শামস আল মমীনের কবিতা
কবিতা একটি যুদ্ধ
‘বিজয় দিবস’ কে স্মরণ করে
অনেক রাত্রির ঘুম চোখে মারাত্মক মারানাস্ত্র হাতে
ওসমানপুর থেকে মোসাদ্দেক,
সাহা পাড়া থেকে জগদীশ
প্রায় ছয়ফুট উঁচু আখক্ষেত পার হয়ে দীর্ঘদেহী সোলায়মান
জোনাকির মতো ঝাঁকে ঝাঁকে ঝোপের আড়াল থেকে বেরিয়ে আসে;
ওদের সবার চোখে স্বাধীনতার ঝিলিক।
কবিতা একটি যুদ্ধ, যাকে শর্তহীন ভালাবাসা যায়
আর তাই
আমি এমন কবিতা চাই যে বন্দুক চালাতে পারে
চিপা গলিতে শত্রু পক্ষের সাথে তুমুল ধ্বস্তাধস্তি শেষে
তাকে ধরাশায়ী করতে পারে,
মেঘ বৃষ্টি ঝড়ে
বিদ্যুৎ খুঁটির মতো একরোখা
নিশ্চুপ
দাঁড়িয়ে থাকতে পারে।
কবিতা একটি যুদ্ধ, যা পকেটে রাখা যায়। আর
তাকে ভালবেসে
নতুন পতাকা হাতে সর্ষে ক্ষেতের ভেতর দিয়ে
ছুটতে ছুটতে ছেলেগুলো গেয়ে ওঠে
জয় বাংলা,
একজন ভিখারি শুন্য থালা উচিয়ে বলে,
বুকের ভিতর আজীবন
জয় বাংলা;
এক জোড়া বালিহাঁস কচুরি পানার ভেতর থেকে
উঁকি দিয়ে টুকু দেয়…
জয় বাংলা;
দাউ দাউ পূর্ণিমায়, ঝিঁ ঝিঁ পোকা আর জোনাকীর
উৎসবে এতো সুর করে কে গায়,
জয় বাংলা।
মোটরগাড়ি, সারি সারি
রিক্সা, ঠেলাগাড়ি,
ট্রেনের ছাদে
জামার বোতাম খুলে
যশোর রোডে,
হিলি, বেনাপোলে
ভিড়;
ভিড় বাড়ে
কুমিল্লা, জয়পুরহাটে
গন্জের হাটে
হাট ভাঙা মানুষ ওয়ানব্যান্ড রেডিওতে
কান পেতে
শোনে
ঢাকার খবর কি।
ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিনী
তারামন বিবি,
গাছের গুড়িতে বসে শীত সকালে
রোদ পোহায়
ভাবলেশহীন…
ওরা প্রাণ দিয়ে দেখে উড়ে যাওয়া পাখি, নির্মল আকাশ,
শত্রুহীন মাঠ ঘাট,
বিজয়ের প্রথম হাসি।
আমি চাই, এই কবিতাটি সকলে পড়ুক
জোরে জোরে, কিম্বা
মনে মনে, প্রতিদিন
সকাল সন্ধ্যা।
ইউসুফ মুহম্মদ-এর কবিতা
কতিপয় অন্ধ ও ভাস্কর্য কথা
মোমের আলো ও পিলসুজ দেখে যারা ভয় পায়
তারা ফুলের আঙিনা জুড়ে পাথর ছুঁড়েছে ,
উনিশ’শ একাত্তরে যারা মানুষ হত্যার উৎসব করেছে,
ধর্ষণকে স্বীকৃতি দিয়ে পুরনো পুঁথির দোহাই দিয়েছিল।
মানুষকে আগুনে সেঁকতে দিয়ে
মসজিদের মিনার বেদখল করেছিল,
অন্ধকার ভালোবেসে তারা ফুলের শিল্পিত আঙিনায়
পাথর ছুঁড়েছে। আমি নিরব থেকেছি,
হুমায়ুন আজাদের শব্দশিল্পের টুঁটি চেপে ধরা প্রত্যক্ষ করে
আমি নিশ্চুপ ছিলাম, বাউল-সাধনা ও শিল্পসভায়
খামচি দিয়েছে দেখে কিছুই বলিনি।
