You are currently viewing মানবতার পিঠে চাবুকের দাগ – অতীশ চক্রবর্তী

মানবতার পিঠে চাবুকের দাগ – অতীশ চক্রবর্তী

জীবনদর্শন এই শব্দটি খুব জানা – কিন্তু এর মানে কি? আমি জানি না। আমরা কেউ কি জানি? সহজ কথায় যতটুকু বুঝি তা হল আমার জীবনটা আমি কিভাবে কাটাব তা নিয়ে দিক নির্দেশনা। কে দেবে? দার্শনিক দেবে। কিসের ভিত্তিতে দেবে?  দর্শন একটা শৃঙ্খলাবোধ জাগায়। দর্শনের ব্যাপ্তি বিশাল। আমেরিকাতে এসে দেখি সাধারণ লোকেরা অফিসে কাছারিতে আমাদের ডক বলে ডাকে। এদের অনেকে জানে না যে আমাদের নামের আগে যে ডঃ বসে তার সঙ্গে ডাক্তারির কোন সম্পর্ক নেই। এদের অনেকে জানেই না যে ডক্টরেট অফ ফিলসফি কে ছোট করে ডঃ লেখা হয়। বুঝিয়ে বলতে আমাদের পরীক্ষাগার যে ঝাড়পোঁছ  এবং পরিষ্কার করতে আসে সে ইংরাজিতে বলেই বসল – ‘আপনি তাহলে দার্শনিক?’ আমি বললাম – সে অর্থে তাই। এই জন্যই তো যে কোন বিষয়ে মৌলিক কোন গবেষণা করে উত্তরণের দিশা দেখাতে পারলে  ডক্টরেট অফ ফিলসফি উপাধি দেওয়া হয়।  তারপর সে তার জীবনের সংগ্রামের অনেক কথা বলল, কিভাবে সে সংগ্রাম করে সঠিক পথে থেকে জ্যানিটারের কাজ নিয়ে উচ্চ শিক্ষার অর্থ জোগান করছে তাও বলল। আমি তাকে সেদিন বলেছিলাম – তুমিও একজন দার্শনিক – তোমার জগতে তোমার মত করে তুমি কিভাবে জীবনটাকে সঠিকভাবে পরিচালনা করে বড় হবে এই যে নিয়ত চিন্তাভাবনা করেছ এটাও দর্শন নয় তো কি? দর্শন কক্ষনো আচার আচরণ, বাহ্যিক আড়ম্বরকে নিয়ে বড়াই করে না, সঙ্ঘবদ্ধতার তোয়াক্কা করে না। ধর্ম শিক্ষার সঙ্গে দর্শনের এখানেই  প্রবল তফাৎ। ধর্ম দর্শনের অনেকগুলি ধারার একটি মাত্র হতে পারে, কিন্তু কোন একটি ধর্ম দর্শনের ব্যাপ্তি ধরতে পারে না।   আমরা দর্শন শিক্ষা বললেই মনে করি ধর্ম শিক্ষা দিতে হবে। ধর্ম যুক্তিতর্কবিহীন অকপট বিশ্বাস দাবি করে। মানুষের মনের দুর্বলতাকে সহায় করে সঙ্ঘবদ্ধ করে দল পাকানোর প্রচেষ্টা করে।

আমি যখন জন্মালাম তখন আমি একা কেঁদে উঠেছি, তা শুধু জৈবিক চাহিদা থেকে, কোন দর্শন জ্ঞ্যান থেকে নয়। এই জন্যই বুঝি আমাদের ধ্যানধারণাতে বলা হয় যে একটা শিশুর ৫ বছর বয়েস পর্যন্ত তার মধ্যে দেবত্ব থাকে। তারপরে বয়েস বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ষড়রিপু-র জান্তব প্রভাব বাড়তে থাকে। সুস্থ সামাজিক জীব হিসাবে বেঁচে থাকার জন্য যেটুকু দর্শন শিক্ষা দেওয়া হয়, আজ বুঝি তার অনেক কিছুই আসলে আমরা কেউ মানি না, কৌশলের আশ্রয়ে শুধু বেসাতি করে চলি, শঠতা করে চলি। তাই বলে তো একটা শিশুকে এটা বলা যায় না যে মিথ্যা কথা বলা মহাপাপ নয়, বা সর্বদা সত্য কথা বলতে নেই ইত্যাদি। আমরা দর্শন শিক্ষা বললেই মনে করি