You are currently viewing মাঘনিশিথের কোকিল – মোস্তফা অভি

মাঘনিশিথের কোকিল – মোস্তফা অভি

হোটেলে একজন গ্রাম্য মোড়ল বিপদে পড়া লোকটির দলিল-খারিজ দেখায় ব্যস্ত। সে একবার পুরনো ফ্রেমের চশমার ফাঁক দিয়ে আগন্তুকের দিকে তাকিয়ে কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। কৌতুহলের বসে কি-না কে জানে, একটু পর সে লোকটির কাছে জানতে চাইল-বাড়ি কই মেয়া?

লোকটি খাবার প্লেটে ডান হাতটা স্থগিত করেএভাবে বলল, এই বিঘাই গ্রাম-ই আমার পূর্ব পুরুষের বসবাস। আমার দাদা ছিল এ গ্রামের পরিচিত একজন মানুষ। সে প্রায় শাতায়ু হয়ে দেহ ত্যাগ করেছে।তবে মৃত্যুর আগে বংশধর বলতে ছিলাম একমাত্র আমি। আমার খুব মনে পড়ে দাদার সেই অন্তিম দিনগুলির কথা।যখন লাশের খাট কাঁধে তুলে আমি নিজ হাতে তাকে কবরের পাশে রেখেছিলাম। পাড়া-প্রতিবেশি তাকে যখন মাটির বিছানায় শুইয়ে দিয়ে মুখের কাপনটা সরিয়েছিল আমার ছোট বুকটা ভেঙে গিয়েছিল তখন। আর আমি আকাশ বিদীর্ণ করা চিৎকার দিয়ে বলেছিলাম- ও দাদা তুমি কোথায়!

মোড়ল লোকটির হৃদয়ের কোথায় যেন কথাগুলো তীরের ফলার মতো বিঁধে গেল। সে আগন্তুকের দিকে সদয় দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, কি নাম আছেলে আপনের দাদার?

মনে হল, মোড়লের সঙ্গে কথা তোলার একটা প্রসঙ্গ পেয়ে গেল আগন্তুক লোকটি। সে খাওয়া অর্ধেক রেখেই হাত ধুয়ে মোড়লের কাছাকাছি বসে রুগ্নচিত্তে বলল-তার নাম ছিল বুরকুনদাস।

বিঘাই গ্রামে হঠাৎ আগত লোকটি বুরকুনদাস নামটিকে অবলম্বন করেই গ্রামের পথে ঢুকল। তারপর গাছ-গাছালিতে ঘেরা গ্রামের প্রথম বাড়ির উঠনে দাঁড়িয়েলোকজন জড়ো করার মত কীর্তি করল। সে কয়েক ঘরের মানুষ একত্র করে বলল- তার নাম কালাচান। হতে পারে সে বহু বছর আগের কথা।তবুও হয়ত এ গ্রামের মানুষের মনে থাকবে এক পরিচিত বৃদ্ধের নাম। লোকটি কুঁজো হয়ে লাঠিতে ভর করে রাস্তায় চলত। আর তার নিচের ঠোঁট জবজবে পানের রসে ভিজেরক্তিম হয়ে থাকত। আর তার নাম ছিল- বুরকুনদাস।

নবাগত কালাচান গ্রামের লোকদের সরল সমাদর দেখে অভিভূত হল। তারপর সে একে একে বলে যেতে থাকল তার পুরনো স্মৃতির কথা। কোথায় ঠোকর খেতে খেতে একসময় সে পায়ের তলায় মাটি খুঁজে পেয়েছে। কতটা নির্মম ছিল তার সেই জীবন। মা-বাবাহারা এতিম কালাচান বৃদ্ধ দাদার হাত ধরে তার ছায়া হয়ে চলত। লোকজন কোন অদৃশ্য কারণে অশীতিপর বুরকুনদাসকে খুব ক্ষেপিয়ে তুলত। অথচ কাশের রোগী লোকটির প্রতি মানুষের দয়া মায়ার ছিটে ফোঁটাও ছিলনা। কালাচান এসব বলতে গিয়ে প্রায় কান্নার প্রস্তুতিপর্বের মত মুখের ভঙ্গিমা করল। আর তাতে সরল সহৃদয়বান গ্রামের চাষা পরিবারগুলো তার পাশে জড়ো হয়ে, হারিয়ে যাওয়া পরমাত্মীয়ের খোঁজ পাওয়ার মত ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ল। পুরুষ লোকগুলো একে একে করমর্দন করল কালাচানের সঙ্গে।