বিচারালয়ের সিংহদরজার প্রতীকচিহ্ন
বোরকায় ঢেকে দিতে বলল ,
তাতে সায় দিয়ে আমি কেলিকুঞ্জে বসে
হেসে হেসে শুধু হাততালি সাজিয়েছি।
এসব গোপনে দেখে ভেংচি কেটেছে বানর ও শেয়াল,
সেদিকেও আমি ভ্রূক্ষেপ করিনি,
কেননা তখন আমি ঠক-সমাবেশে
বধিরের সভাপতিত্বে ছিলাম।
আঁধারের সে সব কীটপতঙ্গ সরবে-নিরবে
বাড়তে বাড়তে মাতাল হয়েছে , তারা লাল-সবুজের
ছায়াটুকু কেড়ে নিতে আজ বাড়িয়েছে হাত
ভেঙে চুরমার করেছে জনকের শিল্পময় রূপ।
আমার পতাকা, আমার স্বাধীনতায়
কালো বেড়ালের আধা-চোরা থাবা,
কতিপয় অন্ধ ভূল পুঁথি হাতে নিলে
অমাবস্যায় চাঁদের কিরণ উদিত হবে ভেবে আজ
উলঙ্গ-উল্লাসে নাচে।
যতই নাচুক, আমার এ মাটি আঘাত ফেরাতে জানে ,
উপড়াতে পারে– ভেঙে দিতে জানে বিষধর দাঁত,
আমার পাঁজর কিন্তু আজ ঊন্ হয়ে আছে
অচল হয়েছে শ্বাস, গ্রামবাসী কেউ জেগে আছো?
কেউ জেগে আছো ? শব্দ করছো না কেনো!
স্বাধীনতা শব্দটির তিলকমাটিতে
জামার আস্তিনে যারা লুকোতে চেয়েছে প্রসব বেদনা
তারা একটি শব্দের মাহাত্ম্যের কিনারায় পৌঁছুতে পারেনি—
তজবিহ্তে সিঁদুর মেখে ওজুখানা রক্তরঙ আবিরে মাখায়।
তীর হারা উচ্ছন্ন মানুষ কোদালের দাগ মুছে
সেই মহান শব্দের প্রার্থনায় পথ হেঁটে হেঁটে স্বাক্ষর রেখেছে রক্তে,
একটি ডাকের সন্মোহনে জীবনের রঙধনু জমা রাখে বারুদের কাছে।
খোলা জানালায় চোখ রেখে যারা পৃথিবী দেখার ইচ্ছে রচনা করেনি
উৎসাহ ছিলো না ‘সৃষ্টি সুখের উল্লাসে’,
তারাই কদম ফুলে কালি মেখে ডুগডুগি বাজিয়ে বহন করে…
আজো তো বহন করে বিষধর উত্তরাধিকার।
সেই স্বাধীনতা শব্দটির তিলকমাটিতে
দোয়েল পাখিরা লিখে রাখে কালকূট মানুষের কলঙ্কের ইতিহাস।
তমিজ উদ্ দীন লোদী
আমরা হাঁটতে শুরু করেছিলাম
তারা সবাই সগুম্ফ সচুলো সশস্ত্র
দৃঢ পদক্ষেপে এসে দাঁড়ালো আমাদের উঠোনে
আমাদের উঠোন তখন ভেসে যাচ্ছিল জ্যোৎস্নায়
তাদের ছায়া দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়ে ঝুলে থাকলো কাঁঠাল শাখায়
আমরা তখন সব ভুলে হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলাম ঠাণ্ডা নলে
জানতাম এটিই প্রয়োজনে কিভাবে উত্তপ্ত হয়ে ওঠে
একেকজন গেরিলা একেকজন চেগুয়েভারা
দাঁড়ি ও গোঁফের ফাঁকে হাসি ঝুলে আছে
পেছনে ফেলে এসেছি আগুন ও ছাই
পেছনে ফেলে এসেছি মাটিচাপা লাশের বহর
ফেলে এসেছি সম্ভ্রম , অসংখ্য অজস্র করুণ চিৎকার
