You are currently viewing মরণ রে – অনিন্দিতা গোস্বামী

মরণ রে – অনিন্দিতা গোস্বামী

মেয়েটি মেরে ফেলল আমায়। ধারালো ছুরিটা বুকের এফোঁড়-ওফোঁড় করে দিল একেবারে। শুধু মারলই না রক্তমাখা ছুরিটা ঝুলিয়ে রেখে গেল আমার নাকের ডগায়,  একটা গাছের ডালে। টপ টপ করে রক্ত পড়ছে এখনো ওটা থেকে। এতক্ষণ বেঁচে থাকার কথা নয় আমার তবু কী করে যে বেঁচে আছি কে জানে! চেতন অবচেতনের মধ্যে একটা অবস্থা। সবকিছু বুঝতে পারছি আবছা আবছা কিন্তু মাথা তুলতে পারছি না। সম্ভবত আমাকে একটা ভ্যান রিকশায় তোলা হচ্ছে। এত জঙ্গলের মধ্যে ভ্যান রিক্সা এলো কোত্থেকে কে জানে!আচ্ছা ওরা কী আমাকে শ্মশানে নিয়ে যাবে নাকি হাসপাতলে? এই মরেছে কথাবার্তা তো কিছুই কানে আসছে না।

কারা আমাকে ভ্যানে তুলেছে জানিনা। চোখটা আবার ভালোভাবে খুলতেও পারছিনা। যদি পুলিশ হয় তবে ওরা হাসপাতালেই নিয়ে যেতে চাইবে। ওরা ভাবছে আমি বেঁচে যাব। বেঁচে গেলেই আমি বয়ান দেব। কিন্তু আমি জানি আমি আর বেশিক্ষণ বাঁচবো না। তবে প্রত্যেক খুনিই একটা ভুল করে এই মেয়েটিও করেছে। মেয়েটি আমার মোবাইল ফোনের এই বিশেষ ক্ষমতার কথা জানত না। এটি আমার মামা আমাকে জাপান থেকে এনে দেন। এই ফোনটায় মনে মনে বলা কথাগুলোও রেকর্ড করা যায়। আমি বহু কষ্টে প্যান্টের পকেট হাতড়ে হাতড়ে ফোনের সেই সুইচটা টিপে দিলাম। ব্যাস আমি নিশ্চিন্ত আমার সমস্ত মৃত্যুকালীন বয়ান রেকর্ড হয়ে রইল।

ভ্যান রিক্সাটা লাফাচ্ছে। সম্ভবত কোনো মেঠো পথ ধরে এগোচ্ছে রিক্সাটা। আমার মত মানুষের এরকম মৃত্যু ভাবাই যায় না। কত গুপ্তঘাতক কে আমি ফুঁ দিয়ে উড়িয়েছি,  শেষপর্যন্ত কিনা একটা মেয়ের কাছে এইভাবে! কত ডাকাত রানী দস্যু রানীর গল্প শুনেছি, আজ প্রত্যক্ষ করলাম। প্রথম থেকেই এ মেয়ের চোখ দেখে আমার সন্দেহ হয়েছিল কিন্তু ওই যে প্রতিপক্ষকে দুর্বল ভাবলে যা হয় আর কি। আসলে আমি রাজনীতি করা লোক,আমি একটু বেশি সাহসী,  মঞ্চে উঠে ভীতু লোকের গুণগান গাইলেও প্রকৃতপক্ষে আমি ভীতু লোকেদের খুব একটা পাত্তা দিই না। আমার লাইনে তো পিছন থেকে ছুরি মারার লোকের অভাব নেই!  সামনে দাঁত কেলিয়ে একসঙ্গে বসে চা খাবে পরে হেড অফিসে গিয়ে টুক করে লাগিয়ে আসবে উল্টো কথা। এ তো গেল এক রকমের খুন,  প্রত্যক্ষ খুনির খপ্পরে ও আমি পড়েছি।

