You are currently viewing ভাড়া বাসায় ২২ বছর/ মনিজা রহমান

ভাড়া বাসায় ২২ বছর/ মনিজা রহমান

ভাড়া বাসায় ২২ বছর

মনিজা রহমান

 

মনে হয় যেন বহুকাল আগের কথা। কিন্তু না সেদিনই তো ঘটল।

হালকা মতো কলিংবেলের আওয়াজ শুনে সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়াতে বড় ছেলে বলল, ‘না, মা কেউ আসেনি। পাশের ফ্ল্যাটের কেউ হয়ত ভুলে চাপ দিয়েছে।’

পড়ন্ত বিকেলে এখন তো কারো আসার কথা নয়। তবু দরজা খুলি। তাকিয়ে দেখি, মাঝবয়সী ফর্সা চেহারার এক মহিলা সিঁড়ির গোড়ায় দাঁড়িয়ে আছে। আমাকে দেখে হাসিমুখে তাকালেন।

-আমার নাম মেলিস। আমি আগে এই ফ্ল্যাটে থাকতাম।

মহিলা কথা বলতে খোলা দরজা দিয়ে আমার বাসার দিকে ইঙ্গিত করলেন। তারপর যুক্ত করলেন, ‘আমার স্বামী ভুল করে তার ক্রেডিট কার্ডে এই বাসার ঠিকানা দিয়ে ফেলেছে। তাই খোঁজ নিতে এসেছি আপনারা কোন মেইল পেয়েছেন কিনা!’

  • আপনার স্বামীর নাম কি ?
  • এডসেল ভেরা। আর আমার নাম মেলিস ভেরা।
  • আপনার স্বামীর নামে কোন চিঠি দেখেছি বলে মনে পড়ছে না। তবে এই ফ্ল্যাটে আসার পরে মেলিস নামে অনেক চিঠি দেখেছিলাম।

সেই চিঠিগুলি দীর্ঘদিন জমিয়েও রেখেছিলাম। কিন্তু কেউ না আসাতে পরে গার্বেজ করে দিয়েছি। কিন্তু শেষের তথ্যটা তাকে বললাম না। মেলিস তখনও হাসিমুখে তাকিয়ে আছে।

-আসুন না ভিতরে।

ভদ্রমহিলাকে ঘরে ডাকতেই উনি উঠে এলেন। লিভিংরুমে ঢুকে দাঁড়িয়ে রইলেন। বসলেন না কোথাও। বললেন, রাস্তায় গাড়ি স্টার্টে রেখে এসেছি।

মেলিস আমার ঘরের চারদিকে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখলেন। কেন যেন মনে হল, ওনার দৃষ্টি আমার ঘর ছাড়িয়ে চলে গেছে যেন বহুদূর।

  • জানেন, আমি এই বাসায় বাইশ বছর ছিলাম। এডির সঙ্গে বিয়ের পরে এ বাসায়  আমার সংসার জীবন শুরু হয়। আমার দুই কন্যার জন্মও হয়েছে এ বাসায়। কত স্মৃতি এই বাসাকে ঘিরে।

ভদ্রমহিলার আবেগময় কথাগুলি খুব স্পর্শ করল। মানুষের জীবনে কতগুলি মোড় থাকে। যাকে ইংরেজীতে বলে টার্নিং পয়েন্ট। মেলিসের জীবনের অনেকগুলি মোড় মিলেছিল এই মোহনায়।

  • আপনারা কবে এসেছেন এই ফ্ল্যাটে?

মেলিসের প্রশ্নের জবাব দিতে হিয়ে আমি একটু চিন্তা করি।

  • ২০১৯ সালের আগস্ট মাসে এখানে এসেছি। আগে জ্যাকসন হাইটসে থাকতাম।
  • তারমানে…. আমরা চলে যাবার পরেই আপনারা এসেছেন।

ওনার কথায় মৃদু হাসি। এখানে আছি আড়াই বছর। তবু মেলিসকে কখনও দেখিনি আগে।

-আপনি তো আগে কখনও আসেননি?

– এসেছিলাম দুই বার। কলিংবেল বাজিয়েছিলাম। আপনারা মনে হয় বাসায় ছিলে না।

– এখন কোথায় থাকেন?

– আমরা লংআইল্যান্ডে বাড়ি কিনেছি। সেখানে থাকি। তবে আমার শ্বাশুড়ি আপনাদের পাশের স্ট্রীটে থাকেন। যে কারণে এখনও এখানে আসা হয়।

মেলিস চারদিকে তাকিয়ে ডান দিকের বেডরুমের দিকে আঙ্গুল তুলে বলে- ‘ আমার মেয়েরা ওই রুমে থাকতো। আর ছোট বেড রুমে আমি আর আমার স্বামী।’

আমি কিছু বলার আগে বড় ছেলে বলে উঠল, ’আমরাও এভাবে ঘুমাই। আমি আর আমার ভাই বড় বেড রুমে আর বাবা-আম্মু ছোট বেড রুমে।’

ভদ্রমহিলা চলে যেতে গিয়ে শ্লথ হয়ে যান। গাড়ি স্টার্ট দিয়ে রেখে এসেছেন রাস্তায়। তবু কি যেন মনে পড়ে যায় ওনার।

‘আচ্ছা পাশের ফ্ল্যাটে ইকুয়েডরিয়ান যে দম্পতি থাকতো, তারা আছে?’

‘পাশের ফ্ল্যাটে তো কোন দম্পতি থাকে না। একটা লোক থাকে, একা।’

‘আর দোতলার শেষ মাথার ফ্লাটে পেরুভিয়ানরা?’

‘হ্যা, ওনার আছে। আপনি জানেন কিনা, করোনার পিক সময়ে ওই বাসার খুব বয়স্ক এক লোক মারা যান। এম্বুলেন্স আর পুলিশ এসে লাশ নিয়ে যায়। কেউ সঙ্গে যেতে পারিনি।  আমি জানালা দিয়ে দেখেছি।’

‘ওহ্ জেসাস। আমার জানা ছিল না।’

শুধু স্প্যানিশ প্রতিবেশীদের নিয়ে ওনার আগ্রহ দেখে বুঝি মেলিসও ওনাদের মতো হবেন। হয়ত কলম্বিয়ান কিংবা পুয়ের্তিকান।

আমি মেইনগেট পর্যন্ত ওকে এগিয়ে দিতে যাই। গেটের পাশে একটা জংলী গোলাপের ঝাড়। ওখানে এসে মেলিস থেমে যায়। আমার দিকে তাকিয়ে কানায় কানায় আবেগে সিক্ত হয়ে বলে, ‘জানো এই গাছটা কে লাগিয়েছে? আমার বড় মেয়ে।’

আমার তথ্যটা জানা ছিল না। জেনে খুব ভালো লাগল।

আমি দাঁড়িয়ে থেকে মেলিসের চলে যাওয়া দেখি। তারপর গোলাপ ঝাড়ের দিকে তাকাই। মানুষ চলে গেলেও বৃক্ষ একই জায়গায় থেকে যায়।