You are currently viewing বিষ্ণু বিশ্বাসের ঘোর ও সময়ের ঘূর্ণি > আলী সিদ্দিকী

বিষ্ণু বিশ্বাসের ঘোর ও সময়ের ঘূর্ণি > আলী সিদ্দিকী

বিষ্ণু বিশ্বাসের ঘোর সময়ের ঘূর্ণি

আলী সিদ্দিকী

বিষ্ণু বিশ্বাস যে সময়কালের ভেতর দিয়ে কাব্যজগতে বিচরণ করেছেন সেই সময়টিতে আমিও সমান্তরালে পথ চলেছি ভিন্ন অঞ্চলে। সমসময়ের প্রপঞ্চের ভেতরে জারিত হয়েছে আমাদের বোধ ও মননের শাখা-প্রশাখা। তাই সমকালের আরশিতে পরিষ্কারভাবে বিষ্ণু বিশ্বাসের যাপিত সময়ের প্রতিচিত্র সহজেই দেখতে পাই। সেই আলোকেই বিষ্ণু বিশ্বাসের কবিতা উদযাপন ও  কাব্যচেতনায় প্রতিফলিত সমকালকে দেখার প্রয়াস থেকেই এই লেখার আয়োজন।

১৯৮৩ সালে বিষ্ণু বিশ্বাস যখন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষ ইতিহাসের ছাত্র তখন আমার চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাস বিভাগের তৃতীয় বছর।  ১৯৮১ সালের ৩০শে মে জিয়াউর রহমান হত্যা, বিচারপতি সাত্তারের বিরুদ্ধে রক্তপাতহীন অভ্যুত্থান করে জেনারেল এরশাদের (২৪শে মার্চ, ১৯৮২) ক্ষমতা দখল ইত্যাদি রাজনৈতিক নাটকীয়তা দেশে এক অস্থিরতা সৃষ্টি করে। জেনারেল এরশাদ ক্ষমতা কুক্ষিগত লক্ষ্যে সকল রাজনৈতিক কর্মকান্ড নিষিদ্ধপূর্বক সামরিক শাসনকে তৃণমূল পর্যন্ত বিস্তৃত করে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর সকল ছাত্রসংগঠনের মধ্যে গুঞ্জন সৃষ্টি হয়। গল্প আর কবিতা লেখা তখন আমার একমাত্র নেশা। প্রয়াত কবি শাহিদ আনোয়ার, মাহমুদ কচি, রিজোয়ান খান, পারভেজ কায়সারকে নিয়ে দল বেধে ক্যাম্পাসে ঘুরছি, আড্ডা দিচ্ছি। বন্ধু রিজোয়ানের মাধ্যমে সলিমুল্লাহ খানের সাথে যোগাযোগ হয় এবং ইকবাল করিম হাসনুসহ কয়েকজনে মিলে প্র্যাক্সিস অধ্যয়ন সমিতি গঠন করি। প্র্যাক্সিস জার্নালও ছাপা হয়। কিন্তু মৌলিকভাবে লেখালেখিতে থেকে যাই এবং সে সময় ‘এরোটিক’ নামে একটা কবিতাপত্র বের করেছিলাম। তিন চার ইস্যু করার পর একদিকে অর্থসংকট অন্যদিকে ছলকে উঠা রাজনৈতিক দাবানল আমাকে একপ্রকার উড়িয়ে নিয়ে এলো রাজপথে। পর্যায়ক্রমে দেশ  দীর্ঘ রাজনৈতিক সংগ্রামের উত্তপ্ত হয়ে উঠে। একদিকে স্বাধীনতাবিরোধী সহকারে বিএনপি জোট অন্যদিকে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষশক্তি। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছিলো মৌলবাদীদের দুর্গ। তাই ত্রিমুখী লড়াই করতে হচ্ছিলো। একই অবস্থা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়েও মৌলবাদী জামাত-শিবির হিংস্র থাবা দিচ্ছে বারবার। ফজলে হোসেন বাদশা’র সাহসিক লড়াই ছিলো। সে সময় বিষ্ণু রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সবুজ চত্বরে গান আর কবিতা আবৃত্তি দিয়ে সকলকে মুগ্ধ করে চলেছেন।