ধর্ম শিক্ষা দিতে হবে। ধর্ম শব্দটির মানে আমার কাছে হল – যাহা ধারণ করে। কাকে ধারণ করে? সমাজকে ধারণ করে – উদ্দেশ্য সমাজের ভাল করা। কিন্তু বাস্তবে ধর্ম শিক্ষা দিতে গিয়ে আমরা সমাজটাকে শুধু সাম্প্রদায়িক বানিয়ে রেখেছি। সত্যিকারের দর্শনশিক্ষা একজনকে মুক্ত চিন্তা করতে শেখায়। সংগঠিত ধর্ম (Organized religion)  তা শেখায় না। সংগঠিত ধর্ম একটি ক্ষমতার হাতিয়ারে পর্যবসিত হয়েছে, আজ নয়, যেদিন থেকে ধর্মের যাত্রা শুরু হয়েছে সেদিন থেকে। রাজনৈতিক ক্ষমতার  বা ধর্ম-ক্ষমতার বাইরে থাকলে মুক্তচিন্তা খুব পছন্দের একটা জিনিস, আন্দোলনের আকর্ষণীয় হাতিয়ার, কিন্তু রাজনৈতিক ক্ষমতা ও ধর্ম-ক্ষমতার পরিমণ্ডলে থাকলে মুক্ত চিন্তাকে শত্রু মনে হয়। কিন্তু প্রতিটি নাগরিকের ব্যক্তিগত জীবনদর্শন এটাই হওয়া উচিত যেন সে তার নিজের বিচার বিবেচনা দিয়ে তার স্বাধীন পথ বেছে নিতে পারে। তাই হাজার বছর আগের বিভিন্ন ধর্মের সদুপদেশকে আজকের দিনের প্রাসঙ্গিকতায় ফেলে বোঝার চেষ্টা করি না। হাজার হাজার বছর আগে ধর্মগ্রন্থে কি লেখাছিল তার অনেক কিছুই আজকের দিনে প্রাসঙ্গিক থাকবে না এই চিন্তাবোধ আমার কাছে আমার দর্শন। দর্শন হচ্ছে বিশ্লেষণাত্মক মুক্তচিন্তা করার সোপান।  আমার এক খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু আছে – সে তার ধর্মীয় সংগঠনে ধর্মপ্রচার করে বেড়ায়। ইংরাজিতে congregation বলে একটা শব্দ আছে তার বাংলা করলে দাঁড়ায় জামাত বা ধর্মসভা। আমি তাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম আমাকে তুমি তোমার ধর্মসভায় ঢুকতে দেবে? সে উৎফুল্ল হয়ে বলল – কেন নয় অবশ্যই দেব। আমি তাকে বলেছিলাম আচ্ছা আমি যদি যাই সেখানে তুমি তোমার ধর্মগ্রন্থ থেকে পড়ে যখন ব্যাখ্যা করবে তখন আমি প্রশ্ন করতে পারব? সে আমতা আমতা করে বলেছিল যে তুমি যদি প্রশ্ন করতে চাও তা ধর্মগ্রন্থের কোন লাইনের মানে বুঝতে না পারলে করতে পার। কিন্তু তোমাকে ধর্মগ্রন্থের ঐ বক্তব্যকে প্রশ্ন করা চলবে না – সেখানে যা লেখা আছে তার ওপর বিশ্বাস রাখতে হবে। সেইজন্য আমরা বলি আই বিলিভ ইন – আমি বিশ্বাস করি। আমি বললাম – মানে অন্ধবিশ্বাস রাখতে হবে বলছ? ও বলেছিল – ভগবানকে প্রশ্ন করবে – এর মধ্যে অন্ধবিশ্বাসের কোন জায়গা নেই করা যায়? এ ধ্রুব সত্য – প্রশ্নের জায়গা নেই। ধর্মীয় নেতা যেদিন পৃথিবীতে এই ধর্ম প্রচার করেছিলেন তখন তিনি ভগবানের দূত ছিলেন তিনি যা বলেছিলেন তার মধ্যে কোন ভুল থাকতে পারে না। ভুল আছে ভাবলে তুমি নাস্তিক। যে ধর্মে কোন ধর্মসভার ব্যাপার নেই সেই ধর্ম কোন ধর্মই নয়। আমার মনে হল – ছোটবেলা থেকে আমিওতো এটা শুনে এসেছি – ‘বিশ্বাসে মিলায়ে বস্তু তর্কে বহুদূর’! তাহলে একে দোষ দিই কি করে? আমি জিজ্ঞাসা করেছিলাম – তুমি কি মনে কর না যে ধর্ম মানবতাকে টুকরো টুকরো করে চলেছে। ওঃ আমাকে বলেছিল –  না না আমরা ঠিক, বাকীরা ভুল। আমরা যারা আমার ধর্মের অনুসারী নন, তাদের আমাদের ধর্মে দিক্ষা দিয়ে মানবতাকে একত্রিত করার চেষ্টা করে চলেছি, তাই তো নিরন্তর প্রচার করে চলেছি – সকলকে আমার ধর্মে আনার জন্য। আমি বললাম জানতো আমাদের দেশে এক মহাপুরুষ ছিলেন যিনি বলেছিলেন ‘যত মত তত পথ’। ও বলল যত মত তত পথ থাকতে পারে কিন্তু সব পথ কি আর ঠিক পথ হতে পারে? তাহলে তুমি জিপিএস ব্যবহার কর কেন? সবপথ তো উপরওয়ালার কাছে পৌঁছায় না।  ধর্ম হল এই জিপিএস যা তোমাকে সঠিক দিশা দেখাবে।  আমি আর তর্ক বাড়ালাম না।

তখন সদ্য সদ্য অ্যামেরিকা এসেছি, সব কিছুই নতুন।  একবার কর্মসূত্রে স্যানফ্রান্সিস্কো যাব। ফ্লাইট ঘণ্টা তিনেক লেট। অগত্যা কি করি। বসে আছি লাউঞ্জে। আমার পাশে একজন বেশ বয়স্ক ব্যক্তি মুখভরা প্রশান্তি নিয়ে হাসি মুখে বসে আছেন।  চোখাচোখি হতেই  তিনি আমাকে ‘হাই’ বলাতে আমিও হাই বললাম।  বললেন ৮২ বছর তার বয়েস। জিজ্ঞেস করলেন আমি কোথা থেকে এসেছি। আমি ভারতীয় শুনে ভারতীয়দের খুব প্রশংসা করলেন। প্রায় ঘণ্টাখানেক তিনি আমার সঙ্গে ভারতীয় সংস্কৃতি নিয়ে কথা বললেন।  তিনি হিন্দুধর্ম নিয়ে নাকি পড়াশুনো করেছেন। আমি ওনাকে বললাম আমি জন্মসূত্রে হিন্দু হলেও আমি হিন্দু ধর্মগ্রন্থ, যেমন বেদ, গীতা, পুরাণ  ওপর ওপর পড়লেও এগুলো সম্বন্ধে আমার সম্যক জ্ঞান আছে এ দাবী আমি করতে পারি না। এই ধর্মগ্রন্থগুলো সরাসরি আমি পড়িনি। আর পাঁচটা লোক যেমন লোকমুখে শুনে থাকে বা বইতে পড়ে থাকে, ছায়াছবিতে রামায়ন, মহাভারত, ইত্যাদি শুনে থাকে, দেখে থাকে আমারও অনেকটা সেকরকম জ্ঞ্যান। কথা শুনে মনে হল তিনি ভারত সম্পর্কে জানেনও অনেক কিছু। তিনি কর্মসূত্রে নাকি বেশ কিছুদিন ভারতে ছিলেন। আমাদের কথাবার্তা এতটাই আন্তরিক ছিল যে ঘণ্টাখানেক কোথা দিয়ে কেটে গেল বুঝতেই পারিনি। ঘোর কাটল এই ঘোষণায় যে আর পাঁচ মিনিটের মধ্যে প্লেন ছাড়ার জন্য প্রস্তুত হয়ে যাবে। কাজেই কথা গুটিয়ে আনার পালা। কথাবার্তা শেষ হলে ওনাকে বিদায় সম্ভাষণ জানিয়ে উঠে যাবার মুহূর্তে তিনি আমাকে একটা ছোট্ট পকেট বই দিলেন। বললেন এটা পড়ে দেখো, জীবনে সব প্রশ্নের উত্তর পাবে। আমার বুঝতে বাকি রইল না যে এই বইটি আর কিছু না – এটি বাইবেল।  