কালাচান পোশাক পরিচ্ছদে আধুনিক, কথার ভেতর জাদু মেশানো আছে। প্রকৃতি থেকে আয়ত্ব করে নিয়েছে কীভাবে মানুষকে ভোলানো যায়। সে মজমাওয়ালা জাদুকরের মত আসর জমিয়ে সবাইকে ধন্যবাদ দিতে গিয়ে এমন একটা ভাব করল, যেন গ্রামবাসীর জন্য কালাচান নতুন কোনো বার্তা নিয়ে এসেছে। গাঁয়ের মানুষের বিশ্বাস-ই হল বড় সম্বল। প্রতি বছর এনজিওর লোকেরা তাদের কাছে নতুন নতুন বার্তা নিয়ে আসে। তারা ভূমিহীন অসহায় পরিবারকে টিনের দোচালা ঘর করে দেয়, বিধবাকে গাভী কিনে দেয় আর যে কোনো এক বাড়ির আঙিনায় গড়ে তোলে অস্থায়ী ভ্রাম্যমান স্কুল। কালাচান প্রথম বাড়ি থেকে বিদায় নিয়ে অপ্রশস্ত কাঁচা পথ ধরে সামনে এগিয়ে যেতে লাগল। অপরিসর রাস্তাটির দুপাশে সঠি গাছের জঙ্গল। মানুষের পায়ের তলায় পিষে মর মর অবস্থার একটা বাইত গাছ তুলে চোখের সামনে ধরে সে মিটমিট করে হাসল। তারপর গাছটিকে সংসারের অপ্রয়োজনীয় জিনিষের মত দূরে ছুড়ে ফেলে মাথাটা নিচু করে সামনের বাড়িটির উঠানে সটান হয়ে দাঁড়াল। একজন বৃদ্ধকে অনাহুত ছালাম ঠুকে বলল, আমারে মনে হয় চেনতে পারেন নায়?

বৃদ্ধ ফজর আলী অপরিচিত যুবকের সালাম পেয়ে কোমড়ে হাত রেখে প্লাস্টিকের চেয়ার থেকে কৌতুহল নিয়ে দাঁড়াল। তারপর ডান হাতটা ত্যারছা করে কপালের ওপর ধরে কালাচানকে  জিগ্যেস করল-বাড়ি কোম্মে ম্যাছাপ?

কালাচান একজন শায়েরীর মত মনমুগ্ধকর কাহিনির সুর তুলল ফজর বুড়োর কাছে।যা ছিল তার জীবনের প্রাথমিক ইতিহাস। বুরকুনদাস মারা যাবার পর সে কতটা অভিভাবকহীন হয়ে পড়েছিল। অসহায় এক এতিম বালকের আশ্রয়দাতা কেউ ছিলনা তখন। প্রায় তিন-চারমাস এবাড়ি ওবাড়ি ঠোঁকর খেয়ে একদিন বিষণ্ন মুখে বাঁশতলা ঘাটে দাঁড়িয়েছিল লঞ্চে মাল ওঠানামা করা দেখতে। তখন লঞ্চের এক খালাসি তার মাথায় হাত বুলিয়ে বলেছিল- বুলিটা শিখ্যা লও বাপু, এই… চা গরম।

সেই থেকে কালাচানের নদী আর লঞ্চের যাত্রীদের সাথে মিত্রতা।প্রতিদিন বাঁশতলা ঘাটের কাছে যখন লঞ্চ ভিড়ত সে লঞ্চের পর্দা তুলে জানালা দিয়ে থাকিয়ে থাকত দূরের একটা কড়াই গাছের দিকে।যেখানে একসময় দাদা-নাতি আনন্দের সঙ্গে বসবাস করত। মফস্বল থেকে রাজ হংসের মত লঞ্চটা বড় বড় নদীর বুকের ওপর দিয়ে চলে যেত রাজধানী ঢাকা শহর।আর সে দেখত প্রতিদিন লঞ্চে যাতায়াতরত রঙ বেরঙের মানুষের ভ্রমণপথের নিত্য নতুন ব্যবহার। মাঝেমধ্যে কাল-বৈশাখি ঝড়ের সঙ্গে লঞ্চটা যখন নদীর ঠিক মাঝখানে দাপিয়ে দাপিয়ে মৃত্যুকে আহ্বান জানাত, কালাচান জানালার ধারে একমনে দাঁড়িয়ে দেখত বড় বড় তরঙ্গের নাচন। মৃত্যুর ভয় নয় বরং আছড়েপরা ঢেউয়ের গোঙানি শুনে তার মনে হত, আপনজন ছাড়া মৃত্যুই তার কাছে সুন্দর। সে চলে যাওয়া পর তিনগ্রাম দূরের মামা বাড়ির আত্মীয়রা তার কোনো খবর নিয়েছিল কি-না সেসব তার জানা নেই। তবে কখনো পরিচিত দু’একজন যাত্রী তার চোখে পড়ত। আর তারা দূর থেকে অবজ্ঞার দৃষ্টিতে তাকাত কালাচানের দিকে।

