You are currently viewing মোস্তফা অভি || নিকট দূরের পদযাত্রা

মোস্তফা অভি || নিকট দূরের পদযাত্রা

মোস্তফা অভি || নিকট দূরের পদযাত্রা

(বড় গল্প)

ব্যাপারটা আমার কাছে অবিশ্বাস্য মনে হল, এই জাঁকজমকহীন নির্জন এলাকার ছোট্ট বাড়িটিতে শামীমার নামে কী করে চিঠি আসতে পারে! আমি শামীমাকে জিগ্যেস করলাম, তুই কি কারো কাছে আমাদের ঠিকানা সম্পর্কে জানিয়েছিস? শামীমা উত্তরে ‘না’ সূচক মাথা নাড়ল। এই খ্রিস্টান-অধ্যুষিত এলাকায় আমরা তিনমাস ধরে বসবাস করছি। বলা যায় এটা একপ্রকার আত্মগোপন। জলের ভেতর কোনোকিছুতে আটকে গিয়ে সেখান থেকে নিস্তার পেলে মানুষ যেভাবে দম ফেলে বাঁচে, আমাদের অবস্থাটাও ঠিক সেরকম। আমি আমার সংসার জীবনে দুর্বিষহ যন্ত্রণার ভেতর দিয়ে পার করছিলাম। সর্বদা চেষ্টা করতাম এ অবস্থা থেকে নিস্তার পেতে।
একদিন আঁখি আই কেয়ারের তৃতীয় তলায় আমি সিরিয়াল দিয়ে ডাক্তারের জন্য অপেক্ষা করছি। এক মধ্যবয়সি নারী আমাকে এমনভাবে পাশ কাটিয়ে চলে গেল, যেন বাতাসে পরিচিত কোনো গন্ধ পেলাম। আমি অন্যকিছু দেখার ভান করে যখন সামনে থেকে ওকে দেখলাম, মুহূর্তে আমার ভেতরের কোথায় যেন আকস্মিক সংগীতের সুর বেজে উঠল। আমি সেই সুরের মূর্ছনায় চৌদ্দ বছর আগের গভীর প্রবাহে হারিয়ে যেতে লাগলাম। ওর মুটিয়ে যাওয়া শরীরের চর্বিগুলো জামার ওপর দিয়ে আমার চোখে আটকে যাচ্ছিল। আমি বুঝতে পারলাম, প্রায় এক যুগের অধিক সময়ে এই পৃথিবীর বহু কিছু পাল্টে গেছে ঠিক আমার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মহিলাটির মতন। শামীমা আমার তুলনায় বিচক্ষণ ছিল, ওর দীর্ঘাঙ্গী অবয়ব আর সুন্দর চোখজোড়া আমাকেই বেশি আকর্ষিত করত। হয়তো সেজন্যই আমি ওকে দেখামাত্রই চিনতে পারলাম। আমি শামীমাকে বললাম, কী সৌভাগ্য আমার, অপ্রত্যাশিতভাবে তোর সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। শামীমা আমার দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকাল। ও ঠোঁটদুটো বাঁকা করে কেমন আহ্লাদিত সুরে বলল, আমিও তোকে বহুদিন ধরে খুঁজছি।’

এটাও কি সম্ভব! আমি শামীমাকে বললাম। কলেজে আমরা খুব ভালো বন্ধু ছিলাম। আমরা পরস্পর এতটাই কাছের ছিলাম, অন্যরা আমাদের দেখে হিংসায় জ্বলে যেত। তবে আমি তোকে যেভাবে ব্যথিত করেছিলাম তাতে কখনোই মনে হয়নি তোর সঙ্গে আবার কখনো দেখা হতে পারে!
আমি বললাম, তুই আমাকে ব্যথা দিয়েছিলি এটা সত্য, তবে মন থেকে আমি কখনোই তোকে মুছে ফেলতে পারিনি। আমি মনে মনে প্রত্যাশা করতাম, ঠিক একদিন তোকে খুঁজে বের করে ফেলব। হয়তো আমার প্রত্যাশা ছিল স্বর্গীয় আলোর মতো পবিত্র। আমার আত্মবিশ্বাস সুগন্ধের মতো বাতাসে এমনভাবে ছড়িয়ে পড়েছিল, শেষপর্যন্ত সত্যিই আমাদের দেখা হয়ে গেল।

শামীমার হাসিটা সুন্দর, ওর কথা বলাটা সাজানো আর চোখদুটো পিটপিট করা শৈল্পিক। ও আমার কাঁধের ওপর শালীনভাবে হাত রেখে বলল, একটুও বড় হওনি বাবু, ঠিক বাচ্চাসুলভই আছ।

শামীমা আর আমি একই ইয়ারে একই ডিপার্টমেন্টে পড়তাম। তবে এত বছর পরেও ওর আর আমার শারীরিক পরিবর্তনগুলো চোখে পড়ার মতো। আমি ঠিক জানি না, আমার সাঁইত্রিশ বছরের শরীরিক কাঠামো কী করে এখনো বাইশ বছরের যুবকের মতো থাকতে পারে! অথচ আমার সমবয়সি মেয়েগুলো খুব সহজেই বুড়িয়ে যায়। ওদের চামড়ায় ভাঁজ পড়েছে, পেটের চর্বি ঝুলে গেছে। আবার এক বান্ধবীকে দেখলাম, কানের উপরদিকে কাশফুলের মতো কয়েকগাছি সাদা চুল উঁকি দিচ্ছে।

এটা আমার বহুদিনের প্রশ্ন, ওরা কেন এত দ্রুত অন্তিমের দিকে এগিয়ে যায়! সে যা-ই হোক, শামীমাকে নিয়ে আঁখি আই কেয়ারের নিচে নামলাম। আমাদের ঘর-সংসার, পেশাগত কাজ আর উভয়ে চিনি এমনসব বন্ধুদের নিয়ে অনেক কথাবার্তা হল। তবে ওর কথায় কোথাও একফোটা আবেগ খুঁজে পেলাম না। এতটুকু কৌতুকও করল না আমার সঙ্গে। অথচ বহুদিন আগে ওর কৌতুকের হাস্যরসে আমি প্রায় রাস্তায় গড়িয়ে পড়তাম।
প্রতিদিন কাজ থেকে ফেরার পর শামীমাকে নিয়ে ভাবতাম। গভীর রাতে স্ত্রীকে একপাশে রেখে লুকিয়ে ওর সঙ্গে চ্যাটিং করতাম। চ্যাটিঙে আমাদের আলাপ ছিল খুবই সাধারণ। এই যেমন, রাতে কী দিয়ে খেয়েছি, স্ত্রীর সাথে আজ রাতেও ঝগড়া করেছি কি-না! কতদিন ধরে আমরা একসঙ্গে থাকি না ইত্যাদি। আমার মনে হত, আমরা একই শহরের এমাথা-ওমাথায় থাকি। প্রতিদিন কত রকমের মানুষের সঙ্গে আমার দেখা হয়, অথচ চৌদ্দ বছরে একবারও শামীমার সঙ্গে দেখা হয়নি। আমি ওকে মনে মনে খুঁজতাম আর আমি বিশ্বাস করতাম ও যেখানেই থাকুক, বেঁচেবর্তে আছে। নিশ্চয়ই কোনো একদিন আমাদের দেখা হয়ে যাবে।

