You are currently viewing বিপ্লবী আলোয় ‘কবিতাসমগ্র মাও সে-তুঙ’ > লাবণী মণ্ডল

বিপ্লবী আলোয় ‘কবিতাসমগ্র মাও সে-তুঙ’ > লাবণী মণ্ডল

বিপ্লবী আলোয় ‘কবিতাসমগ্র মাও সে-তুঙ’ 

লাবণী মণ্ডল

 

‘কুচকাওয়াজের মাঠে প্রথম সূর্যের আলোয়

পাঁচফুট–রাইফেল কাঁধে

কি উজ্জ্বল আর সাহসী দেখাচ্ছে তাদের।

রোখা মেজাজে ভরপুর চীনের মেয়েরা

তারা হাতিয়ারগুলির প্রেমিকা,

সিলক আর শাটিনের নয়।

হুঁশিয়ার

এই সময়

কোনো কথা বলতে নেই।

এই সময়

কারো ডাকে সাড়া দিতে নেই।

তাহলেই

তোমার ভাইবেরাদরদের ভেতর থেকে

তোমাকে ছোঁ মেরে নিয়ে যাবে সেই কালো হাত

যা মানুষজনকে গুনতি করতে চায়

একটার পর একটা মাথার খুলি দিয়ে।’

 

মাও সে–তুঙয়ের এ কবিতাটি বহুবার পড়েছি। কমরেডদের মুখে শুনেছি। এর বাইরে আরও দুয়েকটি কবিতা পড়ার সুযোগ হয়েছিল। তবে তাঁর যে আরও অসংখ্য কবিতা রয়েছে, সেটি জানা ছিল না। কৌতূহল মানুষকে জানার সুযোগ করে দেয়। সেটি আবারও সত্য প্রমাণিত হলো।

মুস্তাফা মজিদ সম্পাদিত ‘কবিতাসমগ্র মাও সে–তুঙ’ বইটি হাতে পেয়েই গোগ্রাসে পড়া শুরু করলাম। কী বিচিত্র দুনিয়া! কত অজানা!

মাও সে তুঙ একজন বিপ্লবী, একজন কমিউনিস্ট। পুরো বিশ্বকে কাঁপিয়ে দেওয়ার মতো সৎসাহস ক’জনেরই বা থাকে! বিপ্লবীদের ভেতর রোমান্টিকতা থাকে না, এমন কথা একবিংশ শতাব্দীতেও বেশ প্রচলন রয়েছে; কিন্তু পূর্বসূরীদের ইতিহাস পড়লে এসব যান্ত্রিক কথার বাইরে এক ভিন্ন বাস্তবতা বুঝা যায়।

ঊনবিংশ শতাব্দী। ১৮৯৩ সাল। ডিসেম্বর মাস। কনকনে শীত। এ রকম এক দিনে পৃথিবীর বুক আলোকিত করার জন্য এক শিশুর জন্ম হয়। ২৬ ডিসেম্বরের কোনো এক সময়ে। তিনি মাও সে–তুঙ। বাবা ছিলেন কৃষক; কিন্তু একাগ্রতা তাঁকে বিত্তশালী করে তুলেছিল। মা–বাবা দুজনেই সামান্য শিক্ষিত ছিলেন। কৈশোর থেকেই বাঁধাধরা নিয়মভিত্তিক পড়াশুনার বাইরে গল্প, কবিতা ও উপন্যাসের বই পড়তেন। রাজনৈতিক সাহিত্যও বাদ দেননি। মাত্র ষোলো বছর বয়সে মাও সে–তুঙয়ের বুদ্ধিবৃত্তিক ও রাজনৈতিক ধ্যানধারণার ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে। বাবার অমতে তিনি আধুনিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। এটিই তাঁর সঠিক জীবনের সন্ধান দেয়।

