে যায় ওরা পাচঁজন এই পরিত্যক্ত বাড়িটায়। ওদের পনেরো সদস্যের দুই জন মুক্তিযোদ্ধা আগেই শহীদ হয়েছে। বাকি আটজন কসবায়।
এমন আরো কয়েকটি দল কসবায় প্রথাগত (কনভেনশনাল) আক্রমণ চালায়। কসবার বিভিন্ন স্থানে ছিল পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর প্রতিরক্ষা অবস্থান। পাকিস্তানি সেনাদের সব প্রতিরক্ষা অবস্থানে ছিল সুরক্ষিত ও মজবুত বাংকার।সেদিন গোটা কসবা এলাকায় ভয়াবহ যুদ্ধ সংঘটিত হয়। তারপরও ওরা সালদা নদী এলাকা দখল করতে পারেনি। তবে কসবার বিরাট এলাকা স্থায়ীভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের দখলে চলে আসে। এ যুদ্ধে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। সেখানে জাফর ওর প্রিয় সঙ্গী ও বড়ভাই তাহেরকে হারায়।

নভেম্বর মাস। ১৯৭১।

আজ কুমারখালি গ্রামে পাকিস্তানি বাহিনী সবচেয়ে বড় হত্যাযজ্ঞ চালায়। অনেক নিরপরাধ লোক মারা যায়, তার মধ্যে খলিলও ছিল। প্রতিদিনের মতো আজও গিয়েছিল খাবার দেয়ার জন্য। খাবার পৌঁছে দেয়ার পরে খলিলকে খেত দেয় সেই খাবার। খলিল খানিকক্ষণ গড়িমসি করায় বুকের ভেতরে একটি গুলি তাড়াহুড়ো করে ঢুকে পড়ে। খলিল হাসতে হাসতে চোখ বুজে মাটিতে পড়ে যায়। কচুপাতার টলটলে জীবনটা নিয়ে মানুষ নিজ ভু্মি ছাড়ে। যাবার আগে অনেকে বশির মেম্বারের কাছে আসে, অর্থের বিনিময়ে দলিল রেখে যায়, বশির মনে মনে প্রমদ গোনে, কত ভু-সম্পত্তির মালিকানা ওর নামে। পাকিস্তানিদের তালে তাল মিলিয়ে বশির মেম্বার এখন চেয়ারম্যান হবার পাঁয়তারা করে। চেয়ারম্যান হঠাৎ ছেলের মায়ায় পাকিস্তানিদের এড়িয়ে চলছে। মুক্তিযোদ্ধাদের গোপনে সাহায্য ও সহানুভূতির দেখাচ্ছে। সেকারণে ধীরে ধীরে চেয়ারম্যান কোনঠাসা হয়ে পড়েছেন। পরিস্থিতির দিক পরিবর্তনের জেড়ে বশির মেম্বার পরিবারের সবাইকে শ্বশুর বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছেন। সারা গ্রামে পাকিস্তানি বাহিনী ছড়িয়ে পড়েছে, মুখে তাদের একটাই কথা…

ঘরমে কোয়ি মুক্তি হ্যায়?
ঠিক হ্যায়, বলো পাকিস্তান জিন্দবাদ।
তুম মুজলিম হো।’ উতরো’

জাফর ওর সঙ্গীদের সাথে নিয়ে আরো দুইদিন পরে বের হয়ে আসে নো ম্যানস ল্যান্ডের কাছাকাছি লোকশূন্য বাড়িটা থেকে এক রাতে। অস্ত্রসহ বের হওয়ার জন্য চাঁদের হাসি নিয়ে কবিতা লেখা যুবকগুলো অপেক্ষা করছিল অমাবস্যার। কিন্তু হঠাৎ অতর্কিত হামলা করে পাকিস্তানি বাহিনী। জাফরদের দলের সবাই সেই আক্রমনের দাঁত ভাঙা জবাব দিয়েছিল। আর দাঁত ভাঙা জাবাবের প্রত্যুত্তর যে এতোটা কঠিন হবে তা জাফর ভাবতেও পারে নাই। অনেকদিন সম্মুখযুদ্ধে বন্দুক চালানোর দক্ষতার কারণে বিশ্বাসটা আরো গভীর ছিল হয়তো। তারপরও সেই গভীরতা থেকে বেরিয়ে একটি গুলি এসে লাগে জাফরের ফিমারে। তারপরের কথা আর ওর মনে নেই। জ্ঞান ফেরে একদিন পরে, কড়া ঔষধের প্রভাবে সারাক্ষণ ঘুমিয়ে কাটায়, বিজয়ের প্রথম প্রহরে অন্যদেশের হাসপাতালে কেটে যায় যুদ্ধে আহত যোদ্ধার দিন।

