You are currently viewing মনবাসিনী ।। শাদাত আমীন

মনবাসিনী ।। শাদাত আমীন

বরফগলা সকাল। কঠিন শীত নেমেছে এবার। জানালা খুললেই মেলে থাকা চোখের দৃষ্টিকে আলিঙ্গন
করে শাপলাচত্বর, শাপলা সিনেমা হল, এতটা কাছে। সেটাও দেখা যাচ্ছে না আজ।
মিমি কলেজে গেছে, কারমাইকেল কলেজে; যেটাকে বাবার দেশের লোকেরা ;লালবাগ গরুহাটী কলেজ
বলতো। অবশ্য যে ভুল বলতো, তা কিন্তু নয়! কলেজের পাঁচিল ঘেঁষে হাট; রবিবার, বুধবার- হাটবার।
আর ছেলেটা রংপুর মেডিকেল কলেজে পড়ছে, এবার চান্স পেল। এমন ভাগ্য খুব কম বাচ্চাদের হয় যে,
নিজের জেলাতেই পড়ার, বিশেষ করে মেডিকেলের ক্ষেত্রে। সে খেয়ালে ছেলেটার আমার কপাল ভালোই!

আচ্ছা, শীতের রাত এত লম্বা হয় কেন! বিচ্ছিরি লাগে। শরীরটা কেমন পোড়ায়! অথচ বৈবাহিক
বন্ধনসূত্রে পাওয়া স্বামীটা সেটা কিছুতেই বুঝতে পারে না; পাশ ফিরে শুয়ে থাকে। তখন কখনো-সখনো
সৈয়দ শামসুল হকের সেই কবিতাটা মনে পড়ে, ওই যে-

“আমি কার কাছে গিয়া জিগামু সে দুঃখ দ্যায় ক্যান,
ক্যান এত তপ্ত কথা কয়, ক্যান পাশ ফিরা শোয়”

জীবনের সাথে যেন মিলে গেছে কবিতাটা। কলেজে থাকতে আমি এই একটি কবিতাই যে কতবার আবৃত্তি
করেছি; তার হিসেব কষা কঠিন। এই কবিতাই এখন আমার জীবনের জাতীয় সঙ্গীত। হায় রে দুনিয়া!
কল্পনা কেমনে বাস্তব হয়! তাহলে কল্পনা করা কি পাপ? যার ফল বয়ে বেড়াতে হয় চিরকাল! তবে সব
কল্পনা বাস্তব হলে, আমার কাচ্চা-বাচ্চারা তাদের দাদি-দাদার মুখও দেখতে পেত।

প্রথম যেদিন ডান্স ক্লাবে জিতু আমাকে দেখলো, কেমন দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল ও। সে ভাষা আমি
বুঝতাম না, সেদিন বলা হয় নি জিতুকে। কেবলেই মনে হলো- এই তো একটা মুখ, এইতো একজোড়া ঠোঁট,
যে ঠোঁটে আমি নিশ্চিন্তে চুমু আঁকতে পারি।
জীবনে একজোড়া ঠোঁটেই চুমু আঁকতে হয়, দ্বিতীয় জোড়ায় চুমু আঁকা মানেই চরিত্রহীনতা? যদি
ভাগ্যরেখার হেরফের হয়! দ্বিতীয় জোড়ায় ঠোঁট রাখতেই হয়; তা হলেও কি চরিত্রহীনতা?

আমার সাজানো সংসারটা অগোছালো হয়ে যাবে, ধ্বংসের বাঁশি বাজবে, বুঝিনি। এটা যে হবে, তা
কল্পনাও করি নি। কারণ, মিমি আর সৌমিক কত বড় হয়েছে, ওদের দিকে তাকিয়ে হলেও এটা
অসম্ভব। কার মুখে কি শুনলো, নাকি সাবিনা ভাবি কিছু বললো; বুঝতে পারলাম না।
তাকে বাড়িতেই রেখে গিয়েছি, টিভি দেখছিল। ছেলেমেয়ে দুটো তাদের জায়গায়- কলেজে, মেডিকেলে।
আধা-ঘন্টা খানিকের মাথায় লালবাগ থেকে বাজার করে, ঘরে ঢুকেছি-

তুই চরিত্রহীনা, তোর জিতুর সাথে সম্পর্ক ছিল। তোকে আমি তালাক দিলাম- এক তালাক, দুই তালাক,
তিন তালাক…

চুপ করো, মিমির বাবা চুপ করো। কি বলো এসব!

