You are currently viewing বড় বাবুর কুকুর – দেবাশিস ভট্টাচার্য

বড় বাবুর কুকুর – দেবাশিস ভট্টাচার্য

বড়বাবু সম্প্রতি বদলি হয়েছেন এসেছেন এ মফস্বল শহরটায় । অত্যন্ত সুশ্রী এ মানুষটির সাথে এসেছে তার প্রিয় কুকুর ডন। কুকুরটার চালচলন দেশি কুকুরদের চেয়ে আলাদা। আমাদের কুকুরদের মতো একপাল উঁকুন আর বিশ্রি দূর্গন্ধের জীব সে নয়। ডন বড়বাবুর কুকুর। তার ঠাট আলাদা। তাকে প্রত্যহ দেখাশোনার জন্য একজন কেয়ারটেকার আছে। নিয়মিত খাওয়ানো, গোসল, পরিচর্যা ছাড়াও বাথরুম করানোর কাজও তার উপর ন্যস্ত আছে। প্রথমদিকে বড় বাবু নিজেই তার পরিচর্যা করতেন। কাছে ডেকে মাংস খাওয়াতেন। পরিষ্কার ধূসর পশমের ভেতর আঙুল ঢুকিয়ে আদর করতেন। বিকেলে সাথে নিয়ে হাঁটতে বের হতেন। এ ছোট্ট মফস্বল শহরের পরিবেশ খুব সুন্দর নৈসর্গিক। পূর্বে পাহাড় আর পশ্চিমে সমুদ্র আর মাঝখানে এ ছোট্ট শহরটা। ভাগ্য খারাপই বলতে হবে। কিছুদিন যেতে না যেতেই হঠাৎ পেটের ব্যামো ধরলো কুকুরটার। কিছুই মুখে দিতে পারে না। এর জন্য সুস্বাদু খাবারের ব্যবস্থা করা হলো। যা একটু খেল তার চেয়ে বেশি বেড়ে তার বেরিয়ে যেতে লাগলো। চেহারা ভাঙতে লাগলো। বেচারা কেয়ারটেকার মহাচিন্তায় হাবুডুবু খেতে খেতে একদিন ধরা খেলো বড় বাবুর হাতে। আর বাথরুম নিয়ে যেতে যেতে তার অবস্থা আরো খারাপ। বড়বাবু গিয়ে জিজ্ঞেস করলেন – কিরে দিন দিন ডন এমন হয়ে যাচ্ছে কেন? তার ওজন তো অনেক কমে গেছে। কারণ কি? জানাসনি কেন? কেয়ারটেকার ভয়ে ভয়ে বলল – পেটের ব্যামো স্যার। যা একটু মুখে দেয় তার তিনগুণ বেরিয়ে যায়। বাঁচবে না স্যার ডন। তুই আমাকে বললেই আমি পশু ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতাম। ভাবলাম আবহাওয়া সহ্য হচ্ছে না। সয়ে এলেই ভালো হয়ে যাবে। কিন্তু না এটা চিন্তার ব্যাপার। বড়বাবু কি করবেন ভাবছেন। এত খারাপ অবস্থা হয়ে যাবে তিনি তা ভাবতে পারেননি। রাগে-দুঃখে ঘরের ভিতরে গিয়ে ধুম করে দরজায় খিল লাগিয়ে দিয়ে বিছানায় ঝাঁপিয়ে পড়লেন। আসলে তিনি নিজের সন্তানের মত ভালোবাসতেন ডনকে। পরদিন অফিসে বসেই টেলিফোনে জরুরি তলব করলেন পশু ডাক্তারকে। তিনি এলেন। উপর থেকে চেইন লাগানো অবস্থায়ই কেয়ারটেকার হেকমত ডনকে কে নিয়ে এলো ডাক্তারের কাছে। ডাক্তার চোখের চশমার উপর নিচ করে জীভ, পেট ইত্যাদি পরীক্ষা করে বললেন – হুম। বড়বাবু জিজ্ঞেস করলেন কেমন দেখলেন তিনি। ডাক্তার কোনো কথা বললেন না। অতঃপর কাপড়ের ব্যাগ থেকে একটা লম্বা ইনজেকশন বের করে হলুদ রঙের কিছু ওষুধ মিশিয়ে তিনি পুশ করলেন ডনের শরীরে। ডনের পায়ে চেপে ধরে থাকা হেকমতের ঘাম দিয়েছে কপালে। পরামর্শ পত্রে লিখে দিলেন তিনি। প্রতিদিন