দ্বিতীয়বার দেখা হবার আগের রাতে আমার বেশ উত্তেজনা হয়েছিল। সারারাত কতকিছুই-না কল্পনা করেছি! আমাদের অনার্স-জীবনের কথা। আমরা দুই বন্ধু আর শামীমা। তখনকার সময় ওর শারীরিক কাঠামো, ওর সুন্দর চোখজোড়া সারারাত আমার চোখে ভাসত। তবে আমার মনের ভেতর চোরা ফাটলের মতো একটা সন্দেহ দানা বেঁধেছিল, শামীমা সত্যিই কি আমার সঙ্গে আবার দেখা করতে আসবে! হয়তো এমনও হতে পারে, কাল আকাশটা প্রচণ্ডরকম বদমেজাজে থাকবে। দিনের শুরুতে এমন বৃষ্টি নামবে যা সেঁক দেবে বিকেলের দিকে। বলা তো যায় না, শামীমা আমাকে বাজিয়ে দেখে একসময় ওর ফোন নাম্বারটা চিরতরে বন্ধ করে দেবে। তবে এসবের কোনোকিছুই সত্যি ছিল না। যখন ওর সংসার ভেঙে গেল, বহু বন্ধুবান্ধবের কাছে আমার খবর নিয়েছে। আমার সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছে কিন্তু সঠিক রাস্তার পথ ধরে সত্যিকারের লক্ষ্যস্থানে পৌঁছাতে পারেনি। আমি ওর আগ্রহ নিয়ে মোটেও দ্বিধাগ্রস্থ হতে পারি না।

আমাদের দ্বিতীবার দেখা হওয়াটা ছিল নতুন ঢেউটিনের ওপর আলোর রশ্মির মতোই উজ্জ্বল।

শামীমার পরনে ছিল জলপাই রঙের জামা। পিঠের দিকে অন্তর্বাসের ফিতেটা এমনভাবে জেগে উঠেছিল, আমি বেশ কয়েকবার সেদিকে নজর দিচ্ছিলাম। ওর কালো ত্বকের ওপর রোদের আলো চিকচিক করছিল আর গলার নিচের ভাঁজগুলোয় জেগে উঠেছিল বিন্দুবিন্দু ঘামের কণা। আমি শামীমাকে বললাম, সংসারজীবনে আমি ধীরে ধীরে নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছি, যদি তুই রাজি থাকিস আমি সবকিছু ছেড়ে চলে আসতে পারি।
শামীমা চুপ করে রইল।
যদিও ওর চুপ থাকাটা আমার জন্য যন্ত্রণার তবুও আমি ওকে জোর করতে পারি না। আমি শুধু বললাম, আমার স্ত্রীর সঙ্গে বনিবনা একদম তলানিতে। যেন পৃথিবীর দুপ্রান্তে দাঁড়িয়ে একে অপরের সঙ্গে কথা বলি। একই ছাদের নিচে আমাদের বসবাস অথচ দুজনের মন থেকে আমরা যোজন যোজন দূর। তুই হয়তো জানিস না, দিনে দিনে আমি দম বন্ধ হয়ে মারা যাচ্ছি। অনন্ত কারাগারে আমি একদমই আর থাকতে পারছি না।
শামীমা একজন ভাবুক মানুষের মতো বলল, সংসার এক কঠিন বন্ধনের জায়গা। যে একবার সেই বন্ধনে আটকে যায় সহজে আর বের হতে পারে না। অন্যদিকে যে একবার সেখান থেকে পালিয়ে যেতে চায় তাকে কেউ বেঁধেও রাখতে পারে না। আমার মনে হয়, জীবনটা যেহেতু তোর, সঠিক সিদ্ধান্ত তোরই নেওয়া উচিত।

আমার কাছে এখন এটাই সত্য, আমি তোকে নিয়ে থাকতে চাই। আমি বললাম।

এটা তোর অজানা থাকার কথা নয়, যে একবার জীবন থেকে ছিটকে পড়ে আমার মনে হয় না কখনোই সে প্রকৃতপক্ষে সুখি হতে পারে। আমি তো ছুটে চলা শ্যাওলার মতো ঘরহারা মানুষ। তুই যদি আমাকে নিয়ে সুখে থাকতে পারিস আমার কোনো আপত্তি নেই।
শামীমার আকস্মিক রাজি হওয়াতে হঠাৎ আমার চৌদ্দবছর আগের দিনগুলোর কথা মনে হতে লাগল। যখন ও আর আমি একসঙ্গে শহরের রাস্তার একপাশ ধরে ঘণ্টার-পর-ঘণ্টা ধরে হাঁটতাম। ওর হাঁটার দৃশ্য, চোখ পিটপিট করার অপূর্বভঙ্গি আর আমার যে-কোনো মতামতকে ভ্রুকুঁচকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেওয়া। আমি ওর সঙ্গে পাশাপাশি হাঁটতাম, ওর চঞ্চল দুটি স্তনের দিকে ফিরে ফিরে তাকাতাম। পাছে যদি ধরা পড়ে যাই, সেই ভয়ে পরিস্থিতিটা সামাল দেয়ার জন্য উপযুক্ত কথাগুলো মনে মনে ঠিক করে রাখতাম। পুরনোদিনের সেসব কথা মনে পড়তেই আমি ভেতরে ভেতরে উত্তেজিত হতে লাগলাম। আমি টের পেলাম, আমার হৃদ্পিণ্ড কাঁপছে, মাথার ভেতর দিয়ে গরম বাতাস বেরিয়ে যাচ্ছে আর আমার শিশ্নটা ক্রমশ ফুলে উঠছে।

এটা এক অদ্ভুত ব্যাপার, চৌদ্দ বছর পর হঠাৎ শামীমার সঙ্গে দেখা! যেন পৃথিবীর দুমেরু প্রচণ্ড ঘূর্ণনে এক হতে চলেছে। দুপুরের তেজোদীপ্ত সূর্যটা আলো হারাতে হারাতে যেন মিশে যাচ্ছে সন্ধ্যার আঁধারের সাথে। কয়েকদিনের মধ্যেই একই কেন্দ্রবিন্দুতে মিলিত হতে যাচ্ছি আমরা।

কোন মোহের বসে কে জানে, শেষ পর্যন্ত আমি সংসার ত্যাগ করলাম। প্রিয় সন্তান, আত্মীয়-পরিজন এমনকি বহুদিনের অভ্যস্ত বিছানাকে আমি এক মুহূর্তে পায়ে ঠেলে দিলাম। সূর্যমুখী ব্যাংকের সেলস বিভাগের চাকরি থেকেও ইস্তফা নিলাম। আমি নিজের চারপাশে এমন এক প্রহেলিকা তৈরি করতে চাইলাম যেন রহস্যময় আঁধারের মতো চেনা জগৎ থেকে হারিয়ে যেতে পারি। হয়তো আমি এমন একটা সুসময়ের অপেক্ষায়ই ছিলাম। একদিন বিদ্যুৎহীন চারপাশে অমাবস্যার আঁধার নামল, আকাশ থেকে গুড়িম গুড়িম কয়েকটা বাজ পড়ল, তারপর ছিটে ছিটে বৃষ্টিতে রাস্তার পিচগুলো কালো হয়ে আঁধারে মিশে গেল। আমি চেনা জগৎ থেকে মুখ আড়াল করে নিরুদ্দেশের পথে পা বাড়ালাম। সেই থেকে শামীমা আর আমি একসঙ্গে থাকি।

