You are currently viewing মুর্শিদা > লতিফ জোয়ার্দার

মুর্শিদা > লতিফ জোয়ার্দার

মুর্শিদা
লতিফ জোয়ার্দার

আউট সিগনাল বরাবর মেয়েটাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে, ভেবেছিলাম মেয়েটা হয়তো আত্মহত্যা করবে আজ। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টির সন্ধ্যায় আমি তখন একা। স্টেশনের দিকে যেতে যেতে মনে হলো, মেয়েটার সাথে একবার একটু কথা বলা প্রয়োজন। অথচ আমি কোনো কথা না বলেই এগুতে থাকলাম। যে জাগতিক দুঃখ থেকে মুক্তি চায় ! তাকে ধরে রেখে কী লাভ। তার জন্যে আত্মহত্যা করা ভালো। হয়তো সে সব লোভ, সব মোহ, সব দুঃখ, সব ভালোবাসা থেকে নিজেকে হারাতে পারবে। নিজের সাথে নিজের চূড়ান্ত ফয়সালার নাম হলো আত্মহত্যা করা। কয়েক কদম পা ফেলার পর আরও একবার ফিরে চাইলাম আমি। আধো আলো অন্ধকারে আর কিছুক্ষণ পর মেয়েটা হয়তো হারিয়ে যাবে। সিগনালে লালবাতি জ্বলে আছে। আজ হয়তো ট্রেন লেট। অথচ মেয়েটি সঠিক সময়েই এসে ট্রেনের জন্য দাঁড়িয়ে আছে। আউট সিগনাল থেকে স্টেশনের দূরত্ব এক কিলোর মত হবে। দ্রুত পা চালালে বিশ মিনিটের বেশি লাগার কথা নয়। কিন্তু আজ বৃষ্টির কারণে সেভাবে পা চালানো যাচ্ছে না। কিছুদূর যাওয়ার পর মনে হলো, মেয়েটার হাতে কোনো ব্যাগ ছিলো কিনা? অথবা মেয়েটা কাউকে কিছু বলতে চায় কিনা? অল্প সময়ের মধ্যে চারপাশের সবুজ বৃক্ষগুলোয় অন্ধকার বাসা বাঁধলো। অজান্তে হঠাৎ করেই পিছন ফেরার সিদ্ধান্ত নিলাম আমি। বিষয়টা আমার কাছে অনেকটা স্বপ্নের মত মনে হলো। আমাকে আবার ফিরে আসতে দেখে! সে হয়তো কোনো এক ঝোপের আড়ালে লুকাবে। অথবা তার কোনোকিছুই হবে না। কিন্তু আমি তাকে যে অবস্থায় দেখি গেছি, এখনো সে সেই অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে। কে এলো আর কে গেল! এ বিষয় নিয়ে তার কোনো মাথাব্যথা নেই।

ইতোমধ্যে আমি আবার তার কাছে ফিরে এসেছি। কিন্তু ফিরে আসার পর মনে হলো, আমার প্রতি তার কোনো প্রকার খেয়াল নেই। আমি পকেট থেকে মোবাইল লাইটটা বের করে তার মুখের দিকে ধরতেই, সে আমার দিকে তেড়ে এলো। বোরকার নেকাবে তার পুরো মুখমন্ডল ঢাকা। বয়স হয়তো ছত্রিশ সাইত্রিশের বেশি হবে না। স্বাস্থ্যও বেশ ভালো। দেখতেও তেমন একটা মন্দ না। হঠাৎ তার কথায় সব এলোমেলো হয়ে গেল আমার।

