You are currently viewing ভারবাহীদের গান―পবিত্র মুখোপাধ্যায় এর মহাকবিতা ||  নিবিষ্ট পাঠ#পারমিতা ভৌমিক

ভারবাহীদের গান―পবিত্র মুখোপাধ্যায় এর মহাকবিতা || নিবিষ্ট পাঠ#পারমিতা ভৌমিক

ভারবাহীদের গান―পবিত্র মুখোপাধ্যায় এর মহাকবিতা।

নিবিষ্ট পাঠ#পারমিতা ভৌমিক

 

সম্পূর্ণ ব্যঙ্গে লিখিত বিষাদমথিত কবিতা ‘ভারবাহীদের গান’। লক্ষণীয় যে পুরাণ প্রসঙ্গ ছেড়ে এই মহাকবিতায় কবি রূঢ় বাস্তবে নেমে এসেছেন।

পৃথিবীর কঠিন পরিবেশে মানুষ ভারবাহী পশুদের মতো জাবর কাটছে। এখানে রোমান্টিকতার কোন স্থান নেই।

সাম্যবাদী দলের নৈতিক দিকটি চিত্রিত করার সাহস দেখিয়েছেন কবি এবং প্রাতিষ্ঠানিক শক্তির নিষ্পেষণের বিরুদ্ধেও কথা বলেছেন।

দূষিত নৈসর্গিক পরিবেশ, মানুষের সার্বিক অধঃপতন উচ্ছৃঙ্খল যাপনচিত্র এ সবকিছুর মধ্যে মানবজীবন শ্বাসরুদ্ধ হয়ে ভারবাহী পশুতে পর্যবসিত হয়েছে মাত্র।

এ মহাকবিতার বিশ্বস্ত রেখায় রেখায় পবিত্র মুখোপাধ্যায় সমকালীন দুর্দশাগ্রস্ত একটা সময়ের ছবি তুলে দিয়েছেন মাত্র। কবির স্বতঃস্ফূর্ত আশাবাদের দিকটা কোনও ভাবেই উকি দেয় নি। তাতে মনে হয়। প্রবল নৈরাশ্য গিলে ফেলেছিল সময়টাকে। নিসর্গের শুদ্ধতাতেও মালিন্য দেখেছেন কবি ――

“‘লাফিয়ে উঠেছে মলিনসূর্য মনুমেন্টের চূড়ায়

ওঁ জবাকুসুম সঙ্কাশং

পিছলে পড়েছে সূর্য গঙ্গার ঘোলাটে জলের বয়ার উপর কবিতা লিখছি, ‘হে অনন্ত নক্ষত্রবীথি, হে মোহময়ী রাত্রি।

তোমার গুচ্ছ গুচ্ছ কালোচুলের বন্যায়

আমাকে ভাসিয়ে নাও।”

 

কংক্রিটে কংক্রিটে মানবতার অবমূল্যায়ণের ছবি এই মহাকবিতার কাঠামো রচনা করেছে।

 “হাড়পাঁজর বের করা ফুটপাতের উপর ছেঁড়া ন্যাকড়ায় শরীর ঢেকে মা পেতেছে হাত। কোলের উপর সদ্যমৃত শিশুর নিথর শক্ত শরীর নিয়ে বিনিয়ে সাতকাহন গাইছে মা…. ফুল্লরার বারোমাস্যা নিত্যদিনের, আর আমাদের দেবী ডানা মেলে, হাইহিলের মিঠে শব্দ তুলে চলে যাচ্ছে গড়িয়াহাটের অমরলোকে সংক্রান্তির সেল-এ’।

 কবির অহম্ হীন সত্তার কন্ঠ প্রথম থেকেই সোচ্চার। স্বাভাবিক ভাবেই নির্মোহ দৃষ্টিতে সত্যচিত্রটিকেই তুলে ধরার প্রতিশ্রুতিতে কবি শুরু করেছেন ‘ভারবাহীদের গান’ মহাকবিতাটি।