ফজরবুড়ো যৌবনকালের একমাত্র পরম বন্ধুর নাতিকে পেয়ে বুকে জড়িয়ে ধরল। তার মনে পড়ল বহু পুরনো কিছু স্মৃতির কথা। বুরকুনদাস তখন অন্তিম যাত্রার দলে নাম লিখিয়ে শুধু অপেক্ষা করছে পরাপারে যাবার জন্য। বুরকুনদাস চিকন একটা লাঠিতে ভর দিয়ে রাস্তার এক কিণারা ধরে হাঁটত। গাঁয়ের বেহুদা মানুষগুলো তাকে ক্ষ্যাপানোর জন্য মুখের কাছে এসে বলত- ওই মেয়া তোমার হইত্যাকালের নামডা রাখছেলে কেডা, বুরকুনদাস। বুরকুনদাস সেসব শুনে খুব চটে যেত আর তার চোখ থেকে বেরিয়ে পড়ত জলন্ত আগুনের ফুলকি। তখন পোলাপানগুলো পৈশাচিক আনন্দ পেতে আরো বেশি মরিয়া হয়ে উঠত। আর ওরা দূর থেকে ঠোঁটদুটো গোল করে বুরকুনদাসকে উদ্দেশ্য করে বলত-কু উ উ ক।

বুরকুনদাস তখন বিরক্তির সাথে শুধু একটি বাক্যই বলত-পাইখাস্তা জানি কোনহানকার।

ফজরবুড়ো এসব দৃশ্য কখনো দূর থেকে দেখত। আর তার মনে হত একজন গায়-গতরে শক্তিহীন বুড়ো মানুষের পাইখাস্তা গালি দেয়া ছাড়া আর কী উপায় আছে! অথচ লোকটি প্রতিদিন একপা একপা করে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। পৈশাচিক আনন্দে মেতে ওঠা মানুষগুলো হৃদয়হীন, নিষ্ঠুর। ওরা অসহায়, বৃদ্ধ আর পাগলকে ক্ষেপিয়ে আনন্দ পেতে ভালোবাসে। অথচ নিগৃহীত মানুষটির হৃদয় থেকে বেরিয়ে আসত অভিসম্পাত। যা দেখার মত তৃতীয় নয়ন ওদের কারো নেই।

ফজরবুড়ো কালাচানকে পাশের চেয়ার টেনে বসিয়ে বুরকুনদাসকে নিয়ে আরো কিছু স্মৃতির কথা বলল। যদিও সেসব কালের আবর্তে এখন ধোঁয়াসা। কিন্তু পরম বন্ধুর জীবনের কত কথাই তো জানা ছিল তার। বুরকুনদাসের তখন মর মর অবস্থা, একরত্তি শরীরটা নিয়ে কাশতে কাশতে দলা পাকিয়ে পড়ে থাকত চৌকির এক কোনে। এরকম একদিন কথায় কথায় ফজরবুড়োকে বলেছিল তার নামের রহস্যের কথা। তখন সময়টা ছিল অস্থির, বৃটিশের চ্যালা জমিদার, মধ্যসত্ত্বভোগী আর মহাজনদের অত্যাচারের স্টিম রোলার চলত রায়তের ওপর। মাঝেমধ্যে সেসময় গাওয়ালে গোমস্তা নিয়ে আসতেন নায়েব মশায়। তার ডান পাশে নায়েবের প্রতীক লাঠি নিয়ে গোঁফে তা দিতে থাকত আজ্ঞাবহ মৃধা। আর বামপাশে প্রায় নতমুখে চুপ করে দাঁড়ত বরকনদাজ। অত্যন্ত বিনয়ী আর রহম দিলের মানুষ ছিল সেই বরকন্দাজ।লোকটি মাঝেমধ্যে রায়তের কাছে বিভিন্ন খবরাখবর নিয়ে আসত আর জমিদারের নির্মম অত্যাচার প্রথা ভর্ৎসনা করে বিগলিতকণ্ঠে ক্ষমা চাইত সকলের কাছে। আর লোকটির বিশুদ্ধ আচরণে সন্তুষ্ট হয়ে সবাই মুগ্ধ-বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকত তার মুখের দিকে। সেই শান্ত, সুন্দর প্রকৃতি পুত্রের নামানুশারে বুরকুনদাসের বাবা পুত্রের নাম রেখেছিল -বরকনদাজ। কালের বিবর্তনে আর মানুষের মুখে মুখে সে নামটা মাধূর্য হারিয়ে হয়ে গেল এক উপহাস। সেই থেকে বরন্দাজ লোকটির বিবর্তিত নাম- বুরকুনদাস।

প্রাকসন্ধ্যায় অপরিচিত মুখের লোকটিকে দেখে বাড়ির যুবক-বৃদ্ধ আর ঝি বউয়েরা জড়ো হতে লাগল।তারা পরম উৎসাহে শুনল কালাচানের জীবনের পূর্বাপর বৃত্তান্ত। নিজগ্রাম, নিজের চেনা পথ থেকে বিচ্যুৎ হয়েকালাচান কতটা দুঃসহ জীবনযাপন করেছে। কত যন্ত্রণার ঠোকর খেতে খেতে মাটির ওপর পা খামচে ধরে দাঁড়িয়েছে। তারা সস্নেহে কালাচানের আকস্মিক আবির্ভাবকে অনুমোদন করল।

