ভেড়ার পা
মূল গল্প: রোয়াল্ড ডাল
অনুবাদ: মনিজা রহমান
ঘরটা বেশ উষ্ণ ও পরিস্কার। জানালায় ভারী পর্দা টানা আছে। দুটি টেবিল ল্যাম্প জ্বলছে। টেবিলের অপরপাশে একটা খালি চেয়ার পড়ে আছে। টেবিলের পাশে সাইডবোর্ডে দুটি লম্বা গ্লাস, সোডা, হুইস্কি ও বরফকুচি রাখা।
মেরি মালোনি তার স্বামীর কাজ থেকে ফেরার অপেক্ষা করছিল।
বারবার ঘড়ির দিকে তাকিয়ে সময় দেখছিল ও। তবে কোন দুশ্চিন্তা ছিল না ওর মধ্যে। বরং ও খুশীতে ডগমগ হয়ে ভাবছিল, ঘড়ির কাঁটা যত এগোচ্ছে ওর স্বামীর আসার ক্ষণ তত কাছে চলে আসছে।
হাসিমুখে সেলাই করছিল মেরি। সন্তানসম্ভবা ও। আর তিন মাস পরে সন্তানের জন্ম দেবে। ওর নরম ঠোঁটে, চোখের পাতায় ও গালে এক ধরনের প্রশান্তির আভা।
তখন ঘড়িতে পাঁচটা বাজতে দশ মিনিট বাকী। রোজকার মত আজও নুড়ি বিছানো রাস্তায় প্রথমে গাড়ির টায়ারের ও পরে দড়াম করে দরজা লাগানোর আওয়াজ শুনল মেরি। তারপর তার পায়ের মৃদু শব্দ ও চাবি দিয়ে ক্লিক করে দরজা খোলার আওয়াজ কানে এল। ওর স্বামী এসেছে। যার জন্য এতক্ষণ অধীর আগ্রহে প্রতীক্ষা করছিল ও।
মেরি সেলাই একপাশে রেখে উঠে দাঁড়াল। স্বামী আসার সঙ্গে সঙ্গে তাকে চুম্বন করতে এগিয়ে গেল।
–হ্যালো প্রিয়তম। মেরি বলল।
— হ্যালো। উত্তর এল শুকনো কণ্ঠে।
মেরি ওর স্বামীর কোটটা নিয়ে আলমারিতে সাজিয়ে রাখল। তারপর হেঁটে গিয়ে টেবিলের ওপর রাখা লম্বাটে গ্লাস দুটিতে দুটো পানীয় বানাল। নিজের জন্য হালকা, স্বামীর জন্য একটা কড়া পানীয় তৈরী করল।
স্বামীর হাতে পানীয়টা ধরিয়ে দিয়ে আবার চেয়ারে ফিরে এসে সেলাই হাতে নিল।
দিনের সবচেয়ে প্রিয় সময় এটি মেরির। ও জানতো, প্রথম পানীয় শেষ না হওয়া পর্যন্ত ওর স্বামী কোন কথা বলতে চায় না। চুপচাপ স্বামীর পাশে বসে থাকতে মেরির ভালো লাগত। বাড়িতে দীর্ঘ সময় একাকী থাকার পরে স্বামীর সঙ্গ সত্যি উপভোগ করত ও।
এই মানুষটির উপস্থিতি মেরিকে কিরকম যেন একটা আনন্দ দেয়। সূর্যরস্মি যেভাবে মানুষকে উত্তাপ দেয়, তেমনি এই পুরুষের উপস্থিতির উজ্জ্বলতা ওর মনপ্রাণ ভরিয়ে দিত।
মানুষটি যখন চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে থাকত, কিংবা দরজায় এসে দাঁড়াত, অথবা বড় বড় পা ফেরে ঘর জুড়ে হেঁটে চলত- সবকিছুই ভালোবাসত মেরি। বিশেষ করে প্রথম বার পানীয় শেষ করার পরে যেভাবে পূর্ণ দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকাত।
–ক্লান্ত লাগছে ডার্লিং?
— হ্যাঁ। আমি সত্যিই ক্লান্ত!