শোকের ছায়া প্রতিচ্ছবির মতো ঝুলে আছে দেয়ালে
আমরা শোক ভুলে যাই না , আমরা মৃত্যু ভুলে যাই না
তবু আমাদের মনে হয় এবার দাঁড়াতে হবে
আমাদের ভাঙ্গাচোরা বিধ্বস্ত ভূখণ্ডকে মেরামতে আনতে হবে
মৌলিক কিংবা অন্য কোনো নামে নয়
প্রকৃত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে দেশে
বিজয়কে সামনে রেখে আমরা হাঁটতে শুরু করেছিলাম
সে হাঁটা অব্যাহত আছে ,শুরু হয়েছিল , শেষ হয়নি …
অন্য ভূগোলের গল্প
রিজোয়ান মাহমুদ
সূর্যটা উঠেছে মেঘের জিহ্বা ঘেরা
তাতে আলো নেই
আলোকে আটকে দিয়ে আঁধার কাফনমুখো
যাত্রী – সাদা রঙ ছড়িয়েছে ; এটাই গুহার মুখ
কত-শত পরিব্রাজক এসেছে – যাচ্ছে সহস্র বছর ধরে-
এখানে চেনে না কেউ, যেন পরিচয় লুকানোর চেষ্টা
এই তো বাবার দাঁত একপাটি দাঁতের সুরম্য মাড়ি
মা’র বুকের ক্ষরণ লেপ্টে রয়েছে মাটিতে।
আমার দাদিমা যেন হাঁড় হয়ে শুয়ে আছে সবখানে
এত মাটিপোকা শয়ে শয়ে কালো কালো বিষময়
আদরে জড়ানো হাঁড় অদ্ভুত আদরে মাখামাখি।
এক – একটি দিনের বুনন যেন বা একশো বছর
এবার নতুন কেউ এলে তৈলাধার নিয়েই আসতে বলব – আঁধার মেরামত হবে।
সকলি আয়ান ঘোষ, কেউ কেউ রাধা
নাহার মনিকা
১
ছিটমহলের বুকে মধুভাণ্ড নিয়ে নদী কথা বলে ওঠে
চোখের সামনে ভাসে মমীদের শরীরের বাঁক।
তোমাকেও অমাবস্যা পাক, অন্ধকারে নদীকে জড়াও
পানিপোকা হয়ে নেমে যাও, রত হও মূর্ছা যাও
স্নানের বিরহে। পানির শরীরে গুঁজে প্রলম্বিত কাঁধ
তারপর জেগে ওঠো আহত সম্বিত
কাঁটাতার উলের গোলক হয়ে খুলে যাক পথের কোটরে।
২
অগস্ত্যের ঠগ খেয়ে বিন্ধ্যের কুর্ণিশে স্থির থাকো
বিরহের গানগুলি নিয়ে তোলো আরেক ঝরায়,
‘মফস্বল- মফস্বল’- রাধার শাড়িতে লেখা নাম
হাঁটু গেড়ে করজোড়ে ডাক পড়ে যায়
আয় তবে স্রোতের ওপারে— স্রোতের ধারের কাছে ধারি
জলপোকা দ্বিধা ক’রে বেয়ে যাবে মানভাঙ্গা দাঁড়।
অনুপস্থিতির চেয়ে ধারে মারে কেটে যাওয়া ভালো
অপেক্ষায় অন্ধ হবে, ঝিমিকির চালে দেবে খণ্ড খন্ড আলো।
৩
কী তীব্র সাধ নিয়ে তাকিয়েছো তৃণতুচ্ছ সম্পর্কের দিকে
অথচ এটাই সত্যি, এখানে গভীর কাব্য নাই
আছে নাকি-অনতি গম্ভীর সম্পূরক কথার ইঙ্গিত।
আঙ্গুর রসের দিকে সতৃষ্ণ থাকে না কোন সবুজ মরিচ
তবু বলি,
এই যাত্রা কহতব্য কোন রং, রঙ্গের ভুবন দেখা হলো
ভ্রমণ আর ভ্রমের বাসনা বেহুদাই ঘুরে ফিরে আসে!
