You are currently viewing মনির জামানের ৩টি গল্প

মনির জামানের ৩টি গল্প

মনির জামানের ৩টি গল্প
 
 
 
ধনী হওয়ার সহজ উপায়
 
 
গুপীবাগের মতিন সাহেবের গলিতে দুই কাঠার উপর আমাদের একটা টিনের ঘর ছিলো। বাবা তার চাকুরি-জীবনের মাঝামাঝি ঘরটা করেছিলেন। আমাদের ছেলেবেলা কেটেছে এই ঘরে। বোনেরা ঘরের সামনে গেটফুলগাছ লাগিয়েছিলো। ছোট্ট উঠানের চারপাশে ছিলো লাল চীনা-গোলাপ। উঠানের মাঝখানের কাঠাল গাছটায় সকাল-সন্ধ্যায় প্রচুর চড়ুই পাখি জড় হয়ে আমাদের কানে তালা লাগিয়ে দিতো। বিকেলে আমরা ব্রাদার্স ইউনিয়নের মাঠে ফুটবল খেলে এসে কলপাড়ে ট্যাপ ছেড়ে গোসোল করতাম। আমার বোনরা লাল ফিতায় দুইবেনী করে কপালে কালো টিপ আর চোখে কাজল টেনে পড়শিদের সাথে এক্কা-দোক্কা খেলতো। আমাদের পাশের প্লটে ছিলো কাস্টম-চাচার বাসা—একই রকম; টিনের চালের। বাবা ছিলো কাস্টম চাচার বড়। বাবাকে খুব মান্যগন্য করতো। সন্ধ্যায় নওয়াব আলীর দোকানে গিয়ে দুজনে ঝোল দিয়ে পুরি খেতো, আর খুব গল্প করত। কাস্টম চাচা প্রতিদিনই এক্সটা ইনকাম করতো বিধায় বাবাকে কখনই চা-পুরির বিল দিতে হতো না। বড় বোনের বিয়ের পুরো খরচটাই বাবা কাস্টম চাচার কাছ থেকে নেয়। আমরা কলেজ, ভার্সিটিতে ভর্তি হওয়ার সময়ও বাবা ওনার কাছ থেকে ধার করে। কাস্টম চাচার উপরী-ইনকাম থাকায় টাকা দিতে কার্পণ্য করতো না। একে একে বোনদের বিয়ে হয়ে যায়। মা’র রান্নাঘরের ব্যস্ততা কমে আসে। মা প্রায়ই কাস্টম চাচীর সঙ্গে গল্প করতে ওদের বাসায় যায়। চাচীর এক ছেলে, এক মেয়ে; আমাদের মতো কলেজ, ভার্সিটি নিয়ে মেতে থাকে। এই সময়টায় বাবা পেনশনে যায় বটে, আমরা তখনো ইনকাম-সক্ষম হয়ে উঠি নি; ফলে বাবার খরচ কমে না। তখনো কাস্টম চাচা বাবাকে টাকা দেয়। বাবা এবং কাস্টম চাচার লেনদেন নিয়ে আমরা মাথা ঘামাই না। ভালো পড়শীর মতো বেড়ে উঠি। কাস্টম চাচার ছেলে দোলন আমাকে বড় ভাইয়ের মত জানে। কনা টেন-ইলেভেন ক্লাশে পড়ার সময় আমার সঙ্গে প্রেম-প্রেম ভাব জমিয়েছিলো বটে, মেডিকেল কলেজে ভর্তি হওয়ার পর ও পাল্টে যায়। আমিও ওর দিক থেকে মন ফিরিয়ে নিয়ে সময়গুলোকে ভার্সিটি-কেন্দ্রিক করে ফেলি। বাবার রিটায়ার্ডমেন্টের পর দুই ভাই চাকুরি নিয়ে নেয়। এই টিনের ঘর আর ওদের ভালো লাগে না। ওরা বিয়ে করে নতুন ঢাকায় ফ্লাট-বাড়িতে উঠে যায়। বাবার কিডনী আর ডায়বেটিসের অসুখ বেড়ে যাওয়ায় ওরা ছুটির দিনে বউ, নিয়ে বেড়াতে আসে, আর বউদের বলে—
 