সেবার পুরসভার ভোটে একটা ওয়ার্ডের দায়িত্বে ছিলাম আমি।ওই ওয়ার্ড নিয়ে একটু চাপে ছিল আমার দল। প্রতিপক্ষ ছিল খুব জোরালো, তার থেকেও বড় কথা আমাদের দলের এক নেতা নির্দল গোঁজ দিয়ে খেলাচ্ছিল। আসল মাস্টারমাইন্ডটা যে কার আমি সেটা ধরে ফেলেছিলাম।ব্যাস,  অপিস থেকে ফেরার সময় আমি লক্ষ্য করতাম কেউ একজন আমাকে ফলো করছে।প্রথম কয়েক দিন আমি বেশ ভয় পেলাম এবং মানুষ ভয় পেলে যা যা করে তাই তাই করলাম।  লোকটার সঙ্গে দূরত্ব বাড়ানোর জন্য আমি খুব জোরে জোরে হাঁটলাম এবং এমন জোরে হাঁটলাম যে একসময় লক্ষ্য করলাম আমি দৌড়াচ্ছি, আমার কপালের পাশ দিয়ে বিন্দু বিন্দু ঘাম ঝরল,  ঘামে পিঠের জামা ভিজে সপসপ করলো,  ভাবলাম রাজনীতি করা ছেড়ে দেবো। কিন্তু একদিন সেই নেতাই আমাদের দল ছেড়ে দিলেন আর ওই লোকও আমাকে ফলো করা বন্ধ করে দিল। আমি বুঝে গেলাম লোকটার উদ্দেশ্য আমাকে মারা ছিল না,  লোকটা আমাকে শুধু ভয় দেখাতে চেয়েছিল।

তারপর থেকে আমি আর কোনো কিছুতেই ভয় পাই না,  আমার সাহস দ্বিগুণ হয়ে গেছে।পার্টিতেও আমার প্রভাব-প্রতিপত্তি বেড়েছে অনেক। পার্টিতে অধিক সময় দেবার জন্য আমি চাকরিটাই ছেড়ে দিলাম। একটা বিরাট এলাকার  সংগঠনের দায়িত্ব আমাকে দেওয়া হল। সাধারণ  পার্টি কর্মী থেকে নেতা হয়ে উঠতে আমার দেরী হলো না। আর তার প্রধান কারণ হলো আমার কাজ করার ক্ষমতা। আমি আগ বাড়িয়ে কোন দায়িত্ব খুব একটা নিতে চাই না,  একটু ভেসে-ভেসে থাকি, খানিক কবি স্বভাব  কিনা আমার তাই। কিন্তু দায়িত্ব একবার নিয়ে ফেললে সেখানে আর কোনো ফাঁক রাখিনা আমি,  সমস্ত জায়গাটা ঘিরে ফেলি। জনসংযোগে আমার কোনো জুড়ি নেই।

