You are currently viewing ভাটির টানে/ এলিজা খাতুন

ভাটির টানে/ এলিজা খাতুন

ভাটির  টানে/এলিজা খাতুন

বৃষ্টি থেমেছে ; সায়েমা পেছনে পিচের রাস্তা ফেলে এসেছে অনেক্ষণ। ইট সলিংএ খানিক পথ এগিয়েছে বেশ ভালোভাবেই। এখন সামনে যত যাচ্ছে পিছলে পড়ার সম্ভাবনা বাড়ছে। সায়েমা আগেই শুনে এসেছে দুই কিলোমিটার পথ কাঁচা। মাঠে আসার আগে নিশান্তর কাছ থেকেও এনজিও সম্পর্কে জেনেছে অনেক কিছুই।

গ্রামের  মানুষগুলো  সকাল থেকে শহরের দিকে আসছে। পায়ে পায়ে কাদা উঠে আসছে এদিকে, ইটসলিং এর উপরে পানি কাদার প্রলেপ পড়েছে জায়গা জায়গা। দূর থেকে সামনে যতদূর দেখা যাচ্ছে ইটের লাল রং তত অস্পষ্ট। মাটির পথ খুব কাছেই। খটং মটং শব্দে পাশ কেটে দু’একটা করে বাইসাইকেলে দুজন করে করে পার হয়ে পিচের রাস্তার দিকে উঠে আসছে। সায়েমা  পিচ পথ, ইটসলিং সব পেছনে ফেলে আড়াআড়ি  উঁচু মেঠো পথের গায়ে এসে ঠেকলো। বেশ উঁচু পথ, মাটি দিয়ে বাঁধ দেওয়া, বাঁধের উপরে মাটির পথ। নিচু জমির এলাকা ও রাস্তাঘাট থেকে বাঁধের উপরের মেঠো পথের অবস্থা ভালো মত বোঝা যাচ্ছে না। তবু স্বস্তি হচ্ছে সায়েমার- অফিসের ম্যানেজারের বর্ণনা অনুযায়ী মিলে যাচ্ছে পথ ঘাট।

মোটা জিবলী গাছের কচা টেনে তাতে ভর করে উঁচু পথের উপরে উঠতে হলো। পথের দিকে দূরে তাকিয়ে সায়েমা মনে মনে বলল- একি অবস্থা ! ধান রোয়ার আগে ক্ষেত যেমন থকথকে কাদা করে তোলা হয়, এ মাটি-পথ তেমনই ! থকথকে কাদার আবাদ করে রেখেছে যেন কেউ।

সায়েমা দাঁড়িয়ে একটু দম নিয়ে ; চোখের ভেতর পথের দূরত্ব তীরের মত বিধিয়ে নেয়। পথ উপচানো কাদার ভেতর পায়ের চিহ্নগুলো কাঁথায় সেলাই ফোঁড় তোলার মত বিছিয়ে আছে। দু পাশে সারি সারি বাবলা গাছ, বাবলার ছোট হলুদ ফুল, কাঁটা কাদা মিলেমিশে একাকার।

পা থেকে জুতো জোড়া  খুলে এক হাতে নিল, অন্য হাতে পাজামা টেনে গুটিয়ে এক পা দু’পা তুলে এগোনোর চেষ্টা সায়েমার। ডানে বামে চেয়ে দেখছে দু পাশে নিচু বিস্তীর্ণ ধানের জমি। আবার সামনে দৃষ্টি ; এক একটা পদক্ষেপ কাদার ভেতরে যত সহজে পুতে যাচ্ছে, পুনঃ পদক্ষেপের জন্য  সেখান থেকে পা টেনে তোলা ততটা সহজ নয়। কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে এভাবে কিছুদূর চলল।  প্রচন্ড গরম না পড়লেও কাদার সাথে পদযুদ্ধে এতক্ষণে পিঠ ভিজে উঠেছে ঘামে। কপালে বিন্দু ঘাম, দু’পাশে কানের লতির নিচ দিয়ে, কন্ঠা চুঁয়ে আসা ঘাম গলার নিচে এসে মিলছে।

একজন বয়স্ক মানুষ ওদিক থেকে আসছে, সায়েমা মুখ তুলে দেখলো পথের ধার দিয়ে হাঁটছে লোকটি, খুব সহজ ভঙ্গিতে। স্বাভাবিক তার পায়ে চলার গতি। সায়েমার পাশ দিয়ে বিপরীতমুখী অর্থাৎ শহরের দিকে যেতে যেতে বলল-

– উরাম মদ্যিখানতে হাঁটলি বোলো আগুতি পারবা না খুকি, ধারদে ধারদে হাঁটা ধরো। ও যোমের মদ্যি পুততি গিছাও ক্যান !

পথের ধারের দিকে তাকালো ; শিউরে ওঠে সায়েমার শরীর, কাদার গভীরতা কম হলেও ভয়ানক পিচ্ছিল। দু’পাশে খুব ঢালু ধানের জমি, কোমর সমান পানি। এসব জলাভূমিতে এখন আমন ধান হয়েছে। থৈ থৈ পানিতে হাবুডুবু খাচ্ছে ধানগাছের আগা।

নিম্নপক্ষে সাত-আট ফুট লম্বা হয় আমন ধান। কোনভাবে পা পিছলে পড়লে সায়েমাকে ধানগাছগুলোর  মতো গলা ডুবিয়ে থাকতে হবে।

কিন্তু এভাবে আর কতদূর ? হাঁপিয়ে উঠেছে, পেছনে ফিরে তাকায় ; চলার গতি থেকে অনুমান করার উপায় নেই কতদূর এলো, আর কতদূর বাকি ?

তখন  পেছন দিক থেকে ইট বোঝাই একটা পাওয়ার টিলার আসতে দেখা গেল। এই কাদাপথটাকে পাওয়ার টিলারের চাকাগুলো ধানের জমি হিসেবে নিয়েছে যেন! পাওয়ার টিলারে ভরা ইটগুলো উপরে সমতল করে সাজানো। তার উপরে একজন পুরুষ একজন মহিলা বসা। চালক সহ তিনজন। কাদায় পা ডুবিয়ে সায়েমা পেছন ফিরে তাকিয়েছে, টিলারের উপরে বসা মহিলাটিও দূর থেকে দেখতে দেখতে আসছে। সায়েমার পরিপাটি জামাকাপড়, কাঁধে ঝোলানো ব্যাগ দেখে বুঝতে অসুবিধা হলো না তার- মেয়েটি এ পথে হাঁটতে অনভ্যস্ত।

টিলারের ভটভট শব্দের সাথে পাল্লা দিয়ে চেঁচিয়ে সায়েমাকে উদ্দেশ্য করে বলল-

– ও মেইয়্যে ! গাঁয়ে পা দিতি হেনো  মিলা দূরস্তার ; ওটপা নাই ?

চালকের দিকে হাত বাড়িয়ে থামতে বলে,-

– এ ময়না খাড়া খাড়া, তোর ইসটাট থামা, মেয়েডারে উটায় নে।

বলতে বলতে পাওয়ার টিলারটি সায়েমাকে ছাড়িয়ে গেছে কয়েক ধাপ। পানের পিক ফেলতে ফেলতে এড়ানো কথার মত করে বলল সায়েমাকে-

– তোড়ে এস্যু

সায়েমা ভাবছে মন্দ হয় না। না উঠার সিদ্ধান্ত নেবারও সময় নেই ; এমনিতেই অনেক দেরি হয়ে গেছে। কাদায় ভারি হয়ে যাওয়া পা দু’টো  কোনমতে দু’চার ধাপ বাড়িয়ে পাওয়ার টিলারের উপরে উঠল, মহিলাটি একপ্রকার টেনে তুলল। পা ঝুলিয়ে পেছনে বসল। কোলের পরে কালো ব্যাগ, অন্য হাতে জুতো জোড়া।

ইতোমধ্যে পাশে বসা মহিলাটি পাতার বিড়ি ধরিয়েছে। সায়েমার মাথা ঘুরছে। কাদার সোঁদা গন্ধ, বাবলা পাতা-ফুলে বাতাসের মাখামাখি হালকা গন্ধটাও মন্দ লাগেনি এতসময়। মহিলার নাক মুখ দিয়ে ভক ভক করে বের হওয়া তামাকের ধোঁয়া সায়েমার পেটের ভেতর থেকে গুলিয়ে আনছে। নামতে পারলে বেঁচে যায়।

খানিকটা পথ যাবার পর স্টার্ট বন্ধ করে মহিলাটি বলল-

– লাবতি পারবানে ?

সায়েমা বসে থেকেই চারপাশে তাকিয়ে ম্যানেজারের বর্ণনার সাথে এ স্থানের মিল খুঁজছে। বড় নিমগাছ, নিচে ছোট্ট দোকান, দশ বারোটা বয়োমে- কাঠি চকলেট, গুলিমিঠাই, মিছরি, লবন, হলুদ ইত্যাদি, পাঁচ ছয়টি রং বেরং এর মোড়কে সাবান।

ততক্ষণে মহিলাটি নেমে পেছনে এসে সায়েমাকে নামতে সাহায্যের জন্য হাত বাড়ালো। এখানটায় কাদা কিছুটা কম, কেন তা  বোঝেনি এখনও। মহিলার হাতে ভর করে নেমে পড়ল একলাফে।  সামনে ফিরে বুঝতে পারলো পাওয়ার টিলার এসে থেমেছে একজনের বাড়ির উঠোনে। রাস্তার দিকে ঢালু হয়ে নামা উঠোনের একপাশে বালির স্তুপ ; পানি দাঁড়ায় না; উপরন্তু বালি ধুয়ে গড়ে সারা উঠোনে ছড়িয়েছে খানিক, কাদা বিহীন উঠোন।

মহিলাটি মুখে রহস্য হাসি নিয়ে প্রশ্ন করল

–  ঠিক জাগামত নে আইছি তো আফা ?

মহিলাটি সায়েমাকে হাতের ইশারা করে ডেকে নিয়ে সামনে সামনে চলল; কিছুদূর এগিয়েই চোখ পড়ল- একটা কাঁঠাল গাছে পেরেক ঠুকে ঝুলানো সাইনবোর্ডে অফিসের নাম লেখা –  ‘প্রসারণ ক্ষুদ্রঋণ, ইসলামপুর মহিলা সমিতি’।

এবার সে নিশ্চিত হলো গন্তব্যে এসে গেছে। হাঁটু পর্যন্ত কাদা পা, কাঁধে কালো ব্যাগ, লম্বা গড়ন, পরিপাটি পোশাকে  সায়েমাকে দেখে দুজন মহিলা এগিয়ে এলো,

প্রথম জন–  ও আফা আইজগেত্তে তুমি আসপেন ?

২য় জন –  মিলা সমাত্তে বসি রইছি। পত্তম দিন আপনার সঙ্গে লোক দেইনি ক্যান ?

সায়েমা  স্মিত হেসে বলল-

– রাস্তার যা অবস্থা ! লোক দিলেই বা কি হতো

বারান্দার চৌকিতে হাত বাড়িয়ে ব্যাগটা রেখে টিউবয়েলে পা ধুয়ে নিচ্ছে ; ততক্ষণে পরিচয় পর্বও প্রায় এগোচ্ছে, ইতোমধ্যে আরও জনা চারেক হাজির,

– আফার বাড়ি কোয়ানে ?

– আফা তোমার বে হয়্যি ?

– ও আফা তুমি থাকপান তো ? আমাগের কেন্দ্রে কোন সার আফা বেশিদিন টেকে না ; ক্যান তা কিজাইন ?

সায়েমা ব্যক্তিগত প্রশ্নগুলো এড়িয়ে উত্তর দিল।

–  আপনাদের গ্রুপে কতদিন আসতে পারবো পরিস্থিতি বলবে। ভালো আছেন আপনারা সবাই ?

একসাথে কয়েকটি কন্ঠে উত্তর-  হ্যায় !!