বিষ্ণু বিশ্বাসের দীর্ঘদিনের সহচর কথাসাহিত্যিক ফয়জুল ইসলামের স্মৃতিগদ্য “আমার বন্ধু বিষ্ণু বিশ্বাস” থেকে জানা যায়, “এর মাঝে, ১৯৮৪ আর ১৯৮৫-তে, অল্প ক’টা রোমান্টিক কবিতা লিখেছিল বিষ্ণু। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসভিত্তিক পত্রিকাতে ছাপা হয়েছিল তার দু’একটা। তবে সে দেশের জাতীয় কোনও দৈনিক বা সাপ্তাহিকীতে কখনোই তার কবিতা ছাপতে দেয়নি। ১৯৮৬-র পয়লা দিকে দেখা গেল, বাঁক বদল হচ্ছে তার কবিতার- রোমান্টিক কবিতার পাশাপাশি নৈর্ব্যক্তিক কবিতা লিখছে সে, বাহবাও পাচ্ছে।“ ১৯৮৭ সালের জানুয়ারীতে বিষ্ণু বিশ্বাস বন্ধু শামসুল কবির কচি ও এনায়েত কবির টুকুনের সাথে “পেঁচা” পত্রিকা প্রকাশ করেন। ‘ভোরের মন্দির’ এ সংযুক্ত কবিতা “নির্বেদ” “টেলিগ্রাম”, “অ-ভাব মৃত্যুর কবিতা” “সুধীন্দ্রনাথ”, “মৃত্যু”পেঁচা প্রথম সংখ্যায় প্রকাশিত হয়। “ভোরের মন্দির”-এ গ্রন্থিত কবিতাগুলোতে রচনার দিন তারিখ না থাকলেও ১৯৯৩ সালে অন্তর্ধানের পর বিষ্ণু বিশ্বাসের আর কবিতা লেখা হয়ে ওঠেনি। “১৯৯৩-র পয়লাতে ঢাকা ছেড়ে যাবার পরে সে আর কবিতা লিখেনি; কোনও বইটইও পড়েনি! অজ পাড়াগাঁতে বই আসবেই বা কোথা থেকে?” ফয়জুল ইসলাম লিখছেন । ২০১৫ সালে ঢাকায় ফিরে এলে সকলের অনুরোধে কিছুটা মনোনিবেশ করে কিছু কবিতা লিখেছিলেন বিষ্ণু কিন্তু ঢাকা ভালো না লাগায় মায়ের কাছে পশ্চিমবঙ্গের বনগাঁ এলাকায় চলে যান।

