You are currently viewing মধুবন রিসোর্ট /  শারমিন সাথী

মধুবন রিসোর্ট /  শারমিন সাথী

মধুবন রিসোর্ট

 শারমিন সাথী

রেবা সাহা সমাজবিজ্ঞান বিভাগে ইডেনে প্রথম বর্ষে পড়ছে। রেবার বাবা রিতেশ সাহা গতবছর স্ট্রোক করে মারা গেছেন। বক্ষব্যাধি হাসপাতালে ডাক্তারদের রোগীদের অপেক্ষমান তালিকা তৈরি করতো। হয়তো রোগীদের দেখতে দেখতে তার কখন হাইপ্রেশার হয়ে গিয়েছিল, টের পাইনি। প্রায়ই বলতো মাথা ব্যাথা করছে। কিন্তু, ডাক্তারদের সাথে থেকেও ডাক্তার দেখানোর প্রয়োজন মনে করতো না।

এখন সংসারে মা আর ছোট ভাই। ছোট ভাই ক্লাস নাইনে পড়ে। বাবার যে পেনশনের টাকা তাতে রেবার ছোট ভাই অনিকের লেখাপড়া চালানো মুশকিল হয়ে পড়ছিল। রেবা মনে মনে সিদ্ধান্ত নেয় লেখাপড়া চালানোর জন্য দু একটা টিউশনি করাবে। কিন্তু, এই করোনার মধ্যে টিউশনিও পাচ্ছে না। পেলেও এক দু হাজার টাকার বেশি কেউ দিতে চায় না। করোনায় মানুষের আর্থিক অবস্থা ভালো যাচ্ছে না। সন্তানের লেখাপড়া চালানোও কঠিন হয়ে গেছে। অনলাইন ক্লাস এ সন্তুষ্টিও নেই অনেক বাবা মায়ের। বাসায় যতটুকু নিজেরাই সময় করে একটু দেখায়।

তিতলির সাথে একদিন নীলক্ষেতে বই কিনতে গেছে। বইয়ের দাম হলো ৫৬০ টাকা। রেবার কাছে ছিল ৫০০ টাকা। সলজ্জে তিতলির দিকে তাকালো রেবা। বললো, তিতলি, ৬০ টাকা শর্ট পড়েছে। তোর কাছে থাকলে যদি দিতি, খুব উপকার হতো। বইগুলো কিনতে পারতাম। আরে, আছে। এতো অনুনয় করে বলতে হবে না। তুই তো শুধু আমার ক্লাসমেট না। রুমমেটও। তোর প্রতি আমার একটা দায়িত্ব আছে না? ব্যাগ থেকে ৫০০ টাকার একটা নোট বের করে রেবার হাতে দিল তিতলি।

হোস্টেলে ফেরার পথে তিতলি রেবাকে বললো, রাতে তোর সাথে কথা বলবো। কী বিষয়ে, কিছুটা অন্যমনষ্ক হয়ে প্রশ্ন করলো রেবা। আরে রাতেই বলবো, বলে তিতলির রহস্যময় হাসি হেসে রেবাকে হাত দিয়ে টেনে কিছুটা কাছে টেনে নিল, যতটা কাছে নিলে শরীরের সাথে শরীর লাগলে, নীরবতার ভাষা বোঝার ক্ষমতা অর্জন করা যায়। রেবার কিছুটা অস্বস্তি লাগলেও কিছু বললো না।

রাতে পাশাপাশি বিছানায় শুয়ে আছে দুজন। এই রেবা ঘুমিয়ে পড়লি?