খরচের ব্যাগটা হাত থেকে ফ্লোরে, সদ্য কেনা আলু-শিম-টমেটোগুলো প্রচন্ড ঝাঁকুনি পেল, ব্যাগের
ভিতরে। পায়ে পড়ে কত কান্নাকাটি করেছি, হাত জোড় করেছি, শোনে নি সেদিন। যেই মানুষটার জন্য
বাপ-মা ছেড়ে আছি, সে পর করলো!

বাবা সেইবার ইলেকশন করছেন, ইউপি চেয়ারম্যান পদের জন্য।
সে উপলক্ষে আমাদের গ্রামে নাট্যদল, নৃত্যশিল্পী আনলেন বাবা। রোজ সন্ধ্যাবেলা যারা নাচ-গানে
মাতায় গ্রামের মানুষদের; জায়গায় জায়গায় নির্বাচনী প্রচারণার অনুষ্ঠানের পর বাড়িতে ফেরা
মানুষদের জন্য বাড়তি আনন্দ। নৃত্যশিল্পী হিসেবে এসেছিল আখতারুল নামে একজন।

এল প্যাটার্নের আধপাকা প্রকান্ড বাড়ি। বাবা প্রচারণায় বেরিয়েছেন, মা-ও বেরিয়েছে বাবার সাথে।
নাট্যদলের সবাই একটু বাজারের দিক গেছে। বাড়িতে ভোলার মা, আমি আর সেই আখতারুল।

পড়ন্ত বিকেল। বাড়িটা এখন অনেকটা সুনসান।
আমার পাশের ঘরটাতেই ভাতঘুম দিয়েছে আখতারুল। আমার মাথায় আবার কি যে ভূত চেপেছে, নাচ
শিখবো। ভাবলাম জেগে আছে কিনা দেখি, নিজের ইচ্ছের কথা বলি তাকে।

নির্ভয়ে ঘরে ঢুকলাম, আস্তে আস্তে। দেখি, শুয়ে আছে। তার মাথার কাছে বসলাম। বাহ! কি মায়াভরা
মুখটা! কত স্মার্টভাবে কথা বলে, কি সুন্দর নাচে! গতকাল স্কুল মাঠে প্রাকটিস করার সময় দেখেছি।

আমি দুষ্টামি করে টেবিলে রাখা পানির গ্লাসটা থেকে পানি নিয়ে, আখতারুলের মুখে ছুড়লাম, একটু;
ভয়ে চমকে উঠলো সে!
ভাগ্যিস ভোলার মা বাড়ির পেছনের পুকুরপাড়ের দিক ছিল! আখতারুল চিৎকার করতে যাবে- অমনি
আমি তার মুখ চেপে ধরলাম। জীবনে প্রথম কোনো পুরুষেকে ছুঁইলাম। সে উঠে বসতে চেষ্টা করলো; হাত
সরিয়ে নিলাম আমি, তার মুখ থেকে। চলে আসব- ঠিক, ঐ সময় হাতটা আস্তে করে চেপে ধরল
আখতারুল। লজ্জা লাগছে ভীষণ!

তারপর…. নাচ শেখানোর নাম করে, দরজা বন্ধ করে..
আর বলতে পাচ্ছি না! কারণ, জীবনের প্রথম ভালো লাগার পুরুষ এই রকম স্মৃতি উপহার দেবে, ভাবি
নি। হ্যাঁ, প্রশ্ন আসতে পারে চিৎকার কেন করি নি? চিৎকার করার সুযোগ কি ছিল? চিৎকার করতে
চেয়েছিলাম, আমার গলা টিপে ধরেছিল। বুকটা তছনছ করে দিয়েছে সেদিন, ইচ্ছে মতো হাত চালাচ্ছিল
বুকে। দম বন্ধ হবার উপক্রম…

এ ঘটনার একমাত্র সাক্ষী ভোলার মা। ও তো চিৎকার করতেও পাচ্ছে না! লোক জানাজানি হলে এ
বংশের মান শেষ হবে- এই ভয়ে। এই ভোলার মায়েই আমাকে স্কুল নিয়ে যাওয়া-আসা করতো। কত
আদর করতো!

ভোলার মা কোনো মতে ঘরে ঢুকতেই, আখতারুল নিজেকে সামলে বেরিয়ে পড়লো ঘর থেকে।

ঐ খানকির ব্যাটা, কই যাস! খাড়া!