রাজধানী ঢাকা থেকে জায়াগাটা খানিক দূর। বুড়িগঙ্গার লেজ লম্বা হয়ে যে নদীটা বিরুলিয়া অতিক্রম করেছে আমরা সেখানকার একটি গ্রামে উঠেছি। খ্রিষ্টান-অধ্যুষিত গ্রামটির নাম কমলাপুর। জায়গাটা সমতল নয়, উঁচু-নিচু লালমাটির টিলাগুলোর ওপর গড়ে উঠেছে আয়তকার গোলাপবাগান। এছাড়াও মাঝেমধ্যে চোখে পড়ে জারভারা, গ্ল্যাডিওলাসের মতো উঁচুস্তরের বিদেশি ফুল। বাগানগুলোর একপ্রান্তে দাঁড়ালে বাতাসে কান্নার শব্দ শোনা যায়। কমলাপুর গ্রামে যে কেউ এলে মনে হতে পারে, চেনা জগৎ থেকে যেতে যেতে সে দূরাগত কোনো দেশের সীমানায় এসে পৌঁছেছে। ঠিক যেন পৃথিবীর অন্য কোনো প্রান্তের সাথে এখানকার মানুষজনের যোগাযোগ নেই। একটা মুসলিম-অধ্যুষিত দেশে এখানকার মানুষের সমাজ-সংস্কৃতি,ধর্ম আর সাধারণ চালচলন আমাদের কাছে সম্পূর্ণ অপরিচিত মনে হয়। আমরা নিজেদের আড়াল করার মতো উপযুক্ত জায়গা খুঁজে পেয়ে ঈশ্বরকে মনে মনে ধন্যবাদ জানালাম।

আমাদের দুজনের হাতে মাত্র জমানো দুইলাখ টাকা। টাকাগুলো শেষ হলে তারপর কী করব জানি না। তবু অনিশ্চয়তার ভবিষ্যৎ আমাদের উদ্বিগ্ন করে না। রাত দ্বিপ্রহরে, খ্রিষ্টানপাড়ার বাড়িগুলোর আলো যখন নিভে যায় তখন দূর থেকে শোনা যায় চার্চের ঘণ্টাধ্বনি। ধ্বনিটা যেদিক থেকে আসে আমরা সেদিকে মুখ তুলে অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে পেছনের দিনগুলোর কথা বলি। গত চৌদ্দ বছর কে কী ধরনের অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছি, সেসব।

আমি রহস্যের গন্ধ পাওয়া মানুষের মতো শামীমার কাছে জানতে চাইলাম, এই নির্জন গ্রামে তোর নামে কে আবার চিঠি পাঠিয়েছে?
শামীমার চোখে-মুখে অস্বাভাবিকতার কোনো ছায়া নেই। তুই হয়তো ভাবছিস, আমাদের নিরুদ্দেশে তোর বউ নিশ্চয়ই থানায় ডায়রি করেছে। মোবাইল নেটওয়ার্ক ঘেঁটে পুলিশ হয়তো আমাদের ঠিকানাও খুঁজে বের করে ফেলেছে। কিন্তু আমি তোকে আশ্বস্ত করে বলছি- এই চিঠির সাথে আমাদের আত্মগোপনের কোনো সম্পর্ক নেই। ইন্স্যুরেন্স কোম্পানীতে আমার একটা পলেসি ছিল আর ওটা এ মাসেই ম্যাচিউর হওয়ার কথা। আমি ওদের এখানকার একটা শাখায় নতুন ঠিকানাটা দিয়ে এসেছিলাম।

আমরা চিঠির বিষয়টিকে পাশ কাটিয়ে বাইরের দিকে তাকালাম। রাতের আঁধারে মোটা পরত পড়েছে আর গোলাপবাগান থেকে ধেয়ে আসছে সুখ সঞ্জীবনির গন্ধ। আমি শামীমার অন্তর্বাসের আড়ালে মুখ লুকিয়ে শুয়ে পড়লাম। ওর দু’বাহুর ভেতরের উষ্ণতা আমাকে এমনভাবে তাড়িত করল যেন বহু বছরের ঘুমিয়ে থাকা মানুষটি এইমাত্র জেগে উঠেছে। আমাদের সঙ্গম হয়ে যাওয়ার পর মনে হল, অতীত জীবনের সমস্ত বেদনাগুলো গোলাপবাগানের ভেতর দিয়ে দূরে কোথাও উড়ে যাচ্ছে। আমি মাথটা পুরোপুরি হালকা বোধ করলাম আর সমুদ্র তলদেশের সবচেয়ে শান্ত জায়গাটিতে নিজেকে কল্পনা করলাম। শামীমাকে বললাম, চিঠি নিয়ে আমারও একটি অভিজ্ঞতা আছে। যদি তুই শুনতে চাস তাহলে শোনাতে পারি।

শামীমা নিজেকে ঠিকঠাক করে ‘হ্যাঁ’ সূচক মাথা নাড়ল।

তখন আমি সম্ভবত উচ্চমাধ্যমিকে পড়ছি। একদিন ডাকযোগে আমার নামে চট্টগ্রামের নাসিরাবাদ থেকে একটি চিঠি আসে। ছোট্ট বক্তব্যের বিষয়বস্তু ছিল, প্রেরক আমাকে স্বপ্নে দেখেছেন আর স্বপ্নের ভেতরই আমি তাকে আমার ঠিকানা বলেছি। আমি ঠিক জানি না, এমনটা ঘটা সম্ভব কি-না। যদি ঘটেও থাকে তাহলে বলতে হবে লোকটির হাতে যথেষ্ট অলস সময় ছিল। হয়তো তিনি আমাকে কোনো কামেল দরবেশ ভেবে চিঠিটা লিখেছিলেন। সেই চিঠির উত্তর আমি এখনো দিইনি। তুই কি শুনছিস?

শামীমা ঘুমে জল হয়ে আছে। আমি ওর মুখের দিকে তাকিয়ে ঘুমন্ত শিশুর ছায়া দেখতে পেলাম। এমন নিশ্চিন্ত সুখের ঘুমে ও কতদিন বিভোর হয়ে থাকেনি কে জানে!