একটা বিষয় পরিষ্কার বোঝা যায় যে, সমকালীন বাস্তবতায় সামগ্রিকভাবে জনসমাজে, বিশেষতঃ ছাত্র সমাজে স্বৈরাচার বিরোধী গণতান্ত্রিক আন্দোলন এবং যুগপৎভাবে সাংস্কৃতিক আন্দোলনের যে আবেগঘন আবহ সৃষ্টি হয়েছিলো, বিষ্ণু সেই বলয়ের ভেতরেই ছিলো- আবৃত্তি, গানে তার অংশগ্রহন ছিলো কিন্তু তার নিজের সৃষ্টির মধ্যে সেই আবেগের প্রতিফলন ঘটেনি।  ‘জনারণ্যে একা’ জাতীয় বিচ্ছিন্নতাবোধ, ঘোর এবং বিভ্রমের যে প্রবণতা তৎকালীন যুবসমাজের একটি অংশকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিলো – বিষ্ণু তাদের মতোই একজন। সামরিক শাসনবিরোধী লড়াইয়ে সম্পৃক্ত হবার আগ পর্যন্ত আমিও সেই দলভুক্ত ছিলাম। ঘোরলাগা সময়ের গায়ে হেলান দিয়ে কাটিয়ে দেয়া সময়গুলো ছিলো আড্ডা, হল্লা, আর গলা ফাটিয়ে সমস্বরে গান গেয়ে বেড়ানো। কবিতা-গল্প লেখা, আবৃত্তি করা, মাঝে-মধ্যে মিথ্যে বিরহে হাউমাউ মান্না, কিশোর, আরডিতে গড়াগড়ি করা। বোহেমিয়ান জাতীয় চালচুলোহীন ভেসে বেড়ানো। সবকিছুতে আছি আবার কোত্থাও নেই। যাপিত জীবন, সমাজ ও বাস্তবতার প্রতি এক ধরণের নির্লিপ্ততাই ছিলো এই প্রবণতার মূল উপসর্গ। আমাদের সময় আবহেই বিষ্ণুর বিচরণ এবং ঘোরলাগা প্রহরের ভেতর থেকে কুড়িয়ে নেয়া শব্দ দিয়ে কবিতা লিখে গেছেন। অই সময়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার সঙ্গী ছিলো মহসিন বয়াতী, মাহমুদ কচি ও প্রয়াত বন্ধু কবি শাহিদ আনোয়ার। মহসিনের ছিলো জমকালো আর ভরাট গলা। সে ট্রেনে, বাসে, স্টেশনে, মামু’র দোকানে, ক্যাম্পাসে দরাজ গলায় মরমী গান- মাইজভান্ডারী, লালন, হাসন- গেয়ে যেতো আপনমনে। কচি ছিলো চুপচাপ, মৃদুভাষী, চাপা তবে আবৃত্তি করতো দরদ দিয়ে। শাহিদ আনোয়ারের প্রবণতার সাথে বিষ্ণু অনেক মিল দেখা যায়। যদিও শাহিদ আনোয়ার এক পর্যায়ে রাজনীতিতে কিছুদিনের জন্য সক্রিয় হয়েছিলো কিন্তু দীর্ঘদিন সিজোফ্রেনিকে ভুগে গতবছর হারিয়ে গেছে পৃথিবী থেকে। বিষ্ণুর মধ্যে আমাদেরই প্রতিবিম্বের প্রতিসরণ দেখতে পাই।

বিষ্ণুর এই নির্লিপ্তি সম্পর্কে কবি, নাট্যকার ও অনুবাদক বদরুজ্জামান আলমগীর তাঁর “ফ্রিদা কাহলোর হরিণ” প্রবন্ধে সঠিকভাবে বলেছেন, “ ভিতরে ভিতরে ইতিহাসের চালচিত্রটি তাঁর বোধের মধ্যে ছিল- সামরিক শাসনবিরোধী যে আন্দোলনটি হচ্ছিল তার প্রাণভোমরায় বিষ্ণু মানুষের সামাজিক ও মনস্তাত্ত্বিক মুক্তির প্রকৃত বীজানু দেখতে পাননি, ফলে সামরিক স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন তাঁকে আমূল উদ্বুদ্ধ করেনি।“