বলেই সে একটা অস্বাভাবিক কাজ করল। সে তার গ্লাসটি তুলে নিল। একচুমুকে গোটা পানীয়টা ঢক ঢক করে গলায় ঢেলে দিল। এমনটা তো সে কখনও করে না। মেরি কিছুটা ভয় পেল।
‘বস, আমি আরেকটা বানিয়ে আনছি এখনই।’ রীতিমত চেয়ার ছেড়ে লাফিয়ে উঠল মেরি।
–তুমি বসে থাক। আমি বানাচ্ছি।
মেরি খেয়াল করল এবার বানানো পানীয়তে হুইস্কির তুলনায় সোডার পরিমান অনেক কম। কেমন যেন অস্বস্তি লাগছিল ওর।
–আমি তোমার চপ্পলজোড়া নিয়ে আসি ডার্লিং?
–না।
স্বামী কঠিন গলায় উত্তর দিল। পানীয়তে যখন সে চুমুক দিচ্ছিল, তখন মেরি তাকে দেখছিল। পানীয়র হলুদ তরলে সামান্য ঘুর্ণন দেখা যাচ্ছিল। কারণ সেটা বেশ কড়া ছিল।
–আমি মনে করি এটা অন্যায়। তোমার মত একজন সিনিয়র পুলিশ অফিসারকে ওরা এভাবে সারাদিন দৌড়ের ওপর রাখে!
আপনমনে গজগজ করতে লাগল মেরি। অপর দিক থেকে কোন উত্তর এলনা। ফলে মাথা নিচু করে আবার সেলাই শুরু করল ও।
গোটা ঘর নিস্তব্ধ। শুধু ওর স্বামী পানীয় পান করার সময়ে গ্লাসের গায়ে বরফের টুকরো লেগে মৃদু টুংটাং শব্দ কানে আসছিল।
–ডার্লিং, তোমার জন্য আমি কিছু পনির নিয়ে আসি। আজকে বৃহস্পতিবার তো, ভেবেছিলাম বাইরে খেতে যাব। এজন্য কোন রাতের খাবার তৈরী করিনি।
— দরকার নেই।
–তুমি যদি খুব ক্লান্ত থাকো। তাহলে বাইরে যাবার পরিকল্পনা বাদ দাও। এখনও তো খুব বেশী দেরী হয়নি। ফ্রিজে মাংস ও পনির আছে। আমরা না হয় আজ রাতে ঘরেই খাব।
কথা বলে মেরি অন্য দিক থেকে সম্মতির অপেক্ষা করে। একটা উত্তর, একটু হাসি, একটু মাথা নোয়ানোর জন্য অপেক্ষা করছিল ও। কিন্তু কোনা সাড়াই নেই। তবু দমে গেল না ও।
–যাই হোক, আমি তোমার জন্য একটু চিজ আর বিস্কটু তো নিয়ে আসি..
–দরকার নেই, বললাম তো!
কিছু অস্বস্তিভরে নড়েচড়ে বসল মেরি। বড় বড় চোখ মেলে স্বামীর মুখের দিকে তাকিয়ে এখনও সে।
–কিন্তু তোমাকে তো রাতে অবশ্যই কিছু খেতে হবে। তোমার জন্য কিছু তৈরি করে দিই? ল্যাম্ব চপ খেতে পারি আমরা। নাকি পর্ক? তুমি যাই চাও। ফ্রিজে আছে সবকিছু।’
–বাদ দাও তো।
–কিন্তু তোমাকে তো কিছু খেতে হবে। আমি বানিয়ে দিচ্ছি। ইচ্ছে হলে খাবে। তোমার যা ইচ্ছে।
সেলাইয়ের কাজগুলো টেবিল ল্যাম্পের কাছে রেখে উঠে দাঁড়াল ও।
–তুমি বস। বসতে বলেছি বস।
অদ্ভুত গলায় নির্দেশ এল। এতক্ষণ পর্যন্ত ভয় পাচ্ছিল না ও। কিন্তু এই কণ্ঠ শোনার পরে একটা অজানা ভয় মেরিকে পেয়ে বসল।
–যা বলছি তাই কর। বস এই চেয়ারে…
মেরি ধীরে ধীরে চেয়ারে বসে। ওর বড় বড় চোখ বিভ্রান্ত। অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল স্বামীর দিকে। ওর স্বামী পানীয়ের গ্লাসটি শেষ করে মেঝের দিকে তাকিয়ে আছে।
–শোন, তোমাকে কিছু কথা বলার আছে।
— কী কথা ডার্লিং? কি ব্যাপারে?
