You are currently viewing মৃতরা ফিরে ফিরে আসে || রুখসানা কাজল

মৃতরা ফিরে ফিরে আসে || রুখসানা কাজল

মৃতরা ফিরে ফিরে আসে

রুখসানা কাজল

১ 

গোরস্তানের গেটে এসে থমকে দাঁড়ায় ছোট।  

অবল্য অসাড়তা পেঁচিয়ে ধরেছে ওর দুপা। শ্লথ হয়ে গেছে চলন। মন আর চলতে চাইছে না। বিভ্রান্ত চোখে ও তাকিয়ে দেখে, একটি গর্ভবতী ছাগল পিঠ চুলকে নিচ্ছে  গোরস্তানের দেওয়াল ঘষে ঘষে। স্ফীত পেট। দুধভরন্ত স্তনের গোলাপী বোঁটাগুলো  ভারী এবং সবল হয়ে উঠেছে। শীর্ণ শুকনো মুখ। শিরদাঁড়া বেরিয়ে পড়ে পাঁজরের  হাড়গুলো দেখা যাচ্ছে। কতগুলো জীবনকে পৃথিবীতে আনবে বলে এই ভারি শরীরে গোরস্তানের দেওয়াল ঘেঁষে গজিয়ে ওঠা ঘাসপাতা খেতে খেতে ছোটর দিকে তাকিয়ে  আছে। 

ছাগল মায়ের চোখে অনির্দেশ্য শুন্যতা। বুকটা দুলে ওঠে ছোটর।       

এ শহরে এসে অনিয়ন্ত্রিত আবেগে ভেসে যাচ্ছে সে। বার বার আম্মুর কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। আব্বার অকাল  মৃতুর পর অভাব দারিদ্র্যে শুকিয়ে গেছিল আম্মুর শরীর। বড়  সন্তানরা চাকরি পেলেও বিয়েশাদী করে নিজেদের সংসার গুছিয়ে নিয়েছিল। মায়ের  পাশে থেকে ছোট দুটি ভাইবোনের সেভাবে কেউ খোঁজখবর নেয়নি। সেও এক কষ্ট ছিল আম্মুর। ওরা হয়ত ভেবে নিয়েছিল আম্মু ত দুঃখকষ্টে হাল ধরার মতো একজন  শক্ত মানুষ। আম্মুকে দুঃখেই ভালো মানায়। প্রথম জীবনের স্বচ্ছলতায় কেনা সুইস ঘড়িটা হাতে পরে মেজমেয়েটি বলেছিল,‘আম্মা তুমি ত আর পরো না। ঘরেই পড়ে  আছে। কবে আবার বিক্রি দাও– তারচে আমি নিয়ে নিলাম আম্মা।’      

কিছু বলতে গিয়েও চুপ করে গেছিল আম্মা। এই মেয়ে তাকে অনিয়মিতভাবে  ওষুধের টাকা পাঠায়। মাঝে মধ্যে ঈদ পার্বণে ছোট ভাইবোনদের জামাকাপড়ও বানিয়ে দেয়। তার সেজমেয়েটি একদিন আম্মার প্রিয়, সোনার জরিপাড়ের শাড়িটি পরতে গিয়ে দেখে, ফেঁসে গেছে। এক কালে আব্বাআম্মা কলকাতায় থাকত। সেই  সুদিনে এটা পরে আব্বার সাথে ফারপোজে যেত আম্মা। সেজো চুপিচুপি শাড়ির জরিগুলো তুলে পোদ্দারের দোকানে বিক্রি করে এসে বলেছিল, ‘ধুত্তোরের স্মৃতিফিতি। তোমার ফারপোজের চেয়ে এখন কত ভালো ভালো চাইনিজ রেষ্টুরেন্ট হয়েছে। চলো না আম্মা, এই টাকায় আমরা চিকেন চাউমিন আর স্যুপ খেয়ে আসি।’          

সেদিন খুব শ্বাস উঠেছিল আম্মার। বুকপিঠে গরম সর্ষেতেল ডলে দিচ্ছিল ওরা। সেজো আম্মার পা ডলতে ডলতে চাইনিজ খাবারের নানা টেষ্টের কথা বলে লোভ দেখাচ্ছিল। একটুখানি হেসেছিল আম্মা। অই মৃত্যুলগ্ন মুহুর্তে আম্মার করুণ হাসি দেখে ছোটর মনে হয়েছিল, আট বছরের বড় বোনটিকে এক্ষুণি কিছু কথা শুনিয়ে দেয়। ঝগড়া হলে, হোক। আপুটা এত নিষ্ঠুর কেন হয়েছে কে জানে!         

