You are currently viewing ম্যান্ডেলা আর মুসতাকিম>   ইশরাত তানিয়া   

ম্যান্ডেলা আর মুসতাকিম>  ইশরাত তানিয়া  

ম্যান্ডেলা আর মুসতাকিম

 ইশরাত তানিয়া

 

দিনটা ডিসেম্বারের ৫, ২০১৩। এটা তাহলে সেই একই ব্যথা-অনুভব। যখন বুক ভার হয়ে আসে আর কান পাতলে শাঁইশাঁই শব্দ শোনা যায়। ম্যান্ডেলা শ্বাসনালীর সংক্রমণে ভুগে মারা গেলে মুসতাকিম অবাক হয়ে যায়- বিস্ময়ে বুকের ভেতর শাঁইশাঁই শব্দটাও বেড়ে গেলো কি না সেটা অবশ্য বোঝা যায় না। শীতের সময়টায় মানুষ শ্বাসনালীর সংক্রমণে ভুগতেই পারে। বিস্ময়টা জোরালো হয়ে ওঠে যখন দেখে আরো অনেকেই এ কথা শুনে আশ্চর্য হয়ে যায়! মুসতাকিম-মনীষাসহ পৃথিবীর কয়েক হাজার মানুষ চমকে ওঠে। তারা স্পষ্টভাবে মনে করতে পারে নয় দশকের কোনো এক বছর নেলসন ম্যান্ডেলা কারাগারে মারা যান।

তখন শীতের বিকেলে সাদাসিধে এক কফিশপে মুসতাকিম আর মনীষা কথা বলছে। কোনো চেয়ার ফাঁকা নেই। কফিশপের ভেতরে বাইরে শহরের সর্বত্রই থিকথিক করছে মানুষ। যেন ভেতরে এঁটে উঠতে পারছে না তাই বেরিয়ে আসছে। এ পাশটা স্মোকিং জোন বলে নারী-পুরুষের হাতে দেদার সিগারেট ধোঁয়া ওড়াচ্ছে। ‘ই-মার্টের’ অফার নিয়ে একটা সিদ্ধান্তে আসার চেষ্টা করে মুসতাকিম। মনীষা বলে- আরেকটু চিন্তা করে দ্যাখো। বাজার দামের চেয়ে অর্ধেক দামে… অফারটা অস্বাভাবিক।

টিভিগুলো আজকাল দেয়ালে উঠে গেছে, এমনটাই ভাবছিলো মুসতাকিম, আর দেয়ালের ক্যালেন্ডারগুলো মোবাইল ফোনে নেমে এসেছে। যুগধর্ম। তখনই নিউজ চ্যানেলে ম্যান্ডেলার মৃত্যুর খবর দেখতে দেখতে মুসতাকিম কফিতে চুমুক দিতে ভুলে যায়। খবর শেষ হয়। মনীষা দ্বিতীয়বার কফির প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে। ডান হাত তুলে ওয়াটারকে ইশারায় ডাকে।

মুসতাকিমের চোখ দুটো উজ্জ্বল হয়ে টিভিস্ক্রীনে স্থির। ভ্রু’র ওপরে কপালে চিন্তার ভাঁজ। স্ক্রীনের নিচে নিউজবারে ম্যান্ডেলার মৃত্যুর খবর ‘ব্রেকিং নিউজ’ হয়ে ভাসছে। চলে যাচ্ছে আবার ফিরে আসছে। যুবক বলা না গেলেও মুসতাকিমের রোদে পোড়া তামাটে শরীর সুঠাম-সুন্দর। এই বয়সেই কালো চুলে সাদা নুনের ছিটে অকালপক্কতার ছাপ ফেলেছে। ভাসা ভাসা চোখ দুটো মায়াকাড়া। কবিতা লিখতো খুব এক সময়। ‘বারুদ ও বিটোফেন’ নামের একটা কবিতার বইও বেরিয়েছিলো। সেসব আজ আর না বললেও চলে। অফিসের চাপে বহু বছর আগে কবিতা উড়ে গেছে। দেশি কোম্প্যানির প্রোডাকশান এক্সিকিউটিভ হলেও নানান বিষয়ে মুসতাকিমের অপার কৌতূহল। রাজনীতি থেকে ক্রিকেট, অর্থনীতি থেকে সিনেমা কোনো কিছুতেই অনাগ্রহ নেই। টেবিলের ওপর কালো কফি রেখে যায় ওয়েটার। মুসতাকিম লক্ষ্য করেছে যতো গরমই হোক কফির কাপ থেকে ধোঁয়া ওড়ে না।