যদিও প্রচ্ছন্নভাবে বাইবেলীয় গল্পের ছায়া কবিতায় পড়েছে।

ডিমিথের পুরোনো স্টাইলটি নতুনভাবে কবি প্রতিষ্ঠা করেছেন এ কবিতায়। অহংকারের রোমশ কম্বলের আড়ালে শুয়ে বসে দিন কাটাতে দেখেছেন জাবর কাটা ভারবাহী মানুষ-মেঘের দলকে। এইসব মানুষের একটা যৌথ চরিত্র এঁকে দিয়েছেন কবি। দাসত্বের উচ্চকিত প্রচারে মেরুদন্ডহীন যন্ত্রণা- সায়ক-বিদ্ধ মানুষগুলি প্রভুর স্তবে গলা মিলিয়েছে। কেননা বেঁচে থাকার এই-ই সবচেয়ে সহজতম ও ঘৃণ্যতম উপায়।

এইসব মানুষের যে বর্ণনা কৰি দিয়েছেন, তারমধ্যে নিহিত অপ-আদর্শের বিস্তার চিত্রিত হয়েছে। মানুষগুলো এখানে সাদা-কালো, ঢ্যাঙা বা বামন, খুনি বা সন্ত্। এরা ছারপোকার দল। প্রতিবাদহীন জীবনে অভ্যস্থ। কখনই এদের মিলিত শক্তিতে নক্ষত্রমণ্ডল ঝলমল করবে না। এদের শুদ্ধ প্রার্থনায় কোনও দিনও দিগন্ত ফুঁড়ে উঠে আসবে না ত্রাণকর্তা। অপচিত জীবনের সমস্ত শুদ্ধতা এরা হারিয়েছে। নিছক জৈবতার পায়ে দাসখত লিখে দিয়েছে।

এদিকে আবার, প্রকৃতির নিয়মে বসন্ত এসেছে। রবি ঠাকুরের গানও বেজেছে। সিরিষ গাছ ছড়িয়ে দিয়েছে হলুদ পাপড়ি। কোকিল গানও গাইছে। কিন্তু সে কোকিল হাড়গিলে।

ন্যাড়া নিমের ডালে শেষ পাতাটুকু নেই বলে জীবন বিবর্ণ। কবিরা যতই কোরাস

ধরুক না কেন, সে সব শুধু হয়ে উঠেছে হাওয়ায় ছুঁড়ে দেওয়া নীল বুদবুদ।

মানুষের সবকছু বিকিয়ে যাচ্ছে অল্পদামে।

“বড়ো অল্পদামে কিনে নিচ্ছে মকবুল মিঞা

ওদের ওপরে

বাদশাহী পাঞ্জার ছাপ

কেমন বিকিয়ে গেল

দেড়টাকা কেজি দরে অবলীলায়।'”

 

কবির চেতনায় যে কবিকথা স্তব্ধ হয়ে আছে বাস্তবের যন্ত্রণায় তা বেরিয়ে আসতে পারছে না।

একটা গভীর জীবন-দর্শন থেকে কবি একটি মূল সত্য আবিস্কার করেছেন:―

“আমরা ভুলে যাই সহজে, অথচ আমাদের বেঁচে থাকতে হয় অনেকদিন”

কাঁধ বেঁকে যায়, নুয়ে পড়ে মাথা, তবু চলতে ফিরতে হয় অবাধ্য পা টেনে হিচড়ে, আর, এ ওর কাঁধে থাপ্পড় মেরে বলি――

“ব্রেভো, লড়ছে যেন বাঘের বাচ্ছা”

চটির স্ট্র্যাপ ছিঁড়ে যাচ্ছে কখন! চটি আটকে গলাপিচে ―

 এইভাবে রেখে যাচ্ছি চরণ চিহ্ন ধূলোয়”)

 