না, ভোলার মা তাকে ধরতে পারে নি, পালিয়েছে ও।
আশপাশে লোকেদের বাড়ি নেই বললে চলে, আছে কিছু দূরে দূরে। আমাদের বাড়ির আশপাশে খালি পুকুর
আর বাঁশঝাড়। বাড়ির পাশে বিশাল বাঁশঝাড়, এটা গিয়ে লেগেছে স্কুলের পাশের রাস্তায়; কোনো মতে
বাঁশঝাড় পেরুতে পারলেই- পগার পার! কে চেনে! চিনলেও ভাববে, বোধ হয় চা-পান খেতে যাচ্ছে বাজারে।

ছেড়া কামিজটা লুকিয়ে ফেলা, জঘন্য লীলার ঘরটাকে ঠিক করে রাখা, সব কাজ করেছে ভোলার মা।
আমার ঘরের বিছানায় আমাকে শুয়ে দিলো সে। আমার চোখ দিয়ে পানি ঝরছে। বুকটা কেমন জ্বলছে,
চিরে গ্যাছে দু’এক জায়গায়, মনে হয়। ভোলার মা চোখ মুছতে মুছতে ঘর ছেড়ে বের হলো।

সন্ধ্যা হয়ে আসছে। বাবা মা ফিরলেন। জানোয়ারটা সত্যি পালিয়েছে।
ভোলার মা, আমার মাকে ফিসফিসিয়ে বললো: ভাবি, বেটির মনে হয় স্রাব হইচে, পোথথোম পোথথোম
তো! জ্বলা-যনতোনা কইরবার ধচ্চিল। মুই অসুদ আনি খিলি দিচো। শুতি আচে, উয়ার কাচে যাবার
দরকার নাই।

আমি ঘুমের ভান করে সব শুনছি, কাঁথার নিচ থেকে।

আচ্ছা, তুই তাহলে ওর সাথেই থাকিস রাতে, খেয়াল রাখিস। কিছুক্ষণ পর আমরা দক্ষিণপাড়ায় যাব,
তোর সাহেবও যাবেন। ফিরতে ফিরতে অনেক রাত।

বাবা ব্যস্ত থাকায় খেয়াল করেন নি; বাবা অস্থির তার গুণধর ভাড়াটে নৃত্যশিল্পীর জন্য।

বিরোধীদলের চেলাদের হুমকির মুখেই কি আখতারুল পালিয়েছে? -এমনটাই ভাবছে সবাই। বাবা বললেন:
আমার খাসা দুই হাজার টাকা গেল রে!

বাবা সেইবার হেরে গেলেন। বাবা ভেঙে পড়েছেন। বড়ভাইয়েরা ইংল্যান্ডে, দেশে যে আসবে সে সুযোগ
সহজে হয় না।
বাবা আর যেন নির্বাচন করতে না দ্যাখি আপনাকে; কি দিয়েছে নির্বাচন: ফোনে রাগ নিয়ে বললো
কথাগুলো, ভাইয়েরা।

রাগে জ্বলছি আমিও, এই রাগে আমি কেমন করে শীতল হই! এই একটা কারণে সবাই আমাকে ভয় পেত,
সেটা হলো- জেদ। জেদ চাপলে কারো সাধ্য ছিল না আমাকে আটকায়। ভাইদের বলে দিলাম: ক্লাশ এইট,
এই গ্রামে পড়ছি না আমি! রংপুরে পড়ব। স্ট্রেটকার্ট বললাম কিন্তু! নো চান্স টু চেঞ্জ ইট।

কেরানিপাড়া।
শীতের সকাল। মিষ্টি রোদ ছুঁয়ে যাচ্ছে।

হন্নে হয়ে খুঁজলাম আখতারুলকে, পেলামও দু'মাস খুঁজে; পাবলিক লাইব্রেরির মাঠে। কিন্তু না চেনার
ভান করলো সে। আমাকে দেখে যেন আকাশ থেকে মাটিতে পড়লো। আমিও ছাড়ার পাত্রী নই। উচ্চ
মাধ্যমিক অবধি পড়ার পাশাপাশি ডান্স শিখলাম। হ্যাঁ, ওরই ডান্স ক্লাবে।
জীবনের প্রথম পছন্দের পুরুষকে স্বামী হিসেবে পেতে কার না ইচ্ছে থাকে! আমারও ছিল।
তবে বাবা মা কেউ রাজি ছিলেন না, ভাইয়েরাও না। আর সে-ও তো অনেক ঝামেলা করছে, তাই তো জিতুর
সাথে মিশতে চেয়েছিলাম; ও-কে ক্ষ্যাপানোর জন্য, দেখানোর জন্য। কেরানিপাড়ায় মামা বাসায় থেকেই
উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করেছি, অনার্স ভর্তি হয়ে বিয়ে।