মৃত মানুষ বেঁচে উঠতে পারে না। তাই আবার মরে যাওয়ার সুযোগ নেই- মুসতাকিম এ কথা বলে। মনীষারও গলায় সংশয়- আরে! ম্যান্ডেলা না সেই কতো বছর আগে মরে গেছিলো?

মনীষা, মুসতাকিমের স্ত্রী, মশলা-চা ভালোবাসে। মাইগ্রেনের ব্যথার জন্য কফি খাওয়া ছেড়েই দিয়েছে। মাঝে মাঝে অল্প কয়েকটা চুমুক। এখানে চায়ের ব্যবস্থা নেই, কফিই সই। তবু মুখ লাবণ্যময়। ফরসা কপালে এক বিন্দু লাল টিপে অপূর্ব মুখশ্রী। এসপ্রেসো কফি ভেতর থেকে উষ্ণতা ছড়িয়ে দিলে গায়ের শাল ভাঁজ করে চেয়ারের পিঠে ঝুলিয়ে রাখে মনীষা। সে-ও এমন কি টেলিভিশনে ম্যান্ডেলার শেষকৃত্য অনুষ্ঠান দেখার কথা মনে করতে পারে। যদিও সেটা ওদের দুজনেরই ছোটোবেলার কথা।

মুসতাকিম গাল চুলকে অনেক বছর আগের শেষকৃত্য অনুষ্ঠানের পাশাপাশি ম্যান্ডেলার স্ত্রীর হৃদয়বিদারক ভাষণের কথাও মনে করে। অ্যাশট্রেতে সিগারেটের মাথার আগুন চেপে মনীষাকে বলে- এটা কী হলো? নেলসন ম্যান্ডেলা কারাগারে মারা যায়নি? আমি তো ম্যান্ডেলার শোকাকূল স্ত্রীর কথা দিব্বি মনে করতে  পারছি।

কফি পান শেষ হয়। ই-মার্টের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত মুলতবী রেখেই বাড়ি ফেরে ওরা। মুসতাকিম ভিডিও ফুটেজ খোঁজে। ফোনে গুগল করে অদ্ভুত ব্যাপারটা পরিষ্কার করতে চায়। কিন্তু ম্যান্ডেলার শেষকৃত্যের ফুটেজ খুঁজে পায় না। যা আদৌ ঘটেনি, পাওয়া যাবেই বা কেমন করে? কারাগারে মারা যাননি ম্যান্ডেলা বরং ১৯৯০ সালে কারাগার থেকে মুক্তি পান। ১৯৯৪ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন। আর হ্যাঁ, এটাই সত্য যে তিনি আজকেই মারা গেছেন। ২০১৩ সালের ডিসেম্বারের ৫ তারিখে। নিজের এতো বড়ো ভুল ধারণায় মুসতাকিম বিচলিত। এ তো আর দু’একজন মানুষের ভুল জানা-বোঝা নয়। সোশ্যাল মিডিয়ায় অনেকেই জানাচ্ছে- ওরা ভেবেছিলো নেলসন ম্যান্ডেলা অনেক আগেই কারাগারে মরে গেছেন। অথচ  ম্যান্ডেলা তখনো বেঁচে। একটা অসত্য ঘটনাকে পৃথিবীর কিছু মানুষ সত্য মনে করছে, একই রকমভাবে মনে রেখেছে। এমনও হয়!