ফজরবুড়োর শিকারীর মত চোখদুটো কালাচানের মুখের কাছে এনে বলল-ও  মেয়া, কোনো মতলব টতলব নাই তো?সে বুকের ওপর ছড়িয়ে থাকা দাড়িতে হাত বোলাতে বোলাতে একাগ্রভাবে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল কালাচানের মুখের দিকে। তারপর সামান্য সময়ের ব্যবধানে হয়ত আরো কোনো স্মৃতির আড়ালে ধরা পড়ল সে। তখন প্রায় হাহাকার করা বুকে চাপড় দিতে দিতে বলল-বুরকুনদাসের কতা কইয়া মনে বড় দাগা দেলা ভাই!

কালাচার বৃদ্ধের মুখের মুখের দিকে আর তাকালো না। সে পশ্চিম দিকের সীমানাভেড়ীর দুটো বাঁশঝাড়ের ফাঁকের সরু পথ ধরে বিলের দিকে নেমে পড়ল। মুহূর্তেই সন্ধ্যার চোরা আঁধারের মতো সবার দৃষ্টিসীমানা থেকে অদৃশ্য হয়ে যায় সে।

কালাচানকে পরদিন সকালে দেখা গেল নদীর ধারে ছোট্ট চা দোকানের পাশে। সে উপস্থিত সবাইকে সালাম দিয়ে বলল, এই গ্রামে কি দেল-দরিয়ায় রহম থাকা মানুষ একজনও নাই?

দোকানের বেঞ্চ থেকে কথাটা ছো মেরে ধরল কান্দার বুড়ো রহম আলী। আর সে বলল, আম্নেরে নতুন ঠেহি যেনো এ কান্দায়?

কালাচান বাকপটু আর চৌকস। ঝানুলোকের মত দোকানের বেঞ্চে বসে কথার ঝড় তুলল আর দোকানদারকে বলল, সবাইকে চা দেও এক কাপ করে। সে বৈয়াম থেকে চারকোনা খোন্তা বিস্কিট বের করে ধরিয়ে দিল মুরব্বীদের প্রত্যেকের হাতে। সে সবার উদ্দেশে প্রায় ভাষণের মত করে বলল, এই গ্রামে এক কালে ছিল বুরকুনদাস। সে আরো বলল, মৃত বুরকুনদাসের ছায়ারূপ যেন এখানকার প্রত্যেক বৃদ্ধের মুখে সে দেখতে পায়। সে চায়ের কাপে ঝড় তুলে দোকানে জড়ো হওয়া লোকদের শোনাল তার সফলতার গল্প। মুরব্বিদের একজন উৎসাহ নিয়ে জানতে চাইল, এত দালানকোডা যোগাড় হললা ক্যাম্মে?

কালাচান কথা বলার একটা সুযোগ পেয়ে হাড়িতে চড়ানো ভাত ফোটার মত বলতে লাগলতার বিঘাই গ্রাম থেকে নিরুদ্দেশের কথা। একটা দীর্ঘ সময় সে লঞ্চের যাত্রীদের সাথে একেবারে মিশে গিয়েছিল। তারপর বহুদিন সে কেবিনের দালালি করেছে।কেবিনের যাত্রীবেশী হরেক রকম মানুষ এস পরিচিত হত তার সঙ্গে। তাদের মধ্যে কেউ ছিল অন্যের বউ, কেউ পেশাগত কাজের ছুতায় মিথ্যা বলা যুবক। যারা কেবিনের ছোট্ট খুপরীর ভেতর স্বামী-স্ত্রী পরিচয় দিয়ে ঢুকে পড়ত।তারা নিরুদ্দেশে গন্তব্যের যাত্রীর মত কেবিনের ছোট্ট রুমে এমনভাবে হাওয়া হয়ে যেত, সারারাত একবারের জন্যও বাইরে মুখ তুলে তাকাত না। ভোরে তাদের চোখেমুখে ভর করত রাজ্যের ক্লান্তি, মনে হত বিশাল এক মহাপ্লাবণ সারারাত তাদের শরীরের ওপর দিয়ে বয়ে গেছে। কালাচান বিশেষ বখশিস পেয়ে মুচকি হাসি দিয়ে তাদের আবার আসার আমন্ত্রণ জানাত। অথচ সেসব দিন এখন বহু অতীত।

সে সময় কালাচানের বিঘাই গ্রামের কথা খুব মনে পড়ত। আর সে ভাবত, যদি আপনাত্মীয় কেউ বেঁচে থাকত নিশ্চয়ই তার খবর নিত। কিন্তু সবহারা মানুষের এসব আফসোস শুধু ভেতরেই গুমড়ে কাঁদে। কালাচান এভাবেই নিজগ্রাটাকে একদিন ভুলে গিয়েছিল। তারপর বহু বছর সে বিভিন্ন পেশার মানুষের সংস্পর্শে থেকেছে। তারা ছিল ক্ষমতাধর আর পয়সাওয়ালা।আর এভাবেই সে ঢাকায় গড়ে তুলতে পেরেছে দুটো পাকা বাড়ি আর কয়েক টুকরো জমিন।