শামীমার সাথে আমার পরিচয়টা ছিল আকস্মিক। সেটা ছিল অনার্স দ্বিতীয় বর্ষের ঘটনা। ক্যাম্পাসের পশ্চিমদিকে লেকের পাড়ে আমি প্রাণোচ্ছল এক তরুণীকে দেখেছিলাম। শামীমা ছিল আমার থেকে প্রায় দুই ইঞ্চি লম্বা, পাতলা দেহ আর গায়ের রং কালো। ওর চটুল চাহনিতে পাতলা ভ্রুযুগল বুনোফলের গোড়ায় কচিপাতার মতন বেঁকে যেত। তবে সবচেয়ে আকর্ষণীয় ছিল ওর কোমড়। দোতরা বাদ্যটি নিতম্বের দিক থেকে যেভাবে সরু হতে হতে উপরের দিকে উঠে যায়, ওর নিতম্ব থেকে উপরদিকটা ছিল সেরকম। এমন এক অকপট উষ্ণতা ছিল ওর ভেতর, যা আমাকে সেই মুহূর্তে আকৃষ্ট করেছিল। আমরা প্রমদিনেই পরস্পরের বন্ধু হয়েছিলাম। প্রতিদিন ছুটির পর সারা শহর একসঙ্গে তিনজন ঘুরতাম। ক্লান্তহলে যে-কোনো বন্ধ দোকানের টুলের উপর বসে জিরিয়ে নিতাম। আমাদের সিনিয়র বন্ধুটি এমনসব অপরিচিত কথা বলত, সেসব আমরা ক্লান্তিহীনভাবে মন দিয়ে শুনতাম। ওর আলাপের অধিকাংশই ছিল পৌরাণিক ইতিহাস। অথচ আমরা সেসব শুনতে কখনোই বিরক্ত হতাম না। সিনিয়র বন্ধুটি যেদিন অনুপস্থিত থাকত আমি ভেতরে ভেতরে শুদ্ধ হয়ে উঠতাম আর নিজেকে একটা গণ্ডির ভেতর আটকে ফেলতাম। আমার মনে হত, শামীমার সঙ্গে প্রকৃতির সামান্য কয়েকটা বিষয় বাদে আর কোনো আলাপ থাকতে পারে না। তখন আমি মনের দিক থেকে সত্যিই পরিণত ছিলাম কিন্তু আমার শারীরিক গঠন কোনোভাবেই পুরুষোচিত ছিল না। হতে পারে সে-কারণেই, সিনিয়র বন্ধুটির মতো কখনোই আমি খোলস থেকে বের হতে পারতাম না।

কিন্তু কিছুদিন যেতে না যেতেই আমাদের বন্ধুত্বের নতুন সংজ্ঞা তৈরি হল। সিনিয়র বন্ধুটি ব্যস্ত থাকায় শামীমা আর আমি ঘনিষ্ঠ হওয়ার সুযোগ পেলাম। আমাদের মধ্যে নারী আর পুরুষের লিঙ্গভেদ ছিল না। এমনও হত, সারাদিন কথা বলার পরও আমাদের কথা ফুরিয়ে যেত না। মনে হত, আগামিকাল বহুদূর। আমরা একে অপরকে উপহার দিতাম, চোখের দিকে একধ্যানে তাকিয়ে থাকার খেলা খেলতাম আর কলেজের লেকে ছোট ছোট ঢিল ছুঁড়তাম।

তখন শীতকাল প্রায় শেষ হয়ে এসেছিল। শামীমার হাত-পায়ে ওঠা মাছের আঁশের মতো ফাটা দাগগুলো মিলিয়ে যাচ্ছিল। ওর কালো ত্বকের ওপর সূর্যের আলো পড়লে এমনভাবে চিকচিক করত, আমি বিস্ময়ে ওর দিকে তাকিয়ে থাকতাম। আমরা তখনো বন্ধুত্বের স্বাভাবিক সীমা অতিক্রম করিনি। কেউ কাউকে প্ররোচিত করিনি, কোনো প্রাচীরের আড়ালে দাঁড়িয়ে একে অপরকে চুমু খাইনি এমনকি কোনো বন্ধুর খালি বাসায় ঘনিষ্ট ডেটেও যাইনি। আমি শুধু ওর সঙ্গে গল্প করে কাটানো সময়টুকুই উপভোগ করতাম। সত্যি বলতে কী, আমরা সমবয়সি হলেও যে কোনো কারণেই হোক সাহসের দিক থেকে আমি ছিলাম ভিতুর ডিম। তবে গল্প করতে করতে আমি যখন ওর মায়ায় পড়তাম, কেমন এক অদ্ভুত ভালো লাগায় আমার ভেতরটা ভরে যেত। আমি ওকে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরতে চাইতাম। মাঝেমধ্যে আমার ইচ্ছেটা এমনভাবে মাথাচাড়া দিত, আমি ইতস্তত করে ওকে বলে ফেলতাম।

একদিন শামীমাকে বললাম, তুই আমাকে এমন কোথাও নিয়ে যেতে পারিস, যেখানে আমি তোকে একটু জড়িয়ে ধরতে পারি!

মনে হয়, আমার কাছে এরকম একটা নিভৃত জায়গা আছে, শামীমা বলল। মহিলা আমার দূর সম্পর্কের আত্মীয়া হন। তার স্বামী খুব ভোরে ব্যবসার কাজে শহরে যায়। বাড়িতে একমাত্র ছোট্ট ছেলেটি ছাড়া আর কেউ নেই।
তুই কি আমাকে সেখানে নিয়ে যেতে পারিস? আমি বললাম।
সে তো শহর থেকে বহুদূর, শামীমা বলল। কাছাকাছি হলে তবুও কথা ছিল। শহর ছাড়িয়ে অন্তত আমাদের তিনঘণ্টা পথ কাঁচা রাস্তা ধরে হাঁটতে হবে। এমনকি আমাদের ফিরতে রাতও হয়ে যেতে পারে।
আমি জানি এটা তোর জন্য সত্যিই কষ্টকর হবে। তবুও আমি তোর কাছে এটুকু আনুকূল্য চাই। তুই কি আমাকে একটু জড়িয়ে ধরতে দিবি?
আমি জানি, তুই আমার সবকিছু শেষ করে ছাড়বি। তবুও আমি তোর ইচ্ছেটাকে সম্মান করে বলছি, তোকে আমি নিরাশ করতে চাই না।

এক শনিবার দুপুরে আমরা শহর ছাড়িয়ে একটা বদ্ধ খালের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলাম। জনশূন্য সেই কাঁচা রাস্তাটির গন্তব্য কোথায় ছিল কে জানে! রাস্তার দু’ধারে বহু তফাতে একেকটা বাড়ি ছিল। আরো কিছুদূর পর দুপাশের জমিতে শুধু থৈ থৈ জল ছাড়া আর কিছুই ছিল না। আমরা বিকেলের দিকে সেই ভাবীর বাড়িতে পৌঁছালাম। বাড়িটা এতটাই নিরিবিলি আর শান্ত ছিল, আমি চারপাশে সেই নির্জনতা দেখে পুলকিত হয়েছিলাম।

শামীমা আমাকে বলল, তুই কি এমন একটা জায়গাই চেয়েছিলি?