বিয়ের আগে পর্যন্ত আমি তিনটা টিউশনি করাতাম, সে সময়ে। তিনটা মিলে তিনশ টাকা পেতাম; নিজের
যৎসামান্য প্রসাধনী, টুকিটাকি খরচ, পড়ার বই- সব ওই টাকা দিয়েই ম্যানেজ করতাম; ম্যানেজ হত
না, তবুও করে নিতে হত। মামীটা ভালোই ছিল, রোজ দুইবেলা খেতে দিত, আরেক বেলা না খাইয়ে রাখত;
বেশ তাই না?

শালবন মিস্ত্রীপাড়া।
দোচালা বাড়ির মধ্যবিত্ত উঠোনটায় লাগানো আম্রপলি গাছটায় মুকুল এসেছে। রক্তগাঁদার গাছটা
একটুখানি নেতিয়ে পড়েছে, মিমি লাগিয়েছিল শীতে।

আজ কত বছর হয়ে গেল; অথচ সাবিনা ভাবির কোনো খবর নাই! স্বামী হারিয়ে মানসিক রোগে ভুগছিল
সে। তার বাবা-মা নিয়ে গেলেন বাড়িতে, চিকিৎসা করানোর কথা বলে। আর কই ফিরে আসলো দিদি!
আমার জন্য আজ কত্ত আনন্দের দিন! দিদি থাকলে খুব খুশি হত। মিমি আর সৌমিক- আগামী সপ্তাহে
অস্ট্রেলিয়া যাচ্ছে; সরকারি খরচে। মিমি যাচ্ছে পলিটিক্যাল সায়েন্সে ছ’মাসের একটা কোর্স করতে;
আর সৌমিক পি.এইচ.ডি. করতে। ভাবছি ওদের এবার লেখাপড়ার পার্টটা চুকে গেলে বিয়ে দিয়েই দেবো।
বয়স তো কম হলো না, ওদের।

মানুষটাকে ছাড়া কি সুখের দিন গেছে সেটা আর কত বলি! বাবা বিছানায় পড়েছেন, মা-ও অনেক দূর্বল
হয়ে গেছে; ভাইয়েরা খোঁজ নেন না। কিছু জমি, দুটো পুকুর বর্গা দিয়ে-যা আসে তা দিয়ে মা-বাবার দিব্যি
চলে। রমেশ কাকুর সাথে সেদিন সিটি মার্কেটে দেখা হলো; কেমন বুড়ো বুড়ো ভাব চলে এসেছে চেহারায়।
তার কাছেই বাবা-মার খবর শুনলাম।

মিমি, সৌমিকদের একটা বড় কষ্ট- নানা, নানিকে দেখলো না তারা। অনেক বছর তো হলো, নিজেও সেই
কত বছর থেকে বাপের মুখ দেখি না, মায়ের কোলে মাথা রাখি না; যাবো নাকি ওদের নিয়ে! রাগ কত পুষে
রাখি?
ছেলে-মেয়ে দুটো জীবনে অনেক কিছুই পায় নি। কত কি খেতে চাইতো, ফ্রেন্ডদের সাথে ট্যুরে যেতে
চাইতো, কিন্তু শেষ অবধি যাওয়া হত না। নিজেরা টিউশন করিয়ে টুকটাক নিজের খরচাপাতি চালাতো।
একটা বেসরকারি স্কুলে পড়িয়ে যা পাই; তা দিয়েই এই ভাড়াবাড়িতে থাকছি, ওদের নিয়ে। চেয়েচিন্তে
চলতে হয় প্রায়শ, তবু বাবার কাছে যাওয়া হয় না।

মা, বাবাও কিন্তু কম নয়। মা হয়তো আমার জন্য কাঁদে, খুব কাঁদে! সে কান্নার কোনো ভ্যালু নিশ্চয়ই
দেন নি বাবা! দিলে মা ঠিক আমাকে খুঁজতো, এখানে আসতো। আর মামা- সে তো আমার বিয়ের আগেই
পৃথিবীকে গুড বাই বলে দিয়েছেন; হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে। মামী তো মামার লোকান্তরে চল্লিশ
দিনের মাথায় বাবার বাড়ি গেছে, আর ফেরে নি; ফিরেই বা কি হবে! ছেলেপুলেও তো নেই; একটা মেয়ে
দুবছর বয়সে নেকমরদের মেলায় হারিয়ে গেল, বড় ছেলেটা কোন ফটকাবাজ মেয়ের পাল্লায় পড়লো;
মেয়েটাকে নিয়ে পালালো আর কোনো খবর নেই; বোধ হয় বিয়ে-শাদি করেছে।

