You are currently viewing বিষম >  মেহনাজ মুস্তারিন

বিষম > মেহনাজ মুস্তারিন

বিষম

মেহনাজ মুস্তারিন

 

মাঠের চেহারা দেখে খদেজা অবাক! নিত্যদিন যে মাঠ দেখে সে অভ্যস্ত, তার কোন নিশানাই নাই। মাঠের একপাশে বিশাল সামিয়ানা টানানো হয়েছে, বেশ বড় একটা মঞ্চ, তার পেছনে বড় বড় অক্ষরে লেখা:

দুইদিন ব্যাপী জীবনানন্দ কবিতা উৎসব

কবিতা শব্দে খদেজার মনে বিস্ময় জাগে, এ জিনিষ তো একান্তে পড়বার, তা নিয়ে উৎসব? তার ছোট মাথায় ঢোকে না, তা সত্ত্বেও খদেজার বুঝতে অসুবিধা হলো না যে, কবি হোক কি যেই হোক, মাঠের দখল চলে গেছে এমন কারো হাতে, যাদের সে চেনে না। সে এই মাঠে খেলে, পাতা কুড়ায়, এক অর্থে এটা তারই মাঠ। মাঝে মধ্যে এখানে এর ওর অনুষ্ঠান হয়, তখন মাঠের দখল তাদের কাছে চলে যায়। দখল নিয়ে তারা কী করে না করে, তারপর যথারীতি মাঠ নোংরা করে চলে যায়। তখন এই খজেদাকেই পরিষ্কার করতে হয়, নোংরা মাঠ তার ভালো লাগে না।

মাঠের দখল নাই তো খেলাও নাই। খদেজা ভাবে, খেলা নাই তো কী হয়েছে? সিদ্ধান্ত নিতে দেরি করে না সে, এ দুইদিন এখানেই ঘাপটি মেরে বসে থাকবে। কবিতার উৎসব বলে কথা! দুপুরে একবার বাসায় গেলেও চটজলদি ফিরে এসেছে সে।

বিকাল গড়াতে না গড়াতেই খদেজা দেখলো, মানুষজন আসছে। একে একে অভ্যাগতরা এসে চেয়ারে বসছে। ওদিকে স্টেজ থেকে কেউ কেউ উচ্চস্বরে মাইকে কথা বলছে। খদেজার সেদিকে মনোযোগ নাই; অনেকক্ষণ ধরে ফ্রক দিয়ে লম্বা ঠ্যাং ঢাকবার ব্যর্থ চেষ্টা করে চলেছে, কেন করছে, নিজেই  বুঝতে পারছে না। বছরখানেক হলো গায়ে গতরে লম্বা হয়ে উঠেছে খদেজা। ইদানিং মানুষজন কেমন করে জানি তাকিয়ে থাকে। এটা নতুন অভিজ্ঞতা খদেজার, মানুষগুলো তার মধ্যে কী দেখে আল্লাই জানে। দেখে দেখুক, সেদিকে মনোযোগ দিলে তো পেটের ভাত জোগাড় হবে না। বছর দু’য়েক হলো মা ওদের রেখে চলে গেছে।  নিজের বলতে দুই বোন, ছোটটা বছর চারেক বয়স। সৎমার ঘরেও তিন ভাইবোন। বাপ বাদাম বিক্রি করে। সৎ-মা বাসা বাড়িতে কাজ করে।

খদেজার স্পষ্ট মনে আছে সেই রাতের কথা– বাইরে প্রচন্ড ঝড়, তবু তার কান শুনতে পেয়েছিল মা’র গলায় গোঙানি– ‘মারো, আরো মারো, মেরে শেষ করে দাও, এ জীবন ভাল্লাগে না…।’ পাশাপাশি বাপের ভয়ঙ্কর গলার আওয়াজ– ‘বেশ্যা মাগি, কয়টা ভাতার লাগে তোর, অ্যাঁ…।’ দরজা লাগানো ছিল, খদেজা কয়েকবার ধাক্কাও দিয়েছিল; কিন্তু, কেউ খোলেনি। দরজার ওপাশে তখন একটানা ধুমধাম শব্দ। রাগে-দুঃখে অন্য ঘরে গিয়ে কাঁথার নিচে মাথা লুকিয়ে কানে হাত দিয়ে বন্ধ করতে চেয়েছিল প্রলয়। পরদিন ঘুম ভেঙে মাকে আর দেখেনি। সেভাবে খোঁজাও হয়নি। বাপের কোনো আগ্রহ ছিল না; ভাবখানা এমন– যেখানেই যা, পেটে দানাপানি না পড়লে সুরসুর করে চলে আসবে! বাপের হিসেবে ভুল ছিল, মা আর ফেরেনি। মা যে কেন ফিরলো না, কী ঘটেছিল সেদিন আর কেনই-বা বাবা চাইলো না মা ফিরে আসুক, সবই অজানা খদেজার।