তোর কাছে আমার কৃতজ্ঞতার শেষ নেই, আমি বললাম।
আমরা পেছনের একটা রুমে কিছুক্ষণ নীরবেই বসে রইলাম। আমার মনে হচ্ছিল, মহা সমুদ্রের উত্তাল তরঙ্গগুলো আমার বুকের ভেতর একসঙ্গে আছড়ে পড়ছে। সেই বিশাল বিশাল তরঙ্গের মাঝে শামীমা আমাকে ডুবিয়ে ফেলতে চাইছে। আমি ওর বুক থেকে ওড়নাটা তুলে দূরে ছুড়ে মারলাম। তখন ও ভয় পেয়েছিল কি-না জানি না, তবে পাশের জানালার শিক ধরে অনেক্ষণ গুটিয়ে রইল। তারপর ধীরে ধীরে আমরা এতটাই ঘনিষ্ঠ হয়ে বসলাম, দুজন দুজনার বুকের আবেগজর্জর ধুকপুকানি শুনতে পেলাম। আমি ওর কপালে মাথা ঠেকালাম, ওর ঠোঁটে আমার আঙুল ছুঁয়ে দিলাম। আমাদের শিরার ভেতর দিয়ে প্রবাহমান রক্তের ধারা এমনভাবে বয়ে যাচ্ছিল, তখন পরমাত্মার মতো দুজন দুজনার সাথে মিশে যেতে চাইলাম।

আমি বিশ্বাস করতে পারছিলাম না আমার সামনে যে-মেয়েটি বসে আছে ও আমারই পরিচিত কেউ। হঠাৎ কোনো এক অদৃশ্য শক্তি আমাকে মাঝপথে থামিয়ে দিল। আমি সামনের পদক্ষেপে একদম আগাতে পারলাম না।

ফিরে আসার পথে শামীমা আক্ষেপের সুরে শুধু এটুকুই বলল, আমি আজ তোর কাছে সর্বনাশ হতেই এসেছিলাম।

সম্ভবত সেটাই ছিল শামীমা আর আমার একান্তভাবে শেষ দেখা-সাক্ষাৎ! তারপর আমি ধীরে ধীরে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছিলাম। আমার পৌরুষের ওপর আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেললাম আর আমি প্রাণপণে পুরুষ হতে চেষ্টা করলাম। কিছুদিন পর আমাদের ফাইনাল পরীক্ষা হল, তারপর এক দু’বার শামীমার সঙ্গে দেখা হয়েছিল সত্যি, আমি ততদিনে পরবর্তী জীবনের করণীয় বিষয় নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম। তারপর গত চৌদ্দ বছরে আমাদের আর দেখা হয়নি।

এই নির্জন লোকালয়ে এসে আমাদের সময়টা খুব দ্রুত কেটে যাচ্ছে। প্রতি শুক্রবার শামীমাকে নিয়ে গোলাপগ্রামে বেড়াতে যাই আর ছবি তুলে গুগোল ড্রাইভে সেভ করে রাখি। এখান থেকে উত্তরদিকে চলে গেছে এক বিমুগ্ধ সড়ক। রাস্তার দুপাশে কৃষিবিদ কোম্পানির গোরু আর মুরগির খামার। দিনের আলোতে পরিবেশটা নৈসর্গিক আর যখন রাত নামে, শেয়ালের আনাগোনায় চারপাশ সরব হয়ে ওঠে। তখন বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে অদৃশ্য ভয়ের পরত। সেই ভয় আমাদের ঘনিষ্ট হতে সাহায্য করে। আমরা পরস্পরকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে পড়ি। আমি বিশ্বাস করি, আমাদের ঘুমন্ত সেই দৃশ্যটা দেখলে যে-কেউ মনে করবে পৃথিবীতে একমাত্র আমরাই সুখি মানুষ।

একরাতে শামীমা জানতে চাইল-বাচ্চাটার জন্য তোর কি কখনো খারাপ লাগে না?

আমি এত বড় সত্য বিষয়টিকে বাহানা করে উত্তর দিতে চাইলাম না। বলতে পারিস, ছেলেটা আমার কলিজা। ওর যখন পাঁচ বছর বয়স, চোখের সামনে যা কিছু দেখত আমাকে প্রশ্ন করে উতলা করে তুলত। আমি ওর প্রতিটি প্রশ্ন খুব মনোযোগ দিয়ে শুনতাম আর ছোট ছোট বাক্যে উত্তর দিতাম। ও তখন ছোট্ট মাথাটা উঁচু করে আমার দিকে তাকিয়ে হাসত আর আমি ওকে পরম ভালোবাসায় বুকে জড়িয়ে ধরতাম। কিন্তু ওর মায়ের এমন পাথুরে হৃদয়, শেষ পর্যন্ত ছেলেটাকে আমার স্নেহের পরশ থেকে বঞ্চিত করতে বাধ্য করল।

মৌসুমীর সাথে তোর কীভাবে পরিচয়? শামীমা জানতে চাইল।

সে এক অপ্রত্যাশিত ঘটনা। আজকাল প্রযুক্তি আমাদের সম্পূর্ণ অপরিচিত মানুষকেও দু’দিনের ব্যবধানে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়। মৌসুমীর সাথে আমার মোবাইলের রং-নাম্বারে পরিচয়। আমি ওকে যতটা সম্ভব বিরক্ত করতে চাইতাম আর সেইসূত্রে আমাদের ভেতর তর্ক-বিতর্ক হত। আমি ঠিক জানি না, ঝগড়া করতে করতে আমরা কখন যেন একজন আরেকজনের মধ্যে প্লাবিত হয়ে গিয়েছিলাম। হতে পারে এটা তোর কাছে হাস্যকর ব্যাপার, সত্যিই আমরা একে অপরকে না দেখে প্রেমে পড়লাম। মৌসুমী ওর ভাইবোনের সঙ্গে যাত্রাবাড়ীর দনিয়ায় থাকত আর আমি মহাখালির একটা মেসে। পরিচয়ের ছয়মাস পর আমরা সামনাসামনি দেখা করলাম। ফোনে ওর কণ্ঠস্বর শুনে আমার মনে হত, বাতাসে ভেঙে পড়া মেয়েদের মতো ওর শরীর আর ওর মুখটা কিশোরীদের মতো ছোট। ওর বুকের গঠন এতটাই গোলাকার ছিল, আমি ক্ষণে ক্ষণে চুরি করে ওর বুকের দিকে তাকাতাম। কিন্তু সত্যি কথা বলতে, ও ছিল পুরোদস্তুর একজন নারী। মুখটা গোলাকার আর শরীরের আগাগোড়া সমান। ওর মাথাভর্তি কালো চুল দেখলে যে-কেউ মনে করবে, জমে যাওয়া কালো মেঘ পৃথিবীর দিকে ঝুলে আছে। আমি প্রথম দেখাতেই মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, যে-কোনোকিছুর বিনিময়ে আমি মৌসুমীকে বিয়ে করতে চাই।