অসম্ভব কষ্ট সহ্য করে আম্মা সেদিন ঘুমিয়ে গেছিল। ছোট সারারাত বসেছিল। বুকের ওঠাপড়া খেয়াল করে, নাকের নীচে বারবার হাত রেখে নিঃশ্বাস পরখ করে দেখেছে, আম্মা বেঁচে আছে ত? ওদের যে আম্মাই শক্তি।        

 ২ 

গোরস্তানে ঢোকার সাহস পাচ্ছে না ছোট। গেটের কাছে বরইগাছ পেঁচিয়ে উঠে গেছে কতগুলো উচ্ছেলতার গাছ। তাতে হলুদরঙ ফুল ফুটেছে। দুটো ভ্রমর অসুন্দর ডানা ঝাপটে বসতেই নুয়ে পড়ছে ফুলগুলো। স্মৃতি ফেনারাশি ছেড়ে ওর মনে ভেসে আসে একটি দৃশ্য। ময়লারঙের এক বিকেলে পুরনো ডিভানে শুয়ে আব্বা আম্মাকে বলেছিল, ‘ শরীর খুব ভার লাগে আজকাল। মাথাটা নুয়ে আসে বুঝলে সালমা। মাসল্‌গুলোতে মনে হয় জং ধরে গেছে। কখন যে ভেঙ্গে পড়ি।’              

সেদিন আব্বাআম্মার কাছে ছুটে যেতে গিয়েও যায়নি ছোট। তদ্দিনে ও বুঝে গেছিল, বাবামায়ের একান্ত সময়ে কাছে যেতে নেই। ফাইভ পেরিয়ে সিক্সে উঠেছে সে । পাড়ার দর্জিদাদু ইশকুল ইউনিফর্মের মাপ নিয়ে বলেছিল, ‘কন্যাগো, তুমার বুকে দেহি দুধের মুচি উঠতিছে —’ 

  
তাই শুনে আব্বাস নামের সহকারি দর্জিটা কেমন চোখে ওর দিকে তাকিয়ে দেখছিল। লজ্জায় কুঁচকে গেলেও বেপরোয়া ভাব দেখিয়ে ও বলেছিল, ‘খাটাশবুড়ো তোর হাড় আমি ভেঙ্গে দেব।’     

৩  

ঈদুলচাচা ঘটকালি করত বলে শহরের সবার বাড়িতে অবাধে চলে আসত। প্রায়  বিকেলে ওদের বাসায় এসে আম্মাকে বলত, ভালো একজন পাত্র পেয়েছি গো বড়বউ।  এই যে দেখো ছবি। ঘর, বংশ খারাপ না। 
আম্মা ছবি দেখে চাচাদের ডেকে বলত, তোদের মিয়াভাইকে একটু বুঝিয়ে বলনা  ভাই। যার এতগুলো মেয়ে তার কি এমন পাত্র ফিরিয়ে দেওয়া সাজে ! 

চাচারা জানত, মিয়াভাইকে বুঝিয়ে লাভ নেই। স্বপ্নের জগতে থাকে তাদের ভাই। স্বপ্নে বাঁচে। কিন্তু যাদের নিয়ে স্বপ্ন দেখে তারা যে সেই স্বপ্নের মূল্য দিচ্ছে না এটা মিয়াভাই কোনদিনই বুঝবে না। ভাইরা তাই কিছুটা বিরক্ত হয়েই দূরে সরে থাকত।       

ছোটর মনে আছে, ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া শেখাতে আব্বাআম্মা বদ্ধপরিকর ছিল। কি স্বপ্ন দেখেছিল ওরা কে জানে! মেয়েরা চাকরি করে স্বাবলম্বী হবে। সমাজ সংসারে মাথা উঁচু করে চলবে। আব্বা ত আত্মীয়মহলে বলে দিয়েছিল, তার মেয়েদের বিয়েটিয়ে এখন বন্ধ। তবু ঘটকচাচা আসত। পাত্র ভালো, ঘর ভালো, চাকরি ভালো। আব্বা ভাবত, মেয়েদের ব্রেন ভালো। স্বাস্থ্য ভালো। সুশ্রী দেখতে, আচার ব্যবহারেও চৌকস। তার মেয়েদের জন্য ঘটক ত আসবেই। আম্মা অনেক বুঝাত, ‘ভালো পাত্র, ভালো ঘর। তুমি রাজি হও প্লিজ। তোমার সেজমেয়ে কিন্তু উড়ু উড়ু স্বভাব পেয়েছে। পড়াশুনার চেয়ে প্রেমট্রেম ভালোবাসে। কখন কি করে বসে ভয় হয়।’        