ওর স্বামী মাথা নীচু করে মেঝের দিকে তাকিয়ে রইল। প্রদীপের আলো তার সারা মুখে ছায়া ফেলছিল। মেরি খেয়াল করল, তার স্বামীর বা চোখটা যেন সামান্য কাঁপছে।
–ভয় পাচ্ছি, তোমার জন্য বড় একটা আঘাত হবে নিশ্চয়ই। এ ব্যাপারে আমি অনেক ভেবেছি। বুঝলাম এখনই তোমাকে বিষয়টা জানানো ছাড়া আর কিছু করার নেই।
কথাটা বলতে বেশীক্ষণ লাগল না। চার কি পাঁচ মিনিট- বড়জোর। মেরি যেন পাথরের মূর্তির মত স্থির হয়ে ওর স্বামীর প্রতিটি কথা শুনছিল। কিন্তু একটা শব্দের অর্থও ওর মাথায় ঢুকল না।
–এটাই হচ্ছে কথা। জানি তোমাকে বলার জন্য সময়টা খারাপ। কিন্তু আসলে আমার কোন উপায় ছিল না। তবে তোমাকে দেখাশুনা করার জন্য টাকাপয়সা দেব। যাতে তোমার মোটামুটি চলে যায়। তুমি শুধু এই নিয়ে চিৎকার চেঁচামেচি করে অনর্থ বাধিয়ো না। যাতে কাজের জায়গায় আমার সুনাম নষ্ট না হয়।
মেরির কাছে সবকিছু অবিশ্বাস্য মনে হল। মনে হচ্ছিল সবকিছুই ওর নিজের কল্পনা। মনে হয়, ও কিছুই শুনতে পায়নি। যেন কোন স্বপ্ন দেখছে। বাস্তবে এমন কিছুই ঘটেনি।
লাফ দিয়ে চেয়ার থেকে উঠে ‘আমি এক্ষুনি খাবার বানিয়ে আনছি’ বলে রান্নাঘরে ছুটল মেরি। এবার আর কোন কোন বাধা এল না।
যখন মেরি রুমের মধ্যে দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিল, মনে হচ্ছিল ওর পা দুটি মেঝে স্পর্শ করছে না। কেমন যেন মাথা ঘোরাচ্ছে। বমি বমি ভাব হচ্ছে। মাথার মধ্যে কিছুই কাজ করছিল না। ঘোরের মধ্যে নীচতলায় রান্নাঘরের সুইচ অন করে বাতি জ্বালাল ও। ডিপ ফ্রিজ খুলল। তাতে হাত ঢুকিয়ে বের করে আনল ব্রাউন পেপারে মোড়ানো লম্বা একটা জিনিষ। ঠান্ডায় জমে পাথরের মত শক্ত হয়ে যাওয়া একটা ভেড়ার পা।
ঠিক আছে, আজকে ডিনারে ওরা ভেড়ার মাংস খাবে। সরু অংশটা দুহাতে ধরে ওপরতলায় যায় ও। লিভিং রুমে ঢুকে দেখে ওর দিকে পিছনে ফিরে দাঁড়িয়ে আছে লোকটা। একটু থামে ও।
সে অবস্থায় লোকটা বলে, ‘তোমাকে তো বললাম, আমার জন্য খাবার তৈরী করতে হবে না। বাইরে যাচ্ছি আমি।’
ঠিক সে সময় মেরি মেলোনি লোকটার পিছন পর্যন্ত হেঁটে যায়। তারপর একটু থামে। তারপর জমে বরফ হয়ে যাওয়া ভেড়ার পা ওপরে তুলে যতখানি সম্ভব জোরে লোকটার মাথার পিছনে মারে। লোহার ডান্ডা দিয়ে মারলেও আঘাত হয়ত এতটা মারাত্নক হত না।
তারপর আস্তে আস্তে কয়েক পা পিছিয়ে আসে মেরি। অবাক হয়ে দেখে। চার-পাঁচ সেকেন্ড একইভাবে দাঁড়িয়ে থাকে লোকটা। তারপর ধপ্ করে কার্পেটে পড়ে যায়।
লোকটার পড়ে যাওযার শব্দ, ছোট্ট টেবিলটা উল্টে পড়া- সবকিছু আচমকা মেরিকে বাস্তবে ফিরিয়ে আনে। বিস্মিত হয়ে স্বামীর দেহটার দিকে তাকিয়ে থাকে। হাতে তখনও ভেড়ার পাটা শক্ত করে ধরা। তারপর বিড়বিড় করে বলে ওঠে-
–তাহলে আমি ওকে খুন করে ফেললাম।
হঠাৎ করে ওর মনের মধ্যে সবকিছু পরিস্কার হয়ে ওঠে। খুব দ্রুত ভাবতে শুরু করে ও। একজন গোয়েন্দার স্ত্রী হিসেবে ওর জানা আছে কী শাস্তি হতে পারে! তবে তাতে কোনো পরিবর্তন হয় না ওর ভিতর। আসলে এটা এক ধরনের স্বস্তি। কিন্তু তাহলে বাচ্চাটার কী হবে?