মেয়েটি এসেছিল আমার সংগঠনে যোগ দিতে।  সে তো অনেকেই আসে।সদস্য সংখ্যা বাড়ানোও তো আমার অন্যতম কাজ। খুশিই হয়েছিলাম। মহিলাদের  দিয়ে কাজ করানো সুবিধা,  তাদের ডিভোশন অনেক বেশি।মেয়েটি খুব দ্রুতই ওর দক্ষতার পরিচয় দিয়েছিল। যে কাজ দিতাম সে কাজই ও সাফল্যের সঙ্গে করতো,  ফলে আমিও ওকে দায়িত্ব দিয়ে নিশ্চিন্ত হতাম। যোগাযোগও বাড়ছিল নিয়মিত। একদিন বুঝতে পারলাম ও আমার এলাকায় অপরিহার্য হয়ে উঠেছে,  আমার কাছেও। বুঝলাম ওর ডানা ছাঁটার সময় হয়েছে। ওকে গুরুত্বহীন করবার জন্য ওকে আমি কাজ দেওয়া বন্ধ করলাম,ফোন করাও। নানা লোক মারফত খবর পাচ্ছিলাম ও নাকি অভিমান করেছে, বলছে সংগঠনের আমাকে আর প্রয়োজন নেই।  অথচ আমার কাছে এসো কখনো কোনো কাজ বা দায়িত্ব কিন্তু  চাইত না। ওর এই জেদটাই আমার অসহ্য লাগতো। কিন্তু আমি বুঝতে পারছিলাম ওর অভাবে আমার সংগঠন দুর্বল হয়ে পড়ছে। তারপর একদিন ফোন করে খুব কড়কালাম। বললাম যাদের ডেকে ডেকে কাজ দিতে হয় তাদের সংগঠনে না থাকাই ভালো। ব্যাটা বেয়াদব মেয়ে ফোন পেয়ে খিলখিল করে হেসে বলে কী কাজ দেবেন বলুন, আমি প্রস্তুত। যেন কিছুই হয়নি। এই মেয়ের কর্মদক্ষতা যা, চেহারা, বাচনভঙ্গি যা তাতে যে কোন পার্টিতে গেলে ও তরতর করে এগোবে। এমনকি আমাদের পার্টিতেও অন্য যে কোন নেতার আন্ডারে কাজ করতে গেলে ওকে লুফে নেবে।কিন্তু ও সেসবের কোন উদ্যোগই দেখায় না শুধু আমার সঙ্গে লেগে থাকে। আমার ভিতরে কেমন সন্দেহর কাঁটা খচখচ করতে লাগল।  আমি লোক লাগালাম মেয়েটার সম্পর্কে খোঁজখবর নিতে।

আমার লোক খবর যা আনলো রক্ত হিম করা। আমাদের পার্টির একটি শাখা সংগঠন এখন উগ্র মতাদর্শে বিশ্বাসী। উগ্র বিপ্লববাদ সন্ত্রাসবাদেরই নামান্তর। এরা গণতন্ত্রে বিশ্বাস করে না। আরে বাবা এরা বোঝে না গণতন্ত্রে আস্থা না রাখলে রাষ্ট্রযন্ত্রে শামিল হওয়া যায় না। স্বপ্ন দিয়ে বাস্তব চলেনা। যে নেতাকে ওরা পুজো করে সে নেতাকে তো একসময় আমরাও মেনেছি। কিন্তু বুঝতে হবে প্রত্যেক দেশের পরিস্থিতি আলাদা।  ওরা সেসব কিছু বোঝেনা। ওদের সবচেয়ে রাগ এখন আমাদের ওপর। আমাদের ওরা ভন্ড মনে করে। মনে করে বিশ্বাসঘাতক। খবর পাওয়া গেল ওই মেয়ে সেই পার্টির হয়ে কাজ করতে এসেছে এখানে। ওই মেয়ের আসল উদ্দেশ্য হলো আমাকে খতম করা। খবরে যদিও কোনো তথ্য-প্রমাণ নেই তবুও এমনই শোনা গেছে। স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে আমি উড়িয়ে দিলাম কথাটা কারণ নেতাদের নির্ভীকতার একটা ভেক ধরতে হয়।