আমাদের গেটফুলগাছ ছিলো, চীনা গোলাপের সারি ছিলো উঠানের চারপাশে।
বউরা কাঠাল-তলার বেঞ্চে বসলে মা ওদের চা খেতে দেয়। আমি সপুর দোকান থেকে গরম গরম পুরি আনি। আগে ডাল-পুরি হতো; মুদ্রাস্ফিতির কারনে এখন পুরিতে আলু দেয়। বউরা আধুনিক। ওরা তেলেভাজা এড়াতে এক,দুই কামড় মুখে নেয়। বাবার কিডনির অসুখ বেড়ে গেলে ঘর থেকে আর বেরুতে পারে না। ফলে কাস্টম চাচার সঙ্গে যোগাযোগটা বড় আপা চালিয়ে যায়। বড় আপার বিয়েতে কাস্টম চাচা উকিল বাপ ছিলো। কারন, বড় দুলাভাই ওনার দূর-সম্পর্কের ভাগ্নে। দুজনে আজকাল খুব আসে, কাস্টম চাচার সঙ্গে মিটিং করে আর বাবাকে সপ্তাহে সপ্তাহে হাসপাতালে নিয়ে যায়।
বাবা মারা গেলে চাচা ‘ভাই, ভাই…’ করে খুব কাঁদে। অফিস থেকে ছুটি নিয়ে দাফন-কাফনের সব ব্যবস্থা করে। চল্লিশার খাওনিতে বিরাট ভূমিকা রাখে; যেনো বাবা ওনার আপন ভাই। বাবা চলে যাওয়ার পর বাসাটা নিরব হয়ে যায়। আমি বাইরে বাইরে থাকি। চাচি এসে মাকে সঙ্গ দেয়। কিন্তু বড় আপা মাকে একা থাকতে দিতে চায় না। দুই মেয়েকে সঙ্গে করে এসে মাকে নিয়ে যায়। ফলে আমি একাই বাসায় থাকি।
এমন এক সকালে কাস্টম চাচার ছেলে দোলন এসে বলে—ভাই, আপনার ঘরটায় এখন থেকে আমি থাকবো।
আমি বলি—অবস্যই। এই নাও চাবি।
সকাল বেলায় দোলনের হাতে চাবি তুলে দিয়ে মতিন সাহেবের গলিটাকে পিছে ফেলে বড় রাস্তায় উঠে আসি, আর শহরটা অচেনা হয়ে যায়।
আগে হলে মা রুটি, আলু ভাজি করে রাখতো; আমি ডিম পোজ করে ডাইনিং টেবিলটায় খেতে বসতাম। আজ ব্রেকফাস্টের ইচ্ছেটা মরে যায়। হাটতে হাটতে পার্কে এসে ঢুকি। সকালের নিরব, সবুজ পার্ক হেসে উঠে বলে—আয়, আমার কোলে বস।
আমার বিষাদ কাটে না। অপুকে দেখি, এক দঙ্গল ছেলে,মেয়ে নিয়ে এসে মিছিলে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। আমাকে দেখে বলে—আরে আপনি! চলেন, মিছিলে যাবেন।
কিসের মিছিল? গনতন্ত্রের জন্য; আমরা গনতন্ত্র পাবো; আর সবাই মিলে ভালো থাকবো…।
মিছিল পার্ক ছেড়ে রাস্তায় উঠে গেলে আমিও ওদের সঙ্গে সামিল হই। অনেক মানুষের মধ্যে আমাকে আর আলাদা করা যায় না। আমি মিছিলের সঙ্গে হাটি/ কেউ যেনো আমার কান্না না দেখে।
 
 
 
দাম্পত্য
 
 
আমরা পাঁচ তলায় দুই রুমের ছোট্ট ফ্লাটে থাকি। রাতে দাপাদাপি করলে লোহার খাটটা ও-আল্লা, ও-আল্লা বলে কোঁকাতে থাকে।
মিথিলা বলে—বালের খাট! এইটা পাল্টাও।
আমি বলি—ভাঙ্গারীর দোকানে বেচে দিয়ে চলো, ফ্লোরিং করি।
মিথিলা ক্ষেপে যায়—ফকিরের ঘরের ফকির; তোরে কে কইছে সংসার পাততে! যা পার্কে গিয়া পইড়া থাক।
সকাল বেলায় ছোট্ট ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে সেজে-গুঁজে মিথিলা বেরিয়ে পড়ে। বসার ঘরে একটা বেতের ডিভান আর টি-টেবিল। ওগুলোও এনেছিলাম বোনের বাসা থেকে। ঘর-দোর গুছাবো কী!—কাজতো দুই, খাই আর শুই। বাড়িওয়ালাকে ভাড়া দিই ভেঙ্গে ভেঙ্গে। টাকা দরকার; পামু কই!
 