আব্বা হেসে আম্মার কথা উড়িয়ে দিয়ে বলেছিল, ‘আল্লাহ কি আর সবার মনে প্রেম দেয় সালমা ! এসব ভেবে তুমি আর দুশ্চিন্তা করো না। তাছাড়া পরীক্ষার চাপ পড়লে এসব প্রেমট্রেম কোথায় কেটে যাবে।’          

কাটেনি। বরং আম্মার আশঙ্কাকে সত্যি করে পারিবারিক মানসম্মান কেটেকুটে দিয়েছিল সেজোপু। পড়াশুনা না করে সকাল বিকেল বাগানের দেওয়ালের খাঁজে, গেটের নীচে যে প্রেমপত্র আসত সেগুলোর হিসেব রাখতে শুরু করেছিল সেজো। এমনকি কেউ একদিন চিঠি না দিলে তাকে চার্জ করে বলত, কিরে তোর চিঠি কই কাল্টু! এসব দেখে আম্মা খুব বকেছিল। বকা খেয়ে সেজো যে এমন সাংঘাতিক কান্ড করে বসবে, কেউ ভাবতেও পারেনি। সবাই ভেবেছিল, রাগ অভিমানে ওর ফুপিমার বাসায় চলে গেছে। দুদিন পরে নিজেই ফিরে আসবে। কিন্তু দুদিন পর জানা গেল, পড়াশুনা ভালো লাগে না বলে সেজোপু ওর ছোটবেলার বন্ধু কাল্টুর সঙ্গে পালিয়ে  গেছে। ওরা তাজমহল দেখে আজমীঢ় শরীফ যাবে। সেখান থেকে হিমালয়, আরও অনেক জায়গায় ভ্রমণের প্ল্যান করেছে দুজন। ঈদুলচাচা দুঃখ করে বলেছিল, ঘুরতে যাচ্ছে ভালো কথা। কিন্তু হিন্দুর ছেলের সাথে কেন ? তাই শুনে, সামাজিক বয়কটের কঠিন খাঁড়া নেমে এসেছিল ওদের পরিবারে। সেকি দুঃসময়! চাচাফুফু আত্মীয়রা সরে গেছিল। আব্বা আর সামলাতে পারেনি। সেই রেশ এখনও ওদের পোহাতে হচ্ছে।  

      

৪              

ছোট দেখে কবরের ফাঁকে ফাঁকে আম, বেল, আতাসহ অনেক গাছ টগবগিয়ে বেড়ে উঠেছে। বাঁধানো কবরগুলোর উপর ফুটেছে নানারঙের ফুল। কাঁচা,আধকাঁচা কবরগুলোতে হাস্নুহেনা, কামিনী আর দেশী গোলাপের বাড়বাড়ন্ত ঝাড়। গাছগুলো তীব্র সতেজ। এরা কোথায় পায় এত সরসতা ? কবর ত গাছ নয় যে গোররক্ষক রোজ পানি দেবে, সার খাইয়ে যত্ন করবে, নিঃশ্বাস নিতে মাটি খুঁড়ে আলগা করে দেবে শিকড়ের জড়তাকে!   

শহরের সবচে পুরনো এই গোরস্তান। এখানে মৃত মাবাবার বুকে সন্তানের কবর, তার বুকে তার সন্তান, এভাবে কবরের উপর কবর নিয়ে যেন চেয়ে আছে। ছোটর মনে হল, প্রতিটি কবর যেন নড়ে উঠল খুশিতে, কে এলো? কে এলে? ওগো কে এলে তুমি মেয়ে?    

