You are currently viewing মাহমুদ দরবেশের কবিতা || ভুমিকা ও অনুবাদ: তূয়া নূর

মাহমুদ দরবেশের কবিতা || ভুমিকা ও অনুবাদ: তূয়া নূর

মাহমুদ দরবেশের কবিতা

ভুমিকা ও অনুবাদ: তূয়া নূর

মাহমুদ দরবেশ ফিলিস্তিনী জনগণের অনুপ্রেরণা ও প্রাণের কবি। তাঁর কবিতা জুড়েই ফিলিস্তিনী জনগণের অস্তিত্ব, অধিকার, ক্ষোভ ও সংগ্রামর কথা। ফিলিস্তিনী কবি মাহমুদ দরবেশ গ্যালিলির আল-বিরওয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন ১৯৪১ সালের ১৩ মার্চে। তার জন্ম মধ্যবিত্ত কৃষক পরিবারে। বাবা মা কৃষিকাজে ব্যস্ত থাকতো আর মাহমুদ বেড়ে উঠেছেন দাদার আদরে। ১৯৪৮ সালের যুদ্ধে ইসরাইল এই গ্রামটা দখল করে ও সেখানকার অধিবাসীদের বিতাড়িত করে। পরের বছর তারা ফিরে এসে দেখে দেখেন তাদের বাড়িঘর ভেঙে বড় দুটো স্থাপনা বানানো হয়েছে। দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক হিসাবে গণ্য হলো সেখানকার আরবরা। এখানের স্কুলে তার প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হলো। স্কুলে এক উৎসব উপলক্ষে তিনি লিখেছিলেন একটা কবিতা, যেখানে একজন ফিলিস্তিনী বালকের মনের কথা আছে। এই কবিতা নিয়ে মাহমুদ পরে বলেছেন, কথা গুলো আমার হুবহু মনে নেই তবে ভাবটা এমন ছিলো—
তুমি খেলতে পারো রোদে যখন ইচ্ছে
তোমার আছে খেলনা
আমি খেলতে পারি না
তোমার বাড়ি আছে, আমার কিছু নেই
তোমার উৎসব আছে, আমার নেই
আমরা কেন খেলতে পারি না এক সাথে?

তার কাব্যগ্রন্থ Leaves of the Olive (১৯৬৪), A Lover from Palestine ( ১৯৬৬) ও End of the Night (১৯৬৬) ইসরাইলে প্রকাশিত হয়। তিনি ছিলেন আপাদমস্তক আধুনিক। বিয়ে করেন ভালবেসে এক ইহুদী নারীকে। তিনি যুক্ত হয়েছিলেন ইসরাইলী কম্যুনিস্ট পার্টির সাথে। সম্পাদনা করে আল ইত্তিহাদ পত্রিকা। এ সময় ইসরাইলী ফিলিস্তিনীদের উপর জাতীয়তাবাদী মত প্রকাশের উপর নিষেধাজ্ঞা ছিলো। তিনি কয়েকবার জেলে যান ও অধিকাংশ সময় ছিলেন অন্তরীণ অবস্থায়।

১৯৭১ সালে তিনি ইসরাইল ত্যাগ করে মস্কোতে আসেন পড়াশুনা করার জন্য। সেখান থেকে কায়রো ও পরে বৈরুতে আসেন। যুক্ত হন ফিলিস্তিনী মুক্তি আন্দোলনের সাথে।

উদ্বাস্তু হয়ে মাহমুদ দরবেশ বৈরুত ও প্যারিসে বহু বছর নির্বাসিত জীবনযাপন করেন।

‘পরিচয়পত্র’ ফিলিস্তিনের জাতীয় কবি মাহমুদ দরবেশ (Mahmoud Darwish) এক বিখ্যাত বিখ্যাত কবিতা। এই কবিতার জন্য যা ফিলিস্তিনী জনগণের কাছে গণসংগীত হয়ে ওঠে। কবিতাটা প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৬৪ সালে। বারবারা হারলো সম্পাদিত Resistance Literature সংকলনে ১৯৮৭ তে স্থান পায় ডেনিজ জনসন-ডেভিসের এই কবিতার ইংরেজি অনুবাদ। এই কবিতায় পরাধীনতার বিড়ম্বনা স্বরূপ নিজ ভূমিতে সামরিক পোষ্টে আইডিকার্ড চেক ও শত প্রশ্নের উত্তর এই কবিতায় উঠে এসেছে। ফিলিস্তিনীদের প্রতিরোধ আন্দোলনে এই কবিতা প্রেরণা দিয়েছে।
তাঁর কবিতার বই তিরিশের উপর এবং গদ্যের বই আটটা। চল্লিশটা ভাষায় অনুদিত হয়েছে তাঁর কবিতা। তিনি পেয়েছেন ল্যানান ফাউন্ডেশন থেকে ল্যানান সাংস্কৃতিক স্বাধীনতা পুরস্কার, পেয়েছেন লেনিন শান্তি পুরস্কার। ফ্রান্স থেকে পান নাইট অফ আর্টস এবং বেলেস লেটারস পদক। ২০০৮ সালে নিউ ইয়র্ক টাইমস মাহমুদ দরবেশকে সমসাময়িক আরব কবিদের মধ্যে অন্যতম প্রধান কবি হিসাবে বিশেষিত করে। ২০০৮ সালের ৯ আগস্ট তিনি মারা যান টেক্সাসের হিউস্টনে।