প্রশ্নটি করে সায়েমা নিজের কাছেও প্রশ্নের সম্মুখিন হলো। এই মানুষগুলোর ভালোথাকাটা কোন পর্যায়ের? কতটুকু ভালো থাকলে ওদের সঠিক ভালো থাকা বলা যায় ?

মহিলাটি ততক্ষণে অস্থির হয়ে উঠেছে ;

– আফা এবারডা আমার ছাড়ো, এট্টু ব্যস্ত ব্যস্ত লিকি দ্যাও, বলেই  একশত টাকা এগিয়ে দিলো।

সায়েমা পাশবই হাতে নিয়ে দেখলো পাঁচ হাজার টাকা ঋণের সাপ্তাহিক পরিশোধের  কিস্তি  আকারে একশ পঁচিশ টাকা, সাপ্তাহিক সঞ্চয় পঁচিশ টাকা। সায়েমা  মেয়েটির মুখের দিকে চাইল; এখনও ৫০ টাকা ঘাটতি।

কিছু বলার আগেই মহিলাটি ঝটপট করে বলল-

– আফা পঁচিশ টাকা কম আছে, দেকি বাড়ি যেইয়্যে। কডা হাঁসের ডিম বিক্কির কইরে দে যাতি পারি কি।

– ২৫ নয়, ৫০ টাকা ঘাটতি। প্রথমত পঁচিশ টাকা আপনার সাপ্তাহিক সঞ্চয়,  আরও পঁচিশ টাকা আপনার ঋণ পরিশোধের দরুণ । সঞ্চয় করাটা বেশি জরুরী।

– এ আফা দেকতিছ  উল্ডো কতা কচ্ছে। হ্যাতোকাল ঝ্যাতো স্যার এয়্যিছে সকগুলি কইছে- সঞ্চয় দেও চাই না দেও  কিস্তি মাপ নেই।

পাশবই হাতে নিয়ে  সায়েমা খেয়াল করল-  সুদসহ ঋণ পরিশোধের  ঘর পূরণ থাকলেও  প্রত্যেকেরই  সঞ্চয়ের ঘর ফাঁকা। সঞ্চয় মনোভাবহীন এরা সবাই। বরং ঋণ পরিশোধ করে আবার ঋণ গ্রহণ করে।

রেজিস্টার লেখার ফাঁকে ফাঁকে আনমনা হওয়া সায়েমার মুখে তাকিয়ে একজন বৃদ্ধা বলে উঠল-

– খুকি,  কিস্তি নিকতি ভুল কইরে না, আমাগের নক্ত পানি কুরা টাকা। আগের সার আমার দুই কিস্তির টাকা মেইরে দেছে। আমি তো নোজ নোজ আসতি পারিনে, ছাওয়ালের বউ নে আসে ; বউডা এট্টু সরলপানা। কদিন কাদা পাইনতে পাতা মেইরে আমার পার তুলা ফেইটে হা হই গে। নক্ত বের হতিলো দেক্যি সুক্কাল বিলা বউ কল্যে আইজগে তুমার পাতা মারতি যেত্যি হবেনা, আমি যাবানে। তুমি নাই বইকান নে সুমিতিত যাইয়্যানি। তাইতি আইচি খুকি। দেকি শুন্যি ঠিক করে নেকো ।

বৃদ্ধার ভাঙাচুরো এবড়ো থেবড়ো দাঁতে চিবোনো পান খাওয়া বেশ ভালো লাগলো ; ফুক ফুক করে বের হয়ে আসা জর্দার ঘ্রাণটুকুও।

বৃদ্ধার কথা শুনে অন্যজন বলল-

– ওরে আর কইস নে, সানু’গের বাড়িতি যে সমিতি বসে উকিনতে লোন নিলাম, আমারও দুডো তিনডি কিস্তির টাকা মেইরে নেছে ঐ দাঁত ক্যালানি আফা।

ওদের উচ্চারিত প্রত্যেকটি কথা শুধু শুনছে না সায়েমা, শব্দগুলো আঘাত করছে  মাথায় ; নিজেকে খুব অসহায় লাগছে এই ভেবে যে-  এসব হতদরিদ্র মানুষদের কাছে কিভাবে কোন্ উপায়ে নিজেকে প্রমাণ করবে,-  এই মেয়েটি ওদের কষ্টের টাকা ফাঁকি দিয়ে নেবে না। নিজের হিসাব-বইয়ে এন্ট্রি দেওয়া হিসাবটা পড়তে পারে না  যারা ; আসলেই কি ওরা ফাঁকির চোরাবালিতে ডুবছে না ? চক্রবৃদ্ধির অংক শিখে যারা এ অংকের অপব্যবহার করে লুফে নিচ্ছে চক্রবৃদ্ধিহারে সুদের সমুদ্র ; তারা ফাঁদ পেতে রেখেছে রক্তচোষার মত।

সম্বিত ফিরলো চাচির কথায়-

– ও খুকি, পচ্চিম পাড়ার গুরুপ চেনো তো ? এ মনা … এ মেয়েডার সাথে গে দিকাই দে আয়, পেত্তম দিন চেনবেন না।

– আফা চলো, তুমার দিকাই দে এস্যি কডা ঘ্যাঁটকোল তোলবো। আমি মেইয়ে লোক হইয়ে কদিন চালাবো কও দিনি ? আইজগের কিস্তির টাকা জোগাড় করিচ কুঁড়ো বেচে।

কুঁড়ো বেচা কথাটা শুনে চমকে উঠলো সায়েমা। বাড়ির কথা মনে পড়ল, সেই সাথে মায়ের মুখটা।  ইতোমধ্যে সায়েমা রেজিস্টার, ব্যাগ,  টাকা গুছিয়ে উঠে পড়েছে।

পথ প্রদর্শক মহিলা আগে না চলে পাশাপাশি হাঁটছে, গলার স্বর নামিয়ে বলল-

– আফা এইবারডা এট্টু বেশি করে লোন দেবেন, আগেরবার টাকা নে কুলোন দেয়নি।

– কি করেছিলেন ?

– গাভী কেনার জন্যি নিলাম,

– কয়টা গাভী আছে বর্তমান ?

– গাভী নেই

– মানে ? বেচে দিয়েছেন ?

– না, সে কিনতি পারিনি। মেয়ে বিয়ে দিলাম

সায়েমা হঠাৎ হাঁটার গতি কমিয়ে মহিলার মুখের দিকে তাকালো, আস্তে করে উত্তর দিল-

– ও , তা এবার কি কাজের জন্য নেবেন ?

– গাভী পালন

– কত টাকা হলে একটা গাভী কিনতে পারবেন ?

– এই যুগে গাভী কিনে পুষ্যে লাভ করা মুকির কুতা ? কাগজে লিকতি হয় তাই তুমি লিকি দিয়ানে। শোন মা , তুমি তো অপিসি কতি যাচ্চাও না, তুমার সঙ্গে কলি দোষ নিই। তুমি হলি নিজেগে লোক। এইবারা টাকা তুলতি হচ্ছে মেইয়ের সিজার করাতি লাগবে তাই। এইরাম বিপদ আপদের সময় কাজে লাগবে, তাইতি সমিতি করিচ মাগো।

সায়েমা বাকরুদ্ধ।

পদে পদে নিশান্তর কথা মনে পড়তে লাগলো সায়মার। আজকাল শিক্ষিত মেয়েদের বেশি বেশি চাকরি হয় এনজিওতে। নানা রকমের বাণী-বক্তব্য চালু আছে এ নিয়ে, নারী-সমতা কথাটা তার মধ্যে বেশি চালু। এখানে যে টাকা আদায়ের জন্য এসেছে সে, এখানেও নারী সদস্যদের সংখ্যাই বেশি। আসার পথে যত মানুষ শহরমুখো যেতে দেখেছে- প্রায় সবই নারী, তাদের হাতে ঝুড়ি কোদাল। নিশান্ত অনেক জ্ঞান দিয়েছে তাকে, নিজের প্রাত্যাহিক কাজকর্ম আর চাকরি জীবনের নানা মজার গল্পও শুনিয়েছে,-

সেদিন  নিশান্ত আলু সেদ্ধ  দিয়ে রাইসকুকারে ভাত বসিয়ে বাড়ির সব কাজ দেখভাল করে,মা বাবাকে  সকালের ঔষধ- চা-টোস্ট দিয়ে, ঘরদোর গুছিয়ে, স্নান সেরে রেডি হয়ে অফিস বেরুলো ; উদ্দেশ্য  সময়মত পৌঁছাতে পারা !

বাড়ি থেকে মিনিট পাঁচের পথ ইট সলিং, তারপর পিচ রাস্তা। পানি জমে ছপ ছপ করছে। রাস্তায় জমে ওঠা লালচে কাদা পানি পচাৎ করে ছিটকে এসে কামিজে পড়ল। সাদা জামায় পানির লালচে দাগ গুলো তাকিয়ে আছে যেন। সকালে স্বচ্ছ রোদ দেখে সাদা পরেছে, আকাশের গোমড়াভাব আগে টের পেলে অন্তত এটা পরতো না। জামার অবস্থা দেখে মেজাজ বিগড়ে গেল, অবশ্য অফিসে এক্সট্রা ড্রেশ রাখা আছে। সামনে কিছুদূর এগোলেই চার রাস্তার মোড়। দু’চারটে চা’এর দোকানে পাড়ার গোটাপাঁচেক নামধারী সমাজসেবক বসে থাকে, চা’এর কাপে তাদের অলস ভোরগুলোকে ঝাঁকিয়ে গুলিয়ে পান করে।

বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়ানোর পর অবশেষে একখানা পা চালিত ভ্যান পেল নিশান্ত।

–  চাচা যাবেন ?

ভ্যান চালক চাচা ইশারায় উঠতে বলে দাঁড়ালেন, হাঁপাচ্ছেন, ঘামে গোসল করছেন। দেরি না করে চেপে বসল, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ভাড়া আগে থেকে চুৃকিয়ে উঠলেও আজ সময় নেই। মোড়ের বাঁক ঘুরে টানা পিচ রাস্তায় এসে নিশান্ত জিজ্ঞেস করল-

– চাচা, গত দুদিন থেকে ব্যাটারি চালিত ভ্যান একটাও দেখছিনা, একেবারেই বন্ধ করে দিল ?

– আপনার আর কি বলবো মাগো ; তাগ্যের সব আইন কানুন গরীব-গুরবার উপরে, সমিতি থেইকে তিরিশ হাজার টাকা ঋণ তুইলে চার্জার ব্যাটারি কিনিলাম, সিডা এখন থানায় আটকানি। কিস্তি দিতি পারতিছিনে, সমিতির ছার এসে ঘরের চাল খুইলে নিতি চায়, ঝ্যাতো জ্বালা আমাগ্যের।

পথিমধ্যে একজন ভদ্রলোক উঠলো ভ্যানের সামনে ডানদিকের সিটে।

নিশান্ত স্বভাবসিদ্ধ চালে ভ্যান চালকের সাথে আলাপে মেতে উঠলো, বাড়ির খোঁজখবর নিল। এক সময় ভ্যান চালক দুঃখ করে বলল-

‘গতরডারে এট্টু আরাম দেই, সে কুপাল নে আসিনি মাগো ; এদিকি পুলিশি ব্যাটারী খুল্যে নেছে, আবার ওদিকি ঠিকই ঋণের কিস্তি টানতি হতিছে, এদিকতে চুষতিছে, ওদিকতে চুষতিছে”

নিশান্ত  চাচার কথার মধ্যেও খুঁজছে তার ঘাম-ভেজা টাকায় কেনা ব্যাটারির  বৈধতা-অবৈধতা।  ঘামে ভেজা টাকা’ই তো!  তা দিয়েই তো ব্যাটারী কেনার ঋণ শোধ করছে তাও আবার সুদেআসলে। পাশে বসা লোকটির কথায় নিশান্তর সম্বিত ফিরলো ;

– ঋণ নিলে তো শোধ করতেই হবে চাচা ! দেশে এনজিওগুলো  এসেই গরীব মানুষগুলো বেঁচে গেল।

অবশ্য চালক চাচাও সে কথায় সম্মতি দিল-

– হ্যায় ! তা না হলি একসাথে এত টাকা নিজের ভাইও ভাইকে দেয় না আজকাল।

– গরীব নিঃস্ব মানুষগুলো টাকার মুখ দেখেছে, সংসারের উন্নতি হয়েছে তাদের সব এনজিওদের বদৌলতে, কি বলেন আপা ?  বলল লোকটি।

আপা শব্দটি কানে আসতেই নিশান্ত ভাবল- সৌজন্যর সুবাদে তার উত্তর করা উচিত।

– হুম, বেঁচে গেল বলছেন, সেটা কিরকম ?