ধুলাভরা ভূগোলের ঘর
১
এত গৃহস্থালী আসে আগে আগে,
রকমারী বিষয় আশয়, বড় বৃহত্তর।
খুলে গেল পুতুল খেলার পরম্পরা
কেটে গেল দূরাগত শূন্যতার ভার
পুরুষ্ট স্তনের তাপে মানুষের সুখ—
কেঁপে গেল দৈবাৎ ধুলাভরা ভূগোলের ঘর।
তারপরও আমি আর যাইনি সেখানে
ঐ ঘর, ঘরের পৈথান
তবু কেন আমাকেই নাম লিখে ডাকে!
২
নেহাৎ অভ্যস্থ হাতে আসঙ্গলিপ্সায় ডুবে যাই
নীল চোখে তাপ দিয়ে খোলা বই পাঠ করা যায়
এখন মলাট বন্দী দুপুরের প্রেম, কার কাছে যায়!
আমি তার পিছে পিছে উড়ি। নিহিত বেলুন
থেমে গেলে, বাতাসে আবার যাদুর সন্ধান করি।
কুয়াশায় মোম মাখা উত্তাপ নিয়ে ঘরে আসি
অন্ধকারে ঘর ভর্তি মাটিচাপা শেকড়ের ঘ্রাণ।
লোড শেডিং এর ফল, ত্বকের নিষিদ্ধ আলো জ্বলে ।
নানান যাদুর মধ্যে ঘুরপাক খাই, আমি
ধাঁধার আলোকবাতি সঙ্গে নিয়ে শহর সাঁতরাই।
৩
নিজের নিবিষ্ট বুকে টান দিয়ে ছিঁড়ে ফেলা জলের প্রপাত
শুখা শূণ্যতার সাপ বসে ছিল ভেজা শিরস্ত্রাণে।
এসো আজ সাপের রহস্যগল্প হোক…
কোনোকালে কেউ থাকে, আছে, তবুও
নিঃসঙ্গ আলো ঘিরে রাখে সন্ধ্যাবেলার ফেরীঘাট,
স্বপ্নের গোলকের মসৃণতা নিয়ে।
চারপাশে পলায়নপর আতশবাজির টোপ
অল্প অল্প ক’রে স্বার্থপর সাজায় চিবুক।
ও আমার দিক জাগানিয়া বুক, তবু একা থাকো।
কথা কও তালাবন্ধ সুখের ভেতরে। তীর্থ, ফাঁকিবাজি
বাইরে ঝুলিয়ে রাখা প্রণয়ের রহস্য কুড়াল
নির্বিরোধে কাটো নালিছাড়া সবিনয় সন্ধ্যার কাল।
রক্তহীন কাটাকাটি জড়িয়েছে কোমরের কাছে
সহস্র বছরের শ্বাস নিয়ে একা বাঁচে সেই সাপ ।
হীনাক্ষী পোকাদের নিস্তরঙ্গ গান
১
পাহাড় দেখিনা বলে মনে হয় বিকেলের মর্ম ভুলে গেছি।
পাহাড়ে বিকেল নামে কলস্বরে। সদ্য বিবাহিতা আলো
ক্লান্ত হয়ে হাসে, আধশোয়া আমাদের কোমলাঙ্গী খাটে।
তারপর চোরাই সুগন্ধি মেখে চারপাশে সাহস বিছায়।
উঁচু নীচু ঢেউছাড়া জনপথ, ফিরতে হচ্ছে বলে ফিরি
সমতলে জন্ম দিই বহু ব্যবহৃত নীলগিরি।
বিকেলের সঙ্গী হয়ে ব্রীড়ানম্র প্রেম-পাঠ হয়,
বিশদ দিনের ব্যাখ্যা, টীকাভাষ্যে আলোর পংক্তি উড়ে যায়।
রোদের অন্ধ চোখ সবখানে একই ভাবে তীব্র ও কোমল-
পরিচিত ভুলের সংবাদ উঠে আসে শীর্ষতালিকায়।
প্রখর দিনের খোঁজে রাস্তাঘাট ধ্যানমগ্ন রেখে চলে যাই,
বিকেল তাড়িত চোখ বন্ধ হয় মর্ম গাঁথা পাহাড়ের খোঁজে।
২
বসতবাড়ি ছেড়ে যায় গহীনাক্ষী পোকাদের দল
সেতো রোজ রোজই যায়, ঘর ছাড়ে, বনে যায়
তাদের কথায় অভিবাসী শব্দেরা টুং টাং নাচে,
ঘোর লাগে চোখে আর অন্তরঙ্গ বিষন্নতায়।
ঘোরের পেছনে ঘুরি মন্ত্রমুগ্ধ বেহাল জনতা
একা একা আর কত! যাপনের বেমক্কা কথা
জগৎ কখনো কোন ষড়ঝড় বাঁশীর বাদন!
