You are currently viewing বিস্ময়>  বিচিত্রা সেন

বিস্ময়> বিচিত্রা সেন

বিস্ময়

বিচিত্রা সেন

 

কয়েকদিন ধরে রবিনের মনটা খুব অস্থির। বন্ধুবান্ধব সবাই প্রেম করছে। অথচ ওর কোনো প্রেমিকা নেই। ক্লাসমেট অনেক মেয়ে ছিল,কিন্তু কারও সাথে তার কখনো বন্ধুত্ব গড়ে ওঠেনি। ছোটবেলা থেকে সে মেয়েদেরকে এড়িয়ে চলতো। কেন যেন মেয়েদের সাথে কথা বলতে তার নার্ভাস লাগতো। এ কারণেই মেয়েদের সাথে তার বন্ধুত্ব গড়ে ওঠেনি। কিন্তু এ কয়দিন ধরে তার মনটা কেমন বিষণ্ন হয়ে যাচ্ছে। সব বন্ধুর প্রেমিকা আছে,আর ওই কেবল নিঃসঙ্গ! না,এভাবে চলতে পারে না। এবার একটা প্রেম করতেই হবে। 

 

গা ঝাড়া দিয়ে শোয়া থেকে উঠে বসে রবিন। ল্যাপটপটা ওপেন করে। ওর চোখে একটু সমস্যা আছে। এজন্য মোবাইলে কমফোর্ট ফিল করে না। নেটের দুনিয়া ভ্রমণ করতে চাইলে সে ল্যাপটপই বেছে নেয়। ফেইসবুকটা একটু সার্চ দিই,দেখি এখান থেকে কাউকে মনে ধরে কিনা,মনে মনে ভাবে রবিন। যেই ভাবা সেই কাজ। একের পর এক বন্ধুবান্ধবদের আইডিতে ঢুকে মেয়েদের আইডি খুঁজতে থাকে সে। শেষপর্যন্ত একজনকে মনে ধরে তার। নীলিমা আজিজ- নামটাও বেশ। একটু ভেবে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠিয়ে দেয় সে। তারপর অপেক্ষার পালা। একঘণ্টা যায়,দুঘণ্টা… রিকোয়েস্ট আর একসেপ্ট হয় না। এদিকে মা ডাকছে ভাত খেতে। দূর! এসময় কি খাওয়া পেটে ঢোকে? তবুও উঠতে হয়। মা না হয় রেগে যাবেন। কোনোরকমে দুটো খেয়ে উঠে যাবার সময় মা বলেন,

-কী রে! এত তাড়াহুড়ো করছিস কেন? শান্তিমত ভাতটা খা। 

-খেয়েছি তো। আর পারবো না। 

বলেই রবিন বেসিনের দিকে এগোয়। তারপর হাতমুখ ধুয়ে আবার ল্যাপটপ নিয়ে বসে। না,এখনো রিকোয়েস্ট একসেপ্ট করেনি। দূর! মেয়েটা কি ইচ্ছে করে তাকে কনফার্ম করছে না,নাকি এখনো তার রিকোয়েস্ট চোখেই পড়েনি। সে রাতটা প্রচণ্ড উৎকণ্ঠায় কেটে যায়। পরেরদিন সকালে অফিসে চলে যায়। সারাদিন প্রচণ্ড ব্যস্ততায় কাটে তার। ফেইসবুকে ঢোকার মত সময় হয় না। বিকালে বাসায় এসে নাস্তা করে ফেইসবুকে ঢুকতেই বুকটা ধক করে ওঠে তার। তবে আতংকে নয়,আনন্দে। মেয়েটি তার রিকোয়েস্ট একসেপ্ট করেছে। আহামরি সুন্দরী সে নয়,কিন্তু বড্ড মায়াবী। চোখদুটোর দিকে তাকালে কেন যেন শুধু তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করে। পাঠাবে নাকি একটা টেক্সট ম্যাসেন্জারে? মনটা একটু খু্ঁতখুঁত করলেও হাতের আঙ্গুলগুলো টাইপ করে বসে, “হ্যালো,আমাকে একসেপ্ট করার জন্য ধন্যবাদ।” তারপর নিজের অজান্তেই  সেন্ড করে দেয়। 

 

রবিন দেখে নীলিমা ম্যাসেজটি সিন করেছে। একটু পরই উত্তর ভেসে আসে,”এফবি একাউন্টে একসেপ্ট করেছি, জীবনে নয়।” বাহ্!  মেয়েটি তো দারুণ কথা জানে। এমন মেয়েই তো তার পছন্দ। সাথে সাথে সে উত্তর দেয়,”এটাও বা কম কী? আমি এতেই খুশি।” নীলিমা এ ম্যাসেজটাও সিন করে। একটু পরই উত্তর আসে,”এত অল্পেই খুশি? বাহ! ভালো ছেলে তো।” রবিনকে কথার নেশায় পেয়ে বসে। একের পর এক টেক্সট দিতেই থাকে। নীলিমাও মজার মজার উত্তর দিয়ে নেশাটা আরও বাড়িয়ে দেয়। একসময় রবিন লেখে,”আমরা কি বাস্তবে বন্ধু হতে পারি?” এবার আর নীলিমা ম্যাসেজ সিন করে না। একসময় ওর সবুজবাতি নিভে যায়। রবিন ভাবে,দূর! বেশি তাড়াহুড়ো করে ফেললাম না তো?