১৯২০ সাল। বসন্তকাল। দুর্ভিক্ষের হাতছানি। চীনজুড়ে দেখা দেয় গণবিদ্রোহ। চারদিকে বিদ্রোহের লেলিহান শিখা ছড়িয়ে পড়ে। তৎকালীন সরকার নানা ধরনের নির্যাতন ও দমনমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করে। মাও ও তার সহপাঠীরা এ নিয়ে বিস্তর পর্যালোচনা করেন। পরবর্তী সময়কালে মাও এ সম্পর্কে বলেন, ‘এই বিদ্রোহীরা অতি সাধারণ মানুষ, অবিচার এদের জীবনকে পঙ্গু করে রেখেছে।’

এসব বিদ্রোহী মনোভাবসম্পন্ন সাধারণ মানুষই মাও সে–তুঙয়ের চিন্তায় গভীরভাবে প্রভাব ফেলে। সাধারণ মানুষের পক্ষাবলম্বন করেছেন বরাবরই; কিন্তু এভাবে একটি–দুটি ঘটনায় সমাজ পরিবর্তন হবে না বলে বিপ্লবের জয়গানও গেয়েছেন।

মাও সে–তুঙয়ের মধ্যে রোমান্টিকতা ছিল। বিপ্লবী চেতনা এবং রোমান্টিকতাকে সমন্বয় করে, একের পর এক শব্দ গেঁথে, গীতিময়তার মাধুরী মিশিয়ে লিখেছেন কবিতা। এটি তাঁর প্রধান কাজ ছিল না, তবে বিপ্লবী কর্মকাণ্ডের ফাঁকে ফাঁকে লিখতেন কবিতা। বিপ্লবের প্রতি তাঁর দৃঢ়তা এবং মার্ক্সবাদ–লেনিনবাদের চিন্তার আলোকেই যে গণমানুষের মুক্তি সম্ভব; এই চিন্তাই তাঁর কবিতাতে ফুটে উঠত। এখানে রোমান্টিকতা তাঁর বিপ্লবী সত্তাকে আরও স্বতঃস্ফূর্ত ও সৃজনশীল করেছে।

শুধু বন্দুক দিয়েই পুরো বিশ্ব জয় করা যায় না। এর পেছনে প্রেম, ভালোবাসা, বিরহ–বেদনা, শিল্প–সাহিত্যের প্রতি অনুরাগ থাকাটাও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। জনগণের শিল্প–সাহিত্য–সংস্কৃতি গড়ে না তুলতে পারলে, বিপ্লবের পথ সুদৃঢ় হয় না। যে কারণেই, মননশীল শিল্প–সাহিত্যের প্রতি তিনি দিতেন আলাদা জোর। শিল্প–সাহিত্য দিয়েও যে শত্রুর দুর্গে আঘাত হানা দেওয়া যায়, শত্রুর মসনদকে টলিয়ে দেওয়া যায়, সেটি তিনি ধারণ করতেন।

১৯৪২ সালের, মে মাসে ‘সাহিত্য ও শিল্পকলা’ সম্পর্কে ইয়েনানের আলোচনা সভায় তিনি বলেন, ‘চীনা জনগণের মুক্তির জন্য আমাদের সংগ্রামে বিভিন্ন ফ্রন্ট রয়েছে, সেগুলোর মধ্যে লেখনী ও বন্দুকের ফ্রন্ট অর্থাৎ সাংস্কৃতিক এবং সামরিক এই দুটি ফ্রন্ট রয়েছে। শত্রুকে পরাজিত করার জন্য অবশ্যই আমাদের সর্বপ্রথমে বন্দুকধারী সেনাবাহিনীর উপর নির্ভর করতে হবে; কিন্তু কেবল এই বাহিনীই যথেষ্ট নয়, একটি সাংস্কৃতিক বাহিনীও আমাদের অবশ্যই থাকতে হবে, যে বাহিনী আমাদের নিজেদের ঐক্যবদ্ধ করার জন্য এবং শত্রুকে পরাজিত করার জন্য নিতান্তই অপরিহার্য।’