আসলে কবি দেখেছেন জীবনটাই চলছে ডোপিং-এ। এভাবেই অমরত্বের অভিলাষ বুকে নিয়ে ধুঁকতে ধুঁকতে বেঁচে আছে জীবন। পাড়ায় পাড়ায় হাড় হাভাতে মানুষদের উপছে পড়া ভীড়। টিউবকল সার জীবনে হাঁড়ি-কলসীর পাহাড় উঠেছে জমে। অশ্রাব্য আদান-প্রদান চলছে মেয়ে মানুষগুলোর মধ্যে। এরই মধ্যে নশ্বরতার শিলালেখ রেখে যেতে হচ্ছে, রেখে যেতে হচ্ছে চরণচিহ্ন। একটা ক্লান্তিকর জার্ণি নৈরাশ্যের বর্ণনায় ভরপুর। মিথ্যে হয়ে যাচ্ছে রাজেশ্বরীর গলার গান, ‘আমার হিয়ার মাঝে লুকিয়েছিলে’। বৈপরীত্যের ছবিতে কবি আঁকছেন জীবন “ভস্ম অপমান শয্যা ছাড় পুষ্পধনু, হে বিজয়ী, বীরের তনুতে লহো তনু”।

ট্রামের হাতল ধরতে পারলেই―

“নেপোলিঁয়র পৌরুষ

 সেই চেষ্টাই করা যাক্।”

―― দূষণের সর্বব্যাপী পার্থিব ছবি ছড়িয়ে রয়েছে এই কবিতার প্রেক্ষাপটে। ‘সূর্য’ এখানে পিছলে পড়ছে গঙ্গার ঘোলাটে জলে ভেসে থাকা বয়ার উপর। অসহায়তার রোজনামচা তবু কবি লিখে চলেছেন :: ―

“হে অনন্ত নক্ষত্রবীথি, হে

মোহময়ী রাত্রি! তোমার

 গুচ্ছ গুচ্ছ কালো চুলের বন্যায় আমাকে ভাসিয়ে নাও

‘ কঙ্কা, শঙ্কা কোরো না।’ ……. ইত্যাদি।

মানুষকে জাগানোর জন্য এসব কৃত্রিম কবিতা। তবু বিশ্রামহীনভাবে লেখা হয়ে চলেছে। যদিও কবি অন্য এক পৃথিবীর, তবু তারা হাত ধরেছে আধা-প্রেমের। তাদের সেই অসম্পূর্ণ পৃথিবী থেকে নেমে আসছে শুধু বিকৃত কাব্য। ভারবাহী পশুরা মেরুদন্ডহীন জীবনে তাকে কেন্দ্র করেই জাবর কেটে চলেছে, বিজৃম্ভন  তুলছে। কবির কোমল সত্তা আজ মৃত। ধোঁয়া আর গ্যাসের কটু গন্ধে অনবরত মরে যাচ্ছে তাদের প্রাণ-ভ্রমর।

ভারবহনকারী পশুত্বকে তবু ধিক্কার দিচ্ছে কবির অন্তরসত্তা। ফুটপাত ভেঙ্গে চওড়া রাজপথ তৈরী হচ্ছে, লাক্সারী বাসে ঝলমল করছে কোলকাতা, হাতের চেটোয় খেলা করছে ইলেকট্রিক সুইচ। তবুও গেঁয়ো ভূতের দল কন্ঠ মেলাচ্ছে ঐক্যতানে। অসৎ রাজনীতির শিকার হয়ে মিছিলের পিছনে পিছনে খুঁড়িয়ে চলছে জীবন : ‘গাঁ গঞ্জের মানুষ চলেছে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে, হাতে

রঙচটা সুটকেস

এই তো বেশ

এক ঢিলে দুই পাখি – দেখা হ’লো কলকাতা

আর হওয়া গেলো বিপ্লবের সামিল, এবার

বিনা টিকিটে ফেরার পালা।’