একদিন মাকে খুঁজে বের করতে পারবে, সেই আশায় একটু একটু করে বড় হয় খদেজা।

একবেলা স্কুল আর দিনের বাকি সময় বাপের সাথে বাদাম বিক্রির কাজ করে খদেজা। এভাবেই কেটে যাচ্ছিল। হঠাৎ করে একটা পরিবর্তন ঘটে তার মধ্যে। ইশকুলে বাংলা বইয়ের কবিতাগুলো ভালো লাগতে শুরু করে। একই কবিতা সে বারবার করে পড়ে। যতবার পড়ে ততবার নতুন কিছু আবিস্কার করে। তখন অদ্ভুত এক ভালোলাগায় ভরে যায় তার মন। বাংলা ক্লাসে সে সবচেয়ে মনোযোগী। একদিন বাংলা-শিক্ষক তার কাছে জানতে চেয়েছিল, “তুই কি সব বিষয়ে এমন মনোযোগী, না কি শুধু বাংলায়?’

খদেজা মুখ হা করে তাকিয়েছিল। মনোযোগ বিষয়টা বুঝতে সে অক্ষম ছিল। তার বদলে শিক্ষক যদি জানতে চাইতেন, সবচেয়ে প্রিয় বিষয় কী, তাহলে চোখ বন্ধ করে বলে দিতে পারাতো, কবিতা!

খদেজার কবিতাপ্রীতি গোপন বিষয় না। কেউ কোনদিন জানতে চায়নি কবিতা কেন তার এত প্রিয়। তাতে কিছু যায় আসে না, তার বুকের মধ্যে লুকিয়ে রেখেছে ছোট একটা দুঃখ— মায়ের মুখ। খদেজা তাই কবিতার মাঝে মায়ের মুখ খোঁজে, আর অদ্ভুতভাবে পেয়েও যায়। কবিতা পড়ার সময় তাকে খুব আনমনা দেখায়। চারপাশের শূন্যতার মধ্যেও নিজেকে তখন আর একা লাগে না। মনে হয় কবিতার প্রত্যেকটা শব্দ আর ছন্দের মাঝে যেন মা তার সাথে কথা বলে।

কয়েকবছর আগের কথা, তখন সে সবে  ক্লাস ফোরে উঠেছে, একদিন বাদামের ঠোঙ্গার সাদা অংশে সে লিখে ফেলে,

মা তুমি হারিয়ে গেলে

আকাশের ঐ মেঘের কোলে!

লেখার পরে তার মনে এক অন্যরকম চাঞ্চল্য ভর করে। সে বুঝতে পারে কিছু একটা হয়েছে, কিছু একটা একেবারে নতুন! ঠোঙ্গাটা সে যত্ন করে বইয়ের ভেতরে লুকিয়ে রাখে। এভাবে সে প্রায়ই এটা সেটা লিখে, আর বইয়ের ভাঁজে ভাঁজে যত্ন করে সাজিয়ে রাখে। তার কেন জানি মনে হয় এসব লিখার সময় কবিতার বর্ণমালা তার একান্ত হয়ে যায় আর মা যেন তার সাথে গল্প করতে থাকে। কত রকমের গল্প! তার কি শেষ আছে না হবে কোনদিন? একদিন শিক্ষককে তার লেখা দেখাতে গেলে কোনকিছু না ভেবেই শিক্ষক বলে দিলেন, “আরে, তুই তো কবিতা লিখেছিস!”

সেই থেকে কবিতা শব্দটা খদেজার নিজস্ব। যেখানে যেই শব্দটা উচ্চারণ করুক, খদেজার মনে হয় তাদের সে চেনে, তারা তার আপনজন। এতদিন ধরে যাদের কবিতা মুখস্ত করেছে, সেই কবিদের পাশে নিজেকে সে দেখতে পায়, আর অদ্ভুত এক আনন্দে মনটা ভরে যায়।

এভাবে কখন যে কবিতার দিকে খদেজার ঝোঁক বেশ বেড়ে গেল, টের পায়নি। কেবল মা’কে খুঁজে পাওয়া তো না, কবিতার ছন্দে অদ্ভুতভাবে মার আদর স্পর্শ সব পেতে শুরু করলো সে। ওই বয়সেই তার অনেক কবির নাম মুখস্ত হয়ে গেল, এমনকি তাঁদের কবিতাও। বাড়ির আশেপাশের অনেকে তা শুনতে চাইতো,  আর  শোনার পরে সবাই  কেমন অবাক হয়ে তাকাতো!