ছেলে মেয়েগুলোর মুখের দিকে তাকিয়ে, আখতারুলের প্রিয় সেই স্মৃতিমাখা বাড়িটা ছাড়তে হয়েছে
আমাকে। মিস্ত্রীপাড়ায় এসে উঠতে হয়েছে এই বাড়িতে। কতবার বাড়ি করতে চাইলো ওরা, কিন্তু করা
হয় না। তবে এবার বানাতেই হবে, ওদের জন্য।

আচ্ছা, মিমির বাবা কোথায় আজ?.আমার কথা কি একটা বারও মনে ওঠে না! আমি তো একজোড়া
ঠোঁটেই চুমু এঁকেছি, অথচ সে বুঝলো না! নিশ্চিত আর একটা বউ পেয়েছে, যে তার চাহিদার রাতের
উপযোগ মেটায়; ভেজা চুলে ঘুম ভাঙায় হয়তো!

২.
গত পরশু রংপুর টাউন থেকে ফেরার পথে, কুড়িয়ে পাওয়া এই ডায়েরিটা নতুন নয়, পুরনো; নৃত্যশিল্পী
জপিদ খানের কাছে। চোখের পানি ঝরছে, দু’গাল বেয়ে। ডায়েরিটার শেষে লেখা: ০৫-১১-১৯; আর আজ
০৯-১২-১৯। তার মানে.. ওই অনুষ্ঠানে সে এসেছিল, বেঁচে আছে এখনো।
এটা জপিদের প্রথম স্ত্রীর লেখা ডায়েরি। অংশুর ডায়েরি।

সেদিন অংশু বাজারে গিয়েছিল জপিদ। অংশুর শোবার ঘরের টেবিলে পড়েছিল ডায়েরিটা; পড়লো জপিদ।
সংকীর্ণ মনে সন্দেহ জন্মালো, মাথায় আগুন উঠলো- ব্যস! মুখের উপরে তালাক! কতটা বোকামি
করেছে জপদি, কতটা জঘন্য মানুষের পরিচয় দিয়েছে অংশুর কাছে- এখন বুঝতে পাচ্ছে। আচ্ছা, ফিরে
যাবে ওর কাছে! না, কোন মুখ নিয়ে যাবে?

যে মেয়ে সেই ছোট্টবেলায়, তার সাথে ঘটে যাওয়া নোংরা স্মৃতিকে মনে চেপে ধরে, আবেগের বশবর্তী
হয়েছে; নিজের সাথে স্ট্রাগল করে, বাপ-মা, ভাইদের ছেড়ে, শত অপমান সহ্য করে- এই অমানুষটাকে
অবলম্বন করে বাঁচতে চেয়েছিল; সেই মহতী রমণী অংশুর সামনে কিভাবে দাঁড়াবে জপিদ? আর অনাদরে,
চেয়েচিন্তে, খেয়ে, না খেয়ে বেড়ে ওঠা ছেলেমেয়েগুলো! ওদের কি জবাব দেবে? ফিরে যাবার কি আসলেই
রাস্তা খোলা আছে?

বাইশ হাজার টাকায় কেনা কড়াই কাঠের দৃষ্টিনন্দন বিছানায় পাশ ফিরে শুয়ে আছে রাইসা, শুধু আজ
নয়; বিয়ের পর থেকে গত দশটা বছর! প্রায়শ ওইভাবে শোয়- জপিদের দ্বিতীয় স্ত্রী। কোনো ছেলেপুলে
হয় নি রাইসার; সমস্যাটা বউয়ের, ডাক্তার বলেছেন।

বাবা-মায়ের কথায় অসম্মতি জানানোর পথ ছিল না; বাধ্য হয়ে স্বামীপরিত্যক্তা রাইসাকে তাই বিয়ে
করতে হয়েছে জপিদের। বিয়ে-ই করা হয়েছে; কিন্তু, মনে তো অংশু-ই বাস করে, ওর জন্য চোখ জোড়া
ভেজে কত রাত, সে কথা কি অংশু জানে?