ওনার চোখের দিকে তাকিয়ে ধন্যবাদ জানিয়ে আমি আর এক মুহূর্ত দাঁড়ালাম না। এক লহমায় ওনার সঙ্গে কথোপকথনে যে অনাবিল আনন্দ পাচ্ছিলাম, তা বিলীন হয়ে গেল। নিজেকে মনে হল বাজারের খদ্দের – ধর্মবাজারের ছলনায় মোহিত করে খ্রিস্টধর্ম গছাতে এসেছিলেন, কিং অব প্রাসিয়া মলে যেমন সুন্দরী মহিলা বা সুসজ্জিত সুপুরুষ অত্যন্ত মেকি ভদ্রতা ও হাসিমুখ নিয়ে একটা পারফিউম বিক্রির চেষ্টায় থাকে অনেকটা সেরকম। একজনকে খৃস্টধর্মে ধর্মান্তরিত করতে পারলে উনি নিজে স্বর্গে যাবেন, এই বিশ্বাসে কথার মায়াজালে আমাকে জড়িয়ে ধর্মান্তরিত করতে চেয়েছিলেন। ওনার মুখের প্রশান্তি আমার কাছে একটা শিশুকে অপহরণ করার আগে ছেলেধরার মুখের প্রশান্তির মত দেখাল।

তখন ১৯৮৪ সাল। সকালবেলা ১০ টা নাগাদ হবে। আমি তখন ছোট। আমরা তৎকালীন বি ই কলেজের সামনে একটা ভাড়া বাড়ির চারতলায় ভাড়া থাকতাম। ইন্দিরাগান্ধী খুন হয়েছেন দুই শিখ দেহরক্ষীর হাতে। তৎপরবর্তী ব্যাপক দাঙ্গায়  দু তিন দিনের মধ্যে ৭০০র ওপর শিখকে হত্যা করা হয়েছে, বিশেষত দিল্লিতে।  হাওড়ায় আমাদের বাড়ির কাছে সান্তা সিং পেট্রল পাম্প বলে একটা বাস স্টপ ছিল – জায়গাটার কাছে একটা গুরুদ্বার  (শিখদের উপাসনালয়) ছিল। ভবানিপুর কলকাতাতেও শিখ অধ্যুষিত অঞ্চল ছিল।  দিল্লিতে কংগ্রেসের স্বেচ্ছাসেবকরা যখন সক্রিয়ভাবে ধরে ধরে শিখদের মারধোর করা, খুন করার প্ররোচনায় যুক্ত বলে দাবী করা হচ্ছিল, তখন পশ্চিমবঙ্গে বামগণতান্ত্রিক সরকার।  তাদের পার্টিকর্মীরা ও স্বেচ্ছাসেবকরা  গুরুদ্বার ও শিখ অধ্যুষিত এলাকা দিনরাত পাহারা দিয়ে গণহত্যা ও উপাসনালয়গুলোর ধ্বংস রোধ করতে সক্ষম হয়েছিল। তখন মনে পড়ে আমার পরিচিত কংগ্রেসিরা এদের খালিস্তানি চর, দেশদ্রোহী বলে নিন্দা করেছিল। কোন এক ধর্মের একজন গুঢ় অপরাধ করলে সমস্ত সম্প্রদায়কে কালিমালিপ্ত করা এবং সংহারে উদ্যত হওয়া আমার পক্ষে কোনভাবেই সমর্থন করা সম্ভব হয় নি। সংগঠিত ধর্মের এই ধরণের ব্যবহারকে সমর্থন না করলেই তাকে চর, দেশদ্রোহী, নাস্তিক আখ্যা দেওয়া হয়।  আর এত বছর পরে আজও দেখি ১৯৪৭ পরবর্তী ইতিহাসের পরিহাসে দ্বিজাতি ত্বত্তের ভিত্তিতে বিভক্ত তিনটি রাষ্ট্র সাবালক হতে পারল না, এক দেশের রাজনৈতিক টানাপোড়েন আর এক দেশের রাজনীতির তুরুপের তাস হয়ে ওঠে। যারা বামিয়ান বুদ্ধমূর্তি ধবংস করার তীব্র নিন্দা করেছিল, বলেছিল হাজার হাজার বছরের একটা মূর্ত ইতিহাসকে উড়িয়ে দেওয়া হল, তারাই বাবরি মসজিদ ধ্বংস করবার সময়ে তা ভুলে গেছিল। সংগঠিত ধর্মের (Organized religion) এটাই সমস্যা।