মাও সে–তুঙয়ের কবিসত্তা যে কতটা শক্তিশালী, সেটি ‘কবিতাসমগ্র মাও সে–তুঙ’ বইটি পড়ার মধ্য দিয়ে বুঝা সম্ভব। সেইসঙ্গে এটিও সত্য যে, বিপ্লবের নেতৃত্ব দানকারী সত্তার পদভারে তাঁর কবিসত্তা বেশ খানিকটা ম্লান হয়ে পড়ে, অথবা কম আলোচ্য থেকে গেছে। অথচ মাও সে–তুঙয়ের বিপ্লবের নেতৃত্ব দানকারী সত্তার সৃজনশীল বিকাশে তাঁর কবিসত্তা বা রোমান্টিক সত্তার অবদান অনস্বীকার্য।

মাও সে–তুঙয়ের জীবদ্দশায় তাঁর কবিতা ততটা প্রচার পায়নি, আলোচনায়ও আসেনি। তবে তাঁর মৃত্যুর পর বিস্তৃত হয়েছে সারা বিশ্বে। সমাজ পরিবর্তনকামী অনেক ব্যক্তিবর্গের মধ্যেই তাঁর কবিতা অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে। চীনা ভাষা থেকে প্রথমে ইংরেজিতে তাঁর কবিতাগুলো অনুবাদ হয়। ইংরেজি থেকে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়েছে। বাংলা ভাষার অন্যতম তাৎপর্যপূর্ণ কবি বিষ্ণু দে প্রথম মাও সে–তুঙয়ের কবিতা অনুবাদ করেন বলে জানা যায়। বাংলা ভাষায় তখনই মাওয়ের কবিতা প্রাণ পায়। বিস্তার ঘটে। এরপর ক্রমানুসারে সন্দীপ সেনগুপ্ত, কমলেশ সেন, জয়ন্ত চৌধুরী, অমল দত্ত, ফয়েজ আহমদসহ আরও বিভিন্নজন বিভিন্ন সময় মাও সে–তুঙয়ের কবিতা অনুবাদ করেন।

এ বইটিতে বিভিন্ন সময় অনূদিত প্রকাশিত এবং অপ্রকাশিত কবিতা সংযুক্ত করা হয়েছে। ৪১টি কবিতা রয়েছে। এ ছাড়াও রয়েছে কবিতা নিয়ে মূল্যায়ন। সম্পাদনা করতে গিয়ে মুস্তাফা মজিদ এখানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে কাজটি করেছেন, সেটি হলো বাংলার পাশাপাশি ইংরেজি কবিতাগুলোও তুলে ধরেছেন। এতে ভিন্ন ভাষাভাষীরাও বইটি পড়তে পারবে। সেইসঙ্গে পাঠকরা ইংরেজির সঙ্গে মিলিয়েও নিতে পারবেন। আমার জানামতে, মাও সে–তুঙয়ের কবিতা নিয়ে এটি সম্ভবত প্রথম সমৃদ্ধ সংকলন। ‘কবিতাসমগ্র মাও সে–তুঙ’ বইটি ২০০২ সালে, জীবন প্রকাশন থেকে প্রকাশিত হয়। ২০০২ সালের প্রকাশিত বই নিয়ে ২০২১ সালে আলোচনা; এটি থেকেই বোঝা যায় বইটির প্রাসঙ্গিকতা। এখানেই শিল্প–সাহিত্যের শক্তি। বিষয়বস্তুর গুরুত্ব বিবেচনা করে যতদিন মানবসভ্যতা টিকে থাকবে, ততদিন এ রকম শিল্প–সাহিত্য মানুষ পড়বে নিজ প্রয়োজনেই।

প্রতিটি কবিতাই আলাদা আলাদা অর্থ বহন করে। প্রেম–বিরহ–বিপ্লব; প্রাণ–প্রকৃতির সমন্বয় করেই তিনি কবিতা লিখেছেন। সংগ্রামী মানুষের কবি হওয়াটা সাধনার ব্যাপার বটে! রাজনীতিতে নেতৃত্ব দেওয়া এবং সেই রাজনীতিকে শিল্প–সাহিত্যরূপে ছাপ রেখে যাওয়া দুঃসাধ্য এবং কষ্টকর।