– এই যে দ্ররিদ্র শ্রেণীর মানুষেরা সহজেই টাকা পাচ্ছে, এটা কি কম ব্যাপার ?

– ব্যাপার কম নয়, বেশ লাভজনক। তবে তা দরিদ্র মানুষগুলোর নয়।

– মানে ? লোকটি যে মতামত আশা করেছিল তা দপ করে নিভে গেল। নিশান্ত আবার বলল-

– আচ্ছা বলেন তো –  এত বছর ধরে আপনারা দরিদ্রশ্রেণীকে টাকা দিয়েই যাচ্ছেন, তাতে কি দারিদ্র্য মোচন হয়েছে কানাকড়িও ?

– তাহলে এসব এনজিও যে এত হাজার হাজার, লক্ষ লক্ষ টাকা ছড়িয়ে দিচ্ছে  গ্রামে গ্রামে সেসব কিচ্ছু না!

– ক্ষুদ্রঋণ আসলে ঋণগ্রহীতার দারিদ্র্য কমায় না, বরং আরও বাড়ায় ।

– ক্ষুদ্রঋণ নিয়ে কেউ কি স্বাবলম্বী হচ্ছে না ?

– হচ্ছে, আচ্ছা বলুন তো- মহাজনী কাজ কারবারের সঙ্গে বিদ্যমান  ক্ষুদ্রঋণের তফাৎ কতটুকু ?

– শুনুন আপনি কিন্তু এভাবে আঙ্গুল তুলতে পারেন না। ক্ষুদ্রঋণ নিয়ে ঋণগ্রহীতার উন্নতির অনেক সুন্দর সুন্দর প্রমাণ আছে। আপনি দেখবেন ?

– এমন মানুষের সংখ্যা কত ? ক্ষুদ্রঋণের সবচেয়ে চমকপ্রদ ব্যাপার  এই যে-  এটা দারিদ্্র্য দূরিকরণে সম্পূর্ণ ব্যর্থ একটা প্রোগ্রাম। এই দুর্ভাগ্যজনক প্রপঞ্চটি বাস্তব এবং সত্য হওয়ার পরেও এটি টিকে আছে !

– ঠিক আছে যুক্তি দেন…

– এই হতদরিদ্র গোষ্টিটার পক্ষের যুক্তি-তর্ক সময়ের কাছে বাঁধা পড়ে যায় সর্বদা।

– তার মানে ?

– মানে আমাকে এখানেই নামতে হচ্ছে, সেই সাথে থামতেও হচ্ছে ; তবে প্রসঙ্গটা থামানোর নয়।

গেটের উপরে সাইনবোর্ডে  বড় অক্ষরে লেখা  ‘ মানবিক সাহায্য সংস্থা ’ এটা দেখিয়ে লোকটি বলল-

– এটাই আপনার অফিস ?

– জ্বি,

নিশান্ত ভ্যানভাড়া মেটানোর ফাঁকে লোকটি কার্ড বের করে এগিয়ে দিল। ভ্যান চলেও গেল। রাস্তা ক্রস করে অফিস ক্যাম্পাসে ঢুকে কার্ডটিতে চোখ রেখে আশ্চর্য হলো। এতক্ষণ ক্ষুদ্রঋণের বিরুদ্ধে নিশান্ত যাকে এত কথা শুনিয়েছে, ইনি ক্ষুদ্রঋণ প্রোগ্রামের রিজিওনাল ম্যানেজার ! এ ধরণের বিব্রতকর অনেক গল্প আছে নিশান্তর জীবনে।

৩য়  গ্রুপে যাবার  মাঝপথ,  মাঠ ছাড়িয়ে  দূরে  চোখে পড়লো ফাঁকা বিলে চিকোন আইলে ঘেরা কাদাপানির এক একটি জমিতে  সারিবেঁধে ধান রোপণ করছে নারীরা। বাঁ দিকে  বাঁশতলার নিচ দিয়ে ছায়া ছায়া সরু পিচপথ।  সায়েমা হাঁটতে হাঁটতে সভানেত্রীর নাম জিজ্ঞাসা করে জানলো সম্মুখে  কিছুদূর এগিয়ে কেন্দ্র।

চিতোই বেড়ায় ঘেরা বাড়ির উঠোনে ঢুকলো সায়েমা বাঁশের চটার গেট ঠেলে। লম্বা বারান্দাসমেত এলশেপড মাটির বাড়ি। সিমেন্টের বস্তা  বিছিয়ে বারান্দায় পা মেলে বসে মায়ের সাথে খুঁনসুটি করছে একটি কিশোর।

মহিলাটি  সায়েমার দিকে তাকিয়ে বসতে বলল, ‘আগের দিন স্যার কয়্যে গেলো, সুমিতির আফা তুমি?’

– হ্যাঁ । সদস্য কেউ আসেনি ?

ওপাশ থেকে আরেকজন-

– ইকিন সদস্য কোয়ানে পাবা ? সগ্গুলির বাড়ি গে নে এসতি হয়, তামাদি হয়্যি গে সব।

রেজিস্টার খুলে দেখলো তেইশজন সদস্য। পাঁচ/ ছয়জন ছাড়া অনিয়মিত সবাই। সদস্যদের ডেকে আনতে বড় বউ বাইরে গেলো।

দু ‘একজন করে সদস্য আসতে শুরু করলে মেজোবউ  বসতে বলে তাদের-

–  তোতা’বু এস্যু,  বস্যু।

আটপরে কাপড় পরা মধ্যবয়সী মহিলা, হাঁটুর নিচের খানিক অংশ ভেজা। শ্যামলা পুরু পায়ের পাতায় কাদা মাখা, দু‘একটি সবুজ  ঘাসের মতো লম্বা পাতার ছেঁড়াছুটো টুকরো লেপ্টে আছে। টাকা সহ পাশবই ধরিয়ে দিয়ে বলল-

– ন্যাও আমারডা এট্টু তোড়ে নেকো, পাতা মারতি মারতি উট্যি আইচি।

সদস্য যারা আসেনি সায়েমা  রেজিস্টার দেখে এক এক করে নাম  জিজ্ঞাসা করতেই  বড় বউ বলতে লাগলো তাদের কার বাড়ি কোন্ দিকে, কতদূর-

– মনোয়ারার বাড়ি উই মাঠের মদ্দি, হালিমা মনোহারির মাল বেচে বিকেলে টাকা দে আসে অফিসি,  ছবিরাণী মোড়ের মাতায় তরকারি বিক্কির কত্তেচ ;  উকিন গে নিতি হয়। এটুকু বলে বড়বউ ঘরে গেল।

তোতা সায়েমার কানের কাছে মুখ নিচু করে বলল-

– অন্তরার টাকা পেয়্যিছাও  ?

রেজিস্টারে চোখ রেখে সায়েমা বলল-

– আচ্ছা অন্তরার কোন্ বাড়ি ?

মেজবউ সায়েমাকে ইশারা করে বললো-  ‘অন্তরা এ বাড়ির মেয়্যি, আমাগের ননদ, শ্বউর বাড়ি থাকে। বড় বউ কিস্তি চালাবে কুতা দিয়্যি তার কাছতে লোন তুল্যি নেছে।’

বড়বউ ঘর থেকে চেঁচিয়ে বলল-

– ফিরতি পতে এইস্যান। আমি দুবানে অন্তরার টাকা।

সায়েমা রেজিস্টার গুছিয়ে উঠে আরেকটা মোড়ে চাচিকে খুঁজে খুঁজে বের করলো। চাচি চটের বস্তা ভাঁজ করে আসন পেতে বসে তরকারি বিক্রি করছিলো। সায়েমা কিস্তি চাইতে  চাচি বস্তার মুখের ভাঁজ উল্টে পলিথিন  মোড়ানো পাশবই বের করে সায়েমার দিকে হাত উঁচু করে ধরে বললো-

– আমার বইতি বোলো কোন সমষ্যি নেই। আর পেত্তেক সুপ্তায় ইকিনতে আমার কিস্তির টাকা নুবা। আগের ছারেরাও এরাম করে নিতো। মালামাল থুয়ে বোলো  ওটবার কায়দা নেই। কাঁচামালের ব্যাপসা করি্য এই ন’বচ্চর সুমিতি চালাচ্ছি, এট্টা সুপ্তাও খেলাপির রেকর্ড নেই।

সায়েমা হাঁটছে আর ভাবছে চাচির কথা “ন’বচ্চর সুমিতি চালাচ্ছি”। ন’ বছরে ন’বার নেওয়া সমিতির ঋণ কতটুকু পরিবর্তন এনেছে চাচির জীবনে!

সব গ্রুপের কালেকশন শেষে  ফেরার পথে সায়েমা  বড়বউ এর এখানে পুনরায় এলো অন্তরার কিস্তি নিতে। খাড়া দুপুর, ঘরে ঘরে যে যার মতো খাওয়া বিশ্রামে ব্যাস্ত। বড়বউ  সায়েমার হাত ধরে টানতে টানতে অন্তরার ঘরে নিয়ে গেল। ছোট্ট ঘর, একটা চৌকি, মাটির দেওয়ালের চারিপাশ রঙ্গিন কাগজে ফুল কেটে লাগানো, ঠিক চৌকির সোজাসোজি উপরে চালার সাথে ঝাড়বাতির মতো ঝুলনো একটা বড় কাগজের ফুল। ঘরে ঢুকেই মেথির ঘ্রাণ নাকে এলো ; দেওয়ালে চারকোণা করে মাটি কেটে বানানো কুঁদলিতে খোলা মুখের কাঁচের বোতলে নারকেল তেলের সাথে মেথি মেশানো।

মাথার দিকের বালিশ উঁচু করে দু‘খানা কাঁথা বের করে সায়েমাকে দেখানো শুরু করলে সায়েমা বললো-

– আপা অনেক দেরি হয়ে গেছে, এসব অন্যদিন দেখায়েন, এখন কিস্তি দিয়ে বিদেয় করেন।

– সেই জন্যি কচ্ছি। এগুনু অন্তরার খ্যাতা, আমার বেচতি কয়্যেছে।

– তা বেইচেন, কিন্তু এখন তো দেরি করা যাচ্ছে না, কোনভাবে ম্যানেজ করেন।

– চেষ্টা তো কম কল্লাম না আফা, পাল্লামনা।

একটু ঢোক গিলে বড়বউ সায়েমার হাত চেপে ধরলো-

– ও আফা,  তুমি নে যাও খ্যাতা দুডো। কিস্তিতে যা লাগে দে দিয়্যানে। একদম নতুন খ্যাতা। তোমার লস হবেন না।

কান্না জড়ানো কন্ঠে এসব বলেই বড়বউ  কাঁথা দুটো একটা শপিং ব্যাগে ভাঁজ করে সায়েমার হাতে ধরিয়ে দিল।

সায়েমা হতভম্ভ। কিছুক্ষণ থ হয়ে বসে থাকলো।

দুপুর সাড়ে তিনটা। ৩য়  অর্থাৎ শেষ গ্রুপের কালেকশন শেষ। চার জনের কিস্তি আদায় হয়নি। ২য় গ্রুপের শরিফা খাতুন বাড়ি নেই। শেষ গ্রুপে ছালেহা বেগম বাপের বাড়ি গেছে।

সায়েমা ফোন দিলো, ওপাশে ফোন রিসিভ হলো-

– কি খবর সায়েমা ? আপনার কালেকশন শেষ ?