না, ঘুমাইনি। তোকে যে কথা বলতে চেয়েছিলাম, শোন, আগামীকাল তো শুক্রবার। আমাদের ক্লাস নেই। আমি এক জায়গায় যাবো। তোকে নিয়ে যাবো। রেবা ঘুম ঘুম চোখে স্বাভাবিকভাবে জিগ্যেস করলো, কোথায়? তিতলি বললো, এতো জানার দরকার কী? গেলেই জানতে পারবি। কথা না বাড়িয়ে অভাবের ভারে ন্যুব্জ শরীরটা নরম করে ঘুমোলো রেবা।

পরের দিন সকাল বেলা টার্মিনালে গেল দুজন। এই তিতলি এটাতো নারায়ণগঞ্জে যাবার টার্মিনালে নিয়ে এলি। কেন? আমরা কই যাবো? তিতলি আত্নবিশ্বাসী হয়ে বললো,  হ্যা, আমরা নারায়ণগঞ্জে যাবো। ওখানে এক ম্যাডামের সাথে দেখা করবো। উনি ওখানে ব্যবসা করেন। হরেক রকমের ব্যবসা। ওখানে আমি একটা চাকরি পেয়েছি। ওনার সাথে কথা বলে দেখি তোর একটা চাকরির ব্যবস্থা করা যায় কিনা। কী বলিস? এতো দূরে!  ঢাকা থেকে এখানে এসে চাকরি করা অসম্ভব, রেবা বলে। এখানে তো প্রতিদিন আসতে হয় নারে পাগল। মাঝে মাঝে। রেবা ভ্রু কুঁচকে জিগ্যেস করে, মানে কী? শোন, তোর না টাকার প্রয়োজন। লেখাপড়া শেষ করতে হবে না? এইটা সবাই জানলে সমস্যা। কারণ, এই ব্যবসা করলে মানুষ খারাপ বলে। কিন্তু, গোপনে করলে তো কোনো সমস্যা নেই। আর এটা কেউ জানতে পারবে না। ঢাকার বাইরে খুব নিরাপদ জায়গা। তিতলি খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বলে। শুনে রেবার শরীর বেয়ে শীতল ঘাম ঝরে। কী বলিস তিতলি! তুই, ছিঃ আমি ভাবতেই পারছি না। তুই আমাকে দেহ মানে দেহ ব্যবসার কথা বলছিস! আরে এখন তো সময় খারাপ, কোনো কাজ তো পাচ্ছি না। সেজন্য, সাময়িকভাবে করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত বা অন্য কোনো ভালো চাকরি না হওয়া পর্যন্ত তো করা যায়। আমাদের এখান থেকে আরও কয়েকজন যায়। এমনকি টাকাওয়ালা বাপের মেয়েরাও যায়। আর আমাদের তো টাকা নেই। ওরা তো এসবকে কিছুই মনে করে না। আর আমরা তো বিপদে পড়ে যাচ্ছি। তোকে জোর করবো না। ভেবে দ্যাখ।

সারারাত কী ভাবলো রেবা কে জানে। তেমন ঘুম হলো না। এক ঘণ্টা ঘুমিয়ে ভোর ছয়টায় উঠে পড়লো রেবা। জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকালো। গাছের মাথায় গজিয়ে ওঠা কচি পাতাগুলোর দিকে তাকালো। মনে মনে ভাবলো, গাছ হয়ে জন্মালে আজ ওই কচি পাতা আমার শরীর থেকে উঁকি দিতো। পাখি হয়ে জন্মালে ওই গাছের ডালে বসতাম। যার যেমন জন্ম তার তেমন কর্ম। কর্ম তো দূরে থাক পুরো জীবকুলই তো অস্থায়ী এই পৃথিবীতে। আরও মনে হলো,  প্রয়োজন আইন মানে না। তারপর, তিতলিকে বললো, শোন, আমি যাবো। কখন বের হবো? তিতলি ওখানে কয়েকদিন গিয়েই কেমন বদলে গেছে। ওর কথা, চিন্তা বড় মানুষকেও হার মানায়। বিজ্ঞের মতো করে বললো, গুড। জীবনকে, জীবনের প্রয়োজনকে বোঝার জন্য ধন্যবাদ।