মাও সে তুঙয়ের শিল্প কমিউনিস্টদের বেশ প্রভাবিত করে। ইতিহাস ঘেঁটে জানা যায়, ‘লংমার্চ’ কবিতাটি বিপ্লবীদের অন্যতম হাতিয়ার হিসেবে আখ্যায়িত হয়। এমন একটি কবিতা, যার প্রতিটি চরণে লালফৌজের আশা–আকাঙ্ক্ষার কথা। উপমা ও প্রতীক সেভাবেই ফুটিয়ে তুলেছিলেন। লালফৌজ বাহিনীর প্রত্যেক কমরেডই এমন একটি কবিতা নিজেদের চিন্তায় ধারণ করেছিলেন। যা বিপ্লবী রাজনীতির জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যে বিষয়টির একবিংশ শতাব্দীতে ব্যাপক অভাব। শিল্প–সাহিত্যের ভয়ংকর খরাকাল চলছে। কলম যেন স্তব্ধ। রাষ্ট্রের কাছে জিম্মি!

এ বইটি পড়ে এ কারণেই বেশ অনুপ্রেরণা পেয়েছি। যদিও এটি অনূদিত বই। তবুও এর শব্দচয়ন, বাক্যশৈলী বেশ সাবলীল। এর আগে মাও সে–তুঙয়ের যেসব প্রবন্ধ পড়েছি, সেগুলোও সহজ–সুন্দরভাবে উপস্থাপন করা। ধারণা করা যায়, মূল লেখায় সহজ ভাষার উপস্থাপনই অনুবাদে প্রতিফলিত হয়েছে।

১৯৩৫ সালের অক্টোবরে তিনি ‘লং মার্চ’ ছাড়া আরও দুটি কবিতা রচনা করেন। যার একটি হলো ‘কুনলুন’। এ কবিতাটির চমক অন্য ঢংয়ের। রূপকথার ছন্দে লেখা।

তাঁর কবিতায় রূপকথার বিষয়বস্তু ছিল– লালফৌজরা শ্রম ও বুদ্ধি দিয়েই পারে পৃথিবীর এই পাপ–পঙ্কিল আবর্জনার স্তূপ সরাতে, নতুন পৃথিবী গড়ে তুলতে। চিন্তা–চেতনায় বিপ্লবী দৃঢ়তাকে কত প্রখরভাবে স্থান দিলে রূপকথায় এ রকম বিপ্লবী চিন্তা স্থান পায়! সত্যিই বিস্ময়ের শেষ নেই।

‘যাত্রাশেষে’ কবিতাটি হলো সাদা ড্রাগন নিয়ে। সাদা ড্রাগন অশুভ শক্তি। এই অশুভ শক্তিকে বাঁধতে চান কবি। লিউপান শিখর অনেক উঁচুতে। যেখানে লাল পতাকার শোভায় শোভায়িত হোক, অশুভ শক্তি পরাস্ত হোক। বিপ্লবী চিন্তা–চেতনার বহিঃপ্রকাশই ঘটেছে মাও সে–তুঙয়ের সৃষ্টিতে। উত্তরাঞ্চলের নৈর্সগিক প্রকৃতি কবি মনকে বারবার প্রলুব্ধ করেছে।

১৯৩৫ সালের পর কবিতা লেখার ক্ষেত্রে তিনি নিয়েছেন দীর্ঘ বিরতি। যে বিরতি তাঁকে আরও বেশি শাণিত, সমৃদ্ধ করেছিল। অথচ অনেক শিল্পী–সাহিত্যিকরা প্রতিদিনই লিখেন, যে লেখায় নেই কোনো বাস্তবতা, নেই জনগণকে অনুপ্রাণিত করার কথা!