সাম্প্রদায়িক হিংসামুক্ত, কলোনিয়াল হ্যাংওভারমুক্ত, গণতান্ত্রিক একটি রাষ্ট্রের জন্য প্রাণ দিলো ত্রিশলাখ মানুষ কিন্তু দেশটিতে সংখ্যালঘু মানুষেরা স্বদেশেই পরবাসী হয়ে গেলো আর স্বৈরাচার ও পরিবারতন্ত্রের যাঁতাকলে শ্বাসরুদ্ধ মানুষের জীবন। আমার প্রচুর বন্ধুদের মধ্যে সারাক্ষণ একধরণের তটস্থতা, হতাশা, অনিশ্চয়তা দেখে দেখে বড় হয়েছি। সাম্প্রদায়িক হিংস্রতা তাদের মধ্যে অসহায়ত্বকে প্রকট করে তুলতে দেখেছি। তারা যেনো শ্যাওলার মতো ভাসছে। ১৯৯০ সালে, এরশাদের ক্ষমতাচ্যূতির পূর্বে দেশে পরিকল্পতভাবে সংখ্যালঘুদের উপর তিনদিন ধরে হামলা চালানো হয়। এলাকার সখ্যালঘুদের বাড়িঘর আমরা রাতজেগে পাহারা দিয়েছি। ভয়ের যে সংস্কৃতি সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর উপর চাপিয়ে দেয়া হয়েছে তার আর্থ-সামাজিক প্রতিক্রিয়ার চেয়ে মনস্তাত্ত্বিক যে বিহবলতার জন্ম দিয়েছে তার মূল্য সীমাহীন। স্বদেশে উদ্বাস্তু মানুষের নিঃসহায়তা কোনো মূল্য দিয়েই নিরূপণ করা যায় না। বিষ্ণুর মধ্যে এই অসহায়ত্ব ভয়াবহ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে ১৯৯২ সালের দাঙ্গায়। তিনি সিজোফ্রেনিকে আক্রান্ত হন। এব্যাপারে বদরুজ্জামান আলমগীর তুলে ধরেছেন এভাবে, “দেশভাগের পরম্পরায় বিষ্ণু বিশ্বাস নিজের দেশেই উদ্বাস্তু ছিলেন, কখনোই নিজের জন্মভিটায় সাতপুরুষের দৃঢ়, নির্বিঘ্ন নোঙর পুঁতে বসতে পারেননি- জীবনভর নামহীন গোত্রহীন কচুরিপানা হয়ে ভাসছিলেন।“

বাস্তবতা থেকে, জায়মান রুদ্ধতা থেকে , অন্ধকারে ছেয়ে থাকা জীবনপ্রবাহ থেকে ভয়ে মুখ লুকিয়ে রাখার বেদনার্ত প্রহরগুলো বিষ্ণুর শব্দচয়নের পরতে পরতে জীবন্ত হয়ে থাকে। “ভয় শেষে” কবিতায় দেখি তার রূপ;

“মাঝে মাঝে ভয়ে থাকি বিপুল আঁধার মাঝে এক মেশার সংশয় থাকে আগামীর অন্ধকারে জেগে। কেবল মৃত্যুর দূতী গাছ থেকে চুপি চুপি নেমে আঁধারে দাঁড়িয়ে থাকে, থাকে শুধু দাঁড়িয়ে, ডাকে না। পরিচিত বন্ধুদের শব কোন্ শ্মশানের ঘাটে পুনর্বার মরতে দেখি-নিহত ছুরিকাঘাতে। কী যে বিষন্ন বিপদে রাত্রি, রাত্রি শুধুরাত্রি চতুর্ধার। যদি জন্মন্তর মানি, পরজনমের রক্তস্রোতে আমি স্নিগ্ধ শবাধার।“

বাঙালি সমাজের ধর্মীয় বিভাজনের বিষাক্ততা সাতচল্লিশ সাল থেকেই রক্তক্ষরণ করছে, অশ্রুতে ভেসে যাচ্ছে জনপদ। বিষ্ণুর পূর্বপুরুষদের অনেকেই দেশান্তরী হয়েছে-তাদের মধ্যে অনেক বিদ্যান, অনেক প্রতিভাবান মানুষ ছিলো। সাতচল্লিশের ভ্রান্তি ঘোচাতে গিয়ে অজস্র প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীন দেশটিও বিভাজন রেখা মুছতে চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছে। এখানে বিষ্ণুর নয় হার হয়েছে সমগ্র বাঙালী জাতির।

জুলাই ২০, ২০২২

আলী সিদ্দিকী

কবি, কথাসাহিত্যিক, সম্পাদক – মনমানচিত্র