রান্নাঘর থেকে ফোঁড়নের গন্ধ সারা বাড়িতে ছড়িয়ে পড়েছে। টেবিলে খাবার রেখে ঘরে ঢোকে মনীষা।  শরীরজুড়ে গরম চুলার ভাপ। তেল ছিটকে বাঁ হাতের কবজির ওপরটা লালচে হয়ে আছে। সোয়েটারের হাতা গুটিয়ে ওপরে তোলে মনীষা। বরফের টুকরো ঘষে জ্বলুনিটুকু সহ্য করে- শীতের সময় লাউ দিয়ে শোল মাছ না খেলে হয়? এইটুকু মাছের যা  দাম! পাতে একপিসের বেশি…  মুসতাকিমের দিকে তাকিয়ে বাক্যটা শেষ হয় না। মুসতাকিমের চেহারায় হতাশার চেয়ে বেশি বিস্ময়। মাছের দামের বদলে ম্যান্ডেলার মৃত্যু কথা হয়ে আসে। এবার বাক্য সম্পূর্ণতা পায়- তুমি এতো ভাবছো কেনো? ছোটবেলার কথা… ভুল হতেই পারে!

মুসতাকিম স্বাভাবিক গলায় বলে- মানুষ সত্য এবং কাল্পনিক ঘটনা গুলিয়ে ফেলতে পারে। সেটা না। কিন্তু এতো দিনের জানা সত্য আসলে সত্য না। এটা ভেবে আসলেই অস্বস্তি লাগছে।

– ধরে নাও ফলস মেমোরি না কি যেনো তেমন কিছু…

– এতোগুলো মানুষ একইভাবে ম্যান্ডেলার মৃত্যুকে মনে রেখেছে, অথচ সেটা তখনো ঘটেনি!

– আচ্ছা।

কোনো কথা খুঁজে না পেয়ে দুজন চুপ করে বসে থাকে। আয়ান টেনিস বল হাতে একবার বাবার দিকে আরেকবার মায়ের দিকে তাকিয়ে কথা শোনে। সবে বারো’তে পা। ক’দিন আগেই সে বীরেন্দ্র স্যারের কাছে ম্যান্ডেলার কথা শুনেছে। অ্যালজেব্রা ভুলে দেয়ালে সাঁটা পোস্টারের দিকে আয়ানের তাকিয়ে থাকাটা স্যারের চোখ এড়ায়নি। মিডল টার্ম ফ্যাকটর শেখাতে গিয়ে কিছুটা অপ্রাসঙ্গিকভাবেই বলেছিলেন- আজীবন বর্ণবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করা দক্ষিণ আফ্রিকার এই বিপ্লবী নেতার কথা। ১৯৯০ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি। ২৭ বছর ধরে কারাবন্দী করে রাখার পর হঠাৎ করেই ম্যান্ডেলাকে মুক্তি দেয়ার ঘোষণা দেয়া হলো। হাতে ২৪ ঘণ্টারও কম সময়। নেতাকে বরণ করে নেয়ার পরিকল্পনা সেভাবে করা হয়ে ওঠেনি। তবু উৎসব মুখর হয়ে উঠেছে সোয়েটো শহর। রাস্তায় লাখো মানুষের স্রোত ভেঙে ম্যান্ডেলার গাড়ি এগোতে পারছে না। মাদিবাকে এক ঝলক দেখার জন্য সবাই মরিয়া হয়ে উঠছে। ম্যান্ডেলা জেলে যাবার পর যাদের জন্ম হয়েছে, তাদেরই আগ্রহ বেশি। গাড়ির ড্রাইভারও ঘাবড়ে গেছে। এক পর্যায়ে নেলসন ম্যান্ডেলার গাড়ি আর খুঁজে পাওয়া যায় না। কমরেড মুহাম্মাদ ভ্যালি মুসা, আর্চ বিশপ টুটুসহ রাজনৈতিক সহকর্মীরা ভেবে পান  না কী করবেন? নেলসন ম্যান্ডেলা কোথায়? কেপ টাউনের এক ট্রাফিক পুলিশ জানায় ম্যান্ডেলাকে পাওয়া গেছে। স্থানীয় এক রাজনৈতিক কর্মীর আত্মীয়দের সাথে চা পান করছেন।