একদিকে মাঠের দখল অন্যদের কাছে চলে যাওয়া, অপরদিকে কবিতার প্রতি টান— এই দোটানায় খদেজা আটকে ছিল দু-দিন। অবশেষে, কবিতার টানেই কবিতা উৎসবে ছুটে এলো সে। বাবা শুনলে বাঁধা দিতে পারে সে আশঙ্কায় তাকে কিছু না বলেই চলে এসেছে। চিন্তা করলে করুক, হারিয়ে তো যাচ্ছে না। আসার পর একটা কোনায় চুপচাপ বসে খুব ভালোভাবে সবকিছু বোঝার চেষ্টা করছে খদেজা। কত সুন্দর করে সব সাজানো, ফুল দিয়ে, গাছ দিয়ে। কবিতা উৎসব তো না, যেন বিয়ে বাড়ি, তেমনি একটা সাজসাজ ভাব। ছেলেরা ইস্ত্রিভাঙা পাঞ্জাবি, আর মেয়েরা নতুন নতুন রঙচঙে শাড়ি পরে এসেছে। ঘাড়ে তাদের লম্বা লম্বা চটের বা কাপড়ের ব্যাগ। সকলের হাতে বই। নিশ্চয়ই কবিতার বই!

খদেজা শুনতে পেল মাইকে কে যেন মিষ্টি কন্ঠে বলছে, “জীবনানন্দ কবিতা উৎসবে সকলকে স্বাগতম!”

খদেজার মন আটকে গেল জীবনানন্দ শব্দে। মঞ্চের পেছনে এই শব্দটি সে দেখেছে, এখন মাইকেও শোনা যাচ্ছে। মাইকে ভেসে আসা বেশিরভাগ শব্দই খদেজার কাছে নতুন। এসব শব্দের মানে জানতে ইচ্ছে করছে তার। কিন্তু, কাকে জিজ্ঞেস করবে? তার মনে প্রশ্ন জাগে, আচ্ছা এখানে যদি সবাই কবিতা পাঠ করে আর শোনে, তাহলে এত সেজেছে কেন? কবিতায় থাকবে গরীবের কথা, দিনমজুরের কথা, বলবে পাপ-পূণ্যের কথা, ভালোবাসার কথা, ন্যায় অন্যায়ের কথা। তার বদলে আকাশ বাতাস, সূর্য কতকিছু নিয়ে তারা কথা বলে যাচ্ছে। এর মধ্যে কয়েকবার ভালোবাসা শব্দটা উচ্চারিত হতে শুনেছে খজেদা। তার মনে প্রশ্ন জাগে, ”আচ্ছা ভালোবাসা কী? এটা কি শুধু ধনীদের থাকে?”

খদেজা চোখ বড় বড় করে দেখছে, সকলে ছবি তোলায় আর হাসি খুশিতে ব্যস্ত, কত রকমের অঙ্গ ভঙ্গি তাদের। ওদিকে মাইকে বারবার বলে যাচ্ছে, “এইতো অল্পক্ষণের মধ্যেই অনুষ্ঠান শুরু হবে, আপনারা আসন গ্রহণ করুন।” আশেপাশের মানুষদের দেখে খদেজার বুঝতে এতটুকু অসুবিধে হলো না যে, বেশিরভাগ মানুষ কিছুই শুনছে না বা শোনার ভান করছে। সকলেই তাদের মোবাইল ফোন নিয়ে ব্যস্ত! আচ্ছা ওরা কি কবিতা শুনতে এসেছে না অন্যকিছু?

মাইকে ইতিমধ্যে কয়েকবার জীবনানন্দ নামটা বলা হয়ে গেছে। খদেজার খুব জানতে ইচ্ছে করছে এই জীবানানন্দ ব্যক্তিটা কে? তিনি কি কবি? কবিই যদি হয়, তো তার সম্পর্কে শিক্ষকদের কাছে কেন সে কিছুই শোনেনি? বই-এ তার কোন কবিতা নাই কেন? খদেজা ইতস্তত এদিক ওদিক তাকালো, কাকে জিজ্ঞাসা করা যায়, ভাবতে ভাবতে উঠে গিয়ে এক ভদ্রমহিলার চেয়ারের পাশে বসলো সে, তারপর খুব নিচু স্বরে চেয়ারে বসা ভদ্রমহিলার কাছে জানতে চাইলো, ”খালাম্মা! জীবানানন্দ কে?”

ভদ্রমহিলা অবাক হয়ে খদেজার দিকে তাকালো। তার চোখের দৃষ্টিতে বিস্ময়, যেন এমন আহাম্মক আছে বাংলাদেশে যে কিনা জীবনানন্দকে চেনে না! ভদ্রমহিলার মধ্যে জবাব দেয়ার আগ্রহ দেখা গেল না। সেটা বুঝতে পেরে খদেজা জানতে চাইলো, ”অনেক টাকাপয়সা আছে তার? আপনাদের মত ধনী?”