আমি আমার নিকটজনের কাছে হা হা করে হেসে বললাম,আমি একজন তৃতীয় শ্রেণীর নেতা, পার্টির বাঘা বাঘা নেতা-মন্ত্রীদের ছেড়ে ওরা আমাকেই বাছবে কেন হত্যা করার জন্য? তা-ও কিনা এতদিন ধরে সময় নিয়ে। বরং দেখো গে আমার পার্টির ভেতরেই কেউ হয়তো আমাকে সরিয়ে দেবার চেষ্টা করছে তার পথ পরিষ্কার করার জন্য,  তাই এমন গল্প ছড়াচ্ছে। বললাম বটে কিন্তু আমি এড়িয়ে চলতে আরম্ভ করলাম মেয়েটিকে। অনেকটা যেন ইঁদুর বেড়াল খেলার মত। ও যেখানে যায় আমি সেখানে যাই না।  আমি ওর এলাকায় গেলেও কখনো আগে থেকে ওকে খবর দিই না,  চুপেচাপে কাজ সেরে পালিয়ে আসি। কিন্তু আমি যত ওকে এড়াতে চাই দেখি ওর মুখোমুখি পড়ে যাই। আমি আমার চারিদিকে মহিলা ব্রিগেডের সংখ্যা বাড়ালাম। ওকে দেখিয়ে দেখিয়ে আমি ঐসব মহিলা স্কোয়াডের সদস্যাদের বেশি বেশি করে কাজ দিতাম। সেই মহিলারাও আমাকে ডাকলে আমি ছুটে চলে যেতাম ওই এলাকার সমবায় কিংবা পার্ক উদ্বোধনে,যাতে ও অপমানিত হয়ে চলে যায়। কিন্তু ও যেত না। যেতও না আবার আমার কাছাকাছি ও খুব একটা ভিড়ত না।

আমি একে নেতা তাই আবার কবি। সবসময়  না হলেও মাঝেসাজে এক আধটা কবিতা আমার ছাপা হয় এখানে ওখানে। চেহারাও খানিক যুবক সুলভ।মেয়েরা স্বভাবতই আমাকে দেখলে একটু আকর্ষিত হয় বেশি। আমি তাদের হয়ে এতোটুকু করলে তারা যেন ধন্য হয়ে যায়। হয়তো কারোর ছেলের স্কুলে ভর্তি, আমি একটু বলে দিলাম।হয়তো কারো ঋণ বের করা, আমি একটু লিখে দিলাম। আমি কোথাও বক্তৃতা দিতে গেলে মেয়েরা আমার ঘাড়ের ওপর এসে পড়ে আর এ মেয়ে সামনে দিয়ে চলে যায় নিজের কাজে, এত দেমাক! যদি সত্যিই মারতে আসত ও আমাকে তবে তো ও আমার আরো কাছে ঘেঁষার চেষ্টা করত!  গভীর সংকটে পড়ে যাই আমি,  ক্রমশ ওর কালো বেত লতার মতো শরীর,  চ্যাপ্টা নাক,  উল্টানো ঠোঁট আর দীঘল চোখের মধ্যে যেন দেখতে পাই আমার মৃত্যুর কালো ছায়া।

দম চাপা লাগে আমার। এই দীর্ঘ উদ্বেগ আমি আর বইতে পারি না। ভাবি  যা হোক হেস্তনেস্ত একটা হয়েই যাক। পার্টিতে আমার কাছের লোকেরা আমাকে বলেছে ওরা ছোট নেতা নির্বাচন করে প্রথমে। কারণ বড় নেতা মন্ত্রী মারলে হই হই হয় বেশি। আর আমাদের মতো নেতারা তো চিরকালই বড় নেতাদের ঘুটি হয়ে এসেছি। যেমন মেয়েটি। আমাকে মেরে ও-ও তো নিজে বাঁচবে না। হয়তো জেলে পচবে নয় তো ফাঁসি যাবে। কিংবা মানববোমা ও হতে পারে, আমাকে জড়িয়ে ধরে নিজেও ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল। যে মেয়ে গর্ভে সন্তানের বদলে বোমা নিয়ে ঘোরে সে মেয়ের সাহস দেখে মরবার আগের মুহূর্তেও কি আপনি একবার তার প্রেমে পড়বেন না?  ঠিক করলাম মেয়েটির সঙ্গে একবার সরাসরি মোকাবিলা করা দরকার।  জরুরী মিটিং ডাকলাম আমার এলাকার সমস্ত সদস্যদের নিয়ে।

মিটিং শেষ হবার মুখে মুখে মেয়েটি দেখলাম পিছনের দরজা দিয়ে কেটে পড়ছে,  আমি ডাকলাম মেয়েটিকে,  দাঁড়াও কথা আছে। সকলে চলে গেলে মেয়েটির সঙ্গে আমি মুখোমুখি বসলাম। বললাম, শোনা যাচ্ছে আমাকে হত্যা করার জন্য নাকি লোক ফিট করা হয়েছে।

মেয়েটি বলল,ও।

আমি বললাম,  আমি অবশ্য মরতে অত ভয় পাই না।

মেয়েটি বলল,  তাই?