দোকানের সামনের জটলাটা ভেঙে যাবার পর কালাচান ধানখেতের ছিলার ভেতের দিয়ে বিলের ভেতর নেমে গেল। তার দ্বিতীয় দিনের গন্তব্য পশ্চিম দিকের মানেরুদ্দিন হালাদার বাড়ি।কোনো এককালে মানেরুদ্দিন গ্রামের হাওলা কিনেছিল। আর বাড়িটির ছিল একপাল মহিষের হাল-হালুটি। অথচ কালের বিবর্তনে বহু জীর্ণ আর মলিন এবাড়ির চেহারা। এখন এবাড়ির ঝি-বউরা ব্লাউজ ছাড়া কাপড় পরে। উঠতি বয়সী মেয়েরা ফুটকি ছাপার জামা গায় দেয়। আর বাড়ির পুরুষদের নানান পদের পেশা। কালাচান মানেরুদ্দিন হালাদার বাড়ির উঠানে এসে এমন একটা ভাব করলযেন, মহা প্লাবনের হাত থেকে সে এবাড়ির মানুষকে বাঁচাতে এসেছে।

কালাচানকে দেখে বাড়ির বউগুলো মাথার কাপড় সামনে ঝুলিয়ে মুখটা আড়াল করার চেষ্টা করল। আর উঠতি বয়সী মেয়েগুলো ওড়নাটা ঠিকঠাক করতে করতে জটলার সামনে এসে ভীড় করল। কিন্তু বাড়ির বাসিন্দা আপ্তের, কালু, ছোবাহান আর খলিল কালাচানের আগা-গোড়া কয়েকবার দেখে নিঃসন্দেহের ভঙ্গিতে বলল, মোরা বাপুতোমারে চেনতে পারি নাই।

কালাচান জটলাটা এড়িয়ে পুকুরপাড়ে ভিটার দিকে এগিয়ে গেল। সেখানে ওলকপি গাছে পানি ঢালছে উত্তর ভিটির ঘরের হকমান আর তার সহোদর জজমান। কালাচান পকেট থেকে দুটো বেনসন সিগারেট দুই ভাইয়ের দিকে বাড়িয়ে ধরে বলল, জমিদাড়ি বিড়ি। নেও হকমান ভাই, সুখটান মারো।

হকমান ইতস্তত করে সিগারেট জ্বালিয়ে কালাচানের মুখের দিকে নির্বিকারভাবে তাকিয়ে রইল। আর ওদিকে জজমানের অবস্থা এমন যেন, কোনো জাদুকরের ইন্দ্রজালে বশীভূত হয়ে সে চেতনাহীন হয়ে পড়েছে। কালাচান হকমান আর জজমানকেও শোনালো তার সংক্ষিপ্ত সাফল্যের কথা।কালাচানের পূর্পুরুষ রকুনদাসের কথা শুনে দুই ভাই স্মৃতির দিকে ঢিল ছুঁড়ে তার কথা মনে করার চেষ্টা করল।অনেক্ষণ নীরব থাকার পর হকমান বলল, বুরকুনদাস লোকটার কতা বহুত হুনছি ভাই। হুনছি লোকটা ভালো আছেলে বেমালা।তয় হ্যারে মোরা কোনোদিন দেহি নাই।

কালাচান সময়টা উপযুক্ত মনে করে হকমানের কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলল, কাম আছে হকমান ভাই, যাবা?

হকমান কাঁধের গামছাটা ঝারা দিয়ে ধূলি উড়িয়ে বলল, কোম্মে?

কালাচান সিগারেটের গোড়া জুতার তলায় পিষে ফেলতে ফেলতে বলল- পদ্মাসেতুর কাম, মাসে পঁচিশ হাজার বেতন আর থাহন হ্যাগো।

এরপর কথা সংক্ষিপ্ত করে কালাচান সেদিনের মত নিঃশব্দে চলে গেল। পরদিন বিকেলে বাঁশতলা বিরাণ লঞ্চঘাটে একটা ঝোপের আড়ালে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করল দুই ভাইয়ের জন্য। প্রকসন্ধ্যার ছায়ায় বিকেলটা প্রায় মরে এসেছে, বহু কালের আগের খরস্রোতা নদীটা এখন একেবারেই শান্ত। কালাচান ঘুমে ডুবে যাওয়ার প্রস্তুতি নেয়া গাছ-গাছালির ছায়ার দিকে তাকাতে গিয়ে দেখল, হকমান আর জজমান তার দিকেই আসছে। সে দুইভাইকে জোত্তর মত শাসিয়ে বলল, এসব কথা তারা যেন চার কান না করে।