মিথিলা বলে—পেটে-ভাতে আর ভাল্লাগতেছে না। রাইতভর ঝগড়া না কইরা যাই গিয়া।
কই যাবা?
হেই কথা কি তোরে কইতে হইবো, বাইঞ্চোৎ কোথাকার!
গেলে তো গেলা; কাবিনের টাকা নিয়া যাবা না!
মিথিলা গ্লাস ছুড়ে মারে—তুই দিবি টাকা! সেই মুরদ আছে!
খপ করে ধরে না ফেললে গ্লসটা খান খান হয়ে ভেঙ্গে যেতো; আর টাকাগুলো হাতে না এলে মিথিলা চলে যেতো, দুচোখ যেদিকে যায়। টাকা পেয়ে গ্রিল-নান কিনলাম। ওর জন্য ড্রেস, আরো টুকিটাকি জিনিসের সঙ্গে একটা এন্ড্রয়েড ফোন নিয়ে এসে বলি—এইবার! এইবার যাইবা ক্যামনে?
মিথিলা গোল গোল চোখ করে তাকায়—আবার কার সাথে বাটপারি করছো?
না, না; হালাল কামাই। ওর হাতে লাখ টাকার তোড়াটা দিয়ে বলি—সেজান দিছে; ওর নতুন টিভি সিরিয়াল ‘ও মোর স্বোয়ামি’ লিখে দেওয়ার জন্য।
খুব ভালো; টিকে গেলা।
খাটটার ক্যাচক্যাচের জ্বালায় দুজনে ওটাকে খুলে বারান্দায় রেখে ফ্লোরে জাজিম পেতে জড়াজড়ি করে গড়াগড়ি দিই।
মিথিলা বলে—একটা আলমারি নাই! টাকাগুলা কথায় রাখি!
আরে, ব্যাগে রেখে দাও। কে নেবে! চোরতো আমার ঘরেই আছে। বিয়ের পরপর আংটি বেচে দিয়ে চোরের স্থায়ি খেতাব পেয়ে গেছি।
আমি বলি—এবার আর তোমার টাকা ধরবো না।
ধরার সুযোগ দিলেতো!
কি করবা টাকা দিয়া?
টাকা হলো ঘরের স্বাস্থি; বাইরের উচ্ছলতা। গৃহশান্তি নষ্ট করতে চাই না বিধায় ব্যাগে হাত না দিয়ে সকাল সকাল বেরিয়ে পড়ি। শুটিং ইউনিটে সময় দেওয়ায় দু’রাত ঘরে ফেরা হয় না।
মিথিলা ফোন করে—ব্যস্ত খুব?
হ্যাঁ; বলো।
আজকে কয় তারিখ?
কেনো?
দেরি না করে বাসায় আসো।
শালিকা দরজা খুলিয়ে বলে—ওয়েলকাম, দুলাভাই।
দুলাভাই কিরে! বল দাদাবাবু। ঘরে ঢুকে সবকিছু অচেনা মনে হয়। সুন্দর ডাইনিং টেবিলে একটা বার্থডে কেক। পাশে ছোট্ট ফ্রিজ, শোকেস, বুকসেলফ; ঘরময় ঝলমলে আলো। ভিতরের রুমে দারুন খাট, আলমারি, নতুন ড্রেসিং টেবিল। মিথিলার দিকে তাকিয়ে জানতে চাই—এতো কম টাকায় এতকিছু হয়।
হয় না; হওয়াইতে হয়।
শাশুরি ডাক দেয়—আসো, কেক কাটবা।
আমি ছুরি হাতে দাঁড়াই। সবাই বলে ওঠে—হাপি বার্থডে টু ইউ…।
মিথিলা আমাকে কেক খাইয়ে দেয়। শাড়িতে ওকে খুব ভালো দেখাচ্ছে। আমি বলি—সব টাকা শেষ?
আরো লাখ টাকা ধার হইছে।
চলবা ক্যামনে!
কেনো! তুমি আবার আনবা।।
 
 
 