একটা মোটামুটি বড় জয়াগার একদিকে বেশ কৃত্রিম নানারকম ফুলের এবং লতাগুল্মের গাছপালায় ঘেরা পুকুর দেখতে পেলো রেবা। পুকুরের চারদিকে চারটা বাশ ও কাঠের তৈরি ছোট চারটা ঘর মাটি থেকে বেশ খানিকটা উপরে দাঁড়িয়ে আছে মনে হচ্ছে যেন বেহুলা লখিন্দরের ঘর। পাশেই একটা বড় সাদা রঙের দোতলা বিল্ডিং। বিল্ডিংয়ের দোতলায় উঠে পড়লো দুজন। দরজা খুলে দিলো এক কিশোরী। ম্যাডাম আছে?  আসার আগে ফোনে কথা হয়েছে দুবার, একবার রওনা দেবার সময়, আরেকবার আধা ঘণ্টা আগে। তবুও ভদ্রতা দেখাতে জিগ্যেস করা।

জ্বি, আছে। আসুন। ভেতরে আসুন।

সোফায় দুজন বসলো। তিতলি এবার রেবাকে বলে, তুই মাথা ঠান্ডা রাখ। ম্যাডাম খুব ভালো। মানুষ বুঝে, শ্রেণি বুঝে খদ্দের ঠিক করে। তার বোঝার ক্ষমতা অসীম।

ম্যাডাম একটু পরে প্রায় বিশ ফিট লম্বা রুমটার এক কোনায় রাখা চেয়ার-টেবিলের চেয়ারটায় গিয়ে বসলো। তিতলি এগিয়ে গিয়ে সালাম দিয়ে বললো, ম্যাডাম, ওর কথাই বলছিলাম। ম্যাডাম মাথা থেকে পা পর্যন্ত একবার চোখ বুলিয়ে প্রশ্ন করলো, ভয় পাচ্ছো? ভয়ে স্নায়ুতন্ত্র সজাগ হয়ে আছে,  তবুও রেবা বলে, না, আমি ঠিক আছি। রেবার চোখের দিকে অভয় দেবার আশ্বাস নিয়ে তাকিয়ে ম্যাডাম বলে, গুড গার্ল!

প্রথম দিন। রেবার প্রথম যৌনকর্মী হিসেবে কাজ করবার দিন। কাস্টমার এসেছে কোথা থেকে তার নাম পরিচয় কিছু জানা যায় নি। এখানে ছদ্ম নামেই সবাই আসে। ছেলেটা তার ছদ্ম নাম বললো, তারেক। ওর আসল নাম পল্লব। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফিজিক্সে মাস্টার্স শেষ করে বিসিএস এর জন্য পড়ছে। বছর খানেক ওর এক সহপাঠী মেয়ের সাথে সম্পর্ক ছিল। হঠাৎ করে মেয়েটি একদিন বলে বসে, বাবা তার বন্ধুর ছেলের সাথে ওর বিয়ে ঠিক করেছে। মেয়েটিও ওর সহপাঠীর কথা বলতে পারেনি। মাত্র পাশ করে বেরিয়েছে। কোনো জব করে না। কোন মুখে বলবে। পল্লবকে ছেড়ে যুথি সেই বাবার পছন্দের ছেলেকে বিয়ে করলো। পল্লবের লেখাপড়া হচ্ছে না এসব কারণে। এর মধ্যে পর্ণ আসক্তি তৈরি হলো। নেশার মতো করে দেখলো প্রায় দুই মাস। এরপর আর ভালো লাগে না নেশা কেটে গেল। মনে হতে লাগলো সত্যিকারের রক্ত-মাংসের মেয়ে মানুষ চাই। কোথায় পাব? প্রেম আর করবে না বলে কসম কেটেছে। হঠাৎ করে এক সিনিয়র ভাইয়ের সাথে এসব বিষয় নিয়ে কথা বলতে গেলে সে পল্লবকে নারায়ণগঞ্জের এই মধুবন রিসোর্টের ঠিকানাটি দিল। রিসোর্টির চারটি সুশোভিত ঘরের একটি ঘর বিশেষ কাজের জন্য রাখা হয়েছে। বাকিগুলো সাধারণ মানুষের জন্য।

ম্যাডাম তারেককে বললো, পুকুর পাড়ের  চার নম্বর কাঠের ঘরটিতে যান। বয়সে জুনিয়রদেরও সম্মান করে আপনি বলে ম্যাডাম। বেশ শিক্ষিত এবং চোখ দেখেই মনে হয় নারী হিসেবে বেশ সাবধানী সে। কথা শুনলে তাকে সাইকোলজিস্ট বলে ভ্রম হতে পারে।