গল্প শুনতে শুনতে চশমাটা নাকের ডগায় নেমে এসেছিলো। চশমা ঠেলে ঠিকঠাক করে আয়ান দ্যাখে দেয়ালের সেই সাদাকালো পোস্টারে ম্যান্ডেলা বলছে- কখনো ব্যর্থ না-হওয়াটা নয় বরং প্রতিবার ব্যর্থ হয়ে উঠে দাঁড়ানোই জীবনের মহান গৌরব। কঠিন মনে হলেও কথাগুলো নিজের মতো করে আয়ান বুঝে নিয়েছে। ভেবেছে নিজের ঘরের দেয়ালে এমন একটা পোস্টার লাগালে বেশ হয়। মুসতাকিমের দিকে তাকায় আয়ান- ম্যান্ডেলার ডাক নাম মাদিবা। তাই না, বাবা?

– হুঁ।

– বাইক কবে কিনবে?

– একটা স্পেশাল অফারের অপেক্ষায় আছি। কয়েকটা দিন ধৈর্য ধরো।

– আচ্ছা। পালসার কিনবে কিন্তু!

কলেজের চাকরিটা না-ছেড়ে উপায় ছিলো না মনীষার। আয়ানকে রাখার মতো দায়িত্বশীল কাউকে পেলো না। কলেজের কাছে একটা ডে-কেয়ার সেন্টার পেলে হয়তো প্রভাষকের চাকরিটা ছাড়তে হতো না। বাজারে পাল্লা দিয়ে প্রতিটা জিনিসের দাম বাড়লে ডাঙ্গায় তোলা মাছের মতো হাঁসফাঁস করে মনীষা। সচ্ছলতা যখন হাত ফসকে যায়, ছেড়ে আসা চাকরির কথা দফায় দফায় মনে পড়াটাই স্বাভাবিক।

বাজারদর আর চাকরির কথা ভুলে মনীষার মনে পড়ে সেই কবে টিভিতে শেষকৃত্য দেখেছিলো। সেটা ম্যান্ডেলারই ছিলো বিশ্বাস করে এসেছে। এতো বছর ধরে ম্যান্ডেলা বেঁচে আছে কি নেই, এ নিয়ে ভাবার সুযোগ হয়নি। সেদিন দূর সম্পর্কের এক মামা বেঁচে আছেন কি না মনে করতে পারেনি। মামীর সাথে বিয়ে বাড়িতে দেখা। ‘মামা এলেন না?’ এই প্রশ্ন সচেতনভাবে এড়িয়েই কথাবার্তা চললো। যদিও ম্যান্ডেলা আর  মামার তুলনা হয় না। তবুও, কাছের দূরের সে যে-ই হোক না কেনো, জীবিত আর মৃতের মাঝে ফারাক আছে। নিজেদের বেঁচে থাকায় সে মানুষটির প্রভাব না থাকলেও মৃত্যুর খবরে ভেতরটা নড়ে যায়। যাপিত জীবনের পুকুরে আচমকা একটা ঢিল পড়ে। যদিও সাময়িক সেই অস্থিরতা সময়ে ফের স্থির হয়ে যায়। হাঁফ ছাড়ে মনীষা। মুসতাকিম আর আয়ান ছাড়া কাছের মানুষই বা কারা?

আয়ান বল হাতে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। মুসতাকিমের কপালের ওপর এসে পড়া চুলগুলো এতোটাই আলতোভাবে ঠিক করে দেয় মনীষা, ওর আঙুল মুসতাকিমের কপাল স্পর্শ করে না- ওঠো, ঠাণ্ডা হয়ে গেলে খেতে ভালো লাগবে না।

মুসতাকিমের বুকের ভেতরটা শাঁইশাঁই করে। শ্বাসকষ্টে নাকি ম্যান্ডেলার মৃত্যুজনিত বিভ্রান্তিতে সেটা বোঝা যায় না।