আমি ঠিক জানি না, প্রথম দর্শনে মৌসুমী আমাকে পছন্দ করেছিল কি-না! তবে এটা সত্যি ছিল যে, দিনের পর দিন আমাদের কথা বলার অভ্যাস মায়ায় পরিণত হয়েছিল। আর পৃথিবীতে মায়া এমন এক বস্তু যাকে তুই কোনো সংজ্ঞা দিয়েই বিচার করতে পারবি না। তোর কাছে এটা অবিশ্বাস্য মনে হতে পারে, দ্বিতীয় দিন দেখা হওয়ায় আমি মৌসুমীকে চুমু খেয়েছিলাম। আমি ঠিক জানি না কী করে সেটা সম্ভব হয়েছিল! হয়তো সময়ের ব্যবধানে ততদিনে আমি পুরুষ হয়ে উঠেছিলাম। আমরা কিছুদিন একসঙ্গে ঘুরলাম- শাহবাগ, বোটানিক্যাল গার্ডেন, বলদা গার্ডেন আর ঢাকার বিভিন্ন ফুটপাত। আমাদের প্রেম জমে ওঠার আগেই এক বীভৎস অভিজ্ঞতা বিচ্ছেদের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিল। আমরা একদিন বোটানিক্যাল গার্ডেনে বেড়াতে গেলাম। একটা ঝোপের আড়ালে মৌসুমী আমার থেকে একটু সরে বসেছিল কিন্তু অমন নির্জনে দূরে দূরে বসার যন্ত্রণা নেওয়া আমার জন্য ছিল সত্যিই কষ্টকর। বলা যায়, অতর্কিত হামলার মতোই আমি মৌসুমীকে জড়িয়ে ধরলাম। আমি খুব উত্তেজিত ছিলাম, হয়তো সেকারণে সামান্য বেপরোয়াও হয়ে উঠেছিলাম। আমাদের ঠিক জানা ছিল না, ছেলেগুলো কোথায় ওত পেতেছিল আমাদের দেখার জন্য। ওরা কয়েকজন এসে আমাদের চারপাশ ঘিরে দাঁড়িয়ে বলল-আমরা পাবলিক প্লেসে অমার্জিত কাজ করেছি। সেজন্য আমাদের দশ হাজার টাকা কৈফিয়ত গুনতে হবে। ওরা মৌসুমীকে কব্জায় নিয়ে ওর স্পর্শকাতর জায়গাগুলোতে হাত দিতে থাকল। আমার শিশ্ন আর অণ্ডকোষ এমনভাবে মুঠো করে ধরল, সামান্য একটু চাপ দিলেই আমার মৃত্যু হতে পারত।

তুই কি ছেলেগুলোকে টাকা দিতে পেরেছিলি? শামীমা জানতে চাইল। আমি কয়েকজন বিশ্বস্ত বন্ধুকে ফোন করেছিলাম আর ওরা মোবাইল ব্যাংকের মাধ্যমে সহজেই টাকা পাঠিয়েছিল। আমরা তিন হাজার টাকার মধ্যস্থতায় বিষয়টিকে মিটিয়ে নিয়েছিলাম।

যখন আমরা গার্ডেনের ফটক থেকে বেরিয়ে এলাম তখন চারপাশের সন্ধ্যাবাতিগুলো জ্বলে উঠেছে। তবুও আমাদের জন্য সামনের পথটুকু ছিল মরুভূমির মতো অন্ধকার। আমরা এতটাই বিধ্বস্ত ছিলাম, মনে হয়েছিল আমরা গোলকধাঁধার ভেতর দিয়ে দূরের কোনো আলোর নিশানা ধরে এগিয়ে যাচ্ছি। আমাদের গন্তব্য কতদূর তা জানা নেই।

সেই রাতের পর থেকে মৌসুমীর ফোন চিরতরে বন্ধ হয়ে গেল আর আমরা সম্পূর্ণরূপে যোগাযোগ বিচ্ছিন্নহয়ে পড়লাম।

আমি মৌসুমীকে নিয়ে স্মৃতির মুহূর্তগুলোর কথা ভাবতাম আর সারারাত জানালার ধারে বসে থাকতাম। ঝিরঝিরে বৃষ্টির জলের মতো আমার চোখদুটো ভিজে উঠত। আর আমার গালদুটো শুকিয়ে এতটাই পাতলা হয়ে গিয়েছিল, দূর থেকে দেখলে যে-কেউ মনে করত বার্ধক্যের কাছাকাছি পৌঁছে যাওয়া কোনো মানুষ আমি। ঠোঁটদুটোর রঙ হয়েছিল ছাইয়ের মতো ধূসর। তখন আমার কাছে সমস্ত যুক্তিই অসার মনে হয়েছিল। আমি ঠিক জানতাম না মৌসুমী কী কারণে যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছিল। প্রতিদিন আমি প্রায় কুড়ি কিলোমিটার বাসের হ্যান্ডেল ধরে ওকে দেখার জন্য যেতাম। আমি মনে মনে ভাবতাম, যে কোনো প্রয়োজনে মৌসুমী বাইরে বেরিয়ে আসবে। কিন্তু এভাবে বহুদিন পালাক্রমে দাঁড়িয়ে থাকার পরও একবারের জন্যও ওর দেখা পেলাম না।

একদিন মুষলধারে বৃষ্টিতে দুনিয়া ভেসে যাচ্ছিল, আমি ওদের বাসার বিপরীতে মঙ্গল বেকারীর সামনে হাঁটুজলে দাঁড়িয়ে থাকলাম। আমার এমনই দৈন্যদশা ছিল, লোকজন আমার দিকে আঙুল তুলে হাসাহাসি করল কিন্তু আমার কাছে সেসবের কোনো গুরুত্বই ছিল না। এটা তুই বিশ্বাস করতে পারিস, মৌসুমীকে আমি সত্যিই ভালোবাসতাম।

নিঃশেষিত গোধূলীর মতো আমার হারিয়ে যাওয়া প্রেমিকাকে ফিরে পেতে মরিয়া হয়ে উঠলাম। একদিন ঘুমের ওষুধ খেয়ে টলতে টলতে মৌসুমীর এক ছেলেবন্ধুর কাছে সাহায্য চাইলাম। আমি ছেলেটির ব্যাচেলর বাসার মেঝের ওপর গভীর ঘুমে তলিয়ে যেতে থাকলাম। পরদিন দুপুরের পর যখন আমি উঠে দাঁড়ালাম মৌসুমী শক্ত করে আমার হাত ধরল। আমরা নতুন জীবনের সন্ধানে বেরিয়ে পড়লাম।

সত্যি বলতে কী, মৌসুমীর পরিচর্যা এতটাই নিবিড় ছিল, আমি ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠলাম। একদিন পীরেরবাগ কাজী অফিসে গিয়ে আমরা বিয়ে করলাম। একটা ছোট্টঘর ভাড়া করে পুরোদমে সংসার করা শুরু করলাম। এর কয়েকদিন বাদেই আমি সূর্যমুখী ব্যাংকের লোন-সেকশনে সেলসম্যান পদে জয়েন করলাম। আমার কাজ ছিল উপযুক্ত গ্রাহক খুঁজে বের করে লোন দেওয়া আর কিস্তির টাকা আদায় করা। কাজটি আমার জন্য এতটাই কঠিন ছিল যেন প্রত্যেক মাসে একেকটি যুদ্ধ শেষ করে বাড়ি ফিরতাম। আমার একটা ব্যাগ ছিল ওটা সার্বক্ষণিক সঙ্গীর মতো আমার কাঁধের সাথে ঝুলে থাকত। তাতে আমার কাঁধের মাংস ধীরে ধীরে অসার হয়ে পড়েছিল আর সবসময় আমি পিঠে প্রচণ্ড ব্যথা অনুভব করতাম। যেসব ব্যবসায়ীদের ঋণ দিয়ে সাহায্য করতাম, ওদের অনেকেই আমাদের প্রাপ্য সম্মানটুকু জানাত না। ওরা এতটাই হীন আর স্বাথপর্র ছিল, নিজেরটা ছাড়া অন্যের কোনোকিছু বুঝত না। মাসশেষে যখন কিস্তির তাগাদা পড়ত, ওরা ব্যস্ততার অজুহাতে লাপাত্তা হয়ে যেত। তবু আমরা দিনের শেষ আলো নিভে যাওয়া পর্যন্ত গ্রাহকদের দোকানের সামনে অপেক্ষা করতাম। যখন আমরা শূন্যহাতে অফিসে ফিরতাম, আমাদের কণ্ঠস্বর রুদ্ধ হয়ে আসত। স্যারের ডেস্কের চারপাশে গলায় শেকল পরানো কুকুরের মতো দাঁড়িয়ে থাকতাম। আমাদের মনে হত এই পৃথিবীতে আমাদের চেয়ে দোষী আর অপরাধী বুঝি আর কেউ নেই। তুই কি সেই সময়ের সত্যিকারের চিত্রটা বুঝতে পারছিস? আমি শামীমাকে বললাম।