তারেক বেশ কিছুটা সংকোচ নিয়ে পুকুরের কিনারা দিয়ে হেঁটে হেঁটে কাঠের সিড়ি বেয়ে উঠে গেল চার নম্বর লেখা ঘরটিতে। রেবা অন্য যৌনকর্মীদের মতো এগিয়ে এসে অভ্যর্থণা জানালো না। বসে রয়েছে খাটের এক কোণে হেলাল দিয়ে। তারেক পাশে গিয়ে বসলো। তারেকের কেন যেন মনে হতে লাগলো এই মেয়েকে আমি চিনি। তারেকের নিঃশ্বাসের চারপাশ দিয়ে ঘুরে বেরিয়েছে বহুদিন। ছোটবেলায় কি পরিচয় হয়েছিল কোথাও। এসব ভাবতে ভাবতে তারেক এক নতুন অনুভূতির মধ্য দিয়ে গেল। ও এখন ভাবতে লাগলো, এই মেয়েটিকে জোর করে তারেকের সাথে বিয়ে দেয়া হয়েছে। কোনো কথা জিগ্যেস করার তাগিদ পাচ্ছে না। ওর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ার ইচ্ছেও জাগছে না। তবে, একটা মায়া কাজ করছে। মনে হচ্ছে মেয়েটা বিপদে পড়ে এখানে এসেছে। কীসের বিপদ, কীভাবে এলো তাও জানতে ইচ্ছে করছে না। শুধু মনে হতে লাগলো, ওকে একটু আদর করে দেই। কপালে গালে চুমু দেই। হাত ধরে বসে থাকি।

ওর সাথে সেক্স করতে ইচ্ছে করছে কিন্তু ইচ্ছেটা কোথায় গিয়ে যেন গোল পাঁকিয়ে যাচ্ছে, এমনকি ওর সুডৌল স্তনে হাত রাখার ইচ্ছেটাকেও প্রশ্রয় দিল না।  তারেক একটু পরে রেবাকে বললো, তোমার ভয়ের কোনো কারণ নেই। আমি যদি তোমাকে আমার বুকের মাঝে নিয়ে একটু আদর করতে চাই, তোমার কি আপত্তি আছে?  ছেলেটির এমন প্রশ্ন শুনে রেবার যেন বাস্তব জগতে ফিরে এলো। ছেলেটার দিকে এবার চোখ তুলে তাকালো। ওর চোখ দেখে রেবার মনে হলো, সেও কি ওর মতো বিপদে পড়ে এখানে এসেছে? পর মূহুর্তে ভাবলো, ছেলেরা তো বিপদে পড়ে নয়, বরং বিনোদন করতে, তীব্র যৌন ক্ষুধা মেটাতে এখানে আসে। তবে, তাই যদি হয় ছেলেটি এমন অদ্ভুতভাবে এসব বলছে কেন? ছেলেটি কি খুব চেনা কাছের কেউ? পল্লব রেবার বাম হাতটা ধরে বুকের ডানপাশে শরীরের সাথে ওকে টেনে নিল। নতুন প্রণয়ের সম্পর্কে মানুষ যেভাবে কিছুটা আড়ষ্ট হয়ে যায় প্রেমিকের স্পর্শে রেবাও কিছু না বলে তেমন আড়ষ্ট হয়ে রইলো। পল্লব আরো একটু ঘনিষ্ঠ হয়ে বসলো। রেবার ডান গালে ওর বাম হাতে আলতো বোলাতে বোলাতে বললো, তোমার শারীরিক সৌন্দর্য, চোখের ভাষা যেকোনো পুরুষের কাছে অপ্রতিরোধ্য। রেবার চোখের দৃষ্টি যেন পল্লবকে সম্মোহনের জালে জড়িয়ে রাখলো। একটু পরে বলে, আমি এই প্রথম এমন একটা জায়গায় এলাম। যতটুকু জানি, এখানকার মেয়েরা এমন হয় না। তারা অনেক প্রফেশনাল আচরণ করে। তুমি সম্ভবত প্রফেশনাল নও বা নতুন এসেছো এখানে। রেবা কপালের চুলগুলো পেছন দিকে সরাতে সরাতে বিমর্ষ কন্ঠে বললো, আমি আজই প্রথম এসেছি।পল্লবের চোখের সামনে হঠাৎ ওর এক্স গার্লফ্রেন্ডের মুখ ভেসে ওঠে। প্রথম যেদিন ওর গার্লফ্রেন্ডকে আদর করেছিল সেদিন যা বলেছিল আজও রেবাকে আদর করতে করতে সেই কথাগুলোই বলতে থাকে, কথাই মানুষের সাথে মানুষের সম্পর্ক টিকিয়ে রাখে। হোক সে ভালো কথা অথবা মন্দ কথা। ভালো কথা সম্পর্ক ভালো রাখে, খারাপ কথা সম্পর্ক খারাপ রাখে। আর স্পর্শ মানুষের সম্পর্ককে জীবন্ত রাখে। এসো, আমরা পরষ্পরকে স্পর্শ করে পৃথিবীতে আরো একটি গভীর প্রেমের চিহ্ন রেখে যাই।