মাথা ঝাঁকালাম আমি,হুঁ,রাজনীতি করতে নেমেছি জানি মৃত্যু একদিন অতর্কিতে আসবে।

মেয়েটি বলল,  বেশ তো। তবে এমন জায়গায় চলুন না যেখানে অন্য নেতারা সচরাচর যেতে ভয় পায়।

আমি বললাম,  কোন জায়গা?  আর কেনই বা যাব আমি?

মেয়েটি বলল, সে গভীর জঙ্গলের ভেতরে ছোট্ট এক গ্রাম। সেখানকার মানুষ কতদিন ভালো করে খেতে পায় না, ভালো জামা কাপড় পায় না।

আমি বললাম,  ওখানকার লোকাল কমিটি নেই,  স্থানীয় নেতা কর্মীরা?

সেখানে কেউ যায়না,  ওই কটা তো মাত্র ভোট৷

কিন্তু ওদের ডিঙিয়ে আমিতো সেখানকার জন্য কিছু করতে পারি না।

মেয়েটি বলল,  তারমানে আপনি ও ভয় পাচ্ছেন।

শিভালরি দেখানোর জন্য বললাম,  না একদম না, যে কোনো একদিন চলে যাওয়া যাবে সেখানে।

মেয়েটি চলে গেল। ভাবলাম যাক বাবা খুব কাটানো গেছে। তবে একটু নিশ্চিন্ত বোধ হচ্ছে এই ভেবে যে খবরটা সম্ভবত ভুল। না হলে মেয়েটি আগ বাড়িয়ে অমন জঙ্গলে নিয়ে যাওয়ার কথা বলত না। পরদিন সকালবেলা মেয়েটি আমার বাড়িতে এসে হাজির। বলল, চলুন।

আমি বললাম,  মানে?

মেয়েটি বলল,  যাবেন বলেছিলেন।

আমি বললাম,  কোথায়?

ওই জঙ্গলের গভীরে সেই গ্রামে।

আমি বললাম,  আরে চলুন বললেই হলো নাকি!  সুবিধামতো একদিন ব্যবস্থা করতে হবে।

মেয়েটি বলল,  না এখুনি চলুন।  আমি গাড়ির ব্যবস্থা করে রেখেছি।

মেয়েটির কাঁধে একটা ঝোলা ব্যাগ, ওটার মধ্যে কি বোমা আছে?বোমা না পিস্তল? যাব না বললেই হয়তো আমার খুলি উড়িয়ে দেবে। আমি কি পুলিশ ডাকবো? মোবাইলটা বার করতে নিলাম পকেট থেকে। বলল, ওটা আমাকে দিন। ওর একটা হাত কাঁধের ঝোলা ব্যাগে। আমি ফোনটা ওকে দিয়ে দিলাম। ও বলল,  আসুন। আমি চুপচাপ ওকে অনুসরণ করে উঠে পড়লাম একটা সাদা অ্যাম্বাসেডর গাড়িতে। হুস করে ছেড়ে দিল গাড়িটা।