অনাগত সন্তানের খুনিদের ব্যাপারে আইন কী বলে? ওরা কি মা-সন্তান দুজনকেই মৃত্যুদন্ড দেয়? নাকি বাচ্চাটার জন্ম হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করে? কী করে ওরা? জবাবটা মেরি মেলোনির জানা নেই। তবে কোন সুযোগ নিতে চায় না ও। তার যে সন্তান পৃথিবীর আলো এখনও দেখেনি, অন্তত: সেই শিশুটির জন্য তাঁকে বাঁচতে হবে।
ঠান্ডা মাথায় ভেড়ার পাটাকে রান্নাঘরে নিয়ে গেল মেরি। পানিতে ধুয়ে, পাত্রে রেখে, মশলা মাখিয়ে, সোজা ভরে দিল ওভেনে। ওভেনের নবটা বাড়িয়ে দিতেও ভুলল না।
হাত ধুয়ে সোজা সিড়ি বেয়ে চলে এল ওপরতলায় বেডরুমে। সেখানে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে যত্ন করে চুল আচড়াল। গালে পাউডার লাগাল। হালকা সাজগোজের পরে একটু হাসার চেষ্টা করে। হাসিটা অদ্ভুত দেখায়। আবারও চেষ্টা করে।
শব্দ করে হাসিমুখে বলে, ‘হ্যালো স্যাম।’। গলার স্বরটাও অদ্ভুত শোনায়। আবার চেষ্টা করে ও।
‘হ্যালো স্যাম। কিছু আলু দাও তো। আর হ্যাঁ, এক টিন শিমও দাও।’
এবার ঠিকঠাক আছে। হাসি আর গলার আওয়াজ দুটোই একেবারে স্বাভাবিক। আরও বেশ কয়েকবার বলা মকশো করে মেরি। তারপর সিঁড়ি দিয়ে নেমে এসে, ওভার কোট চড়িয়ে পেছনের দরজা দিয়ে বাগান পেরিয়ে রাস্তায় গিয়ে ওঠে।
তখনও ছয়টা বাজেনি। মুদি দোকানে লাইট জ্বলছিল।
–হ্যালো স্যাম।
মেরি উজ্জ্বলভাবে হেসে বলল। কাউন্টারের পিছনে লোকটির দিকে তাকিয়ে হাসল।
–শুভ সন্ধ্যা, মিসেস মেলোনি। কেমন আছেন?
–আমাকে কিছু আলু দেবে স্যাম? আর হ্যাঁ, এক প্যাকেট মটরশুঁটিও দিও।
স্যাম পিছনে ফিরে আলু ও মটরশুটি গোছাতে লাগল।
–আর বল না স্যাম। অফিস থেকে ফিরে প্যাট্রিক বলছে, ও খুব ক্লান্ত। বাইরে খেতে যেতে চাইছে না আজ। তুমি তো জান, বৃহস্পতিবারগুলিতে আমরা সাধারণত বাইরেই খাই। এখন রান্না করতে গিয়ে দেখি, ঘরে কোন শাকসবজি নাই।
দোকানী জিজ্ঞাসা করে-
— কিছু মাংস নেবেন?