শামীমা নিঃশব্দে কাঁদছে। ওর চোখের জল আমার লোন-সেকশনে কাজ করার দুঃসহ দিনগুলোর ক্ষতটা হয়তো মুছিয়ে দিতে পারবে না। তবে আমার মনের ভেতরে এমন এক প্রশান্তি অনুভব করলাম, যা ইতোপূর্বে আর কখনো পাইনি। আমি শামীমাকে শক্ত করে বুকের সাথে চেপে ধরলাম। শামীমা সত্যিকারের আপন মানুষের মতো সামনের কথাগুলো শুনতে চায়।

তখন এছাড়া আমার আর কোনো উপায় ছিল না। আমি শামীমাকে বললাম। মনে হত, কোনো এক অদৃশ্য ধনপতি সুতায় পয়সা বেঁধে আমাদের চোখের সামনে ঝুলিয়ে রেখেছে। আমরা সবকিছু হজম করে পয়সাগুলো অধিকারে নেওয়ার চেষ্টা করতাম। কিন্তু বারবার পরাজিত সৈনিকের মতো মাটিতে গড়াগড়ি খেতাম। আমরা যে-কোনো মূল্যে চাকরিটা টিকিয়ে রাখতে চাইতাম।

প্রতিদিন একবার করে এভাবেই আমরা বাস্তবতার কাঠগড়ায় দাঁড়াতাম। আমাদের গলার টুঁটি এমনভাবে চেপে ধরা হত, প্রতিবাদ করার ক্ষমতা চিরতরে হারিয়ে ফেলতাম। তবু আমরা হাল ছেড়ে দিতাম না। মাসশেষে বেতনের টাকা অনাদায়ী একাউন্টে জমা করে খালিহাতে বাড়ি ফিরতাম। আমাদের সেলস টিমের প্রত্যেক সদস্যের এটাই ছিল নিয়তি। সন্ধ্যায় আমার হাতে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র না দেখে মৌসুমী প্রচণ্ডরকম চ্যাঁচাত। আমার সারাদিনের ক্লান্তমুখের দিকে একবার ফিরেও তাকাত না ও। ধীরে ধীরে মৌসুমীর পরিবর্তনগুলো দেখে মনে হত-কী নিষ্ঠুর নিয়ম এই পৃথিবীর, মানুষ অল্পদিনের মধ্যেই কীরকমভাবে ভালোবাসাকে ভুলে যায়!

ততদিনে আমি নিশ্চিত হলাম, দিনে দিনে মৌসুমীর হৃদয় থেকে আমি দূরে সরে যাচ্ছি। কোনোদিন বাসায় গিয়ে দেখতাম, টেবিলের ওপর এঁটো থালা-বাসনের জঞ্জাল। সেসব থেকে বের হত সুস্বাদু খাবারের ঘ্রাণ। আমি সহজেই বুঝে নিতে পারতাম, মৌসুমী ওর পরিবারের সাথে গোপন যোগসূত্র বজায় রেখে চলছে। হয়তো সে-কারণে ধীরে ধীরে আমাদের মাঝের অদৃশ্য পর্দাটা মোটা হয়ে যাচ্ছে। আমি শুধু মনে মনে বলতাম, এই মৌসুমী কখনোই আমার ছিল না।

আমি বাড়িওয়ালার তির্যক চাহনির ভয়ে প্রায় মধ্যরাতে চোরের মতো বাসায় ফিরতাম। একজন পরিশ্রান্ত আপন মানুষের সঙ্গে কীরকম ব্যবহার করা উচিত মৌসুমী সেটা চিরতরে ভুলে গিয়েছিল। সবসময় ওর মেজাজ খিঁচড়ে থাকত আর কথায় কথায় হেয় করত আমাকে। একটা ফ্যাসাদের জাল সর্বত্র এমনভাবে বিছিয়ে রাখত যা থেকে পরিত্রাণ পাওয়া সম্ভব ছিল না। আমি তখন জীবনের সবচেয়ে কঠিন মুহূর্তটি পার করছিলাম।

তুই ওর সামনে প্রেমিকের মতো হাঁটুগেড়ে বলতে পারতি, আমি তোমাকে আগের মতো ফিরে পেতে চাই। যদি এসবে কোনো কাজ না হত তবে শাসন করার অধিকারও ছিল তোর, শামীমা বলল।
যে মানুষটা এত দ্রুত বদলে যেতে পারে তাকে শাসন করে নিয়ন্ত্রণ করা আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না। আমি ততদিনে জেনে গিয়েছিলাম মৌসুমী নিষ্ঠুর, প্রতিবাদী আর প্রচণ্ড রকমের জেদি, যে কখনো অন্যায় করেও অনুতপ্ত হতে জানে না। এমনকি চোখের সামনে কাউকে নিষ্ঠুরভাবে পেটাতে দেখলেও ওর নারীহৃদয় সামান্য ব্যথিত হয় না। আমি কীরকমভাবে ওর কাছে ভালোবাসা ফেরত চাইতাম!

আমি খুব আশাহত ছিলাম আর যে কোনো মূল্যে মৌসুমীকে ছেড়ে আসতে চাইতাম। কিন্তু ছেলেটার জন্ম হওয়ায় আমার সমস্তপথ রুদ্ধ হয়ে গেল।

মৌসুমী বাচ্চাটাকে নিয়ে পরিবারের কাছে পড়ে থাকত। আমি দিনের পর দিন একা একা দগ্ধ হতাম। আমার কাজ করার উদ্যম এমনভাবে ধাক্কা খেতে লাগল, ক্রমশ কাজের গতি হারিয়ে ফেলতে লাগলাম। যখন মনের ভেতর অন্য কাউকে খুঁজে ফিরতাম, তখন তুই ছাড়া সেখানে আর কাউকে অনুভব করতাম না। আমি কল্পদৃশ্যে তোর সাথে স্মরণীয় স্মৃতিগুলোর কথা মনে করে কাতর হয়ে পড়তাম।

সেটাকে তুই ভালোবাসা বলতে পারিস না, শামীমা বলল। একজন অসহায় মানুষের শেষ অবলম্বনের মতো আমি শুধু তোর মনে প্রভাব বিস্তার করতাম। তাছাড়া তোর তো জানা ছিল, আমিও একজন বিবাহিতা নারী ছিলাম।