গভীর বিতৃষ্ণার মধ্যেও কখনও কখনও কবি স্বপ্ন দেখতে ও দেখাতে ভোলেন না।

প্রাণের আরামই নামান্তরে ঈশ্বর। তাকে কুর্ণিশ করতে হয়। ছন্দিত ভঙ্গীতে। আবিশ্ব ধরে অশেষ যে পথ, প্রগতি তারই নাম। কবি সেই গতিতেই পা মেলাতে ডাক দিচ্ছেন, ছন্দে ছন্দে। ভারবাহী পশুদের স্থবির জীবন তাঁর কাঙ্খিত নয়। আলো হীনতা, বাস্তব ঘরে ঘরে, মনের ঘরেও, মননের ক্ষেত্রেও। লোডশেডিং এর চাপে মার খাচ্ছে শিল্প। তবু ভারবহন করছে বোবা মেষীরা।

কলকাতার আদর্শ ছবি রেখায়িত করে তুলনার একটি প্রেক্ষিত তৈরী করেছেন পবিত্র মুখোপাধ্যায়। সে পংক্তিগুলো প্রাণিধানযোগ্য ――

এই আমাদের কলকাতা ভাজা আর ছটফটে

ওই তো ভাসছে ময়ূরপঙ্খী গঙ্গার নীলজলে

ওই তো মাস্তুলে বসেছে সিন্ধুসারস

◆◆◆   ◆◆◆  ◆◆◆   ◆◆

কাচস্বচ্ছ জলে ভাসছে শরৎমেঘের ছবি।

আর আজকের মানুষের কাছে কলকাতা একটা শব্দময় বর্ণাঢ্য উৎসব নগরী। নিয়নপ্লাবিত বাতিদান রেস্তোঁরার তান্ডবকে রোজরাতে মোহময়ী করে তোলে। দুরস্ত, মেধাহীন ঘুম নামে ভালোবাসায়। মদির ঠোঁট কাঁপে কামনায় –এ শহরে আজ এই হল প্রেমের অভিসার ছবি। একটা অদ্ভুত বৈপরীত্য স্বল্পকথনে মনে করিয়ে দিচ্ছে আমরা কোথায় এসে পৌঁছেছি।

        -পবিত্র মুখোপাধ্যায় শুদ্ধতম রোমান্টিক কবি। রোমান্স-ক্লিষ্ট নন। প্রিয়ার সঙ্গে মৃত্যু, প্রিয়ার দ্বারা মৃত্যু, প্রিয়ার মধ্যে মিশে যাওয়ার ও একত্ব হওয়ার অন্তিম মৃত্যুবোধ একটা রমণীয় আলো ফেলছে তাঁর মহাকবিতাগুলিতে – এমন মনে করেন আলোচক শ্রীধর মুখোপাধ্যায়।

        -আত্মিক ধ্বংসের বোধ এবং একটা বিপন্নতার অনুভব পবিত্রর রোমান্টিক চৈতন্যেরই প্রকাশ – তা সে রূঢ় যন্ত্রণাময় বাস্তবই হোক আর স্বপ্নময় বাস্তবচারিতা হোক।

 হাড়কাটা রাস্তায় চাঁদের হাট বাইলেনের হালকা আলোয় ঠুনঠুন রিক্সার আওয়াজ আর কাঁচের চুড়ির রিণিঝিনি জাগতিক ক্লেশের উর্দ্ধে গিয়ে একটা স্বর্গীয় নিষ্পাপকোট কবিকে ভাসিয়ে নিয়েছে। কবির ঐকান্তিক আর্তি তাই――- ‘হে রাত্রি, তোমাকে স্বাগত/গাঢ় ঘুমে তলিয়ে যাও জাগ্রত বিবেক।’

ভারবাহী মানুষগুলো তবুও যে পশুস্তরে রয়ে গেছে তা স্পষ্টতঃই এই মহাকবিতায় বর্ণিত। এ ভার যে কেবল ব্যক্তিগত সংসার কিম্বা রাষ্ট্রীয় শাসকের চাপিয়ে দেওয়া কর্মভার বা দাসত্ব তা নয়, এর সঙ্গে হিসাবে রয়ে যাচ্ছে অতি সাধারণ-স্তরে নীতিহীনতা, লোভ, কামনা ও ইন্দ্রিয় পরায়ণতা। কবি এখানে কি অসামান্য শব্দ ব্যবহার করেছেন ‘নির্বোধ দুঃখ’। এ দুঃখ সত্যি বোধহীন শরীর সম্পৃক্তির ফল। মননহীন রাস্তায় চলতে চলতে তাই মানুষের ভবিতব্য ভারবাহী পশুদের সঙ্গে জড়িয়ে গেছে। এবং কবির প্রসারিত রোমান্টিক দৃষ্টির মধ্যেও তার কোনও পরিত্রাণের ছায়া পড়ছে না তাদের জন‍্য। এমন অবস্থা বর্ণনা করতে গিয়ে পবিত্র মুখোপাধ্যায় লিখেছেন――