আমি আর মেয়েটি দুজনে দুটো জানলার দিকে মুখ করে বসে ছিলাম। কেউ কারো সঙ্গে কথা বলছিলাম না। শহর ছেড়ে গাড়ি ফাঁকা রাস্তায় পড়ল। গাড়িতে ওঠার সময় দেখেছি গাড়ির মাথায় কতগুলো বস্তা ডাঁই  করা। ওগুলোর মধ্যে কি চাল আছে? নাকি বিস্ফোরক কিছু! রাস্তার দুপাশে লাল মাটি,  শাল,  পলাশ আর শিমুলের জঙ্গল। সময় গড়াচ্ছে, দিন ঢলে যাচ্ছে সন্ধ্যের দিকে। লাল ধুলোয় ঢেকে যাচ্ছে গাড়ির কাচ।একটা তাজা বুনো গন্ধ এসে লাগছে নাকে। মেয়েটি মোবাইল ফোনটা ছুঁড়ে দিল আমার কোলের কাছে। আমি অতি উৎসাহে ওটা তুলে নিয়ে দেখলাম কোন টাওয়ার নেই। কোথাও ফোন করে কিছু আমি জানাতে পারব না। আমি হতাশ হয়ে ফোনটা রেখে দিলাম প্যান্টের পকেটে। মেঠো রাস্তাও এক সময় শেষ হয়ে গেল জঙ্গলের ভেতরে। গাড়ি থামলো। মেয়েটি বলল,  নেমে আসুন। আমি নামতেই গাড়ি ছেড়ে চলে গেল। আঁতকে উঠলাম আমি,  এই গভীর জঙ্গলে এখন আমার কী হবে! মেয়েটি আমার হাত দুটো পিছমোড়া করে বাঁধলো প্রথমে। অন্ধকার ঘন হয়ে উঠেছে। আমার মাথা ঘুরছে,  আমি কিছু বলবার চেষ্টা করলাম কিন্তু গলা দিয়ে কোন স্বর বেরোলো না।  মেয়েটি ঝুঁকে এলো আমার সামনে এবং ওর কাঁধের ঝোলা ব্যাগ থেকে একটা চকচকে ছুরি বের করে ঢুকিয়ে দিলো আমার বুকের এফোঁড়ে ওফোঁড়ে।

খুব যন্ত্রণা হচ্ছে বুকের বাঁ পাশটায়, জল তেষ্টা পাচ্ছে। আমি কি জল চাইলাম? কে যেন ফোঁটা ফোঁটা করে জল দিল আমার ঠোঁটের ওপরে। ঠান্ডা লাগছে শরীর। শেষবার এই পৃথিবী কে দেখবার জন্য আমি কষ্ট করে একটু চোখ খুললাম। আকাশে মস্ত বড় গোল চাঁদ,জ্যোৎস্নায় আলো হয়ে আছে চারপাশ।আসার সময় পথের দু’পাশে হাড় জিরজিরে রুগ্ন কতগুলো বাচ্চাকে খেলা করতে দেখেছিলাম। আমি মরে গেলে জায়গাটা নিয়ে হইচই হবে,  নজর পড়বে সবার। ওরা খেতে পাবে,  জামা পাবে, আঃ কী শান্তি! কী আশ্চর্য,  আমার পাশে বসে আছে যে ওই মেয়েটি!  গোঙানির মতো কিছু একটা শব্দ বেরোচ্ছে আমার মুখ দিয়ে। মেয়েটি আমার গা থেকে  রক্তে ভিজে যাওয়া শার্ট খুলে ফেলল দু’হাতে। যেন আমার বল্কল খসে গেল।  অতি যত্নে নিজের কোলের উপর তুলে নিলো আমার মাথা তারপর নিচু হয়ে ঠোঁট ছোঁয়ালো আমার বুকের ক্ষতে। আমি মরে গেলাম। এক্ষুনি পুষ্পবৃষ্টি হবে আমার ওপরে। লাল পলাশে ঢেকে যাবে আমার শরীর।  মৃত্যুও এতো সুন্দর হয়! মেয়েটি বলেছিল, ভয় কী চলুন। যদি মরেও যান দেখবেন সে মৃত্যু হয়তো নতুন করে বেঁচে ওঠারই শামিল।