এপ্রিলের চরমভাবাপন্ন আবহাওয়ায় মনীষাও বিভ্রান্ত হয়ে যায়। জমাটবাঁধা শীতের পর অব্যর্থ গরম পড়েছে। শীতটা আরেকটু দীর্ঘ হলে পারতো এই ভেবে হাতে রুটির টুকরো নিয়ে সকাল সকাল বারান্দায় এসে দাঁড়ায়। কার্নিশের ময়লার ওপর উড়ে এসে পড়েছে কারো মেলে দেয়া লাল অন্তর্বাস। স্ট্র্যাপে জড়িয়ে আছে কমলার উজ্জ্বল আধখানা খোসা। মনীষার ছুঁড়ে দেয়া রুটির টুকরো গিয়ে পড়ে লাল-হলুদের ওপর। ঝট করে ঠোঁটে তুলে নিয়ে কাক উড়ে যায়।

শহরের লোকজন এরই মধ্যে বেরিয়ে গেছে। পুরুষদের কাঁধে রেক্সিনের ব্যাগ। নারীদের কাঁধ থেকে লেডিজ ব্যাগ কোমরে লেপটে আছে। কারো হাতে দুপুরের খাবারভরা হটপটের ব্যাগ। ঝুঁকে হাঁটার প্রবণতা দেখে বোঝা যায় ঘাড় নিচু করতে পারাটা কী যে স্বস্তির! অভ্যস্ততায় যা হয়। মাথা উঁচু করলে ক্ষয়ে যাওয়া  হাড়ের বদলে সুতোয় বোনা শিরদাঁড়ায় টান লাগে। অস্বস্তির অনুভব শিরশির করে ঘাড়ের আশেপাশে। ওদের মধ্যে মুসতাকিম একজন। তিন তলার বারান্দা থেকে মনীষা এসব দৃশ্য দেখতে পায় না। একের পর এক দালান পেরিয়ে অনেকটা দূরে দিয়ে গলি মিশেছে রাজপথে। চোখের দৃষ্টি দালানের সাথে পেরে ওঠে  না।

অফিসগুলো শহর থেকে দূরে। বাস ধরতে তাই গলি পেরিয়ে মূল রাস্তায় উঠে মুসতাকিমকে অনেকটা পথ হাঁটতেই হয়। সিটি বাস আসার অপেক্ষায় পাতলা রোদ ক্রমশ চওড়া হয়ে উঠলে ওর ভ্রু কুঁচকে কপালে ভাঁজ পড়ে। সেখানে ঘামের বিন্দু ফোটে। ঠোঁটের ওপরও। দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে কেউ রূমালে মুছে নেয়, কেউ সহ্য করে ঝরে যাওয়া অব্দি। ওদের চোখে-মুখে বিরক্তি, নির্লিপ্তি আর চাঞ্চল্যের মিশ্র অভিব্যক্তি স্পষ্টতর। সদ্য কেনা টিকেটের দিকে তাকায় মুসতাকিম। পকেটে ঢুকিয়ে রেখে লাইনে দাঁড়ায়।

তখনই রুক্ষস্বরে কে যেন বলে ওঠে- এই যে ভাই, এখানে তো আমি ছিলাম। পিছনে যান।

মুসতাকিমের স্পষ্ট মনে আছে চেক শার্টের পেছনে কেউ ছিল না। এই রুক্ষস্বর পরে এসে আগে দাঁড়াতে চাইছে। ঝামেলা না বাড়িয়ে সে পেছনে সরে যায়। ধাক্কা টাক্কা দেয়নি এই না কতো!

ঘেমে নেয়ে শার্ট ভেজা চুপসানো টিস্যুর মতো গায়ে সেঁটে আছে। এভাবে অফিসে যাওয়া কী যে বিরক্তির! ভিড়ঠাসা বাসে উঠেও স্বস্তি নেই। চাকা যেন পথের সাথেই আটকে থাকে। নড়তে চায় না। একটা মোটর সাইকেল থাকলে পরিস্থিতি এতোটা অসহনীয় হতো না। বুক থেকে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে যায় অজান্তেই।