আমার শুকিয়ে আসা জীবনস্রোতে, চাতক পাখির অপেক্ষমান ঠোঁটের কাছে বৃষ্টির জল হয়ে আমাকে জাগিয়ে তুলছে আবার নতুন করে তোমার স্পর্শ, রেবা। রেবার নমনীয় অথচ ভীতসন্ত্রস্ত চোখের দিকে তাকিয়ে পল্লব এবার বলে, Nothing is wrong in the world. Everything is a matter of perception.

বিশাল এক অপরাধ প্রবণতাকে গলায় জড়িয়ে রেবা সঙ্গমের কিছুপর মূহুর্তে বলে, আমার ভালো লাগছে না এখানে। আমি আর আসবো না। ওর চোখের জল টুপ টুপ করে পল্লবের প্যান্টের উপরে পড়তে থাকে। আমার টাকার দরকার নেই।

রিসোর্টের গেটে ঢোকার আগে প্রায় আধা কিলোমিটার পথ। চারপাশে প্রায় ফাঁকা। এই পথটা ইট বিছানো। রাস্তাটা ছোট বড় নানা ধরনের গাছপালায় আকীর্ণ হয়ে আছে। গাছের নিচে ঘাসের আবাস। সেখানে সন্ধ্যা হলেই নরনারীদের আনাগোনা শুরু হয়। প্রায় দশ বারো গজ দূরে দূরে তারা বসে যায়। তাদের পোশাকে বোঝা যায় তারা নিম্নবিত্ত থেকে শুরু করে প্রায় মধ্যবিত্ত ঘরের মানুষ। একটু রাত নামলেই সেখানেও শুরু হয়ে যায় সঙ্গম।

সঙ্গমের জন্য বিছানা প্রয়োজন কি?

সঙ্গমের জন্য প্রয়োজন দেহ। দুটো রক্ত-মাংসের দেহ। অরণ্যেও সম্ভব যদি থাকে উত্তেজনার মিছিল অলিতে-গলিতে এবেলা ওবেলা – ব্যাপার না। বাজারে কনডমের তো অভাব নেই। আবছা অন্ধকারে রাস্তার পাশ থেকে কনডেমের ভীড় ঠেলে উঠে আসে দুটো শরীর। মূহুর্তের মধ্যে কেউ কাউকে চেনে না। মনেই পড়ে না এইতো কিছুক্ষণ আগে নেকড়ের মতো দূর্লভ সব শারীরিক কসরত করে জলকে মেঘের রঙে সাজিয়েছে। পায়ের কাছে কতক্ষণ ঘেউ ঘেউ করতে থাকা কুকুরটাও মুখ ফিরিয়ে চলে গেছে তাদের প্রেমহীন মায়াহীন ঘর্মাক্ত শরীরের গন্ধ শুঁকে।

ওদিকে পাপ পাপ বলে চিৎকার করে কয়েকজনকে জড়ো করলো দুটো শালিক। ছিঃ এসবও দেখতে হয় নগরীতে!  আরেকজন বলে ওঠে, ছিঃ বলছেন কেন, বিছানায় পরিপাটি হয়ে করলে বুঝি পাপ নয়? মিষ্টতার অভিনয়ের চেয়ে কি সিক্ততার তীব্রতাই মধুর নয়?