১৯৪৯ সালে আবার তিনি কবিতা লেখা শুরু করেন। ওই বছর এপ্রিলে তিনি লিখেন ‘নানকিং বিজয়’। যে কবিতাটি রাশিয়ায় সমাজতান্ত্রিক অক্টোবর বিপ্লবের বিজয়কে ইঙ্গিত করে। তিনি লিখেন, ‘বীরোচিত বিজয়ে বিপর্যস্ত আকাশ ও মাটি।’ এরপর আরও বেশি কিছু কবিতা লিখেছেন মাও। এর মধ্যে ‘এবার সজাগ হও’ কবিতাটি খুব নাড়া দিয়েছিল। বিপ্লবী সংগ্রাম যখন নাজুক অবস্থায়, তখন বিপ্লবী নেতার এমন ডাক আরও বেশি অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিল।

১৯৫০ সালের প্রথম জাতীয় দিবস। নৃত্য–গীত অনুষ্ঠান চলে দেদারসে। সে সময় লিও ইয়া জু একটি কবিতা রচনা করেন। যে কবিতার উত্তরে মাও সে–তুঙ লিখেন–

‘চীনের আকাশে এখন রক্তাক্ত সোনালি প্রভাত। শতাব্দীব্যাপী শয়তানের ঘূর্ণিনৃত্যে তা পক্ষাঘাতগ্রস্ত। চীনের আশি কোটি মানুষ কোনোদিন ঐক্য খুঁজে পায়নি, তবু মোরগ ডেকেছে, প্রভাত হয়েছে…।’

এরপর তাঁর আরও কিছু অসামান্য সৃষ্টি রয়েছে। যাঁর একটি হলো ‘পেইটাই হো’। নয়া চীনকে যখন কেউ স্বীকৃতি দিচ্ছে না, তখন তিনি এ রকম একটি কবিতা লিখেন। যে কবিতাটি জুড়ে ছিল আশাবাদ।

১৯৬১ সালে মাও সে–তুঙ লিখেন মহিলা মিলিশিয়াদের জন্য কবিতা। আমরা নারীদের নিয়ে সাহিত্যের যে নোংরামী দেখি, আর অবাক হই। ঠিক বিপরীতভাবে কিছু মহৎ ব্যক্তির সাহিত্যে নারীকে তাঁরা দৃঢ়চিত্তে তুলে ধরেছেন। তিনি নারী মিলিশিয়াদের জন্য লিখেন, ‘সকালের প্রথম আলোতে প্যারেডের মাঠে/ পাঁচ ফুট লম্বা রাইফেল অসম সাহসিনী উজ্জ্বল জ্বলজ্বল/ এরা চীনের মেয়ে– মনে দুর্বিজয়ের আশা/ তারা ভালোবাসে যুদ্ধসাজ/ শাড়ি–গয়নার চেয়েও।’ এ রকম একটি কবিতা লেখার শক্তি কোথা থেকে আসে– মানুষের নির্ভুল চিন্তা যেমন আকাশ থেকে পড়ে না, তেমনি এটিও পাতাল ফেড়ে বের হয়নি। এটি মাওয়ের বিপ্লবী ও সাহিত্য সত্তার মিলিত রূপের বহিঃপ্রকাশ। মাও খুব স্পষ্টভাবে শাড়ি–গয়নার চেয়েও যুদ্ধসাজের শক্তিকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরেছেন। কোনো মহৎ নেতা যখন গেরিলাদের এভাবে উজ্জীবিত করতে পারে, তখন উজ্জীবিত না হয়ে উপায় আছে কী! বড় অভাব, একজন সত্যিকারের লিডারশিপের অভাব! যিনি যুদ্ধসাজকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরতে পারবেন, দৃঢ়ভাবে বলাতে পারবেন– কাঁধে রাইফেল নাও, বুকে সাহস জোগাও; তবেই না বিপ্লবী শক্তি ঘনিভূত হবে।

‘বন্ধুর জবাবে’ কবিতায় লিখেছেন, ‘… প্রতিধ্বনিত হচ্ছে পৃথিবী কাঁপানো গানে গানে/ এবং আমি হারিয়ে গেছি স্বপ্নের ভেতর।’