 

পরের দিন রবিন আগ বাড়িয়ে আর কোনো টেক্সট পাঠায় না। কিন্তু বার বার নীলিমার ম্যাসেন্জারে চোখ রাখে।  সবুজবাতি জ্বলছে ওর। কিন্তু ম্যাসেজ সিন করছে না। ভীষণ দ্বিধায় পড়ে যায় রবিন। টেক্সটা পাঠিয়ে সে কি অন্যায় করে ফেলেছে! মেয়েটা এমন নীরব হয়ে গেল কেন? হঠাৎ কবিতার কয়েকটি লাইন এসে তার মাথায় বিলি কাটে। বিন্দুমাত্র সময় নষ্ট না করে সে টাইমলাইনে গিয়ে কবিতাটা লিখেই ফেলে। তারপর পোস্ট করে দেয়। এরপর জোরে জোরে আবৃত্তি করতে থাকে সেই কবিতা–

 

“তোমার বাড়ির সবুজবাতি 

দিচ্ছে আমায় ডাক

মনকে বলি চোখ সরাতে

মন তো বলে থাক।

আমার বাড়ির সবুজবাতি

তোমায়ও কি ডাকে?

কেমন করে মনকে বোঝাও

মন কি বশে থাকে?”

 

হঠাৎ ওর মুখে এমন আবৃত্তি শুনে মা এসে উঁকি দেন। বলেন,

-কী রে! কাকে কবিতা শোনাচ্ছিস?

রবিন হেসে বলে,

-কাউকে না। নিজে নিজে উচ্চারণ ঠিক করছি। 

 

মা কী বুঝলেন কে জানে। তবে কথা আর না বাড়িয়ে চলে যান। রবিন টেনশন আর নিতে না পেরে বিছানায় গা এলিয়ে দেয়। একটু পর মোবাইলের স্ক্রিনে ম্যাসেঞ্জারে চোখ রাখে সে। আর সাথে সাথেই আনন্দে লাফাতে ইচ্ছে করে তার। নীলিমা তার প্রশ্নের উত্তর দিয়েছে। লিখেছে,”আমি রাজি।” জানায় রবিনের কবিতাটা পড়ে সে মুগ্ধ হয়েছে। এরপর দুজনের কথা যেন আর ফুরোয় না। তারপর ঘণ্টা গড়ায়,ঘণ্টার সাথে সাথে দিন। রবিনকে কথার জালে জড়িয়ে ফেলেছে নীলিমা। একটু সময় পেলেই ও এখন ম্যাসেঞ্জারে সময় কাটায়। তবে অফিসে মোবাইলে হাত দিতে পারে না। বাসায় আসার পর আর কোথাও বের হয় না। মা তো মহাখুশি। ছেলে এখন সবসময় ঘরেই থাকে। আগে সন্ধ্যার পরে বাসায় এসে আবার বেরিয়ে যেতো। এখন যদিও সারাক্ষণ ল্যাপটপ নিয়ে থাকে,তবুও তো চোখের সামনেই থাকে। রাতে কোথাও গেলে মায়ের মনটা দুরুদুরু করে। একমাত্র ছেলেকে নিয়ে সারাক্ষণ তিনি টেনশনে থাকেন।

 

সেদিন রাতে ঘুমুতে যাবার আগে নীলিমাকে একবার নক করে রবিন। নীলিমা নেটেই ছিল। সাথে সাথে সাড়া দেয়। হঠাৎ রবিনকে চমকে দিয়ে নীলিমা টেক্সট পাঠায়,”আমার সাথে দেখা করতে ইচ্ছে করে না?” রবিন তো মেঘ না চাইতেই জল পেয়ে যায়। খুশিতে ডগমগ করে লেখে,”খুব ইচ্ছে করে,কিন্তু ভয়ে বলি না। যদি তুমি রাজি না হও।” নীলিমা হাসির ইমো পাঠায়। তারপর লেখে,”চলো,কালকে বিকেলে আমরা দেখা করি।” রবিন তো তখন হাওয়ায় উড়ছে। তাড়াতাড়ি লেখে,”আমি রাজি। বিকেল পাঁচটায় আমি সিআরবিতে অপেক্ষা করবো। ঠিক গোলচত্বরটাতে থাকবো।” নীলিমা লেখে,”ওকে,আমি আসবো।” এরপর শুভরাত্রি বলে দুজন দুজনার কাছ থেকে বিদায় নেয়।

 