সকালে স্থানীয় ডেবার পাড়ের চারপাশে তাকে দৌড়ানোর ব্যবস্থা করে নিতে হবে এবং প্রতিদিন এই কাজ শেষে তার স্বাস্থ্যের জন্য মুক্ত ভাবে ছোলা খাওয়াতে হবে। প্রয়োজনে তার গলার সাথে সুতা দিয়ে ছোলার টিন বেঁধে দিতে হবে। যেখানে ইচ্ছা সেখানে খেতে পারে মত। তাকে দিতে হবে স্বাধীনতা। তখন আস্তে আস্তে চোখের নিচে কালিমা কেটে যাবে। সুস্বাদু খাবার দিতে হবে। তবেই মাংস লাগতে থাকবে শরীরে এবং আগের মতোই নাদুসনুদুস হয়ে যাবে ডন। মুহূর্তেই আগের ডনের ছবিটা ভেসে উঠল বড় বাবুর দু চোখের সামনে। একটা বাগানের ভেতর ডনের সাথে পিংপং খেলছেন তিনি। সাদা ডিমের মতো বলটা তিনি ছুড়ে মারছেন আর মুহূর্তে ডন মুখে করে সেটা কুড়িয়ে আনছে। আবেগে তিনি জড়িয়ে ধরলেন পশু ডাক্তারকে। পরদিন থেকে কাকভোরেই ডনকে নিয়ে যাওয়া হলো ডেবার পাড়ে। ডেবাটি চৌকনা। সব দিকে একই দূরত্ব মনে হয়। ঠিক হলো পশ্চিম দিক থেকে ছাড়া হবে ডনকে। সে দক্ষিণ দিক দিয়ে ঘুরে আসবে আগের জায়গায়। গলায় ভেজা ছোলার টিন বাঁধা হল। প্রথম দিন চেইন ধরেই কেয়ারটেকারের সাথে দৌড়ালো ডন। কুকুরটার সাথে হেকমতের অবস্থা আরো খারাপ হয়ে গেল। ডন তেমন ছোলা খেতে অভ্যস্ত নয়। গলা থেকে টিনটা ফেলে দেওয়ার জন্য সে আপ্রাণ চেষ্টা করছিল। শেষমেষ না পেরে টিনের ভেতর মাথাটা লাম্বা করে ঢুকিয়ে দিয়ে সে বড় বড় করে শ্বাস নিতে লাগলো। পরদিন চেইন খুলে দিয়ে টিনটাকে আগের মত মজবুত করে বাঁধা হল এবং ডনকে ছেড়ে দেওয়া হল। ডন দৌড়াচ্ছে হেকমতও দৌড়াচ্ছে। মুখটা টিনের ভেতর ঢুকে শ্বাস প্রশ্বাস বন্ধ হওয়ার জোগাড়। কিছুদুর গিয়েই ডন পরে গেল। হেকমত ভাবছে পরিশ্রান্ত ডন ছোলা খাচ্ছে। একসময় দৌড়াতে দৌড়াতে ক্লান্ত হেকমত গাছের গুড়িতে হেলান দিয়ে একটু ঘুমিয়ে নিল। ঘুম থেকে উঠে দেখল যথেষ্ট বেলা হয়ে গেছে। কি করার! দৌড়ে গিয়ে দেখল ডন তখনও আগের ভঙিতেই টিনে মুখ ঢুকিয়ে আছে। তার শরীর ঠান্ডা ট্রলারের মাছের মত। টিনও খোলা যাচ্ছে না মুখ থেকে অবশেষে কাঁদতে কাঁদতে কেয়ারটেকার হেকমত বড় বাবুর বাংলোতে এসে সালাম ঠুকল। – স্যার, ডন দৌড়াতে দৌড়াতে পড়ে গিয়ে ঠান্ডা হয়ে গেছে। এই দেখেন স্যার। বড় বাবু পরিক্ষা করে দেখলেন তার চোখমুখ রক্তবর্ণ ধারণ করলো। তিনি চিৎকার করে টেলিফোনে পশু ডাক্তারকে ডেকে আনলেন। তিনি মাথা ঝুকিয়ে দাঁড়ালেন। স্যার কি ব্যাপার? তুমি বুঝতে পারছো না? তুমি তো আমার ডনকে মেরেই ফেলেছো। ডনের জীবন তুমি ফিরিয়ে দেবে। নাহয় জেল খাটবে। পরদিন ভুল চিকিৎসার কারণে পশু ডাক্তারের বিরুদ্ধে মামলা হল এবং পশু ডাক্তারকে অন্যত্র বদলি করে দেওয়া হল। ডন সত্যি সত্যি ভালো বিচার পেল ভেবে বড় বাবু প্রাণ খুলে হাসলেন।