এককালীন টাকা দিলে ৪৫ দিনের মধ্যে বাজার দামের চেয়ে অর্ধেক দামে কাক্ষিত পণ্যের ডেলিভারি দেয়া হয়। এর সঙ্গে আছে দু’শ পারসেন্ট ‘ক্যাশব্যাক’ এর অভিনব লোভনীয় অফার। ৩০ লাখ নিবন্ধিত গ্রাহক নিয়ে দুই বছরে প্রায় হাজার কোটি টাকার পণ্য বিক্রি করেছে ‘ই-মার্ট’। মধ্যসত্ত্বভোগীদের বাদ দিয়ে সরাসরি উৎপাদক বা আমদানিকারক থেকে পণ্য এনে বিক্রি করেও যে এভাবে ব্যবসা করা যায় শুরুতে বিশ্বাস করেনি মুসতাকিম। সাপ্লাই চেইন ম্যানেজমেন্টের খেলা বটে। শেষতক জাতীয় ক্রিকেট টিমের  বিদেশ সফর স্পনসর করতে দেখে ই-মার্টকে বিশ্বাস করেই ফেলে মুসতাকিম। ফ্রিজ, টিভি, মোবাইল ফোন সেট,  মোটর  সাইকেল, গাড়ি– কী নেই তালিকায়! আয়ানের শখ বাবার একটা পালসার। এখনো জানে না টাকা আটকে রেখে, মুসতাকিমকে জানিয়ে দেয়া হয়েছে, মোটর সাইকেল স্টক আউট তাই অর্ডার বাতিল করা হয়েছে। অগ্রিম টাকা ফিরিয়ে দেয়ার সক্ষমতা নেই ই-মার্টের।

এই দীর্ঘ লাইনে দাঁড়ানো অনেকের জীবন হয়তো মুসতাকিমের মতোই। মধুর প্রত্যাশায় প্রতারণার হুল ফোটে। লাখো গ্রাহকের হতাশা আর ক্ষুব্ধতায় ব্যবসায়িক কার্যক্রম বন্ধ হয়ে গেলেও, মুসতাকিমদের পকেট ফাঁকাই রয়ে যায়। ছেলেটা খুব কষ্ট পাবে। মনীষার দুঃখ হবে। জমানো টাকা এভাবেই মানি লন্ডারিং এর বিশাল কৃষ্ণগহ্বরে ঢূকে যায়। ভোজবাজির মতো- এই ছিলো, এই নেই।  মুসতাকিমের কাছে অবিশ্বাস্য লাগে সব। এখনো বাস আসেনি। হাতের মুঠোয় মুসতাকিমের রুমাল ঘামে ভিজে আরেকটু নরম হয়ে আসে।

ছুটির দিনের সকালটা অবশ্য অন্যরকম। প্রাতঃভ্রমণে বেরিয়ে পড়ে স্বাস্থ্য সচেতন নাগরিক। শহরের একমাত্র লেকের পাড়ঘেঁষা ওয়াক ওয়ে ধরে হাঁটে প্রৌঢ়রা। অপেক্ষাকৃত কম বয়সিরা দৌড়ায় মাঠজুড়ে।  ঘরের ভেতর ফ্যানের গতি বাড়িয়ে দেয় মনীষা। আয়ানের স্কুলের বেতন আর টিউশান ফি’র টাকাটা  আলমারি থেকে বের করে রাখে। হকারকে বলে দেয়- শুধু সাপ্তাহিক ছুটির দিনেই পত্রিকা দিতে। রোজকার দুধের বরাদ্দ দৈনিক থেকে সাপ্তাহিক হিসাবে ঢুকে যায়। আয়ান বলেছিলো- বন্ধুর চশমা দিয়ে ভালো দেখতে পায়। ছেলের চোখটাও তো দেখাতে হবে। সেই দু’বছর আগে ডাক্তার দেখিয়েছিলো। পাওয়ার  বাড়লে বা কমলে চশমা বাবদ খরচও যে বাড়বে, সেটাও চেপে বসে। মনীষার ফোলা চোখের ওপরে-নিচে কাজল সামান্য ছড়িয়ে মেঘলা মায়াময়। কাল রাতে খুব কেঁদেছে।