হকমান চুপ থাকলেও জজমান বিষয়টি নিয়ে ভাবতে চায়। সে ভেতরে ভেতরে থুরথুর করে।

কালাচান অবস্থা বুঝে বিঘাই গ্রামের প্রত্যেক বাড়ির একেকজনকে নির্বাচন করল আর তাদের কাছে লোভনীয় কাজের খবরটা পৌঁছে দিল। তবে জীর্ণ গ্রামটির মত এখানকার মানুষগুলোর মুখও শুষ্ক। তাদের কারো ঘরের বেড়া ঝাঝরা হয়ে গেছে আর সেসব ফাঁক দিয়েছাল ওঠা কুকুর উঠে খাবারে মুখ লাগায়। নদী লাগোয়া রাস্তাটা ভাঙাচোরা, অপরিসর। উন্নয়ন বলতে কিছুই নেই। এখানকার মানুষ পঁচিশ হাজার টাকার কাজের প্রস্তাব ফিরিয়ে দেবে এমন নির্লোভ কেউ তো নয়!

কালাচান যার থেকে যেমন পারল, দালালি উঠালো। তারপর সবাইকে বলল, যে কোনো সময় তার সঙ্গে কাওরাকান্দি যেতে হবে। তবে পথে টরকী বন্দরের পুবে তার বন্ধুর বাড়ি আছে। সেখানে তারা দুদিন বিশ্রাম নেবে। তার বন্ধুর বউ শুকনো ভাত তেলে ভেজে ভাতপোলাও রাঁধতে জানে। হাঁসের ডিম মিঠা ঝোলের মধ্যে ডুবিয়ে রাঁধে অদ্ভুত মজার এক পদ। এসব খাবারের দৃশ্যের কথা করে বিঘাই গ্রামের কয়েকজন মজুর লোভাতুর চোখে কল্পনা করল কালাচানের বন্ধুর বাড়ির কথা। তারা জানেনা, কল্পিত সেই বাড়ি চোখের সামনে আসাটা সময়ের ব্যবধানে কতদূর!

কালাচান হকমানকে ডেকে বলল, সবাইরে জানাই দেও, অঘ্রাণ মাসের দশ তারিখ প্রথম দফা কাওরাকান্দি যাবে। দু’দিন টরকী বন্দর থেকে তার বন্ধুর বউয়ের হাতের মজাদার ভাতপোলাও খেয়ে তারপর সবাই কাজে যোগদান করবে। এসব লোভনীয় প্রস্তাবে  দালালির পয়সায় কালাচানের পকেট ভরে যায়।

অঘ্রাণ মাসের দশ তারিখ চলে যাওয়ার পর জজমান হকমানরে বলল-বেবাক ধুরন্ধরি ভাই। টাহা ফেরত লইয়াও, পদ্মাসেতু যাইয়া কাম নাই।

কালাচান হকমানের কথা নির্বিকারভাবে শুনে বলল, ও হকমান, দাদো? জজমানরে কইও-পাডার কপালে কিন্তুক হিন্দুর লাগে না।

এদিকে আলতাব, মুশুকুল, কালছার আর ছালামের বড়পুত ( তার আসল নাম জানা যায় না) কালাচানরে ধরল টাকার জন্য। কালাচান আবারো আশ্বাস দিয়ে বলল, শীঘ্রই তারা টরকী বন্দরে তার বন্ধুর বাড়ি ভাতপোলাও খেতে পারবে।

জজমান গলার কাছে এটা ছোট্ট কাশির দলা এনে বলল- এ হকে, এ ভাই, হালায় একটা ধান্ধাল। এই মুই কইয়া থুইলাম।

পরদিন শেষরাতে কালাচান সবাইকে ঘুম থেকে জাগিয়ে আনন্দের খবর দিল। কোথা থেকে যেন ঘরঘর করা টমটম নিয়ে ভাঙা দোকানের সামনে উপস্থিত হল এক অপরিচিত লোক। কালাচান সবাইকে টমটমে উঠতে বলল আর চারপাশ থেকে বেড় দিয়ে দিল ভাঙা গাড়ির শরীরটা। কুয়াসার চাদর কেটে ফর্সা হওয়ার আগেই সবাই পটুয়াখালী বাসস্টেশন নামল। তারপর সাই সাই করে এগিয়ে চলল ঢাকা গামী পরিবহণ। দুপুরের শেষদিকে মজুরদের প্রথমদফা নামল টরকী বন্দর।বন্দরের পুবদিকে নদীর ভেতর তীরের ফলার মত একটা চোখা দ্বীপ। কালাচান নৌকা পর হয়ে সবাইকে নিয়ে সেই গ্রামটার দিকে লাপাত্তা হতে লাগল।তখন অপরিচিত মানুষের ছোট্ট বহর দেখে হা করে সেদিকেই তাকিয়ে রইল বন্দরের বেহুদা মানুষ।