– না স্যার, চারজন দেয়নি।

– একজনও বাকি রাখা যাবেনা।

– কি করবো স্যার দু’জন এলাকার বাইরে। বাকি দু’জন বাড়িতে নেই। তাদের একজন বাবার বাড়ি।

– দেখেন ! কোনভাবে কিস্তি ফেলে আসা যাবে না ।

– সদস্য তো বাড়ি নেই !

– বাড়ি তো উঠে যায় নি।

ম্যানেজারের  সৌজন্যহীনতায় সায়েমা  আশ্চর্য সহকারে বিরক্ত হলো। মনে পড়ল ওরিয়েন্টেশনের কথা, তখন প্রশিক্ষণ দিয়েছিল- কি করে ঋণ নেওয়ায় গ্রামের মহিলা সদস্যদের  উদ্দুদ্ধ করতে হয়, কীভাবে সুদ কে সার্ভিস চার্জ হিসেবে তুলে ধরে ঋণ গ্রহিতাকে ভালো ধারণা দিতে হয়,  কিস্তি না দিলে ঋণগ্রহিতার বাড়িতে অনশন অবস্থান ; এসবে পারদর্শিতা চাকুরীর শর্তাবলীর মধ্যে।

রেজিস্টার, কালেকশনের টাকা গুছিয়ে ব্যাগে ঢুকিয়ে কাঁধে ঝোলালো। আগের গ্রæপে ফিরতে হবে।

দুপাশে মাছের ঘের, মাঝখানে আইলের উপর দিয়ে হেঁটে যাবার একটা আড়াআড়ি পথ আছে কম সময়ে পৌঁছবার। মাঝপথে শরিফার বাড়ি পড়বে। সামনের দু চার ঘরে বাস করা মানুষজনের কাছে শুনে শুনে শরিফার বাড়ি পৌঁছালো সায়েমা। চারটি ঘেরের সংযোগস্থলে উঁচুমত ছোট্ট ভিটেতে দো’চালা ঘর একটা, বিচালি দিয়ে ছাওয়া। সরু বারান্দা, উঠোন থেকে এক ধাপ উঁচু। শুকনো কলাপাতা ঝুলছে উঠোনের বেড়ায়। বারান্দার এক মাথায় জোড়া উনুন। পলিথিনে ঢাকা। চুলোর ঠিক উপরের চালে বড় বড় দু তিনটি ছিদ্র। বিচালি পচে, ক্ষয়ে পোড়া খয়েরী রং হয়েছে। দেয়াল থেকে চাপ চাপ মাটি খসে পড়া অংশে কঞ্চির কাদামাখা দাঁত খিচিয়ে উঁকি দেওয়া।

বারান্দার একমাথায় কাঁত হয়ে থাকা নড়বড়ে টুলটা সোজা করে নিয়ে বসলো সায়েমা। ফাঁকা বাড়ি, নতুন জায়গা, ব্যাগে এতগুলো টাকা নিয়ে বসা ; উঠোনে খুঁটির সাথে বেঁধে রাখা হাঁসটির আফাস ধাপাস, প্যাক প্যাক ডাক শুনছে বলে থমথমে ভাবটা কম বোধ করছে সায়েমা। কিছুক্ষণ অপেক্ষাতো করতেই হবে, কেউ না কেউ বাড়িটাতে ফিরবে আশাটুকু জিইয়ে রেখেছে পায়ে দড়ি বাঁধা হাসের মত। টুলে বসে খুঁটিতে হেলান দিল, বেলা পড়ে এসেছে। শুকনো কলাপাতার বেড়ার ফাঁকফোকর দিয়ে  কারও হেঁটে আসা পা দেখতে পেল। চাপ চাপ কাদামাখা পা দেখে বোঝার উপায় নেই কেমন বয়সের মানুষ, নারী না পুরুষ।

যখন উঠোনে ঢুকলো ছেলেটা, হকচকিয়ে গেল সায়েমা। ১০/১১ বছরের। আভরণহীন ; লম্বা কালো শরীর। যে কেউ’ই বয়স নির্ণয় না করেই ওকে প্রথমে দেখে দৃষ্টি নামাবে ; ছেলেটিকে অসভ্য বলে গালি দেবে। ঘাড়ে বাঁধানো  ছেঁড়া জাল, ঝুড়ি  সবগুলো একসাথে হড়মড় করে ফেলে দিল। ঝুড়ির ছোট ছোট শামুক গুলো বেঁধে রাখা হাঁসটার সামনে দিল। সায়েমা একবার তাকিয়ে আর ফিরে দেখেনি ছেলেটির দিকে ;  অথচ ছেলেটির স্বাভাবিক চলন, যেন আভরণহীনতাতেই সে অভ্যস্ত । তবু স্বস্তি যে-  কঞ্চির উপরে কাদা লেপ্টে রাখা দেয়ালের মতই ওর অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ কালচে কাদায় লেপ্টে আছে। কাদা যে লজ্জা ঢাকতে পোশাকের দায়িত্ব নিতে পারে সায়েমা আজ প্রথম জানলো।

এমন দামড়া ছেলে কোথা থেকে এল ? আশপাশের ঘেরে ছিল হয়ত, খলুই থেকে কয়েকটা কই, টাকি বের করে উনুনের পাশে ভাঙা  বালতিতে রাখল। খলুইটা ঝেড়ে বাঁশের খুঁটির মাথায় উপুড় করে শুকাতে দিল। সায়েমা এবার জিজ্ঞেস করল-

– শরীফা তোমার কে হয় ?

– মা

– কোথায় গেছে ?

– উই এসতিসে

একথা বলে চালার নিচে টানানো দড়িতে ঝুলোনো  চিট চিটে গামছা টেনে কাঁধে নিয়ে বেরিয়ে গেল। একটু পরেই ঝপাঝপ শব্দ ; পাশে পুকুরের মতই গভীর বড় ঘেরের পাড় থেকে বোধ হয় লাফ দিচ্ছে।

শুকনো পাতার ফাঁক দিয়ে বাইরে দেখলো,  বাতাসের বেগে হেঁটে আসছে পাতলা টিনটিনে এক মহিলা, কাঁখে ২/৩ বছরের বাচ্চা। অন্য হাতে ঝুলানো থলে, দুপাশে ঘেরের আইল-পথের মাঝখান দিয়ে জোর পা ফেলে ফেলে এগিয়ে আসতে আসতে চেঁচিয়ে বলল-

– ও আফা ; বাড়ি বস্যি রইচাও তা আমি ওদিকতে শুনিচি। কি করবো কন ! উগির বাপ গারে¥ন্টে গে দু’মাস হল্যু। হ্যানো পর্যন্ত এট্টা পয়সা পাটায়নি। না পেরি  ইটিগাছার মোড়ে হোটেলে ঝাল পেঁয়াজ কাটার কাজ নিসি।

– এত অবেলায় আপনার বাড়ি বসে আছি ; কিস্তির টাকাটা তো কোনভাবে গুছিয়ে রেখে যাবেন !

– আফা, আমার কোন কিস্তি বাধায় থোবো না। তুমি আইজগে অফিসি যান, আমি কালগের সুক্কাল বিলাই অফিসি গে দে আসবান।

চাকরির শ্যেণচক্ষু পেছন থেকে ছোবল তুলছে, বুঝলো  সায়েমা। আশার আলো টুকু ধপ করে নিভে গেল। এবারে অসহ্য হয়ে উঠলো পুরো ব্যপারটা। কড়া ভাবে দু’চার কথা বলা যেতেই পারে ; কিন্তু কি বলবে ?

– আচ্ছা আমি অফিসে গিয়ে কি করে মেটাবো বলেন তো ? নিজের পকেট থেকে হলেও কিস্তি আদায় দেখাতে হবে। সে কি সম্ভব ?

– সম্ভব না বুজতিছ, তা আমি তো কচ্ছি দে দোবো, আমাগের সুদির টাকাত্তে তুমাগের বেতন হয়, সেও জানি। এট্টা দিন সবুর হতিস না !

মন:কষ্ট নিয়ে সায়েমা উঠে দাঁড়ালো, চলে যাবার জন্য উদ্যত হলে-  বৃদ্ধা হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠল শরীফার উপরে

– বার বার মানা করিলাম, ও জালে আর জড়াইনা, নাচতি নাচতি  গে টাকা তুললে, একোন বোজ ! ধরম ভাই  পাতায়ে তারির পোঙায় ঢালতি ঢালতি আমার ছাওয়ালের তেনা শুকাত্যি না। হ্যাতো পিরিত আসে কোয়ান তে?  এবার বাড়ি আসুক, ছোওয়ালের কবো নক্ত বিক্কির করি হলিও  সব সুমিতির টাকা শোধ কইরে আসতিছি।

সায়েমার শরীরের রক্ত বোধ হয় চিলিক পেড়ে উঠল, ব্যাগের ভেতরে টাকার বান্ডিল ক’খানা  যেন ফনা তুলছে। যেন অন্ধকার কুন্ডলি পাকিয়ে সায়েমার চোখে ঘুর্ণি  উঠছে ; ভেজা কাপড়ের জল নিংড়ানোর মতো করে যেন  ছোট্ট গ্রামটাকে নিংড়ে  টাকা তুলেছে। পাশের দু তিনজন মহিলারা  নিজেদের মধ্যে বৃদ্ধার কথা নিয়ে পর্যালোচনা করতে লাগলো।

গুনগুন আওয়াজের ভেতর থেকে সায়েমা যেটুকু বুঝলো তার সারমর্ম এই যে-

শরীফার স্বামী গার্মেন্টস এর কাজে যাবার পর তার বড় ছেলের পেটের অসুখে অপারেশন হয়। যে লোকটি টাকা দিয়ে সাহায্য করেছে, ধরম ভাই ডেকেছে তাকে।

শরীফা কাঁদতে কাঁদতে নিজের পক্ষের কথাগুেেলা বলল এবং সেই সাথে উপস্থিত মহিলাদের সাক্ষি করে সায়েমাকে উদ্দেশ্য করে শোনালো-

– শরীফা কিরাম সদস্য তা তুমার ম্যানেজার আর অফিসির লোক সগ্গুলি জানে, কি কও বু ?

মহিলাদের একজন বলল-

– হ্যাতো গিজাইসনে দিন, সপ্তার দিন আসার আগে হুশ করতি পারিসনে ?

শরীফা পুনরায় বলল-

– তুমি যাও খুকি,  অফিসি ফিরতি সন্ধ্যি হয়ি যাবানে, আমি কুতা দিচ্ছি কাল সুকালে ঝে করি্য হোক টাকা পৌঁছায় দোবো অফিসি। তা না হলে এ হাঁস বিক্কির কইরে দোবানে।

সন্ধ্যা সাতটা প্রায় ; চোখে মুখে উৎকন্ঠা সায়েমার। অফিস গেটে পা রেখে ছাতাটা বন্ধ করে ব্যাগে ঢোকালো। মেন দরজায় ঢুকেই বড় টেবিল, সোরগোল হচ্ছে। সায়েমা সহ পাঁচজন লোন অফিসার, ওর চেয়ারটা ফাঁকা এতক্ষণ। কাঁধের ব্যাগ টেবিলে রেখে চেয়ারে বসার সময় সবার মুখের দিকে এক ঝলক করে তাকালো। ইতোমধ্যে প্রত্যেকের কাজ ও কথার মধ্যে এক ঝলক করে দৃষ্টি পড়েছে সায়েমার দিকে। একটু দূরে অন্য টেবিলে আর.এম বসে, উনিও এক ঝলক। ফিরে চশমাটা ঠেলে উপরে তুলে আবার চোখ নামালেন টেবিলে ছড়ানো একগাদা কাগজপত্রে। মিজান নতুন জয়েন করেছে  সায়েমার সাথে একই দিনে ; তারও আজ প্রথম কালেকশন। প্রথমে উনিই কথা বললেন-

– সায়েমা আপা ফিরলেন ? এত দেরি ?