তিন রাউন্ড হাঁটা শেষে নাশতার দোকানগুলোর সামনে প্লাস্টিকের লাল চেয়ারে বসে মুসতাকিম।  ‘ব্যাচেলার পয়েন্ট’ ভ্যারাইটিজ কাবাবের দোকান। চা, কফি, ফুচকা, চটপটি, লাচ্ছি, জুস, কোমলপানীয়তে উপচে পড়ছে। বিকেল থেকে কাবাব-পরোটার যোগান শুরু হবে। সকালের নাশতাটা অনেকে এখানেই করে। দোকানগুলো থেকে পরোটা, ডাল-সব্জি আর অমলেট প্রায় উড়ে গিয়ে মানুষের পাতে পড়ছে।

শান্ত একটা হাওয়া ভেসে আসে লেকের প্রায় স্থির পানির ওপর দিয়ে। সে হাওয়ায় গত সাত মাসের  কোনো আভাস ইঙ্গিত নেই। মেনস্ট্রিম মিডিয়াগুলো তো তিন মাসের মধ্যেই ব্ল্যাক আউট। কোথাও কোনো খবর নেই। ফলোআপ নেই। অনলাইন-অফলাইন সব জায়গা থেকে ই-কমার্স প্ল্যাটফর্মের এতো বড়ো  জোচ্চুরির ব্যাপারটা স্রেফ মুছে গেছে। প্রচলিত আইনের সংস্কার আর ডিজিটাল বাণিজ্য আইন প্রণয়নের কাজ চলছে মন্থর গতিতে। অথচ পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে গেছে উল্কার বেগে। একদিন চাইলেও ই-মার্টের কোনো রেফারেন্স খুঁজে পাওয়া যাবে না। ম্যান্ডেলা ইফেক্টের মতোই মানুষের মনে হবে এতো দিন যা কিছু জেনেছিলো সেটা মিথ্যা। ই-মার্টের প্রতারণার ঘটনাটি আসলে বাস্তবে ঘটেইনি।

মাহবুব সাহেব এসে মুসতাকিমের পাশের চেয়ারে বসেন। চাকরি থেকে সদ্য অবসরে গেছেন। দুজনের পরিচয় হাঁটাহাঁটির সুবাদে। পারিবারিক থেকে আন্তর্জাতিক সব আলাপই চলে। ঋতুভিত্তিক সব্জির দরদাম, সঞ্চয়পত্রের সুদের হার কমানো থেকে রানা প্লাজা ট্র্যাজেডি নিয়ে বিস্তর বলেন মাহবুব সাহেব। যুদ্ধাপরাধের রায় কার্যকর করা কিংবা ম্যান্ডেলার মহাপ্রয়াণ- সমস্ত খবরাখবর গুলে খেয়ে উগরে দেন ধানমন্ডি লেকের পাড়ে। লেকের পানি জানে শুধু একটা তথ্য এড়িয়ে যান মাহবুব সাহেব। দেশের অন্যতম  বৃহৎ অনলাইন প্রতিষ্ঠান ই-মার্টে চাকরি করতো তার ছোটো ছেলে। নিজেই এখন অনলাইনে কম বিনিয়োগে অধিক মুনাফার ব্যবসায় উদ্যক্তা হয়েছে। ই-অ্যাপল। ব্যবসায়িক নিয়মনীতির বালাই নেই। জবাবদিহিতা নেই। লুটে নেয়ার এই তো সুযোগ! শুধু সময় বুঝে কেটে পড়তে হবে। দোকানের ছেলেটা এসে আদা-লেবুর চা দিয়ে যায়। কাকে উদ্দেশ্য করে যেন বলে- বুঝলে বুঝপাতা, না বুঝলে তেজপাতা। চমকে ওঠেন মাহবুব সাহেব। এই বয়সেই ই-অ্যাপলের কল্যাণে ছেলে ফোর হুইলার হাঁকাচ্ছে। বিষবৃক্ষের ফল ফলছে। প্রভূত প্রাপ্তিযোগে তিনি নির্বিকার হয়েই রইলেন।