চোখের গমক নিয়ে থেমে থাকে নদীর কিনার,
কুয়াশা আক্রান্ত চোখে রোয়াবী তারার রাগ দেখি
আমিও তো যেতে চাই, ঘর ছেড়ে, অনভ্যাস ছেড়ে
তুলোয় মুড়িয়ে নিয়ে আমুল সাগর,
পিষ্ট হয়ে ডুবে যাই দুখপাঠ্য রহস্যের কোনা!
গহীনাক্ষী পোকাদের নিস্তরঙ্গ গান
খালি খালি আমাকেও ঘর ছাড়া ছাড়া করে।
৩
কথায় অনাসক্ত হতে দূরে সরে গেছি
মাত্রা থেকে উঠে এসে সোনালু লতার শীষ
বিকশিত প্রশ্নের জামা দিয়ে ঢাকে বাহুমূল
বিচ্ছেদ সংক্রান্ত ভাষা বুকের প্রকোষ্ঠে জমা হয়।
কথায় আসক্ত হয়ে কাছে ফিরে আসি
কাছে থাকি, না ছেড়েও দূরের গন্তব্য ডাকে প্রতি ভোর বেলা,
ঘুমের ঘড়ির কাছে সমর্পিত একজন জেগে উঠি, আরেক মানুষ ।
সমস্ত শহর জুড়ে শব্দের ইকেবানা নাচে
দূরের ভ্রমণ থেকে পিছ-দৌড়ে জয়ী হয়ে ফিরে আসি কাছে।
আমার স্বাধীনতা
রওনক আফরোজ
কেউ শিখিয়ে দেয়নি, নির্দেশও না
তবুও বুঝেছিলাম চুপচাপ থাকাই শ্রেয়,
অন্য অর্থে
হজম করে যাওয়া, মানে দাঁড়িয়ে থাকবো অথচ মাথা থাকবে নত
ইঙ্গিত, অভিজ্ঞতা, গর্ব, সত্য এদের সবাই নিয়েছে মৌনব্রত।
মুখ খুললেই তপ্ত গ্রীষ্মে সাহারার ঝাঁঝাঁ বালুঝড়ে
পুড়ে যাবে খুনির কালো হাত, নেতার স্নায়ু, ধর্ষকের অণ্ডকোষ ;
সবাই জানে কার পিঠ কে চুলকায়, কার হাত টেবিলের তলে,
কে অস্ত্র চালায়; তবু আমারই দোষ।
আমি পরনির্ভরশীল নারী কোথাও আমার স্বাধীনতা নাই
আমি আত্মনির্ভরশীল, সংসারে আমার স্বাধীনতা নাই
চরভাসা, কপর্দকহীন, নিরন্ন, নিরস্ত্র আমার স্বাধীনতা নাই,
আমি পক্ষের বিপক্ষে আমার স্বাধীনতা নাই।
তখনও স্বাধীনতার দাবী ছিল অপরাধ, অবিশ্বাস্য হলেও এখনও তেমনটাই,
মাঝেমাঝে নড়িচড়ি, আবার কিছুটা পিছু হটি
চিড়িয়াখানার পশুর মতো নির্বীজ, উদাসীন থাকি
আপাতঃ নির্ভাবনায়।
আমি যুদ্ধবাজ নই;
সেজন্যই বলে রাখছি, একবারই অনেক, বারবার নয়,
এনাকন্ডার মতো সর্বাংশে গিলে নেবো যদি আবার হাত দাও আমার স্বাধীনতায়।
ডিসেম্বর ১১, ২০২১
সাদাত সায়েম
নিখোঁজ মুক্তিযোদ্ধা
যে কিশোর যুদ্ধ শেষে
বাড়ি ফিরে এলো না
তার মা বলেছিল:
সে আর ফিরবে না
এই কথাটা বলো না
বরং তুমিও অপেক্ষা কর!