‘বিদ্রোহী সব মেঘপুঞ্জ’ উড়ে যাচ্ছে পাশ দিয়ে। দ্রুত এবং শান্ত।’ পংক্তিগুলো তাঁরই সৃষ্টি। কী চমৎকার গাঁথুনী শক্তি! সাহিত্যের প্রতি অভাবনীয় ভালোবাসা থাকলেই এ রকম শব্দের ভাণ্ডার তৈরি হয়। যা আবার কলমের খোঁচায় ডায়েরিতে লিখতে পারা যায়। কতটা নির্মল, উদার চিন্তাশক্তি থাকলে যুগ–যুগান্তর ধরে সৃষ্টিশীলতার মধ্য দিয়ে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখা যায়– তাঁর বিস্তর উদাহরণ আমরা ইতিমধ্যে পেয়েছি।

বিপ্লবী নেতা মাও সে–তুঙ ১৯৬৫ সালে শেষ কবিতা লিখেন। এরপর আর কোনো কবিতা তিনি সম্ভবত লিখেননি, অথবা প্রকাশিত হয়নি। তাঁর শেষ কবিতাটি হলো, ‘দুটো পাখি : একটি সংলাপ।’ এটি ১৯৭৬ সালে ‘শিকান’ নামক একটি কবিতা পত্রিকায় প্রথম প্রকাশ হয়। এরপর ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশিত হয় ‘পিকিং রিভিউ’ পত্রিকায়।

বিস্ময় হলেও সত্য, তাঁর কবিতার সাহিত্য মূল্য বিবেচনা করাটাও দুঃসাধ্য কাজ। সমাজ পরিবর্তনে এ সাহিত্য যে ভূমিকা রেখেছে তা এক কথায় অমূল্য। নারী প্রশ্ন, শ্রেণী দৃষ্টিভঙ্গী, বিপ্লবী চেতনা, ছত্রে ছত্রে রূপকের যথার্থ ব্যবহার তার কবিতাকে এক ভিন্ন মাত্রা দিয়েছে।

১৯৭৩ সালের অক্টোবরে প্রকাশিত হয় কমরেড সিরাজ সিকদারের কবিতা সংকলন ‘গণযুদ্ধের পটভূমি’। ওই বইয়ের ভূমিকায় সিরাজ সিকদার লিখেছেন,

‘শিল্প–সংস্কৃতি গড়ে তোলার সময় আমাদের শুধু শ্রেণী সংগ্রামকে তুলে ধরলেই চলবে না, কারণ তা বুর্জোয়া এমন কি বড় বুর্জোয়াদের নিকটও গ্রহণীয়। শ্রেণী সংগ্রামের অনিবার্য পরিণতি সর্বহারাশ্রেণীর একনায়কত্ব (বর্তমানে জনগণের গণতান্ত্রিক একনায়কত্ব ), ইহা প্রতিষ্ঠার জন্য সর্বহারাশ্রেণীর রাজনৈতিক পার্টি, এর নেতৃত্বে সশস্ত্র ও অন্যান্য সংগ্রাম এবং সর্বহারাদের শ্রেণীসংগ্রাম পরিচালনার বৈজ্ঞানিক তাত্ত্বিক ভিত্তি মার্ক্সবাদ–লেনিনবাদ–মাও সে তুং চিন্তাধারা ও তার প্রয়োগ–অনুশীলন শিল্প–সাহিত্য–সংস্কৃতিতে প্রতিফলিত হতে হবে। তখনই এ ধরনের শিল্প–সংস্কৃতির বিষয়বস্তু সর্বহারার বিশ্ব দৃষ্টিকোণ দিয়ে সঠিক বলে বিবেচিত হবে ।…’

‘… বিপ্লবী বিষয়বস্তু ও উচ্চমানের শিল্পরূপের (জনগণ কর্তৃক গ্রহণীয় ও সমাদৃত) একাত্মতা সম্পন্ন সাহিত্য–শিল্প–সংস্কৃতি পূর্ব বাংলার বিপ্লবে মতাদর্শগত প্রস্তুতির সৃষ্টি করবে, বিপ্লবের পক্ষে জনমত সৃষ্টি করবে এবং জনগণকে বিপ্লবী কর্মে উদ্বুদ্ধ করবে।