  ভদ্রমহিলা এবার ভালো করে খদেজাকে লক্ষ করলো। মেয়েটা যে বস্তিতে থাকে, টোকাই-ফোকাই হবে, তাতে কোন সন্দেহ নেই। কাগজ টোকানোর কাজ করছিস সেটাই কর বাপু, তোর কেন আদার ব্যাপারি হয়ে জাহাজের খোঁজ নিতে হবে? ভদ্রমহিলার মনে যাই থাক, খদেজার কান শুনতে পেল, ”এই! তুই এসবের কী বুঝিস? জীবনানন্দকে জেনে তোর কাজ কী? যতসব আজগুবি প্রশ্ন!  তুই কি কবি হতে চাস? যা, একটু দূরে গিয়ে বসতো। তোর কথার অত্যাচারে আসল কথাগুলোই শোনা হলো না।” ‍

মুহূর্তে খদেজার মধ্যে জেদ চাপলো। ভদ্রমহিলার কথামতো দূরে না গিয়ে সে ওখানেই মাটি কামড়ে পড়ে রইলো।

খজেদার বেয়াদপি সহ্য হলো না ভদ্রমহিলার। অগত্যা, তিনি নিজেই একটু দূরে গিয়ে অন্য একটা চেয়ারে বসে মোবাইল ফোনে কী যেন দেখতে লাগলেন।

একটা ঠোঙার সাদা কাগজে খদেজা লিখলো,

 

অমন করে বলো না,

আমিও কবি হতে পারি!

আমিও পারি কবিতার মাঝে ডুবে যেতে,

আবার পারি কবিতার মাঝে ভেসে উঠতে!

জানো কি জানো না,

আজও নজরুল পথ চেয়ে আছে, আমি তারই

কথা শুনতে পাই, তারই দিকে আছি চেয়ে, তারই

বার্তা শোনা যায় চারিদিকে,

ভুলে যেও না–

তাই বলছি, অমন করে বলো না,

আমিও কবি হতে পারি,

পারি তোমাদের অহংকার টেনে নামাতে।

 

এই কয়েক লাইন লিখার পর খদেজার বুকে অভিমান জন্মে। মা যে কেন ফিরে আসে না! ভাবতে ভাবতেই তার মনে হলো মা যেন পেছনে দাঁড়িয়ে তাকে বলছে, ’এদিকে আয়। এদিকে আয় বলছি!’

মুখটাকে পেছনে ফেরাতেই খদেজা দেখতে পেলো বেশ খানিকটা পেছনে মা দাঁড়িয়ে, তার মুখ থেকে বিচ্ছুরিত হচ্ছে আলো, যা মঞ্চের সব আলাকে ম্লান করে দিয়েছে। সহসা খদেজার বুক পাহাড়ের মতো উঁচু হয়ে গেল। ’দাঁড়াও! আসছি!’ বলে সে কবিতা লেখা কাগজটিকে ভাঁজ করে এক পা দু-পা করে ভদ্রমহিলার কাছে গেল, তারপর তার হাতে সেটি গুঁজিয়ে দিয়ে মায়ের হাত ধরবে বলে পেছন ফিরে দৌড়াতে শুরু করলো। তার মনে হলো, মা যেহেতু এসেই গেছে, কবিতার আর প্রয়োজন নাই।

কাগজের ভাঁজ খুলতেই ভদ্রমহিলার নজর গেল সুন্দর হস্তাক্ষরে লেখা কবিতার দিকে। একবার পড়ার পরেই তাঁর মধ্যে ভাবান্তর দেখা গেল। তিনি তাঁর চারপাশে খুঁজলেন; কিন্তু, কোথাও মেয়েটাকে দেখতে পেলেন না। তিনি চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন, সামিয়ানার নিচ থেকে বেরিয়ে এবার অনেকটা দূরে তাকাতে তাঁর নজর গেল অল্পবয়সি কয়েকটা মেয়ের দিকে, তারা একসাথে খেলা করছে। তিনি দ্রুত সেখানে গেলেন এবং কবিতাটি দেখিয়ে তাদেরকে জিজ্ঞেস করলেন, “তোমাদের মধ্যে কে এই কবিতা লিখেছ? আমাকে বলো!”

সকলে ভদ্রমহিলার মুখের দিকে চোখ গোল করে তাকিয়ে থাকলো। তাদের মুখভঙ্গি দেখে ভদ্রমহিলার বুঝতে এতটুকু অসুবিধে হলো না যে, কবিতা লেখা দূরের কথা, এমন আজব শব্দ তারা জীবনেও শোনেনি।

===================