কাওড়াকান্দি থেকে বিঘাই গ্রামে প্রথমবারের মত পাঁচ হাজার টাকা আসার পর সাধারণ মানুষের মধ্যে নতুন এক আলোড়ন দেখা দিল। তারা যে যার কাজ রেখে আলোচনা করতে লাগল কাওরাকান্দির কথা। রাসু মোল্লার ব্যাটারীচালিত অটোরিক্সার গ্যারেজটা ড্রাইভার শূন্য। মজুর লোকগুলোর চোখে-মুখে অপার এক রহস্য খেলা করে-পদ্মাসেতু কত দূর! তারা কালাচানের বন্ধুর বউয়ের ভাত পোলাওয়ের কথাও মনে করল। আর বাতাস থেকে তাদের নাকে ভেসে আসতে লাগল মিঠা ঝোলে ডোবানো হাসের ডিমের মিষ্টি সুবাস। মিষ্টি সুবাসটা তাদের লোভাতুর জিহ্বাকে উসকে দিল। বিঘাই গ্রামে কালাচানের মত আলোচিত ব্যক্তি আর কেউ নেই।

কয়েকদিনপর কালাচান গ্রামে ফিরে আরো কিছু মজুর জোগাড় করল। তারা বিভিন্ন অঙ্কের টাকা অগ্রিম দিয়ে পদ্মাসেতুর কাজে নাম লিখিয়েছে। কালাচান পশারীবুনিয়, সাইচাবুনিয়া, তিতকাটা হয়ে দক্ষিণ বিঘাই গ্রামের পথে পথে তার উপস্থিতির পায়ের ছাপ ফেলল। সে কষ্টার্জিত টাকাগুলোর দিকে নির্ভার তাকিয়ে থাকেআর সে মনে মনে ভাবে, এই বিশুদ্ধ গ্রামটির মেয়েলোগুলো কত অসহায়! আর তারা প্রতিদিন সন্ধ্যায় পুরুষগুলোর পথের দিকে তাকিয়ে অপেক্ষা করে। রাতে রান্না হলে টিমটিমে আলোর নিচে খাবারগুলো গোগ্রাসে গিলে সারাদিনের খিদের মুক্তি দেয়। মেয়েগুলোর জট পাকানো চুল, মুখে জেল্লা নেই মোটেও আর স্তনগুলো চিমষে মিশে গেছে বুকের সাথে। প্রসুতি মেয়েগুলোর বুকের কাছে দুধ না পেয়ে ট্যা ট্যা করে কাঁদে কোলের বাচ্চা। কালাচানের গরিবের জন্য ভগ্নহৃদয় এমনভাবে কেঁদে ওঠল তার চোখের একফোটা জলও কারো দৃষ্টি আকর্ষণ করল না। কালাচানের মনে হল, বিঘাই গ্রামের মেয়ে আর মহিলাদের জন্য কিছু করা দরকার। সে হকমানের মাধ্যমে আরেকটি লোভনীয় সংবাদ বিঘাই গ্রামে ছড়িয়ে দিল-পদ্মাসেতুতে মেয়ে লেবারের খুব চাহিদা। তারা সূযাস্ত পযন্ত টানা পরিশ্রম করে আর তারা পুরুষের মত কাজে ফাঁকি দেয় না। খবর শুনে এক সন্ধ্যায় বাবুলের বউ মনোয়ারা,কাঞ্চুর বউ শেফালী আর খলিলের বউ গোলচেহারা কালাচানের সঙ্গে দেখা করে বলল- জুদি মান ইজ্জাতের ভসসা পাই তইলে পদ্মাসেতু যামু।

কালাচান আকাশের পশ্চিমকোণে বিকেলের পড়ন্ত আলোর দিকে ত্যারছাভাবে তাকিয়ে শুধু এটুকু ভাবার অবসর পেল, এইসব চিমসে যাওয়া মেয়েলোকের ভেতর পদ্মাসেতুতে কাজে লাগানোর মত জোয়ান ছেড়ি নেই। সে গোলচেহারার দিকে ইংগিত করে বলল-দলটারে আরেকটু বড় করলে তোমরা নতুন ট্যাকার গন্ধ পাইতে পারো।

কালাচানের পদক্ষেপ ছিল ধীর, একাগ্রচিত্তে সে ধারাবাহিক চেষ্টা চালিয়ে গেছে। কারো বিদ্রুপে সে কান দেয়নি, কারো সন্দেহের চোখের সামনে থেকে নিজেকে আড়াল করেনি আর মনের ভেতর ছিল জিতে ঘরে ফেরার প্রচণ্ড আকাঙ্ক্ষা।হয়ত কে জানে, একারণেই হয়ত কয়েকদিনের মধ্যে মেয়েলোকদের দলে আরো কয়েকজন নাম লেখালো। কালাচানের এসব ছিল অপ্রত্যাশিত প্রাপ্তি।