“সারাটা দিন তাড়া খেয়ে মরছি

আর তো উড়তে পারছি না, ডানায়

অসীম ক্লান্তি

কাচের আড়ালে ঢেলে রেখেছো খিদের আরাম

 ভুখ লেখেছে আমাদের

বন্দুক উচিয়ে পাহারা দিচ্ছো লকার

ভুখ লেগেছে আমাদের

আমরা খুবলে খাবো, হাত পা ছড়িয়ে ঠুকরে খাবো”

◆◆◆   ◆◆◆   ◆◆◆   ◆◆

ঘৃণায় ছড়িয়ে দেবো বিষবাষ্প

◆◆◆   ◆◆◆  ◆◆◆   ◆◆

হাওয়ায় ছড়িয়ে নিচ্ছি ভাইরাস

― ভারবাহীদের গান ১৯৮৩ সালে প্রকাশিত হয়েছিল। ইতিহাসের বিচারে সেটি সামাজিক ক্লিন্নতার সময়। একটা নিরাময়হীন সত্তা কবির ভেতর ক্রমশঃ সাম্রাজ্য তৈরী করছিলো। ব্যক্তিগত সাফল্যের ধার ধারলেন না কবি। সময়কে ধিক্কার জানাতে এগিয়ে এলেন।――

“বুক ভরে নিশ্বাস নিতেও ভয়

একঝলক বিষ ঢুকেছে ফুসফুসে। তারগুলো বৃদ্ধের ছানিপড়া চোখের তারা

 বৃষ্টি পড়ছে ঘোলাটে চোখের মনি ছাপিয়ে মাটিতে। আমি

বুড়ো হয়ে যাচ্ছি, তুমি’

——হাজার বছরের পথ চংক্রমণে কখনো রুক্ষ পথগুলো গুলুওস্তাগর লেন ছাড়িয়ে তুর্কেমেনের দিকে কখনো সাইবেরিয়ায় এসে থেমেছে চিড়িয়াখানায় হ্রদে হাঁসেদের মাইগ্রেশন দেখতে। কবির মনে হয়েছে গাছের ডালে ওদের অস্থায়ী সংসার, সুন্দর পাখনা ছড়িয়ে ভেসে থাকা, সবই ভারবাহী মানুষদের জীবনের প্রতিলিপি। কবির মনে হয়েছে এই পণ্যসভ্যতা এবং মানুষের যন্ত্রীকরণ জীবন চক্রের অনিবার্য পরিণাম। তবে আশার কথা এই যে, এই চাপের বিপরীত দিক থেকেও কয়েকজন সিসিফাস পাথর তুলতেই থাকবে। যদি এমন মনে করি সেই প্রতিরোধ-চেতনাটিকে সমগ্রের মধ্যে কবি চারিত করতে চাইছেন, তাহলে ভুল হবে না। কবি অঙ্গুলি নির্দেশ করেছেন। একটা তামসিক নিষ্ক্রিয়তার দিকে।―

“ভুরু কুঁচকে ফুটো করছে গাড়ির টায়ার দুই দেবদূত। ওদের চোখে ক্ষোভ আর ঘৃণা হিংসা আর লোভ

কেমন স্নাক ফেটে স্তন পড়ছে লাফিয়ে

নিতম্বের ঘষায় জ্বলছে বিদ্যুৎ

আহা, দেবকান্তি তরুণীর দল

––বিলোও কিছু করুণা এইসব অপাত্রে, আমরা খিদের জ্বালায় খুবলে খাচ্ছি নিজেদেরই শরীর। জ্বলছে তোমাদের উদ্দাম উরুর ঘর্ষণে বাড়ে তৃষ্ণা প্রেম দাও একটু