– হ্যাঁ, ভ্যান রিক্সা কিছু নেই ;  অনেকখানি হাঁটু কাদা পার হয়ে যেতে আসতেই

সহকর্মী শরিফুল বলল- ও গ্রæপ আগে আমার ছিল,  ভালো গ্রুপ তো ! উত্তরে হামিদ ভাই বলল-

– প্রত্যেকের কাছে তার প্রাক্তন গ্রæপ ভালোই হয়, আর যেটা বর্তমান থাকে তার মত খারাপ গ্রæপ আর নেই,  তাই তো?

সায়েমা খেয়াল করল- হামিদ ভাই এর সামনা সামনি উচিত কথা। বিষ্ণুদা এখানে সবচেয়ে পুরাতন, তার জিজ্ঞাসা-

– আপা কি মনে হচ্ছে ? চাকরী করবেন তো !

সায়েমার  মলিন হাসি,  হামিদ ভাইয়ের আবারও প্রশ্ন-

– টাকা-পয়সা  পাকস্থলীতে কিছু দিয়েছেন ?

মুহূর্তে হকচকিয়ে গেল সায়েমা ; পরক্ষণে ঠিক বুঝলো,  বলল-

– না ভাই; ওখানের দোকানে তেমন কিছু দেখিনি, তাছাড়া উদরের তাগিদ নড়াচড়া করার স্পেস পায়নি।

সবাই হাসি রহস্যে সরগরম হয়ে উঠলো, হামিদ ভাই শরিফুলের পেছনে আবারও উঠেপড়ে লাগলো-

– শরিফুল ভাই, আপনার তো প্রায় ২ বছর, এ যাবৎ ছমাস অন্তর বদল করে দল পরিচালনা করেছেন চারটা,  প্রতিবারই তো দল ছাড়ার সময় বলেন এ দল খুব ভালো দল, তা আপনার বর্তমান দল ভালো তো ?

বিষ্ণুদা সাথে সাথে রিপ্লাই-

– আর বলবেন না হামিদ ভাই, শরিফুল ভাই যখন যে  গ্রুপে গেছে যাচাই না করে এনামে বেনামে লোন দিয়েছে, আসল ঠাঁই ঠিকানা খুঁজে পাওয়া যায় না। বেশির ভাগ ঋণ একহাতে গেছে।

ওদের পুরাতন তিনজনের মধ্যে শুরু হলো  খুনসুটি ; সায়েমার দিকে কারও মনোযোগ নেই ; সায়েমা এরই মধ্যে ব্যাগ থেকে এক ঝাপ টাকা বের করে গোছাতে লেগেছে। পেট কুঁকড়ে গেছে, চেয়ারে বসা সায়েমাকে কুঁজো দেখাচ্ছে।

সাতক্ষীরা সদর ব্রাঞ্চ-ম্যানেজার এর অফিস আবাসিকেই থাকা খাওয়া। অফিসের ভেতরেই মেস ব্যাবস্থায় রান্না চলে। সন্ধাকালীন চা, সাথে হয়ত টাও ; তারপর পান চিবোতে চিবোতে টেবিলে এসে বসে। সায়েমার টাকা গণনার গতি খেয়াল করে বললো-

– হামিদ সাহেব আপনার আফার টাকা গোনা শিখায়ে দেন।

বলেই চেয়ার থেকে উঠে জানালার গ্রীলে মুখ ঠেকিয়ে পানের পিক্ ফেলল, চৌকাঠে খানিকটা লাল রং মেখে গেছে। সায়েমার পেটের ভেতরে জর্দার কড়া ঝাঁঝ  হুড় হুড় করে ঠেলা দিলো যেন। অথচ কি অদ্ভুত ! সকালে ১ম গ্রুপের বৃদ্ধার কাছে এই গন্ধটাই পেয়েছিল ! তখন একটা মায়া মায়া সুবাস অনুভব করেছে। পদার্থ বা দ্রব্যের মধ্যকার  রাসায়নিক ক্রিয়া-বিক্রিয়ায় মানুষের স্বভাব বা চারিত্রিক বৈশিষ্ঠ্যও  প্রভাব ফেলে বোধ হয়। তাছাড়া একই পদার্থের গ্রহণযোগ্যতা সময়ের এবং স্থানের প্রেক্ষিতে ভিন্ন ভিন্ন হয়। দুটোর যেকোন একটা কারণ  হতে পারে অথবা দুটো কারণই হতে পারে ।

গণনা শেষে সায়েমা ছোট করে বলল-

– স্যার, ঊনত্রিশ হাজার সাতশত ঊনিশ টাকা।

ম্যানেজার হামিদ ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বলল-  হামিদ সাহেব ওখান থেকে বিশ হাজারের একটা বান্ডিল করেন।

হামিদ  সায়েমার থেকে টাকাগুলো নিয়ে মিজানের সামনে চালান করল। ইশারা করে দ্বায়িত্বটা চাপিয়ে দিল মিজানের উপরে। মিজান  সায়েমার দিকে মুখ বাড়িয়ে আস্তে বলল-

– আফা খেয়ে আসেন আগে ; পরে রেজিস্টার মিলাবেন।

চেয়ার ছেড়ে উঠতেই ম্যানেজারের প্রশ্ন-

– কিস্তি কয়টা ফেলে এসেছেন ?

– একটাও  ফেলে আসিনি, তবে তিন চার জন বাড়িতেই ছিল না।

– সে একই কথা। কাল বিকেলে কালেকশন শেষে আবার ঐ গ্রুপে যাবেন।

বাবলা কাঁটা ছড়ানো হাঁটু সমান প্যাঁক পেঁকে কাদার দৃশ্যটা সায়েমার চোখে ভেসে উঠলো। হ্যাঁ অথবা না কোন জবাব না দিয়ে দরজার ওপারে চলে গেল সায়েমা।

মাসখানেক হলো ভাড়া এসেছে সায়েমা নিশান্তদের নিচতলার একটা ঘরে। অফিসের পাশে। নিশান্ত প্রায়ই খেয়াল করে মেয়েটা সাতটায় বেরিয়ে যায়, দুপুরে একটায় এসে দু’টায় আবার চলে যায়। এক ঘন্টা সময়েই ঝড়ের মতো  হাঁড়ি-কড়া-বাসন ধোয়া, তরকারি-আনাজ কাটা, আলু –ডিম সেদ্ধ দিয়ে ভাত বসানো। স্নান সেরে গোগ্রাসে গিলে আবার অফিস ছোটা। খাতা কলমে ৫টায় অফিস শেষ দেখানো হলেও  বেশিরভাগ দিনই সুদের হিসাব করতে রাত দশটা বাজে। তবু একবার উপরে গিয়ে নিশান্ত আপুর সাথে আলাপ করে আসে। অফিস থেকে সন্ধ্যের পূর্বে ফেরা হলে নিশান্তর সঙ্গেই চা’পর্বটা বেশ জমে।

নিশান্ত  নিজের অফিস, পড়াশোনা-লেখালেখি, সাহিত্যে কার রচনায় কেমন ধরণের জীবনচিত্র, অধিকার, পুঁিজিবাদ, শ্রেণী-বৈষম্য এসব নিয়ে কথা বলে, সায়েমা অবাক হয়ে শোনে। সায়েমার গ্রাম্য জীবন-যাপন, পোশাক-আশাক এর জীর্ণতা, অনুন্নত বাসস্থান, খাদ্যের অপর্যাপ্ততা, এমনতর  মৌলিক অধিকার এর অপ্রাপ্যতা, দারিদ্র্য’র সাথে সংগ্রাম, পারিবারিক-সামাজিক নানা  সমস্যায় জর্জরিত থাকার কথাও নিশান্ত শুনেছে সায়েমার কাছে। আরও শোনে ঋণের ভারে নিস্পেষিত হতদরিদ্র মানুষগুলোর  চড়া-সুদে  কিস্তি পরিশোধের করুণ গল্প। শুধু গল্প নয়, ব্যাঙের ছাতার মত গজানো এনজিওদের সুদবাণিজ্যর সুফল-কুফল সব বিষয়ের গভীরে চলে যায় দুজনেই, যার থৈ পাওয়া যায় না প্রকৃতই।

আজ একটু তাড়াতাড়ি চলে এসেছে সায়েমা। ফ্রেশ হয়ে তোয়ালেয় মুখ মুছতে মুছতে সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে সোজা  নিশান্তর ঘরে ঢুকলো। নিশান্ত আধা শোয়া হয়ে পড়ছিল ‘লেভ তলস্তয়’ এর ‘ওয়ার এন্ড পিস’। সায়েমাকে দেখে উঠে বসল-

– আজ তাড়াতাড়ি যে ?

– হুম, বিকেলে ফিল্ডে যে সদস্যর কিস্তি আদায়ে যাবার কথা ছিল, সে অফিসে এসে দিয়ে গেছে।

– বাহ্, তোমার সদস্যারা দেখছি সচ্ছল হয়ে উঠেছে

– ষোল’শ পঞ্চাশ টাকা। দু’সপ্তার কিস্তি, সাথে স্বামী ঋণ এর মাসিক-কিস্তি। ভাগ্যিস দিয়েছে, তাই একরকম বাঁচা। নইলে মাস শেষে গাঁটির থেকে খসতো।

– সকালে যে দিতে পারেনি, বিকেলে সে এত টাকা ম্যানেজ করলো কীভাবে ?

– সকালে শুনেছি আরেকটা এনজিওতে ঋণ তুলতে গেছে, হাতে এসেছে তাই দিয়ে গেল। আগামীতে এখান থেকেও তো নিতে হবে, পাশবইটা পরিস্কার রাখছে।

– ঠিক এ কথাটাই শুনতে চাইছিলাম, একজন দরিদ্র গ্রাহক এক এনজিওর ঋণ পরিশোধ করতে অন্য এনজিওর দারস্থ হয় ; সেই অন্য এনজিওর ঋণ শোধরাতে  পুনরায় পূর্বের এনজিও থেকে  আরও বেশি ঋণ করে। তার বৈষয়িক উন্নতি বা অবস্থার পরিবর্তন প্রকৃতই হয় কি ?

– শোন আপা- আমরা তো কাজে লাগানোর জন্যই ঋণ দিয়ে থাকি, তারা যদি কাজে না লাগায় তো-

নিশান্ত সায়েমার মুখের কথা শেষ না হতেই বলল-

– আরে কাজে লাগাবে কি ! ক্ষুদ্রঋণের বেশিরভাগ অংশই তারা বেঁচে থাকার জন্য মৌলিক চাহিদা পূরণে প্রয়োজনীয় দ্রব্য ক্রয় করে, যার কারণে নতুন কোন আয়ের উৎস তৈরি করতে পারেনা।

– হ্যাঁ, তা বেশ বললে  তুমি ! তবে অনেকেই তো ব্যবসায় কাজে লাগাচ্ছে। তারা ঠিক ঠাক কিস্তি চালায়।

– হ্যাঁ কিস্তি চালাচ্ছে, কিন্তু দারিদ্রবিমোচনে ঋণের ভূমিকা শূন্য ; ঐ যে বালির বসতি ! বালি টেনে টেনে বাঁধ উঁচু করে, আবার স্রোত এসে সমান করে দেয়। গড়ে ফলাফল জিরো।

– অর্থাৎ কি বোঝাতে চাইছো আপু ?

– ধর, ক্ষুদ্রঋণ যদি ব্যসায়িক কাজে ব্যবহৃত হয়, দেখা যায়- ওই ব্যবসা এক ধরণের চাহিদা স্বল্পতায় ভুগে। কারণ তাদের মূল ক্রেতা কিন্তু সেই দরিদ্রজনগোষ্টি ; যারা মুলত বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য কিনে থাকেন, যা কিনা ইতোমধ্যে বাজারে রয়েছে। যেহেতু তাদের নতুন করে আর কোন দ্রব্যের চাহিদা থাকে না ফলে দেখা যায় নতুন উদ্যোগটি ইতোমধ্যে প্রতিষ্ঠিত কোন ব্যবসায় স্থান দখল করেছে। কাজেই এই ব্যবসা বা উদ্যোগ নতুন কোন আয় অথবা কর্মসংস্থান তৈরি করতে পারে না।

– মাথাটা কেমন গুলিয়ে যাচ্ছে আপা।  আমার তো মনে হয়েছে- বছর বছর  যারা ঋণ নিচ্ছে তাদের অনেকেই, ভালো ঘর নির্মাণ করেছে, পর্যাপ্ত খাদ্য কিনছে ;

– খাদ্য কিনছে, উৎপাদন করছে কি ? জমি বেড়েছে কি ? ফসল চাষাবাদ বেড়েছে কি ? ঋণ নিয়ে মূলত কেউ সম্পদ বাড়াতে পেরেছে ?