তারপর থেকে আমিও
প্রতীক্ষারত
তার প্রায়ান্ধ মায়ের মতো
চিরকুট
চিরকুটটা যে কোথায় রেখেছি, শার্টের পকেটে নাকি প্যান্টের পকেটে, নাকি হারিয়ে ফেলেছি একদম মনে করতে পারছি না! শুধু মনে আছে মা দিয়েছিল আমার জন্মলগ্নে আর বলেছিল: আমার আরও দুটি চোখ হলো। বাবাও তাই ভাবতো। তবে জগৎটাকে আমি আমার চোখেই দেখছি। চিরকুটটা এখনও খুঁজছি!
দুটি কবিতা
পুলক বড়ুয়া
দেশ-কাল-পাত্র
(১)
দিনগুলি ছিল
জায়গাগুলি ছিল
নির্ভুল ।
দিনগুলি আছে
জায়গাগুলি আছে
বিলকুল।
(২)
দিনগুলি ছিল
জায়গাগুলি ছিল
ঝাঁক ঝাঁক ।
দিনগুলি আছে
জায়গাগুলি আছে
ঠিকঠাক।
(৩)
দিনগুলি কই
জায়গাগুলি কই
ছিল অই ।
দিনগুলি খুঁজি
জায়গাগুলি খুঁজি
পই পই !
অবিকল্প
একদিন জাগব না
একদিন জানব না
একদিন দ্যাখব না
পথহীন পথিক হব
পদচিহ্নহীন পথিক হব
যে পথ পথ নয়
যে পথ একমুখী
যেখানে বসে থাকে না কেউ
যেখানে অপেক্ষা করে নেই কেউ
তবু যাব, ওখানেই …
এমন অন্ধ হয়ে যাব
এত অজ্ঞান হয়ে যাব
যোগ থেকে বিয়োগ হয়ে যাব
গুণ আর ভাগের হিস্যা তোমরাই কর
অনুপাত কত, জানি না
শতকরা কত, জানি না …
সরল অংকও দ্যাখেছি জটিল না-হলেও সরল নয়
সমীকরণ কিংবা সমাধানও জানি না
সুদাসল থেকে সুধাই পেয়েছি, আসল তেমনি আছে
তার
কায়াহীন কায়া
ছায়াময় ছায়া
মায়াবী মায়া
আজও আসা-যাওয়া করে
আজও ঘোরাফেরা করে
মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়
জেগে থাকা আর অপেক্ষা
জেগে থাকা আর ঘুম
সমার্থক শব্দ হয়ে যায়
প্রতিশব্দ হয়ে দাঁড়ায়
জেগে থাকা মানে একা থাকা
জেগে থাকা মানে একা হওয়া
জেগে থাকা মানে
মানের ঊর্ধ্বক্রম
গাণিতিক সোজা ক্রমিক—শূন্য, এক …
জেগে থাকা মানে
মানের অধক্রম
গাণিতিক উল্টো ক্রমিক—এক, শূন্য …
অতঃপর নেই হওয়া
অতঃপর গুম হয়ে যাওয়া
অতঃপর ঘুম হয়ে যাওয়া
গুমের সমসমান হওয়া
ঘুমের সমান্তরাল হওয়া
সমান সমানই প্রামাণ্য অন্তরাল থাকা
অন্তর্গত হয়ে যাওয়া।