ভয়তরাস গলায় ও বলে ওঠে, ‘মামা, চলো ফিরে যাই।’        

‘কি যে বল খালা। এতদূর এসে কেউ কি ফিরে যায়। চলো চলো’— ইভানমামা হাঁটতে শুরু করেছে। ছোট ভয়ে ভয়ে মামার পেছনে হাঁটতে থাকে। রাস্তা জুড়ে বিছিয়ে আছে যশোরলতা। সেগুলো না পাড়িয়ে সযত্নে সরিয়ে দেয় মামা, ‘তোমরা ত নানার কবরটা বাঁধাতে পারতে খালা। কত টাকা লাগত বল!’      
‘তুমি ত জানো, আব্বা এসব পছন্দ করতেন না। উনি মাটির দেহ মাটিতেই মিশিয়ে রাখতে চেয়েছিলেন।’    

‘উনি তো আল্লার ফেরেশতার মতো মানুষ ছিল। দুনিয়াদারী কিছু কি বুঝত। তোমরা কেন শুনলে! জানো খালা, একবার উনার মৃত্যুবার্ষিকীতে কবরই খুঁজে পাচ্ছিল না কেউ। কোথায় ফুল দেবে, আর কার কবরে দোয়া পড়বে! শেষতক গোররক্ষক এসে দেখিয়ে দিয়ে গেছল। সবাই খুব ছি ছি করেছিল তোমাদের।’       

ছোট চুলগুলোকে ঘোমটার ভেতরে গুঁজে দিয়ে ছোটন ভাবে, ক্লিপ আটকে আসা দরকার ছিল। কেউ দেখলে ছিছি করে উঠবে। কিন্তু এটা ত সত্য, ওরা কোন ভাইবোন কেউই কখনও এসে আব্বাআম্মার কবরে দোয়া পড়ে না বা পড়ানোর ব্যবস্থাও করে না। আব্বার মৃত্যু হয়েছিল স্ট্রোকে। বাকি পনেরোটা বছর আম্মা একা ধুঁকে ধুঁকে অযত্ন আর অবহেলা নিয়ে মরে গেছে। ছোটও বড়দের মতো অবহেলা করতে শিখে নিয়েছিল। ভাবত, আম্মা ত না খেয়েও থাকতে পারে। কিম্বা কিছু না কিছু ঠিকই ম্যানেজ করে নেবে, ভাবনা কি!    

পা ভেঙ্গে আসে ছোটর। ইভানমামার কাছে ও সত্যিটা বলে না। আসলে ওরা ভাইবোনেরা কেউই টাকা দিতে চায়নি বলে আব্বাআম্মার কবর পাকা করা হয়নি। এই কি পাপ? তবে ত জাহান্নামও আছে এই পাপের শাস্তি ভোগের জন্য। তবুও সবাই কেমন বীরদর্পে চলে। ও কেন পারে না? ওর প্রাণে কেন এত সংশয় বাজে? কেন মনে হয়, বড়দের করা একই ভুল ও কি করে করলো? কেন ওর বোধের জমিন পুড়ে যায় অনুশোচনার আগুনে?  

চোখ বন্ধ করে ফেলে ছোট। কেঁপে ওঠে ওর অন্তরাত্মা। ডাবের জলে কচি শাঁস আর বরফকুচি দিয়ে আম্মা যেন বলছে, পরীক্ষা কেমন হল রে ছোট ?  

ক্রমাগত পরীক্ষায় ভালো করে চাকরি পেয়েই বিয়ে করে ফেলেছিল ছোট। একবারের জন্যেও ভাবেনি আম্মাকে দেখতে হবে। বয়েস হয়ে গেছে আম্মার। অভাবের সাথে লড়ে অনিয়মিত খেয়ে আম্মা ক্ষয়ে গেছে। এখন একটু যত্নের প্রয়োজন। নিজের স্বার্থ নিয়ে সব সময় ভেবেছে। নিজের সংসার, সন্তান। তাদের ভালো রাখা, ভালো খাবার দেওয়া, পড়াশুনা ইত্যাদি। কত চাপ ! চারদিকে স্বপ্নেরা ভাসছে। সেগুলো ধরতে হবে যে তাকে!       

  

৫   

একটুখানি কান্না উথলে ওঠে ওর মনে। কিন্তু অন্তরাত্মা থেকে জল আসে না বলে চোখ ভেজে না। তবু চোখ মুছে নেয়। পাথরের মত শক্ত মণিদুটো ঘষা খেয়ে সামান্য ছলছল করে ওঠে। ইভানমামা সরল মানুষ। তাড়াতাড়ি বলে ওঠে, ‘কাইন্দো নাগো খালা। সন্তানের সেবাযত্ন কি সব বাবামার ভাগ্যে থাকে!’   