– ওভাবে তো ভেবে দেখিনি !

– হুম , ভাবতে হবে, জানতে হবে;

হঠাৎ নিশান্তর চোখ পড়ল দরজার দিকে। সাজু  দরজার কাছে বাইরে দাঁড়িয়ে ছিল এতক্ষণ। ওদের আলাপের মধ্যে ছোট কোন বিরতি খুঁজছিল হয়তো। নিশান্ত বলল-

– দাঁড়িয়ে আছেন কেন ? ভেতরে আসেন, আপনার ছেলের বই এনে রেখেছি।

সাজু  খুশি খুশি ভঙ্গিতে ঘরে এল, নিশান্ত পাশের টেবিল থেকে দড়ি দিয়ে বাঁধা এক পাঁজা বই ধরিয়ে দিল। সাজুখালা সায়েমাকে উদ্যেশ্য করে বলল-

–  আফা, মিজান ভাইয়ের কইয়্যান  বুকাবুকি না করে ঝ্যান, গত সপ্তার কিস্তি আর এ সপ্তার কিস্তি দুইডা একসনতে দে আসপান অপিসি। দেকতিছাও তো ছোওয়ালের বই খাতা তাই কিনতি পারিনি। নিশা আপা না দিলি বড্ড বেগতিক পড়্যি যাতাম।

সায়েমা হালকা মাথা নেড়ে সম্মতি দিল। বুঝতে পারলো সাজু  মিজান ভাইয়ের  কোন গ্রæপের সদস্য। সাজু চলে যাবার পর পুনরায় প্রসঙ্গে ফিরে এলো নিশান্ত-

– আচ্ছা বলতে পারো ! এই নন গভ:অর্গানাইজেশন গুলোয় বেশিরভাগ বিদেশের মালিকানা কেন ?

– আমি যদ্দুর জেনেছি,- বিদেশী যারা ডোনার তারা দুস্থ্য অসহায়দের সাহায্যখাতে টাকা দেয়।

– তাহলে তাতে সুদ থাকবে কেন ?

আলাপের ফাঁকে বয়ামের মুখ খুলে বিস্কিট বের করে সায়েমার হাতে দিতে দিতে নিশান্ত আরও বলল- ‘ওসব সাহায্য, সেবা খাত ওসিলা মাত্র, ঋণ আসলে দমিয়ে রাখার একটা দারুণ কার্যকরী মাধ্যম। জনগণকে বামধারার আন্দোলন থেকে দূরে রাখা সম্ভব এই বলে যে, দারিদ্র্য আসলে রাজনৈতিক সমস্যা নয়, এটি একটি ব্যক্তিগত সমস্যা।

– কিন্তু ওরা তো কোন কোন এনজিওর মাধ্যমে  সেলাইমেশিন, ছাগল এসবও দেয়। সায়েমা সোফায় হেলান দেওয়া থেকে ঘাড় সোজা করে নড়ে চড়ে বসে বলল একথা।

– হুম, দেয় ঠিকই। আরে বোকা- ওরা তাদের দেশসমূহের ব্যবসায়ীদের দালাল !  বিদেশীরা এভাবেই বাঙ্গালীদের ভেতরে দালাল পেতে পারে সহজেই, জল তো সব সময় নিচের দিকেই গড়ায়, ওদের টার্গেটটাও তেমনই ;  হতদরিদ্র নিরক্ষর জনগণকে বোঝানো সহজ। বিদেশের ব্যবসায়ীদের দালালরা এদেশের ব্যবসায়ীদের দালালদের সাথে জোট হয়ে চালাচ্ছে এসব কার্যক্রম !

– তার মানে এটা বিদেশীদের একটা চক্র ! আমি যেখানে কাজ করি সেটাও ?

– তোমার কাজের জায়গা একটা খন্ড চিত্র মাত্র। দেশের আনাচে কানাচে অগণিত এনজিও আছে। আর এগুলোর পেছনে অনেক দেশই জড়িত

সায়েমা অবাক-মুগ্ধ হয়ে শুনছে নিশান্তর কথা। কোন মেয়ের মুখে এত সুন্দর গোছানো কথা পূর্বে শোনা হয়নি তার। এত পরিস্কার করে বুঝিয়ে বলছে তবু পুরো বিষয়টা কেমন ধোঁয়াশা। সাজু খালা এর মধ্যে চা দিয়ে গেল। নিশান্তর কথার ফ্লো থামেনি-  এক হাতে চা তুলে চুমুক দিতে দিতে অন্য  হাত উঁচিয়ে- আঙুিল নাড়িয়ে কি চমৎকার  যুক্তিতে বলে যাচ্ছে-

– আচ্ছা সায়েমা ভেবে দেখ- কৃষক তার গরুকে খড়-বিচালী খাওয়ায়, কী কী কারণে ? বলতো দেখি-

– সায়েমা লাফিয়ে উঠে জবাব দিল- কি কারণে আবার ! হয় তার মাংশ-দুগ্ধ খাবে, নয় তাকে দিয়ে লাঙ্গল ঠেলবে!

– কারেক্ট ! ঠিক তেমনই এই ক্ষুদ্রঋণ দেওয়া হয় শ্রমজীবীদের শ্রমশক্তি  বাঁচিয়ে রাখতে। রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণের জন্যও  ক্ষুদ্র ঋণ  কার্যকর একটা পন্থা!

এবার বিজ্ঞের মতো ভাব করে সায়েমা বলল-

– তবে একটা ব্যাপার বুঝতে পারি- দেশকে পুরো সাহায্যের উপরে নির্ভর করে চলতে হবে এমন পরিস্থিতি হচ্ছে দিন দিন। আচ্ছা বলোতো-  এসব এনজিওর বিষয়ে সরকারের কোন নজরদারি নেই কেন ?

– এবার প্রসঙ্গে এসেছো বাছা ! বলেই  নিশান্ত সায়েমার কথায় হেসে উঠলো। তারপর আরও বলল-  ‘সরকারই যেখানে চড়াসুদে ঋণ করছে সেখানে-

নিশান্তর কথা শেষ না হতেই ওর মুখের কথা কেড়ে সায়েমা পুনঃপ্রশ্ন করল:-

– আচ্ছা যেখানে সরকারই চড়াসুদে ঋণ নিচ্ছে সেখানে এনজিওরা দাতাগিরি ফলাচ্ছে কেনো ?

নিশান্ত   সায়েমার দিকে  রহস্যেভরা  দৃষ্টি নিক্ষেপ  করে বলল- এখানেই তো জট !

সায়েমা আনমনা। কি যেন ভাবছে। খেয়াল করলো নিশান্ত। ইতোমধ্যে সায়েমার পারিবারিক অবস্থা জেনেছে। ও মাঝেমাঝেই কোথায় যেন হারিয়ে যায়। এ মুহূর্তটা তেমনই। তাছাড়া  কয়েকদিন ধরেই ওকে আরও বেশি বিষণ্ণ লাগছে। ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রমে নিযুক্ত থেকে সায়েমা একরকম হীনমন্যতায় ভুগছে।  নানাভাবে টের পেয়েছে নিশান্ত।

– সায়েমা, বাড়ি থেকে দুদিন ঘুরে এসো, মাকে দেখে এসো। তারপর তোমার সাথে অনেক কথা আছে, অনেক কাজ আছে।

– দেখি কবে ছুটি নিতে পারি,

এ কথা বলে সায়েমা স্বাভাবিক হাস্যভঙ্গিতে উঠে নিচে যাবার জন্য উদ্যত হলো, কিন্তু গভীর ভাবনা থেকে ফিরে এসেছে কিনা বোঝা গেল না।

দেখতে দেখতে দু’বছর কেটে গেল এভাবেই। একই ব্রাঞ্চে দীর্ঘদিন অবস্থানের সুযোগে কোন কর্মী যেন আর্থিক দুর্নীতি না করতে পারে  তার প্রতিরোধ-ব্যবস্থাস্বরুপ  এমনিতেই ছ’মাস পর পর রেজিস্টার বদল এবং তার প্রেক্ষিতে গ্রাম এবং গ্রæপ বদল হয়ে থাকে। মূলত সায়েমার ব্রাঞ্চ বদল হয়েছে। সাতক্ষীরা থেকে কালিগঞ্জ। প্রায় একসপ্তাহ হলো এসেছে, অফিসের কাছাকাছি এক রুমের একটা বাসায় উঠেছে। নতুন গ্রামে নতুন নতুন গ্রæপ সব আবার বুঝে নিতে হচ্ছে।

নদীর এপার ওপার নিয়ে উপজেলা। উঁচু ব্রীজটা শহরকে দুভাগ করে রেখেছে। গত তিনদিন এপারেই কালেকশন। গতকাল  তবু বিকেলে ঘুরতে বেরিয়ে হাঁটতে হাঁটতে  নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে সায়েমা দেখেছে-  নদীর গর্ভ নিংড়ানো ভাঁটা ;  ঘাটে ইট ছড়ানো, দুপাশে সুরমা রং এর থকথকে কাদা। ঢালু হয়ে নেমে যাওয়া ঘাট নদীর তলদেশ ছুঁয়েছে। ভাঁটার টানে নদীর নিরুপায় জল কেমন  দৌড়চ্ছে। দু.কুলের নরম কাদা-মনে রেখে যাচ্ছে ফিরে আসার সিক্ত ভাঁজ-চিহ্ন। ভোর বেলা আর পড়ন্ত বেলায় পারাপারের জন্য নৌকায় চড়তে গেলে নাকি-  কীনার থেকে নদীর তলপেট অব্দি নেমে যেতে হবে।

অফিসে এসে পুরোনো বলতে হামিদ ভাইকে পেয়েছে,  সায়েমা আসার কিছুদিন পূর্বে বদলী হয়ে  এ ব্রাঞ্চে এসেছিল।

– আপনার আজ বসন্তপুরে কালেকশন, চারটা গ্রæপ, প্রথমটা চিনিয়ে দেওয়া হবে, পরেরগুলো নিজেই চিনে নেবেন। হান্নানতো  অফিসে আসেনি আজ, ফোনও বন্ধ। তাই ওর গ্রæপে আমাকে যেতে হচ্ছে। নইলে আপনাকে সাথে নিয়ে গ্রæপ চিনিয়ে দিতে পারতাম। বলল ম্যানেজার।

– জ্বী । সায়েমার উত্তর।

– হামিদ সাহেব আপনার গ্রæপের দিকেই যেহেতু, যেতে যেতে তাকে লোকেশানটা বুঝিয়ে দেবেন।

মাথা কাত করে সম্মতি জানালো হামিদ। পাশ থেকে হামিদভাই সায়েমার কানের কাছে আস্তে করে বলল-‘ব্যাগে পাউরুটি কলা নিয়েন’ । সদর অফিসে সায়েমার প্রথমদিনের গ্রæপে সারাদিনের দুর্ভোগের কথাটা স্মরণ করিয়ে দিল বোধ হয় হামিদভাই। ছোট্ট একটা হাসি হেঁটে চলে গেল সায়েমার ঠোঁটের আইল ধরে।

অফিস থেকে বের হলো সবাই একসাথে। পেছনের সড়ক ধরে সাইফুল ভাই ও প্রশান্তদা গেল ভাড়াসিমলার দিকে। সার্জিক্যাল ক্লিনিকের সামনে দিয়েসোজা মাছ বাজারের গলিতে ঢুকলো সায়েমা। সাইকেল ধরে সাথে সাথে হামিদভাইও বাঁক নিল। সায়েমা ডানদিকে ঘাড় ঘুরিয়ে বলল-

– আপনিও  কি একই গ্রামে আজ ?