–না, না, ধন্যবাদ। মাংস আছে ঘরে। ফ্রিজে একটা ভেড়ার পা ছিল। ওটাই রাঁধবো আজ।
–এই আলু চলবে তো মিসেস মেলোনি?
–হ্যা চলবে। দুই পাউন্ড প্লিজ।
দোকানী ঘাড় ফিরিয়ে ওর দিকে চেয়ে বলে-
–আর কিছু লাগবে? ডেজার্ট নেবেন নাকি? একটা বড় চিজকেক নিয়ে যান। মনে হয় আপনার স্বামীর পছন্দই হবে।
–দারুণ। চিজকেক তো প্যাট্রিকের অসম্ভব প্রিয়।
সবকিছু প্যাক করে একমুখ উজ্জ্বল হাসি দিয়ে মেরি বলল, ‘ধন্যবাদ স্যাম। শুভরাত্রি।’
দ্রুত হেঁটে ফিরে আসতে আসতে আপন মনে মেরি বলে, ওর ক্লান্ত স্বামীর কাছে ফিরে যাচ্ছে ও, ডিনারের জন্য অপেক্ষা করছে লোকটা। তাকে তো ভালো করে রান্না করে খাওয়াতে হবে, যতখানি সম্ভব স্বাদ হয় যাতে, বেচারা খুব ক্লান্ত।
ঘরে ফেরার অস্বাভাবিক বা ভয়ঙ্কর কিছু যদি দেখে, একটা বড় আঘাত পাবে ও, তখন দু:খ আর ভয়ের প্রতিক্রিয়া দেখাতে হবে। তবে ঘরে কিছুই অস্বাভাবিক দেখবে বলে ভাবছে না এখন। ক্ষুধার্ত স্বামীর জন্য ডিনার তৈরি করতে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় জিনিষপাতি কিনে ঘরে ফিরে যাচ্ছে।
নিজের মনে বলে, এটাই একমাত্র উপায়। সবকিছু স্বাভাবিকভাবে করতে হবে। অভিনয় করার কোনো দরকার নেই। সম্পূর্ণ স্বাভাবিক রাখতে হবে সব। পেছনের দরজা দিয়ে রান্নাঘরে ঢোকার সময় আপন মনে গুনগুন করে গান গায় ও।
জোরে ডাক দেয়-
–প্যাট্রিক, কী করছ ডার্লিং?
ঠোঙ্গাগুলো টেবিলের ওপর রেখে লিভিং রুমে ঢোকে ও। স্বামীকে মেঝের ওপর পড়ে থাকতে দেখে সত্যি সত্যি আঘাত পায়। লোকটার জন্য সকল ভালোবাসা যেন ফিরে আসে। ছুটে গিয়ে শরীররটার পাশে বসে পড়ে। তারপর বুকফাটা আর্তনাদ করে কেঁদে ওঠে। খুব সহজ হল কাজটা। কোন অভিনয় করতে হয়নি।
কয়েক মিনিট পর উঠে গিয়ে ফোনের কাছে যায় ও। থানার নম্বরটা জানা ছিল। ওপাশের লোকটা ফোন উঠিয়ে জবাব দিলে কেঁদে উঠে বলে-
–জলদি , জলদি আসুন, প্যাট্রিক মারা গেছে।
–কে কথা বলছেন?
–মিসেস মেলোনি। মিসেস প্যাট্রিক মেলোনি।
–বলেন কি! প্যাট্রিক মারা গেছে?
–হ্যাঁ। তাই তো মনে হচ্ছে। মেঝেতে পড়ে আছে। দেখে মনে হয় প্রাণ নেই।
মেরি কেঁদে ওঠে।
–ঠিক আছে, এক্ষুনি আসছি আমরা।
লোকটা বলে।
অল্পক্ষণের মধ্যেই গাড়িটা আসে। সামনের দরজা খুললে দুজন পুলিশ ভেতরে ঢোকে। দুজনেই পূর্বপরিচিত। থানার প্রায় সবাইকে জেনে ও। কান্না সামলাতে না পেরে জ্যাক নুনানের ওপর গিয়ে পড়ে ও। জ্যাক ওকে ধরে সাবধানে চেয়ারে বসিয়ে দেয়।
চিৎকার করে বলে-
–ও কি সত্যিই মারা গেছে?
–মনে হচ্ছে তাই। কী হয়েছিল?