পিরিতি কারে কয়
 
 
পুটি আর চান্দু; আর একটা কালো কুকুর, যার পিঠের খানিকটা সাদা—একরাতে আমি আবিষ্কার করি; যখন শহরের কোলাহল থেমে যাচ্ছিলো; জেগে উঠতেছিলো আরেক শহর; যা মধ্যবিত্তের একদম অচেনা। আমি তখন বদ্ধ বহেমিয়ান। মনে হতো পৃথিবীর পুরোটাই আমার বাসস্থান। শ্রেনী-চৈতন্য ভুলে গিয়ে শুয়ে থাকতাম পথের পাশে। চেনা-জানারা বলতো—আহা, শিক্ষিত পোলাডা ক্যামনে এমন পাগল হয়া গেলো…! পাগল ব্যাপারটা আপেক্ষিক। পরিচিতরা এড়িয়ে যাচ্ছিলো; আর অচেনারা হয়ে উঠেছিলো আপন। অনেকটা গরিব আত্মিয়দের মধ্যবিত্তরা যেমন এড়িয়ে চলে, আমিও তেমনি চেনা শহরে অচেনা মানুষ হয়ে থাকি। একরাতে বৃষ্টি হবে হবে সময়ে, আমি নির্জন যাত্রি-ছাউনিতে বসে থাকতে থাকতে কাঁৎ হয়ে শুয়ে পড়ি। আর কালো কুকুরটা লাফ মেরে আমার পায়ের কাছে উঠে এসে পাছার উপর বসে সামনের পাদুটোয় ভর করে এদিক ওদিক তাকায়। আমি কিছু মনে করি না; ও-ও যেনো আমাকে অনেকদিন ধরে চেনে। তখনি ঝমঝম করে বৃষ্টি শুরু হয়। এমন তুমুল বৃষ্টি—ধাবমান গাড়ির আলোটিকুই শুধু চোখে পড়ে। আমি উঠে বসি; আর, কুকুরটা লাফ মেরে রাস্তায় নামে গিয়ে আবার যখন ফিরে আসে, তখন ওর সঙ্গে যে দুটি ছেলে-মেয়ে আসে, ওরাই চান্দু আর পুট। বেশ ভিজে গেছিলো। বেঞ্চে বসে মেয়েটা ফস করে বিড়ি ধরায়।
 
আমি সিগারেট বের করে বলি—আগুনটা দে।
বিড়ির আগুনে সিগারেট ধরিয়ে আমি বৃষ্টির তান্ডব দেখি। ওরা খুব কাছাকাছি মুখোমুখি বসে চোখে চোখে তাকাতাকি করে মিটমিট করে হাসে।
ছেলেটা বলে—কি?
মেয়েটাও বলে—কি!
ওরা ‘কি’, ‘কি’ কাটাকাটি করে; আর কুকুরটা ওদের পায়ের কাছে বসে কান নাড়ায়। মেয়েটা কুকুরটার পিঠের উপর পা তুলে দিয়ে আদর করে। কুকুরটা বৃষ্টির মধ্যে কোথায় যেনো চলে যায়। ওদের ‘কি’ ‘কি’ খেলা আর কুকুরটার দুরন্তপনা নিমিষে আমার বিষাদ কাটিয়ে দিয়ে মনের মধ্যে প্রশ্নের ঝড় তোলে—কি? কি? প্রশ্নই যেনো উত্তর। বৃষ্টি থেমে গিয়ে ভোররাতের আকাশে চাঁদ দেখা দেয়। আমি ঝিরিঝিরি বৃষ্টির নিচে রাস্তায় নেমে এসে গান ধরি—বৃষ্টি ভেজা রাত/ সোডিয়াম আলো। একটা কালো কুকুর/ আর একখানা বেঞ্চ, নড়বড়ে/ এমন রাতে বলো কে থাকে ঘরে…।
জাহিদের গান; টিএসসির বারান্দায় বসে গলা ফাটিয়ে গাইতাম। খান আতার ছেলে আগুন অনুমতি না নিয়ে টিভিতে গেয়েছিলো বলে খুব আন্দোলন করেছিলাম। আর এখন, গানটা আপন আনন্দে মাঝ-রাস্তায় নেচে নেচে গাই। দুইজন টহল পুলিশ যেতে যেতে বলে—শহরটা পাগলে ভইরা গেছে। এরপর দিনমান যতই বুদ্ধিবৃত্তিক চেতনা নিয়ে ঘুরি, রাত বেড়ে যখন পোয়াতি হয়, মাথাটা দুই হাঁটুতে নেমে আসে, তখন অবচেতনে দেখি—পুটির পিছে প্রবল ঊচ্ছলতায় চান্দু ছুটতেছে! আর রাতের বাতাসে পুষ্পরেনু ছড়িয়ে দিয়ে পুটি খিলখিল করে হাসতেছে। ওদের সাথে পাল্লা দিয়ে কালো কুকুরটা আমার কাছে এসে দাঁড়ায়।
 