কয়েকদিন বাদে মহিলাদের একটি দল উত্তরদিকে রওয়ানা হল, তারা জানেনা কাল্পনিক কাওরাকান্দি কত দূর। তারা বাসের জানালা খুলে রাস্তার দুপাশের পেঁয়াজ আর আলুর খেত দেখতে দেখতে নিজেদের পেছনের স্মৃতি ভুলে যেতে লাগল তবু তাদের পথের দূরত্ব ফুরোয় না।কালাচান তাদের বলেছিল, বন্ধুর বাড়ি সবাইকে নিয়ে ভাতপোলাও খাওয়াবে অথচ, কয়কেঘণ্টা চলার পর বাস একটা জরাজীর্ণ রাস্তার ভেতর ঢুকে পড়ল।নারকেল আর কলাগাছে ঘেরা একটি পুরনো বাড়ির কাছাকাছি বাসঠি হঠাৎ থেমে পড়ল। আর সেখানে বিদ্যুতের খুঁটির মত নিশ্চলভাবে দাঁড়িয়েছিল বাবরি চুলওয়ালা আবুল। বিবর্ণমুখের মহিলাগুলোকে নীরাবতার এক পাথরের দেয়াল ঘিরে ধরল আর তারা জানেনা শেষ পযন্ত তাদের মুক্তি কোথায়! তারা আবুলের চারপশে এমন মিনতির ভঙ্গিতে দাঁড়াল যেন একটু পরেই আবুল মহাজনদের মত কিছু টাকা অগ্রিম দেবে। আবুলের সঙ্গে মহিলাদের দফাটি হেরিংবনের রাস্তা ধরে দৌলাতদিয়ার পথের দিকে এগিয়ে চলল।

প্রকৃতির কী নিষ্ঠুর খেলা কে জানে! বিঘাই গ্রাম থেকে কতগুলো মহিলা কাজের সন্ধানে গেল অথচ তাদের নিয়ে কেউ রা শব্দটি করল না। কিন্তু সন্যামত বাড়ির আরজিনার নিরুদ্দেশে গ্রামটা ভূমিকম্পের মত কেঁপে উঠল।গ্রামবাসীর বন্ধ ঠোঁট আস্তে আস্তে নড়তে শুরু করল আর তারা জানতে পারল সন্যামত বাড়ির সীমানালাগোয়া চৌচালা ঘরের কুমারী আরজিনা বেগম ছয় মাসের পোয়াতী হয়েছিল।তারা আরজিনা বেগমের পোয়াতী হওয়ার নানান কল্পনায় বিভোর হয়ে ক্লান্ত হয়ে এক সন্ধ্যায় ঘুমিয়ে পড়ল।যখন ভোরে তারা জেগে উঠল তখন দেখল, চারজন সিপাই নিয়ে বিঘাই গ্রামে থানা থেকে এসেছে শাহানেওয়াজ দারোগা।পুলিশ গ্রামবাসীকে আরজিনা সম্পকে জিগ্যেস করল আর তারা ক্ষণিকের নীরাবতা বজায় রেখে বলল, এই ব্যাপারে মোগো তেমন কিছু জানা নাই।

পুলিশ গ্রামে এক অপরিচিত যুবকের আনাগোনার ব্যাপারে জানতে চাইল, তারা বলল-এমন কোনো অপরিচিত লোকের কতা হুনিনাই।

পুলিশ মানেরুদ্দিন হালাদার বাড়ির হকমান আর তার ভাই জজমানের খবর জানতে চাইল।গ্রামবাসীজানালো, দশসনা খতিয়ানে আর পুরনো দলিলে হকমান আর জজমান নামে দুই সহোদরের নাম পাওয়া যায়। তারা গণ্ডগোলের বছরের বহু আগে মারা গেছে। এই গ্রামে তাদের উত্তরসুরীদের দলিলপত্র ছাড়া তাদের নাম আর কোথাও লেখা নাই।

ফজরবুড়োকে ডেকে এনে একটু অসম্মানের কণ্ঠেই শাহনেওয়াজ দারোগা বলল, হেই বুড়ো, বুরকুনদাসের ব্যাপরে জানতে চাই।

ফজরবুড়ো হাতদুটো হাঁটুর দিকে ছেড়ে দিয়ে মিনতির ভঙ্গিতে বলল-ছার, বিটিশ আমলে বুরকুনদাস নামে মোর একজন দোস্ত আছিল।লোকটার বিয়াশাদী, সোংসারধম্ম কিছুই অয় নাই।বুরকুনদাস অল্প বয়সেই যক্ষ্মার রোগে মারা যায়।

শাহনেওয়াজ দারোগা গ্রামবাসীর কাছে ফের কালাচানের ব্যপারে জানতে চাইল, তারা বিস্ময়ভরা চোখে একে অপরের দিকে অনেক্ষণ ধরে চেয়ে রইল। তারপর নীরাবতা ভেঙে এক মধ্যবয়সী লোক বলে উঠল- ও ছার, এইরম আচুক্কা নাম মোরা বাপের বয়সেও হুনি নাই।