– কি মনে হয়, এই বৃষ্টির মধ্যে কাস্টমার ধরার জন্য দাঁড়িয়ে আছি আমি। আমাকে দেখে কি পতিতা লাগে?
হঠাৎ আমি যেন সব ভাবনা থেকে ছিটকে পড়ি। অল্প সময়ের মধ্যে সে তার নেকাব খুলে আমাকে ফিরে যাবার কথা বললো।
– শুনেন আমি কিন্তু পতিতা না। পতিতারা কখনো আউট সিগনালে দাঁড়িয়ে থাকে না।
তার কথা শুনে কিছু একটা বলার জন্য ব্যাকুল হলাম আমি । অথচ তার প্রতি আমার কোনো রাগ কোনো অভিমান কিছুই হচ্ছে না।
– তবে আপনি এখানে কি মনে করে?
– দ্যাখেন বেশি কথা বলার সময় নাই আমার। প্যাচাল না পেরে অন্য জায়গায় কাস্টমার খুঁজেন গিয়ে! পেলেও পেতে পারেন।
এখন এ সময় আমার কী করা উচিত ঠিক বুঝে উঠতে পাচ্ছিছিলাম না। অল্প সময়ের মধ্যে সিগানলে সবুজবাতি জ্বলে উঠলো। মেয়েটা আমাকে তাড়ানোর জন্য ব্যস্ত হয়ে উঠলো।
– এই যে মিয়া গেলেন না যে। আর কিছুক্ষণ থাকলে আমি কিন্তু লোক ডাকবো। চিলা-পালা করবো।

আমার তখন মনে হলো, প্রয়োজনে তাই করুক সে। তবুও তো মেয়েটার জীবন বেঁচে যাবে। নিশ্চয় আমাকে দেখে লোকজন খারাপ মানুষ ভাববে না।

এভাবে কিছু সময় দাঁড়িযে থাকতেই, বেশ দূরে তখন ট্রেনের আলো দেখা গেল। আমি তখন ঘেমে উঠছি। ফিরে গেলে মেয়েটা নিশ্চিত আত্মহত্যা করবে। আর এখানে থাকলে হয়তো এখনই চিল্লা-পাল্লা শুরু করে দিবে। কী করা উচিৎ কিছইু বুঝে উঠতে পারছিলাম না। বার বার মনে হলো এই বুঝি সে চিলাইয়া ওঠে। দ্রুত ট্রেনের আলো এগিয়ে এলো। তখন আমাকে সে বার বার হুসিয়ার করছে।
-এখনো সময় আছে চলে যান, নইলে আমি কিন্তুক!

ততক্ষণে আমি বুঝে গেছি সে আমাকে হুমকি দিচ্ছি। প্রকৃতই সে কোনো প্রকার চিল্লাপাল্লা করবে না। আমাকে ভয় দেখানোর জন্যেই তার এ কাজ। হয়তো আজ বৃষ্টির কারণে এদিকে কেউ আর আসবে না। যে দুই-চারটা বাড়ি-ঘর আছে তাও বেশ দূরে। হঠাৎ করে ট্রেনের সবুজবাতি নিভে গেল। মনে হলো ট্রেন খুব ধীরে ধীরে আসছে। আবার সিগনালে লালবাতি জ্বলে উঠলো। মনে হলো সিগনালের একটু অদূরে ট্রেন এসে দাঁড়ালো। হঠাৎ করেই আমার কাছে যেন সবকিছু ভূতুরে মনে হচ্ছিল। আমার এই পথে যাওয়া। একটা মেয়ের আত্মহত্যা করার প্রস্তুতি। ট্রেনের লালবাতি, সবুজবাতি আবার লালবাতি। সব যেন গোলমেলে লাগছিলো। কি করবো বুঝে উঠতে পারছিলাম না আমি।

আমাদের এই স্টেশনে একটাই মাত্র ট্রেনলাইন। লোকাল ট্রেন ছাড়া আর অন্য কোনো ট্রেন দাঁড়ায় না এখানে।অথচ দূর থেকে মনে হলো স্টেশনে আরো একটি ট্রেন দাঁড়িয়ে আছে। অজগবি সব কারবার। একই লাইনে দুইটা ট্রেন। সব এলোমেলো আমার কাছে। মেয়েটি তখনো আমার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। তার হাতে ধরা একটি ব্যাগ। সেই ব্যাগে হয়তো তার প্রয়োজনীয় কাপড়-চোপড় আছে। আমি আরো একবার মোবাইলে টর্চ লাইট জ্বলিয়ে তাকে চেনার চেষ্টা করলাম। হয়তো তাকে চিনি আমি। তার কণ্ঠ আমার কাছে বেশ পরিচিত মনে হলো। মেয়েটা দেখতে বেশ কালো। তবে সুন্দর। এর আগে আমার সাথে দেখা হযেছে কিনা ঠিক মনে করতে পারছিলাম না। সে আমাকে চেনে অথচ আমি তাকে চিনি না। ততক্ষণে বৃষ্টি থেমে গেছে। তাকিয়ে দেখি কোনো ট্রেন নেই কোনো সিগনাল বাতি নেই। সিগনাল ছেড়ে আমরা অনেক দূরে চলে এসেছি।