পরদিন একটা নীল পাঞ্জাবি পরে বিকেল পৌনে পাঁচটায়  সিআরবির গোলচত্বরে হাজির হয় রবিন। পরিচিত কাউকে দেখা যায় না,নীলিমাকেও না। বার বার চারদিকে চোখ বুলায় সে। এরই মধ্যে আধঘণ্টা পার হয়েছে। এখন সোয়া পাঁচটা। এখনো নীলিমার দেখা নেই। মেয়েটার দেখি কোনো সময়জ্ঞান নেই। মনে মনে বিরক্ত বোধ করে সে। প্রতীক্ষার প্রহর যেন ফুরোয়ই না। কে যেন বলেছিলেন,অপেক্ষা মৃত্যুর চেয়েও ভয়ংকর। এখন তো তার তাই মনে হচ্ছে। মোবাইলে ম্যাসেঞ্জারে বার বার চোখ রাখে রবিন। নীলিমার সবুজবাতি অফ। কী বোকামি করেছে। এতদিন ধরে কথা বলছে ওরা। অথচ ফোন নম্বর বিনিময় হয়নি। এতদিন সেটার প্রয়োজনই হয়নি। আজ এ মুহূর্তে রাগে নিজের চুল ছিঁড়তে ইচ্ছে করছে তার। দূর! আর পারবো না অপেক্ষা করতে, ভেবে যেই না রবিন স্টেডিয়ামের দিকে পা বাড়িয়েছে, দেখে সামনে নীলিমা। প্রথমে নিজের চোখকে বিশ্বাস হয় না তার। কিন্তু সেই মায়াবী চোখ,সেই মিষ্টি হাসি। রবিন মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকে। রবিনের চোখের সামনে হাত নেড়ে যেন ওর ঘোর কাটাতে চায় নীলিমা। বলে,”আমি নীলিমা। চেনা যায় আমাকে?” রবিন নিজেকে সামলে নিয়ে একটু হেসে বলে,”আমি রবিন।” নীলিমা মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বলে,”আরে তোমাকে পরিচয় দিতে হবে না। আমি চিনেছি বলেই তো সামনে এগিয়ে এসে পরিচয় দিলাম।” রবিন অপ্রস্তুত হয়ে যায় নীলিমার সপ্রতিভতায়। তবুও স্মার্ট ভঙ্গিতে বলে,”চলো,তাসফিয়ায় বসি।” 

 

ওরা দুজন তাসফিয়ায় গিয়ে বসে। রবিন চিকেন টিক্কা আর পরোটার অর্ডার দেয়। তারপর খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে থাকে নীলিমাকে। গায়ের রঙটা শ্যামলা,মাঝারি গড়ন,পরে এসেছে তাঁতের শাড়ি। অনেকের চোখে হয়তো খুবই সাধারণ। কিন্তু রবিনের চোখে সে অসাধারণ এক মানবী। রবিনকে চুপ দেখে নীলিমাই টুকটাক কথা বলছিল। রবিন অপলক তাকিয়েছিল ওর দিকে। ঠিক এসময়ই ব্যাপারটি ঘটে। একটি ছেলে  এসে দাঁড়ায় ওদের দুজনের মাঝখানে। রবিন ভ্রু কুঁচকে তাকায় ছেলেটির দিকে, কিন্তু চিনতে পারে না। ততক্ষণে নীলিমা উঠে দাঁড়িয়েছে। ওর মুখ রক্তশূন্য। চোখে আতংকের ছায়া। ছেলেটি কণ্ঠে বিদ্রূপ ঢেলে নীলিমার দিকে তাকিয়ে বলল,”এবারের শিকার বুঝি ও?” রবিন তাকিয়ে আছে নীলিমার দিকে। নীলিমা স্তব্ধ, বাকরহিত। ছেলেটি এবার রবিনের দিকে তাকিয়ে বলল,”সাবধান,আপনার আগে আমি ছিলাম ওর শিকার। আমার আগে ছিল আরেকজন। সেই ছেলেটি যখন আমাকে এসে বলেছিল,তখন বিশ্বাস করিনি। তাই তো আজ আমার এ পরিণতি। কিন্তু আজ আমি আপনাকে জানিয়ে গেলাম সত্যটা। বিশ্বাস করা না করা আপনার ব্যাপার। ও ভয়ংকর এক নারী। শুধু শিকার খুঁজে বেড়ায়।” বলেই একটা সজোরে চড় কষিয়ে দেয় নীলিমার গালে। তারপর থু বলে  টলতে টলতে বেরিয়ে যায়। 

 

ঘটনার আকস্মিকতায় রবিন স্তব্ধ। তার চোখ নীলিমার দিকে। কিন্তু নীলিমার চোখ ছেলেটির দিকে,সে চোখে প্রচণ্ড আতংক। রবিন বুঝতে পারে না এ মুহূর্তে তার কী করণীয়? সে কিছু বলার আগেই হঠাৎ টেবিল থেকে পার্টসটা তুলে নিয়ে ছুটে বেরিয়ে যায় নীলিমা। রবিন অপলক তাকিয়ে থাকে তার দিকে। তবে এবারের দৃষ্টিতে সেই মায়াবিনীর প্রতি মুগ্ধতা নয়,আছে বিপন্ন  বিস্ময়।

 

==================