শীৎকারকে চাপা দিতে আঙুল রাখে ঠোঁটের উপর পাছে বেজির দল প্যাচপ্যাচ করে ওঠে। তবুও শরীর ঠেলে বেরিয়ে আসে রোমন্থনের সুখ। হায়! এ কী এক সংক্রামক ব্যাধি! অসার বিষণ্ণ পাথরকেও জাগিয়ে তোলে উন্মাদনার ডামাডোলে।

সূর্য ডুবে যেতে থাকে মহাকালের কোলে। ফের দুজন, চারজন, ছয়জন, আটজন একটা নির্দিষ্ট দূরত্ব মেপে মেপে বসে যেতে থাকে পুরোনো কনডমের বিছানায় ঘাসের উপর। অন্ধকার তার দেয়াল তুলে আড়াল করে রাখে নগরীর এই সঙ্গমের বন্দরকে।

কাঠের ছোট ঘর থেকে রেবা প্রায় দৌঁড়ে সিড়ি বেয়ে নিচে নেমে পুকুর পেরিয়ে মধুবন রিসোর্টের বাইরে চলে এলো। রাতের বেলায় রাস্তার দুপাশে এমন খোলা জায়গায় নরনারীদের অবাধ মেলামেশা দেখে ওর বুক কাঁপতে থাকে।

তিতলি ওকে রেখে চলে গিয়েছিল। পল্লব ম্যাডামকে টাকা দিয়ে বেরিয়ে এসে রেবাকে পেলো না। কোথায় থাকে এই মেয়েটা কে জানে।

একদিন বিকেল বেলা টিএসসিতে আড্ডা দিচ্ছে রেবা, তিতলি এবং আরো কয়েকজন ছেলেমেয়ে। পল্লব পাশের একটা গ্রুপে আড্ডা দিচ্ছে। গল্প করতে করতে সামনের দিকে তাকাতেই হঠাৎ পল্লব রেবাকে দেখতে পেলো। পল্লব রেবাকে দেখে দিনের বেলায় আকাশে পূর্ণিমার চাঁদ দেখার মতো অবাক হলো।

কাছে গিয়ে হাত ইশারা করে ডাকলো রেবাকে। রেবা পল্লবকে দেখে ভয় পেয়ে আড়ষ্ট হয়ে গেল। বান্ধবীদেরকে বলে কিছুটা দূরে সরে একটু ফাঁকা জায়গায় গিয়ে দাঁড়ালো দুজন। রেবা বিস্ময়ভরা চোখে তাকিয়ে পল্লবকে জিগ্যেস করে, আপনি এখানে!  পল্লবেরও একই প্রশ্ন মনের মধ্যে উঁকি দিলেও রেবার প্রশ্নের উত্তরে হাজারো কথা এসে মনের আকাশে কিচিরমিচির শব্দে ভীর জমালো।

সত্য পরিচয়টা দেবে নাকি মিথ্যে বলবে ভেবে কিছুক্ষণ চুপ থেকে সত্যিটাই বলবে ঠিক করে। রেবাকে হারাতে চায় না পল্লব। ওই একটা দিনের একটা মায়া ওকে ঘিরে রেখেছে। মিথ্যে বললে কোনোদিন রেবা জানতে পারলে দূরে চলে যাবে। পল্লব বলে, আমার নাম পল্লব। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিজিক্স এ পড়ি। মাস্টার্সে। তিন মাস আগে আমার ব্রেক আপ হয়। তারপর পর্ণগ্রাফিতে আসক্তি বেড়ে যায় বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে। হঠাৎ এক বন্ধু আমাকে মধুবন রিসোর্টে নিয়ে যায়। তারপর কী হলো সেটুকু তোমার জানা। বিশ্বাস করো, সেদিন তুমি ওভাবে চলে আসার পর রিসোর্টে তোমার ঠিকানা জানতে চেয়ে না পেয়ে কত এদিকে সেদিকে খুঁজেছি তোমাকে। তোমার নামটা পর্যন্ত জানি না। রেবা বিশ্বাস করে পল্লবকে ওর সব কথা জানালো। কীভাবে কেন রিসোর্টে গেল। মধুবন রিসোর্টে গোপনে চারটা ঘরের একটাতে যৌনকর্মীদের দ্বারা উপার্জন চলছে। পল্লব রেবাকে বলে, আমরা কি বন্ধু হতে পারি? রেবা কিছু না বলে পল্লবের চোখের দিকে তাকিয়ে একটা আশ্রয় খোঁজার চেষ্টা করে। সেখানে কি সত্যিই কোনো নির্ভরতা আছে।