পরিচয়পত্র
আরবি থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ: ডেনিজ জনসন-ডেভিস

আমার নাম নিবন্ধন করো
আমি একজন আরব
আমার পরিচয় পত্রের নাম্বার হল পঞ্চাশ হাজার
আমার আটটা সন্তান
নয় নম্বর যে সন্তান— আসছে গ্রীষ্মের পর
তুমি কি ক্রোধে অন্ধ?

আমার নাম নিবন্ধন করো
আমি একজন আরব
আমি অন্য বন্ধুদের সাথে পরিশ্রম করে পাথর খুঁড়ে আনি
আমার আটটা সন্তান
তাদের জন্য রুটি, কাপড় আর পাঠ্যবইয়ের সংস্থান করি নুড়িপাথর থেকে
আমি তোমার দরজায় ভিক্ষা চেয়ে হাত পাতি না
হই না নতজানু তোমার দোরগোড়ায়
এতে কি তুমি রেগে যাও?

আমার নাম নিবন্ধন করো
আমি একজন আরব
আমার একটা পদবীহীন নাম আছে!
এমন একটা দেশে বাস
যেখানে ক্ষোভে ফুঁসছে মানুষ
আমার শেকড় গভীরে প্রোথিত এই ভূমিতে
সময়ের জন্মের আগে এবং যুগের সূচনার আগে
পাইন ও জলপাই গাছের আগে
ঘাসের জন্মের আগে
মা বাবা এসেছেন কৃষক পরিবার থেকে লাঙল নিয়ে যাদের কাজ
ধনিক শ্রেণীর কেউ নয়
আমার পিতামহ কৃষিজীবী ছিলেন
উচ্চমার্গীয় জাতি নয়, জন্ম হয়নি সোনার সোনার চামচ মুখে নিয়ে
আমাকে শিখিয়েছেন সূর্যের অহংকার বই পড়া শেখার আগে
আমাদের বাড়িটা পাহারাদারের কুঁড়েঘর ডালপালা ও নলখাগড়া দিয়ে তৈরি
আমার অবস্থা দেখে খুব খুশি হও?
আমার একটা পদবীহীন নাম আছে!

আমার নাম নিবন্ধন করো
আমি একজন আরব
চুলের রং কাঠ-কয়লা
চোখের রং বাদামি
আমার স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য:
আমার মাথায় আরবিয় পাগড়ী, ঘিরে আছে রজ্জু।
আমার হাতের তালু পাথরের মত শক্ত
যে ছুঁয়েছে আঁচড়ের দাগ পড়েছে তার গায়ে
আমার ঠিকানা নিরস্ত্র বিস্মৃত এক গ্রাম
সব মানুষ খুঁড়ে নুড়িপাথর তোলে
এতে তোমার ক্ষিপ্ত হবার কী আছে?

আমার নাম নিবন্ধন করো
আমি একজন আরব
তুমি দখল করেছো আমার পুরো পুরুষদের আঙুরের ক্ষেত
আর যে ভূমি চাষ করেছি আমি এবং আমার সন্তানেরা
তার কোন কিছুই নেই অবশেষে আমাদের জন্য
না আমাদের সন্তানদের জন্য নুড়ি-পাথর তোলা ছাড়া
তোমার সরকার এগুলো কেড়ে নেবে নিবন্ধিত হলো যখন
নিবন্ধনের শীর্ষে লিখে রাখো
আমি মানুষকে ঘৃণা করি না
আমি অন্য কারো সম্পত্তি ভোগ দখল করিনা
তবুও কখনো যদি ক্ষুধার্ত হয়ে পড়ি মাংস ছিঁড়ে খাব আমার আত্মসাৎকারীদের
আমার ক্ষুধা থেকে সাবধান
সাবধান আমার ক্রোধ থেকে।

=*=*=*=*=*=*=*=*=*=*=*=*=*=

তূয়া নূর: কবি ও অনুবাদক

=*=*=*=*=*=*=*=*=*=*=*=*=*=