‘বিপ্লবী শিল্প–সংস্কৃতি নিয়ে চীন–ইন্দোনেশিয়া–ভারত এবং অন্যান্য দেশে ভ্রাতৃপ্রতিম কমরেডগণ পরীক্ষা–নিরীক্ষা করছেন। আমাদেরকেও পূর্ববাংলায় পরীক্ষা–নিরীক্ষা চালাতে হচ্ছে– কারণ বাংলা সাহিত্যে আমাদের সঠিক পথ দেখাবার মতো কোনো উত্তরসূরী নেই। এ কারণে আমাদের বিষয়বস্তু ও শিল্পরূপে দুর্বলতা দেখা দিতে পারে; কিন্তু আমরা গুরুত্ব দেব বিষয়বস্তু অর্থাৎ রাজনীতিতে, আর অনুশীলনের প্রক্রিয়ায় গড়ে উঠবে নিখুঁত শিল্পরূপ।’

কমরেড সিরাজ সিকদারের এ বক্তব্য আজ আরও বেশি প্রাসঙ্গিক। ‘কবিতাসমগ্র মাও সে–তুঙ’ বইটি পড়তে গিয়ে বারবার উপরোক্ত কথাগুলোই নাড়া দিচ্ছিল চিন্তাজগতে। মাও সে–তুঙয়ের যথার্থ উত্তরসূরী কমরেড সিরাজ সিকদার খুব স্পষ্টভাবেই জনগণের শিল্প–সাহিত্যের গুরুত্ব উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন।

উল্লেখ্য, আমাদের দেশের সাধারণ মানুষ এখনো বিভিন্ন কুসংস্কারে আচ্ছন্ন। এগুলো হলো মানুষের ভেতরের শত্রু। অনেক সময় দেখা যায় সাম্রাজ্যবাদের চেয়েও এই শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াই করা বেশি কঠিন। তাই জনগণের কাছে গিয়ে আমাদেরই বলতে হবে তাদের নিরক্ষরতা, কুসংস্কার ও অস্বাস্থ্যকর বদভ্যাসের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করার জন্য। এই সংগ্রামের জন্য যুক্তফ্রন্ট অপরিহার্য।

সাংস্কৃতিক কাজকর্মে যুক্তফ্রন্টের দুটি মূলনীতি হলো– এক. ঐক্যবদ্ধ হওয়া এবং দুই. সমালোচনা করা, শিক্ষা দেওয়া ও রূপান্তরিত করে তোলা। যুক্তফ্রন্টে আত্মসমর্পণ করা ভুল হবে এবং তেমনি নিজেদের বিশিষ্টতা বোধ থেকে ও অন্যদের প্রতি অবজ্ঞার ভাব থেকে সংকীর্ণতাবাদও ভুল হবে। এই রূপান্তরিত সংস্কৃতিকেই মাও সে–তুঙ নয়া–সংস্কৃতি বলে উল্লেখ করেছেন। পুরাতন সংস্কৃতির মধ্যকার প্রতিক্রিয়াশীল অংশ বর্জন করতে হবে, যা সেই পুরনো রাজনীতি ও পুরনো অর্থনীতি থেকে অবিচ্ছেদ্য। ঠিক তেমনি নয়া–সংস্কৃতি, নতুন রাজনীতি ও নতুন অর্থনীতি থেকে অবিচ্ছেদ্য। এই নতুন রাজনীতি হলো– নয়া–গণতন্ত্রের রাজনীতি, নতুন অর্থনীতি হলো– নয়া–গণতন্ত্রের অর্থনীতি। আর নতুন সংস্কৃতি হলো– নয়া–গণতন্ত্রের সংস্কৃতি।