ডিসেম্বর মাস,১৯৭১

চেয়ারম্যানকে সরিয়ে কয়টাদিন বশির মেম্বারের বেশ আরামে কাটে। তবে সেই আরামের স্থায়ীত্ব যে ফুরিয়ে আসছিল তা তিনি বুঝতে পেরেছিলেন। তাই তো উল্টা তসবিহ গোনা শুরু করেন। নিজের পরিবারের সদস্যদের নিরাপদ আস্তানায় পাঠিয়ে পাকিস্তানিদের আদর, আবদার, তোষামোদির ইতি টানেন। নভেম্বর মাসের শেষদিকে বশির মেম্বার উল্টা তসবিহ বিষয়টাকে আরো পক্ত করার জন্য পাকিস্তানি বাহিনীর গোপন কিছু তথ্য মিত্রবাহিনীর কাছে পৌঁছে দেয় কৌশলে। সেটা তার দেশপ্রম না ভন্ডামী তার বিচার করতে কেউ আসে না। আসবেই বা কে! তখন যে বশির মেম্বারের অঢেল সম্পত্তি। গচ্ছিত্ব সম্পদের মালিকানা নিজের নামে লিখিয়ে দান সদকা শুরু করেন।

আমার অহংকার / আমার লজ্জা

দেশ স্বাধীন হয়। স্বাধীন একটি রাষ্ট্রেকে সুসংগঠিত করতে অর্থের খুব প্রয়োজন। লাখ লাখ শহীদের রক্ত ও হাজারও নারীর সম্ভমের বিনিময়ে পাওয়া দেশটাকে নতুন করে গোছাতে হবে। প্রয়োজন অর্থ, তাই তো আট মাস যুদ্ধের বিরোধিতা করা মানুষটা হঠাৎ করে দেশপ্রেমিক হয়ে যায়। পরবর্তীতে তিনি পেয়ে যান মুক্তিযোদ্ধার সাটিফিকেট।

জাফর দেশে ফিরে আসে আড়াই মাস পরে, এক পা হারিয়ে, যুদ্ধাহত যোদ্ধা হিসেবে জাফরের প্রতি নতুন সরকারের অনেক দয়া হয়। তাই তো পায়ের চিকিৎসার জন্য দেশের বাহিরে পাঠানো হয় ওকে। চিকিৎসা শেষে জাফর গ্রামে ফিরে আসে, ওর সেই কথাটুকু রাখার জন্য ‘ বেঁচে ফিরলে আবার তোমাদের বাড়িতে আসব’। ফিরে এসে বাতাসে শুনতে পায় ভয়ংকর কিছু ফিসফিসে কথা। রাজাকারের সন্তানের সাথে সম্পর্কটা আর বাড়াতে ইচ্ছে করে না জাফরের। লোকসমাজ তাই জানে যা তাদের জানানো হয়। আসল কারণটা সবার অজানা থাকে মানসন্মানের রক্ষার তাগিদে।

সেইদিন সমাজের কাছে বড় বড় বুলি আওড়ানো জাফর মনটাকে বড় করতে পারে না। রাজকারের সন্তানরাও যে দেশের জন্য বড় ত্যাগ স্বীকার করেছিল তা কেউ কখনো জানতে পারে না। আছিয়া অনেক সময় বলতে চেয়েও বলতে পারে না।

ছেচল্লিশ বছর পরে।

সারাদিনের ক্লান্তি শেষে টিভির সামনে এসে বসেন আছিয়া রহমান। বিয়ে পরে স্বামীর ইচ্ছায় রহমান হয়েছেন। বাবার অর্থের শতাংশের জোড়ে আছিয়া জীবন হয় সুখের লাভাংশ । তারপরও মনে ভেতরে বয়ে চলে নিদারুণ এক হাহাকার।

টিভির রিমোট কন্ট্রোলটা পৃথিবী প্রদক্ষিণ করতে করতে হঠাৎ থেমে যায়, চোখ দুটো স্থির হয় পর্দায়। স্ক্রিনে ভেসে ওঠা প্রিয় একটি নাম। মানুষটা ওর বহুদিনের পরিচিত।

‘বীর উত্তম জাফরউদ্দীন আজ দুপুর ২ টায় ঢাকাস্থ একটি বেসরকারি হাসপাতালে মৃত্যুবরন করেছেন, মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল…

চোখে আছিয়ার বিহ্বলতা, চাপা কষ্ট মুখোশের আড়ালে চাপ পড়ে যায়, টিভিতে চলে বিজ্ঞাপণ
‘স্বপ্ন যাবে বাড়ি আমার’

আছিয়া মন ছুটে যায় ছেচল্লিশ বছর আগের সেই মেঠো পথে।

************************