তখন পুটি হাঁপাতে হাঁপাতে বলে—দেখেন তো ভাই, চান্দুটা আমারে রাইতভর ক্যামন বিরক্ত করে!
পুটি আমার পিছে লুকায়।
চান্দু ডানে-বায়ে ঊঁকি দিয়ে বলে—কি? কি!
মেয়েটা একটু দম নিয়ে আবার ছুটতে শুরু করে। কুকুরটা ওর আগে আগে ছোটে; চান্দু ওদের পিছে পিছে। বাতাসে আনন্দের রেনু ছড়িয়ে ওরা কোথায় যে চলে যায়, আর দেখিনা। মনে মনে হাসতে হাসতে আমি আবার ঘুমিয়ে পড়ি। এ জীবন হিসাব-নিকাশের না; এ যেনো শিমুল তুলোর উড়াউরি। একরাতে পার্কে আড্ডা দিচ্ছিলাম; কালো কুকুরটা এসে লেজ নাড়ে। আমি হাত নাচিয়ে বলি—কি? কুকুরটা ছুটে দূরে চলে যায়। তাকিয়ে দেখি, পুটি আমাকে ইশারায় ডাকতেছে।
 
আমি গেলে চান্দু বলে—ভাই, মাজার থেইকা শিন্নি আনছি। পুটি কইলো আপনারে লইয়া খাইবো।
খেতে খেতে পুটির বাড়ন্ত পেট দেখে বলি—কি?
চান্দু বলে—পুটি পোয়াতি। মানিক মামা কইছে, পোলা হইবো।
পুটি জানতে চায়—ভাই, পোলা ভালো, না মাইয়া ভালো?
যেটা হয়, সেটাই ভালো।
ঠিক কইছেন। চান্দু খালি পোলা পোলা করে।
কুকুরটা ঘেউ ঘেউ করে চান্দুকে শাসায়। চান্দু লাথি মারলে কুকুরটা দূরে গিয়ে বসে কুঁইকুঁই করে।
চান্দু বলে—পুটি পোয়াতি হওয়ার পর থেইকা কুত্তাডা আমারে সহ্য করতে পারেনা। এই কুত্তা গেলি, না পুলিশ ডাকমু!
আরেক বৃষ্টিভেজা রাতে বুশের দোকানে বসে চা খাচ্ছিলাম; কুকুরটা এসে দাঁড়ায়। আমি গেয়ে উঠি—একটি কালো কুকুর/ একখানা বেঞ্চ, নড়বড়ে…। কুকুরটা লেজ নাড়ে। আমি বলি—অরা কই? কুকুরটা আমার প্যান্ট কামড়ে ধরে টানে। আমি বলি—চল, যাই। আমরা যেমন ভাবি, সবার জীবন কী তেমন? যৌবন এলে আমরা সঙ্গি চাই; সন্তান এলে সংসার; বার্ধক্যে গোরেস্তান খুঁজি। পুটিকে জানার আগে ভাবতে পারিনি—জীবন নিজেই এইসব বৃত্তের বাইরে গিয়ে আরো মুক্ততা খুঁজে নিতে জানে! বহুদিন ধরে ভেবে আসছিলাম, জ্ঞানেই মুক্তি; জেনে-শুনে, যুক্তি-বুদ্ধিতে চলতে হয়। এখন দেখতেছি, জীবন চলে জীবনের নিয়মে। কালো কুকুরটা, যার পিঠের খানিকটা সাদা—কাউকে যাত্রি ছাউনির কাছে ঘেষতে দেয় না। চান্দুর দিকেও ঘেঁউ ঘেঁউ করে তেড়ে যায়। চান্দু দেখতে চায়, শিশুটি কেমন করে মাতৃস্তন চষে চুষে অস্তিত্বের জানান দিতেছে; কী আবেগে চাঁদের আলো শরীরে মাখছে মা ও শিশু। পুটি যে তা কাউকে বুঝতে দিতে চায় না, কালো কুকুরটাই তা জানতে পায়।
কুকুরটার অস্থিরতা দেখে পুটি বলে—এহানে বইয়া আছো ক্যান! যাও, খাওনের জোগাড় করো গিয়া।