জনগণের সাথে সংযুক্ত হয়ে গভীর সম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে। জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে নতুন সংস্কৃতির বিকাশ ও বিস্তার সম্ভব নয়। কবিতা, শিল্প, সাহিত্যের মাঝে ওই জনগণের উপস্থিতিই গণসাহিত্যের মূল বিষয়। কমরেড মাও সে–তুঙ বলেন,

‘প্রায়ই দেখা যায় বাস্তব দিক থেকে জনসাধারণের একটি পরিবর্তনের প্রয়োজন রয়েছে; কিন্তু ভাবনার দিক থেকে তারা (জনগণ) তখনো ওই প্রয়োজন সম্পর্কে সচেতন হয়ে উঠেনি। এ রকম ক্ষেত্রে, আমাদের ধৈর্য্য ধরে অপেক্ষা করতে হবে। যতক্ষণ আমাদের কাজের মধ্য দিয়ে জনসাধারণের অধিকাংশ এই পরিবর্তনের প্রয়োজন সম্পর্কে ইচ্ছুক হয়ে উঠছে বা ওই পরিবর্তন সাধনে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়ে উঠছে, ততক্ষণ ওই পরিবর্তন নিয়ে আসা আমাদের দিক থেকে উচিত হবে না। অন্যথায় আমরা জনগণ থেকে নিজেদের বিচ্ছিন্ন করে ফেলব। …আমাদের উগ্র হলে চলবে না; উগ্রতা পরিণামে শুধু ব্যর্থতাই ডেকে আনবে। যে কোনো কাজের ক্ষেত্রেই কথাটি সত্য এবং বিশেষ করে যে সাংস্কৃতিক ও শিক্ষাগত কাজকর্মের লক্ষ্য হচ্ছে জনগণের চিন্তাধারায় রূপান্তর নিয়ে আসা, সে ক্ষেত্রে আরও বেশি করে সত্য।’

এ কথার সহজ অর্থ হলো– আমাদের জনগণের সঙ্গে মিশতে হবে, তবেই জনগণের ভাষায়, জনগণের বোধগম্য করে সাহিত্য, কাব্য চর্চা সম্ভব হবে; যেখানে উঠে আসবে জনগণের কথা, মুক্তির বার্তা। মাও সে–তুঙ তাঁর কাব্যে, অথবা রাজনৈতিক সাহিত্যে সে কথাই বিভিন্ন রূপে তুলে ধরেছেন।

যা–ই হোক, একটি বই আলোচনা–পর্যালোচনা মানুষ তখনই করে, যখন সেখান থেকে শেখার মতো কিছু থাকে। এ বইটি আমাকে বেশ সমৃদ্ধ করেছে। কবিতার প্রতি আলাদা মায়াবোধ তৈরি করেছে। সেইসঙ্গে আত্মকেন্দ্রিক সাহিত্যের বিপরীতে সামষ্টিক চিন্তা বা ‘বিপ্লবী তেজসমৃদ্ধ’ কবিতার প্রতি আলাদা অনুরাগ তৈরি হওয়ার জন্য এমন সাহিত্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। আর এ সংকলনটি করার জন্য সম্পাদক ধন্যবাদ পেতে পারেন।

লেখাটি শেষ করছি একটি পংক্তি দিয়ে ‘আঙুলে তুড়ি বাজানোর মতোই গড়িয়ে গেল আটত্রিশ বছর।’ এ পংক্তিতে এটি স্পষ্ট হয় যে, মানব সভ্যতীর দীর্ঘ ইতিহাসে সময় কত দ্রুত চলে যায়; কিন্তু বিপ্লবী দর্শন, আদর্শ একবার জীবনে ব্রত হিসেবে মেনে নিতে পারলে; তা প্রতিনিয়ত মানুষের চিন্তার জগতে আঘাত করে। মার্ক্সবাদী চেতনায় শাণিত হতে তাড়িত করে। আর এ রকম একটি বই সাহিত্যপ্রেমীদের মধ্যে কিছুটা হলেও প্রভাব ফেলুক এই প্রত্যয় ব্যক্ত করছি।

 

লাবণী মণ্ডল: সাহিত্য সমালোচক  ও প্রাবন্ধিক