– না, নাজিমগঞ্জ বাজার কালেকশন।

বোঝা গেল একসাথেই ঘাট পার হবে। সায়েমা স্বস্তি পেল। ম্যানেজার গ্রæপ লোকেশন বোঝানোর সময় সায়েমা ভেতরে ভেতরে একটু ঘাবড়েছিল। নদী পার হতে হবে, খুব স্রোত নাকি।  ঢালু পথে আগে আগে নামছে হামিদ ভাই, পেছনে সায়েমা। হামিদ ভাই পাটাতনের পরে সাইকেল ঠেলে উঠাতে উঠাতে মাঝিকে  বলল-

ভোরবেলার নদী তো ভাঁটায় যায়, আজকে যায়নি !

– নদী ফুঁসতিছে  আজগের, সোঁতও সেইরাম। ভাব ভালো ঠেইকতি  না।

– চাচা আপনাদের গ্রæপে এবার থেকে আপা কালেকশন করবে।

সায়েমাও  সতর্কে ধীরে পা টিপে টিপে পাটাতন থেকে উঠে নৌকার মাঝে এসে দাঁড়ালো। মাঝি চোখ তুলে বলল-

–  নতুন এয়্যিছে ?

– হ্যায় চাচা। কিস্তি সমস্যা করেন না যেন, আবার তো নেবার সময় কাছাই এসলো।

– আইজগের এট্টু ফিরতি পথে নিতি হবে মাগো ; আমার এরাম হয় না।

সায়েমার দিকে তাকিয়ে সম্মতি চেয়ে আরও বলল-

– আমি দুকুরবিলা ঘাটেই থাকপানে।

নৌকার টালমাটাল দোলা ; অস্বস্তি নীরবে চেপে রেখে সায়েমা সম্মতিস্বরুপ ঘাড় নাড়ালো। হামিদ ভাইয়ের দিকে চোখ পড়তেই সে ইশারা করলো  কিস্তির ব্যাপারে  ছাড় না দিতে।

নাজিমগঞ্জ বাজারের কোণ ঘেঁসে নতুন ঘাট নির্মাণ হয়েছে, বড় বড় চওড়া ঢালাই সিঁড়ি নদীর তলদেশ থেকে উপরে উঠে গেছে। ঘোলা কালো জলের সাথে ভাঁটির টানে ভাঁটির দিকেই দ্রæতপার হলো। নৌকা থেকে নেমে সিঁড়ির ধাপ বেয়ে উপরে উঠতে উঠতে হামিদ বলল-

– এরাম ছাড় দিলে এদের অভ্যেস খারাপ হয়ে যাবে আফা। দলে এত নরম হলে সদস্যরা পেয়ে বসবে, মাস শেষে কাভার করতে পারবেন না। যাক আজ বলে ফেলেছেন যখন ফেরার সময় নিয়েন। এর পরেরতে কেন্দ্রে বসে মহিলার কাছ থেকে আদায় করবেন।

– হুম। আপনি কখন ফিরবেন ?

– আমার আজকে দেরী হবে।

– দলে সমস্যা ?

– আরে নাহ্। বাজার কালেকশন আজ। কুড়িজনের মতো মাসিক কিস্তি। মাস শেষের দিকে তো ! দু লাখের কাছাকাছি টাকা আসবে। ব্যাংকে জমা দিয়ে তারপর অফিস ফেরা।

– দুই লাখ !

– চমকে গেলেন ?

– এত টাকা ?

– পরের টাকা, লাফিয়ে ওঠা কিংবা হতাশ হওয়া কোনটাতেই ফায়দা নেই। এখান থেকে আমি বাঁ দিকে যাবো, আপনি ঐ যে সোজা পথ ধরে হাঁটতে থাকেন, হাফ কিলো মতো গিয়ে সভানেত্রীর নাম বললে বাড়ি চেনা যাবে। একথা বলে হামিদভাই হাঁটতে হাঁটতে নাজিমগঞ্জ বাজারের কাপড়পট্টির মধ্যে ঢুকে পড়ল।

‘ফায়দা নেই’  কথাটা সায়েমার কানে বাজলো।  কথাটা দরিদ্র শ্রমজীবী  মানুষদের বেলায় খুব বেশি প্রযোজ্য ; সায়েমার  একটু একটু করে ধারণা জন্মেছে ; একটা ব্রাঞ্চেই এত টাকার কারবার ! সমগ্র বাংলাদেশে এর কার্যক্রম কত টাকা যে চক্রবৃদ্ধিহারে বাড়িয়ে টাকার পাহাড় তুলছে এসব এনজিও দারিদ্রবিমোচনের নামে ক্ষুদ্রঋণ প্রদানের মধ্য দিয়ে ! নিশান্তর কথা মনে পড়লো। নিজের সাথে কথা হচ্ছে  সায়েমার-  ‘দরিদ্র জনগোষ্টির এত এত ঋণ নিয়ে কী ফায়দা হচ্ছে ? তাদের অসহায়ত্তে¡র সুযোগ গ্রহণ করছে দালাল শ্রেণী। সায়েমা কি দরিদ্রজনগোষ্টির একজন নয় ? সে কি শোষিত নয় ? নাকি নিজেও দালাল পক্ষের একজন ? দালালের দালালী !’ গত একবছরে নিজের কাজে এতটুকু তৃপ্তি পেয়েছে সে!  ইসলামপুরের সদস্য শরীফার কথাও মনে পড়লো-

“ আমাগের সুদির টাকাত্তে তুমাগের বেতন হয়”

গাঙ্গের সমান্তরালে বাঁধের উপর উঁচু পিচ সড়ক, দুপাশে কিছুদূর ব্যবধানে টালি দিয়ে ছাওয়া মাটির দেওয়ালের ছোট ছোট খুপরি ঘর, কোন কোনটি মাটির চার দেওয়ালের পরে একচালার ছাউনির একটা ঘর, হাঁড়ি কুড়ি, ঝালপেঁয়াজের ঝুড়ি, কাঠ নিয়ে তারা খোলা আকাশের নিচে উঠোনে বসে রান্না করে ঘরে তোলে।

সায়েমা হাঁটতে হাঁটতে সভানেত্রীর নাম ধরে তার বাড়ি খুঁজছে, দু একজনের কাছে জিজ্ঞাসা করায় তারা দূরে আঙুল তুলে দেখালো। আরও বেশ খানিকপথ সম্মুখে যেতে হবে। কিছুদূর যাবার পর হাঁটার গতি কমিয়ে নিল। হয়েেতা গন্তব্যের কাছাকাছি  এসে গেছে। খুপরী ঘরগুলো ধীরে ধীরে ঘন হয়ে আসছে। একটু দূরে একদল ছেলেমেয়ে দৌড়ছুট খেলায় মেতে আছে। একটি ৮/৯ বছরের কিশোর, জীর্ণ শীর্ণ দেহ, ছোট এক বাচ্চার হাত থেকে আখ নিয়ে টানাটানি কাড়াকাড়ি করছে। বাচ্চাটির চ্যাঁচ্যাঁ করে কান্নার শব্দে মাঝ বয়সি মহিলা দৌড়ে এসে বড়টিকে ঠেলে তাড়ালো। গাল পাড়তে শুরু করলো-

– ওরে হারামজাদা ! সুক্কাল বিলা উরির পোঙায় লাগিছিস ক্যান ! তোর বোলো এবারা দুবাবান !  দূর অ…. হ্যান তে… দূর অ….

খুপরির পাশ  থেকে  মহিলাটি বড় ছেলেকে তেড়ে আসতে আসতে সায়েমার সম্মুখে চলে এলো ; সায়েমার দিকে তাকালো।  সেই মুহূর্তে সায়েমা জিজ্ঞাসা করলো- গ্রæপ কালেকশান হবে যেখানে সেই বাড়িটা কই ? মহিলাটি বিস্ময়ে চেয়ে থেকে বলল-

– সোমবারের সুমিতি ? স্যার এসতো যে ! আইজগের তে তুমি ?

– হুম, আপনিও সদস্য ?

– হ্যায়, তা আমি সুমিতিত যাইনে মিলা দিন, তুমি আসেন দিখাই দিচ্ছি।

মহিলার পাশে পাশে সায়েমা হেঁটে চলল। পিচ সড়কের  দু পাশে কিছুদূর অন্তর কয়েকটি করে ঘর, তার পেছনে দূরে ধুধু পাড়, আরও দূরে সমান্তরালে প্রবাহমান স্রোতোময় ঘোলাজল।

– ঐ যে দূরে কি গাঙ্গের পানি দেখা যাচ্ছে ?

– হ্যায়, এরাম দিকা যায় না, আইজগের সুক্কাল তে গাঙ্গের পেট ফুলতিছ্।

সায়েমার ব্যগে হঠাৎ ফোন বেজে উঠল। সেট টা হাতে নিয়ে দেখল নিশান্তর ফোন। রিসিভ করে কুশলাদি জিজ্ঞেস করার পরে নিশান্ত যা বলছে তা শুনে একটা ধাক্কা খেল-

‘ সাজু আত্মহত্যা করেছে। কয়েকটি সমিতির কয়েক সপ্তাহের কিস্তির টাকা দিতে না পারায় গত রাতে তার বাড়ির পরে এনজিওর  লোকজন এসে যা তা বলে গেছে। মূলত এক এনজিও থেকে ঋণ তুলে অন্য এনজিওর ঋণ পরিশোধ প্রকৃয়ায় সে বহুঋণে জড়িয়েছে। আরও বেশি ঋণগ্রস্থ হতে হতে সে  ঋণের কবলে ক্ষতবিক্ষত। এ নিয়ে স্বামীর সাথে কথা কাটাকাটির এক পর্যায়ে সাজুকে তালাক দেবার কথাও ওঠে। সকালে ঘরে পাওয়া যায় তার ঝুলন্ত লাশ।’

নিশান্ত খবরটা জানিয়ে সায়েমাকে কিছুটা সতর্ক করল এক প্রকার। আরও বলেছিল-

– ঋণ কার্যক্রম  ও তার প্রভাব নিয়ে বেশ হৈচৈ পড়েছে, পত্রিকায় বেশ লেখালেখি চলছে। যাদের লক্ষ্য করে বা যাদের পক্ষে কথা বলে আলোড়ন তোলা হচ্ছে  সেই সব সংখ্যাগরিষ্টদের  ভালো কিছু  হোক না হোক ; তোমাদের মত দু একজন কর্মী কে হেস্তনেস্ত  করা উদ্দেশ্য, এটা মাথায় রেখো।  এটা একটা  কৌশল। কথায় বলে-  ‘কারও  ঘর যখন আগুনে পোড়ে,  সে আগুনে কেউ রান্নাও সারে’।

সভানেত্রীর বাড়িতে পৌঁছালে দু’জন সদস্য  এসে খুঁটি ধরে দাঁড়ালো, সায়েমা নিজের পরিচয় দিয়ে বসতে বলল। তাদের একজন বলল-

– আইজগের বিশাল বিপদ হয়্যি গে আফা, মিলাজন কিস্তি দিত্ পারবে না। অন্যজনও সায় দিয়ে একই কথা বলল।

একে একে আরও জনা দু তিন এসে প্রায় সমস্বরে বলে উঠল-

– আমাগের এ গিরামে সব্বোনাশ হয়্যি গে,

– জোয়ান জোয়ান মদ্দাগুনোর ক্ষ্যয় কইরে দেস্। বলল আরেকজন ।

সায়েমা সবার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল-

–  কার কি কি সমস্যা আলাদা আলাদা করে বলেন, সবার কি একই সমস্যা ?