প্রেম অন্তত

একদিনের বাদশা বনে যাই তোমাদের কৃপায়।”

পবিত্র মুখোপাধ্যায়ের সার্থকতা শুধু নৈরাজ্য বর্ণনায় নয়, কিম্বা মানুষের মধ্যে নৈরাজ্য বিতরণ করায় নয়। কবির তিমির বিনাশী সত্তা একটা আলোর পাখি হয়ে জাগ্রত প্রত্যাশার ধ্বনি শুনিয়ে যেতে চায়। একথা সত্যি, কবি নিজেও এক ভারবাহী মানুষ। তবুও অন্ধকারকে অতিক্রম করার স্বপ্ন দেখতে জানেন আশাবাদী পবিত্র মুখোপাধ্যায়।――

‘একদিন কেউ এসে আকাশ থেকে একটানে খুলে ফেলবে শবাচ্ছাদন, আর তখনই ঝলমল করে জ্বলে উঠবে নক্ষত্রমণ্ডল’

তিনি জানেন ‘জন্মাচ্ছে শিশু ইসলামিয়ার ফ্রি বেডে / আর একটি কাগজকুড়ানী যন্ত্রের শুভ আবির্ভাব’ তথাপি তিনি বলতে পারেন ‘লাফিয়ে উঠে মলিনসূর্য মনুমেন্টের চূড়ায় ওঁ জবাকুসুমসঙ্কাশং । পিছলে পড়ছে সূর্য গঙ্গার ঘোলাটে জলের বয়ার উপর’

নির্জনে কবিতায় ফুল ফোটাতে চেয়েছেন কবি। শিশিরভেজা সকালে স্বর্ণালী সন্ধ্যায় লেকের সান্নিধ্যে দাঁড়াতে চেয়েছেন কবি। সেখান থেকে নিবিষ্ট মনে দেখতে চেয়েছেন পাখিদের কুলায় ফেরা, খুঁটে আনা শস্যদানা ক্ষুধার্ত ছানার হাঁ-এর মধ্যে পুরে দেওয়া। যদিও এর সবটাই মনে হয়েছে ভারবাহী জীবকূলের একটা দিনের ভাঙা চাকা গড়িয়ে নিয়ে যাওয়ার ব্যাকুলতা। মনে হয়েছে এ এক অবক্ষয়িত জীবনের তীরে দাঁড়িয়ে দুখজাগানিয়া গান শোনা। এরই মধ্যে উঁকি-ঝুঁকি দিয়েছে কলকাতায় রূপময়ী দেবকন্যাদের কথা ভেবে বেঁচে থাকার জড়-স্পৃহা। তারই মধ্যে থেকে কবি পঁচিশে বৈশাখে, ‘গুরু’ নামে জীবন বাঁচানোর এক অদ্ভুত খেলা দেখেছেন। কিন্তু আটকাতে পারেন নি ক্ষুধার্ত দিনের আস্তে আস্তে গিলে ফেলা গোটা সাম্রাজ্যের অবক্ষয়। অদ্ভুত বৈপরীত্যে রাজাবাজারের বস্তিতে যখন শিশু জন্মাচ্ছে ইসলামিয়ার: ফ্রী বেড়ে, যখন জন্ম হচ্ছে আরেকটি কাগজ কুড়ানী যন্ত্রের, তখন বাতাস মথিত করে ভাসছে,

‘ঐ মহামানব আসে

দিকে দিকে বাজে জয়শঙ্খ

জয় হোক নবজাতকের

জয় হোক চিরজীবিতের।’

পবিত্র মুখোপাধ্যায়ের গভীর গোপনে আছে এক আনন্দসত্তা, যার ডানামেলার আকাশ রবীন্দ্র সম্ভারে মিশে গেছে – ‘বসন্ত এসেছে, ফুটপাতে রবিঠাকুরের গান —

ক) “মহামানব আসে…….”