আর একটু এগুলেই স্টেশন। হারিকেনের মত টিমটিম করে জ্বলে আছে স্টেশনের বাতি। দু’একটা চায়ের দোকান ছাড়া সব দোকানপাট বন্ধ তখন। মেয়েটা যেদিকে যাচ্ছে আমিও যেন সেই দিকে যাচ্ছি। সব যেন তার ভেলকিবাজির খেলা। আবার কখনো সে আমাকে বলছে,
– কোথায় নিয়ে যাবেন আমায়? পাঁচ শত টাকা ছাড়া আমি কিন্তু কাম দেই না।

তখন আমার যেন পাগল হবার দশা। কিছুই বুঝতে পারছি না আমি। একটা মেয়ে মানুষ। সিগনাল বাতি,ট্রেন, স্টেশন। তার আহ্বানে আমি যেন বোবা বোনে গেছি। অথচ আমার কোনো পটেক নেই। আমার কোনো মানিব্যাগ নেই। ততক্ষণে মেয়েটা আমার হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছে। অতঃপর আমরা স্টেশনের পাশে একটা খুপরি ঘরের দিকে এগুচ্ছি। অথচ কোনো প্রকার লালসা নেই আমার। কোনো কামভাব নেই আমার। আমার কোনো পকেট নেই। কোনো টাকা পয়সা নেই আমার কাছে।

আমরা এগুচ্ছি একটা ধূসর খুপরি ঘরের দিকে। অল্প সময়ের মধ্যে আমি তার অদ্ভুত হাসির শব্দ শুনতে পেলাম। সে আমাকে বোকতে শুরু করলো।
-সব শুকুনেরা এক। আমার মাংশ খেয়ে আর টাকা দেয় না। সব শুয়োরেরা এক! আমাক বাগাইয়ে আর টাকা দেয় না। জানিসনি আমার তো সুংসার আছে। স্বামী ছালপাল আছে। তারা আমাকে লটি -বেশ্যি কয়। ছিনাল বৈতিল কয়।
কিছুক্ষণ পর আবার কাঁদতে শুরু করলো সে।
-সেই জন্যিই তো মরতি চাই আমি। বাঁইচি থাকি আর কী হবি। যেখানে কেউ বিশ্বাস করে না। না হয় আমি একটা প্রেম করিছিলিম। ভাব-ভালোবাসা করিছিলিম। আরে ছায়াল-পাল হলি কী আর প্রেম করা যায় না। ভাব- ভালোবাসা করা যায় না? এই মিনসি তোর নাম কি? আমার নাম শুনবু। আমি মুর্শিদা। গাং পারের মুর্শিদা। এই গাঁয়েই আমার বিয়ি হইছিলি। আমি তুবারের বউ। আমার বড় ছাওয়াল এবার এস এস সি পরীক্ষা দিবি। ছোট মেয়ে ক্লাস টু-তে পড়ে। সুংসারে কত কাজ করি আমি। তাও আমাক বিশ্বাস করলি না হারামজাদা। আরে কত মান্ষুই তো কত কিছু করে। তুই কী সাদু। লটি পাড়ায় যাসনি কুনুদিন। মাগির ঘরে ঢুকিসনি তুই। আর মিয়ি মানুষ একটা কতা কইলিই জাত চইলি যায়। একটা কিছু করলিই সমাজের গায়ে ফোঁরা ওঠে।