একজন দু’হাত উঁচিয়ে সবাইকে থামতে বলে মোটা গলায় বেশ জোর দিয়ে  বলল-

– হাদে আফা শোন, খুলি কতিস্ – এই গিরামের মদ্দানোকগুনো মাল আনতি গেল  উপারে, কালগির নাত্তির বিলা গাঙ্গের ওপার থেইকে এপারে দল বেন্দে মাল নে এসতিলো। সেকোন মিলাজনের গায়ে বি এস এফের গুলি ল্যাগিস। দু এক জনের হদিস নি। কেউ কেউ গুলি খেয়ি তাও সাঁতরাইত সাঁতরাইত এপারে এস্যি উটেচে। দমদমার উকিন দু তিনজনার লাশ পড়েছে। তাগ্যের সগ্গলির বাড়িতি কান্দাকাটা পড়ি গেস্। কেউ কোন টাকা দিত পারবে না আইজগের।

সায়েমার কপাল কুঁচকে উঠেছে চিন্তায়। আজ প্রথম গ্রæপেই এই অবস্থা। পরবতী গ্রæপগুলোয় নাকি আরও সমস্যা। কিভাবে কালেকশন শেষ করবে!  সায়েমা ফোন করে ম্যানেজারকে। ফোন ঢুকছে না, দুতিনবার ফোন দিয়ে বন্ধ পেয়ে  গ্রæপের পরিস্থিতির কথা  হামিদভাইকে জানালো।  কিন্তু আশ্চর্য হলো তার  কথা শুনে ;

–  কালেকশন যে অবস্থায় আছে থাকুক, রেজিস্টার ক্লোজ করে অফিসে চলে আসেন  আপা ; আমরাও চলে এসেছি।

এরই মধ্যে বাতাসের বেগ বেড়ে উঠেছে। গাছপালার ডাল পাতার মাতলামী একমুখো। আশপাশের সব ঘরের ছাউনি থেকে গোলপাতাদের ওলোটপালট। একটা খালি ভ্যান চালিয়ে বাজারমুখো যেতে দেখে এক সদস্য চেঁচিয়ে থামতে বলল-

– আফা উই ভ্যানখান গঞ্জের দিকি যেতিস, তুমি ওতে করি্য চল্যে যাও। দেকতিছাও তো আন্ধার হয়্যে আসতিছে।

সায়েমা রেজিস্টার গুছিয়ে ব্যাগ কাঁধে উঠিয়ে বেরিয়ে পড়ল। এতক্ষণ ঘরের দেওয়ালের আড়ালে ছিল,  মাটির রাস্তায় নেমে খোলা আকাশের নিচে বাতাসের তান্ডবে নিজেকে বড় শুন্য মনে হচ্ছে। মাটির রাস্তার ধুলো উড়ে চারপাশ ধোঁয়াশা হয়ে গেছে। ভ্যানে চেপে বসে চালককে  নাজিমগঞ্জ ঘাটে যেতে বলল।

– উকিন গে কুনো লাব নি আফা, গাঙ্গ ফাঁপরায় উট্যি। সাঁকোর পর দে যাতি হবে। গায়ের জোরে প্যাডেল ঘোরাতে ঘোরাতে বলল ভ্যান চালক।

বাতাসে টালমাটাল খেতে খেতে ভ্যান এগিয়ে চলল। বাজারের মধ্যে এসে পড়ার পর চারদিকে ছুটোছুটি লক্ষ্য করল সায়েমা। দোকানের সাটার বন্ধ করছে কেউ কেউ, চা এর দোকানের উনুনে পানি ঢেলে দিল। কিছুক্ষণ পর পর ভীষণ ধাক্কা আসছে বাতাসের।  এক মুদি দোকানের সামনে কিছুক্ষণ দাঁড়ালো ভ্যান। সায়েমা গুটিয়ে ছইয়ের ভেতরে বসে আছে। দোকানের একজন চেঁচিয়ে আরেকজনকে বলল-

– হাদে খবর শুনিচাও ? গাবুরা, পাতাখালি বুড়ি গে।

– হ্যায় শুনিচ, মনডার মদ্যি অনজ্বালা হচ্ছে। ছোট বুনডার কদিন আগে বে দিলাম পাতাখালি। সুক্কালতে ফোন দিতিস। ধরিনি তারা। একোন দিতিস তা বন্ধ।

বাতাস এর ধাক্কা  একটু থামলে আবার চলতে লাগলো। বাঁ দিকে ঘাটের দিকে তাকিয়ে দেখল বড় গাছের ডাল ভেঙ্গে পড়েছে। ভ্যান সোজা সড়ক ধরে পার হয়ে চলে গেল। সাঁকোর পর দিয়ে ঘুরে যেতে হবে। কালিগঞ্জ ডাকবাংলার সামনের ঘাট অব্দি পৌঁছে দেখা গেল নদীতে উঁচু উঁচু ঢেউ একের পর এক এসে আছড়ে পড়ছে। বাঘের গর্জনের  মতো শব্দ তুলে ফুঁসে ফুঁসে উঠছে যেন। ভ্যান চালক প্রশ্ন করলো-

– আফা সমিতির কাজ করো নাই ?

– হুম।

– আইজগের কোন সমিতি কালেকশন করতি পারলোনা।  কিস্তি ফিলায় থুয়ে অফিসি ফিরি গে।

দশটার  মধ্যে  মাঠকর্মী রা সবাই একে একে ফিরে এসেছে অফিসে। ঝোড়ো বাতাসের সাথে পাল্লা দিতে দিতে ভ্যান এসে দাঁড়িয়ে গেল ভূমি অফিসের মোড়ে। শিমুলগাছটা মাঝখান থেকে ভেঙে রাস্তা বøক করে পড়ে আছে। নেমে ওটুকু দু’মিনিট সময় হেঁটে এসে অফিস গেটে ঢুকে পড়ল। কিন্তু একি ?

বাইরে যেমন ঝড় তুফান, দালানের ভেতরেও  চলছে তুখোড় ঝড়। টেবিল চাপড়ে কৈফিয়ত, জেরা , এসব চলছে। ব্যাগ থেকে রেজিস্টার বের করে টেবিলের পাশে বসল, বোঝার চেষ্টা করছে বিষয় কি, ঘটনা কি ঘটেছে। এটুকু বোঝা যাচ্ছে-  গতকাল ব্যাংক একাউন্ট থেকে কয়েক লক্ষ্য টাকা উত্তোলন হয়েছে, যার কোন হদিস মেলেনি। টাকা  উধাও  হওয়াকে কেন্দ্র করে ফোন করে ম্যানেজারের কাছে  হিসেব চেয়েছে  রিজিওনাল ম্যানেজার। ব্রাঞ্চ পরিদর্শনে সকালে আর.এম আসার কথা ম্যানেজার  জানতো। কিন্তু অন্যদের জানায়নি। এদিকে  হান্নান ভাই আজ অফিসে আসেনি। ম্যানেজার তার গ্রæপে যাবার কথা বলে বেরিয়ে উনিও গ্রæপে যাননি। তার সাথে ফোনেও যোগাযোগ করা যাচ্ছে না।  বিষয়টা ঘোলাটে।  এজন্যই কি ম্যানেজারের ফোন  তখন  বন্ধ  পেয়েছে  সায়েমা ?

সায়েমা হাত মুখ ধুতে পাশের বেসিনে গেল, টেবিলে কথা চলছে, শোনা যাচ্ছে-   কীভাবে ব্যাংক থেকে এতগুলো টাকা সরলো ? কে কে জড়িত এর সাথে ? হেড অফিসে খবর চলে গেলে এ মুহূর্তে কি কি হতে পারে ?  আরও শুনতে পেলো ঝড়টা বেশি উঠবে চেকসাক্ষরকারী তিনজনের উপরে।

এক এক করে সবার উপরে তদন্ত  চলবে, কেউ কেউ চাকুরীচুত্যও হতে পারে। আবার হয়তো কারও কিছু হবে না, যদি হেড অফিসের কানে পৌঁছবার পূর্বে ব্যাপারটা ব্রাঞ্চ অফিসেই মেটানো যায়। এসব নানা সম্ভাব্য কথা শুনছে, সায়েমা পুনরায় টেবিলে এসে বসে। এরপর যা শুনল, তাতে আশ্চর্য হতে আর বাকি রইলো না!

হামিদ ভাই বলল-

– স্যার একটা সমাধান আছে, সফট্ওয়ারে বিভিন্ন নামে কিছু নতুন সদস্য ক্রিয়েট করে তাদের নামে ঋণ বিতরণ দেখিয়ে দেওয়া যাবে।  অনেকের ঘরবাড়ির চিহ্ন থাকছে না, ঘরবাড়ি ছেড়ে অনেকে ক্রমশ উত্তরের দিকে যেতে লেগেছে, এবং পরবর্তীতে অনেক স্থানীয় সদস্যদেরও হদিস পাওয়া কঠিন।  কাজেই  ঝড়টাকে আমরা দারুণভাবে কাজে লাগাতে পারি ! আর কাগজপত্র রেডি করে ফাইল ঠিক রাখলেই ব্যাস্!

এ কথা শুনে তীরবিদ্ধ হচ্ছে সায়েমা !  আস্তে করে উঠে বারান্দার গ্রিলের পাশে পাঁয়চারি করছে আর নিজের প্রতি প্রশ্ন উঠছে-

“ অসংখ্য হতদরিদ্রের লক্ষ্য লক্ষ্য টাকা  কেউ আত্মসাৎ করল, আবার তাই  ধামাচাপা দিতে পুনরায় ঐ হতদরিদ্রদেরই  ব্যবহার ! এসব মেনে নিয়ে এখানে থাকা যায় ! এখানে তার কি কাজ ? কি করছে সে ? কেন করছে ? কার/কাদের জন্য করছে ? সুদের  টাকা শোধ করার জন্য একজন সদস্য ঘরে পোষা মুরগীর ডিম নিজে না খেয়ে সন্তানকে না খাইয়ে একটু একটু করে নিংড়ে জমানো টাকা যেসব এনজিওর থালায় তুলে দেয় ; সায়েমা তাদের হয়ে শ্রম দিচ্ছে ! সায়েমার কি আর কিছুই করার ছিল না!

নিশান্তর কথা মনে পড়ল। দুপুরের পর পরই  তান্ডব শুরু হয়েছে। দক্ষিণ পশ্চিম দিক থেকে ধেয়ে আসে ভয়াল কালো অন্ধকার। একটু পর সায়েমা শুনতে পেল-  দুর্যোগকবলিত জেলাগুলোয় কিস্তি আদায় সাময়িকভাবে বন্ধ ঘোষণা হয়েছে। ভাবছে কদিন ছুটি নেবে, মায়ের কাছে যাবে, শফি ভাইয়ের ফসলের জমি তলিয়ে গেল কিনা জানতে ইচ্ছে করছে। নিশান্ত ডেকেছিল, কি কথা সায়েমার সাথে !

গ্রীলের বাইরে দৃষ্টি গেল সায়েমার, চারিদিকে  জল আর জল, নোনা জল বাড়ছে-  নদীনালা খালবিলে, ফসলের জমিতে, মাছের পুকুরে, গোয়াল ঘরে, রান্না ঘরে,  বুকের জমাট জল বেড়ে চলেছে। হয়তো নামবে ভাঁটার টানে, হয়তো ধুয়ে নেবে সব জরা, ঋণ,হীন। রেখে যাবে পলির শান্তনা।  হয়ত সায়েমা দাঁড়িয়ে দেখবে শফি ভাই এর ক্ষেতে দোল খাবে আগামী ধানের ছড়া। অথবা হয়তো নিশান্তর সাথে মুখোমুখি বসে চা এর সাথে চলবে সমাজতান্ত্রিক  সমাজ গঠনের যুক্তিতর্ক। এসব নানা ভাবনা সায়েমার বোধের ভেতরে হাঁচড়পাচড় করতে লাগলো।

ভাটির টানে যখন বেনোজল নেমে যাবে, তখন হয়তো কিছু পলিমাটি রেখে যাবে, সেই পলিতে সমতার ফসল ফলবে হয়তো, বর্তমানে এই আশাটুকু অন্ততঃ করতে পারে সায়েমা।