খ) “….এই ঝর্ণাতলার নির্জনে”

গ) “সেদিন দুজনে দুলেছিনু বনে”

ঘ) “ওগো দুঃখ জাগানিয়া…… “

ঙ) “প্রেম আসে নিঃশব্দ চরণে”

 

একটি উল্লেখযোগ্য পংক্তির উদ্ধৃতি – ‘হাজার বছর ধরে হাঁটছি তো হাঁটছিই

পথ রুক্ষ —

এখানে জীবনানন্দের জীবনবৃত্তের চতুর্থ মাত্রার কথা সহজেই চোখে

পড়ে।

এছাড়াও রয়েছে অন্যান্য আরো সশ্রদ্ধ উদ্ধৃতি –

 ক) “যদিও সন্ধ্যা নামিছে মন্দমন্থরে।”

খ) “স্বপ্ন এখন সবিতা অমাবস্যার দেয়ালি।”

 গ)” এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে না কো তুমি।”

 ঘ) “প্রেম করো প্রেম হবে ধুলোর সংসারে এই খাঁটি।”

ঙ) “মেলাবেন তিনি মেলাবেন।”

চ) “ধান করো ধান হবে ধুলোর সংসার এই মাটি।”

 ছ) “গভীর কোরে তাকায় চোখে জলের অতল কান্না।”

 

মানুষের অন্তর্নিহিত শুভবোধ ও মুমুক্ষু চেতনার প্রতি গভীর বিশ্বাস থেকে তিনি বলতে পেরেছেন,

“হে অম্লান কিশোর, স্তোকনম্রা কিশোরী

 তোমাদের যৌথ আত্মা যেন দূরলোকের সংগীত।’

 

আসলে পবিত্র মুখোপাধ্যায়ের মহাকবিতায় যত অন্ধকার, ততটাই আলো।

ঝাঁকড়াচুলো বিপ্লবী কবিরা যেমন মিছিলের গান গায়, তেমনি দাড়ি কামায় নিখুঁত করে।

 এরোপ্লেনে পাড়ি দেয় ইন্দ্রলোকের দিকে। কুবেরপুরী দিল্লীতে ঝলমলে রাজপথে স্কাইস্ক্যাপারের তলায় ড্রেনে ইঁদুর গোপন সংসার পাতে। হাড়গিলে মানুষেরা ক্ষেতের গন্ধে বিভ্রান্ত, পাথর ভাঙে। তাদেরও হৃদয়ে লেগে থাকে খুদের গন্ধ আকাঙ্খার।

এরই মধ্যে দ্রোহ জাগে মানুষের মনে। তবুও তাদের মুষ্ঠিবদ্ধ হাত কেবল শূন্যে ঘুরেই আছড়ে পড়ে নিজেদের ফাঁপা বুকে। এই চরম অবক্ষয় তবু শেষ তো হোক।――

 “বাসি থকথকে ঘিলু ঠোঁটের কালসিটে মাংস

খাক ও ছিঁড়ে খুঁড়ে

শেষ হোক আমাদের এই থ্যাতলানো পায়ের অভিযান।”

 এই গভীর নৈরাশ্যের মধ্যেও কোথাও যেন জেগে রয়েছে একটা অন্তর্লীন আশাবাদ ও মুক্তির সুর। এই বিশ্বব্যাপী অনর্থক ছক থেকে তাই দাবার খুঁটি সরিয়ে নিতে আগ্রহী হয়েছেন কবি।

 মৃত্যুও এখানে রমণীয়। মৃত্যুর মধ্যে দিয়ে নৈরাশ্যের অবসানকল্পে জন্ম নেবে পৃথিবীর নতুন ঈশ্বর আর তা জন্ম নেবে ভারবাহী পশুদের মধ্যে থেকেই এমন একটা সংগুপ্ত ইচ্ছায় পবিত্র মুখোপাধ্যায় মহাকবিতাটি শেষ করেছেন।

==========================