আমার কাছে যেন সবকিছুই অবাক বিষ্ময়। মনে হচ্ছে আমি আমার পৃথিবীতে নেই। মনে হলো কিছুটা দূরে চলে এসেছি আমরা। সামনেই একটা খুপরি ঘর। অথচ আমার সকল অনুভূতি নিস্তেজ। আমি যেন মরা বৃক্ষ। মুরশিদা তখন বোরকা খুলে ফেলেছে। খুপরি ঘরে গিয়ে হয়তো সালোয়ার-কামিজ সব খুলে ফেলবে সে। আমাকে কাম ভাব জাগাবে। অথচ আমি তখন ৫০০ টাকায় চিন্তায় নিমগ্ন।

আমরা যত দূরে যাচ্ছি ততদূরে এগিয়ে যাচ্ছে খুপরি ঘর। বারবার দূরুত্ব বাড়ছে খুপরি ঘরের। মনে হলো স্টেশন থেকে আমরা বেশ দূরে চলে এসেছি। মনে হচ্ছে কোথায়ও সিগনাল নেই। কোথায়ও কোনো বাতি নেই। সব হারিয়ে গেছে যেন। আমার হাতে কোনো হাতঘড়ি ছিলো না। মুর্শিদাকে বললাম, এখন কয়টা বাজে? সে তখন আমাকে বললো, আমরা সময়ের সীমা অতিক্রম করে এসেছি। এখানে কোনো সময় নেই। কাল নেই, ক্ষণ নেই। এখানে কোনো আলো নেই,কোনো অন্ধকার নেই। এখানে কোনো রাত নেই, কোনো দিন নেই। আমরা একটা আশ্রয়, এক খুপরি ঘর খুঁজে বেড়াচ্ছি। মুর্শিদার কথার কোনো মাথা-মুন্ডু কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। মাঝে মাঝে মনে হচ্ছিল আমরা হয়তো মৃত্যু ট্রেনের যাত্রী। সকল সিগনালবাতি পেরিয়ে এসেছি আমরা।

মুর্শিদা আবার হাসছে। আমি কী করে তার সঙ্গী হলাম। সব স্মৃতি হারাচ্ছি তখন আমি। একটা রেললাইন। গুড়িগুড়ি বৃষ্টি। ছাতা মাথায় আমি হেঁটে চলেছি। স্টেশনে আমার একবন্ধুকে আনতে যাচ্ছি আমি। কোথায় ট্রেন, কোথায় আমার বন্ধু? কিছুই মনে করতে পারছি না আমি। সব যেন সময়ের ভেলকিবাজি। মনে হচ্ছে অনন্ত পথ বেয়ে কোথায় যেন ছুটে চলেছি আমি। মুর্শিদা খুপরি ঘরের খোঁজে দ্রুত পা চালাচ্ছে।
মুর্শিদা, একটু আস্তে হাঁটো। আমি তোমায় ধরতে পারছিনা কেন মুর্শিদা?
ধীরে ধীরে মুর্শিদা আর আমার দুরুত্ব বাড়ছে। ধীরে ধীরে মুর্শিদা দূরের গ্রহ হয়ে যাচ্ছে। কয়েক কোটি আলোকবর্ষ আমাদের দুরুত্ব এখন। মুর্শিদা এখন অতীত। মুর্শিদা এখন কেবল পুরনো স্মৃতি।

রাজশাহী এক্সপ্রেজ ট্রেন সেদিন ছিলো দুই ঘণ্টা লেট। বন্ধু মাহমুজকে নিয়ে স্টেশন থেকে ফেরার পথে। আউট সিগনাল বরাবর কিছু মানুষের হট্টগোল হৈ-চৈ এর শব্দ শুনা গেল। বেশ কিছু টর্চের আলো এক হয়ে আছে সেখানে। আমরা সিগনালের নিকটবর্তী হচ্ছি। আর আমার বুক কাঁপছে। অল্প সময়ের মধ্যে হট্টগোলের কাছে এসে শুনি, আউট সিগনাল বরাবর একটা মেয়ে আত্মহত্যা করেছে আজ। মেয়েটার নাম ঠিকানা কেউ জানে না। অথচ আমার মনে হলো মেয়েটার নাম মুর্শিদা।