প্রত্যেকটা মানুষই তার নিজ জায়গা থেকে সমভাবে কখনো সুখে থাকে, কখনো দুঃখে থাকে। উঁচু জায়গার মানুষের কাছে মনে হতে পারে অপেক্ষাকৃত নিচু জায়গায় থাকা মানুষগুলো কত দুঃখে আছে। এটা ভুল। নিচু জায়গায় থাকা মানুষগুলোর তো উঁচু জায়গা সম্পর্কে কোনো ধারণাই নেই, দুঃখ বা আক্ষেপ থাকবে কী করে?  বরং, তাদের চাহিদা কম বলে দুঃখও কম। আমরা ভাবি, যাদের হাত-পা নেই তারা কত দুখী, আসলে তারাও চাই চাই করা মানুষগুলোর চেয়ে কম দুখী। পল্লবের এসব কথায় নিমেষে রেবার বুকের জমানো দুঃখটা সরে যেতে লাগলো। রেবার ডান হাতটা নিজের হাতের মুঠোয় পুরে পল্লব প্রায় ফিসফিস করে রেবার কানের কাছে মুখ রেখে বললো,  Sometimes peace is just in the air but sometimes it is hard to find even in diamonds.

রেবা নদী খুব ভালবাসে। পল্লব একদিন রেবাকে বালু নদীর তীরে নিয়ে যায়। ওখানে ছোট ছোট খাবারের ঘর। একটা ঘরে বসে আছে দুজন। পল্লব আবৃত্তির মতো করে একবার রেবার দিকে আরেকবার বালু নদীর দিকে তাকিয়ে বলে,

 

দিগন্ত বিছিয়ে রেখেছে রাশি রাশি পথ

তোমার হাঁটার জন্য, ওই দেখো,

কৃষ্ণচূড়ার ডাল নুইয়ে পড়েছে জলের উপর

তোমাকে আলিঙ্গন করতে বহু কৌশল রপ্ত করেছে

সে, লালিমার চাদরে জড়াবে বলে

প্রতীক্ষা আজন্মকালের। সাক্ষী হয়ে আছে  দুটো বিহঙ্গ।

 

জিগ্যেস করে দেখো,

পাথরে পাথর ঘষে আগুন জ্বালানোর যুগ পেরিয়ে গেছে,

তবুও সে তার লাল রঙ ধারণ করে আছে

তোমাকে রাঙাবে বলে।

অন্তহীন প্রেমের সমুদ্রে ভাসানোর কত কী আয়োজন।

 

ওইখানে একটা নদী, তুমি তো নদী পছন্দ করো

নদীর স্বচ্ছ জলে প্রতিবিম্বিত হয়ে ফিরে আসে প্রেম।

ওগো নিনাদিত প্রেম, বাসরের আগুন মেখে কেন দূরে থাকো।

তোমার যৌবন পুড়িয়ে শান্ত জলের নদী হয়ে যাও।

 

কখনো কখনো জীবন ভাবনার চেয়ে সুন্দর হয় তোমার সাথে না চললে আমি বুঝতাম না পল্লব, এই বলে রেবা দ্বিতীয়বারের মতো পল্লবের সাথে মধুবন রিসোর্টের এক নম্বর কাঠের ঘরটিতে মিলনের সবচেয়ে গভীর আনন্দময় মধুময় মূহুর্তটি কাটালো।