ভালোবাসা কখনো সংসারের প্রাচীরে আবদ্ধ কিছু নয়। একটা সুখি দম্পতিও ভেতরে ভেতরে কল্পনার মানুষটিকে ভালোবাসতে পারে যা সংসারের অন্য মানুষটি কস্মিনকালেও জানতে পারে না। আমি বললাম।

আচ্ছা তুই আমাকে বলতে পারবি, কী আছে আমার ভেতর? একথা চিরন্তন যে আমি একজন কালো মহিলা। আমার চামড়ায় কোনো লাবণ্য নেই, আমার ঠোঁটে উষ্ণতা নেই আর আমার কপালটা খোলা জমিনের মতো চওড়া আর উঁচু। আমি কি জানতে পারি, সেটা কী এমন কারণ যার জন্য তুই আমাকেই মনে মনে খুঁজতি?
আমি ঠিক বলতে পারব না। তবে যৌবনের প্রথম যে নারীর শরীরের ঘ্রাণ আমাকে উন্মাতাল করেছিল আমি বিলক্ষণ তাকে ভুলিনি। তোর সেই সময়কার চুলের গন্ধটা এখনো আমার নাকের কাছে ভুরভুর করে।

অদ্ভুত এক অচেনা হাসিতে ফেটে পড়ল শামীমা। ও আমার থুতনিতে হাত ঠেকিয়ে বলল- একযুগেরও আগে এক যুবতীকে হাতের নাগালে পেয়েও তুই তার শরীর ছুঁতে পারিসনি। তোর কাছে অন্ধকার গহ্বরের মতো চিররহস্য হয়ে আছে সেই নারীর শরীর। সেটা যত কুৎসিতই হোক না কেন, তুই সেই না-পাওয়া শরীরটাকে ক্ষণে ক্ষণে পেতে চাইতি।

শামীমা ব্যাগ থেকে একটা পুরনো ঘড়ি বের করে আমার চোখের সামনে দোলাতে দোলাতে বলল- দ্যাখ তো, ঘড়িটা কি চিনতে পারিস?

হঠাৎ আমার সেই হারিয়ে যাওয়া ঘড়িটার কথা মনে পড়ল। যেদিন আমরা ভাবীর বাসায় ডেটে গিয়েছিলাম, তারপর থেকে ঘড়িটাকে আর খুঁজে পাইনি। আমার মনে হয়েছিল, হয়তো অলক্ষ্যে ঘড়িটা কোথাও হারিয়ে গেছে কিংবা ওটা এমন কোথাও খুলে রেখেছি কিন্তু মনে নেই। তারপর ঘড়িটার কথা একদমই ভুলে গিয়েছিলাম।

আসলে তোর ঘড়িটা আমি সেদিন চুরি করেছিলাম, শামীমা বলল। তুই এটাকে একধরনের প্রতিশোধ বলতে পারিস। একজন যুবতীকে একান্তে পেয়েও তুই সেদিন দুঃসাহসী হতে পারিসনি। অথচ আমি সেদিন তোর কাছে সর্বনাশ হতেই গিয়েছিলাম। তখন কেমন একটা ঈর্ষা আমার ভেতর দাউ দাউ করে জ্বলে উঠল, আমি তোর ঘড়িটা চুরি করলাম। তারপর থেকে ঘড়িটা মাঝেমধ্যে আমার দুই স্তনের মাঝখানে রেখে দিতাম। আমার বুকের প্রতিটি স্পন্দনের সাথে তাল মিলিয়ে ওটা টিক টিক করে চলত। কল্পনায় আমি তোর আঙুলের নাড়াচাড়া অনুভব করতাম। যখন তোর-আমার দেখা-সাক্ষাৎ বন্ধ হয়ে গেল, আমি ঘণ্টার পর ঘণ্টা ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে থাকতাম।’

একটা পুরনো ঘড়ি হঠাৎ আমাকে বহুবছর আগের এক নির্জন মুহূর্তে টেনে নিয়ে গেল। আমি উপলব্ধি করলাম, একমাত্র শামীমাই আমার জন্য উপযুক্ত ছিল। অথচ শেষ পর্যন্ত আমি ওকে উপেক্ষা করলাম।

অপরিচিত গ্রামে এভাবেই আমাদের সময় ফুরিয়ে যেতে লাগল। শামীমার ভালোবাসায় ধীরে ধরে আমার পুর্নযৌবন ফিরে পেতে থাকি। তবে কখনো আমার কাছে মনে হতে থাকে, ধীরে ধীরে আমি পৃথিবীর সবকিছু থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছি। যে ভালোবাসা পাওয়ার জন্য আমার বুকের ভেতরটা মরুভূমি হয়ে থাকত সেটার প্রয়োজন আমার কাছে ক্রমশ ফুরিয়ে আসতে লাগল। মনে হয়, এক বাতিকগ্রস্ত মরুভূমির মাঝপথ ধরে গড়িয়ে গড়িয়ে ছুটে চলছি আমি। কিন্তু অনির্দিষ্ট পথের শেষ গন্তব্য কোথায় জানা নেই।

অনভ্যস্ত অলস বসে থাকায় আমাদের সময় দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হতে থাকে। প্রতিদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা যেন একেকটা বছরের সমান। শামীমা প্রতিদিন আমাকে বিয়ের জন্য প্রলুব্ধ করে অথচ আমার মনে হয়, ফিরে পাওয়া প্রেম মানুষের জীবনকে নিরন্তর হত্যা করে।

একদিন ভোররাতের হিমেল হাওয়ার পরশে শামীমা দুই হাত জড়ো করে বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। আমি বন্ধ চোখ খুলে শামীমার উষ্ণ বুক থেকে সরে গিয়ে মাথাটা নাড়াতে লাগলাম। আমার পক্ষে এখানে আর থাকা সম্ভব নয়। আমি বিছানা ছেড়ে উঠে পড়লাম। রাতের জঠর ছেড়ে উষার উন্মেষের প্রাকমুহূর্তে নিয়তি আমাকে কোথায় যেন টেনে নিয়ে যাচ্ছে। অথচ সেই পথের গন্তব্য কোথায় আমার জানা নেই। আমি রাস্তার একপাশ ধরে হাঁটতে লাগলাম। কৃষিবিদ কোম্পানির রাস্তাটা পেরিয়ে যখন ঝোপঝাড়ের কাছে চলে আসি, মনে হল আমাকে কে যেন বলছে- একদিন যে তোর কাছের ছিল তার জন্য এখন আর কোনো বিলাপ নেই। যে এখন বর্তমান, সেখানেও নিরথর্ক আটকে থাকার মানে নেই। শুধু নিষ্ঠুর কালস্রোতে দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে সময়।
আর ভবিষ্যৎ!
সে তো যে-কোনো সময় মৃত্যুকে ডেকে নিয়ে আসবে। টিলার অপরপ্রান্তের নির্জনতা ভেদ করে আমার কানে আরেকটি বাক্য বারবার প্রতিধ্বনিত হতে লাগল- ভেবো না বন্ধু, দিনশেষে প্রত্যেকেই বড় একা।