আমি উঠে দাঁড়াই।কোলাহল থেমে গিয়ে শহরের গায়ে চাঁদের আলো ছড়িয়ে পড়ে। চান্দুর হাতেকিছু টাকা দিয়ে বলি—যা, ভাতওয়ালিগো কাছ থিকা খাওন লইয়া আয়। যেতে যেতে চান্দু কুকুরটার উপর রাগ দেখায়—খাড়া, আইতাছি; আমারে ঘেউয়াস! তোর ঠ্যাং আমি ভাইঙ্গা দিতাছি; সবাই তোরে কইবো, লুলা কুত্তা। কুকুরটা বসে থেকেই ঘেঁউ ঘেঁউ করে জবাব দেয়—বাচ্চা চুরি করবি! যা যা, আমি থাকতে পারবি না। রাস্তার মাঝখানে গিয়ে বলে উঠি—সাব্বাস। তারপর নেচে নেচে গেয়ে উঠি—আমি মানুষ, আমার কেনো পাখির মতো মন/ তাইরে নাইরে গেলো আমার সারাটি জীবন…। ছাউনির নিচে যে বুড়িটা বিড়ি খাচ্ছিলো, গানের মধ্যেই বলতে থাকে—বুঝছো নি বেডা, মাইয়াডা ভালো না; মাইনষের চাইতে কুত্তারে বেশি ভালো পায়। আমি জানতে চাই—তুমি কারে ভালো পাও, মা জননী? বুড়ি হাসে—মওলারে; মওলা পাগলারে। হি হি হি…।
শহর কারো নয়; তবু শহরেই থাকতে হয়। এই যে দালান-কোঠা—সব ছেড়ে ধনীরা নতুন শহরে চলে যেতে থাকে। আর এই শূন্যতার দখল নেওয়ার জন্য নতুন মধ্যবিত্তরা আন্দোলন গড়ে তোলে। যৌক্তিক ব্যস্ততায় পুটির কথা ভুলে যাই। চান্দুকে দেখি, আন্দোলনকারীদের কাছে গাঁজা বেচতেছে—আগের মতো ভোলাভালা না, চৌকশ লুম্পেনের ভঙ্গিতে। আমাকে দেখে সালাম দেয়। পুটির কথা জানতে চাইলে অবজ্ঞার ভঙ্গিতে বলে—কই থাকে কে জানে।
 
একলগে থাকস না?
আমার টাইম নাই, ভাই।
সময় এমন, আন্দোলনও শেষ হয়। আশাবাদী জনতা ব্যানার গুটিয়ে ঘরে ফেরে। পথের পাশে থেকে যাই আমি আর আশাহীন একফালি চাঁদ। সারারাত জেগে জেগে যখন পাঁপড়িতে পাথর গড়ায়, তখন মনে হয়, কেউ যেনো আমার মুখের উপর ঝুঁকে আছে। চোখ মেলে দেখি—কালো কুকুরটা আর শিশু কোলে পুটি। আমার সাড়া পেয়ে মিষ্টি হেসে বলে—ভাই!
আমি উঠে বসি। শিশুটিকে কোলে নিই। মেয়েটা বলে—মাজার থেইকা শিন্নি আনছি; খাইবেন আমাগো লগে?
রাত আসে রাত যায়। ভোরের আলো ফুটলে দেখি, কুকুরটা শিশুটির সাথে শুয়ে আছে। দুজনেই আলুথালু; হয়তো স্বপ্ন দেখতেছে। একটা ছেলে এসে বলে—এই পুটি ওঠ; চল যাই। পুটি ছেলেটার সাথে হাঁটা দেয়। আমার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হেসে বলে—অর নামও চান্দু। দূরন্ত ছেলেটা গলা উঁচু করে বলে—ভাই, আমিও পুটিরে ভালো পাই। সোনালী সকালে ওরা পার্কে ঢুকে ফুল কুড়াবে। আমি কি করে ওদের বাঁধা দিই!
 
++++++++++++++++++