কয়েক কথায় দোকানে গিয়ে ফিরে আসার গল্পটা বলে ও। এসে প্যাট্রিককে মেঝেতে পড়ে থাকতে দেখে। কেঁদে কেঁদে যখন কথা বলছিল ও, তখন লাশের মাথায় শুকনো রক্ত দেখতে পায় জ্যাক নুনান। প্রায় দৌড়ে ফোনের কাছে যায় সে। তারপর আরো অনেকেই আসতে শুরু করে- একজন ডাক্তার, দুজন গোয়েন্দা, পুলিশের ফটোগ্রাফার, আর ফিঙ্গারপ্রিন্ট বিশেষজ্ঞ।
গোয়েন্দারা এসে একের পর এক প্রশ্ন করতে শুরু করে মেরিকে। তবে খুব সদয় ব্যবহার করে ওরা। ওদের বলে মাংসটা কীভাবে ওভেনে ঢুকিয়েছিল, ‘এখনও ওটা আছে ওখানে,’ তারপর কীভাবে পাড়ার দোকানে গিয়ে সদাইপাতি কিনে আনে, ফিরে এসে দেখে কীভাবে লোকটা পড়ে আছে মেঝেতে।
–কোন দোকান?
মেরির উত্তর শুনে গোয়েন্দাটি সহকারীকে ফিসফিস করে কিছু বলতেই সে ছুটে বেরিয়ে গেল। প্রায় পনের মিনিট পরে সে যখন ফিরল, তার হাতে কয়েকটা কাগজে কি সব নোট নেয়া। মেরি তার অবিশ্রান্ত ফোঁপানির মধ্যেও শুনতে পেল ওদের ফিসফিসানির আওয়াজ-
–হ্যাঁ , হ্যাঁ… একেবারে স্বাভাবিক ব্যবহার… বেশ হাসিখুশী ছিল…. রান্না করবে বলছিল… মটরশুঁটি…চিজকেক… না না ওঁর পক্ষে অসম্ভব….
কিছুক্ষণ পরে ডাক্তার চলে গেলে আরও দুজন এসে প্যাট্রিকের মরদেহ নিয়ে গেল। সবাই গেলেও সেই দুই পুলিশ ও গোয়েন্দারা গেল না। জ্যাক নুনান তো এও বলল, দরকার হলে মেরি এই ক’দিন তার স্ত্রীর সঙ্গে থাকতে পারে। যদিও মেরি তাতে রাজি হল না।
‘আপনি বরং বিশ্রাম নিন’ এই বলে গোটা বাড়িটায় তল্লাশি চালায় ওরা। কাজের ফাঁকে জ্যাক নুনান খুব ভদ্রভাবে দু-চারটা কথা বলে ওর সাথে। সে বলে, মাথার পেছনে কিছু দিয়ে আঘাত করে খুন করা হয়েছে ওর স্বামীকে। অস্ত্রটা খুঁজছে ওরা। খুনি ওটা সাথে করে নিয়ে যেতে পারে, অথবা কোথাও ফেলে গেছে কিংবা লুকিয়ে রেখেছে। জ্যাক নুনান বলে-
–সেই পুরনো কাহিনী। বুঝলেন মিসেস মেলোনি। অস্ত্রটা খুঁজে পেলে খুনীকেও পাওযা যাবে।
শেষে একজন গোয়েন্দা ওর পাশে এসে বসে জিজ্ঞেস করে, ও কি জানে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হতে পারে এমন কিছু ঘরে আছে কিনা? ও কি একটু উঠে খুঁজে দেখবে কিছু হারিয়েছে কিনা! যেমন কোন বড় লোহার স্প্যানার বা ফুলদানী?