কালোজিরা ছিটানো চায়ে গরমের তীব্রতা কিছুটা কমে। চেয়ার একটু বাঁয়ে সরিয়ে রোদ এড়ায় মুসতাকিম। স্বগোতোক্তির মতো বলে- গরমে গরম ক্ষয়? শুনে হেসে ফেলেন মাহবুব সাহেব। চা শেষ করে মুসতাকিমের শ্বাসকষ্ট কমেছে কি না জানতে চান। সমব্যথী হয়ে মোটর সাইকেলের কথা তোলেন।

চায়ের অপেক্ষায় মুসতাকিম। মাহবুব সাহেব বলেন- শুধু গ্রাহক না, বিক্রেতাদের দেনাও শোধ করতে পারছে না ই-মার্ট। কতো টাকা হাতিয়ে নিয়েছে এর সঠিক হিসাব এখনো বলা যাচ্ছে না। আনুমানিক পাঁচ হাজার কোটি টাকা তো হবেই। ভাবা যায়!

দোকানের ছেলেটা এবার দু’কাপ চা দিয়ে যায়। আরাম করে চুমুক দিয়ে মাহবুব সাহেব সামান্য বিরতি নেন। ফের বলেন- মানুষের বড়ো লোভ। ধনী হওয়ার তাড়া। কী ক্রেতা, কী বিক্রেতা। লোভে পাপ, পাপে মৃত্যু। আপনার লাভের গুড় তো পিঁপড়া খেলো। কিছু করতে পারলেন? কথাগুলো কৌতূহল কিংবা সমবেদনার চেয়ে বেশি শ্লেষের আভাস হয়ে মুসতাকিমের শ্রুতিসীমায় ঘুরপাক খায়। সে টের পায় দীর্ঘদিন লালিত ওর মোটা চামড়ার পুরুত্ব কমে আসছে। দৃষ্টি স্বচ্ছ। কার লোভে কার পাপ? সেই পাপজনিত কারণে কার মৃত্যু কবেই বা অনিবার্য হয়ে পড়েছে? এসব প্রশ্নের উত্তর ক্রমশ স্পষ্ট। অন্যের প্রবঞ্চনা অতিক্রম করে যেতে না পারা আর বারবার ম্যান্ডেলার সেই উক্তির দায় নেয়া। এটা হয়তো নিয়তিই। তাই মাহবুব সাহেবের ছুঁড়ে দেয়া অম্লতায় মুসতাকিমের ক্ষতে জ্বালাপোড়া বাড়ে।

দোকানের ছেলেটাকে ডেকে চায়ের দাম মিটিয়ে দেয় মুসতাকিম। মাহবুব সাহেবকে কী একটা যেনো বলতে চায় কিন্তু বলে ফেলে অন্যসব কথা- জোড়া ইলিশ কিনেছে গত সপ্তাহে, মনীষার মাইগ্রেনের ব্যথা কমেছে, শেয়ার বাজারের মূল্যসূচক বেড়েছে ইত্যাদি বলতে বলতে উঠে দাঁড়ায় মুসতাকিম। ডান হাতে নাকের বাঁ-দিক চুলকান মাহবুব সাহেব। প্রসন্নতার এসব খবর খুব যে বিশ্বাস করেছেন এমনও না।

একটু এগিয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে মুসতাকিম। শ্বাসকষ্ট সেরে গেছে। বুকের ব্যথাটা তবু রয়ে গেলো। এ এক অন্য কষ্টশ্বাস। বুকে সেই একই রকম ব্যথাভার আর কান পাতলে শাঁইশাঁই শব্দ। ঝুঁকে থাকা শরীরটা দৈব রিফ্লেক্সে হঠাৎ টানটান।

পার্কিংয়ের নির্ধারিত জায়গায় রাজকীয় হাতির মতো একটা নিসান পেট্রোল পথের দিকে মুখ ঘুরিয়ে  দাঁড়িয়ে। কালো ধাতব শরীরে পিছলে পড়ছে চকচকে রোদ। চাকায় একটা জোর লাথি দিয়ে হাঁটতে থাকে মুসতাকিম।

তার মতো সে উঠে দাঁড়ায়।

===================