আমার বরাবর মনে হয়েছে ধর্মের ধব্জাধারীরা বৃহত্তর মানবতাবাদকে চিরকাল শুধু বিপন্ন করে এসেছে। ভারতে হিন্দু ধর্মের জাতপাত নিয়ে তীব্র হিংসার কথাতো আমার জানা ছিল। তখন আমি জানতাম খৃস্টান ধর্ম দুভাগে বিভক্ত – ক্যাথলিক ও প্রটেস্টান্ট। এখানে এসে দেখলাম প্রটেস্টান্টরা শত শত ভাগে বিভক্ত। শুধু আমেরিকাতেই ২০০টির ওপর আর সারা পৃথিবীতে ৪৫ হাজারেরও বেশি স্বীকৃত খৃস্টান ধর্ম-ভাগ আছে – সকলেই খ্রিস্টান, তবু বিভক্ত – কেন? খুব অবাক হয়েছিলাম যখন আমার এক আমেরিকান বন্ধু আর এক বন্ধুকে জিজ্ঞেস করে – ‘হোয়াট ইজ ইওর রিলিজিয়ন’ – আর উত্তর এসেছিল ‘ইস্টার্ন  অরথডক্স চার্চ’ বা ব্যাপ্টিস্ট। আমি  সাউথ আফ্রিকা থেকে আসা এক ধার্মিক সাদা খৃস্টান বন্ধুকে জিজ্ঞেস করেছিলাম তোমাদের দেশে যারা কালো তাদের প্রায় সকলেইতো তোমার ধর্মের, ভগবান যীশুর অনুসারী তাহলে এত বর্ণবৈষম্য হল কেন? সাদা চামড়ার খৃস্টানরা কালো চামড়ার খৃস্টানদের ওপর ঘৃণ্য অত্যাচার করল কেন – সকলেই তো যীশুর অনুসারী। বৌদ্ধধর্ম শান্তির ধর্ম। সেই বৌদ্ধ ভিক্ষুরা তাহলে কি করে শ্রীলঙ্কা আর মায়ানমারে অন্য ধর্মাবলম্বীদের ওপর এত  অবর্ণনীয় অত্যাচার করতে পারে? আমি আমার পাকিস্তানী, আরব, ইরানী, এমনকি পশ্চিম ভারতেরর উত্তর প্রদেশের লখনউ এলাকার মুসলমানদের সঙ্গে কথা বলে দেখেছি বাংলার মুসলমানদের তারা যেন সাচ্চা মুসলমান বলে মনে করে না। বারেবারে মানবধর্ম, মানবতা শুধু বিভক্ত হতে দেখেছি। সব ধর্ম মানবতাকে একত্রিত করতে গিয়ে শুধু তাদের ধর্মের অনুসারী বানানোর টাগ-অব-ওয়ারে নেমে পড়েছে। হাজারো ধর্মের চাবুকের আঘাতে আঘাতে, মানবতার পিঠ আজ রক্তাক্ত।

মনে পড়ে যাচ্ছে সত্যজিৎ রায়ের ‘মহাপুরুষ’ ছায়াছবিটির একটা অংশে বিরিঞ্চিবাবাকে নিয়ে  কিছু কথাবার্তা, নিবারণবাবু, বিজ্ঞানী ননীগোপাল বাবু আর ওনার স্ত্রীর মধ্যে। “কথা কিন্তু বেশ বলেন সব তো বুঝিনা…. চেকস্লভাকিয়ায় তপস্যা করত…আইনস্টাইন যেত ওর কাছে। উনিই তো শিখিয়েছিলেন। কি? Relativity. E = mc2 . বাবাজি শিখিয়েছিলেন? আইনস্টাইনকে? একথা সে বললে? অতগুলি লোকের সামনে? আর সকলে সে কথা বিশ্বাস করলে? Yes! সবাই ক্ল্যাপ দিল। তুইও দিতিস।” এই জন্যই মন্দজনেরা বলেন – ধর্মের চেয়ে বড় আফিম কিছু নেই, ধর্মের ক্যাপ্সুলে সবই খাওয়ানো যায়।

শেষ করি আমার প্রিয় লেখক হুমায়ুন আহমেদের লেখা ‘তেঁতুল বনে জোছনা’ থেকে কয়েকটা লাইন উল্লেখ করে – মনে পড়ে গেল। ভূমিকাটা এইরকমঃ নবনী একটি তেঁতুল গাছে উঠে তেঁতুল পাড়ার ইচ্ছা প্রকাশ করল। বলল “এগুলো আপনি নিয়ে যান, আমি গাছে উঠে নিজের হাতে পাকা তেঁতুল পাড়ব। ইমাম সাহেব খুবই লজ্জিত গলায় বলেছেন, এটা সম্ভব না। মসজিদের কাছে গাছ, সেই গাছে মেয়েছেলে উঠে তেঁতুল পাড়বে এটা ঠিক না। নবনী তেজী গলায় বলেছিল – ঠিক না কেন? আল্লা রাগ করবেন? তার উত্তরে ইমাম সাহেব বলেছেন – আল্লাপাক এত সহজে রাগ করেন না, কিন্তু মানুষ রাগ করে। আমরা এমন, সেই মানুষের রাগটাকেই বেশী ভয় পাই।”