মেরি জানাল, ফুলদানী নেই। তবে গ্যারেজে স্প্যানার থাকতে পারে। অতএব গ্যারেজ তল্লাসি হল। মাঝে মাঝে নুড়ি পিছানো পথে বুটের আওয়াজ আর জানালার কাচে টর্চের আলোতে মেরি বুঝতে পারল তদন্ত চলছে পুরো কদমে।
খোঁজ চলতেই থাকে। অনেক সময় পেরিয়ে গেছে ততক্ষণে। রাত প্রায় নয়টা বাজে। ঘরগুলো তল্লাশি করতে করতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে লোকগুলো। মেরি বলে-
–জ্যাক, একটু পানীয় দেবো? আপনার যথেষ্ঠ ক্লান্ত নিশ্চয়ই।
— ঠিক আছে। পুলিশের নিয়মে পড়ে না এটা। তবে আপনারা নেহাৎ বন্ধু বলে চলবে।
জ্যাক বলে। তারপর গ্লাস হাতে দাঁড়ায় ওরা। গোয়েন্দা দুজন মেরির কাছে গিয়ে অস্বস্তিতে পড়ে যায়। মন ভালো করার মত কিছু বলতে চাইছিল যেন। জ্যাক নুনান একবার রান্নাঘরে ঢুকে দ্রুত বেরিয়ে এসে বলে-
–মিসেস মেলোনি, আপনার ওভেন এখনও জ্বলছে। মাংসটা ভিতরে।
–ওহ্ কি অবস্থা! আমি ভুলেই গিয়েছিলাম ওটার কথা!
–ওভেনটা বন্ধ করে দিই।
–ধন্যবাদ জ্যাক। অনেক ধন্যবাদ তোমায়। শোন, একটা উপকার করবে আমার ভাই?
–বলুন, যদি সম্ভব হয়।
অশ্রুভেজা চোখে মেরি সবার উদ্দেশ্যে বলে-
–সবাই আপনারা আছেন এখানে। আপনারা প্যাট্রিকের প্রিয় বন্ধু। ওর খুনীকে ধরার জন্য চেষ্টা করছেন। আপনাদের সবার খিদে পেয়েছে নিশ্চয়ই। ডিনারের সময় পার হয়ে গেছে অনেক আগে। এতক্ষণ আপনাদের কিছু খেতে দেইনি জানতে পারলে প্যাট্রিক কখনই আমাকে ক্ষমা করত না। ওভেনে চাপানো ভেড়ার মাংসটা সদ্য রাঁধা হয়েছে। আপনারা চারজন মিলে ওটা খেয়ে নিন না কেন?
জ্যাক নুনান বলে-
–ছি, ছি, কি যে বলেন! এই অবস্থায় কি খাওয়া যায়!
কাতর হয়ে মেরি বলে-
–প্লিজ, জ্যাক, আমি আপনাদের সবাইকে অনুরোধ করছি। আজ আমি কিছু মুখে তুলতে পারব না। আপনারা ওটা খেয়ে নিলে আমার সাহায্য হয়। তারপর আবার কাজ শুরু করতে পারবেন।
গোয়েন্দা দুজন ইতস্তত করছিল। কিন্তু খিদেও পেয়েছিল ওদের জবর। শেষ পর্যন্ত কিচেনে ঢুকে নিজেরাই খাবার নিয়ে নেয়।
মেরি যেখানে বসা সেখানেই ছিল। খোলা দরজা দিয়ে ওদের কথাবার্তা কানে আসছিল। নিজেদের মধ্যে কথা বলছিল ওরা। মুখে মাংস থাকায় গলা ভারী শোনায়।
–আরেকটু নাও চার্লি।
–এই একেবারে শেষ করা ঠিক হবেনা।
–উনি চাইছেন আমরা শেষ করি এটা। তাহলেই উনি কৃতজ্ঞ থাকবেন।
–বেচারা প্যাট্রিককে মারার জন্য বড়সড় একটা কিছু ব্যবহার করেছে খুনী। ডাক্তার বলেছে ওর মাথার পেছনটা টুকরো টুকরো হয়ে ভেঙ্গেছে।
–এজন্যেই অস্ত্রটা খুঁজে পেলে তদন্ত করতে সুবিধা হবে।
–আমারও একই কথা।
–যে-ই খুনটা করে থাকুক, এত বড় অস্ত্র সাথে করে নিয়ে যেতে পারেনি সে।
কথা বলে ঢেকুর তুলল একজন।
–আমার মনে হয়, বাড়ির কাছাকাছি কোথাও পাওয়া যাবে।
–হয়তো আমাদের ঠিক নাকের ডগাতেই আছে ওটা। তোমার কি মনে হয় জ্যাক?
পাশের ঘরে বসে মেরি মেলোনি খিলখিল করে হেসে উঠল।