একসময় ওদের বাগানবাড়িতে ঘর তুলে অনেক আশ্রিতজন থাকত। ইভানমামা তাদের একজন। আব্বুর ফার্মেসি আর আম্মার নিজস্ব জমিগুলো দেখাশুনো করত। ছোটকে চোখ মুছতে দেখে মন নরম গলায় বলে, ‘খালা তওবা করে দোয়া পড়। পারো ত? না পারলে আমার সাথে বল।’     

মনকে শক্ত করে ছোট বসে পড়ে ওর আব্বার কবরের পায়ের কাছে। আব্বা  বলেছিল, ভুল আরবী পড়ার চেয়ে আল্লাহর কাছে কিছু চাইতে হলে নিজের মাতৃভাষায়   চাইবে। আরবী ত একটি জাতির ভাষা। তারা তাদের ভাষায় আল্লাহকে ডাকবে, তুমি তোমার ভাষায় ডাকবে। আল্লাহ সর্বজ্ঞ। তার অবোধ্য কিছুই নেই।            

ছোট জানে, ইভানমামা ওর কান্নার গল্প করবে অনেকের কাছে। মসজিদে। অফিসে। আড্ডায়। চায়ের ষ্টলে। তাতে ওদের নিয়ে আত্মীয়স্বজনদের ভুল ধারণা কিছুটা হলেও  কমে যাবে। অনেক কিছু ভেবেই এখানে এসেছে সে। অনেকদিন ধরে ওর মনের  মধ্যে অনুশোচনা ভয়, লজ্জা আর অপরাধবোধ খুঁচিয়ে যাচ্ছিল। এক সময় বড়দের মতো ভাবত, ওর  বাবামা বোকার হদ্দ। এখন বোঝে, ওরা বড় সরল স্বপ্ন দেখেছিল।  ওদের সেই স্বপ্ন কোন সন্তানই পূরণ করতে পারেনি। 

পারিবারিক সেই দুঃসময়ে, বাকিতে ওষুধ নিয়ে দেবোদিচ্ছি করা এক বাসায় গেছিল ছোট। আব্বার সাথে দোস্তি সম্পর্ক ছিল। টাকা শোধ করে ছোটকে অনেক কটু কথা শুনিয়েছিল, তোর আব্বা নাস্তিক। রোযা করে না, নামাজ পড়ে না বলেই ছেলেমেয়েরা এমন বেয়াদব হয়েছে। 

সেদিন রাগ করে ছোটন উঠে এসেছিল। আজ ও সেই বাসায় যাবে। 

তিন মহলা লাল বাড়িটিতে এখন ইঁদুর পঁচা গন্ধ ভাসে। ওদের মেজমেয়ে পরকীয়ায় মেতেছিল। স্বামী বা প্রেমিকের হাতে ছুরি খেয়ে মারা গেছে। ছোট মেয়েটি পালিয়ে গেছিল এক বখাটে ছেলের সাথে। দুটি বাচ্চা নিয়ে এখন অনেক খারাপ অবস্থায়   আছে ওরা। প্রায় দিন ছোটনকে ফোন করে কাঁদে। 

কিন্তু গিয়ে কি বলবে ওদের? বলতে পারবে, ভবিতব্য কাকামণি। মানুষ তার ভাগ্যলেখা এড়াতে পারে না। আমার আব্বাআম্মাও পারেনি। তাই বলে কাউকে হেনস্থা করতে নেই। মেয়েটাকে ক্ষমা করে দেন।       

পা ছোঁয়ার মতো কবরে হাত রাখে ছোটন। হিম ঠাণ্ডা কবর। মামা মোনাজাত ধরেছে, ‘কবরবাসী পুণ্যাত্মাগণ, আমাদের ক্ষমা করুন আর শান্তিতে থাকুন। আপনারা আমাদের আগে মৃত্যুপথে গিয়েছেন, আমরাও দ্রুত আসছি। আমিন।’

এবার অন্তরাত্মা ভেঙ্গেচুরে কান্না আসে ওর। মনে মনে কাঁদতে থাকে ছোটন, আব্বাআম্মাগো আমাকে ক্ষমা করে দেন, ক্ষমা করে দেন আমাদের!         

=======================